হুমায়ূন আহমেদ

ভয় : জিন-কফিল

নেত্রকোণা শহরের বিশিষ্ট মোক্তার মমতাজউদ্দিন সাহেবের বাড়িতে তখন আমি থাকি। ওনার সঙ্গে আমার কোনো আত্মীয়সম্পর্ক নাই। লোকমুখে শুনেছিলাম — বিশিষ্ট ভদ্রলোক। কেউ কোনো বিপদে পড়ে তাঁর কাছে গেলে তিনি যথাসাধ্য করেন। আমার তখন মহাবিপদ। এক বেলা খাই তো এক বেলা উপোস দেই। সাহসে ভর করে তাঁর কাছে গেলাম চাকরির জন্য। উনি বললেন, ‘চাকরি যে দিব, পড়াশোনা কী জানো?’

আমি বললাম, ‘উলা পাস করছি।’

উনি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘মাদ্রাসা পাস করা লোক, তোমারে আমি কী চাকরি দিব! আই.এ., বি.এ. পাস থাকলে কথা ছিল। চেষ্টাচরিত্র করে দেখতাম। চেষ্টা করারও তো কিছু নাই।’

আমি চুপ করে রইলাম। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। বড় আশা ছিল কিছু হবে। একটা পয়সা সঙ্গে নাই। উপোস দিচ্ছি। রাতে নেত্রকোণা স্টেশনে ঘুমাই।

মমতাজ সাহেব বললেন, ‘তোমাকে চাকরি দেওয়া সম্ভব না। নেও, এই বিশটা টাকা রাখ। অন্য কারো কাছে যাও। মসজিদে খোঁজটোজ নাও—ইমামতি পাও কি না দেখ।’

আমি টাকাটা নিলাম। তারপর বললাম, ‘ভিক্ষা নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। ঘরের কোনো কাজকর্ম থাকে বলেন, করে দেই।’

তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘কী কাজ করতে চাও?’

‘যা বলবেন করব। বাগানের ঘাসগুলো তুলে দেই?’

‘আচ্ছা দাও?’

আমি বাগান পরিষ্কার করে দিলাম। গাছগুলোতে পানি দিলাম। দু’-এক জায়গায় মাটি কুপিয়ে দিলাম। সন্ধ্যাবেলা কাজ শেষ করে বললাম, ‘জনাব যাই। আপনার অনেক মেহেরবানী। আল্লাহ্‌পাকের দরবারে আমি আপনার জন্য দোয়া করি।’

মমতাজ সাহেব বললেন, ‘এখন যাবে কোথায়?’

‘ইস্টিশনে। রাত্রে নেত্রকোণা ইস্টিশনে আমি ঘুমাই।’

‘এক কাজ কর। রাতটা এইখানেই থাক। তারপর দেখি।’

আমি থেকে গেলাম।

এক দিন দুই দিন তিন দিন চলে গেল। উনি কিছু বলেন না। আমিও কিছু বলি না। বাংলাঘরের এক কোণায় থাকি। বাগান দেখাশোনা করি। চাকরির সন্ধান করি। ছোট শহর, আমার কোনো চিনা-পরিচয়ও নাই। কে দেবে চাকরি? ঘুরাঘুরি সার হয়। মোক্তার সাহেবের সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখা হয়। আমি বড়ই শরমিন্দা বোধ করি। উনিও এমন ভাব করেন যেন আমাকে চেনেন না। মাসখানেক এইভাবে চলে গেল। আমি মোটামুটি তাঁদের পরিবারের একজন হয়ে গেলাম। মোক্তার সাহেবের স্ত্রীকে মা ডাকি। ভেতরের বাড়িতে খেতে যাই। তাঁদের কোনো-একটা উপকার করার সুযোগ পেলে প্রাণপণে করার চেষ্টা করি। বাজার করে দেই। কল থেকে পানি তুলে দেই।

মোক্তার সাহেবের তিন মেয়ে। বড় মেয়ে বিধবা হয়ে বাবার সঙ্গে আছে। তার দুই বাচ্চাকে আমি আমপারা পড়াই। বাজার-সদাই করে দেই। টিপকল থেকে রোজ ছয়-সাত বালতি পানি তুলে দেই। মোক্তার সাহেবের কাছে যখন মক্কেলরা আসে, তিনি ঘনঘন তামাক খান। সেই তামাকও আমি সেজে দেই। চাকরবাকরের কাজ। আমি আনন্দের সঙ্গেই করি। মাঝে-মাঝে মনটা খুবই খারাপ হয়। দরজা বন্ধ করে একমনে কোরান শরিফ পড়ি। আল্লাহ্‌পাকরে ডেকে বলি—হে আল্লাহ্, আমার একটা উপায় করে দাও। কতদিন আর মানুষের বাড়িতে অন্নদাস হয়ে থাকব?

আল্লাহ্‌পাক মুখ তুলে তাকালেন। সিদ্দিকুর রহমান সাহেব বলে এক ব্যবসায়ী বলতে গেলে সেধে আমাকে চাকরি দিয়ে দিলেন। চালের আড়তে হিসাবপত্র রাখা। মাসিক বেতন পাঁচ শ’ টাকা।

মোক্তার সাহেবকে সালাম করে খবরটা দিলাম। উনি খুবই খুশি হলেন। বললেন, ‘তোমাকে অনেকদিন ধরে দেখতেছি। তুমি সৎ স্বভাবের মানুষ। ঠিকমতো কাজ কর, তোমার আয়-উন্নতি হবে। আর রাতে তুমি আমার বাড়িতেই থাক। তোমার কোনো অসুবিধা নাই। খাওয়াদাওয়াও এইখানেই করবে। তোমাকে আমি ঘরের ছেলের মতোই দেখি।’

আনন্দে মনটা ভরে গেল। চোখে পানি এসে গেল। আমি মোক্তার সাহেবের কথামতো তাঁর বাড়িতেই থাকতে লাগলাম। ইচ্ছা করলে চালের আড়তে থাকতে পারতাম। মন টানল না। তা ছাড়া মোক্তার সাহেবের বাগানটা নিজের হাতে তৈরি করেছি। দিনের মধ্যে কিছুটা সময় বাগানে না থাকলে খুব অস্থির-অস্থির লাগে।

