রবিনের শয্যা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় মুবী। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে তাঁবুর পর্দা ফাঁক করে উঁকি দেয় বাইরে। অন্ধকারে কিছুই চোখে পড়ল না তার। মুবী বাইরে বেরিয়ে আসে। তাঁবুর আড়াল থেকে ইতিউতি দৃষ্টিপাত করে দেখে নেয় প্রহরী কোথায়। দূরে কারুর গোঙ্গানীর শব্দ শুনতে পায় সে। হতে পারে সেই প্রহরী। মুবী দ্রুত হাঁটা দেয় একদিকে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে দ্রুত হেঁটে পিছনের দিকে সতর্ক কান রেখে পৌঁছে যায় টিলার নিকটে। হাঁটা দেয় নিজের তাঁবুর দিকে।

আধা পথ অতিক্রম করার পর দুজন মানুষের চাপা কণ্ঠস্বর কানে ভেসে আসে মেয়েটির। মনে হল, তারই তাঁবুর নিকটে কথা বলছে দুজন মানুষ। মুবীর মনে আশঙ্কা জাগে, প্রহরী হয়ত জেনে ফেলেছে, তাঁবুর একটি মেয়ে উধাও হয়ে গেছে। হয়ত সে কারণেই সে অন্য কোন প্রহরী বা কমাণ্ডারকে ডেকে এনেছে। ভাবনায় পড়ে যায় মুবী। মুহূর্ত মধ্যে সিদ্ধান্ত নেয়, নিজের তাঁবুতে যাওয়া এ মুহূর্তে নিরাপদ নয়। তার চে অন্য পাঁচ পুরুষ সঙ্গীর কাছেই চলে যাই।

মুবীর বণিকবেশী পাঁচ মারাকেশী পুরুষ সঙ্গী এখান থেকে দেড় মাইল দূরে তাঁবু ফেলে অবস্থান করছে। তাদের কাছেই যাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় মেয়েটি।—কিন্তু আবার ভাবে, তার পালানোর ফলে অন্য মেয়েদের উপর বিপদ নেমে আসবে। খানিকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে সে। কিন্তু পরক্ষণেই হাঁটা দেয় সামনের দিকে। নিজের তাঁবু অভিমুখে লোক দুটো কী বলছে শোনার চেষ্টা করে। মুবী আরবী বুঝে। সালাহুদ্দীন আইউবীর কাছে সে মিথ্যা বলেছিল, ‘সিসিলি ছাড়া অন্য কোন ভাষা সে বুঝে না।’

চুপ মেরে যায় লোক দুটো। এখন আর কোন কথার শব্দ শোনা যাচ্ছে না তাদের। পা টিপে টিপে আরও সামনে এগিয়ে যায় মুবী। এবার ডান দিক থেকে কারও পায়ের শব্দ শুনতে পায়। চকিত নয়নে ফিরে তাকায়। ঘন বৃক্ষরাজির মধ্যে কালো একটি ছায়ামূর্তি চোখে পড়ে তার। গতি পরিবর্তন করে টিলার দিকে হাঁটা দেয় মেয়েটি।

কোন বিপদের মুখোমুখি হতে চাচ্ছে না মুবী। নিরাপদে টিলার উপরে উঠতে শুরু করে সে। টিলাটি তেমন উঁচু নয়। অল্পক্ষণের মধ্যেই মুবী টিলার উপরে উঠে যায়।

বড় বিচক্ষণ মেয়ে মুবী। কিন্তু যত চতুরই হোক মানুষ প্রতিপদে পূর্ণ সাবধানতা রক্ষা করতে সমর্থ হয় না। অন্যের চোখ ফাঁকি দিয়ে সবসময় শতভাগ নিরাপদ থাকা অতি বিচক্ষণের পক্ষেও কঠিন হয়ে পড়ে।

টিলার চূড়ায় উঠে গেলেও বিচক্ষণ মেয়ে মুবী লোকটার চোখে পড়ে যায়। মুবী নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করে। মুখের উপর ছড়িয়ে থাকা খোলা চুলগুলো পিঠের উপর সরিয়ে দেয় সে। কিন্তু ক্ষীণ জ্যোত্স্নালোকে মেয়েটির উন্নত বক্ষ আর দীর্ঘ কালো ওড়না ধাওয়াকারী লোকটিকে জানিয়ে দেয়, এটি একটি মেয়ে।

লোকটি সালাহুদ্দীনের প্রহরীদের কমাণ্ডার। রাতের বেলা ক্যাম্পে টহল দিতে বেরিয়েছে। মুহূর্তটা প্রহরীদের ইউনিট পরিবর্তনের সময়। সুলতান সালাহুদ্দীন তিনজন অধিনায়কসহ ক্যাম্পে অবস্থান করছেন। আর সে জন্যেই কমাণ্ডার অধিক সতর্কতার সাথে টহল দিয়ে ফিরছে। সুলতান সালাহুদ্দীনের ব্যবস্থাপনা বড় কঠোর। প্রতি মুহূর্তে যে কোন দায়িত্বশীল আশঙ্কাবোধ করে, হয়ত এ মুহূর্তে সুলতান তদারকি করতে বেরিয়ে আসবেন।

কমাণ্ডার বুঝে ফেলে, টিলার উপর একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ সন্ধ্যায়ই উপর থেকে কমাণ্ডারদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে, খৃষ্টানরা চরবৃত্তি এবং নাশকতামূলক তৎপরতার জন্য মেয়েদের ব্যবহার করতে শুরু করেছে। তাদের নিয়োজিত মেয়েরা হতে পারে মরু যাযাবরের বেশে। ভিক্ষুক বেশে ক্যাম্পে আসতে পারে ভিক্ষা করতে। কেউ আবার নিজেকে বিপন্ন নির্যাতিত বলে আশ্রয় প্রার্থনা করতে পারে। কমাণ্ডারদের বলা হয়েছে, আজই সাতটি মেয়ে, সুলতান সালাহুদ্দীনের আশ্রয়ে এসেছে। মহামান্য সুলতান বাহ্যত তাদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে প্রকৃতপক্ষে তাদেরকে সন্দেহভাজন আখ্যা দিয়ে আশ্রয়ে নিয়ে নিয়েছেন। এ-সব নির্দেশনা শুনে এই কমাণ্ডার তার এক সঙ্গীকে বলেছিল, ‘আল্লাহ করুন, যেন এমন কোন মেয়ে আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে বসে!’ বলেই দুজন খিলখিল করে হাসিতে ফেটে পড়েছিল।

মধ্য রাতে যখন সমগ্র ক্যাম্প গভীর নিদ্রায় অচেতন, ঠিক তখনি টিলার উপর কমাণ্ডারের চোখে পড়ল এক নারীমূর্তি। প্রথমে তার ধারণা হয়, এটি কোন জিন-ভূত হবে হয়ত। কমাণ্ডার নতুন প্রহরীকে তাঁবুর সামনে দাঁড় করিয়ে বলেছিল, ‘ভিতরে কি সাতটি মেয়ে আছে?’ পর্দা তুলে তাকালে ঠিকই সাতটি শয্যা দেখতে পায় প্রহরী। প্রতিটি মেয়ের মুখমণ্ডল কম্বল দিয়ে মুড়ি দেওয়া। প্রচণ্ড শীত পড়ছিল। সপ্তম কম্বলের তলে আসলেই মানুষ আছে কিনা তা আর যাচাই করে দেখেনি কমাণ্ডার। সপ্তম শয্যার মেয়েটিই যে টিলার উপর তার সামনে দণ্ডায়মান, তা তার অজানা।

কমাণ্ডার কিছু সময় চিন্তা করে। নিজেই মেয়েটির কাছে যাবে, নাকি তাকে নীচে নেমে আসার জন্য আদেশ করবে, কিংবা জিন-ভূত হলে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করবে, ভেবে নেয় সে।

ভাবনার মধ্যে কেটে যায় কিছু সময়। কিন্তু এতক্ষণেও অদৃশ্য হয়নি মেয়েটি। বরং দু-তিন পা এগিয়ে গেছে আরও সামনে। আবার ফিরে আসে পিছনে। থেমে যায় এবার। কমাণ্ডার—যার নাম ফখরুল মিসরী—ধীরে ধীরে পৌঁছে যায় টিলার নিকটে। উপর দিকে তাকিয়ে উচ্চকণ্ঠে বলে— ‘কে তুমি? নীচে নেমে এস।’

