এগিয়ে চলছে কাফেলা।

নিহত সুদানীদের লাশের আশেপাশে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে তাদের অস্ত্র। তীর-কামান, বুর্শা-ঢাল ইত্যাদি। কাফেলার কয়েদীদের চোখে পড়ে সেগুলো। তারা পরস্পর কানাঘুষা করে। যে মেয়েটি রক্ষী কমাণ্ডারকে কব্জা করে রেখেছিল, তার সঙ্গেও চোখের ইঙ্গিতে কথা বলে রবিন। লাশ ও অস্ত্র ছড়িয়ে আছে অনেক দূর পর্যন্ত।

ডান দিকে নিকটেই সবুজ-শ্যামল মনোরম একটি জায়গা। পানিও নজরে আসছে। এই সবুজের সমারোহ টিলাগুলোর চূড়া পর্যন্ত বিস্তৃত। মেয়েটি চোখ টিপে ইঙ্গিত করল কমাণ্ডারকে। কমাণ্ডার চলে আসে মেয়েটির নিকটে। মেয়েটি বলল— ‘জায়গাটি বেশ মনোরম, এখানেই তাঁবু ফেল। রাতে বেশ মজা হবে।’

কাফেলার মোড় ঘুরিয়ে দেয় কমাণ্ডার। সবুজ-শ্যামল টিলার নিকটে পানির ঝরনার কাছে গিয়ে থেমে যায় সে। ঘোষণা দেয়, এখানেই রাত কাটবে। উট-ঘোড়ার পিঠ থেকে নামে সকলে। পানির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে পশুগুলো। রাত যাপনের জন্য উপযুক্ত জায়গার সন্ধান করে কমাণ্ডার। দুটি টিলার মাঝে প্রশস্থ একটি জায়গা, সবুজে ঘেরা। ছাউনি ফেলার নির্দেশ হয় এখানে।

গভীর রাত। চারদিক অন্ধকার। ঘুমিয়ে আছে সকলে। জেগে আছে শুধু দুজন। কমাণ্ডার আর মেয়েটি। কমাণ্ডারের ভাবনা এক, মেয়েটির মতলব আরেক। কমাণ্ডারের ইচ্ছা মেয়েটিকে ভোগ করে চলা আর মেয়েটির পরিকল্পনা কমাণ্ডারকে খুন করা।

নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে সবাই। কোন প্রহরা নেই। নিরাপত্তার কথা ভাববারই সময় নেই কমাণ্ডারের। শয়ন থেকে উঠে মেয়েটি পা টিপে টিপে এগিয়ে যায় কমাণ্ডারের নিকট। মেয়েটিকে নিয়ে সকলের থেকে অনেক ব্যবধানে দূরে শুয়ে আছে কমাণ্ডার। মেয়েটি তাকে একটি টিলার আড়ালে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ কাটায় সেখানে। সে আরও একটু দূরে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করে। মিসরী কমাণ্ডার তার ইচ্ছার গোলাম। এ যে এক ষড়যন্ত্র, কল্পনায়ও আসছে না তার। মনে তার বেশ আনন্দ। সে মেয়েটির সঙ্গে হাঁটতে শুরু করে। আরও তিনটি টিলা পেরিয়ে মেয়েটি একস্থানে নিয়ে যায় তাকে। এবার সে থামে। কমাণ্ডারকে দু বাহুতে জড়িয়ে ধরে মন উজাড় করে প্রেম-নিবেদন করে। নিজেকে প্রেম-সাগরে নিজেকে হারিয়ে ফেলে কমাণ্ডার।

রবিন দেখল, কমাণ্ডার নেই। অন্য রক্ষীরাও গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। শুয়ে শুয়েই সে পাশের সঙ্গীকে জাগায়। পাশের জন জাগায় তার পরের জনকে। এভাবে জেগে উঠে তারা চারজন।

রক্ষীরা ঘুমিয়ে আছে তাদের থেকে একটু দূরে। কোন পাহারাদার নেই। বুকে ভর দিয়ে ক্রোলিং করে সামনে এগিয়ে যায় রবিন। রক্ষীদের অতিক্রম করে। চলে যায় অনেক দূর। পিছনে পিছনে এগিয়ে যায় তার তিন সঙ্গী। তারা টিলার আড়ালে গিয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করে। চলে যায় মাঠের লাশগুলোর কাছে। কুড়িয়ে নেয় অস্ত্র। তিনটি ধনুক, তূণীর ও একটি করে বর্শা হাতে তুলে নেয়। এবার অস্ত্র নিয়ে একত্রে ফিরে আসে তিনজন।

সঙ্গীদের নিয়ে ঘুমন্ত রক্ষীদের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় রবিন। হাতের বর্শাটা শক্ত করে ধরে। তুলে ধরে চীৎ হয়ে শুয়ে থাকা এক রক্ষীর বুক বরাবর। অপর চারজনও এক একজন রক্ষীর নিকট দাঁড়িয়ে যায় পজিশন নিয়ে। মুহূর্ত মধ্যে জীবনের অবসান ঘটতে যাচ্ছে সুলতান সালাহুদ্দীনের চার রক্ষীর। এ চারজনকে খুন করে কেউ টের পাওয়ার আগে অপর এগারজনকেও শেষ করে ফেলা ব্যাপার নয়। চাল তাদের সফল। তারপর থাকে তিন উষ্ট্ৰচালক আর কমাণ্ডার। পনের রক্ষীর হত্যার পর তারা হবে সহজ শিকার।

রক্ষীর বুকে বিদ্ধ করার জন্য বর্শাটা আরও একটু উপরে তোলে রবিন। সে রক্ষীর বুকটা শেষবারের মত দেখে নেয়। আঘাতের জন্য হাতটা তার নীচে নেমে এল বলে, হঠাৎ শোঁ শোঁ শব্দ ভেসে আসে রবিনের কানে। সঙ্গে সঙ্গে সম্মুখ দিক থেকে একটি তীর এসে বিদ্ধ হয় রবিনের বুকে। ছুটে আসে আরেকটি তীর। বিদ্ধ হয় রবিনের এক সঙ্গীর বুকে। একই সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে দুজন। অপর তিনজন দেখার চেষ্টা করছে, ঘটনাটা কী ঘটল। ইত্যবসরে ধেয়ে আসে আরও দুটি তীর। আঘাত খেয়ে পড়ে যায় আরও দুজন। এখনও দাঁড়িয়ে আছে একজন। পালাবার জন্য পিছন দিকে মোড় ঘুরায় সে। অমনি একটি তীর, এসে গেঁথে যায় তার এক পাঁজরে। তার দু চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসে; পড়ে যায় মাটিতে।

ঘটনাটা ঘটে গেল নিতান্ত চুপচাপ। একে একে পাঁচটি প্রাণী ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে; কিন্তু টের পেল না কেউ। এখনও সবাই ঘুমুচ্ছে নাক ডেকে। যম এসে দাঁড়িয়েছিল যাদের সামনে, টের পেল না তারাও।