একমাস চাকরির পর প্রথম বেতন পেলাম। পাঁচ শ’ টাকার বদলে সিদ্দিকুর রহমান সাহেব ছ’ শ’ টাকা দিয়ে বললেন, ‘তোমার কাজকর্ম ভালো। এইভাবে কাজকর্ম করলে বেতন আরো বাড়িয়ে দিব।’

আমার মনে বড় আনন্দ হল। আমি তখন একটা কাজ করলাম। পাগলামিও বলতে পারেন। বেতনের সব টাকা খরচ করে মোক্তার সাহেবের স্ত্রী এবং তাঁর তিন মেয়ের জন্য চারটা শাড়ি কিনে ফেললাম। টাঙ্গাইলের সুতি শাড়ি। মোক্তার সহেবের জন্য একটা খদ্দরের চাদর।

মোক্তার সহেবের স্ত্রী বললেন, ‘তোমার কি মাথাটা খারাপ? এইটা তুমি কী করলা? বেতনের প্রথম টাকা—তুমি তোমার আত্মীয়স্বজনের জন্য জিনিস কিনবা, বাড়িতে টাকা পাঠাইবা।’

আমি বললাম, ‘মা, আমার আত্মীয়স্বজন কেউ নাই। আপনারাই আমার আত্মীয়স্বজন।’

তিনি খুবই অবাক হয়ে বললেন, ‘কই, কোনোদিন তো কিছু বল নাই!’

‘আপনি জিজ্ঞেস করেন নাই—এই জন্য বলি নাই। আমার বাবা-মা খুব ছোটবেলায় মারা গেছেন। আমি মানুষ হয়েছি এতিমখানায়। এতিমখানা থেকেই উলা পাস করেছি।’

উনি আমার কথায় মনে খুব কষ্ট পেলেন। উনার মনটা ছিল পানির মতো। সবসময় টলটল করে। উনি বললেন, ‘কিছু মনে নিও না। আমার আগেই জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। তুমি আমারে মা ডাক আর আমি তোমার সম্পর্কে কিছুই জানি না—এইটা খুবই অন্যায় কথা। আমার খুব অন্যায় হইছে।’

তিনি তাঁর তিন মেয়েরে ডেকে বললেন, ‘তোমরা এরে আইজ থাইক্যা নিজের ভাইয়ের মতো দেখবা। মনে করবা তোমরার এক ভাই। তার সামনে পর্দা করার দরকার নাই।’

এর মধ্যে একটা বিশেষ জরুরি কথা বলতে ভুলে গেছি—মোক্তার সাহেবের ছোটো মেয়ে লতিফার কথা। এই মেয়েটা পরীর মতো সুন্দর। একটু পাগল ধরনের। নিজের মনে কথা বলে। নিজের মনে হাসে। যখন-তখন বাংলা-ঘরে চলে আসে। আমার সঙ্গে দুই-একটা টুকটাক কথাও বলে। অদ্ভুত সব কথা। একদিন এসে বলল, ‘এই যে মৌলানা সাব, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে আসছি। আচ্ছা বলেন তো—শয়তান পুরুষ না মেয়েছেলে?’

আমি বললাম, ‘শয়তান পুরুষ।’

লতিফা বলল, ‘আল্লা মেয়ে-শয়তান তৈরি করেন নাই কেন?’

আমি বললাম, ‘তা তো জানি না। আল্লাহ্‌পাকের ইচ্ছার খবর কেমনে জানব? আমি অতি তুচ্ছ মানুষ।’

‘কিন্তু শয়তান যে পুরুষ তা আপনি জানেন?’

‘জানি।’

‘আপনে ভুল জানেন। শয়তান পুরুষও না স্ত্রীও না। শয়তান আলাদা এক জাত।’ আমি মেয়েটার বুদ্ধি দেখে খুবই অবাক হই। এই রকম সে প্রায়ই করে। একদিনের কথা। ছুটির দিন। দুপুর বেলা। বাংলাঘরে আমি ঘুমাচ্ছি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। অবাক হয়ে দেখি, লতিফা আমার ঘরে। আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। লতিফা বলল, ‘আপনেরে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করতে আসছি। আচ্ছা বলেন তো—

হেন কোন গাছ আছে এ-ধরায়

স্থলে জলে কভু তাহা নাহি জন্মায়।’

আমি ধাঁধার জবাব না-দিয়ে বললাম, ‘তুমি কখন আসছ?’

লতিফা বলল, ‘অনেকক্ষণ হইছে আসছি। আপনে ঘুমাইতেছিলেন, আপনারে জাগাই নাই। এখন বলেন— ধাঁধার উত্তর দেন,

হেন কোন গাছ আছে এ-ধরায়

স্থলে জলে কভু তাহা নাহি জন্মায়।’

আমি বললাম, ‘এইটার উত্তর জানা নাই।’

‘উত্তর খুব সোজা। উত্তর হইল—পরগাছা। আচ্ছা আরেকটা ধরি বলেন দেখি—

পাকলে খেতে চায় না, কাঁচা খেতে চায়

এ কেমন ফল বল তো আমায়?’

মেয়েটার কাণ্ডকারখানায় আমার ভয়ভয় লাগতে লাগল। কেন সে এই রকম করে? কেন বারবার আমার ঘরে আসে? লোকের চোখে পড়লে নানান কথা রটবে। মেয়ে যত সুন্দর তারে নিয়া রটনাও তত বেশি।

লতিফা আমার বিছানায় বসতে বসতে বলল, ‘কই, বলেন এটার উত্তর কি—

পাকলে খেতে চায় না, কাঁচা খেতে চায়

এ কেমন ফল বল তো আমায়?

বলতে পারলেন না! এটা হল—শশা। পাকা শশা কেউ খায় না। সবাই কাঁচা শশা চায়। আচ্ছা আপনার বুদ্ধি এত কম কেন? একটাও পারেন না। আপনি একটা ধাঁধা ধরেন আমি সঙ্গে-সঙ্গে বলে দেব।’

‘আমি ধাঁধা জানি না লতিফা।’

‘আপনি কী জানেন? শুধু আল্লাহ্-আল্লাহ্ করতে জানেন, আর কিছু জানেন?’