আহত হরিণীর মত লাফিয়ে ওঠে মেয়েটি। দৌড়ে চলে যায় টিলার অপর প্রান্তে। ফখরুল মিসরী এবার নিশ্চিত হয় এটি মানুষই বটে।

কমাণ্ডার সুঠামদেহী এক সুপুরুষ। টিলাও তেমন উঁচু নয়। দীর্ঘ কয়েকটি পদক্ষেপেই উপরে উঠে যায় সে। চারদিক অন্ধকার। রাতের আঁধারে মেয়েটির পায়ের আওয়াজ শুনতে পায় লোকটি। পিছু নেয় মেয়েটির।

টিলার অপর প্রান্ত দিয়ে নীচে নেমে তীব্রগতিতে দৌড়াতে শুরু করে মেয়েটি। কমাণ্ডারও নীচে নেমে ধাওয়া করতে শুরু করে তাকে। দু জনের মাঝে ব্যবধান অনেক। কিন্তু ফখরুল মিসরী পুরুষ, তদুপরি সৈনিক। সিংহের মত দৌড়াচ্ছে সে। টিলার পিছনে উঁচু-নীচু, শুষ্ক ঝোঁপঝাড় এবং মাঝে-মধ্যে দু চারটি বৃক্ষ। দীর্ঘক্ষণ দৌড়িয়ে এবার ফখরুল অনুভব করল, সামনে কেউ নেই। দাঁড়িয়ে যায় সে। অনিমেষ চোখে তাকায় ডানে-বাঁয়ে ও সামনে-পিছনে। খানিক পর পিছনে বেশ বাঁয়ে মেয়েটির পায়ের আওয়াজ ভেসে আসে তার কানে।

প্রশিক্ষিত মেয়ে। রূপ-যৌবন ব্যবহারের পাশাপাশি সামরিক ট্রেনিংও পেয়েছে সে। খঞ্জর চালনার কৌশলও তার রপ্ত । দৌড়ে পালিয়ে একটি গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিল সে। ফখরুল মিসরী তাকে অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে গেছে। এবার অন্য দিকে মোড় নিয়েছে মেয়েটি।

কানামাছি খেলছে যেন দুজন। কমাণ্ডারের যত সমস্যা অন্ধকারের কারণে। মেয়েটির পায়ের আওয়াজই তার ধাওয়া করার একমাত্র অবলম্বন। চোখে দেখছে না কিছুই। মুবীর পা থেমে গেলে থেমে যায় ফখরুল মিসরীও। চলতে শুরু করলে সক্রিয় হয়ে উঠে ফখরুল মিসরী।

ফখরুল মিসরীর বুঝতে বাকী নেই, মেয়েটি তাগড়া যুবতী। বয়সী হলে এত দ্রুত এবং এত বেশী দৌড়াতে পারত না।

মুবীর পুরুষ সঙ্গীদের ছাউনি সামান্য সামনে। ফখরুল মিসরীকে ফাঁকি দিয়ে ঝোঁপ-ঝাড়ের আড়ালে আড়ালে দৌড়ে ছাউনিতে পৌঁছে যায় মেয়েটি। হাঁক দেয় সঙ্গীদের। নারী কন্ঠের আর্ত-চিৎকার শুনে সন্ত্রস্থ হয়ে জেগে উঠে তারা। বেরিয়ে আসে তাঁবুর বাইরে। আলো জ্বালায়। তরবারী কোষমুক্ত করে নেয় ফখরুল মিসরী। হাঁফাতে হাঁফাতে দৌড়ে এসে দাঁড়িয়ে যায় তাদের সম্মুখে। কমাণ্ডার দেখতে পায়, পাঁচজন মানুষ। পোশাকে প্রবাসী বণিক বলে মনে হল তাদের। সম্ভবত মুসলমান। মেয়েটি তাদের একজনের দুপা দুবাহু দ্বারা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। মশালের কম্পমান আলোতে তার মুখমণ্ডলে প্রচণ্ড ভীতির ছাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। বুকটা উঠানামা করছে তার। প্রচণ্ড শব্দে নিঃশ্বাস ফেলছে মেয়েটি।

‘এই মেয়েটিকে আমার হাতে তুলে দাও।’ নির্দেশের সুরে বলল ফখরুল মিসরী।

‘একটি কেন, আমরা সাত সাতটি মেয়ে আপনার সুলতানের হাতে তুলে দিয়েছি। মন চাইলে আপনি একে নিয়ে যেতে পারেন।’ বিনয়ের সুরে জবাব দেয় একজন।

‘না, না, আমি এর সঙ্গে যাব না! এরা খৃষ্টানদের চেয়েও জংলী। এদের সুলতান মানুষ নয়—আস্ত একটা ষাঁড়, হিংস্র পশু। বেটা আমার হাড়-গোড় সব ভেঙ্গে দিয়েছে। আমি তার কবল থেকে পালিয়ে এসেছি।’ লোকটার পদযুগল আরও শক্ত করে ধরে কান্নাজড়িত ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল মুবী।

‘কোন্ সুলতান?’ বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করে ফখরুল মিসরী।

‘আর কে? তোমরা যাকে সালাহুদ্দীন আইউবী বল, সেই সুলতান।’ জবাব দেয় মুবী। মুবী এবার কথা বলছে আরবীতে।

‘মেয়েটি মিথ্যে বলছে।’ বলেই ফখরুল জানতে চায়, ‘এ কে তোমাদের আত্মীয় কি?’

‘ভিতরে এস দোস্ত! বাইরে ঠাণ্ডা পড়ছে। তরবারী কোষবদ্ধ করে নাও। আমরা ব্যবসায়ী। ভয়ের কোন কারণ নেই। মেয়েটির কাহিনী শোন।’ ফখরুল মিসরীকে উদ্দেশ করে বলল একজন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লোকটি বলল, ‘তোমার সুলতানকে আমি মর্দে মুমিন মনে করতাম। কিন্তু একটি রূপসী মেয়েকে হাতে পেয়ে তিনি ঈমানের কথা ভুলে গেলেন! অবশিষ্ট ছয়টি মেয়েরও তিনি একই দশা ঘটিয়ে থাকবেন অবশ্যই।’

‘অন্য মেয়েদের এই দশা ঘটিয়েছে সালাররা। সন্ধ্যায় তাদেরকে ওরা নিজ তাঁবুতে ডেকে নিয়ে যায় এবং হায়েনার মত উপভোগ করে ফিরিয়ে দিয়ে যায়। তাঁবুতে এখন তারা অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে।’ বলল মুবী।

ভাবান্তর ঘটে যায় ফখরুল মিসরীর। ধীরে ধীরে তরবারীটা কোষবদ্ধ করে তাদের সঙ্গে তাঁবুতে ঢুকে পড়ে সে। বসে পড়ে পাতানো শয্যার এক কোণে। চুলোয় আগুন ধরিয়ে হাড়িতে করে পানি চড়ায় একজন। কফি তৈরি করার নামে কি যেন ঢালে পানিতে। ফখরুল মিসরীর পদমর্যাদা কি জানতে চায় আরেকজন। ফখরুল মিসরী জানায়, ‘আমি পদস্থ একজন কর্মকর্তা—কমাণ্ডার।’ নানা রকম কথা বলে বণিকরাও আন্দাজ করে নেয়, লোকটি সাধারণ নয়—আসলেই পদস্থ কেউ হন। অত্যন্ত বিচক্ষণ এবং দুঃসাহসীও বটে।

বণিকদের একজন—যার নাম ক্রিস্টোফর—কমাণ্ডারকে মেয়েগুলো সম্পর্কে হুবহু সেই কাহিনী শোনায়, যা শুনিয়েছিল সুলতান সালাহুদ্দীনকে।

মেয়েগুলো সুলতানকে প্রস্তাব করেছিল, আমরা যেহেতু বাবা-মার নিকটও ফিরে যেতে পারব না, খৃষ্টানদের কাছেও নয়, তাই আমরা মুসলমান হয়ে যাই। পদস্থ সাতজন সৈনিকের সঙ্গে আমাদের বিয়ে দিয়ে দিন। ক্রিস্টোফর বলল, আমরা শুনেছিলাম, নৈতিকতার প্রশ্নে সুলতান সালাহুদ্দীন আপোষহীন, চরিত্র তার পাথরের মত অটল। ব্যবসার ধান্ধায় আমরা সব সময়ই সফরে সফরে থাকি। বিপন্ন নিরাশ্রয় এই মেয়েগুলোকে কিভাবে আমরা সঙ্গে নিয়ে ঘুরি। তাই নিরাপত্তার জন্য মেয়েগুলোকে সুলতানের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। কিন্তু সুলতান মেয়েগুলোর সঙ্গে কী আচরণ করলেন, তা তো এই মেয়েটির জবানীতে নিজ কানেই শুনলেন!