ঘটনাস্থলে এগিয়ে আসে তীরন্দাজরা। আলো জ্বালায় তারা। তারা সেই দুই রক্ষী, যারা কমাণ্ডারের আচরণে আপত্তি তুলে বলেছিল, গড়িমসি না করে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছা দরকার । শুয়েছিল তারা। চার কয়েদী যখন পার্শ্ব দিয়ে অতিক্রম করছিল, তখন চোখ খুলে যায় একজনের। সে সঙ্গীকে জাগিয়ে কয়েদীদের অনুসরণ করে। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কয়েদীরা যদি পালাবার চেষ্টা করে, তাহলে তাদের তীর ছুঁড়ে খতম করে দেবে। তাই তাদের গতিবিধি অনুসরণ করে তারা অস্ত্র কুড়িয়ে নিয়ে কয়েদীদের ফিরে আসতে দেখে একটি টিলার আড়ালে বসে পড়ে চুপচাপ। এবার যেইমাত্র কয়েদীরা রক্ষীদের বুক লক্ষ্য করে বর্শা তাক করে, অমনি রক্ষীরা তাদের প্রতি তীর ছুঁড়ে দেয়। খতম করে দেয় চার কয়েদীর প্রত্যেককে।

এবার কমাণ্ডারকে আওয়াজ দেয় রক্ষীরা। কিন্তু কোন শব্দ-সাড়া নেই তার। তাদের ডাকাডাকিতে জেগে ওঠে মেয়েরা। জেগে ওঠে অপর রক্ষীরাও। চারটি লাশ দেখতে পায় মেয়েরা। লাশগুলো তাদেরই চার সঙ্গীর। তারা আঁৎকে উঠে। দেহে একটি একটি করে তীর নিয়ে শুয়ে আছে লাশগুলো। অপলক নেত্রে নিঃশব্দে লাশগুলোর প্রতি তাকিয়ে থাকে মেয়েরা। কী করতে এসে সঙ্গীরা লাশ হল, তা বুঝতে বাকী রইল না তাদের। আজ রাতের পরিকল্পনা সম্পর্কে তারাও অবহিত।

মিসরী কমাণ্ডার ছাউনীতে নেই। নেই একটি মেয়েও।

কয়েদী গোয়েন্দাদের বুকে যখন তীর বিদ্ধ হল, ঠিক তখন রক্ষীদের মিসরী কমাণ্ডারের পিঠেও বিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল একটি খঞ্জর। দুটি টিলার পরে তৃতীয় একটি টিলার নীচে পড়ে আছে তার লাশ। সে সংবাদ জানে না রক্ষীরা।

তাঁবু থেকে তুলে মেয়েটি বেশ দুরে তার পছন্দমত একটি স্থানে নিয়ে গিয়েছিল কমাণ্ডারকে। রাতের আঁধারে মেয়েটিকে নিয়ে আমোদে মেতে উঠে কমাণ্ডার। একটি টিলার আড়ালে বসে আছে দুজন। সে টিলারই খানিক দূরে তাঁবু ফেলেছিল বালিয়ান। মুবীর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বালিয়ানও এগিয়ে আসে টিলার দিকে। হাতে তার মদের বোতল। নীচে বিছানোর জন্য মুবী হাতে করে নিয়ে আসে একটি শতরঞ্জি। একস্থানে শতরঞ্জি বিছিয়ে বসে পড়ে মুবী। পাশে বসে মুবীকে জড়িয়ে ধরে বালিয়ান।

হঠাৎ রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে কারও কথা বলার শব্দ ভেসে আসে তাদের কানে। কান খাড়া করে শব্দটা কোন্ দিক থেকে আসছে, আন্দাজ করার চেষ্টা করে বালিয়ান। কী বলছে, তাও বুঝবার চেষ্টা করে সে। বুঝা গেল কণ্ঠটি একটি মেয়ের। বালিয়ান ও মুবী উঠে দাঁড়ায়। পা টিপে টিপে এগিয়ে যায় সেদিকে। কাছে গিয়ে টিলার আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে তাকায় দুজনে। দুটি ছায়ামূর্তি বসে আছে দেখতে পায় তারা। আরও গভীর দৃষ্টিতে তাকায়। এবার পরিষ্কার বুঝতে পারে, ছায়ামূর্তি দুটির একটি নারী অপরটি পুরুষ। আরও নিকটে চলে যায় মুবী। সে গভীর মনে তাদের আলাপ বুঝতে চেষ্টা করে। মিসরী কমাণ্ডারের সঙ্গে মেয়েটি এমন স্পষ্ট ভাষায় কথা বলছিল যে, মুবী নিশ্চিত হয়ে যায়, মেয়েটি তারই এক সহকর্মী। তারা আরও বুঝে ফেলে, কায়রো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মেয়েটিকে।

মিসরী কমাণ্ডারের আচরণ ও কথোপকথনে মুবী নিশ্চিত বুঝে ফেলে, লোকটি এ মেয়েটিকে তার অসহায়ত্বের সুযোগে ভোগের উপকরণে পরিণত করে রেখেছে। মনে মনে ফন্দি আঁটে মুবী। পিছনে সরে গিয়ে বালিয়ানকে কানে কানে বলে— ‘লোকটি মিসরী। সঙ্গের মেয়েটি আমারই সহকর্মী। বেটা জোরপূর্বক ফুর্তি করছে মেয়েটিকে নিয়ে। তুমি তাকে রক্ষা কর। এই মিসরী লোকটি তোমার দুশমন আর মেয়েটি আমার আপন।’ বালিয়ানকে উত্তেজিত করার জন্য মুবী আরও বলে— ‘মেয়েটি বেশ সুন্দরী। মিসরীর কবল থেকে ওকে উদ্ধার করে আনো, এই সফরে ওকে নিয়ে বেশ আমোদ করতে পারবে।’

একটু আগেই মদপান করেছিল বালিয়ান। মাথাটা এখনও তার ঢুলুঢুলু করছে। এবার খুনের নেশা পেয়ে বসেছে তাকে। সে মুবীর দেখানো লোভ সামলাতে পারল না। কোমরবন্ধ থেকে খঞ্জর বের করে হাতে নেয় বালিয়ান। বিলম্ব না করে দ্রুত এগিয়ে যায় মিসরীর প্রতি। খঞ্জরের আঘাত হানে তার পিঠে। পিঠ থেকে খঞ্জরটি টেনে বের করে মারে আরেক ঘা। লুটিয়ে পড়ে মিসরী।

মিসরীর কবল থেকে মুক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায় মেয়েটি। দৌড়ে আসে মুবী। সাংকেতিক শব্দে ডাক পাড়ে মেয়েটিকে। মেয়েটি হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে জড়িয়ে ধরে মুবীকে। অন্য মেয়েরা কোথায়, জিজ্ঞেস করে মুবী। সঙ্গী মেয়েরা কোথায় কিভাবে আছে, জানায় মেয়েটি। সে রবিন এবং তার সাথীদের কথাও জানায়।

পিছন দিকে দৌড়ে যায় বালিয়ান। ডেকে তুলে নিজের ছয় সঙ্গীকে। তাদের কাছে আছে ধনুক ও অন্যান্য হাতিয়ার।

ইত্যবসরে মুসলিম রক্ষীদের একজন কমাণ্ডারকে ডাকতে ডাকতে এগিয়ে আসে এদিকে। তীর ছুঁড়ে বালিয়ানের এক সঙ্গী; খতম করে দেয় রক্ষীকে। মেয়েটি তাদের নিয়ে হাঁটা দেয় ছাউনির দিকে।

সর্বশেষ টিলাটির পিছনে আলো দেখতে পায় বালিয়ান। টিলার আড়ালে গিয়ে উঁকি দিয়ে তাকায় সে। বড় বড় দুটি মশাল জ্বলছে। মশালের দণ্ডগুলো লম্বা হয়ে পড়ে আছে মাটিতে।

