মরুভূমিতে ঘোড়া চলবার সময় তেমন শব্দ হয় না। উট চলে সম্পূর্ণ নিঃশব্দে। চোখে না দেখলে মরুভূমিতে উটের আগমন টের পাওয়া যায় না। বালিয়ান যখন মুবীর সঙ্গে কথা বলছিল, তখন একটি উট ছোট্ট একটি বালির ঢিবির আড়ালে দাঁড়িয়ে তাদের গতিবিধি অবলোকন করছিল। কিন্তু তা টেরই পায়নি বালিয়ান। লোকটি খৃষ্টান কমাণ্ডো দলের একজন সদস্য। দলের কমাণ্ডার অত্যন্ত বিচক্ষণ লোক। বালিয়ানের তাঁবুর প্রায় আধা মাইল দূরে ছাউনি ফেলেছে সে। শিকার যে এত কাছে, মাত্র আধা মাইল দূরে, তা বুঝতেই পারেনি কমাণ্ডার। বুদ্ধি করে সে আশপাশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য তিন কমাণ্ডোকে দায়িত্ব দেয়, উটে চড়ে তারা আশপাশে ঘুরে-ফিরে দেখে আসবে এবং আশঙ্কার কিছু চোখে পড়লে কমাণ্ডারকে অবহিত করবে। উট ছিল এ কাজের উপযুক্ত বাহন।
তিন আরোহী চলে যায় তিন দিকে। এখানকার সমগ্র এলাকাটিই এমন যে, গোটা এলাকা যে কোন কাফেলার অবস্থানের জন্য বেশ উপযোগী। তাই এখানে এসেই কমাণ্ডার ভাবল, অন্য কোন কাফেলা এখানে ছাউনি ফেলে থাকতে পারে।
এক স্থানে আলোর মত কিছু একটা চোখে পড়ে এক আরোহীর। সেদিকে এগিয়ে চলে সে। বস্তুটি একটি মশাল; জ্বলছে বালিয়ানের অস্থায়ী তাঁবুতে। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে একটি টিলার পিছনে দাঁড়িয়ে যায়। টিলাটি উচ্চতায় এতটুকু যে, উটের উপর বসে টিলার উপর দিয়ে সম্মুখে দেখা সম্ভব।
ক্ষীণ আলোতে কয়েকটি মেয়ে চোখে পড়ে তার। সংখ্যায় ছয়জন। কয়েকজন পুরুষের সঙ্গে বসে গল্প করছে তারা। তাদের থেকে খানিক দূরে বসে আছে আরও এক জোড়া নারী-পুরুষ। কথা বলছে তারাও। একপাশে বাঁধা আছে কয়েকটি ঘোড়া।
খৃষ্টান আরোহী উটের মোড় ঘুরিয়ে দেয় পিছন দিকে। ধীর-সন্তর্পণে চলে কিছু পথ। তারপর এগিয়ে চলে দ্রুত। আধা মাইল পথ উটের জন্য কিছুই নয়। অল্পক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যায় ছাউনিতে, কমাণ্ডারের কাছে সুসংবাদ জানায়, শিকার আমাদের হাতের মুঠোয়। সময় নষ্ট না করে অপারেশনের প্রস্তুতি নেয় কমাণ্ডার। ঘোড়র পায়ের আওয়াজে শিকার সতর্ক হয়ে যেতে পারে এ আশঙ্কায় পায়ে হেঁটেই রওনা হয় তারা।
খৃষ্টান কমাণ্ডো দলটি যখন বালিয়ানের তাঁবুর নিকটে পৌঁছে, ততক্ষণে বালিয়ান নির্দেশ জারি করে ফেলেছে, এক একটি মেয়েকে এক একটি ঘোড়ায় বেঁধে ফেল। বন্ধুরা বিস্মিত অভিভূতের ন্যায় তাকিয়ে আছে বালিয়ানের প্রতি। তাদের ধারণা, লোকটার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। নইলে হঠাৎ করে এমন খাপছাড়া কথা বলবে কেন! এ নিয়ে তার সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেয় বন্ধুরা। অনেক সময় নষ্ট হওয়ার পর বালিয়ান তাদের বুঝাতে সক্ষম হয়, সে যা বলছে, হুঁশ-জ্ঞান ঠিক রেখে বুঝে-শুনেই বলছে এবং এ পরিস্থিতিতে কায়রো ফিরে গিয়ে আত্মসমর্পণ করাই কল্যাণকর।
পাণ্ডুর মুখে অপলক নেত্রে ফ্যাল ফ্যাল করে বালিয়ানের প্রতি তাকিয়ে আছে মেয়েগুলো। ঘোড়ায় জিন কষে বালিয়ানের সঙ্গীরা। ধরে ধরে মেয়েগুলোকে ঘোড়ার পিঠে বাঁধবে বলে—ঠিক এমন সময়ে তাদের উপর নেমে আসে অভাবিত এক মহাবিপদ। চারদিক ঘিরে ফেলে আক্রমণ করে বসে খৃষ্টান কমাণ্ডোরা। বালিয়ান বারবার চীৎকার করে উচ্চ কণ্ঠে বলছে— ‘আমরা অস্ত্র ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমরা কায়রো রওনা হচ্ছি। আক্রমণ থামাও, আমাদের কথা শোন।’
আক্রমণকারীদেরকে বালিয়ান সুলতান সালাহুদ্দীনের বাহিনী মনে করেছিল। কিন্তু তার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। তাই কোন ফল হল না বালিয়ানের ঘোষণায়। একটি খঞ্জর এসে ঠিক হৃদপিণ্ডে বিদ্ধ হয়ে স্তব্ধ করে দেয় তাকে। এ আকস্মিক আক্রমণের মোকাবেলা করতে পারল না বালিয়ানের বন্ধুরা। নিজেদের সামলে নেওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায় একে একে সকলে।
খৃষ্টান কমাণ্ডোদের অভিযান সফল। যাদের জন্য সমুদ্রের ওপার থেকে এসে তাদের এ ঝুঁকিপূর্ণ আক্রমণ, তারা এখন মুক্ত। বিলম্ব না করে তারা নিজেদের ছাউনিতে নিয়ে যায় মেয়েগুলোকে।
কমাণ্ডারকে চিনে ফেলে মেয়েরা। সেও তাদেরই বিভাগের একজন গুপ্তচর। সেখানেই রাত যাপনের সিদ্ধান্ত নেয় তারা। পাহারার জন্য দাঁড়িয়ে যায় দুজন সান্ত্রী। তারা ছাউনির চার পাশে টহল দিচ্ছে।
