৩
আজ সারাদিন বাড়ির চারপাশ ঘুরে বেড়াল কৌশিক। নাহ এমন কোনও ফুল নেই যার গন্ধ ওই ওইরকম। তন্নতন্ন করে চারদিক খুঁজতে খুঁজতে শেষে ওই পানায় ভরা পুকুরটার সামনে যখন এল টের পেল পুকুরের কাছে সেই গন্ধটা অনেক বেশি। পুকুরের পানায় এমন গন্ধ হতে পারে না। তাহলে পুকুরের তলায় কিছু…কিছু তো একটা রহস্য রয়েছে, কী সেটা? পুকুরপাড়েই বসে পড়ল। গন্ধটা ওকে মাতাল করে দিচ্ছে। আহ! আবার জেগে উঠছে শরীর। বার বার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে কৌশিকের। জলের দিকে তাকিয়ে ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল ও। ইচ্ছে করছিল ওই জলে নেমে স্নান করতে। এই জল মোটেও স্নানের উপযুক্ত নয়, তবু ওই গন্ধের মধ্যে ডুবতে চাইছিল কৌশিক। হঠাৎই ও মুখ তুলে তাকাতে দেখতে পেল পুকুরের উল্টোদিকে বাবলুদার ঘরের জানলায় একটি মুখ, ওর দিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে। ও তাকাতেই মুখটা চট করে সরে গেল। কৌশিক ততক্ষণে মুখটা চিনে ফেলেছে। বাবলুদার স্ত্রী। এমন লুকিয়ে ওকে দেখছে কেন? আশ্চর্য তো! কৌশিক এই দু’দিনে অনেকবারই খেয়াল করেছে ওকে বাবলুদা এবং ওর স্ত্রী যেন আড়াল থেকে নজরে রাখে। কী দেখে? ভাবনাটা এগোতে গিয়েও পারল না। হাওয়া দিল একটা। আর সেই হাওয়াতে ওই মন মাতানো গন্ধটা যেন গোটা শরীর দিয়ে বয়ে গেল কৌশিকের। উঠে দাঁড়াল ও। পুকুরের জলটা একবার খুব ছুঁতে ইচ্ছে করছে। চারধাপ সিঁড়ি নেমে উবু হয়ে বসে সব যখন জলে হাত ডোবাতে যাচ্ছে তখনই পিছন থেকে ডাক, ভাই করছ কী?
কৌশিক পিছনে তাকিয়ে দেখল বাবলু এসে দাঁড়িয়েছে।
কিছু না জলটা একটু…
ছোঁবে না। উঠে এস।
কেন? ছোঁবো নাই বা কেন? বিরক্ত হয়ে উঠল এবার কৌশিক। কী অসুবিধা আছে?
না অসুবিধা নয়…আসলে বহুদিনের অব্যবহূত জল, তার ওপরে সাপখোপ থাকতে পারে ওইজন্যই বলছিলাম আর কি। উঠে এসো।
শেষ লাইনটায় যেন প্রচ্ছন্ন হুকুম ছিল বাবলুর গলায়। কৌশিক সেটা অমান্য করতে পারল না। আফটার অল ওই এই বাড়ির দায়িত্বে।
ঘরে যাও তুমি। এই পুকুরের দিকে এসো না।
যে গন্ধটার কথা বলছিলাম সেটা কিন্তু এই পুকুরের থেকেই বেরোচ্ছে বাবলুদা।
ওসব তোমার মনের ভুল। আমি এতদিন এখানে রয়েছি কই কোনও গন্ধ পাইনি তো। আমার মনে হচ্ছে তোমার এই বাড়ির পরিবেশ সুট করছে না, তুমি বাড়ি ফিরে যাও, তুমি দাদাবাবুর বন্ধু। মিত্রভিলার গেস্ট। তোমাকে চলে যাওয়ার জন্য জোর তো করতে পারি না, কিন্তু অনুরোধ করতে পারি। আর যদি একান্তই থাকতে চাও তাহলে অনুরোধ করছি দুটো দিন রাতবিরেতে ঘর ছেড়ে বেরোবে না। এতে তোমারই মঙ্গল।
হ্যাঁ এই কথাটা আপনি বারবার কেন বলছেন জানতে পারি? কী রহস্যটা কী?
