কক্ষে সুলতান সালাহুদ্দীন একাকী দাঁড়িয়ে। তিনি মিগনানা মারিউস ও মুবীকে বসালেন। মুবীর প্রতি তাকিয়ে বললেন— ‘তোমার বাবা কি জন্মগতভাবেই বোবা ও বধির?’
‘জি, মুহতারাম সুলতান! এটা তার জন্মগত ত্রুটি।’ জবাব দেয় মুবী।
সুলতান সালাহুদ্দীন বসছেন না। কক্ষময় পায়চারী করছেন আর কথা বলছেন। তিনি বললেন— তোমার আর্জি-ফরিয়াদ আমি শুনেছি। তোমাদের ব্যথায় আমিও ব্যথিত। এখানে আমি তোমাদের জমিও দেব, বাড়িও দেব। শুনেছি, তুমি নাকি আরও কিছু বলতে চাও? বল, কী সে কথা?’
‘আল্লাহ আপনার মর্যাদা বুলন্দ করুন। আপনি নিশ্চয় শুনেছেন যে, আমাকে কেউ বিয়ে করছে না। মানুষ আমাকে হেরেমের চোষা হাড্ডি আর নিংড়ানো ছোবড়া, চরিত্রহীনা, বেশ্যা বলে আখ্যা দেয়। তারা বলে, আমার পিতা নাকি আমাকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এখন আপনি আমাকে জমি-ঘর তো দেবেন ঠিক, কিন্তু আমার একজন স্বামীরও প্রয়োজন, যিনি আমার ইজ্জত-সম্ভ্রমের সংরক্ষণ করবেন। অভয় দিলে আপনার নিকট আমি এ আর্জিও পেশ করব যে, বিয়ের ব্যবস্থা করতে না পারলে আপনিই আমাকে আপনার হেরেমে রেখে দিন। আপনি আমার বয়স, রূপ-যৌবন ও দেহ-গঠন দেখুন। বলুন, আমি কি আপনার যোগ্য নই?’
একথা বলেই মুবী এক হাত মিগনানা মারিউসের কাঁধে রেখে অপর হাত নিজের বুকে স্থাপন করে এবং চোখে সুলতান সালাহুদ্দীনের প্রতি ইঙ্গিত করে।
মিগনানা মারিউস দু হাত একত্র করে সুলতান সালাহুদ্দীনের প্রতি বাড়িয়ে ধরে, যেন সে বলছে, আপনি দয়া করে আমার মেয়েটাকে বরণ করে নিন।
‘আমার কোন হেরেম নেই বেটী! আমি রাজ্য থেকে হেরেম, পতিতালয় এবং মদ উৎখাত করছি। বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন।
কথা বলতে বলতে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী নিজের পকেট থেকে একটি মুদ্রা বের করলেন এবং হাতে নিয়ে মুদ্রাটি নাড়াচাড়া করছেন আর ‘আমি নারীর ইজ্জতের মুহাফিজ হতে চাই’ বলতে বলতে দুজনের পিছনে চলে যান এবং হঠাৎ মুদ্রাটি হাত থেকে ফেলে দেন। টন করে একটা শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে মিগনানা মারিউস চকিতে পেছন ফিরে তাকিয়েই অমনি মুখ ফিরিয়ে নেয়।
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী নিজের কোমরবন্ধ থেকে একটি খঞ্জর বের করে আগাটা মিগনানা মারিউসের ঘাড়ে তাক করে ধরে মুবীকে বললেন— ‘লোকটা আমার ভাষা বুঝে না। একে বল, হাত থেকে অস্ত্র ফেলে দিতে। তোমার বাবাকে বল, যেন একটুও নড়াচড়া না করে। অন্যথায় তোমরা দুজন এক্ষুনি লাশে পরিণত হরে।’
ভয়ে-বিস্ময়ে মুবীর চোখ দুটো কোঠর থেকে বেরিয়ে আসে। কিন্তু তারপরও মেয়েটি অভিনয়ের পরাকাষ্ঠা দেখাবার চেষ্টা করে এবং বলে আমার বাবাকে ভয় দেখিয়ে আপনি আমাকে কব্জা করতে চাচ্ছেন কেন? আমি তো নিজেই নিজেকে আপনার সামনে পেশ করে দিলাম।’
সুলতান সালাহুদ্দীনের খঞ্জরের আগা মিগনানা মারিউসের ঘাড়েই ধরা। সে অবস্থায়ই তিনি বললেন— ‘যুদ্ধক্ষেত্রে যখন তুমি আমার মুখোমুখি হয়েছিলে, তখন আমার ভাষা বলনি। এখন এত দ্রুত আমার ভাষাটা শিখে ফেললে তুমি ……….! একে এক্ষুণি অস্ত্র ফেলতে বল।’
মুবী তার ভাষায় মিগনানা মারিউসকে কি যেন বলল। সাথে সাথে সে চোগার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একটি খঞ্জর বের করল। লম্বায় ঠিক সুলতান সালাহুদ্দীনের খঞ্জরের সমান। সুলতান সালাহুদ্দীন হাত থেকে তার খঞ্জরটা নিয়ে নেন এবং ঘাড়ে তাক করে নিজের খঞ্জরটা সরিয়ে ফেলে বললেন— ‘অপর ছয়টি মেয়ে কোথায়?’