সুলতান সালাহুদ্দীনের প্রেরিত বাহিনীটি এখনও এ স্থান থেকে বেশ দূরে, বালিয়ান কয়েদী মেয়েদেরকে যেখান থেকে মুক্ত করেছিল সেখানে। অকুস্থল থেকে পালিয়ে যাওয়া রক্ষী তাদের রাহ্বর। যেখানে তাদের উপর আক্রমণ হয়েছিল, বাহিনীটিকে সে আগে সেখানে নিয়ে যায়। তারা একটি মশাল জ্বালিয়ে জায়গাটা দেখছে। রবিন ও তার সঙ্গীদের লাশগুলো পড়ে আছে বিক্ষিপ্তভাবে। লাশগুলো এখন আর অক্ষত নেই। শৃগাল-শকুনেরা ছিঁড়ে-ফেড়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে দেহগুলো। তখনও কাড়াকাড়ি চলছিল লাশগুলো নিয়ে। মানুষ দেখে এইমাত্র কেটে পড়েছে হিংস্র পশুগুলো।
রক্ষী যেখান থেকে ঘোড়া নিয়ে পলায়ন করেছিল, সে কমাণ্ডারকে সেখানে নিয়ে যায়। মশালের আলোতে মাটি পর্যবেক্ষণ করেন কমাণ্ডার। ঘোড়ার পায়ের চিহ্ন পাওয়া গেল। রবিন তার দলবল নিয়ে কোনদিকে গেল, তাও অনুমান করা গেল। কিন্তু রাতের বেলা সে পদচিহ্ন অনুসরণ করে চলা তো সম্ভব নয়, কালক্ষেপণ করাও যাচ্ছে না। তবু তারা রাতটা সেখানেই অবস্থান করল।
খৃষ্টান বাহিনীর ক্যাম্পের সকলে জেগে আছে। তারা সফলতার আনন্দে উফুল্ল। কমাণ্ডার সিদ্ধান্ত জানাল, আমরা শেষ রাতের আলো-আঁধারিতে রোম উপসাগর অভিমুখে রওনা হব। শুনে মিগনানা মারিউস বলল, ‘মিশন তো এখনও সম্পন্ন হয়নি। সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করার কাজটা এখনও বাকি আছে।’
কমাণ্ডার বলল, ‘মেয়েগুলোকে উদ্ধার করার জন্য যদি আমাদের কায়রো পৌঁছুতে হত, তখন আমাদের এ কাজটাও করা সম্ভব ছিল। এখন একদিকে আমরা কায়রো থেকে অনেক দূরে। অপরদিকে মেয়েদেরকে পেয়ে গেছি। এদেরকে নিরাপদে ওপারে নিয়ে যাওয়াই এ মুহূর্তে আমাদের মূল কাজ। তাছাড়া ওটা তো ছিল একটা অতিরিক্ত বিষয়। কাজেই সে চিন্তা বাদ দিয়ে চল, জলদি রওনা হই।’
মিগনানা মারিউস বলল— ‘এটা আমার পরম লক্ষ্য। যে কোন মূল্যে কাজটা আমার সমাধা করতেই হবে। মৃত্যু ছাড়া অন্য কিছু এ মিশন থেকে আমাকে হটাতে পারবে না। আমি সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করার শপথ নিয়েছি। এ শপথ আমি বাস্তবায়ন না করে ক্ষান্ত হব না। আমার প্রয়োজন একজন পুরুষ সঙ্গী আর একটি মেয়ে।’
‘দেখ, মারিউস! আমি কাফেলার কমাণ্ডার। কী করব আর কী করব না, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব আমার। তোমার কর্তব্য আমার আনুগত্য করা।’ বলল কমাণ্ডার।
‘আমি কারও হুকুমের গোলাম নই, আমরা সকলেই খোদার দাস।’ বলল মিগনান মারিউস।
ক্ষীপ্ত হয়ে উঠে কমাণ্ডার। শাসিয়ে দেয় মারিউসকে। মিগনানা মারিউসের কাঁধে ঝুলানো তরবারী। সে-ও ক্ষীপ্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। কাঁধের তরবারীটা চলে আসে হাতে। উঁচিয়ে ধরে কমাণ্ডারের মাথার উপর। অবস্থা বেগতিক দেখে এক সঙ্গী এসে দাঁড়ায় মাঝখানে। নিরস্ত্র করার চেষ্টা করে মারিউসকে। উর্ধ্বে তুলে ধরা তরবারিটা নামিয়ে ফেলে সে। তার চোখ ঠিকরে আগুন ঝরছে যেন। মনে তার প্রচণ্ড ক্রোধ। বলে—
‘আমি খোদার এক বিতাড়িত বান্দা। ত্রিশ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদী। চলে গেছে পাঁচ বছর। আমার ষোল বছর বয়সের একটি বোন অপহৃতা হয়েছিল। আমি গরীব মানুষ। বাবা বেঁচে নেই। মা অন্ধ। আমি ছোট ছোট কয়েকটি সন্তানের জনক। গতর খেটে তাদের ডাল-ভাতের ব্যবস্থা করতাম। আমি গীর্জায় ক্রুশের উপর ঝুলান যীশুখৃষ্টের প্রতিকৃতির কাছে বহুবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমি গরীব কেন? আমি তো কখনও পাপ করিনি। বিশ্বস্ততার সঙ্গেই তো আমি এত পরিশ্রম করি, কিন্তু সংসারে অভাব কেন? খোদা আমার মাকে অন্ধ করলেন কেন? কিন্তু যীশুখৃষ্ট আমার জিজ্ঞাসার কোন জবাব দেননি।
যখন আমার কুমারী বোনটি অপহৃতা হয়ে গেল, তখনও আমি গীর্জায় গিয়ে কুমারী মাতা মরিয়মের প্রতিকৃতির কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আমার কুমারী বোনের উপর এভাবে বিপদ নেমে এল কেন? সে তো জীবনে কখনও অপকর্ম করেনি। তবে কি খোদা তাকে এত রূপ দিয়ে তার প্রতি জুল্ম করলেন? কিন্তু না, মা মরিয়মের পক্ষ থেকেও আমি কোন জবাব পেলাম না।
একদিন এক ধনাঢ্য ব্যক্তির এক চাকর আমাকে বলল, তোমার বোন আমার মনিবের ঘরে আছে। আমার মনিব বড় বিলাসপ্রিয় মানুষ। সে সুন্দরী কুমারী মেয়েদের অপহরণ করে আনে আর তাদের সঙ্গে কদিন ফুর্তি করে কোথায় যেন গায়েব করে ফেলে। রাজদরবারে লোকটির যাওয়া-আসা, উঠা-বসা। মানুষ তাকে বেশ শ্রদ্ধা করে। বাদশাহ তাকে একটি তরবারীও উপহার দিয়েছেন। এত পাপিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও খোদা তার প্রতি সন্তুষ্ট। দুনিয়ার আইন-কানুন তার হাতের খেলনা।