মেয়েটির প্রতি তাকায় ফখরুল মিসরী। সুযোগ বুঝে মেয়েটি বলে, ‘খোদা আমাদেরকে একজন ফেরেশতার আশ্রয়ে তুলে দিয়েছেন ভেবে আমরা মনে মনে বেশ খুশী হয়েছিলাম। কিন্তু সূর্যাস্তের পর সুলতানের এক রক্ষী এসে আমাকে বলল, সুলতান তোমায় ডাকছেন। অন্য ছয় মেয়ের তুলনায় আমি একটু বেশী সুন্দরী। আমি কল্পনাও করিনি, তোমাদের সালাহুদ্দীন আমায় অসৎ উদ্দেশ্যে ডেকে পাঠিয়েছেন। আমি সরল মনে চলে গেলাম। সুলতান মদের পিপার মুখ খুললেন। ঢেলে এক গ্লাস রাখলেন নিজের সামনে আর এক গ্লাস ধরিয়ে দিলেন আমার হাতে। আমি খৃষ্টান, মদ পান করেছি শতবার। জাহাজে খৃষ্টান কমাণ্ডাররা আমার দেহটাকে খেলনা বানিয়ে রেখেছিল। সালাহুদ্দীন আইউবীও একই মতলব আঁটলেন। মদ ও পুরুষ আমার জন্য নতুন কিছু নয়। কিন্তু সুলতান সালাহুদ্দীনকে আমি ফেরেশতা মনে করতাম। তার পবিত্র দেহটাকে আমি আমার নাপাক শরীর থেকে দূরে রাখতে চাইছিলাম। কিন্তু খৃষ্টান নরপশু কমাণ্ডারদের চেয়ে তিনি অধিক ঘৃণ্য বলে প্রমাণিত হলেন। তোমাদের সুলতান আমার শরীরের হাড়-গোড় সব ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছেন।

সমুদ্রের মহাবিপদ থেকে খোদা আমাদেরকে উদ্ধার করলেন এবং ছুঁড়ে মারলেন এমন এক ব্যক্তির আশ্রয়ে, যে ফেরেশতারূপী সাক্ষাৎ হায়েনা। সুলতানই আমাকে বলেছিলেন, আমার সঙ্গের অন্য মেয়েরা তার সালারদের তাঁবুতে রয়েছে। আমি সুলতানের পা ধরে মিনতি করেছিলাম, আপনি আমায় বিয়ে করে নিন। তিনি বললেন, তোমার যদি আমাকে পছন্দই হয়ে থাকে, তো বিয়ে ছাড়াই আমি তোমায় আমার হেরেমে স্থান দেব। তিনি আমার সঙ্গে হায়েনার মত আচরণ করেছেন। ছিলেন মদে মাতাল। এক পর্যায়ে দু বাহুবন্ধনে জড়িয়ে ধরে আমাকে তিনি তার পার্শ্বে শুইয়ে দেন ……। এক সময়ে যখন তার দু চোখের পাতা এক হল, আমি উঠে সেখানে থেকে পালিয়ে এলাম। আমার কথায় তোমার বিশ্বাস না হলে তার রক্ষীদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পার।’

এই ফাঁকে ফখরুল মিসরীকে কফি পান করায় একজন। খানিক পর মেজাজে পরিবর্তন আসতে শুরু করে তার। ঘৃণাভরা কণ্ঠে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে এবং বলে— ‘আমাদেরকে আদেশ দেন মদ-নারী থেকে দূরে থাক আর নিজে মদ খেয়ে বুঁদ হয়ে নারী নিয়ে রাত কাটান, না?’

ফখরুল মিস্ত্রী অনুভবই করতে পারেনি, মেয়েটি তাকে যে কাহিনী শুনিয়েছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, নিরেট মিথ্যা। মেজাজ তার কেন পাল্টে গেল, তাও বুঝতে পারেনি সে।

কফি নয়—ফখরুল মিসরীকে খাওয়ানো হয়েছে হাশীশ। হাশীশের নেশায় পড়ে এমন আবোল-তাবোল বকছে সে। কিন্তু এ-যে নেশা, ও বুঝে আসেনি তার। নিজের কল্পনায় এখন সে রাজা। মশালের কম্পমান আলো নাচছে মেয়েটির মুখে। চিক্ চিক্ করছে তার বিক্ষিপ্ত কালোপ জ্বর পশমগুলো। পূর্বাপেক্ষা অধিক রূপসী বলে মনে হল তাকে ফখরুল মিসরীর কাছে। মেয়েটিকে পাওয়ার নেশায় ব্যাকুল হয়ে উঠে তার হৃদয়। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলে ওঠে— ‘তুমি চাইলে আমি তোমাকে আমার আশ্রয়ে নিয়ে নিতে পারি।’

‘না, তুমিও আমার সঙ্গে সুলতানের ন্যায় একই আচরণ করবে। আমাকে তুমি তোমার তাঁবুতে নিয়ে যাবে আর আমি পুনরায় তোমাদের সুলতানের কব্জায় চলে যাব।’ হঠাৎ ভয় পাওয়া মানুষের ন্যায় আঁৎকে উঠে দু পা পিছনে সরে গিয়ে বলল মেয়েটি।

‘আমরা এখন অপর ছয়টি মেয়েকে কিভাবে উদ্ধার করে আনা যায় ভাবছি। আমরা তাদের ইজ্জত বাঁচাতে চেয়েছিলাম; কিন্তু ভুল করে ফেললাম।’ বলল ব্যবসায়ীদের একজন।

ফখরুল মিসরীর দৃষ্টি মেয়েটির উপর নিবদ্ধ। এত সুন্দরী মেয়ে জীবনে আর দেখেনি সে কখনও। কারও মুখে রা নেই। অখণ্ড এক নীরবতা বিরাজ করছে তাঁবুতে। সেই নীরবতা ভাঙ্গে ক্রিস্টোফর। বলল— ‘তুমি কি আরব থেকে এসেছে, নাকি মিসরী?’

‘আমি মিসরী। দু দুটো যুদ্ধে লড়েছি। দক্ষতার বলে এ পদ পেয়েছি।’ বলল ফখরুল মিসরী।

‘নাজি যে সুদানী যে বাহিনীটির সালার, এখন সেটি কোথায়?’ জিজ্ঞেস করে ক্রিস্টোফর।

‘সেই বাহিনীর একজন সৈনিকও আমাদের সঙ্গে নেই।’ জবাব দেয় মিসরী।

‘বলতে পার, এমনটি কেন হয়েছে? সুদানীরা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর নেতৃত্ব ও কমাণ্ড মেনে নেয়নি। বাহিনীটি নিজেকে স্বাধীন মনে করত। নাজি সুলতানকে বলে দিয়েছিল, সে মিসর ছেড়ে চলে যাবে। কারণ, সে বিদেশী মানুষ। এ কারণে সালাহুদ্দীন মিসরীদের একটি বাহিনী গঠন করেন এবং যুদ্ধ করার জন্য এখানে নিয়ে আসেন। তোমাদের সুলতান তোমাদেরকে আত্মমর্যাদা ও সৎকর্মের উপদেশ দেয় আর নিজে আয়েশ করে চলে। তা যুদ্ধ করে গনীমত কিছু পেয়েছ কি?……। দু’ এক চাকা সোনা-রূপা পেয়েছে হয়ত! খৃষ্টানদের জাহাজ থেকে বিপুল পরিমাণ সোনা-চাঁদী সুলতানের হাতে এসেছে। রাতের আঁধারে হাজার হাজার উটের পিঠে বোঝাই দিয়ে সেসব পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে কায়রো। সেখান থেকে পাচার হবে দামেস্ক ও বাগদাদ। সুদানী বাহিনীটিকে নিরস্ত্র করে সুলতান তাদের গোলামে পরিণত করতে চায়। তারপর ফৌজ আসবে আরব থেকে। তখন তোমরা মিসরীরাও গোলাম হয়ে যাবে তাদের।’ বলল ক্রিস্টোফর।