বাবলু ঠান্ডা গলাতেই বলল, রহস্য কিছুই নেই। পুরনো বাড়ি, তাও আবার এমন পরিবেশ। মানিয়ে নিতে সকলেরই কয়েকটা দিন সময় লাগে। আমি যখন চাকরিতে ঢুকি, আমারও শুরুর দিকে এমন সব হত। এখন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।
কৌশিক বাবলুর কথাগুলো শুনছিল আর একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখছিল বাবলুর চোখের মণিদুটো চঞ্চল।
রাত সাড়ে এগারোটা বাজল। মোবাইলে নেট সার্ফ করতে করতে সময়টা খেয়াল করল কৌশিক। আজ ও মনে মনে ঠিক করে রেখেছে রহস্যটা কী তা জেনেই ছাড়বে। কারণ মনের ভেতর একটা অন্যরকম সন্দেহ দানা বাঁধছে ওর। এমন নয়তো বাবলুদা আর ওর স্ত্রী মিলেই কৌশিককে ভয় দেখিয়ে এই বাড়ি ছাড়া করতে চাইছে। হয়তো ফাঁকা বাড়ির সুযোগ নিয়ে বাবলু এখানে এমন কিছু কারবার ফেঁদে বসেছে যা কৌশিকের উপস্থিতিতে চালাতে অসুবিধা হচ্ছে বলেই এইসব রহস্যের অবতারণা। হতেই পারে। আজকাল সবই হয়। আজ মনে মনে প্রস্তুত হয়েই রয়েছে কৌশিক, এসপার ওসপার করতেই হবে। কিন্তু সমস্যা একটাই বেশি রাত পর্যন্ত কোনওকালেই জেগে থাকতে পারে না। মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতেই একসময় বিছানায় ঘুমিয়ে ঢলে পড়ল। আজও ঘুম ভাঙল সেই তীব্র গন্ধে। ঘুমটা ভাঙতেই ধড়মড় করে উঠে বসল কৌশিক। ঘরের দরজাটা হাট করে খোলা। না, আজ বারান্দা থেকে নয় ও দিব্বি বুঝতে পারছে গন্ধের উৎস এই ঘরের ভেতরেই। কে যেন ঘোরাফেরা করছে ঘরের ভেতর। তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। গায়ের প্রতিটা লোম খাড়া হয়ে উঠল কৌশিকের। কিন্তু সেই ভয়ের অনুভূতি মিনিট খানেকও স্থায়ী হল না। তার আগেই ওকে আচ্ছন্ন করে ফেলল সেই ডুবিয়ে দেওয়া গন্ধটা। কৌশিক চেষ্টা করছিল নিজেকে শক্ত রাখতে, আজ কিছুতেই ওই গন্ধের মোহে না ডুবতে কিন্তু পারল না হার মানল। ঘরটায় কৌশিক নিজে ছাড়াও অন্য একজনের উপস্থিতি রয়েছে, নিশ্চয়ই রয়েছে সেটা অনুভব করা যাচ্ছে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। কানের ভেতর খুব মিহি কন্ঠস্বর পৌঁছচ্ছে ওর। যেন বহু দূর থেকে কেউ কথা বলছে। গলাটা…গলাটা কোনও মেয়ের…নাকি ছেলের? কিন্তু কোনও অল্পবয়েসির…সব মিলিয়ে কেমন বিবশ হয়ে গেল কৌশিক। ওই গন্ধের উৎসকে ভীষণভাবে কাছে পেতে ইচ্ছে হল…ও আর নিজেকে সামলাতে পারল না দুই হাত বাড়িয়ে বলে উঠল কে কে তুমি কে? আমার কাছে এস…প্লিজ আমার কাছে এসো আমি আর পারছি না…