বালিয়ান ও তার সঙ্গীরা যেস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, জায়গাটা অন্ধকার। কিন্তু যে স্থানে মশাল জ্বলছে, সেখানে একধারে পাঁচটি মেয়ে নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পায় সে। রক্ষীরাও দাঁড়িয়ে। তাদের মধ্যখানে পড়ে আছে পাঁচটি লাশ। লাশগুলোর গায়ে তীরবিদ্ধ। মুবী ও অপর মেয়েটির কান্না এসে যায়। মুবীর উস্কানীতে এবার বালিয়ান রক্ষীদের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে তার সঙ্গীদের বলে, এরা তোমাদের শিকার, তীর ছুঁড়ে বেটাদের শেষ করে দাও। সংখ্যায় এখন তারা চৌদ্দ। দুর্ভাগ্যবশত মশালের আলোতে তাদেরকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে শিকারীরা।

ধনুকে তীর সংযোজন করে বালিয়ানের সঙ্গীরা। একই সময়ে শো করে ছুটে আসে ছয়টি তীর। এক সঙ্গে শেষ হয়ে যায় ছয়জন রক্ষী। বাকীরা কোত্থেকে কী হল বুঝে উঠতে না উঠতে ছুটে আসে আরও ছয়টি তীর। মাটিতে পড়ে যায় আরও ছয় রক্ষী। এখনও বেঁচে আছে দুজন। অন্ধকারে গায়েব হয়ে যায় তাদের একজন। পালাবার চেষ্টা করে অপরজনও। কিন্তু একত্রে তিনটি তীর এসে বিদ্ধ হয় তার পিঠের তিন জায়গায়। শেষ হয়ে যায় সে-ও। রক্ষা পেয়ে গেছে তিন উষ্ট্ৰচালক। ঘটনার সময় এখানে ছিল না তারা। পরে দূর থেকে টের পেয়ে তারা অন্ধকারে হাওয়া হয়ে গিয়েছিল।

মশালের আলোতে এখন দেখা যাচ্ছে লাশ আর লাশ। প্রতিটি লাশ শুয়ে আছে একটি করে তীর নিয়ে। দৌড়ে এসে মেয়েদের সঙ্গে মিলিত হয় মুবী। এ সময় একটি ঘোড়ার দ্রুত ধাবন শব্দ শুনতে পায় তারা। শঙ্কিত হয়ে ওঠে বালিয়ান। বলল, ‘এখানে বিলম্ব করা ঠিক হবে না। বেটাদের একজন জীবন নিয়ে পালিয়ে গেছে। লোকটা কায়রোর দিকে গেল বলে মনে হল। চল, জলদি কেটে পড়ি।’

রক্ষীদের ঘোড়াগুলো নিয়ে নিজেদের ছাউনিতে চলে যায় তারা। গিয়ে দেখে, যিনসহ তাদের একটি ঘোড়া উধাও। বুঝতে বাকী রইল না, রক্ষীই নিয়ে গেছে ঘোড়াটি। নিজেদের ঘোড়ার নিকট যেতে না পেরে লোকটা চলে আসে এদিকে। এখানে বাঁধা ছিল আটটি ঘোড়া। যিনগুলো খুলে রাখা ছিল পাশেই এক জায়গায়। একটি ঘোড়ায় যিন কষে পালিয়ে গেছে রক্ষী।

চৌদ্দটি ঘোড়ায় যিন বাঁধায় বালিয়ান। মাল-পত্ৰ বোঝাই করে দুটি ঘোড়ায়। অবশিষ্ট ঘোড়াগুলো সঙ্গে নিয়ে রওনা হয়ে যায় একদিকে।

সুলতান সালাহুদ্দীনের রক্ষীদের হাত থেকে উদ্ধার করে আনা গোয়েন্দা মেয়েরা মুবীকে তাদের ঘটনার ইতিবৃত্ত শোনায়। রক্ষীরা তাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছিল, তাও জানায় সে। রবিন ও তার সঙ্গীদের ব্যাপারে বলে, ‘পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা মাঠ থেকে অস্ত্র কুড়িয়ে আনতে গিয়েছিল। কিন্তু বুঝতে পারলাম না, কিভাবে তারা মারা পড়ল।’

মুবী বলল, ‘সালাহুদ্দীনের ক্যাম্পে অকস্মাৎ আমার ও রবিনের সাক্ষাৎ হয়ে গিয়েছিল। সে বলেছিল, আমি দেখতে পাচ্ছি, যীশুখৃষ্ট আমাদের সফলতা মঞ্জুর করেছেন। অন্যথায় এভাবে তোমার-আমার অপ্রত্যাশিত সাক্ষাৎ ঘটত না। আজ আবার তোমাদের সাক্ষাৎ তেমনি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই ঘটে গেল ঠিক; কিন্তু যীশুখৃষ্ট আমাদের কামিয়াবী মঞ্জুর করেছেন, সে কথা আমি বলব না। আমার কাছে বরং যীশুকে আমাদের প্রতি রুষ্ট বলেই মনে হয়। যে কাজে আমরা হাত দিয়েছিলাম, তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে গেল, রোম উপসাগরে আমাদের বাহিনী শোচনীয় পরাজয় বরণ করল। মিসরে আমাদের সহযোগী শক্তি সুদানীদের নির্মম পরাজয় হল। এদিকে রবিন ও ক্রিস্টোফরের ন্যায় নির্ভরযোগ্য সাহসী ব্যক্তিদ্বয় এবং এতগুলো সঙ্গী মারা পড়ল! জানি না, আমাদের কপালে কী আছে।

বালিয়ান বলল, ‘চিন্তা কর না, আমাদের জীবন থাকতে তোমাদের প্রতি কেউ হাত বাড়াতে পারবে না। আমার সঙ্গীদের কৃতিত্ব দেখলেই তো।’

○             ○             ○

কয়েদীদের এ কাফেলা টিলায় যখন লাশের পার্শ্বে দণ্ডায়মান, ঠিক তখন সমুদ্রোপকূলে সুলতান সালাহুদ্দীনের ক্যাম্পে প্রবেশ করে তিনজন আগন্তুক। তাদের পরনে ইতালীয় বেদুঈনদের সাদাসিধে পোশাক। কথা বলতে শুরু করে ইতালী ভাষায়। কিন্তু তাদের ভাষা বুঝছে না ক্যাম্পের কেউ।

আগন্তুকদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাহাহুদ্দীন শাদ্দাদের নিকট। সুলতান সালাহুদ্দীনের অবর্তমানে তিনি এখন ক্যাম্পের কমাণ্ডার। আগন্তুকদের পরিচয় জানতে চান শাদ্দাদ। তারা ইতালী ভাষায় জবাব দেয়। তিনিও তাদের ভাষা বুঝছেন না।

বাহাহুদ্দীন শাদ্দাদ ইতালীয় এক যুদ্ধবন্দীকে ডেকে আনেন কয়েদখানা থেকে। মিসরী ভাষাও তার জানা। তিনি তার মাধ্যমে আগন্তুকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনজনের একজন মধ্য বয়সী। দুজন যুবক। তারা হুবহু একই কথা শোনায়। বলে, ‘খৃষ্টানরা আমাদের তিনজনের তিনটি সুন্দরী বোনকে অপহরণ করে নিয়ে এসেছিল। শুনেছি, ওরা নাকি খৃষ্টানদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে আপনাদের ক্যাম্পে এসে পৌঁছেছে। আমরা বোনদের খুঁজে বের করতে এসেছি।’