সংবাদ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমি তার ঘরে গেলাম এবং আমার বোনকে ফিরিয়ে দিতে বললাম। লোকটি ধাক্কা দিয়ে আমাকে ঘর থেকে বের করে দেয়। আমি আবার গীর্জায় গেলাম। যীশুখৃষ্ট ও মা মরিয়মের প্রতিকৃতির নিকট দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করলাম। খোদাকে ডাকলাম। কিন্তু আমার আকুল আহ্বানে কেউ সাড়া দিল না। আমি যখন সেদিন গীর্জায় প্রবেশ করি, তখন গীর্জায় আর কেউ ছিল না। শেষে পাদ্রী আসলেন। তিনি আমাকে দেখে ধমক দিয়ে বাইরে বের করে দিলেন এবং বললেন— এখান থেকে দুটি মূর্তি চুরি হয়ে গেছে। তুমি জলদি চলে যাও, অন্যথায় তোমাকে আমি পুলিশের হাতে তুলে দেব। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন, এটা কি খোদার ঘর নয়? তিনি বললেন, আমাকে না বলে তুমি এ ঘরে ঢুকলে কেন? পাপের ক্ষমাই যদি চাইতে হয়, তাহলে আমার কাছে এস; কি পাপ করেছে বল, আমি খোদাকে বলব তোমাকে ক্ষমা করে দিতে। খোদা সরাসরি কারও কথা শুনেন না। যাও, বের হও এখান থেকে। এই বলে তিনি খোদার ঘর থেকে আমাকে তাড়িয়ে দিলেন।’
মিগনানা মারিউসের করুণ কণ্ঠের স্মৃতিচারণে সকলে অভিভূত হয়ে পড়ে। অশ্রু ঝরতে শুরু করে মেয়েদের চোখ বেয়ে। মরুভূমির রাতের নিস্তব্ধতায় তার কথাগুলো সকলের মনে যাদুর মত রেখাপাত করে।
কিছুক্ষণ মৌন থেকে মিগনানা আবার বলে, ‘সেদিন আমি পাদ্রী, যীশু-খৃষ্ট, কুমারী মরিয়মের প্রতিকৃতি এবং খোদার প্রতি তীব্র সংশয় নিয়ে বেরিয়ে এলাম। মনে প্রশ্ন জাগল, এরা যদি সত্যই হয়ে থাকে, তাহলে আমার প্রতি এত অত্যাচার কেন? কেন এরা কেউ আমার আকুতিতে সাড়া দিল না? বাড়ি গেলে অন্ধ মা জিজ্ঞেস করলেন, বাছা! আমার মেয়েকে নিয়ে এসেছ? স্ত্রী জিজ্ঞেস করল, জিজ্ঞেস করল সন্তানরা। যীশু-মরিয়ম-খোদার মত আমিও নীরব রইলাম, কথা বললাম না। কিন্তু আমার সহ্য হল না। ভেতর থেকে একটি প্রচণ্ড ঝড় উঠে এল। সঙ্গে সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এলাম। জ্ঞানশূন্যের মত আমি সারাদিন ঘুরতে থাকি।
সন্ধ্যার সময় একটি খঞ্জর ক্রয় করলাম। সমুদ্রের কূলে গিয়ে পায়চারী করতে শুরু করলাম। ধীরে ধীরে রাতের আঁধার নেমে এল। এবার আমি একদিকে হাঁটা দিলাম। আমার বোন যে গৃহে বন্দী, সে গৃহের আলো চোখে পড়ল। হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। সতর্কপদে চলে গেলাম মহলের পিছনে। আমি স্বল্পবুদ্ধির হাবাগোবা ধরনের মানুষ। কিন্তু এক্ষণে এক বুদ্ধি খেলে যায় আমার মাথায়।
আমি মহলের পিছন দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। একটি কক্ষ থেকে কোলাহলের শব্দ কানে ভেসে এল। মদের আড্ডা বসেছিল বোধ হয়। আমি একটি কক্ষে ঢুকতে চাইলাম। সামনে এসে দাঁড়ায় চাকর, বাধা দেয় আমাকে। তার বুকে খঞ্জর ধরে বোনের নাম বলে জিজ্ঞেস করলাম, ও কোথায় আছে বল। চাকর সিঁড়ি বেয়ে আমাকে উপরে নিয়ে গেল। আমাকে নিয়ে একটি কক্ষের দ্বারে দাঁড়িয়ে বলল, এখানে। আমি ভিতরে ঢুকে পড়লাম; অমনি বাইরে থেকে বন্ধ হয়ে যায় কক্ষের দরজা। ভিতরটা শূন্য।
কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে গেল। বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত ঢুকে পড়ল কতগুলো মানুষ। হাতে তাদের তরবারী আর লাঠি। আমি কক্ষের জিনিসপত্র তুলে তুলে তাদের প্রতি ছুঁড়ে মারতে লাগলাম। পাগলের মত যেখানে যা পেলাম, ভেঙ্গে চুরমার করলাম। তারা আমাকে ধরে ফেলল, অনেক মারল। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
আমার যখন জ্ঞান ফিরে এল, তখন আমি হাতকড়া আর ডাণ্ডা-বেড়ীতে বাঁধা। আমাকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে অভিযোগ দায়ের করা হল, আমি ডাকাতি করেছি, বাদশাহর একজন দরবারীর ঘরে ভাংচুর করেছি, হত্যা করার উদ্দেশ্যে তিনজনকে জখম করেছি।
আমার আর্জি-ফরিয়াদ, আকুতি-মিনতি কেউ শুনল না। ত্রিশ বছরের দণ্ডাদেশ মাথায় নিয়ে আমি নিক্ষিপ্ত হলাম কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। কেটেছে মাত্র পাঁচ বছর। এতদিনে আমি মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলেছি। কারাজীবনের কষ্ট তোমরা জান না। দিনে পশুর মত খাটান হয় আর রাতে কুকুরের মত জিঞ্জির পরিয়ে ফেলে রাখা হয় অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। এ পাঁচ বছরে আমি জানতে পারিনি, আমার অন্ধ মা এবং স্ত্রী সন্তানেরা বেঁচে আছেন কি-না। ভয়ঙ্কর ডাকাত মনে করে আমার সঙ্গে সাক্ষাত করার সুযোগ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি কাউকে।
আমি সর্বক্ষণ ভাবতাম, খোদা সত্য না আমি সত্য। শুনেছিলাম, খোদা নিরপরাধ লোকদের শাস্তি দেন না। তাই প্রশ্ন জাগে, তিনি আমায় কোন্ পাপের শাস্তি দিলেন? কোন অপরাধের কারণে আমার নিষ্পাপ সন্তানদের তিনি অসহায় বানালেন?