‘আপনি আমাকে চিনতে ভুল করেছেন মহামান্য সুলতান! আমার সঙ্গে আর কোন মেয়ে নেই। আপনি কোন্ মেয়েদের কথা বলছেন?’ কম্পিত কণ্ঠে বলল মুবী।
সুলতান সালাহুদ্দীন বললেন— ‘আল্লাহ আমাকে চোখ দিয়েছেন, মেধাও দিয়েছেন। একবার কাউকে দেখলে তার চেহারাটা আমার হৃদয়পটে অঙ্কিত হয়ে যায়। অর্ধেকটা নেকাবে ঢাকা তোমার এই মুখাবয়ব এর আগেও আমি দেখেছি। তোমরা যে কাজে এসেছে, তার যোগ্যতা ও ক্ষমতা তোমাদের নেই। আল্লাহ তোমাদেরকে সে মেধা দেননি। সরাইখানায় তোমরা দুজন ছিলে স্বামী-স্ত্রী। এবানে এসে হয়েছে পিতা-কন্যা। বাইরে ঘোড়ার নিকট দণ্ডায়মান তোমাদের সঙ্গীটিও তোমাদের ভৃত্য নেই। লোকটি এখন সালাহুদ্দীনের বন্দী।
কৃতিত্বটা আলী বিন সুফিয়ানের। মুবী তাঁকে বলেছিল, তারা সরাইখানায় এসে উঠেছে। দুজনকে নিজের কক্ষে বসিয়ে রেখে বের হয়েই ঘোড়ায় চড়ে ছুটে গিয়েছিলেন সেখানে। মুবী ও মিগনানা মারিউসের আকৃতির বিবরণ দিয়ে জিজ্ঞেস করলে কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা দুজন স্বামী-স্ত্রী। সঙ্গের লোকটি তাদের ভূত্য। তারা আরও জানায়, এখানে উঠে লোক দুটো বাজার থেকে কিছু কাপড় ক্রয় করে এনেছিল। তন্মধ্যে মেয়েটির বোরকার ন্যায় চোগা এবং জুতাও ছিল।
এতটুকু তথ্য পাওয়ার পর আলী বিন সুফিয়ান আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন। তিনি কক্ষের তালা ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করেন। তল্লাশী চালিয়ে এমন কিছু বস্তু উদ্ধার করেন, যা তাঁর সন্দেহকে দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত করে।
সুলতান সালাহুদ্দীনের সঙ্গে তাদের সাক্ষাতের মতলব বুঝে ফেলেন আলী বিন সুফিয়ান। তিনি ফিরে এসে তাদের ঘোড়াগুলোকে নিরীক্ষা করে দেখে গিয়েছিলেন। বেশ উন্নত জাতের ঘোড়া। সরাইখানার কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞেস করে আলী বিন সুফিয়ান জানতে পারেন, এরা তিনজন এসেছিল উটে চড়ে। মেয়েটি এই ঘোড়া দুটো সংগ্রহ করায়। বলেছিল, আমাদের অতি উন্নত ও দ্রুতগামী দুটো ঘোড়ার প্রয়োজন। কর্তৃপক্ষ আরও জানায়, মেয়েটির স্বামী বোবা। ভৃত্যটিও বোধ হয় কথা বলতে পারে না। এখানে এসে অবধি দুজনের কেউ কারও সঙ্গে কথা বলেনি। যা বলেছে সব মেয়েটিই বলেছে।