বাহাহুদ্দীন শাদ্দাদ জানান, ‘এখানে সাতটি মেয়ে এসেছিল। তারাও আমাদেরকে একই কাহিনী শুনিয়েছিল। ছয়জন আমাদের হাতে বন্দী আছে; সপ্তমজন পালিয়ে গেছে। আমাদের জানা মতে ওরা গুপ্তচর।’

আগন্তুকরা জানায়, গুপ্তচরবৃত্তির সঙ্গে আমাদের বোনদের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা নির্যাতিত গরীব মানুষ। একজন থেকে একটি নৌকা চেয়ে নিয়ে বোনদের সন্ধানে এতদূর এসেছি। আমাদের মত গরীবদের বোনেরা গুপ্তচর বৃত্তির সাহস করবে কিভাবে। আপনি যে সাত মেয়ের কথা বললেন, ‘ওরা তাহলে আমাদের বোন হবে না। জানিনা ওরা কারা।’

‘আমাদের নিকট আর কোন মেয়ে নেই। এই সাতজনই ছিল, তাদেরও একজন লাপাত্তা হয়ে গেছে। অবশিষ্ট ছয়জনকে গত পরশু কায়রো পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওদের মধ্যে তোমাদের বোনরা আছে কিনা, দেখতে চাইলে কায়রো চলে যাও। আমাদের সুলতান হৃদয়বান মানুষ, বললে তিনি মেয়েদেরকে দেখাতে পারেন।’ বললেন বাহাহুদ্দীন শাদ্দাদ।

‘না, আমাদের বোনরা গুপ্তচর নয়। ঐ সাতজন অন্য মেয়ে হবে। তারা হয়ত সমুদ্রে ডুবে মরেছে কিংবা খৃষ্টান সৈনিকরা তাদের কাছে আটকে রেখেছে।’ বলল আগন্তুকদের একজন।

বাহাহুদ্দীন শাদ্দাদ একজন সরল-সহজ দয়ালু মানুষ। তিনি আগন্তুক বেদুঈনদের সাজান কাহিনীতে প্রভাবিত হয়ে পড়েন। তাদের বেশ খাতিরদারী করেন এবং স্বসম্মানে বিদায় করে দেন। আলী বিন সুফিয়ান হলে তাদেরকে এত সহজে ছেড়ে দিতেন না। চেহারা দেখেই তিনি বুঝে ফেলতেন, লোকগুলো গুপ্তচর, যা বলছে সব মিথ্যে।

বিদায় নিয়ে চলে যায় তিনজন। কোথায় গেল তা দেখারও চেষ্টা করল না কেউ। ক্যাম্প থেকে বের হয়ে সোজা হাঁটা দেয় একদিকে। একটানা চলতে থাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। তারা ক্যাম্প থেকে বেশ দূরে নিরাপদ এক পাহাড়ী অঞ্চলে ঢুকে পড়ে।

সেখানে বসে তাদের অপেক্ষা করছিল তাদেরই আঠারজন লোক। এ তিনজনের মধ্য বয়সী লোকটির নাম মিগনানা মারিউস। গ্রেফতার হওয়া মেয়েদের মুক্ত করা এবং সম্ভব হলে সুলতান সালাহুদ্দীনকে হত্যা করার জন্য যে কমাণ্ডো পাঠানো হয়েছে, মিগনানা মারিউস সে বাহিনীর কমাণ্ডার।

এরা তিনজন সুলতান সালাহুদ্দীনের ক্যাম্প সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্যও সংগ্রহ করে নিয়েছিল। তারা জেনে যায়, সুলতান সালাহুদ্দীন এখন এখানে নেই, আছেন কায়রোতে। শাদ্দাদের সঙ্গে কথা বলে তারা জানতে পারে, গুপ্তচর সন্দেহে গ্রেফতার করা মেয়েগুলোকে কায়রো পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাঁচজন পুরুষ বন্দীও আছে তাদের সঙ্গে।

বড় একটি নৌকায় করে এসেছে এ ঘাতক দলটি। সমুদ্রের পাড়ে এক স্থানে সরু একটি খাল। সেই খালে ঢুকিয়ে বেঁধে রেখে এসেছে তারা নৌকাটি। এখন তাদের কায়রো অভিমুখে রওনা হতে হবে। কিন্তু বাহন নেই।

যে তিনজন লোক ক্যাম্পে গিয়েছিল, তারা ক্যাম্পের আস্তাবল ও উট বাঁধার স্থানটা দেখে এসেছে। তারা গভীরভাবে লক্ষ্য করেছে, ক্যাম্প থেকে পশু চুরি করে আনা সহজ নয়। প্রয়োজন তাদের একুশটি ঘোড়া বা উট। ক্যাম্প থেকে এতগুলো পশু চুরি করে আনা অসম্ভব।

ভোরের আকাশে নতুন দিনের সূর্য উদিত হতে এখনও বেশ বাকি। পায়ে হেঁটেই রওনা হয় কাফেলা। বাহন পেয়ে গেলে তারা মেয়েদেরকে পথেই গিয়ে ধরার চেষ্টা করত। কিন্তু কায়রো না গিয়ে উপায় নেই তাদের। তারা জানে, তাদের এ মিশনের সফলতা জীবন নিয়ে খেলা করার শামিল। কিন্তু সফল হতে পারলে খৃষ্টান সেনানায়ক ও সম্রাটগণ যে পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার পরিমাণও এত বেশী যে, অবশিষ্ট জীবন তাদের আর কাজ করে খেতে হবে না। গোষ্ঠীসুদ্ধ বেশ আরামে বসে বসে তারা খেয়ে যেতে পারবে। এ লোভ সামলানোও তো কষ্টকর। তাই তাদের এত ঝুঁকিপূর্ণ মিশনে অবতরণ।

মিগনানা মারিউসকে বের করে আনা হয়েছিল কারাগার থেকে। দস্যুবৃত্তির অপরাধে ত্রিশ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল তাকে। তার সঙ্গে ছিল আরও দুজন কয়েদী, যাদের একজনের সাজা ছিল চব্বিশ বছর, একজনের সাতাশ বছর। সে যুগের কারাগার মানে কসাইখানা। আসামী-কয়েদীদেরকে মানুষ মনে করা হত না। কয়েদীদের রাতের বেলাও এতটুকু আরাম করার সুযোগ ছিল না। তাদের নির্মমভাবে খাটান হত। পশুর মত অখাদ্য খাবার দেওয়া হত। তেমন কারাভোগ অপেক্ষা মৃত্যুই ছিল শ্রেয়।

এ তিন কয়েদীকে মহামূল্যবান পুরস্কার ছাড়া সাজা-মওকুফের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে খৃষ্টানরা। তাদের ক্রুশ হাতে শপথ করিয়ে এ মিশনে নামান হয়েছে। যে পাদ্রী তাদের শপথ নিয়েছিলেন, তিনি তাদেরকে বলেছিলেন, তারা যুত মুসলমানকে হত্যা করবে, তার দশগুণ পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করতে পারলে মাফ হয়ে যাবে জীবনের সমস্ত গুনাহ আর পরজগতে যীশুখৃষ্ট তাদের দান করবেন চিরশান্তির আবাস জান্নাত।