* * *

ক্রিস্টোফরের প্রতিটি কথা হৃদয়ে বসে যাচ্ছে ফখরুল মিসরীর। ক্রিয়াটা মূলত কথার নয়—ক্রিয়া মুবীর রূপ আর হাশীশের। ক্রিস্টোফর এই কৌশল রপ্ত করেছে হাসান ইবনে সাব্বাহর হাশীশীদের নিকট থেকে। মুবী কল্পনাও করেনি, একজন মিসরী কমাণ্ডার তাকে ধাওয়া করে অবশেষে তারই মুঠোয় এসে ধরা দেবে। মেয়েটি জেনে ফেলেছে, মিসরী কমাণ্ডার আরবী ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষা জানে না।

এবার মুবী আরও তথ্য দিতে শুরু করে সঙ্গীদের। বলে, রবিন জখমের ভান করে সুলতান সালাহুদ্দীনের জখমীদের তাঁবুতে পড়ে আছেন। তিনি বলেছেন, নাজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানতে হবে, তিনি বিদ্রোহ কেন করলেন না কিংবা পিছন থেকে কেন তিনি সালাহুদ্দীন আইউবীর উপর আক্রমণ করলেন না। তাছাড়া নাজি আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করলেন কিনা, রবিন তারও খোঁজ নিতে বলেছেন।

মুবীকে ভিন্ন ভাষায় কথা বলতে দেখে ফখরুল মিসরী জিজ্ঞেস করে— ‘ও কী বলছে?’

একজন জবাব দেয়— ‘ও বলছে, যদি এ লোকটি, অর্থাৎ তুমি যদি সালাহুদ্দীন আইউবীর সৈনিক না হতে, তাহলে ও তোমাকে বিয়ে করে নিত। প্রয়োজনে ও মুসলমান হয়ে যেতেও প্রস্তুত আছে। কিন্তু ও বলছে, এখন আর কোন মুসলমানের উপর তার আস্থা নেই।’

জবাব শুনে ব্যাকুল হয়ে উঠে ফখরুল মিসরী। খপ করে মেয়েটির দু বাহু ধরে ফেলে নিজের কাছে টেনে আনে। আপুত কণ্ঠে বলে— ‘খোদার কসম! আমি যদি রাজা হতাম, তবুও তোমার খাতিরে আমি সিংহাসন ত্যাগ করতাম। শর্ত যদি এই হয় যে, আমি সালাহুদ্দীন আইউবীর তরবারী ফেলে দেব, তাহলে এই নাও সালাহুদ্দীনের তরবারী।’ নিজের কটিবন্ধ থেকে তরবারীটা বের করে কোষসহ মেয়েটির পায়ের উপর রেখে দেয় ফখরুল মিসরী। বলে— ‘এ মুহূর্ত থেকে আমি সালাহুদ্দীনের সৈনিক নই, কমাণ্ডার নই।’

‘আরও একটি শর্ত আছে। তোমার খাতিরে আমি আমার ধর্ম ত্যাগ করব। ঠিক; কিন্তু সালাহুদ্দীন আইউবী থেকে প্রতিশোধ আমি নেবই।’ বলল মেয়েটি।

‘তার মানে তুমি কি তাকে আমাকে দিয়ে হত্যা করাতে চাও?’ জিজ্ঞেস করে ফখরুল।

মুবী তার সঙ্গীদের প্রতি তাকায়। পরস্পর চোখাচোখী করে সকলে। জবাবটা কী দেবে স্থির করে নেয় ক্রিস্টোফর। অবশেষে বলে— ‘এক সালাহুদ্দীন বিদায় নিলে তাতে তেমন কি আর লাভ হবে। আসবে আরেক সুলতান। সেও হবে তারই মত। গোলাম হয়েই থাকতে হবে মিসরীদের। কাজেই ও-সবের প্রয়োজন নেই। তুমি বরং একটা কাজ কর; সুদানীদের সালার নাজির কাছে যাও এবং এই মেয়েটিকে তার সামনে উপস্থিত রেখে তাকে জানাও, সালাহুদ্দীন আইউবী আসলে কেমন মানুষ আর লক্ষ্যই বা তার কী?’

বণিকবেশী খৃষ্টান কুচক্রীদের জানা ছিল, খৃষ্টানদের সঙ্গে নাজির যোগসাজশ আছে এবং মুবী অকপটে তার সঙ্গে মিশন নিয়ে কথা বলতে পারবে। কিন্তু সুলতান সালাহুদ্দীন যে বিশ্বাসঘাতক নাজি ও তার সালারদের কৌশলে সংগোপনে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিয়েছেন, তা তাদের অজানা। তথ্য নেওয়ার জন্য নাজির কাছে যাওয়ার কথা ছিল মেয়েটির। কিন্তু তার একা যাওয়া সম্ভব ছিল না। ঘটনাক্রমে ফখরুল মিসরীকে পেয়ে গেছে সে। তাকেই কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত হয়।

মুবীকে নিয়ে রওনা হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয় ফখরুল মিসরীকে। একটি উট দেওয়া হয় তাকে। পানির মশক এবং খাবারভর্তি একটি থলে বেঁধে দেওয়া হয় উটের সঙ্গে। খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে কিছু জিনিস আছে, তাতে হাশীশ মেশানো। বিষয়টা জানা ছিল মুবীর।

একটি লম্বা চোগা এবং ব্যবসায়ীর পোশাক পরিয়ে দেওয়া হয় ফখরুল মিসরীকে। উটের পিঠে সম্মুখভাবে চড়ে বসে মেয়েটি। ফখরুল বসে পিছনে। চলতে শুরু করে উট।

আশ-পাশের কোন খবর নেই ফখরুল মিসরীর। এমনকি নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কেও সম্পূর্ণ উদাসীন সে। এ মুহূর্তে লোকটা জানে শুধু একটাই— পৃথিবীর একটি সেরা সুন্দরী যুবতী তার মুঠোয়, সুলতান সালাহুদ্দীনকে উপেক্ষা করে যে তাকে বরণ করে নিয়েছে! মুবীকে দু বাহুতে জড়িয়ে ধরে পিঠটা তার নিজের বুকের সঙ্গে লাগিয়ে বসেছে ফখরুল মিসরী।

মুবী বলল— ‘তুমিও আবার খৃষ্টান কমাণ্ডার আর তোমার সুলতানের মত হায়েনার পরিচয় দেবে না তো? আমি এখন তোমার মালিকানাধীন, তোমার হাতের মুঠোয়। যা মন চায় করার সুযোগ তোমার আছে। তবুও আমি তোমায় ঘৃণার চোখে দেখব।’

‘তুমি যদি বল, আমি এখনি উটের পিঠ থেকে নেমে যাব। আমাকে তুমি শুধু এতটুকু বল, তুমি মনে-প্রাণে আমাকে কামনা করছ, না-কি নিছক বিপদে পড়ে আমার আশ্রয়ে এসেছ?’ বাহুবন্ধন থেকে মুবীকে ছেড়ে দিয়ে বলল ফখরুল মিসরী।

‘না, তা নয়। আশ্রয় তো আমি ঐ ব্যবসায়ীদেরও নিতে পারতাম। কিন্তু তোমাকে আমার মনে ধরেছে বলেই নিজের ধর্মটা পর্যন্ত ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ জবাব দেয় মুবী। আবেগময় কথা বলে মুবী ফখরুল মিসরীকে মাতিয়ে রাখে এবং কথায় কথায় রাত কাটিয়ে দেয়।

সফরটা ছিল অন্তত পাঁচ দিনের। কিন্তু ফখরুল মিসরী পথ চলছে সাধারণ রাস্তা ছেড়ে অন্য পথে। কারণ, লোকটা দলছুট সৈনিক। ঘুম চাপতে শুরু করে মুবীর। তাই পিছনে হেলান দিয়ে মাথাটা ফখরুল মিসরীর বুকে এলিয়ে দিয়ে গভীর নিদ্রায় তলিয়ে যায় সে। চলতে থাকে উট। জেগে আছে ফখরুল মিসরী।

* * *

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী সবেমাত্র ফজর নামায সমাপ্ত করেছেন। জায়নামাজ ছেড়ে এখনও ওঠেননি। কক্ষে প্রবেশ করে দারোয়ান সংবাদ জানায়, আলী বিন সুফিয়ান এসেছেন। সুলতান দৌঁড়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন। সুলতানকে সালাম দেন আলী বিন সুফিয়ান। কিন্তু সালামের জবাব দেওয়ার আগেই সুলতানের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে— ‘ওদিকের খবর কী?’