তখনই খিলখিল করে একটা হাসি। কী মোহময়ী হাসি! খাট থেকে নামল কৌশিক। ওর মন আর ওর নিজের নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। কে যেন ওকে বাইরের দিকে ডাকছে। গন্ধটা এখন কেমন যেন জমাট বেঁধে গিয়ে ওর আশেপাশেই ঘুরছে, ওকে ছুঁচ্ছে, আবেগে থিরথির করে উঠছে কৌশিক…প্রায় টলতে টলতেই ওই গন্ধের পিছু পিছু এগোতে থাকল ও। বারান্দা পেরিয়ে বাড়ির পিছনের দিকে সেই পুকুরের দিকে এগোতে থাকল, বার বার শুনেতে পাচ্ছে কে যেন ওর কানের সামনে বলছে, এসো, আমার সঙ্গে এসো…এসো…। মোহগ্রস্ত অবস্থায় এগোতে এগোতে একসময় ওই পুকুরঘাটের সামনে পৌঁছল কৌশিক। রাতের ঘসা আবছা আলোতে দেখল হ্যাঁ ওই তো পুকুরের ঘাটের একেবারে নিচের ধাপে সাদা ধোঁয়ার মতো কী যেন একটা…কে যেন একটা…সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গিয়েছে সেই অপূর্ব সুবাস আহ! পেতেই হবে ওই গন্ধটা নিজের গায়ে মাখতেই হবে নইলে জীবন বৃথা…এমন একটা ভাবনা ওর বোধকে গ্রাস করে ফেলল, তারপর ঘোরের মধ্যে ঘাটের সিড়ি দিয়ে নামতে থাকল ওই পুরনো, পানা, ঝাঁঝিতে ভরা পুকুর যেখানে একবার নামলে আর উঠে আসার উপায় নেই। ঝাঁঝিতে জড়িয়ে মৃত্যু অনিবার্য, সেদিকেই এগোতে থাকল কৌশিক। ওই যে সাদা ধোয়াটে অবয়বটা এখন অনেক স্পষ্ট নিটোল। একটি কিশোরীর শরীর, যেন মেঘ দিয়ে দিয়ে গড়া। জলে নেমে যাচ্ছে ওই শরীর এখনই ধরতে হবে তাকে এখনই, শেষ ধাপে নেমে পুকুরের জলে সবে পা দিতে যাবে কৌশিক তখনই ওকে পিছন থেকে কে যেন সপাটে জাপটে ধরল আর ধরামাত্রই জ্ঞান হারাল ও।
চোখ মেলল যখন চারদিকে দিনের আলো। শুয়ে রয়েছে অচেনা একটা ঘরে। ছোট ঘর। মাথা ভার, দুই চোখ মেলতেও কষ্ট হচ্ছে।
ঠিক লাগছে তো তোমার?
গলাটা চেনা লাগল কৌশিকের। অতি কষ্টে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল বাবলুদা বসে রয়েছে। প্রশ্নটা ওই করেছে। হ্যাঁ এবার ঘরটা চিনেছে বাবলুদার ঘর। এই মিত্রভিলায় আসার পর একবারই মাত্র এই ঘরে ঢুকেছিল কৌশিক। শোওয়া থেকে দুই হাতের কুনুইতে ভর দিয়ে উঠে বসল ও। গোটা শরীরে এত ব্যথা যেন বহুদিন ধরে অতিপরিশ্রম গিয়েছে।
আমি এখানে!