‘লতিফা, তুমি এখন ঘরে যাও।’

‘ঘরেই তো আছি। এইটা ঘর না? এইটা কি বাহির?’

‘যখন-তখন তুমি আমার ঘরে আস—এটা ঠিক না।’

‘ঠিক না কেন? আপনি কি বাঘ না ভালুক?’

আমি চুপ করে রইলাম। আধা-পাগল এই মেয়েকে আমি কী বলব? এই মেয়ে একদিন নিজে বিপদে পড়বে, আমাকেও বিপদে ফেলবে। লতিফা বলল, ‘আমি যে মাঝেমধ্যে আপনার এখানে আসি—সেইটা আপনার ভালো লাগে না—ঠিক না?’

‘হ্যাঁ, ঠিক।’

‘ভালো লাগে না কেন?’

‘নানান জনে নানান কথা বলতে পারে।’

‘কী কথা বলতে পারে? আপনার সঙ্গে আমার ভালবাসা হয়ে গেছে? চুপ করে আছেন কেন, বলেন।’

‘তুমি এখন যাও লতিফা।’

‘আচ্ছা যাই। কিন্তু আমি আবার আসব। রাত-দুপুরে আসব। তখন দেখবেন— কী বিপদ!’

‘কেন এই রকম করতেছ লতিফা?’

লতিফা উঠে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে বলল, ‘যে ভয় পায় তাকে ভয় দেখাতে আমার ভালো লাগে। এইজন্যে এরকম করি। আচ্ছা মৌলানা সাহেব, যাই। আসসালামু আলায়কুম। ওয়া রহমাতুল্লাহে ওয়া বরকাতুহু। হি—হি—হি।’

ভাই, আপনার কাছে সত্য কথা গোপন করব না। সত্য গোপন করা বিরাট অন্যায়। আল্লাহ্‌পাক সত্য গোপনকারীকে পছন্দ করেন না। চাকরি পাওয়ার পরেও আমি মোক্তার সাহেবের বাড়িতে থেকে গেলাম শুধু লতিফার জন্য। তারে দেখার জন্য মনটা ছটফট করত। মনে-মনে অপেক্ষা করতাম কোন সময় তারে একনজর হলেও দেখব। তার পায়ের শব্দ শুনলেও বুক ধড়ফড় করত। রাত্রে ভালো ঘুম হত না। শুধু লতিফার কথা ভাবতাম। বলতে খুব শরম লাগছে ভাই-সাব, তবু বলি—লতিফার চুলের একটা কাঁটা আমি সবসময় আমার সঙ্গে রাখতাম। আমার কাছে মনে হত–এইটা চুলের কাঁটা না, সাত রাজার ধন। আমি আল্লাহ্‌পাকের দরবারে কান্নাকাটি করতাম। বলতাম—হে পরোয়ারদিগার, হে গাফুরুর রহিম, তুমি আমাকে একি বিপদে ফেললা। তুমি আমারে উদ্ধার কর।’

আল্লাহ্‌পাক আমাকে উদ্ধার করলেন। লতিফার বিবাহের প্রস্তাব আসল। ছেলে এম.বি.বি. এস. ডাক্তার। বাড়ি গৌরীপুর। ভালো বংশ। খান্দানি পরিবার। ছেলে নিজে এসে মেয়ে দেখে গেল। মেয়ে তার খুব পছন্দ হল। পছন্দ না-হওয়ার কোনো কারণ নাই। লতিফার মতো রূপবতী মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না। ছেলেও দেখতে শুনতে ভালো। শুধু গায়ের রঙটা একটু ময়লা। কথায়বার্তায়ও ছেলে অতি ভদ্র। বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে গেল। বারই শ্রাবণ। শুক্রবার দিবাগত রাত্রে বিবাহ পড়ানো হবে।

আমার মনটা বড়ই খারাপ হয়ে গেল। আমি জানি, এই মেয়ের সঙ্গে আমার বিবাহের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কোথায় সে আর কোথায় আমি। চাকরশ্রেণীর আশ্রিত একজন মানুষ। জমিজমা নাই, আত্মীয়স্বজন নাই, সহায়-সম্বল নাই। তার জন্য আমি কোনোদিন আফসোস করি নাই। আল্লাহ্‌পাক যাকে যা দেন তাই নিয়াই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আমিও ছিলাম। কিন্তু যে-দিন লতিফার বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে গেল সে-দিন কী যে কষ্ট লাগল বলে আপনাকে বুঝাতে পারব না। সারা রাত শহরের পথে-পথে ঘুরলাম। জীবনে কোনোদিন নামাজ কাজা করি নাই—এই প্রথম এশার নামাজ কাজা করলাম। ফজরের নামাজ কাজা করলাম। এত দিন পরে বলতে লজ্জা লাগছে— আমার প্রায় মাথা খারাপের মতো হয়ে গিয়েছিল। ভোরবেলা মোক্তার সাহেবের বাসায় গেলাম। সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। এইখানে আর থাকব না। বাজারে চালের আড়তে থাকব। মোক্তার সাহেবের স্ত্রী বললেন, ‘এখন যাবে কেন বাবা? মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। কত কাজকর্ম। কাজকর্ম শেষ করে তারপর যাও।’

আমি মিথ্যা কথা বলি না। প্রথম মিথ্যা বললাম। আমি বললাম, ‘মা, সিদ্দিকুর রহমান সাহেব আমাকে আজই দোকানে গিয়ে উঠতে বলেছেন—উনি আমার মনিব—অন্নদাতা। ওনার কথা না রাখলে অন্যায় হবে। বিয়ের সময় আমি চলে আসব। কাজকর্মের কোনো অসুবিধা হবে না, মা।’

সবার কাছ থেকেই বিদায় নিলাম। লতিফার কাছ থেকে বিদায় নিতে পারলাম না। সে যখন সামনে এসে দাঁড়াল তখন চোখ তুলে তার দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারলাম না।

লতিফা বলল, ‘চলে যাচ্ছেন?’

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’

‘কেন, আমরা কি কোনো দোষ করেছি?’

‘ছি ছি—দোষ করবে কেন?’

‘আচ্ছা, যাওয়ার আগে এই ধাঁধাটা ভাঙায়ে দিয়ে যান—বলেন দেখি—’ঃ

‘ছাই ছাড়া শোয় না;

লাথি ছাড়া উঠে না। এই জিনিস কি?’