এখনও ভাল। তবে সুদানী সৈন্যদের মধ্যে অস্থিরতা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। তাদের মধ্যে আমি যে গুপ্তচর রেখে এসেছিলাম, তার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, তাদের কোন একজন কমাণ্ডারও যদি নেতৃত্ব হাতে তুলে নেয়, তাহলে বিদ্রোহ ঘটে যাবে।’ জবাব দেন আলী বিন সুফিয়ান।

আলী বিন সুফিয়ানকে নিয়ে তাঁবুর ভিতরে চলে যান সালাহুদ্দীন আইউবী। আলী বললেন— ‘নাজি ও তার অনুগত সালারদের আমরা খতম করেছি ঠিক; কিন্তু তারা সুদানীদের মধ্যে মিসরী ফৌজের বিরুদ্ধে ঘৃণার যে বিষ ছড়িয়ে গেছে, তার ক্রিয়া এতটুকুও কমেনি। তাদের অস্থিরতার আরেক কারণ তাদের অধিনায়কদের গুম হওয়া। গুপ্তচরদের মাধ্যমে তাদের মধ্যে আমি এ সংবাদ ছড়িয়ে দিয়েছি যে, তাদের অধিনায়করা রোম উপসাগরের রণাঙ্গনে গেছে। কিন্তু আমীরে মোহতারাম! আমার ধারণা, সুদানীদের মধ্যে সংশয়-সন্দেহ ঢুকে পড়েছে। তাদের বিশ্বাস, তাদের সালারদের বন্দী করে খুন করা হয়েছে।’

‘আচ্ছা, বিদ্রোহের ঘটনা যদি ঘটেই যায়, তাহলে মিসরে আমাদের যে সৈন্য আছে, তারা কী তা দমন করতে পারবে? তারা অভিজ্ঞ পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের মোকাবেলা করতে পারবে কি? আমার তো সন্দেহ হচ্ছে……!’ জিজ্ঞেস করেন সালাহুদ্দীন আইউবী।

‘আমার মনে হয়, আমাদের এই স্বল্পসংখ্যক সৈন্য তাদের মোকাবেলা করতে পারবে না। তবে আয়োজন একটা আমি করে এসেছি। আমি মহামান্য নুরুদ্দীন জঙ্গীর নিকট দ্রুতগামী দুজন দূত প্রেরণ করেছি। তার সমীপে পয়গাম পাঠিয়েছি, মিসরে বিদ্রোহের ডামাডোল শুরু হতে চলেছে। আমরা এ যাবত যে বাহিনী প্রস্তুত করেছি, প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই অপ্রতুল। তাছাড়া তাদের অর্ধেকই অবস্থান করছে রণাঙ্গনে। সম্ভাব্য বিদ্রোহ দমন করার জন্য আপনি শীঘ্র বাহিনী প্রেরণ করুন।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

‘ওদিক থেকে সহযোগিতার আশা খুব কম। গত পরশু এক দূত সংবাদ নিয়ে এসেছিল, নূরুদ্দীন জঙ্গী রাজা ফ্রাংকের উপর আক্রমণ করেছেন। এ আক্রমণ তিনি আমাদের সহযোগিতার জন্য করেছেন। সে সময়ে ফ্রাংকের কর্মকর্তা ও অধিনায়কগণ ছিল রোম উপসাগরে খৃষ্টানদের সম্মিলিত বাহিনীর নৌ-বহরে। ফ্রাংকের কিছুসংখ্যক সৈন্য মিসরে প্রবেশ করে হামলা করতে চেয়েছিল এবং আমাদের সুদানী বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতার জন্য মিসরের সীমান্তে এসে উপনীত হয়েছিল। সুলতান নূরুদ্দীন জঙ্গী সেই বাহিনীর উপর আক্রমণ করে তাদের সব পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দিয়েছেন এবং রাজা ফ্রাংকের বিস্তর এলাকায় নিজের দখল প্রতিষ্ঠা করেছেন। ক্রুসেডারদের থেকে জরিমানা বাবদ কিছু অর্থও আদায় করেছেন।’ বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী।

তাঁবুর ভিতরে পায়চারী করতে শুরু করেন সুলতান সালাহুদ্দীন। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বললেন— ‘সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী থেকে আমি ওখানকার এমন পরিস্থিতির কথা জানতে পেরেছি, যা আমাকে অস্থির করে রেখেছে।’

‘খৃষ্টানরা কি ওখানে পাল্টা আক্রমণ করবে বলে মনে করেন?’ জিজ্ঞেস করেন আলী বিন সুফিয়ান।

‘আমার খৃষ্টানদের আক্রমণের পরোয়া বিন্দুমাত্র নেই। অস্থিরতা আমার এই জন্য যে, কাফিরদের আক্রমণ প্রতিহত করার দায়িত্ব যাদের, তারা মদের মটকায় ডুবে আছে। ইসলামের দুর্গের প্রহরীরা বন্দী হয়ে আছে হেরেমে। নারীর চুল বেঁধে ফেলেছে তাদের পা। চাচা আসাদুদ্দীন শেরেকোহকে ইসলামের ইতিহাস কখনও ভুলতে পারবে না। হায়! এ সময়ে যদি তিনি জিন্দা থাকতেন! যুদ্ধের ময়দানে তিনিই আমাকে টেনে এনেছিলেন। আমি বড় কঠিন কঠিন মুহূর্ত দেখেছি। চাচা শেরেকোহর বাহিনীর অগ্রগামী ইউনিটের আমি কমাণ্ড করেছি। তার সঙ্গে খৃষ্টানদের অবরোধে আমি তিন মাস কাটিয়েছি। চাচা সব সময় আমাকে সবক দিতেন, বেটা! কখনও ভীত হয়ো না, ভয়-ভীতি থেকে নিজেকে সদা মুক্ত রাখবে। মহান আল্লাহর সাহায্যের প্রতি আস্থা রাখবে। ইসলামের পতাকা উচ্চে ধরে রাখবে সব সময়। আমি শেরেকোহর কমাণ্ডে মিসরী এবং খৃষ্টানদের সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। ইস্কান্দারিয়ায় অবরোধে কাটিয়েছি দীর্ঘদিন। আমার মাথার উপর পরাজয় এসে গিয়েছিল। আমার মুষ্টিমেয় সৈন্যের মনোবল ভেঙ্গে যেতে শুরু করেছিল। কিন্তু তারপরও বিজয় আমার পদচুম্বন করেছে। কিভাবে তা সম্ভব হয়েছিল, কী করে আমি আমার সৈন্যদের মনোবল চাঙ্গা রেখেছিলাম, আল্লাহই তা ভাল জানেন। চাচা শেরেকোহ আক্রমণ করে সেই অবরোধ ভেঙ্গে ফেলেছিলেন। সেই কাহিনী তো তুমি ভাল করেই জান আলী! ঈমান-বিক্রেতারা কাফিরদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আমাদের বিরুদ্ধে কিরূপ ঝড় সৃষ্টি করেছিল, তা-ও তোমার অজানা নয়। কিন্তু এমন কঠিন মুহূর্তেও আমি সাহস হারাইনি, ভয় পাইনি।’