আলী বিন সুফিয়ান যখন ফিরে আসেন, ততক্ষণে বৈঠক শেষ হয়ে গেছে। সোজা চলে যান তিনি সুলতানের কাছে। তাঁকে আগন্তুকদের প্রসঙ্গে অবহিত করেন, তারা তাঁকে যা বলেছে তাও শোনান এবং ইতিমধ্যে সরাইখানা থেকে যেসব তথ্য এনেছেন, তাও সুলতানের কানে দেন। তাদের কক্ষ তল্লাশী করে সন্দেহজনক যা যা পেয়েছেন, তাও দেখান এবং নিজের অভিমত ব্যক্ত করেন যে, ‘আমি নিশ্চিত, তারা আপনাকে হত্যা করতে এসেছে। সেজন্যই আপনার সঙ্গে একান্তে সাক্ষাৎ করা তাদের এত প্রয়োজন। আমার প্রবল ধারণা, তারা পরিকল্পনা করে এসেছে, আপনাকে খুন করে বেরিয়ে যাবে এবং অন্যরা টের পেতে না পেতে দ্রুতগামী ঘোড়ায় চড়ে ততক্ষণে শহর ত্যাগ করে চলে যাবে। এও হতে পারে, এই সুন্দরী মেয়েটির ফাঁদে ফেলে আপনার শয়নকক্ষেই তারা আপনাকে হত্যা করতে চায়।’
ভাবনায় পড়ে গেলেন সুলতান। ক্ষণকাল মৌন থেকে বললেন— ‘এখনই ওদেরকে গ্রেফতার করো না; আগে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।’
আলী বিন সুফিয়ান তাদেরকে সুলতানের কক্ষে পাঠিয়ে দিলেন এবং নিজে দরজা ঘেঁষে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর কমাণ্ডারকে ডেকে বললেন— ‘ঐ ঘোড়া দুটোকে আমাদের ঘোড়ার সঙ্গে বেঁধে যিনগুলো খুলে রাখ আর সঙ্গের লোকটাকে তোমাদের প্রহরায় বসিয়ে রাখ। তল্লাশী করে দেখ, লোকটার সঙ্গে অস্ত্র আছে কিনা। থাকলে নিয়ে নাও।’
নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করা হল। মিগনানা মারিউসের সঙ্গী গ্রেফতার হল, তল্লাশী নেওয়া হল। পোশাকের মধ্যে লুকানো একটি খঞ্জর পাওয়া গেল। ঘোড়া দুটোও জব্দ করা হল।
সুলতান সালাহুদ্দীন তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে হাত থেকে একটি মুদ্রা নীচে ফেলে দিয়ে নিশ্চিত হলেন যে, মেয়েটির সঙ্গের লোকটি বধির নয়। মুদ্ৰাপতনের শব্দ হওয়া মাত্র সে চকিতে পিছন ফিরে তাকিয়েছিল।
○ ○ ○
সুতান সালাহুদ্দীন আইউবী গম্ভীর কণ্ঠে মেয়েটিকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘তাকে বল, আমার জীবন খৃষ্টানদের হাতে নয়— জীবন আমার খোদার হাতে।’
মুবী তার নিজের ভাষায় মিগনানা মারিউসকে কথাটা বললে সে চমকিত হয়ে মুবীকে কী যেন বলল। মুবী সুলতান সালাহুদ্দীনকে বললেন, ‘ইনি জিজ্ঞেস করছেন, আপনারও কি খোদা আছেন, মুসলমানও কি খোদায় বিশ্বাস করে?’