‘জানি না লতিফা।’

‘এত সহজ জিনিস পারলেন না। এটা হল কুকুর। আচ্ছা যান। দোষঘাট হলে ক্ষমা করে দিয়েন।’

আমি আড়তে চলে আসলাম। রাত আটটার দিকে মোক্তার সাহেব লোক পাঠিয়ে আমাকে ডাকিয়ে নিয়ে গেলেন। তিনি শোবার ঘরে চেয়ারে বসে ছিলেন। আমাকে সেইখানে নিয়ে যাওয়া হল। আমি খুবই অবাক হলাম। একটু ভয়ভয়ও করতে লাগল। তাকিয়ে দেখি মোক্তার সাহেবের স্ত্রী খাটে বসে আছেন। নিঃশব্দে কাঁদছেন। আমি কিছুই বুঝলাম না। বুক ধড়ফড় করতে লাগল। না জানি কী হয়েছে।

মোক্তার সাহেব বললেন, ‘তোমাকে আমি পুত্রের মতো স্নেহ করেছি। তার বদলে তুমি এই করলে? দুধ দিয়ে কালসাপ পোষার কথা শুধু শুনেছি। আজ নিজের চোখে দেখলাম।’

আমি মোক্তার সাহেবের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘মা, আমি কিছুই বুঝতেছি না।’

মোক্তার সাহেব চাপা স্বরে বললেন, ‘বোকা সাজার দরকার নাই। বোকা সাজবা না। তুমি যা করেছ তা তুমি ভালোই জান। তুমি পথের কুকুরেরও অধম।’

আমি বললাম, ‘আমার কী অপরাধ দয়া করে বলেন।’

মোক্তার সাহেব রাগে কাঁপতে-কাঁপতে বললেন, ‘মেথরপট্টিতে যে শুয়োর থাকে তুই তার চেয়েও অধম—তুই নর্দমার ময়লা।’ বলতে-বলতে তিনিও কেঁদে ফেললেন।

মোক্তার সাহেবের স্ত্রী বললেন, ‘লতিফা সবই আমাদের বলেছে—কিছুই লুকায় নাই। এখন এই অপমান এই লজ্জার হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় লতিফার সঙ্গে তোমার বিবাহ দেওয়া। তুমি তাতে রাজি আছ, না মেয়ের সর্বনাশ করে পালানোই তোমার ইচ্ছা?’

আমি বললাম, ‘মা, আপনি কী বলছেন, আমি কিছুই বুঝতে পারতেছি না। লতিফা কী বলেছে আমি জানি না। তবে আপনারা যা বলবেন—আমি তা-ই করব। আল্লাহ্‌পাক উপরে আছেন। তিনি সব জানেন, আমি কোনো অন্যায় করি নাই মা।’

মোক্তার সাহেব চিৎকার করে বললেন, ‘চুপ থাক্, শুয়োরের বাচ্চা। চুপ থাক।’

সেই রাতেই কাজী ডাকিয়ে বিয়ে পড়ানো হল। বাসর রাতে লতিফা বলল, ‘আমি একটা অন্যায় করেছি—আপনার সাথে যেন বিবাহ হয় এই জন্য বাবা-মাকে মিথ্যা করে বলেছি—আমার পেটে সন্তান আছে। বিরাট অপরাধ করেছি, আপনার কাছে ক্ষমা চাই।’

আমি বললাম, ‘লতিফা, আমি তোমার অপরাধ ক্ষমা করলাম। তুমি আল্লাহ্‌পাকের কাছে ক্ষমা চাও।’

‘আপনি ক্ষমা করলেই আল্লাহ্ ক্ষমা করবেন। তা ছাড়া আমি তেমন বড় অপরাধ তো করি নাই। সামান্য মিথ্যা বলেছি। আপনাকে বিবাহ করার জন্য অনেক বড় অপরাধ করার জন্যও আমি তৈরি ছিলাম। আচ্ছা এখন বলেন এই ধাঁধাটির মানে কি—

আমার একটা পাখি আছে

যা দেই সে খায়।

কিছুতেই মরে না

পাখি জলে মারা যায়।’

বুঝলেন ভাইসাহেব, আনন্দে আমার চোখে পানি এসে গেল। এই আনন্দের কোনো সীমা নাই! আমার মতো নাদান মানুষের জন্য আল্লাহ্‌পাক এত আনন্দ রেখে দিয়েছেন আমি কল্পনাও করি নাই। আমি কত বার যে বললাম, আল্লাহ্‌পাক, আমি তোমার নেয়ামত স্বীকার করি। আমি তোমার নেয়ামত স্বীকার করি।

বিয়ের পর আমি শ্বশুরবাড়িতেই থেকে গেলাম। আমার এবং লতিফার বড় দুঃখের সময় কাটতে লাগল। শ্বশুরবাড়ির কেউ আমাদের দেখতে পারে না। খুবই খারাপ ব্যবহার করে। আমার শাশুড়ি দিন-রাত লতিফাকে অভিশাপ দেন— ‘মর, মর, তুই মর।’

আমার শ্বশুরসাহেব একদিন আমাকে ডেকে বললেন, ‘সকালবেলায় তুমি আমার সামনে আসবা না। সকালবেলায় তোমার মুখ দেখলে আমার দিন খারাপ যায়।’

শ্বশুরবাড়ির কেউ আমার সঙ্গে কথা বলে না। তারা একসঙ্গে খেতে বসে। সেখানে আমার যাওয়া নিষেধ। সবার খাওয়াদাওয়া শেষ হলে লতিফা থালায় করে আমার জন্য ভাত নিয়ে আসে। সেই ভাত আমার গলা দিয়ে নামতে চায় না।

লতিফা রোজ বলে, ‘চল, অন্য কোথাও যাই গিয়া।’

আমি চুপ করে থাকি। কই যাব বলেন? আমার কি যাওয়ার জায়গা আছে? যাওয়ার কোনো জায়গা নাই। লতিফা খুব কান্নাকাটি করে।

একদিন খুব অপমানের মধ্যে পড়লাম। আমার শ্বশুরসাহেবের পাঞ্জাবির পকেট থেকে এক হাজার টাকা চুরি গেছে। তিনি আমারে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘এই যে দাড়িওয়ালা, তুমি কি আমার টাকা নিছ?’