‘আমার সবকিছু মনে আছে সুলতান! এত যুদ্ধ-বিগ্রহ আর হত্যা-লুণ্ঠনের পর আশা করেছিলাম, এবার মিসরীরা সোজা পথে ফিরে আসবে। কিন্তু এক গাদ্দার মরে তো আরেক গাদ্দার এসে তার স্থান দখল করে। আমি বিশেষভাবে যে বিষয়টি প্রত্যক্ষ করছি, তা হল, মিসরে এ যাবত যে কজন গাদ্দার আত্মপ্রকাশ করেছে, তারা সবাই দুর্বল খেলাফতের সৃষ্টি। ফাতেমী খেলাফত যদি হেরেমে ঢুকে না পড়ত, সুন্দরী নারীর আঁচলে বাধা না পড়ত, তাহলে আপনি আজ খৃষ্টানদের সঙ্গে লড়াই করতেন ইউরোপে, তাদেরই ভূখণ্ডে। কিন্তু আমাদের গাদ্দার বন্ধুরা এই ক্রুশ বনাম চাঁদ-তারার লড়াইকে মিসরের সীমানা অতিক্রম করতে দিচ্ছে না। রাজা যখন ভোগ-বিলাসে ডুবে যান, তখন প্রজাদের মধ্যে কিছু লোক রাজত্বের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। শক্তি ও সাহায্য লাভ করে তারা কাফিরদের থেকে। ঈমান বেচা-কেনায় এত অন্ধ হয়ে পড়ে যে, তারা কাফিরদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং আপন কন্যাদের সম্ভ্রম বিকিয়ে দিতে পর্যন্ত কুণ্ঠাবোধ করে না।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

‘আমি সব সময় এদেরকেই ভয় পাই। আল্লাহ না করুন, ইসলামের নাম যদি কখনও ডুবে যায়, ডুববে মুসলমানদেরই হাতে। আমাদের ইতিহাস গাদ্দারদের ইতিহাসে পরিণত হতে যাচ্ছে। আমার মন বলছে, একদিন মুসলমানরা নিজেদের ভিটেমাটি কাফিরদের হাতে তুলে দেবে। মুসলমান যদি কোথাও বেঁচে থাকে, সেখানে মসজিদ থাকবে কম, গান-বাজনা ও বেশ্যালয় থাকবে বেশী। আমাদের মুসলিম পুরুষরা বুকে ক্রুশ ঝুলিয়ে গর্ববোধ করবে আর মেয়েরা আধুনিকতা-স্বাধীনতার নামে বেহায়ার মত রাস্তায় চলাচল করবে। আমি মুসলিম মিল্লাতের পতনের ঘনঘটা শুনতে পাচ্ছি আলী! তবে হাল ছাড়া যাবে না। তুমি তোমার বিভাগকে আরও সুসংহত, শক্তিশালী কর। দুশমনের এলাকায় গিয়ে কমাণ্ডে আক্রমণ এবং তথ্য সংগ্রহের জন্য শক্ত-সামর্থ ও বিচক্ষণ যুবকদের খুঁজে বের কর। খৃষ্টানরা দিন দিন শক্তিশালী ও সক্রিয় হচ্ছে। তোমাকে এক্ষুণি যে কাজটি করতে হবে, তা হল, সমুদ্র থেকে যেসব খৃষ্টান সেনা জীবনে রক্ষা পেয়েছে, তাদের অধিকাংশ আহত। যারা আহত নয়, তারাও দিনের পর দিন সমুদ্রে সাঁতার কাটার ফলে আহতদের অপেক্ষাও বেশী বিপর্যস্ত। তাদের সকলের চিকিৎসা চলছে। আমি তাদের সকলকে দেখেছি। তুমি তাদের এক নজর দেখে নাও এবং জরুরী তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা কর।’ বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী।

দারোয়ানকে ডেকে নাস্তা আনতে বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন। তারপর আলী বিন সুফিয়ানের প্রতি মুখ ফিরিয়ে বলতে শুরু করলেন— ‘গতকাল কয়েকজন আহত পুরুষ ও কয়েকটি মেয়েকে আমার সামনে হাজির করা হয়েছিল। ছয়জন সমুদ্র থেকে উদ্ধার পাওয়া কয়েদী। তাদের একজনের প্রতি আমাদের সন্দেহ হয়, লোকটা সাধারণ সেপাই নয়। পদস্থ কোন অফিসার বোধ হয়। তুমি সর্বাগ্রে তার সাথে কথা বল। আর পাঁচজন ব্যবসায়ী সাতটি খৃষ্টান মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল।’

ব্যবসায়ীরা সুলতান সালাহুদ্দীনকে যা বলেছিল, তিনি আলী বিন সুফিয়ানকে তা শোনান। তিনি বললেন, ‘আমি মেয়েগুলোকে মূলত বন্দী করেছি, যদিও তাদেরকে আশ্রয় দেওয়ার কথা বলেছি। এই যে মেয়েগুলো বলল, তারা গরীব পরিবারের সন্তান, জ্বলন্ত জাহাজ থেকে নামিয়ে একটি নৌকায় বসিয়ে তাদের ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং নৌকা তাদেরকে কূলে এনে ফেলেছে, এসব বক্তব্য আমাকে সন্দেহে ফেলে দিয়েছে। আমি তাদেরকে একটি পৃথক তাঁবুতে রেখেছি এবং প্রহরার জন্য একজন সান্ত্রী দাঁড় করিয়ে রেখেছি। নাস্তাটা খেয়েই তুমি ঐ কয়েদি আর মেয়েগুলোর কাছে চলে যাও।’

অবশেষে সুলতান সালাহুদ্দীন মুখে মুচকি হাসি টেনে বললেন— ‘গতকাল দিনের বেলা আমি উপকূলে টহল দিচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার প্রতি কোন দিক থেকে যেন একটা তীর ছুটে আসে। তীরটি আমার দু পায়ের মাঝে বালিতে এসে বিদ্ধ হয়।’

সালাহুদ্দীন আইউবী তীরটি আলী বিন সুফিয়ানকে দেখিয়ে বললেন, ‘এলাকাটা ছিল পর্বতময়। রক্ষীরা চারদিকে খোঁজাখুঁজি করেও কোন তীরান্দাজের দেখা পায়নি। পাওয়া গেছে এই পাঁচজন ব্যবসায়ী। রক্ষীরা তাদেরকে আমার কাছে ধরে নিয়ে আসে। এই সাতটি মেয়েকে তারা আমার হাতে তুলে দিয়ে চলে গেছে।’

‘কী বললেন, তারা চলে গেছে! আপনি তাদের যেতে দিলেন!’ বিস্মিত কণ্ঠে বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

‘রক্ষীরা তাদের তল্লাশী নিয়েছিল, তাদের কাছে সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া যায়নি।’ বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন।

তীরটি হাতে নিয়ে নিরীক্ষা করে দেখেন আলী বিন সুফিয়ান। বললেন, ‘সুলতান আর গুপ্তচরের দৃষ্টিতে অনেক পার্থক্য। সর্বাগ্রে আমি ঐ ব্যবসায়ীদের ধরার চেষ্টা করব।’

আলী বিন সুফিয়ান সুলতান সালাহুদ্দীনের তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসলে দারোয়ান বলল, ‘এই কমাণ্ডার সংবাদ নিয়ে এসেছেন, কাল যে সাতটি মেয়েকে আটকে রাখা হয়েছিল, তাদের একজনের খোঁজ নেই। সুলতানকে সংবাদটা জানানোর প্রয়োজন আছে কি?’

গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন আলী বিন সুফিয়ান। সংবাদদাতা কমাণ্ডার আলীর নিকটে এসে বলল— ‘একটি খৃষ্টান মেয়ের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা, অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ হল, ফখরুল মিসরী নামক কমাণ্ডার রাত থেকে উধাও। রাতের সান্ত্রীরা জানিয়েছে, ফখরুল মিসরী মেয়েদের তাঁবুর নিকট গিয়েছিল। সেখান থেকে গেছে জখমীদের তাঁবুর দিকে। তারপর আর তাকে দেখা যায়নি। রাতে সে টহল দিতে বেরিয়েছিল।’

খানিকটা চিন্তা করে আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘এ সংবাদ সুলতানকে এখনই দিও না। ফখরুল মিসরী রাতের যে সময়ে ডিউটিতে গিয়েছিল, তখনকার সব সান্ত্রীকে সমবেত কর।’ আলী সুলতান সালাহুদ্দীনের রক্ষী বাহিনীর কমাণ্ডারকে বললেন, ‘গতকাল যে রক্ষী ইউনিটটি সুলতানের সঙ্গে উপকূল পর্যন্ত গিয়েছিল, তাদেরও আসতে বলল।’

রক্ষীরা সেখানেই উপস্থিত ছিল। সামনে এগিয়ে আসে চারজন। আলী বিন সুফিয়ান বললেন— ‘কাল যেখানে তোমরা ব্যবসায়ী ও মেয়েদের দেখেছিলে, এক্ষুণি সেখানে চলে যাও। ব্যবসায়ীরা যদি এখনও সেখানে থাকে, তাহলে তাদের আটক করে ফেলল। আর যদি না পাও, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এস।’

রক্ষীরা রওনা হয়ে যায়। আলী বিন সুফিয়ান মেয়েদের তাঁবুর নিকট চলে যান। ছয়টি মেয়ে তাঁবুর বাইরে বসে আছে। সান্ত্রী দাঁড়িয়ে। মেয়েদের এক সারিতে দাঁড় করান আলী বিন সুফিয়ান। আরবীতে জিজ্ঞেস করেন— ‘সপ্তম মেয়েটি কোথায়?’