পাঁচ পাঁচটি বছর এ ভাবনা আমার মাথায় তোলপাড় করতে থাকে। এই কিছুদিন আগে দুজন সেনা অফিসার যান কারাগারে। এখন আমরা যে মিশন নিয়ে এসেছি, তারা তার জন্য লোক খুঁজছিলেন। আমি প্রথমে নিজেকে পেশ করতে চাইনি। কারণ, এসব হল রাজা-বাদশাদের লড়াই। আর কোন রাজার প্রতিই আমার শ্রদ্ধা নেই। কিন্তু যখন আমি শুনলাম, কয়েকটি খৃষ্টান মেয়েকে মুসলমানদের কব্জা থেকে উদ্ধার করতে হবে, তখন আমার বোনের কথা মনে পড়ে যায়। আমাকে বলা হয়েছিল, মুসলমান একটি ঘৃণ্য জাতি। আমি মনস্থ করলাম, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও আমি এ অভিযানে অংশ নেব। মুসলমানদের কবল থেকে খৃষ্টান মেয়েদের উদ্ধার করে আনব। খোদা যদি সত্য হয়ে থাকেন, তাহলে এর বদৌলতে আমার বোনকে তিনি খৃষ্টানদের কবল থেকে মুক্ত করে দেবেন। অফিসারদের কাছে আমার সিদ্ধান্ত জানালাম। তারা আমাকে আরও বললেন, একজন মুসলমান রাজাকে হত্যা করতে হবে। আমি সে দায়িত্বও মাথায় তুলে নিলাম। নিজেকে পেশ করলাম তাদের হাতে। তবে শর্ত দিলাম, এর বিনিময়ে আমাকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ দিতে হবে, যা আমি আমার পরিবারের হাতে তুলে দেব। তারা আমাকে প্রতিশ্রুতি দিলেন। বললেন, যদি তুমি সমুদ্রের ওপারে মারাও যাও, তবু তোমার পরিবারকে আমরা এতে পরিমাণ অর্থ দেব, যা তারা জীবনভর খেয়ে বাঁচতে পারবে, তাদের কারও কাছে হাত পাততে হবে না।’
দুজন সঙ্গীর প্রতি ইঙ্গিত করে মিগনানা মারিউস বলল, ‘এরা দুজনও আমার সঙ্গে কারাগারে ছিল। এরাও নিজেদেরকে অফিসারদের হাতে তুলে দেয়। খুটিয়ে খুটিয়ে তারা আমাদের নানা কথা জিজ্ঞেস করে। আমরা নিশ্চয়তা দেই, নিজের জাতি ও ধর্মের সঙ্গে আমরা প্রতারণা করব না। আমরা মূলত নিজেদের পরিবার-পরিজনের জন্যই জীবন বিক্রি করে দিয়েছি।
কারাগার থেকে বের হওয়ার প্রাক্কালে এক পাদ্রী আমাদেরকে বললেন, মুসলমান হত্যা করলে খোদা সব গুনাহ মাফ করে দেন। আর যদি তোমরা খৃষ্টান মেয়েদের মুক্ত করে আনতে পার, তাহলে সোজা জান্নাতে চলে যাবে। আমি পাদ্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, খোদা আছেন কোথায়? জবাবে তিনি যা বললেন, তাতে আমি সান্ত্বনা পেলাম না। ক্রুশের উপর হাত রেখে আমি শপথ করলাম।
আমাদেরকে কারাগার থেকে বের করে আনা হল। আমাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। আমার সামনে আমার পরিবারকে প্রচুর অর্থ দেওয়া হল। আমি আশ্বস্ত হলাম। আমার বন্ধুরা! তোমরা আমাকে এখন সেই শপথ পূরণ করতে দাও। খোদা কোথায় আছেন, দেখতে চাই আমি। আচ্ছা, একজন মুসলমানকে হত্যা করলে আমি খোদাকে দেখতে পাব তো?’
‘তুমি একটা বদ্ধ পাগল। এতক্ষণ যা বক্বক্ করলে, তাতে আমি বিবেক-বুদ্ধির গন্ধও পেলাম না।’ বলল কমাণ্ডার।
‘কেন, ইনি বেশ চমৎকার কথা বলেছেন। আমি এর সঙ্গে যাব।’ বলল মিগনানার এক সঙ্গী।
‘আমার একটি মেয়ের প্রয়োজন’— মিগনানা মারিউস মেয়েদের প্রতি দৃষ্টিপাত করে বলল— ‘আমার সঙ্গে যে মেয়েটি যাবে, তার জীবন-সম্ভ্রমের দায়িত্বও আমার। মেয়ে ছাড়া সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট পৌঁছতে পারব না। এসে অবধি আমি ভাবছি, সালাহুদ্দীনের সঙ্গে একাকী কিভাবে সাক্ষাৎ করতে পারি।’
বসা থেকে উঠে মিগনানা মারিউসের পার্শ্বে গিয়ে দাঁড়ায় মুবী। বলে— ‘আমি যাব এর সঙ্গে।’
‘শোন মুবী! আমরা তোমাদের বড় কষ্টে মুক্ত করে এনেছি। এখন আমি তোমাকে এমন বিপজ্জনক মিশনে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারি না।’ বলল কমাণ্ডার।
‘আমাকে সম্ভ্রম হারাবার প্রতিশোধ নিতেই হবে। আমি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর শয়নকক্ষে অনায়াসে প্রবেশ করতে পারব। আমি জানি, মুসলমানদের মর্যাদা যত উঁচু, সুন্দরী নারীর প্রতি তারা তত দুর্বল। আমি এমন কৌশল অবলম্বন করব, সালাহুদ্দীন বুঝতেই পারবে না, এই তার জীবনের সর্বশেষ নারীদর্শন।’ বলল মুবী।
দীর্ঘ আলোচনা-তর্কের পর মিগনানা মারিউস তার এক সঙ্গী ও একটি মেয়েকে নিয়ে কাফেলা ত্যাগ করে রওনা হয়। তাকে দুআ দিয়ে সকলে বিদায় জানায়। দু’টি উট নেয় সে। একটিতে সওয়ার হয় মুবী, অপরটিতে তারা দুজন। তাদের সঙ্গে আছে মিসরী মুদ্রা, সোনার আশরাফী। মিগনানা ও তার সঙ্গীর পরনে জুব্বা। এতদিনে মিগনানার দাঁড়িগুলো বেশ লম্বা হয়ে গেছে। কারাগারের অসহনীয় গরম এবং হাড়ভাঙ্গা খাটুনির কারণে তার গায়ের রঙ এখন আর ইতালীদের মত গৌর নয়; অনেকটা কালো হয়ে গেছে। এখন তাকে ইউরোপিয়ান বলে সন্দেহ করার উপায় নেই। ছদ্মবেশ ধারণের জন্য আলাদা পোশাক দিয়ে পাঠান হয়েছিল তাদের। কিন্তু সমস্যা হল, মিগনানা মারিউস ইতালী ছাড়া আর কোন ভাষা জানে না। মিসরের ভাষা জানা আছে মুবীর। অপরজনও মিসরী ভাষা জানে না। এর একটা বিহিত না করলেই নয়।
তারা রাতারাতিই রওনা দেয়। অত্র অঞ্চলের পথ-ঘাট সব মুবীর চেনা। সে কায়রো থেকেই এসেছিল। তার গায়েও একটি চোগা পরিয়ে দেয় মিগনানা। মাথায় পরিয়ে দেয় দোপাট্টার মত একটি চাদর।
○ ○ ○
ভোরের আলোতে সুলতান সালাহুদ্দীনের প্রেরিত বাহিনী ঘোড়ার পদচিহ্ন অনুসরণ করে রওনা হয়ে পড়ে। খৃষ্টান কমাণ্ডোরা মেয়েদের নিয়ে রাত পোহাবার আগেই সমুদ্র অভিমুখে রওনা হয়ে যায়। তারা তীব্রগতিতে এগিয়ে চলছে।
