» » রূপনগরের পিশাচিনী

বর্ণাকার

জীবনে বহু বিচিত্র রকমের পুরুষ দেখেছে রূপসা। আলী হায়দরের মতো এমন ভয়ঙ্কর পুরুষ দেখেনি। এত বিপরীত বৈচিত্র্য যে কোনও মানুষের মধ্যে থাকতে পারে তা স্বপ্নেরও অতীত ছিল রূপসার। গত কয়েকদিনে আলীসাহেবকে যত দেখছে ততই বিস্মিত হচ্ছে। সত্তর বছরের বৃদ্ধের কাঁধ পর্যন্ত সাদা চুল কিন্তু এখনও দুজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষের শক্তি ধরেন। সঙ্গমেও তাঁর ক্ষমতা অসামান্য। শিশ্নের দৃঢ়তা এবং সঙ্গমের সময়কাল যে কোনও যুবকের কাছে ঈর্ষার কারণ হতে পারে। আলীসাহেব একেবারেই আপন মর্জির মালিক, অত্যন্ত খামখেয়ালি, কখন কোন মুডে থাকেন কোনও ঠিক নেই, এইমাত্র খুব প্রেমে গদগদ হয়ে রূপসার প্রশংসা করছেন তো পরক্ষণেই তাঁর মেজাজ তিরিক্ষে। গড়গড়ার টিকেয় আগুন কেন ভালো করে ধরেনি তাই নিয়ে প্রবল ধমকাচ্ছেন কোনও পরিচারিকাকে। রূপসা গড়গড়ায় আগুন ধরাতে জানে, এখানে শেখানো হয়েছে। কিন্তু আলীসাহেব রূপসাকে দিয়ে টিকের আগুন ধরাবেন না, কারণ রূপসার আঙুলে ফোস্কা পড়তে পারে। এই কথা শুনলে যে কেউ মনে করবেন না জানি আলীসাহেবের মন কী কোমল! কিন্তু এই মানুষটাই রমণের সময়ে যে কী ভয়ংকর পাশবিক হয়ে ওঠেন তা নিজে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। গতকাল রাতেও রমণের সময়ে উনি তামাকের জ্বলন্ত টিকে চিমটে করে তুলে রূপসার দুই স্তনে, নাভিতে, জঙ্ঘায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে ফোস্কা ফেলছিলেন আর রূপসা উহ! আহ! করে কাতর শব্দ করছিল তাতে তাঁর শিশ্ন আরও প্রহর্ষিত হচ্ছিল। দুই হাতের লম্বা ধারালো নখ দিয়ে রূপসার পিঠে, পেটে, কাঁধে আঁচড়ে রক্ত বার করে পিশাচের মতো সেই রক্ত নিজের জিভে ঠেকাচ্ছিলেন আলীসাহেব। রূপসা দেখছিল বৃদ্ধের জিভ তার রক্তে লাল হয়ে উঠছে। সঙ্গমের সময়েও রূপসাকে নানাভাবে যতটা শারীরিক নিগ্রহ করা দরকার কোনওটারই কসুর করছিলেন না তিনি। রূপসার যন্ত্রণাবোধ সেই ওষধির কারণে না হলেও সে জানে এই ধরনের ধর্ষকামী পুরুষেরা চায় তাদের দেওয়া যন্ত্রণায় নারী কাতর হোক, বেদনায় জর্জরিত হয়ে আর্তনাদ করুক, এতেই তাদের সুখ। রূপসা নিখুঁত অভিনয়ে সেই সকল প্রকার যন্ত্রণার অভিব্যক্তি ফুটিয়ে আলীসাহেবের মনকে তৃপ্ত করেছে। এই পর্যন্ত ঠিক রয়েছে, কারণ এই ধরনের পুরুষ রূপসা আগেও কম-বেশি দেখেছে কিন্তু আলীসাহেবের বিশেষত্ব হচ্ছে সাহিল। আলীসাহেবের সঙ্গে যে দীর্ঘদেহী রোগা ফর্সা যুবকটি এসেছে তার নাম সাহিল আখতার। গত চার পুরুষ ধরে সাহিলরা এই আলীসাহেবদের ফ্যামিলি মিউজিশিয়ান। আবু হায়দরের শখ ছিল সঙ্গীতের। নিজে যেমন ভালো গাইতে পারতেন তেমনই দুই-তিন রকমের বাদ্যযন্ত্র বাজানোর