মেয়েরা পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। মাথা নাড়ে। আলী বিন সুফিয়ান বললেন— ‘তোমরা কি আমার ভাষা বুঝেছ?’

মেয়েরা বিস্ময়ের সাথে আলীর প্রতি তাকিয়ে থাকে। আলী তাদের চেহারা ও হাবভাব দেখে সন্দেহে পড়ে যান। তিনি মেয়েগুলোর পিছনে গিয়ে দাঁড়ান। আরবীতে বলেন, ‘পরনের পোশাক খুলে এদের উলঙ্গ করে ফেল, চারজন হায়েনা চরিত্রের সেপাই ডেকে আন।’

চমকে উঠে মেয়েরা মোড় ঘুরে পিছন দিকে তাকায়। সমস্বরে কথা বলতে শুরু করে দু তিনজন। নিজেদের অলক্ষ্যে আরবীতেই বলছে তারা আমাদের সঙ্গে তোমরা এরূপ আচরণ করতে পার না। একজন বলল— ‘আমরা তো আর তোমাদের বিরুদ্ধে লড়ছি না।’

মুখ থেকে হাসি বেরিয়ে আসে আলী বিন সুফিয়ানের। বললেন— ‘আমি তোমাদের সঙ্গে অনেক ভাল ব্যবহার করব। এক ধমকেই আরবী বুঝাতে ও বলতে শুরু করেছে। বড় ভাল মেয়ে তোমরা। এবার ধমক ছাড়াই বলে দাও, সপ্তম মেয়েটি কোথায়?’

সকলেই অজ্ঞতা প্রকাশ করে। আলী বললেন— ‘এ প্রশ্নের যথাযথ জবাব আমি তোমাদের থেকে নিয়েই ছাড়ব। সুলতানকে বলেছিলে, তোমরা আরবী জান না। আর এখন কিনা আমাদের মতই আরবী বলছ। আমি কি তোমাদের এমনিতেই ছেড়ে দেব?’ আলী বিন সুফিয়ান সান্ত্রীকে বললেন— ‘এদেরকে তাঁবুর ভেতরে বসিয়ে রাখে।’

রাতের প্রহরী এসে গেছে। আলী বিন সুফিয়ান ফখরুল মিসরীর ডিউটির সময়কার প্রহরীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। মেয়েদের তাঁবুর প্রহরী জানায়, ‘ফখরুল রাতে তাকে, এখানে দাঁড় করিয়ে রেখে জখমীদের তাঁবু দিকে গিয়েছিল। খানিক পর আমি তার কণ্ঠ শুনতে পাই— কে তুমি? নীচে নেমে আসো। আমি সেদিকে দৃষ্টিপাত করে অন্ধকারে কিছুই দেখলাম না। সম্মুখে মাটির টিলার উপর ছায়ার মত কী যেন দেখলাম। পরক্ষণেই ছায়াটি অদৃশ্য হয়ে গেল।’

তৎক্ষণাৎ আলী বিন সুফিয়ান ছুটে গেলেন সেখানে। টিলাটি উপকূলের সন্নিকটে। বালুকাময় মাটি। একস্থানে দু মাপের দুটি পায়ের ছাপ পাওয়া গেল। একটি সামরিক বুট পরিহিত পুরুষের। অপরটি ছোট জুতার ছাপ মেয়েলি বলে মনে হল। মেয়েলি চিহ্নটি যেদিক থেকে এসেছে, আলী বিন সুফিয়ান ছুটে যান সেদিকে। এই চিহ্নটি তাকে নিয়ে যায় সেই তাঁবুর কাছে, যেখানে মুবী মিলিত হয়েছিল রবিনের সঙ্গে। আলী বিন সুফিয়ান তাঁবুর পর্দা তুলে ভেতরে ঢুকে যান।

এক এক করে জখমী কয়েদীদের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন আলী বিন সুফিয়ান। সকলের চেহারা পরিমাপ করেন তিনি। রবিন বসে আছে। আলী বিন সুফিয়ানকে দেখামাত্র কোঁকাতে শুরু করে সে। হঠাৎ ব্যথা উঠেছে তার। আলী বিন সুফিয়ান কাঁধে ধরে দাঁড় করিয়ে তাঁবুর বাইরে নিয়ে যান তাকে। জিজ্ঞেস করেন— ‘রাতে তোমার তাঁবুতে একটি কয়েদী মেয়ে এসেছিল। কেন এসেছিল?’ রবিন কোন জবাব না দিয়ে আলীর প্রতি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, যেন সে কিছুই বুঝছে না। আলী বিন সুফিয়ান ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন— ‘তুমি কি আমার ভাষা বুঝ দোস্ত! আমি কিন্তু তোমার ভাষা বুঝি এবং বলতেও পারি। তোমাকেও আমার ভাষায়ই জবাব দিতে হবে।’ কিন্তু রবিন অপলক চোখে তাকিয়েই আছে আলীর প্রতি। আলী বিন সুফিয়ান সান্ত্রীকে বললেন— ‘একে তাঁবুর বাইরে রাখ।’

আলী বিন সুফিয়ান তাঁবুতে প্রবেশ করেন। অন্যান্য কয়েদীদের তাদের ভাষায় জিজ্ঞেস করেন— ‘রাতে মেয়েটি এ তাঁবুতে কতক্ষণ ছিল? সত্য কথা বল, অযথা নিজেদের কষ্টে ফেল না।’

কথা বলছে না কেউ । ধমকি দেন আলী বিন সুফিয়ান। এবার এক জখমী বলল, ‘একটি মেয়ে রাতে তাঁবুতে এসেছিল এবং রবিনের শয্যায় বসে বা শুয়ে ছিল।’

এ লোকটি জ্বলন্ত জাহাজ থেকে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছিল। আগুন এবং পানি দুয়েরই লীলা দেখে এসেছে লোকটি। যত ভীত ততটা আহত নয়। তবে তৃতীয় আর কোন বিপদে পড়তে প্রস্তুত নয় সে। সে জানায়, রবিন ও আগত মেয়েটির মধ্যে কী কথাবার্তা হয়েছে, তা তার জানা নেই। মেয়েটি কে, তা-ও সে বলতে পারে না। রবিনের পদ কি, তাও তার অজানা। সে জানায়, ক্যাম্পে আসার পূর্ব পর্যন্ত লোকটি সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল। এখানে আসার পরই সে এভাবে কোঁকাতে শুরু করেছে।

এক প্রহরীর দিক-নির্দেশনায় আলী বিন সুফিয়ান সেই পাঁচ ব্যক্তিকে দেখার জন্য চলে যান, যারা বণিক বেশে কিছু দূরে তাঁবু ফেলে অবস্থান করছে। আলীর রক্ষীরা আলাদাভাবে এক স্থানে বসিয়ে রেখেছে তাদের। রক্ষীরা আলী বিন সুফিয়ানকে তথ্য প্রদান করে, কাল এদের নিকট দুটি উট ছিল; আজ আছে একটি। বিচক্ষণ গোয়েন্দা প্রধান আলীর জন্য এতটুকু ইঙ্গিতই যথেষ্ট। অপর উটটি কোথায় গেল, বণিকদের কাছে তার সন্তোষজনক কোন জবাব পাওয়া গেল না। অনুসন্ধানে নেমে পড়েন আলী বিন সুফিয়ান। উধাও হওয়া উটের পদচিহ্ন পেয়ে গেলেন তিনি। বণিকদের বললেন— ‘তোমরা সাধারণ কোন অপরাধে অপরাধী নও। অন্যায় তোমাদের গুরুতর। তোমরা গোটা একটি সাম্রাজ্য এবং তার সকল নাগরিকের জন্য বিপজ্জনক। তাই তোমাদের প্রতি আমি এতটুকু সহানুভূতি প্রদর্শন করতে পারি না। বল তো, তোমরা কি ব্যবসায়ী?’