আমার চোখে পানি এসে গেল। এ কী অপমানের কথা! আমি দরিদ্র। আমার যাওয়ার জায়গা নাই—সবই সত্য, কিন্তু তাই বলে আমি কি চোর? ছিঃ ছিঃ।

শ্বশুরসাহেব বললেন, ‘কথা বল না কেন?’

আমি বললাম, ‘আমারে অপমান কইরেন না। যত ছোটই হই, আমি আপনার কন্যার স্বামী।’

শ্বশুরসাহেব বললেন, ‘চুপ। চোর আবার ধর্মের কথা বলে!’

লতিফা সেইদিন থেকে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিল। সে বলল—এই বাড়ির ভাত সে মুখে দিবে না।

আমার শাশুড়ি বললেন, ‘ঢং করিস না। এই বাড়ির ভাত ছাড়া তুই ভাত পাইবি কই?’

দুই দিন দুই রাত গেল, লতিফা পানি ছাড়া কিছুই মুখে দেয় না। আমারে বলে, ‘তুমি আমারে অন্য কোথাও নিয়া চল। দরকার হইলে গাছতলায় নিয়া চল। এই বাড়ির ভাত আমি মুখে দিব না।’

আমি মহা বিপদে পড়লাম।

সারা রাত আল্লাহরে ডাকলাম। ফজরের নামাজের শেষে আল্লাহ্‌পাকের দরবারে হাত উঠায়ে বললাম—হে মাবুদ। হে পাক পরোয়ারদিগার—তুমি ছাড়া আমি কার কাছে যাব? আমার দুঃখের কথা কারে বলব? কে আছে আমার? তুমি আমারে বিপদ থাইক্যা বাঁচাও।

আল্লাহ্‌পাক আমার প্রার্থনা শুনলেন।

ভোরবেলায় চালের আড়তে গিয়েছি। সিদ্দিকুর রহমান সাহেব আমারে ডেকে বললেন, ‘এই যে মৌলানা, আমার একটা উপকার করতে পারবে?’

আমি বললাম, ‘জ্বি জনাব, বলেন।’

‘ময়মনসিংহ শহরে আমি নতুন বাড়ি করেছি। এখন থেকে ঐ বাড়িতে থাকব। সপ্তাহে-সপ্তাহে এইখানে আসব। নেত্রকোণায় আমার যে-বাড়ি আছে—তুমি কি এই বাড়িতে থাকতে পারবে? নেত্রকোণার বাড়ি আমি বিক্রি করতে চাই না। শুনলাম তুমি বিবাহ করেছ—তুমি এবং তোমার স্ত্রী দু’ জন মিলে থাক।’

আমি বললাম, ‘জনাব, আমি অবশ্যই থাকব।’

‘তা হলে তুমি এক কাজ কর, আজকেই চলে আস। একতলার কয়েকটা ঘর নিয়ে তুমি থাক। দোতলার ঘর তালাবন্ধ থাকুক।’

‘জ্বি আচ্ছা।’

‘বাড়িটা শহর থেকে দূরে। তবে ভয়ের কিছু নেই, একজন দারোয়ান আছে। চব্বিশ ঘণ্টা থাকবে। দারোয়ানের নাম বলরাম। ভালো লোক।’

‘জনাব, আমি আজকেই উঠব।’

সেইদিন বিকালেই সিদ্দিক সাহেবের বাড়িতে গিয়া উঠলাম। বিরাট বাড়ি। বাড়ির নাম ‘সরজুবালা হাউস।’ হিন্দু বাড়ি ছিল। সিদ্দিক সাহেবের বাবা কিনে নিয়েছিলেন।

আট ইঞ্চি ইটের দেয়ালে বাড়ির চারদিক ঘেরা। দোতলা পাকা দালান। বিরাট বড় বড় বারান্দা। দেয়ালের ভিতরে নানান জাতের গাছগাছড়া। দিনের বেলায়ও অন্ধকার হয়ে থাকে।

আমি লতিফাকে বললাম, ‘বাড়ি পছন্দ হয়েছে লতিফা?’

লতিফা আনন্দে কেঁদে ফেলল। দুই দিন খাওয়াদাওয়া না-করায় লতিফার শরীর নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। চোখ ছোট-ছোট, ঠোঁট কালচে। মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। এই অবস্থাতেই সে রান্নাবান্না করল। অতি সামান্য আয়োজন। ভাত ডাল পেঁপে ভাজা। খেতে অমৃতের মতো লাগল ভাইসাহেব।

খাওয়াদাওয়ার পর দু’ জনে হাত ধরাধরি করে বাগানে হাঁটলাম। হাসবেন না ভাইসাব, তখন আমাদের বয়স ছিল অল্প। মন ছিল অন্য রকম। হাঁটতে-হাঁটতে আমার মনে হল, এই দুনিয়াতে আল্লাহ্‌পাক আমার মতো সুখী মানুষ আর তৈরি করেন নাই আনন্দে বারবার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল ভাই সাহেব।

ক্লান্ত হয়ে একসময় একটা লিচুগাছের নিচে আমরা বসলাম। লতিফা বলল, ‘আমি যে মিথ্যা কথা বইলা আপনেরে বিবাহ করছি, এই জন্য কি আমার উপর রাগ করছেন?’

আমি বললাম, ‘না লতিফা। আমার মতো সুখী মানুষ নাই।’

‘যদি সুখী হন তাহলে এই ধাঁধাটা পারেন কি না দেখেন। বলেন দেখি—

কাটলে বাঁচে, না-কাটলে মরে

এমন সুন্দর ফল কোন গাছেতে ধরে?’

‘পারলাম না লতিফা।’

‘ভালোমতো চিন্তা কইরা বলেন। এইটা পারা দরকার। খুব দরকার—

কাটলে বাঁচে, না-কাটলে মরে

এমন সুন্দর ফল কোন গাছেতে ধরে?’

‘পারব না লতিফা। আমার বুদ্ধি কম।’

‘এইটা হইল সন্তানের নাড়ি-কাটা। সন্তানের জন্মের পর নাড়ি কাটলে সন্তান বাঁচে। না-কাটলে বাঁচে না। আচ্ছা এই ধাঁধাটা আপনেরে কেন জিজ্ঞেস করলাম বলেন তো?’