সুলতান সালাহুদ্দীন বললেন— ‘তাকে বল, মুসলমান সেই খোদাকে বিশ্বাস করে, যিনি নিজে সত্য এবং সত্যের অনুসারীদের ভালবাসেন। আমাকে কে বলে দিল যে, তোমরা আমাকে হত্যা করতে এসেছ? বলেছেন আমার খোদা। তোমার খোদা যদি সত্য হত, তাহলে তোমার খঞ্জর আমাকে শেষ করে ফেলত। কিন্তু আমার খোদা তোমার হাতের খঞ্জরটি আমার হাতে এনে দিয়েছেন। এই বলে তিনি পার্শ্ব থেকে একটি তরবারী ও কিছু জিনিসপত্র বের করে তাদের দেখিয়ে বললেন— এ তরবারী ও এই জিনিসগুলো তোমাদের। সমুদ্রের ওপার থেকে তোমরা এগুলো নিয়ে এসেছিলে। কিন্তু তোমার পৌঁছার আগেই এগুলো আমার কাছে পৌঁছে গেছে।’
বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে উঠে দাঁড়ায় মিগনানা মারিউস। চোখ দুটো কোঠর থেকে বেরিয়ে এসেছে তার। এ পর্যন্ত যত কথা হয়েছে, সব হয়েছে মুবীর মাধ্যমে। এবার নিজেই কথা বলতে শুরু করে সে। খোদা সম্পর্কে সুলতান সালাহুদ্দীনের কথাগুলো শুনে আবেগ্নাপুত কণ্ঠে নিজের ভাষায় বলে ওঠে— ‘এ লোকটিকে সঠিক বিশ্বাসের অনুসারী বলে মনে হয়। আমি তার জীবন নিতে এসেছিলাম; কিন্তু এখন আমারই জীবন তার হাতে। তাকে বল, তোমার বুকে যে খোদা আছেন, তাকে আমাকে একটু দেখাও, আমি তার সেই খোদাকে এক নজর দেখতে চাই, যিনি বলে দিয়েছেন, আমরা তাকে হত্যা করতে এসেছি।’
এত দীর্ঘ আলাপচারিতার সময় নেই সুলতান সালাহুদ্দীনের; নেই প্রয়োজনও। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুজনকে জল্লাদের হাতে তুলে দেওয়াই ছিল যুক্তিযুক্ত। কিন্তু লোকটাকে বিধ্বস্ত ও বিভ্রান্ত বলে মনে হল তার কাছে। সুলতানের কাছে মনে হল, লোকটা পাগল না হলেও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তাই মিগনানা মারিউসের সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ কথা বলতে শুরু করেন তিনি।
ইত্যবসরে ভিতরে প্রবেশ করেন আলী বিন সুফিয়ান। সুলতান কি হালে আছেন, তিনি দেখতে এসেছেন। সুলতান সালাহুদ্দীন স্মিত হেসে বললেন— ‘কোন অসুবিধা নেই আলী! তার থেকে আমি খঞ্জর নিয়ে নিয়েছি।’ প্রশান্তির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বের হয়ে যান আলী বিন সুফিয়ান।
মিগনানা মারিউস মুবীকে বলল, ‘সুলতানকে বল, আমার দেহ থেকে মাথাটা বিচ্ছিন্ন করার আগে আমি তাকে আমার জীবন-কাহিনী শোনানোর একটু সময় চাই। অনুমতি পেয়ে মিগনানা মারিউস আগের রাতে তার কমাণ্ডার ও সঙ্গীদের যে আত্মকাহিনী শুনিয়েছিল, সুলতান সালাহুদ্দীনকে আনুপুংখ তা শোনায়। সুলতান সালাহুদ্দীন তন্ময় হয়ে শ্রবণ করেন তার সেই করুণ কাহিনী। তারপর যীশুখৃষ্টের প্রতিকৃতির প্রতি, কুমারী মরিয়মের ছবির প্রতি এবং পাদ্রীদের মাধ্যম ছাড়া যে খোদার সঙ্গে কথা বলা যায় না, তার প্রতি তীব্র বিরাগ প্রকাশ করে সে বলল— ‘আমার মৃত্যুর আগে আপনি আপনার খোদার একটি ঝলক দেখিয়ে দিন। আমার খোদা আমার