প্রতিজ্ঞা তাদের দৃঢ় মনোবলও বেশ অটুট। ভাব তাদের, কাজের কাজ করেই তবে মিসর ত্যাগ করবে কিংবা ক্রুশের জন্য জীবন উৎসর্গ করে দেবে।

অবশিষ্ট আঠার ব্যক্তিও খৃষ্টান বাহিনীর বাছাবাছা সৈনিক। তারা জ্বলন্ত জাহাজ থেকে জীবন রক্ষা করে এসেছে। তারা রোম উপসাগরে এই অপমানজনক পরাজয় বরুণের প্রতিশোধ নিতে চায়। পুরস্কারের লোভ তো আছেই। প্রতিশোধ স্পৃহা আর পুরস্কারের লোভেই অদেখা এক গন্তব্যপানে তাদের এই পদব্রজে রওনা হওয়া।

○             ○             ○

বেলা দ্বি-প্রহর। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর হেডকোয়ার্টারের সামনে এসে দাঁড়ায় এক ঘোড়সওয়ার। পা বেয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়ছে ঘোড়ার গায়ের ঘাম। ভীষণ ক্লান্ত। কথা ফুটছে না আরোহীর মুখ থেকে। লোকটি ঘোড়ার পিঠ থেকে অবতরণ করলে প্রবল একটা ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে ওঠে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ঘোড়াটি। কোন দানা-পানি-বিশ্রাম ছাড়াই গোটা রাত এবং আধা দিন একটানা ঘোড়া ছুটায় আরোহী। আরোহীকে ধরে নিয়ে একস্থানে বসায় সুলতান সালাহুদ্দীনের রক্ষীরা। সামান্য পানি পান করতে দেয় তাকে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর এবার বাক্‌শক্তি ফিরে পায় আরোহী। ভগ্নস্বরে বলে, ‘একজন কমাণ্ডার বা সালারের সঙ্গে আমার কথা বলতে হবে।’ সংবাদ পেয়ে বেরিয়ে আসেন সুলতান সালাহুদ্দীন নিজেই। সুলতানকে দেখে উঠে দাঁড়ায় আরোহী। সালাম করে বলে— ‘দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছি আমি মহামান্য সুলতান!’ সুলতান তাকে কক্ষের ভিতরে নিয়ে যান এবং বলেন— ‘জলদি বল, কী সংবাদ তোমার?’

‘বন্দী মেয়েরা পালিয়ে গেছে। আমাদের প্লাটুনের সব কজন রক্ষী মারা গেছে। পুরুষ কয়েদীদের আমরা হত্যা করেছি। বেঁচে এসেছি আমি একা। আক্রমণকারীরা কারা ছিল, আমি তা জানি না। আমরা ছিলাম মশালের আলোতে আর তারা ছিল অন্ধকারে। অন্ধকারের দিক থেকে তীর ছুটে আসে এবং সেই তীরের আঘাতে মারা যায় আমার সব কজন সঙ্গী।’ বলল আরোহী।

এ লোকটি কয়েদীদের রক্ষী প্লাটুনের সেই ব্যক্তি, যে আক্রমণের পর অন্ধকারে উধাও হয়ে গিয়েছিল এবং সুদানীদের ঘোড়া নিয়ে পালিয়েছিল। কাফেলা ত্যাগ করে ঘোড়র পিঠে বসে লোকটি দ্রুত ছুটে চলে এবং পথে কোথাও মুহূর্তের জন্য না থেমে এত দীর্ঘ পথ অর্ধেকেরও কম সময়ে অতিক্রম করে চলে আসে।

আলী বিন সুফিয়ান এবং ফৌজের একজন সালারকে ডেকে পাঠান সুলতান সালাহুদ্দীন। তারা এসে পৌঁছুলে সুলতান আরোহীকে বললেন, ‘এবার ঘটনাটা বিস্তারিত বল।’ লোকটি ক্যাম্প থেকে রওনা হওয়ার সময় থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত ঘটনার ইতিবৃত্ত শোনায়। কমাণ্ডার সম্পর্কে বলে, ‘কিছু পথ অতিক্রম করার পর থেকে তিনি একটি কয়েদী মেয়ে নিয়ে মনোরঞ্জনে মেতে ওঠেন এবং দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে সোজা পথ ত্যাগ করে তিনি এমন পথ ধরে চলতে শুরু করেন, যে পথে কায়রো পৌঁছুতে আমাদের অনেক বেশী সময় ব্যয় হত। আপত্তি জানালে তিনি ক্ষেপে ওঠেন এবং এ ব্যাপারে কাউকে নাক গলাতে বারণ করে দেন।’ এভাবে একের পর এক পুরো ঘটনা আনুপুঙ্খ বিবৃত করে আরোহী। কিন্তু একথা জানাতে সে ব্যর্থ হল যে, হামলাটা কারা করল।

আলী বিন সুফিয়ান ও নায়েবে সালারকে উদ্দেশ করে সুলতান বললেন— ‘তার মানে মিসরে এখনও খৃষ্টান কমাণ্ডো রয়ে গেছে।’

‘হতে পারে, তারা মরুদস্যু। এমন রূপসী ছয়টি মেয়ে দস্যুদের জন্য বেশ লোভনীয় শিকার।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

‘তুমি লোকটির কথা খেয়াল করে শোননি। ও বলল, পুরুষ কয়েদীরা ময়দান থেকে অস্ত্র কুড়িয়ে এনে রক্ষীদের হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল। টের পেয়ে দুজন রক্ষী তীরের আঘাতে তাদেরকে হত্যা করে ফেলে। হামলাটা হয় তার পরে। এতেই বুঝা যায়, খৃষ্টান গেরিলারা পূর্ব থেকেই কাফেলাকে অনুসরণ করছিল।’

‘মুহতারাম সুলতান! হামলাকারীরা যারাই হোক, এক্ষুনি আমাদের যে কাজটি করা দরকার, তাহল পথ দেখিয়ে নেওয়ার জন্য এ সৈনিককে সঙ্গে দিয়ে অন্তত বিশজন দ্রুতগামী ঘোড়সওয়ার তাদেরকে ধাওয়া করার জন্য প্রেরণ করা। তারা কারা, সে প্রশ্নের জবাব পরে খুঁজে বের করা যাবে।’ বললেন নায়েবে সালার।

‘আমি আমার এক নায়েবকেও সঙ্গে দেব।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

‘এ সৈনিককে আহার করাও। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করতে দাও। এ সুযোগে বাহিনী প্রস্তুত করে ফেল। প্রয়োজন মনে করলে আরও বেশী সৈনিক দাও।’ বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন।

‘যেখান থেকে আমি ঘোড়া নিয়ে এসেছি, সেখানে আরও আটটি ঘোড়া বাঁধা ছিল। সেখানে কোন মানুষ দেখিনি। এ ঘোড়াগুলোর আরোহীরাই আক্রমণকারী হবে বোধ হয়। ঘোড়া যদি আটটিই হয়ে থাকে, তাহলে তারাও হবে আটজন।’ বলল আরোহী।

‘গেরিলাদের সংখ্যা বেশী হবে না। আমরা তাদের ধরে ফেলব ইনশাআল্লাহ।’ বললেন নায়েবে সালার।