সূর্যাস্তের এখনও অনেক বাকি। হঠাৎ এক স্থানে সালাহুদ্দীন বাহিনীর চোখে পড়ে কয়েকটি লাশ। আলী বিন সুফিয়ানের নায়েব দেখেই বলে ওঠেন, ‘এ-যে বালিয়ানের লাশ!’ মুখাবয়ব তার সম্পূর্ণ অবিকৃত। পার্শ্বেই এলপাতাড়ি পড়ে আছে তার ছয় বন্ধুর মৃতদেহ। শকুন-হায়েনারা তাদের দেহের অনেক গোশত খেয়ে ফেলেছে। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে কাফেলা। বিষয়টি বুঝে উঠতে পারছে না তারা। রক্ত বলছে, এরা মরেছে বেশীদিন হয়নি। লোকগুলো বিদ্রোহের রাতে মারা গিয়ে থাকলে এতদিনে রক্তের দাগ মুছে যেত, থাকত শুধু হাড়গোড়। বিষয়টি দুর্ভেদ্য ঠেকে তাদের কাছে।
অশ্বখুরের চিহ্ন ধরে আবার রওনা হয় কাফেলা। তীব্রগতিতে ঘোড়া হাঁকায়। আধ মাইল পথ অতিক্রম করার পর এবার উটের পায়ের দাগও চোখে পড়ে তাদের। এগিয়ে চলছে অবিরাম। সূর্য অস্ত যাওয়ার পরও তারা থামেনি। এখন, তারা যে স্থানে চলছে, সেখান থেকে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে উঁচু উঁচু মাটির টিলা। সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার আঁকা বাঁকা একটিমাত্র পথ।
খৃষ্টান কমাণ্ডোরাও এগিয়ে যাচ্ছে এ পথেই। বিস্তীর্ণ পার্বত্য এলাকার পরে বিশাল ধূ ধূ বালু প্রান্তর। পার্বত্য এলাকা অতিক্রম করেই থেমে যায় পশ্চাদ্ধাবনকারী মুসলিম বাহিনী। রাত কাটায় সেখানে।
ভোর হতেই আবার রওনা দেয় তারা। পাড়ি দেয় বিশাল মরু এলাকা। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর তারা সামুদ্রিক আবহাওয়া অনুভব করে। তার মানে সমুদ্র আর বেশী দূরে নয়। কিন্তু শিকার এখানেও চোখে পড়ছে না। পথে একস্থানে খাদ্যদ্রব্যের উচ্ছিষ্ট প্রমাণ দিল, রাতে এখানে কোন কাফেলা অবস্থান নিয়েছিল। ঘোড়া বাঁধার এবং পরে ঘোড়াগুলোর সমুদ্রের দিকে চলে যাওয়ার আলামতও দেখা গেল। তারা মাটিতে ঘোড়ার পদচিহ্ন অনুসরণ করে আরও দ্রুত ঘোড়া হাঁকায়।
সম্মুখে এক স্থানে অবতরণ করে কাফেলা। ঘোড়াগুলোকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম দিয়ে, পানি পান করিয়ে আবার ছুটে চলে। সমুদ্রের বাতাসের তীব্রতা ধীরে ধীরে বাড়ছে। সমুদ্রের লোনা ঘ্রাণ অনুভূত হচ্ছে নাকে। আস্তে আস্তে চোখে পড়তে শুরু করে উপকূলীয় টিলা।
ঘোড়া যত সামনে এগুচ্ছে, উপকূলীয় টিলাগুলো তত স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। একটি টিলার উপরে দুজন মানুষ নজরে পড়ে মুসলিম বাহিনীর। এক নাগাড়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে তারা কাফেলার প্রতি। তারপর তীব্রবেগে নেমে পড়ে সমুদ্রের দিকে। পশ্চাদ্ধাবনকারী কাফেলার ঘোড়াগুলোর গতি আরও বেড়ে যায়। টিলার নিকটে এসে হঠাৎ থেমে যেতে হয় তাদের। কারণ, টিলার পিছনে যাওয়ার একাধিক পথ। উপরে উঠে সম্মুখে দেখে আসার জন্য প্রেরণ করা হয় একজনকে। লোকটি ঘোড়া থেকে নেমে দৌড়ে যায় সেদিকে। একটি টিলায় উঠে শুয়ে শুয়ে তাকায় অপরদিকে। সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসে পেছনে। সেখান থেকেই ইঙ্গিতে সঙ্গীদের বলে, ঘোড়া থেকে নেমে জলদি পায়ে হেঁটে এস। আরোহীরা নেমে পড়ে ঘোড়া থেকে। দৌড়ে এসে দাঁড়ায় টিলার নিকট। সর্বাগ্রে উপরে ওঠেন আলী বিন সুফিয়ানের নায়েব। সম্মুখে তাকান তিনি। তৎক্ষণাৎ পিছনে সরে নেমে আসেন নীচে। মুহূর্তের মধ্যে তার বাহিনীকে ছড়িয়ে দেন তিন দিকে। এক একজনকে পজিশন নিয়ে দাঁড়াতে বলেন এক এক স্থানে।
বিপরীত দিক থেকে অনেকগুলো ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি কানে আসছে। সুলতান সালাহুদ্দীনের গ্রেফতারকৃত গোয়েন্দা মেয়েদের ছিনিয়ে আনা খৃষ্টান কমাণ্ডো দল ঐখানে দাঁড়িয়ে। সমুদ্রের ওপার থেকে এসে তারা যে স্থানে নৌকা বেঁধে রেখে অভিযানে নেমেছিল, এই সেই জায়গা। অভিযান সফল করে এখন তাদের সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আপন দেশে ফিরে যাওয়ার পালা। তারা ঘোড়া থেকে নেমে এক এক করে নৌকায় উঠছে। ছেড়ে দিয়েছে ঘোড়াগুলো।
আচম্বিত তীরবর্ষণ শুরু হয় তাদের উপর। পালাবার পথ নেই। পাল্টা আক্রমণেরও সুযোগ নেই। তারা আত্মরক্ষার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। ক’জন লাফিয়ে উঠে নৌকায়। তারা রশি কেটে দিয়ে শপাশপ দাঁড় ফেলতে শুরু করে। পিছনে যারা রয়ে গেল, তারা তীরের নিশানায় পরিণত হল। নৌকায় করে পলায়নপর কমাণ্ডোদের থামতে বলা হয়। কিন্তু তারা থামছে না। বাতাস নেই। ধীরে ধীরে মাঝের দিকে চলে যাচ্ছে নৌকা। শোঁ শোঁ শব্দ করে বেশ ক’টি তীর গিয়ে বিদ্ধ হয় তাদেরও গায়ে। হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায় দাঁড়ের শব্দ। আরও এক ঝাঁক তীর ছুটে যায় নৌকায়। তারপর আরও এক ঝাঁক। গেঁথে গেঁথে দাঁড়িয়ে আছে লাশগুলোর গায়ে। মাঝি-মাল্লাহীন নৌকা দুলতে দুলতে স্রোতে ভেসে অল্পক্ষণের মধ্যে কূলে এসে ঠেকে। মুসলিম বাহিনী পাড়ে এসে ধরে ফেলে নৌকাটি। নৌকায় কোন প্রাণী নেই। আছে প্রাণহীন কতগুলো দেহ। তীরের আঘাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে মেয়েরাও। গোটা কমাণ্ডের বেঁচে নেই একজনও।
একটি খুটার সঙ্গে বেঁধে রাখা হল নৌকাটি। সাফল্যের গৌরব নিয়ে উপকূলীয় ক্যাম্প অভিমুখে রওনা হয় মুসলিম সেনারা।
○ ○ ○
মুবী ও সঙ্গীকে নিয়ে কায়রোর একটি সরাইখানায় অবস্থান করছে মিগনানা মারিউস। এ সরাইখানাটি দু ভাগে বিভক্ত। একাংশ সাধারণ ও নিম্নস্তরের মুসাফিরদের জন্য, অপর অংশ বিত্তশালী ও উচ্চস্তরের পর্যটকদের জন্য। ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরাও এ অংশে অবস্থান করে। এদের জন্য মদ, নারী ও নাচ-গানের ব্যবস্থা আছে। মিগনানা মারিউসেরা এসে অবস্থান নেয় এ অংশে। এসে পরিচয় দেয়, মুবী তার স্ত্রী আর সঙ্গের লোকটি তার ভৃত্য।