বাবলুদার স্ত্রী এক কাপ চা এগিয়ে দিল কৌশিকের দিকে। চা নাও। কাল ও না থাকলে তুমি আর বাঁচতে না। ওই পুকুরে ডুবে মরতে।
সঙ্গে সঙ্গে গতকাল রাতের কথা মনে পড়ল ওর। পুরো ঘটনাটা পর পর মনে পড়ল। নাহ আজ সকালে গত কয়েকদিন ধরে ওকে পাগল করে দেওয়া গন্ধটা বেমালুম উধাও…
এসব কী বাবলুদা? আমাকে বলুন।
ছেড়ে দাও। কী হবে সবকিছু জেনে। আমার কথা শোনো, যদিও আজ থেকে আবার আগামী দিন পঁচিশেক তুমি মোটামুটি নিশ্চিন্ত থাকতে পার তবে সবটা নয়, ছেলেমানুষের খেয়াল কখন যে কী…
ছেলেমানুষ? কে ছেলেমানুষ? আপনি দয়া করে বলুন দাদা।
কৌশিকের এমন কাতর অনুরোধে বাবলু একবার তাকাল ওর স্ত্রীর দিকে। স্ত্রীর নীরব সম্মতি পেয়ে বাবলু বলল, চা খাও, বলছি। কিন্তু এই কথা যেন তুমি ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ না জানে। মিত্রবাড়ির সম্মান জড়িয়ে রয়েছে এর সঙ্গে।
কৌশিক চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে খেয়াল করল কাপের হ্যান্ডেল ধরা হাতটা থির থির করে কাঁপছে। আপনি বলুন।
আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা। তা প্রায় পনেরো বছর তো হবেই, অরিন্দম দাদাবাবুর একটি বোন হয়েছিল। বাচ্চাটি কী বলব, সদ্যোজাত অবস্থাতেই এত সুন্দর ছিল যে একবার দেখলে তাকে কোলে নিতে ইচ্ছে করবেই। একেবারে রাজকন্যা। শুভাশিসবাবু তার মেয়ের নাম রেখেছিলেন রচনা। রচনা দিদি বড় হতে লাগল। যত দিন যায় আমার দিদিমণির রূপ যেন চাঁদের মতো ছড়িয়ে পড়ে আহা এমন সুন্দর মুখ দাদা আমি কেউ ভূভারতে কেউ দেখেছে বলে মনে হয় না। যেমন সুন্দর দেখতে তেমনই মিষ্টি তার স্বভাব। সকলকে সে সমানভাবে ভালবাসত। ওই একরত্তি রচনা যেন এই মিত্রভিলায় নতুন করে আনন্দ ছড়িয়ে দিয়েছিল। আমরা বুঝতে পারতাম ও এই বাড়িতে আসার পর থেকে পরিবারের সকলেই কেমন আনন্দে থাকে। সবসময়েই যেন একটা খুশির পরিবেশ। আমাদের মনের ভেতরের সব দুঃখ, কষ্ট যেন দূর করে দিয়েছিল ওই মেয়ে। আমরা সকলেই ভাবতাম ও মানুষ নয় সাক্ষাৎ কোনও দেবী এসেছেন মর্তে। আর আমাদের এই ভাবনাটাই যে আর কিছুদিন পরে অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে তা আর কেই বা জানত। আমার সেই দিনটা এখনও মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়। সেদিন দুপুরবেলা ছিল। সম্ভবত রবিবার। কারণ বাড়ির সকলেই সেদিন তখন ঘরে। হঠাৎ রচনাদিদি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠল। সবাই ছুটে গিয়ে দেখে বারান্দায় থোকাথোকা রক্ত, রচনাদিদির পা গড়িয়েও রক্ত নামছে আর দিদি ভীষণ ভয়ে ওই রক্ত দেখে চিৎকার করছে। আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে দিদি ওইদিন প্রথম ঋতুমতী হয়েছিল, বয়স তখন ওর বারো কি তেরো হবে, কিন্তু বয়সের তুলনায় ও ছিল অনেকটাই ছোট। মানে শরীরের বাড় সাধারণ মেয়েদের তুলনায় অনেকটাই বাড়ন্ত হলেও বুদ্ধি বিবেচনাবোধ তখনও ছোটদের মতোই। মানে