‘তুমি বল। আমার বিচারবুদ্ধি খুবই কম।’

‘এইটা আপনেরে বললাম—কারণ আমার সন্তান হবে।’

লতিফা লজ্জায় দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলল। কী যে আনন্দ আমার হল ভাইসাহেব—কী যে আনন্দ!

সেই রাতে লতিফার জ্বর আসল।

বেশ ভালো জ্বর। আমি জ্বরের খবর রাখি না। ঘুমাচ্ছি। লতিফা আমারে ডেকে তুলল। বলল, ‘আমার খুব ভয় লাগতেছে, একটু উঠেন তো।’

আমি উঠলাম। ঘর অন্ধকার। কিচ্ছু দেখা যায় না। হারিকেন জ্বালায়ে শুয়েছিলাম। বাতাসে নিভে গেছে। হারিকেন জ্বালালাম।

তাকিয়ে দেখি লতিফার মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেছে। সে ফিসফিস করে বলল, ‘ছাদের কার্নিশে কে যেন হাঁটে।’

আমি শোনার চেষ্টা করলাম। কিছু শুনলাম না।

লতিফা বলল, ‘আমি স্পষ্ট শুনেছি। একবার না, অনেক বার শুনেছি। জুতা পায়ে দিয়া হাঁটে। জুতার শব্দ হয়। হাঁটার শব্দ হয়।’

‘বোধহয় দারোয়ান।’

‘না, দারোয়ান না। অন্য কেউ।’

‘কি করে বুঝলা অন্য কেউ?’

‘বললাম না—জুতার শব্দ। দারোয়ান কি জুতা পরে?’

‘তুমি থাক। আমি খোঁজ নিয়া আসি?’

‘না না। এইখানে একা থাকলে আমি মরে যাব।’

আমি লতিফার হাত ধরে বসে রইলাম। এই প্রথম বুঝলাম লতিফার খুব জ্বর। জ্বর আরো বাড়ল। একসময় জ্বর নিয়ে ঘুমায়ে পড়ল। তখন আমি নিজেই শব্দটা শুনলাম। ঝনঝন শব্দ। জুতার শব্দ না। অন্য রকম শব্দ। ঝনঝনঝনঝন।

একমনে আয়াতুল কুরসি পড়লাম।

তিন বার আয়াতুল কুরসি পড়ে হাততালি দিলে—সেই হাততালির শব্দ যতদূর যায় ততদূর কোনো জিন-ভূত আসে না। হাততালি দেয়ার পর ঝনঝন শব্দ কমে গেল, তবে পুরোপুরি গেল না। আমি সারা রাত জেগে কাটালাম।

ভোরবেলা সব স্বাভাবিক।

রাতে যে এত ভয় পেয়েছিলাম মনেই রইল না। লতিফার গায়েও জ্বর নেই। সে ঘর-দুয়ার গোছাতে শুরু করল। একতলার সর্বদক্ষিণের দুটো ঘর আমরা নিয়েছি। বারান্দা আছে। কাছেই কলঘর। লতিফা নিজের সংসার ঠিকঠাক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দারোয়ান বলরাম সাহায্য করার জন্য চলে আসল। বলরামের বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। আদি বাড়ি নেপালে। দশ বছর বয়সে বাংলাদেশে এসেছে, আর ফিরে যায় নি। এখন পুরোপুরি বাঙালি। বাঙালি একটি মেয়েকে বিয়ে করেছিল। সে মেয়ে মরে গেছে। বলরামের এক ছেলে আছে। খুলনার এক ব্যাঙ্কের দারোয়ান। ছেলে বিয়ে-শাদি করেছে। বাবার কোনো খোঁজখবর করে না।

বলরামের সঙ্গে অতি অল্প সময়ে লতিফার ভাব। বলরাম লতিফাকে ‘মা’ ডাকা শুরু করল। আমি নিশ্চিন্ত হয়ে দোকানে চলে গেলাম। ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।

বাড়িতে ঢুকে দেখি বারান্দায় পা ছড়িয়ে লতিফা বসে আছে। তার মুখ শুকনা। আমি বললাম, ‘কী হয়েছে?’

‘ভয় লাগছে।’

‘কিসের ভয়?’

‘বিকেলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। একটা খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছি।’

‘কী স্বপ্ন?’

‘দেখলাম আমি ঘুমাচ্ছি। একটা লম্বা, কালো এবং খুব মোটা লোক ঘরে ঢুকল। লোকটার সারা শরীরে বড়-বড় লোম। কোনো দাঁত নেই। চোখগুলা অসম্ভব ছোট-ছোট। দেখাই যায় না—এ-রকম। হাতের থাবাগুলিও খুব ছোট। বাচ্চা ছেলেদের মতো। আমি লোকটাকে দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম। সে বলল, এই, ভয় পাস কেন? আমার নাম কফিল। আমি তো তোর সাথেই থাকি। তুই টের পাস না? তুই বিয়ে করেছিস, আমি কিছু বলি নাই। এখন আবার সন্তান হবে। ভালোমতো শুনে রাখ— তোর সন্তানটারে আমি শেষ করে দিব। এখনি শেষ করতাম। এখন শেষ করলে তোর ক্ষতি হবে। এইজন্য কিছু করছি না। সন্তান জন্মের সাত দিনের ভিতর আমি তারে শেষ করব। এই বলেই সে আমারে ধরতে আসল। আমি চিৎকার করে জেগে উঠলাম। তারপর থেকে এইখানে বসে আছি।’

আমি বললাম, ‘স্বপ্ন হল স্বপ্ন। কত খারাপ খারাপ স্বপ্ন মানুষ দেখে। সবচেয়ে বেশি খারাপ স্বপ্ন দেখে পোয়াতি মেয়েছেলে। তাদের মনে থাকে মৃত্যুভয়।’

কথাবার্তা বলে লতিফাকে মোটামুটি স্বাভাবিক করে তুললাম। সে ঘরের কাজকর্ম করতে লাগল। রান্না করল। আমরা সকাল-সকাল খাওয়াদাওয়া করলাম। তারপর বাগানে হাঁটতে বের হলাম। লতিফা বলল, ‘এই বাড়িতে একটা দোষ আছে, সেইটা কি আপনি জানেন?’