মুবীর রূপ-যৌবন সরাইখানার মালিক-কর্তৃপক্ষ এবং অবস্থানরত লোকদের মনে মিগনানা মারিউস এর প্রভাব বিস্তার করে ফেলে। এমন একজন সুন্দরী যুবতী যার স্ত্রী, তিনি অবশ্যই একজন বিত্তশালী আমীর। মিগনানাকে বিশেষ গুরুত্বের চোখে দেখতে শুরু করে কর্তৃপক্ষ।
নিজেকে মুসলমান পরিচয় দিয়ে সালাহুদ্দীন আইউবীর বাড়ি-ঘর ও দফতর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে মুবী। মুবী জানতে পায়, সুলতান সালাহুদ্দীন সুদানীদের ক্ষমা করে দিয়েছেন ও সুদানী বাহিনীকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেছেন। মুবী আরও জানতে পারে, সুলতান সালাহুদ্দীন সুদানী সালার ও কমাণ্ডার শ্রেণীর লোকদের হেরেম থেকে ললনাদের বিদায় করে দিয়েছেন এবং আবাদী জমি দিয়ে তাদের পুনর্বাসিত করছেন।
মিসরের ভাষা জানে না মিগনানা মারিউস। তথাপি সে আগুন নিয়ে খেলার মত এই ঝুঁকিপূর্ণ মিশনে অবতরণ করল। এটি হয়ত তার অস্বাভাবিক দুঃসাহস কিংবা চরম নির্বুদ্ধিতর পরিচয়। এ জাতীয় হত্যাকাণ্ড সংঘটন এবং এতবড় মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের নিকটে পৌঁছার প্রশিক্ষণও তার নেই। তদুপরি সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তারপরও সে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করতে এল! কমাণ্ডার বলেছিল— ‘তুমি একটি বদ্ধ পাগল; বুদ্ধি বিবেকের বাষ্পও নেই তোমার মাথায়।’ বাহ্যত পাগলই ছিল মিগনানা মারিউস।
এ এক ঐতিহাসিক সত্য যে, বড়দেরকে যারা হত্যা করে, তারা পাগলই হয়ে থাকে। বিকৃত-মস্তিষ্ক না হোক মাথার নাট-বোল্ট কিছুটা হলেও ঢিলে থাকে তাদের। ইতালীর এই সাজাপ্রাপ্ত লোকটির অবস্থাও এর ব্যতিক্রম নয়। তার কাছে এমন একটি সম্পদ আছে, যাকে সে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে শুধু। সে হল মুবী। মুবী শুধু মিসরের ভাষাই জানত না, বরং তাকে এবং তার নিহত ছয় সঙ্গিনী মেয়েকে মিসরী ও আরবী মুসলমানদের চলাফেরা, উঠাবসা, সভ্যতা-সংস্কৃতি ইত্যাদি সব সামাজিক আচার-আচরণ সম্পর্কেও দীর্ঘ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সে মুসলমান পুরুষদের মনের যথার্থ অবস্থা সম্পর্কে সম্যক অবহিত। অভিনয় করতে জানে ভাল। মুবীর সবচে বড় গুণ, সে আঙ্গুলের ইশারায় পুরুষদের নাচাতে জানে। জানে প্রয়োজনে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে যে কোন পুরুষের সামনে নিজেকে মেলে ধরতে।
সরাইখানার রুদ্ধ কক্ষে মিগনানা মারিউস, মুবী ও তাদের সঙ্গী কী আলোচনা করল, কী পরিকল্পনা আঁটলো, তা কেউ জানে না। সরাইখানায় তিন-চারদিন অবস্থান করার পর মিগনানা মারিউস যখন বাইরে বের হয়, তখন তার মুখে লম্বা দাড়ি, চেহারার রঙ সুদানীদের ন্যায় গাঢ় বাদামী। এই বেশ তার কৃত্রিম হলেও দেখতে কৃত্রিম বলে মনে হল না। পরনে সাধারণ একটি চোগা, মাথায় পাগড়ী ও রুমাল। মুবী আপাদমস্তক কালো বোরকায় আবৃত। তার শুধু মুখমণ্ডলটাই দেখা যায়। কপালের উপর কয়েকটি রেশমী চুল সোনার তারের মত ঝক ঝক্ করছে। রূপের বন্যা বইছে তার চেহারায়। মেয়েটির প্রতি রাস্তার পথিকদের যারই দৃষ্টি পড়ছে, তারই চোখ আটকে যাচ্ছে। সঙ্গের লোকটির পরণে সাধারণ পোশাক। দেখে লোকটাকে এদের চাকর-ভৃত্য বলেই মনে হল।
বাইরে উন্নত জাতের দুটি ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে। সরাইখানার কর্তৃপক্ষ মিগনানা মারিউসের জন্য ভাড়ায় এনে দিয়েছে ঘোড়া দুটো। সে স্ত্রীকে নিয়ে ভ্রমণে যাবে বলেছিল। মিগনানা মারিউস ও মুবী দুজন দুটি ঘোড়ায় চড়ে বসে। অপরজন ভৃত্যের মত তাদের পিছনে পিছনে হাঁটছে।
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী কক্ষে উপবিষ্ট। তিনি সুদানীদের ব্যাপারে নায়েবদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন। এই ঝামেলা অল্প সময়ে শেষ করে ফেলতে চান সুলতান। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সুলতান জঙ্গীর প্রেরিত বাহিনী, মিসরের নতুন ফৌজ এবং ওফাদার সুদানীদের সমন্বয়ে একটি যৌথ বাহিনী গঠন করবেন এবং অতিসত্ত্বর জেরুজালেম আক্রমণ করবেন।
রোম উপসাগরে খৃষ্টানদের পরাজয়বরণের পর পরই সুলতান জঙ্গী রাজা ফ্রাংককে পরাজিত করেন। ফলে চরমভাবে বিপর্যস্ত খৃষ্টান বাহিনী দীর্ঘদিন পর্যন্ত আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। আত্মসংবরণের আগে আগেই খৃষ্টানদের হাত থেকে জেরুজালেম উদ্ধার করার পরিকল্পনা নেন সুলতান সালাহুদ্দীন। তিনি তারও আগে সুদানীদের পুনর্বাসনের কাজটা সম্পন্ন করে ফেলতে চাইছেন, যাতে তারা চাষাবাদ ও সংসার কর্মে আত্মনিয়োগ করে এবং বিদ্রোহের চিন্তা করার সুযোগ না পায়।
নতুন বাহিনীর পুনর্গঠন এবং হাজার হাজার সুদানীকে জমি দিয়ে পুর্নবাসিত করা সহজ কাজ নয়। সেনাবাহিনী এবং প্রশাসনে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এমন কিছু কর্মকর্তা আছেন, যারা মিসরের গভর্নর হিসেবে সুলতান সালাহুদ্দীনকে দেখতে চান না। সুদানী বাহিনীকে ভেঙ্গে দিয়েও সুলতান সমস্যার এক নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছেন। সুদানী বাহিনীর কয়েকজন পদস্থ অফিসার এখনও জীবিত। তারা বাহ্যত সুলতান সালাহুদ্দীনের আনুগত্য মেনে নিয়েছিল ঠিক, কিন্তু আলী বিন সুফিয়ানের ইন্টেলিজেন্স বলছে, বিদ্রোহের ভস্মস্তূপে এখনও কিছু অঙ্গার রয়ে গেছে। সুদানীদের পুনর্বাসন এবং সেনাবাহিনীর পুনর্গঠনে এ একটি মারাত্মক সমস্যা।