নির্বোধ নয় কিন্তু সরল, একেবারে জলের মতো স্বচ্ছ। সারাক্ষণ হাসছে হৈ-হুল্লোড় করছে, ওর কাছে যে আসবে তার ওকে ভাল না বেসে উপায় নেই। আর দিদিমণিও আমার সকলকে আপন করে নিতে পারত। চেনা অচেনা যে কাউকে। তো রচনা মা’র যেদিন প্রথম অমন হল সেদিনই ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। গোটা বাড়িটায় এক অপুর্বসুবাসে ভরে গেল। আমরা সকলেই যেন মোহিত হয়ে গেলাম সেই অপুর্ব গন্ধে। এ কোন ফুল? কিসের গন্ধ। প্রায় নিজেদের কাজকর্ম ফেলে রেখে সেই গন্ধের উৎস খুঁজতে লেগে পড়লাম আমরা বাড়ির প্রতিটা গাছ প্রায় খুঁটিয়ে দেখেও কেউ বুঝতে পারলাম না গন্ধটা কিসের। দিন কয়েক গন্ধটা থাকল আমাদের সকলকে যেন ডুবিয়ে রাখল সেই গন্ধ তারপর উধাও। আমরাও ভুলে গেলাম। পরের মাসে আবার যখন গন্ধটা পাওয়া গেল তখন প্রথমেই আমরা জানতে পারিনি উৎসটা কোথায়? পরদিন সকালে জানা গেল রচনা মায়ের আবার ওই ইয়ে মাসিক হয়েছে। আমি তো সেই খবর সরাসরি জানতে পারি না, আমার স্ত্রীর মাধ্যমে জেনেছিলাম আর কী। তবে আমি কর্মচারী হলেও মাত্র পনেরো বছর বয়েসে ওই বাড়িতে কাজে লেগেছিলাম। ফলে থাকতে থাকতে ওই মিত্র বাড়ির একজন সদস্য হয়ে উঠেছিলাম। বাড়ির সবরকম সমস্যা, আলোচনাতে আমাকেও ডাকা হত। আমার স্ত্রীও হয়ে উঠেছিল মিত্র পরিবারের একজন সদস্য। সেইবারে আর তারপর থেকেই অমন…বিশ্বাস করবে না দাদা…ওই গন্ধে আমরা যেন আবার পাগল পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। রচনা কাছাকাছি এলেই সেই গন্ধটা এত তীব্রভাবে এসে নাকে ঝাপটা দিত যে নিজেকে স্থির রাখা দায় হত, মাথা খারাপ হয়ে যেত। আমি দৌড়ে পালাতাম। নিজের মেয়ের মতো যাকে দেখি তাকে ওই গন্ধটার জন্য এক এক সময় খারাপ চিন্তা চলে আসত…ঠিক কেমন…তুমিও তো টের পেয়েছ বলো তাই না? আর এইভাবেই চলতে থাকল প্রতিমাসের কয়েকটা দিন। এই আমার বউয়ের সামনে আমি আজও স্বীকার করছি হ্যাঁ গোটা মাস আমি অপেক্ষা করতাম কবে রচনা মায়ের ওইদিনকটা আসবে। মহুয়ার গন্ধে যেমন নেশা হয় তেমনই নেশা ধরে গিয়েছিল আমার। হয়তো বাড়ির সকলেরই। কিন্তু বাড়ির মেয়ে বলে কথা…কেই বা এমন গোপন সত্যিকে নিজের মুখে স্বীকার করবে বলো? বেশ কয়েকজন ডাক্তার দেখানো হল, তারা ইয়ে পরীক্ষা- টরিক্ষা করে জানালেন তেমন অস্বাভাবিক কিছুই নেই ওতে, অথচ গন্ধটা রয়েছে আর তা কীভাবে তৈরি হচ্ছে তার ব্যাখ্যা তাদের কাছে নেই। তখন মা, মানে রচনাদিদির মা বাড়িতে এক সিদ্ধ সন্ন্যাসীকে ডাকলেন। তিনি অনেক দেখেশুনে বললেন রচনা আসলে মানুষের রূপ নিয়ে পৃথিবীতে এলেও এ আসলে কোনও শাপভ্রষ্ট দেবী। তবে ক্ষতিকারক নয়, ওকে ওর মতোই বড় হতে দিন। মিত্র পরিবারের সৌভাগ্য যে দেবীকে গৃহে পেয়েছে। এইসব কিছু বলার পর তিনি শুধু একটাই কথা বললেন। তবে সাবধান…খুব সাবধান। এ কিন্তু পরিবারের কাছে এক কঠিন পরীক্ষা। একটু পদস্খলন হলেই ঘোর বিপদ। ভয়ংকর বিপদ। অনর্থ হয়ে যাবে। সাবধান!