পুত্র-কন্যাদের না খাইয়ে মেরে ফেলেছে, কেড়ে নিয়েছে আমার মায়ের দৃষ্টিশক্তি। মদ্যপ হায়েনাদের হাতে তুলে দিয়েছে আমার নিষ্পাপ সুন্দরী বোনকে। আর ত্রিশটি বছরের জন্য আমাকে নিক্ষেপ করেছে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। সেখান থেকে বের হয়ে এখন আমি নিপতিত হয়েছি মৃত্যুর মুখে। মহামান্য সুলতান! আমার জীবন এখন আপনার হাতে। আমায় সত্য খোদাকে একটু দেখিয়ে দিন, আমি তাঁর সমীপে ফরিয়াদ জানাব, ন্যায় বিচার প্রার্থনা করব।’
সুলতান সালাহুদ্দীন বললেন— ‘তোমার জীবন আমার হাতে নয়— আমার আল্লাহর হাতে। অন্যথায় এতক্ষণে থাকতে তুমি আমার জল্লাদের কব্জায়। যে খোদা তোমার থেকে আমার তরবারীকে ফিরিয়ে রেখেছেন, তার দর্শন লাভে আমি তোমায় ধন্য করব। কিন্তু তোমাকে সে খোদার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। অন্যথায় তিনি তোমার আকুতি শুনবেন না। ন্যায় বিচারও পাবে না কোনদিন।’
সুলতান সালাহুদ্দীন মিগনানা মারিউসের খঞ্জরটি ছুঁড়ে মারেন তার কোলে। নিজে তার কাছে গিয়ে পিঠটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে যান। মুবীকে উদ্দেশ করে বললেন— ‘তাকে বল, আমি আমার জীবনটা তার হাতে অর্পণ করছি। পিঠে খঞ্জর বিদ্ধ করে আমাকে হত্যা করতে বল।’ খঞ্জরটি হাতে তুলে নেয় মিগনানা মারিউস। নেড়ে-চড়ে গভীর দৃষ্টিতে দেখে অস্ত্রটি। দৃষ্টি বুলায় সুলতান সালাহুদ্দীনের পিঠে। তারপর উঠে ধীরে ধীরে চলে যায় সুলতান সালাহুদ্দীনের সামনে। তাঁকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত নিরীক্ষা করে দেখে। হাতটা কেঁপে উঠে মিগনানা মারিউসের। হাতের খঞ্জরটি রেখে দেয় সুলতানের পায়ের উপর। বসে পড়ে হাটু গেড়ে। সুলতানের ডান হাতটা টেনে ধরে চুমু খেয়ে কেঁদে উঠে হাউমাউ করে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে মুবীকে বলে, ‘জিজ্ঞেস কর, ইনি নিজেই কি খোদা, নাকি নিজের বুকের মধ্যে খোদাকে বেঁধে রেখেছেন। তার খোদাকে আমায় একটু দেখাতে বল।’
মিগনানা মারিউসের দু বাহু ধরে তুলে দাঁড় করান সুলতান সালাহুদ্দীন। বুকে জড়িয়ে নিয়ে নিজ হাতে মুছে দেন তার বিগলিত অশ্রুধারা।
○ ○ ○
মিগনানা মারিউস একজন বিভ্রান্ত মানুষ। মুসলমানদের বিরুদ্ধে তার মনে ভরে দেওয়া হয়েছিল প্রচণ্ড ঘৃণা, ইসলামের বিরুদ্ধে ঢেলে দেওয়া হয়েছিল বিষ। কিন্তু অবস্থাবৈগুণ্যে সে নিজ ধর্মের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছে। এক পর্যায়ে যে বিষয়টি তাকে এমনি এক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নামিয়েছে, তা এক প্রকার পাগলামী ও তৃষ্ণা। সুলতান সালাহুদ্দীনের দৃষ্টিতে সে নিরপরাধ। কিন্তু তিনি লোকটাকে মুক্তি না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন।