গোয়েন্দা বিভাগ আরও রিপোর্ট করে, নিজেদের পরাজয়ে এ বিদ্রোহী নেতাদের যতটুকু দুঃখ, তার চেয়ে বেশী দুঃখ খৃষ্টানদের পরাজয়ে। কারণ, তারা বিদ্রোহে ব্যর্থ হওয়ার পরও খৃষ্টানদের সাহায্য পেতে চাচ্ছিল। এখন খৃষ্টানদের পরাজয়ে তাদের সে আশার গুড়ে বালি পড়েছে। মিসরের প্রশাসন ও ফৌজের দু-তিনজন কর্মকর্তা সুদানীদের পরাজয়ে এজন্যেও ব্যথিত যে, তাদের বুকভরা আশা ছিল, এ বিদ্রোহে সুলতান সালাহুদ্দীন হয়ত নিহত হবেন কিংবা মিসর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হবেন।
এরা হল ঈমান-বিক্রয়কারী গাদ্দার। কিন্তু সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ঘটা করে তাদের বিরুদ্ধে কোন এ্যাকশন নেননি। তিনি তাদের সঙ্গে সদয় আচরণই করতেন। কোন বৈঠকে তাদের বিরুদ্ধে কোন কথা বলেননি। অধীন ও সেনাবাহিনীর উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে কখনও তিনি একথা বলেননি যে, যারা আমার বিরোধিতা করছে, আমি তাদের দেখিয়ে ছাড়ব। তাদের ব্যাপারে ধমকের সুরে কথা বলেননি কখনও। তবে প্রসঙ্গ এলে মাঝে-মধ্যে বলতেন— ‘কেউ যদি কোন সহকর্মীকে ঈমান বিক্রি করতে দেখ, তাহলে তাকে বারণ কর। তাকে স্মরণ করিয়ে দিও যে, সে মুসলমান। তার সঙ্গে মুসলমানদের মত আচরণ কর, যাতে আত্মপরিচয় লাভ করে সে দুশমনের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারে।’
কিন্তু তিনি তাদের তৎপরতার উপর কড়া নজর রাখতেন। আলী বিন সুফিয়ানের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোও গুরুত্বের সঙ্গে তাদের গতিবিধির উপর নজরদারীতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। বিশ্বাসঘাতকদের গোপন রাজনীতি সম্পর্কে অবহিত হতেন সুলতান সালাহুদ্দীন।
আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্ব এখন বেড়ে গেছে আরও। রক্ষী ও উষ্ট্ৰচালকদের নিহত হওয়ার সংবাদ পৌঁছে গেছে কায়রো। এই রক্ষী ও উষ্ট্রচালকদের হত্যা এবং অজ্ঞাত ব্যক্তিদের দ্বারা রক্ষীদের হাত থেকে গুপ্তচরদের ছিনিয়ে নেওয়া প্রমাণ করল, এখনও মিসরে খৃষ্টান গুপ্তচর এবং গেরিলা বাহিনী রয়ে গেছে। আর দেশের কিছু লোক যে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা ও আশ্রয় দিচ্ছে, সে কথা বলাই বাহুল্য। তবে সুলতান সালাহুদ্দীনের প্রেরিত বাহিনী যে ঠিক নৌকায় উঠে ওপারে পাড়ি দেওয়ার সময় সেই গেরিলা বাহিনী ও গুপ্তচরদের শেষ করে দিয়েছে, সে খবর কায়রো পৌঁছেনি এখনও। গতকাল সন্ধ্যায় তিনি গেরিলাদের প্রতিহত করার জন্য প্রেরণ করেছেন দুটি টহল বাহিনী। জোরদার করেছেন গোয়েন্দা তৎপরতা।
বিষণ্ণতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন সুলতান সালাহুদ্দীন। যে প্রত্যয় নিয়ে তিনি মিসর এসেছিলেন, তা কতটুকু সফল হল, সে ভাবনায় তিনি অস্থির। তিনি সালতানাতে ইসলামিয়াকে জঞ্জালমুক্ত করে তাকে আরও বিস্তৃত করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ঝড় উঠেছে যেমন মাটির উপর থেকে, তেমনি নীচ থেকেও। সেই ঝড়ে কাঁপতে শুরু করেছে তার সেই স্বপ্নসৌধ। এ চিন্তায়ও তিনি অস্থির যে, মুসলমানদের তরবারী আজ মুসলমানদেরই মাথার উপর ঝুলছে। নীলাম হচ্ছে মুসলমানদের ঈমান। ষড়যন্ত্রের জালে আটকে গিয়ে সালতানাতে ইসলামিয়ার খেলাফতও এখন খৃষ্টানদের ক্রীড়নকে পরিণত। নারী আর কড়ি প্রকম্পিত করে তুলেছে আরবের বিশাল পবিত্র ভূখণ্ড।
নিজেকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র সম্পর্কেও সুলতান সম্পূর্ণ সচেতন। কিন্তু তার জন্য তিনি কখনও পেরেশান হননি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলতেন— ‘জীবন আমার আল্লাহর হাতে। তাঁর নিকট যখন পৃথিবীতে আমার অস্তিত্ব অপ্রয়োজনীয় বিবেচিত হবে, তখন তিনি আমাকে তুলে নেবেন।’
তাই সুলতান সালাহুদ্দীন কখনও নিজের হেফাজতের কথা ভাবেননি। কিন্তু গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ সজাগ। খৃষ্টানদের কোন ষড়যন্ত্র যেন সফল হতে না পারে, তার জন্য তিনি সুলতান সালাহুদ্দীনের চারদিকে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার আয়োজন করে রেখেছিলেন।
আজ কক্ষে বসে সুদানীদের ব্যাপারে নায়েবদের নির্দেশনা দিচ্ছেন সুলতান। হঠাৎ নিরাপত্তা বেষ্টনীর প্রান্তসীমায় এসে দাঁড়িয়ে যায় দুটি ঘোড়া। আরোহী দুজন মিগনানা মারিউস ও মুবী। তারা ঘোড়ার পিঠ থেকে অবতরণ করে। এগিয়ে এসে ঘোড়ার বাগ হাতে নেয় পিছনে পিছনে হেঁটে আসা আরেকজন লোক। নিরাপত্তা কমাণ্ডারের সঙ্গে কথা বলে মুবী। বলে, সঙ্গের লোকটি আমার পিতা। আমরা সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছি। মিগনানা মারিউসের প্রতি দৃষ্টিপাত করে কথা বলে কমাণ্ডার। সে সাক্ষাতের হেতু জানতে চায়। না শোনার ভান করে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে লোকটি। পাশের থেকে মুবী বলে— ‘ইনি বধির ও বোবা। এর সাথে কথা বলে লাভ নেই। সাক্ষাতের উদ্দেশ্য আমি সরাসরি সুলতানকে কিংবা ঊর্ধ্বতন অফিসারকেই জানাব।’