আর কিছুই না বলে সেই সন্ন্যাসী চলে গেলেন। তারপর বছরও ঘুরল না…ওহ…সে কী ভয়ংকর ঘটনা! একদিন রাতে সকলে যখন ঘুমোচ্ছে রচনা এই পুকুরে এসে জলে ডুবে আত্মঘাতী হল। পরের দিন ভেসে উঠেছিল ফুলের মতো সুন্দর শরীরটা। ওহ সেই দৃশ্য যে কী ভয়ংকর। আর তার থেকেও আরও ভয়ঙ্কর খবর হল…বলে একটু থামল বাবলু। ওর ঘনঘন নিঃশ্বাস পড়ছে…
কৌশিক প্রায় দম বন্ধ করে অপলক তাকিয়ে শুনে যাচ্ছে বাবলুর কথা। চা ঠান্ডা হয়ে কাপেই পড়ে রয়েছে। কী খবর হল বলুন।
পুলিশে খবর দেওয়া ছাড়া আর উপায় ছিল না আর পুলিশ বডি মর্গে নিয়ে গেল। পোস্টমর্টেমে জানা গেল…বলে আবার একটু থেমে নিচু গলায় বাবলু বলল রচনা অন্তঃসত্ত্বা ছিল।
হোয়াট! মুখ বিকৃত করে প্রায় চিৎকার করে উঠল কৌশিক। ওইটুকু মেয়েকে…!
হ্যাঁ অমন ফুলের মতো একরত্তিমেয়েটাকেও…সব থেকে বড় কথা হল, মাসের ওই কয়েকদিন রচনাকে স্কুলে যেতে যেওয়া হত না, বাইরেও ছাড়া হত না, ওই রকম মন মাতাল করে দেওয়া গন্ধটা ওই দিনকটায় ওর শরীর থেকে বেরোত বলেই সাবধানতার কারণে ওকে বাড়ির বাইরে যেতে দেওয়া হত না। ও যখন সুইসাইড করে তখন ওর মাসিক চলছিল। সাধারণত ওই সময়ে মেয়েরা অন্তঃসত্ত্বা হয় না, কিন্তু একেবারেই হয় না তাও নয়। রচনা হয়ে গিয়েছিল।
কে করল এমন?…তাহলে কে?
পুলিশকে এই খবর দেওয়ার পর সন্দেহ এসে পড়ল আমার ওপর যেহেতু আমিই পরিবারের বাইরের লোক। আমার জেরা, পরীক্ষা ইত্যাদি সব হল। এবং আমি নির্দোষ প্রমাণিত হলাম। তারপর পরিবারকে চূড়ান্ত লজ্জা থেকে বাঁচানোর জন্যই হয়তো শুভাশিসবাবু কিছু বড় জায়গার প্রভাব খাটিয়েছিলেন কারণ তারপরেই পুলিশ সেই কেস পুরো চাপা দিয়ে দিল। মিডিয়া ইত্যদি কিছুই জানল না। আর তার কিছুদিন পরেই মিত্র পরিবার থেকে যেন আনন্দ শব্দটাকেই কেউ মুছে দিল। অরিন্দমদাদার সাঙ্ঘাতিক অ্যাক্সিডেন্ট হল, মানে বাড়ির ছাদ থেকে একদিন রাতে পড়ে গেলেন। যদিও আমার মনে হয় না উনি পড়ে গিয়েছিলেন, কারণ রেলিং দেওয়া ছাদে যদি কেউ ইচ্ছে করে না ঝাঁপ দেয়…যাই হোক প্রাণে বেঁচে গেলেন তিনি। আর তারপর থেকে দাদা প্রতিমুহূর্তে সবকিছুকে ভয় পেতেন, একেবারে ছিটিয়ালটাইপ হয়ে যাচ্ছিলেন। মাঝেমাঝে এমনিই চিৎকার করতেন, বিড়বিড় করতেন। অনেক ডাক্তার দেখানো হল। ডাক্তার বললেন, এই বাড়িতে থাকলে উনি কোনওদিন সুস্থ হবেন না, ওর ভেতরে একটা শক রয়েছে। এখান