‘কী দোষ?’

‘এই বাড়িতে একটা খারাপ কুয়া আছে। সিদ্দিক সাহেবের চার বছর বয়সের একটা ছোট্ট মেয়ে কুয়ায় পড়ে মারা গিয়েছিল। কুয়াটা দোষী।’

‘কী যে তুমি বল! কুয়া দোষী হবে কেন? বাচ্চা মেয়ে খেলতে খেলতে পড়ে গেছে।’

‘তা না, কুয়াটা আসলেই দোষী।’

‘কে বলেছে?’

‘বলরাম বলেছে। কুয়াটার মুখ সিদ্দিক সাহেব টিন দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন। সেই টিনে রাতের বেলা ঝনঝন শব্দ হয়। মনে হয় ছোট কোনো বাচ্চা টিনের উপরে লাফায়। তুমি গত রাতে কোনো ঝনঝন শব্দ শোন নাই?

আমি মিথ্যা করে বললাম, ‘না।’

‘আমি কিন্তু শুনেছি।’

আমি বলরামের উপর খুব বিরক্ত হলাম। এইসব গল্প বলে ভয় দেখানোর কোনো মানে হয়? ঠিক করলাম, ভোরবেলায় তাকে ডেকে শক্তভাবে ধমক দিয়ে দেব।

রাতে ঘুমুতে যাবার সময়ে লক্ষ করলাম, লতিফার জ্বর এসেছে। সে কেমন ঝিম মেরে গেছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। হারিকেন জ্বালিয়ে রেখে ঘুমুতে গেলাম। গভীর রাতে ঘুম ভাঙল। লতিফা আমাকে ঝাঁকাচ্ছে। ঘর অন্ধকার। লতিফা বলল, ‘হারিকেন আপনা-আপনি নিভে গেছে। আমার বড়ো ভয় লাগতেছে।’

আমি হারিকেন জ্বালালাম, আর তখনি ঝনঝন শব্দ পেলাম। একবার না, বেশ কয়েক বার।

লতিফা ফিসফিস করে বলল, ‘শব্দ শুনলেন?’

আমি জবাব দিলাম না। লতিফা কাঁদতে লাগল।

যতই দিন যেতে লাগল লতিফার অবস্থা ততই খারাপ হতে লাগল। রোজ সে কফিলকে স্বপ্ন দেখে। কফিল তাকে শাসিয়ে যায়। বারবার মনে করিয়ে দেয়—বাচ্চা হওয়ার সাত দিনের মধ্যে সে বাচ্চা নিয়ে নিবে। মনের শান্তি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেল।

আমি লতিফাকে তার বাবার বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলাম, সে রাজি হল না। প্রয়োজনে সে এইখানেই মরবে, কিন্তু বাবার বাড়িতে যাবে না। আমি তার জন্য তাবিজ-কবচের ব্যবস্থা করলাম, বাড়ি-বন্ধনের ব্যবস্থা করলাম। আমি দরিদ্র মানুষ, তবু একটা কাজের মেয়ের ব্যবস্থা করলাম, যেন সে সারাক্ষণ লতিফার সঙ্গে থাকে।

কিছুতেই কিছু হল না।

এক সন্ধ্যাবেলায় বাসায় ফিরে দেখি—লতিফা খুব সাজগোজ করেছে। লাল একটা শাড়ি পরেছে। পান খেয়ে ঠোঁট লাল করেছে। বেণী করে চুল বেঁধেছে। বেণীতে চার-পাঁচটা জবা ফুল। সে পা ছড়িয়ে মেঝেতে বসে আছে। একটু দূরে বলরাম এবং কাজের মেয়েটা। তারা দু’ জন ভীত চোখে তাকিয়ে আছে লতিফার দিকে।

আমাকে দেখেই লতিফা খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসি আর থামতেই চায় না। আমি বললাম, ‘কী হয়েছে লতিফা?’ লতিফা হাসি থামাল এবং আমাকে হতভম্ব করে দিয়ে পুরুষের গলায় বলল, ‘মৌলানা আসছে। মৌলানারে অজুর পানি দেও। নামাজের পাটি দেও। কেবলা কোন দিকে দেখাইয়া দেও। টুপি দেও, তসবি দেও।’

আমি বললাম, ‘এই রকম করতেছ কেন লতিফা?’

লতিফা আবার হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ে বলল, ‘ওমা, মেয়েছেলের সঙ্গে দেখি মৌলানা কথা বলে! ছিঃ ছিঃ ছিঃ! মৌলানার লজ্জা নাই।’

আমি আয়তুল কুরসি পড়া শুরু করলাম।

আমাকে থামিয়ে দিয়ে লতিফা চিৎকার করে বলল, ‘চুপ কর। আমার নাম কফিল। তোর মতো মৌলানা আমি দশটা হজম কইরা রাখছি। গোটা কোরান শরিফ আমার মুখস্থ। আমার সঙ্গে পাল্লা দিবি? আয়, পাল্লা দিলে আয়। প্রথম থাইকা শুরু করি… হি-হি-হি। ভয় পাইছস? ভয় পাওনেরই কথা। বেশি ভয় পাওনের দরকার নাই। তোরে আমি কিছু বলব না। তোর বাচ্চাটারে শেষ করব। তুই মৌলানা মানুষ, তুই বাচ্চা দিয়া কী করবি? তুই থাকবি মসজিদে। মসজিদে বইস্যা তুই তোর আল্লাহ্‌রে ডাকবি। পুলাপান না-থাকাই তোর জন্য ভালা। হি—হি—হি—।’

একটা ভয়ংকর রাত পার করলাম ভাইসাব। সকালে দেখি সব ঠিকঠাক। লতিফা ঘরের কাজকর্ম করছে। এইভাবে দিন পার করতে লাগলাম। কখনো ভালো কখনো মন্দ।