কক্ষের বাইরে টহল দিচ্ছিলেন আলী বিন সুফিয়ান। মিগনানা মারিউস ও মুবীকে দেখে তিনি এগিয়ে আসেন। ‘আস্সালামু আলাইকুম’ বলে সালাম দিলে ‘ওয়ালাইকুমুস সালাম’ বলে জবাব দেয় মুবী। কমাণ্ডার তাঁকে বললেন, ‘এরা সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে চায়।’ আলী বিন সুফিয়ান মিগনানা মারিউসকে সাক্ষাতের কারণ জিজ্ঞেস করেন। মুবী বলল, ‘ইনি আমার পিতা। কানে শুনেন না, কথা বলতে পারেন না।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘সুলতান এ মুহূর্তে কাজে ব্যস্ত। অবসর হলে হয়ত সময় দিতে পারেন। তার আগে আমাকে বলল, তোমরা কেন এসেছে; দেখি আমিই তোমাদের সমস্যার সমাধান করতে পারি কিনা। হোট-খাট অভিযোগ শোনবার জন্য সুলতান সময় দিতে পারেন না। সংশ্লিষ্ট বিভাগ জনতার অনেক সমস্যার সমাধান দিয়ে থাকে।’
‘কেন, সুলতান কি একটি নির্যাতিত নারীর ফরিয়াদ শুনবার জন্য সময় দিতে পারবেন না? আমার যা কিছু বলার, তাঁর কাছেই বলব।’ বলল মুবী।
‘আমাকে না বলে আপনি সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারবেন না। বলুন, আপনার ফরিয়াদ আমিই সুলতানের কাছে পৌঁছিয়ে দেব। প্রয়োজন মনে করলে তিনিই আপনাদের ডেকে নেবেন।’ একথা বলেই আলী বিন সুফিয়ান তাদেরকে নিজের কক্ষে নিয়ে যান।
উত্তরাঞ্চলের একটি পল্লী এলাকার নাম উল্লেখ করে মুবী বলল— ‘দু বছর আগে সুদানী বাহিনী এ অঞ্চল দিয়ে কোথাও যাচ্ছিল। তাদের দেখার জন্য মহল্লার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোররা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে আমিও বেরিয়ে আসি। হঠাৎ এক কমাণ্ডার ঘোড়ার মোড় ঘুরিয়ে আমার নিকটে এসে জিজ্ঞেস করে, তোমার নাম কী? আমি আমার নাম জানালে তিনি আমার পিতাকে ডেকে পাঠান। আড়ালে নিয়ে গিয়ে বাবাকে কানে কানে কী যেন বললেন। দূর থেকে এগিয়ে গিয়ে একজন বলল, ইনি তো বোবা ও বধির। শুনে কমাণ্ডার চলে গেলেন। সন্ধ্যার পর আমাদের ঘরে এসে উপস্থিত হল চারজন সুদানী সৈনিক। কোন কথা না বলে তারা আমাকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে কমাণ্ডারের হাতে অর্পণ করে। কমাণ্ডারের নাম বালিয়ান। তিনি আমাকে সঙ্গে করে আনেন এবং তার হেরেমে আবদ্ধ করে রাখেন। আরও চারটি মেয়ে ছিল তার কাছে। আমি তাকে বললাম, আপনি সেনাবাহিনীর একজন কমাণ্ডার। আমাকে যখন নিয়েই এলেন, তো বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দিন। কিন্তু তিনি আমার কথা শুনলেন না। বিয়ে ছাড়াই আমাকে স্ত্রীর মত ব্যবহার করতে শুরু করলেন।
দুটি বছর তিনি আমাকে সঙ্গে রাখলেন। সুদানীদের সাম্প্রতিক বিদ্রোহের পর তিনি পালিয়ে গেছেন। পরে মারা গেছেন, না জীবিত আছেন জানি না। আপনার সৈন্যরা তার বাড়িতে প্রবেশ করে এবং আমাদের সব ক’টি মেয়েকে এই বলে বের করে দেয় যে, যাও তোমরা এখন মুক্ত।
আমি আমার বাড়িতে চলে গেলাম। আমার পিতা আমাকে বিয়ে দিতে চাইলেন; কিন্তু কেউ আমাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করার জন্য এগিয়ে এল না। মানুষ বলছে, আমি হেরেমের চোষা হাড়, চরিত্রহীনা, বেশ্যা। সমাজ আমাকে এক ঘরে করে রেখেছে। এখন জীবন নিয়ে বেঁচে থাকাই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে আমার।
নিরূপায় হয়ে বাস্তুভিটা ত্যাগ করে ইনি আমাকে নিয়ে সরাইখানায় এসে উঠেছেন। শুনলাম, সুলতান নাকি সুদানীদের জমি ও বাড়ি দিয়ে পুনর্বাসিত করছেন। আমাকে আপনি আপনাদেরই কমাণ্ডার বালিয়ানের রক্ষিতা বা স্ত্রী মনে করে একখণ্ড জমি এবং মাথা গোঁজার জন্য একটি ঘর প্রদান করুন। অন্যথায় আত্মহত্যা কিংবা পতিতাবৃত্তি ছাড়া আমার আর কোন পথ থাকবে না।’
‘সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা ছাড়াই যদি আপনি জমি-বাড়ি পেয়ে যান, তবু কি আপনার সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে হবে?’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।
‘হ্যাঁ, তারপরও আমি সুলতানকে এক নজর দেখতে চাই। একে আপনি আমার আবেগও বলতে পারেন। আমি সুলতানকে শুধু এ কথাটা জানাতে চাই যে, তার সালতানাতে নারীরা তামাশার বস্তুতে পরিণত হয়েছে। বিত্তশালী ও শাসক গোষ্ঠীর কাছে বিয়ে এখন প্রহসন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আল্লাহর ওয়াস্তে আপনি নারীর সম্মান-সতীত্ব রক্ষা করুন এবং হৃত মর্যাদা ফিরিয়ে আনুন। একথাগুলো সুলতানকে জানাতে পারলে হয়ত আমার মনে শান্তি আসবে।’
মিগনানা মারিউস এমন নির্লিপ্তের মত বসে আছে, যেন আসলেই কোন কথা তার কানে ঢুকছে না। আলী বিন সুফিয়ান মুবীকে বললেন, ‘ঠিক আছে, সুলতানের বৈঠক শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। বৈঠক শেষ হলে আমি তার সঙ্গে আপনার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করব।’ একথা বলেই তিনি দ্রুতপদে বাইরে বেরিয়ে যান।
ফিরে আসেন অনেক বিলম্বে। এসে বললেন, ‘আপনারা আরেকটু বসুন, আমি সুলতানের নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে আসছি।’ আলী বিন সুফিয়ান সুলতান সালাহুদ্দীনের কক্ষে প্রবেশ করেন; কথা বলেন অনেকক্ষণ। তারপর বেরিয়ে এসে মুবীকে বললেন, ‘ঠিক আছে, এবার পিতাকে নিয়ে আপনি সুলতানের কক্ষে চলে যান; সুলতান আপনাদের অপেক্ষায় বসে আছেন।’ বলেই তিনি তাদেরকে সুলতান সালাহুদ্দীনের কক্ষটা দেখিয়ে দেন। সুলতান সালাহুদ্দীনের কক্ষে প্রবেশ করার সময় তারা গভীর দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকায়। সুলতানকে হত্যা করার পর পালাবার পথটাই দেখে নিল বোধ হয়।
○ ○ ○