পক্ষান্তরে মুবী রীতিমত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি মেয়ে, জঘন্য এক গুপ্তচর। যে সাতটি মেয়ে সুদানীদের নিকট খৃষ্টানদের বার্তা নিয়ে এসেছিল এবং সুলতান সালাহুদ্দীনের বিরুদ্ধে সুদানীদের বিদ্রোহে নামিয়েছিল, মুবী তাদের একজন। মুবী ইসলামী সালতানাতের দুশমন, দেশের শত্রু। ইসলামী আইন তাকে ক্ষমা করে না।
মুবী ও মিগনানা মারিউসকে আলী বিন সুফিয়ানের হাতে সোপর্দ করেন সুলতান সালাহুদ্দীন। জিজ্ঞাসাবাদে অপরাধ স্বীকার করেছে দুজনই। স্বীকার করেছে, তারাই রসদ কাফেলা লুট করেছে, বন্দী গুপ্তচর মেয়েদের তারাই মুক্ত করে নিয়েছে। রক্ষী বাহিনী এবং বালিয়ান ও তার সঙ্গীদেরও হত্যা করেছে তারাই।
জিজ্ঞাসাবাদ চলে একটানা তিনদিন। এ সময়ে ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে যায় মিগনানা মারিউসের মস্তিষ্ক। সে সুলতান সালাহুদ্দীনকে জিজ্ঞেস করে— ‘মুবীকে মুসলমান বানিয়ে আপনার হেরেমে স্থান দিয়েছেন কি?’
‘আজ সন্ধ্যায় আমি তোমার এ প্রশ্নের উত্তর দেব।’ কিছুক্ষণ মৌন থেকে জবাব দেন সুলতান সালাহুদ্দীন।
সন্ধ্যার সময় সুলতান সালাহুদ্দীন মিগনানা মারিউসকে সঙ্গে করে খানিক দূরে একস্থানে নিয়ে যান। সেখানে পাশাপাশি বিছানো লম্বা দুটি তক্তা। সাদা চাদর দিয়ে কি যেন ঢেকে রাখা আছে তার উপরে। একটি কোণ ধরে টান দিয়ে চাদরটি সরিয়ে ফেলেন সুলতান সালাহুদ্দীন। অকস্মাৎ ফ্যাকাশে হয়ে যায় মিগনানা মারিউসের চেহারা। চোখের সামনে একটি তক্তায় মুবীর লাশ, অপরটিতে তার সঙ্গীর মৃতদেহ। সুলতান সালাহুদ্দীন মুবীর মাথা ধরে টান দেন সামনের দিকে। ধড় থেকে আলাদা হয়ে সরে আসে মাথাটা। তারপর মিগনানা মারিউসের প্রতি তাকিয়ে বলেন, ‘আমি মেয়েটাকে ক্ষমা করতে পারিনি। তাকে তুমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে, যাতে রূপের ফাঁদে পড়ে আমি আমার ঈমান হারাই। কিন্তু তার দেহটা আমার কাছে মোটেও ভাল লাগেনি। এ একটি অপবিত্র দেহ। তবে হ্যাঁ, এখন মেয়েটাকে বেশ ভাল লাগছে। আমি দুআ করি, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন।’
‘কিন্তু আমাকে ক্ষমা করলেন কেন সুলতান!’ আবেগাপ্লুত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে মিগনানা মারিউস।
‘কারণ, তুমি হত্যা করতে এসেছিলে আমাকে। আর ও এসেছিল আমার জাতির চরিত্র ধ্বংস করতে। তোমার সঙ্গীটিও বুঝে-শুনে পরিকল্পনা মোতাবেক এসেছিল মানুষ খুন করতে। আর তুমি এসেছে, আমার রক্ত ঝরিয়ে আল্লাহর দর্শন লাভ করতে।’ জবাব দেন সুলতান সালাহুদ্দীন।
অল্প কদিন পরই ‘সাইফুল্লাহ’য় পরিণত হয় মিগনানা মারিউস। পরবর্তীতে সুলতান সালাহুদ্দীনের দেহরক্ষী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে সে। সুলতান সালাহুদ্দীনের মৃত্যুর পর সাইফুল্লাহ বাকী জীবনের সতেরটি বছর কাটিয়ে দেয় সুলতানের কবরের পার্শ্বে। আজ কেউ জানে না, সাইফুল্লাহর সমাধি কোথায়!