লতিফা যখন আট মাসের পোয়াতি, তখন আমি হাতে-পায়ে ধরে আমার শাশুড়িকে এই বাড়িতে নিয়া আসলাম। লতিফা খানিকটা শান্ত হল। তবে আগের মতো সহজ-স্বাভাবিক হল না। চমকে চমকে ওঠে। রাতে ঘুমাতে পারে না। ছটফট করে। মাঝে-মাঝে ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখে। সেই দুঃস্বপ্নে কফিল এসে উপস্থিত হয়। কফিল চাপা গলায় বলে, ‘দেরি নাই—আর দেরি নাই। পুত্রসন্তান আসতেছে। সাত দিনের মধ্যে নিয়ে যাব। কান্দাকাটি যা করার কইরা নেও।’ ঘুম ভেঙে লতিফা জেগে ওঠে। চিৎকার করে কাঁদে। আমি চোখে দেখি অন্ধকার। কী করব কিছুই বুঝি না।

শ্রাবণ মাসের তিন তারিখে লতিফার একটা পুত্রসন্তান হল। কী সুন্দর যে ছেলেটা হল ভাইসাহেব, না-দেখলে বিশ্বাস করবেন না। চাঁপা ফুলের মতো গায়ের রঙ। টানা-টানা চোখ। আমি এক শ’ রাকাত শোকরানা নামাজ পড়ে আল্লাহ্‌র কাছে আমার সন্তানের হায়াত চাইলাম। আমার মনের অস্থিরতা কমল না।

আঁতুড়ঘরের বাইরে একটা বেঞ্চ পেতে রাতে শুয়ে থাকি। আমার স্ত্রীর সঙ্গে থাকেন আমার শাশুড়ি আর আমার স্ত্রীর দূর সম্পর্কের এক খালাতো বোন। পালা করে কেউ-না-কেউ সারা রাত জেগে থাকি।

লতিফার চোখে এক ফোঁটাও ঘুম নাই। সন্তানের মা। সারাক্ষণ বাচ্চা বুকের নিচে আড়াল করে রাখে। এক মুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল করে না। আমার শাশুড়ি যখন বাচ্চা কোলে নেন তখনো লতিফা বাচ্চাটার গায়ে হাত দিয়ে রাখে, যেন কেউ নিয়ে যেতে না পারে।

ছয় দিনের দিন কি হল শুনেন।

ঘোর বর্ষা। সারা দিন বৃষ্টি হয়েছে। সন্ধ্যার পর আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। এ-রকম বর্ষা আমি আমার জীবনে দেখি নাই।

লতিফা আমাকে বললো, ‘আইজ রাইতটা আপনে জাগনা থাকবেন। আমার কেমন জানি লাগতেছে।’

আমি বললাম, ‘কেমন লাগতেছে?’

‘জানি না। একটু পরে-পরে শরীর কাঁপতেছে।’

‘তুমি নিশ্চিন্ত হইয়া থাক। আমি সারা রাইত জাগনা থাকব।’

‘আপনে একটু বলরামরেও খবর দেন। সেও যেন জাগনা থাকে।’

আমি বলরামকে খবর দিলাম। লতিফা বাচ্চাটারে বুকের নিচে নিয়া শুইয়া আছে। আমি একমনে আল্লাহ্‌পাকেরে ডাকতেছি। জীবন দেওয়ার মালিক তিনি। জীবন নেওয়ার মালিকও তিনি।

রাত তখন কত আমি জানি না ভাইসাহেব। ঘুমায়ে পড়েছিলাম। লতিফার চিৎকারে ঘুম ভাঙল। সে আসমান ফাটাইয়া চিৎকার করতেছে। আমার বাচ্চা কই গেল—আমার বাচ্চা কই। দুইটা হারিকেন জ্বালানো ছিল, দুইটাই নিভানো। পুরা বাড়ি অন্ধকার। কাঁপতে-কাঁপতে হারিকেন জ্বালালাম। দেখি সত্যি বাচ্চা নাই। আমার শাশুড়ি ফিট হয়ে পড়ে গেলেন।

লতিফা ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ায়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ছুটে গেল কুয়ার দিকে।

কুয়ার উপর টিন দিয়া ঢাকা ছিল। তাকায়ে দেখি টিন সরানো। লতিফা চিৎকার করে বলছে—‘আমার বাচ্চারে কুয়ার ভিতর ফালাইয়া দিছে। আমার বাচ্চা কুয়ার ভিতরে।’ লতিফা লাফ দিয়া কুয়াতে নামতে চাইল। আমি তাকে জড়ায়ে ধরলাম।

ইমাম সাহের চুপ করে গেলেন। কপালের ঘাম মুছলেন।

আমি বললাম, ‘বাচ্চাটা কি সত্যি কুয়াতে ছিল?’

‘জ্বি।’

‘আর দ্বিতীয় বাচ্চা? সে-ও কি এইভাবে মারা যায়?’

‘জ্বি-না জনাব। আমার দ্বিতীয় বাচ্চা শ্বশুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করে।’

‘সিদ্দিক সাহেবের ঐ বাড়ি তাহলে আপনি ছেড়ে দেন?’

‘জ্বি। তাতে অবশ্য লাভ হয় না। কফিলের যন্ত্রণা কমে না। দ্বিতীয় সন্তানটাকেও সে মারে। জন্মের চারদিনের দিন—’

আমি আঁৎকে উঠে বললাম, ‘থাক ভাই, আমি শুনতে চাই না। গল্পগুলো আমি সহ্য করতে পারছি না।’

ইমাম সাহেব বললেন, ‘আল্লাহ্‌পাক আরেকটা সন্তান দিতেছেন। কিন্তু এই সন্তানটাকেও বাঁচাতে পারব না। মনটা বড়ই খারাপ ভাই সাহেব। বড়ই খারাপ। আমি কত বার চিৎকার করে বলেছি—কফিল, তুমি আমারে মেরে ফেল। আমার সন্তানরে মের না। এই সুন্দর দুনিয়া তারে দেখতে দাও।

ইমাম সাহেব কাঁদতে লাগলেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোর হল। ইমাম সাহেব ফজরের নামাজের প্রস্তুতি নিতে লাগলেন।

সেইদিন ভোরেই আমি সফিককে নিয়ে ঢাকায় চলে এলাম। সফিকের আরো কিছুদিন থেকে কালু খাঁর রহস্য ভেদ করে আসার ইচ্ছা ছিল। আমি তা হতে দিলাম না। ইমাম সাহেবের সঙ্গে আরো কিছু সময় থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।