‘মনে রাখবে, ওরা গেরিলা, আর মেয়েগুলো গুপ্তচর। তোমরা যদি একটি গুপ্তচর কিংবা একজন গেরিলাকে ধরতে পার, তাহলে বুঝবে, তোমরা শক্রর দুশ সৈনিককে গ্রেফতার করে ফেলেছে। একজন গুপ্তচর খতম করার জন্য আমি দুশ শত্রুসেনাকে ছেড়ে দিতে পারি। একজন সাধারণ নারী কারুর তেমন কোন ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু একটি গুপ্তচর কিংবা সন্ত্রাসী মেয়ে একাই একটি দেশের সমগ্র সেনাবহর সমুদ্রে ডুবিয়ে মারতে সক্ষম। এই মেয়েগুলো বড় ভয়ঙ্কর। এরা যদি মিসরের অভ্যন্তরেই থেকে যায়, তাহলে তোমরা পুরো বাহিনীই ব্যর্থ হয়ে পড়বে। একটি পুরুষ কিংবা মেয়ে গুপ্তচরকে গ্রেফতার কিংবা খুন করার জন্য প্রয়োজনে নিজেদের একশত সৈনিককে উৎসর্গ করে দাও। তারপরও আমি বলব, এ সওদা অনেক সস্তা। গেরিলাদের ধরতে না পারলেও তেমন চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু যে কোন মূল্যে মেয়েগুলোকে ধরতেই হবে। যদি প্রয়োজন হয়, তীর ছুঁড়ে ওদের হত্যা করে ফেল; তবু জীবিত পালাতে যেন না পারে।’ বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন।

এক ঘণ্টার মধ্যে বিশজন দ্রুতগামী আরোহী প্রস্তুত করে রওনা করা হয়। তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে এই রক্ষী। আলী বিন সুফিয়ানের এক নায়েব যাহেদীন হলেন বাহিনীর কমাণ্ডার।

আলী বিন সুফিয়ান ফখরুল মিসরীকে বিশেষভাবে অন্তর্ভুক্ত করেন এ বাহিনীতে। ফখরুল মিসরীর একান্ত কামনা ছিল, যেন তাকে বালিয়ান ও মুবীকে গ্রেফতার করার জন্য প্রেরণ করা হয়। এখন এ বাহিনী যাদেরকে ধাওয়া করতে যাচ্ছে, তারাই যে বালিয়ান আর মুবী, সে তথ্য না জানে ফখরুল মিসরী, না জানেন আলী বিন সুফিয়ান।

এদিক থেকে রওনা হল বিশজন আরোহী। একুশতম ব্যক্তি তাদের কমাণ্ডার। টার্গেট তাদের কয়েকটি মেয়ে এবং যারা তাদেরকে ছিনিয়ে নিয়েছে তারা। আবার অপর দিক থেকেও এগিয়ে আসছে খৃষ্টানদের বিশজন কমাণ্ডো, একুশতম ব্যক্তি তাদের কমাণ্ডার। তাদেরও লক্ষ্য সেই মেয়েরা। কিন্তু তাদের দুর্বলতা হল, তাদের বাহন নেই। পায়ে হেঁটে এগিয়ে আসছে তারা। মজার ব্যাপার হল, দু পক্ষের কারুরই জানা নেই, যাদের উদ্দেশ্যে এ অভিযান, তারা কোথায়।

○             ○             ○

খৃষ্টানদের কমাণ্ডো দলটি পরদিন সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত অনেক পথ অতিক্রম করে ফেলে। এখন তারা যে স্থানে অবস্থান করছে, সেখানকার কোথাও চড়াই কোথাও উত্রাই। উঁচু-নীচু এলাকা। চড়াই বেয়ে উপরে আরোহণের পর তারা দূরবর্তী একটি ময়দানে কতগুলো উট দেখতে পায়। অসংখ্য খেজুর গাছসহ অন্যান্য গাছও আছে সেখানে। তারা দেখতে পায়, উটগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে পিঠ থেকে মাল নামানো হচ্ছে। বার-চৌদ্দটি ঘোড়াও আছে সেখানে। সেগুলোর আরোহীদেরকে সৈনিক বলে মনে হল। আর যারা আছে, সবাই উষ্ট্ৰচালক। দেখে থেমে যায় এই একুশ কমাণ্ডোর কাফেলা। তারা পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। এ মুহূর্তে যা একান্ত প্রয়োজন, তাই পেয়ে গেছি এমন একটা ভাব ফুটে উঠেছে সকলের চোখে-মুখে। কাফেলাকে থামিয়ে কমাণ্ডার বলল— ‘সত্যমনে ক্রুশের উপর হাত রেখে আমরা শপথ করে এসেছিলাম। ঐ দেখ, ক্রুশের কারিশমা। জাজ্বল্যমান অলৌকিক ব্যাপার। আকাশ থেকে খোদা তোমাদের জন্য সওয়ারী পাঠিয়েছেন। তোমাদের কারও মনে কোন পাপবোধ, কর্তব্যে অবহেলা কিংবা জান বাঁচিয়ে পালাবার ইচ্ছা থাকলে এ মুহূর্তে তা ঝেড়ে ফেলে দাও। খোদার পুত্র— যিনি মজলুমের বন্ধু, জালিমের দুশমন— আকাশ থেকে তোমাদের সাহায্যে নেমে এসেছেন।’

ক্লান্তির ছাপ উবে যায় সকলের চেহারা থেকে। মুহূর্ত মধ্যে ঝরঝরে হয়ে উঠে অবসন্ন দেহগুলো। আনন্দের দ্যুতি খেলে উঠে সকলের চোখে-মুখে। কিন্তু সশস্ত্র সৈনিকদের মোকাবেলা করে এতগুলো উট-ঘোড়ার মধ্য থেকে প্রয়োজনীয় বাহন ছিনিয়ে আনার প্রক্রিয়া কী হবে, তারা এখনও ভেবে দেখেনি।

প্রায় একশত উটের বিশাল এক বহর। যুদ্ধক্ষেত্রে রসদ নিয়ে যাচ্ছে বহরটি। দেশের অভ্যন্তরে বর্তমানে শত্রুর আশঙ্কা নেই ভেবে কাফেলার নিরাপত্তার তেমন কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সঙ্গে দেওয়া হয়েছে মাত্র দশজন সশস্ত্র অশ্বারোহী । উষ্ট্ৰচালকরা সকলে নিরস্ত্র । রাত যাপনের জন্য এখানে অবতরণ করে ছাউনি ফেলেছে তারা।

খৃষ্টান বাহিনীর কমাণ্ডার তার কমাণ্ডোদেরকে একটি নিম্ন এলাকায় বসিয়ে রাখে। কমাণ্ডার কাফেলায় কটি উট, কটি ঘোড়া, কজন সশস্ত্র মানুষ এবং আক্রমণ করলে কী কী সমস্যা দেখা দিতে পারে, তার তথ্য নেওয়ার জন্য দু ব্যক্তিকে প্রেরণ করে। তারপর তারা রাতে আক্রমণ পরিচালনার স্কীম প্রস্তুত করতে বসে যায়। তাদের না আছে অস্ত্রের অভাব, না আছে আগ্রহ-স্পৃহার কমতি। যে কেউ নিজের জীবন নিয়ে খেলতে প্রস্তুত।