‘হ্যাঁ, আমরা ব্যবসায়ী জনাব! আমরা নিরপরাধ।’ মাথা লেড়ে জবাব দেয় সকলে।

আলী বিন সুফিয়ান বললেন— ‘তোমাদের সকলের হাতের উল্টা দিকটা একটু দেখাও দেখি। সকলে নিজ নিজ হাত উল্টো করে আলী বিন সুফিয়ানের সামনে এগিয়ে ধরে। আলী সকলের বাঁ হাতের বৃদ্ধা ও তর্জনী আঙ্গুলের মাঝখানটা দেখেন এবং একজনের বাহু ধরে সামনে নিয়ে আসেন। বললেন— ‘ধনুক-তূনীর কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস বল!’

নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার প্রাণপণ চেষ্টা করে লোকটি। আলী বিন সুফিয়ান সুলতান সালাহুদ্দীনের এক রক্ষীকে নিজের কাছে ডেকে এনে তার বাঁ হাতের উল্টো দিকটা লোকটাকে দেখান। আঙ্গুলের গোড়ায় উল্টো পিঠে একটি দাগ আছে। তেমনি একটি দাগ বণিক লোকটির আঙ্গুলের পিঠেও বিদ্যমান। আলী বিন সুফিয়ান তাকে রক্ষী সম্পর্কে বলেন, ‘এ লোকটি সুলতান সালাহুদ্দীনের সেরা তীরান্দাজ। তার তীরন্দাজ হওয়ার প্রমাণ এই চিহ্ন।’

বণিক লোকটির আঙ্গুলের উল্টো পিঠে অস্পষ্ট ধরনের একটি চিহ্ন, যেন এ স্থানে বারবার কোন একটি বস্তুর ঘর্ষণ লেগেছে। এটি তীর ঘর্ষণের দাগ। তীর ধরা হয় ডান হাতে। ধনুক থাকে বাঁ হাতে। তীরের অগ্রভাগ থাকে আঙ্গুলের উপর। আর তীর ধনুক থেকে বের হওয়ার সময় আঙ্গুলে ঘর্ষণ লাগে। এমনি দাগ থাকে প্রত্যেক তীরন্দাজের হাতে আলী বিন সুফিয়ান লোকটিকে বললেন, ‘এই পাঁচজনের মধ্যে তুইই শুধু তীরান্দাজ। বল, ধনুক-তূনীর কোথায় রেখেছিস্?’

পাঁচজনই নীরব। আলী বিন সুফিয়ান পাঁচজনের একজনকে ধরে রক্ষীদের বললেন— ‘একে ঐ গাছটার সাথে বেঁধে রাখ।’

লোকটিকে একটি খেজুর গাছের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে বেঁধে রাখা হল। আলী বিন সুফিয়ান তার তীরান্দাজের কানে কানে কী যেন বললেন। তীরন্দাজ কাঁধ থেকে ধনুক নামিয়ে তীর সংযোজন করে এবং গাছের সঙ্গে বাঁধা লোকটিকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ে। তীর গিয়ে বিদ্ধ হয় লোকটির ডান চোখে। ছটফট করতে শুরু করে লোকটি। আলী বিন সুফিয়ান অপর চারজনকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে আর যে ক্রুশের সন্তুষ্টি অর্জনে এভাবে ছটফট করে করে জীবন দিতে প্রস্তুত আছ, ওর দিকে তাকাও।’ লোকটির প্রতি চোখ তুলে তাকায় তারা। লোকটি ছটফট করছে আর চীৎকার করছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে তার তীরবিদ্ধ চোখ থেকে।

‘আমি ওয়াদা দিচ্ছি, তোমাদেরকে সসম্মানে সমুদ্রের ওপারে পৌঁছিয়ে দেব। বল, অপর উটটিতে করে কে গেছে, কোথায় গেছে?’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

‘তোমাদের একজন কমাণ্ডার আমাদের একটি উট ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।’  জবাব দেয় একজন।

‘আর একটি মেয়েও।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

অল্পক্ষণের মধ্যেই আলী বিন সুফিয়ানের কৌশল লোকগুলো থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করে নেয় যে, তারা কারা। কিন্তু তারা একটি মিথ্যা কথা বলে যে, মেয়েটি রাতে তাঁবু থেকে পালিয়ে এসে বলেছিল, সুলতান সালাহুদ্দীন রাতে তাকে তার তাঁবুতে রেখেছিলেন এবং তিনি নিজেও মদপান করেন, মেয়েটিকেও পান করান। মেয়েটি পালিয়ে ভীত-সন্ত্রস্থ অবস্থায় এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। তাকে ধাওয়া করার জন্য ফখরুল মিসরী নামক এক কমাণ্ডার আসে এবং মেয়েটির বক্তব্য শুনে উটের পিঠে বসিয়ে তাকে জোরপূর্বক নিয়ে যায়। মেয়েটি সুলতান সালাহুদ্দীনের নামে যে অপবাদ আরোপ করেছিল, আলী বিন সুফিয়ানকে তার সব শোনায়।

আলী বিন সুফিয়ান মুচকি হেসে বললেন— ‘তোমরা পাঁচজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিক ও তীরন্দাজ। আর একটি মানুষ কিনা তোমাদের একটি মেয়েকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল এবং একটি উটও। নিতান্ত নির্বোধ না হলে একথা বিশ্বাস করবে কেউ?

লোকগুলোর নির্দেশনা মোতাবেক আলী বিন সুফিয়ান মাটিতে পুঁতে রাখা ধনুক ও তূনীর উদ্ধার করেন। তাঁবুতে পাঠিয়ে দেন চারজনকে। ছটফট করতে করতে মরে গেছে পঞ্চমজন।

উটের পদচিহ্ন চোখে পড়ছে স্পষ্ট। দশজন আরোহী ডেকে পাঠান আলী বিন সুফিয়ান। মুহূর্ত মধ্যে এসে পৌঁছে দশ আরোহী। সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিয়ে উটের পায়ের দাগ অনুসরণ করে রওনা হন তিনি।

কিন্তু উটের রওনা হওয়া আর আলী বিন সুফিয়ানের এই পশ্চাদ্ধাবনের মাঝে চৌদ্দ-পনের ঘণ্টার ব্যবধান। তদুপরি উটটি অতি দ্রুতগামীও বটে। দানা-পানি ছাড়া উট সবল ও তরতাজা থাকতে পারে অন্তত ছয়-সাত দিন। তাই পথে বিশ্রামেরও প্রয়োজন নেই। তার বিপরীতে পথে ঘোড়াগুলোর দানা-পানি ও বিশ্রামের প্রয়োজন পড়বে একাধিকবার। ফলে চৌদ্দ-পনের ঘণ্টার ব্যবধান কাটিয়ে ফখরুল মিসরীকে ধরা সম্ভব হল না আলীর। ধাওয়া খাওয়ার আশঙ্কায় পথে তেমন থামেনি ফখরুল।

পথে একটি বস্তু চোখে পড়ে আলী বিন সুফিয়ানের। একটি থলে। ঘোড়া থামিয়ে নেমে থলেটি তুলে নেন তিনি। খুলে দেখেন। খাদ্যদ্রব্য পাওয়া গেল তাতে। থলেটির মধ্যে ছোট্ট আরেকটি পুটুলি। তার মধ্যেও কিছু আহার্য বস্তু। খাবারগুলো নাকের কাছে ধরেই আলী বিন সুফিয়ান বুঝে পেলেন, এতে হাশীশ মেশানো। পথে দু জায়গায় তিনি এমন কিছু আলামত পান, যাতে বুঝা গেল, এখানে উট থেমেছিল এবং আরোহী উপবেশন করেছিল। খেজুরের বীচি, ফলের দানা ও ছিলকা ছড়িয়ে আছে এদিক-সেদিক। থলেটি সন্দেহে ফেলে দেয় আলী বিন সুফিয়ানকে। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি, হাশীশের নেশায় ফেলে মেয়েটি ফখরুল মিসরীকে তার রক্ষী বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তথাপি তিনি থলেটি নিজের কাছে রেখে দেন। কিন্তু থলের অনুসন্ধান ও অবস্থান বেশ সময় নষ্ট করে দিয়েছে তাঁর।

* * *