ছেড়ে আপনারা চলে যান। তাই করলেন শুভাশিসবাবু। এই বাড়ি ছেড়ে সপরিবার চলে গেলেন। বাড়ি দেখাশোনার ভার দিয়ে গেলেন আমাকে। সবাইকে জানানো হল অরিন্দমদাদাবাবু বাইরে চাকরি পেয়েছে বলে যাওয়া হয়েছে। আসলে তা নয়, বরং দাদাবাবুর মনের রোগ আজও সারেনি। বরং শুনেছি আরও বেড়েছে। বাড়িতেই থাকেন। আর বড়কর্তা মানে শুভাশিসবাবুই এখনও সংসার চালান। যদিও টাকার অভাব নেই, কিন্তু তবু সংসারটা ছাড়খাড় হয়ে গেল দাদা, অমন ফুলের মতো মেয়েটাও শেষ হয়ে গেল, আর অরিন্দম দাদাও অল্পবয়স থেকে খুব বিলিয়ান্ট ছিল। পড়াশোনায় দারুন। সকলের আশা ছিল বড় হয়ে মস্ত কিছু একটা হবে। কিন্তু…এমনই কপাল…কী যে হল…কে যে…অন্যায়টা করেছিল তা আর জানা গেল না…তবে যেই করুক শাস্তি নিশ্চয়ই তার হবেই।
দীর্ঘ কথা শেষ করে থামল বাবলু। তারপর আবার বলল এই মিত্রভিলা অভিশপ্ত হয়ে গিয়েছে দাদা, রচনা দিদিমনি আজও এখানে ঘোরে, আমি টের পাই, প্রতি মাসের ওই কয়েকটা দিন ঠিক তেমনই গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। আমি এতবছর ধরে সেই গন্ধ পেয়ে অভ্যস্ত তবু যেন এখনও এই বুড়ো বয়েসেও সেই গন্ধে ভেতরটা তাজা জোয়ান হয়ে ওঠে…নিজেকে শক্ত রাখি। জানি কয়েকদিন পরেই গন্ধ মিলিয়ে যাবে।
সেই কয়েকটা দিন বুঝি আমি যেদিন এই বাড়িতে এলাম তারপরের দিন থেকে শুরু হয়েছিল? জিজ্ঞাসা করল কৌশিক।
হ্যাঁ ঠিকই বলেছ। আমার ভয় হচ্ছিল তোমাকে নিয়ে। যদি কিছু অঘটন বাঁধিয়ে বস। রচনা দিদিমনির আত্মা শান্তি পায়নি। প্রথম দিকে আমিও একবার ওই গন্ধে মেতে পুকুরে ডুবে মরতে গিয়েছিলাম আমার স্ত্রী ঠিকসময় এসে বাঁচিয়েছিল। আর কাল আমার মন বলছিল তুমি নিশ্চয়ই কিছু একটা করবে তাই আমরা কাল রাতে দুজনেই ঘরের জানলা দিয়ে তাকিয়ে বসেছিলাম এই পুকুরের দিকে। আর ছাদে যাওয়ার দরজাতেও তালা দিয়ে এসেছিলাম যাতে তুমি ছাদে না যেতে পার। দেখলাম তুমি পুকুরের দিকে আসছ তখনই আর দেরি করিনি। হয়তো কথাগুলো তোমাকে আগে বলে দিকেই ভাল হত, কিন্তু সংকোচ লাগে, বোঝোই তো এতবছর এই বাড়ির নুন খেয়েছি, এই বাড়ির কলঙ্ক আমার গায়েও লাগে।
ঘরের মধ্যে সকলেই চুপ। কৌশিকের চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠলছিল একটা আবছা একটা তেরো চোদ্দ বছরের নিষ্পাপ শরীর, আর একটা গন্ধ…যে গন্ধে গোটা পৃথিবী ডুবে মরতে পারে।
—