তথ্য সংগ্রহ করতে যাওয়া লোক দুটো ফিরে আসে মধ্যরাতের অনেক আগেই। এসে তারা জানায়, কাফেলায় সশস্ত্র আরোহী আছে দশজন। তারা এক স্থানে একত্রে ঘুমিয়ে আছে। ঘোড়াগুলো বাধা আছে অন্যত্র। উষ্ট্ৰচালকরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে শুয়ে আছে নানা জায়গায়। মালপত্র বেশীর ভাগ বস্তায় ভরা। উষ্ট্ৰচালকদের নিকট কোন অস্ত্র নেই। আক্রমণ করে সফল হওয়া তেমন কঠিন হবে না।

কাফেলার লোকেরা গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে আসে খৃষ্টান কমাণ্ডো। চলে আসে একেবারে নিকটে। আগে আক্রমণ হয় ঘুমন্ত সৈনিকদের উপর। টের পেয়ে চোখ খুলতে না খুলতে পলকের মধ্যে অনেকগুলো তরবারী ও খঞ্জরের উপর্যুপরী আঘাতে লাশ হয়ে যায় সব কজন।

খৃষ্টান গেরিলারা তাদের এ অভিযান এত নীরবে সম্পন্ন করে ফেলে যে, অন্যত্র ঘুমিয়ে থাকা উষ্ট্ৰচালকরা টেরই পেল না। চোখও খুলল না একজনেরও। যাদের চোখ খুলল, কী হচ্ছে বুঝে উঠতে পারল না তারা। যার মুখে শব্দ বের হল, তার সে শব্দই জীবনের শেষ উচ্চারণ বলে প্রমাণিত হল।

এবার, উষ্ট্ৰচালকদের সন্ত্রস্ত করার জন্য চীৎকার জুড়ে দেয় কমাণ্ডোরা। তারা জেগে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ধড়মড় করে উঠে বসে বিহ্বল নেত্রে এদিক-ওদিকে তাকাতে শুরু করে। চেঁচামেচি করে ওঠে উটগুলো। এবার উষ্ট্ৰচালকদের কচুকাটা করতে শুরু করে খৃষ্টান কমান্তোরা। পালিয়ে যায় অল্প ক’জন। বাকীরা নির্মম গণহত্যার শিকার হয় খৃষ্টান কমাণ্ডোদের হাতে। খৃষ্টান কমাণ্ডার চীৎকার করে বলে— ‘এগুলো মুসলমানদের রসদ, ধ্বংস করে দাও সব। উটগুলোকেও মেরে ফেল।’ সঙ্গে সঙ্গে তরবারীর আঘাত শুরু হয়ে যায় উটগুলোর পিঠে। পশুগুলোর করুণ চিৎকারে ভারী হয়ে উঠে নিঝুম রাতের নিস্তব্ধ পরিবেশ। ঘোড়াগুলোর কাছে গিয়ে দাঁড়ায় কমাণ্ডার। গুণে দেখে বারটি। দশটি আরোহণের যোগ্য হলেও অবশিষ্ট দুটি কাজের নয়। নয়টি উট আগেই সরিয়ে রেখেছিল সে।

রাত শেষে ভোর হল। পূর্ব আকাশে সূর্য উদিত হল। এক বীভৎস ভয়ানক রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করল ছাউনি। অসংখ্য লাশ ছড়িয়ে আছে এদিক-সেদিক। মারা গেছে অনেক উট। কোনটি এখনও ছটফট করছে। এদিক-সেদিক পালিয়ে গেছে কিছু। সবদিকে রক্ত আর রক্ত, যেন রাতে রক্তের বৃষ্টি হয়েছিল এ স্থানটিতে। খুলে ছিঁড়ে ছড়িয়ে পড়েছে রসদের বস্তাগুলো। তছনছ হয়ে গেছে সব খাদ্যদ্রব্য। রক্তের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে সব। একজন জীবিত মানুষও নেই এখানে। বারটি ঘোড়াও উধাও। যে উদ্দেশ্যে খৃষ্টানদের এ অভিযান, এক প্রলয়কাণ্ড ঘটিয়ে সে উদ্দেশ্য সাধন করে কেটে পড়েছে তারা। এবার তীব্রগতিতে শিকারের সন্ধানে এগিয়ে যেতে পারবে খৃষ্টান কমাণ্ডোরা।

○             ○             ○

ুবীর রূপ-যৌবন আর মদ-মাদকতায় বালিয়ানের মন-মেজাজ এমনিতেই বিগড়ে আছে। মুবী আর মদ, মদ আর মুবী এই তার একমাত্র ভাবনা। তদুপরি এখন তার হাতে এসেছে আরও সাতটি পরমাসুন্দরী যুবতী। মুবীর চেয়ে এরাও কোন অংশে কম নয়। বিপদাপদের কথা ভুলেই গেছে সে। মুবী তাকে বারবার বলছে, ‘এত বেশী থেমে থাকা ঠিক হচ্ছে না। যত দ্রুত সম্ভব আমাদের সমুদ্রের নিকট পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করা প্রয়োজন। শত্রুরা আমাদের ধাওয়া করবে না, তার নিশ্চয়তা কী?’

কিন্তু বালিয়ান রাজার ন্যায় অট্টহাসির তোড়ে ভাসিয়ে দেয় মুবীর সতর্কবাণী। মুবী যে রাতে বালিয়ানকে দিয়ে মেয়েদের উদ্ধার করিয়েছিল, তার পরের রাতে এক স্থানে ছাউনি ফেলেছিল বালিয়ান। সে রাতে সে মুবীকে বলেছিল, ‘আমরা সাতজন পুরুষ আর তোমরা সাতটি মেয়ে। আমার এ ছয়টি বন্ধু বড় বিশ্বস্ততার সাথে আমার সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে। তাদের উপস্থিতিতে তাদের চোখের সামনে আমি তোমার সঙ্গে রঙ-তামাশা করছি। তারপরও তারা কিছু বলছে না। এবার আমি তাদেরকে পুরস্কৃত করতে চাই । অপর ছয়টি মেয়ের এক একজনকে আমার এক এক বন্ধুর হাতে তুলে দাও আর তাদের বল, এ তোমাদের ত্যাগের উপহার।’

‘এ হতে পারে না। আমরা বেশ্যা মেয়ে নই। আমি বাধ্য ছিলাম বলেই তোমার খেলনা হয়ে আছি। কিন্তু এ মেয়েগুলো তোমার কেনা দাসী নয় যে, ইচ্ছে হল আর তাদেরকে বন্ধুদের মাঝে বণ্টন করে দেবে।’ ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল মুবী।

‘আমি তোমাদেরকে কখনও সম্ভ্রান্ত মনে করি না। তোমরা প্রত্যেকে আমাদের জন্য নিজ দেহের উপহার নিয়েই এসেছে। এই মেয়েরা না জানি কত পুরুষকে সঙ্গ দিয়ে এসেছে। তাদের একজনও মরিয়ম নয়।’ আবেশমাখা রাজকীয় ভঙ্গিতে বলল বালিয়ান।

‘আমরা কর্তব্য পালনের স্বার্থেই আমাদের দেহকে পুরুষের সামনে উপহার হিসেবে পেশ করে থাকি। আমোদ করার জন্য পুরুষের নিকট যাই না। আমাদের দেশ ও ধর্ম আমাদের উপর একটি দায়িত্ব অর্পণ করেছে। সে কর্তব্য পালনের নিমিত্ত আমরা আপন দেহ, রূপ ও সম্ভ্রমকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে থাকি। এ যাত্রা আমাদের অর্পিত কর্তব্য পূরণ হয়ে গেছে। এখন তুমি যা করছ ও বলছ, সবই নিছক বিলাসিতা, ধর্মহীন কাজ, যা আমাদের কাম্য নয়, কর্তব্যও নয়। আমরা বিশ্বাস করি, যেদিন আমরা বিলাসিতায় মেতে উঠব, সেদিন থেকেই ক্রুশের পতন শুরু হবে। প্রশিক্ষণে আমাদের বলা হয়েছে, একজন মুসলিম কর্ণধারকে ধ্বংস করার জন্য প্রয়োজনে দশজন মুসলমানের সঙ্গে রাত-যাপন করাও বৈধ এবং পুণ্যের কাজ। মুসলমানদের একজন ধর্মগুরুকে নিজের দেহের পরশে অপবিত্র করাকে আমরা মহা পুণ্যকর্ম মনে করি।’ বলল মুবী।

‘তার মানে তুমি আমাকে ক্রুশের অস্তিত্বের স্বার্থে ব্যবহার করছ! তুমি কি আমাকে ক্রুশের মুহাফিজ বানাবার চেষ্টা করছ?’ বলল বালিয়ান। ধীরে ধীরে জাগ্রত হতে শুরু করে বালিয়ানের অনুভূতি।

‘কেন, এখনও কি তোমার সন্দেহ আছে? একজন ক্রুসেডারের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতালে কী উদ্দেশ্যে?’ বলল মুবী।

‘সালাহুদ্দীন আইউবীর শাসন থেকে মুক্তি অর্জন করার জন্য—ক্রুশের হেফাজতের জন্য নয়। আমি মুসলমান; কিন্তু তার আগে আমি সুদানী।’ বলল বালিয়ান।

‘আমি সর্বাগ্রে ক্রুশের অনুসারী—খৃষ্টান। তারপর আমি আমার দেশের একটি সন্তান।’ এই বলে মুবী বালিয়ানের ডান হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে আবার বলে, ‘ইসলাম কোন ধর্মই নয়। সে কারণে তুমি দেশকে ধর্মের উপর প্রাধান্য দিচ্ছ। এটা তোমার নয়—তোমার ধর্মের দুর্বলতা। আমার সঙ্গে তুমি সমুদ্রের ওপারে চল; আমার ধর্ম কী জিনিস, তোমাকে দেখাব। তখন নিজ ধর্মের কথা তুমি ভুলেই যাবে।’

‘যে ধর্ম তাঁর অনুসারী মেয়েদের পর-পুরুষের সঙ্গে রাতযাপন, নিজে মদপান করা এবং অন্যকে মদপান করানোকে পুণ্যের কাজ মনে করে, সে ধর্মকে আমি মনে-প্রাণে ঘৃণা করি, হাজারবার অভিসম্পাত করি আমি সেই ধর্মকে।’ অকস্মাৎ জেগে উঠে বালিয়ান। তারপর বলে— ‘আমার কাছে তুমি তোমার সম্ভ্রম বিলীন করনি, বরং তুমিই আমার ইজ্জত লুট করে নিয়ে গেছ। আমি তোমাকে নই, বরং তুমিই আমাকে খেলনা বানিয়ে রেখেছে।’

‘একজন মুসলমানের ঈমান ক্রয় করার জন্য সম্ভ্রম তেমন বেশী মূল্য নয়। আমি তোমার সম্ভ্রম লুটিনি, লুট করেছি তোমার ঈমান। তবে এখন আমি তোমাকে ভবঘুরে অবস্থায় পথে ফেলে যাব না। আমি তোমাকে নতুন এক আলোর জগতে নিয়ে যাচ্ছি, তোমাকে হীরা-মাণিক্যের ন্যায় চকমকে উজ্জ্বল এক জীবন দান করব আমি।’ বলল মুবী।

‘আমি তোমার সেই আলোর জগতে যেতে চাই না।’ বলল বালিয়ান।

‘দেখ বালিয়ান! একজন লড়াকু পুরুষ প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পূর্ণ না করে পারে না। তুমি আমার সওদা বরণ করে নিয়েছ। তোমার ঈমানটা ক্রয় করে সেটি আমি মদের সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়েছি; তোমার চাহিদা অনুপাতে আমি তোমাকে মূল্য দিয়েছি। এতটা দিন তোমার দাসী, তোমার স্ত্রী হয়ে রইলাম। তুমি এ সওদা থেকে ফিরে যেও না; একটি অবলা নারীকে ধোঁকা দিও না।’ বলল মুবী।

সমুদ্রের ওপারে নিয়ে তুমি আমাকে যে আলো দেখাবার কথা বলছ, সে  আলো আমাকে এখানেই তুমি দেখিয়ে দিয়েছ। আমার ভবিষ্যত, আমার শেষ পরিণতি এখনই তোমার হীরে-মাণিক্যের মত চমকাতে শুরু করেছে।’ বলল বালিয়ান।

কিছু বলার জন্য মুখ খুলছিল মুবী। কিন্তু বালিয়ান গর্জে উঠে বলল, ‘খামুশ মেয়ে! একটি কথাও আর তোমার শুনতে চাই না আমি। আমি মিসরের গভর্নর সালাহুদ্দীন আইউবীর দুশমন হতে পারি; কিন্তু আমি সেই মহান রাসূলের শত্রু নই, যার আদর্শ রক্ষার জন্য সালাহুদ্দীন আইউবী তোমাদের সঙ্গে মরণপণ লড়াই করে যাচ্ছেন। সেই রাসূলের নামে আমি মিসর-সুদানকে উৎসর্গ করতে পারি। আমি সেই মহান ও পবিত্র আদর্শের বদৌলতে সালাহুদ্দীন আইউবীর সামনে অস্ত্রসমর্পণও করতে পারি।’

‘তোমাকে আমি কতবার বলেছি, মদ কম পান কর। একদিকে অপরিমিত মদ, অপরদিকে সারাটা রাত জেগে আমার দেহটা নিয়ে খেলা করা; তোমার মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে দেখছি। তুমি একথাটাও ভুলে গেছ যে, আমি তোমার স্ত্রী।’ বলল মুবী।

‘আমি কোন বেশ্যা খৃষ্টানের স্বামী হতে চাই না।’ বলল বালিয়ান। বালিয়ানের নজর পড়ে মদের বোতলের উপর। অমনি বোতলটি হাতে নিয়ে ছুঁড়ে মারে দূরে। তারপর উঠে দাঁড়ায়। বন্ধুদের ডাক দেয়। ডাক শুনে দৌড়ে আসে সকলে। সে বলে, ‘এই মেয়েগুলো, বিশেষ করে এ মেয়েটি এখন থেকে তোমাদের কয়েদী। এদের নিয়ে কায়রো ফিরে চল। প্রস্তুত হও, জলদি কর।’

‘কায়রো! আপনি কায়রো যেতে চাচ্ছেন?’

‘হ্যাঁ, আমি কায়রোই যেতে চাচ্ছি। অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই বালুকাময় মরু প্রান্তরে ভবঘুরের ন্যায় আর কতকাল ঘুরে বেড়াব? যাব কোথায়? চল, ঘোড়ায় যিন বাঁধ। এক একটি মেয়েকে এক একটি ঘোড়ায় বসিয়ে বেঁধে নিয়ে চল।’

○             ○             ○