অসামান্য হাত ছিল তাঁর। তাঁর পুত্র সোহারাব আলীর ছিল সেতার বাজানোর অসামান্য দক্ষতা, সোহারাব আলীর পুত্র রশিদ আলীও তাঁর আববার কাছে সেতারের তালিম নিয়েছিলেন কিন্তু আবু হায়দরের একমাত্র সন্তান আলী হায়দর সঙ্গীত শিক্ষা না করলেও রক্তে সেই নেশাটা থেকেই গিয়েছিল তাই তাঁর পূর্বপুরুষ যে মাস মাইনে দিয়ে গাইয়ে-বাজিয়ে রাখতেন সেই ঐতিহ্য তিনি রেখে দিয়েছেন। সঙ্গীতের বোদ্ধা তিনি। সাহিলের আববা রহমত সারেঙ্গি এবং এস্রাজ বাজাতেন। সাহিল আববার কাছ থেকে দুটোই শিক্ষা করলেও আলীসাহেবের বেশি পছন্দ হল সারেঙ্গি। এমন কোনও দিন যায় না যেদিন আলীসাহেব সাহিলের হাতের বাজনা শোনেন না। রহমত মধ্য বয়সেই অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁর ছেলেটিকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন আলীসাহেবের সঙ্গীত সেবার জন্য। তাও কম করে পনেরো বছর হয়ে গেল। আলী সাহেবের মনে হয় বাপের থেকে ছেলের হাতে বেদনার সুর অনেক বেশি আন্তরিক-ভাবে ঝরে পড়ে। আলীসাহেব বেদনার অনুভব ভালোবাসেন। সারেঙ্গি তাঁর হূদয়ের অন্তঃস্থলকে এমনভাবে মোচড় দেয় যে সেই বেদনায় তিনি অপূর্ব এক তৃপ্তি পান। যন্ত্রণাতেই আলীসাহেব আনন্দ পান। নারীর সঙ্গে সঙ্গমের সময় তিনি সাহিলকে ঘরের এককোণে বসিয়ে সারেঙ্গি বাজাতে বলেন। সুর যত বেশি বেদনায় ঝরে পড়ে ততই তিনি সঙ্গমের সঙ্গিনীকে নিপীড়ন করে পরম তৃপ্তি পান। এই অভ্যাস তাঁর আজকের নয়। সাহিলের আববাকেও একসময়ে করতে হয়েছিল তারপর সাহিলকে। কিশোর বয়স থেকে সাহিল তাঁর প্রভুর এমন অদ্ভুত স্বভাব দেখে প্রথমে শিহরিত হত, ভয় লাগত, বিবমিষা আসত, কিশোর চোখে নগ্ন নারী অথবা সঙ্গম দেখলে তার শরীরে যে উত্থান হওয়ার কথা সেই স্বাভাবিকতার বদলে সাহিল দেখতে থাকল রাতের পর রাত ধর্ষণ, নির্যাতন, গণিকা, রূপজীবী অথবা মনিবের স্ত্রীদের যন্ত্রণার আর্তনাদ। কখনও চাবুক, কখনও ছোরা, কখনও হাতের ছড়িটি দিয়েও গণিকাদের আঘাত করে আনন্দ পান আলীসাহেব। আজ পর্যন্ত তিনজন গণিকা আলীসাহেবের অত্যাচারে সঙ্গমকালে নিহত হয়েছে, শুধু অঢেল অর্থের বিনিময়ে রেহাই পেয়েছেন তিনি। এই সব বীভৎস মুহূর্তের নীরব সাক্ষী সাহিল। নারীদের এমন যন্ত্রণা দেখতে দেখতে, তাদের আর্তনাদ শুনতে শুনতে তার হাতের সারেঙ্গিটিও যেন ছড় ছোঁয়ানোমাত্র বেদনায় ককিয়ে ওঠে। বুকের তন্তু যেন ছিঁড়ে যায় সেই কারুণ্যে। সাহিলের নিজের সুন্দরী নগ্নিকার প্রতি কোনও বয়সোচিত যৌন ইচ্ছে তৈরি হয় না, যেটা হয় তা নেহাতই সমবেদনা, সহমর্মিতা। মালিক আলীসাহেবের সঙ্গে ভারতবর্ষের বহু জায়গায় ঘুরেছে সাহিল, বহু নামী-দামি তওয়াইফ, বেশ্যা, বাঈজির শরীর দেখেছে, তাদের কোঠা দেখেছে। দেখতে দেখতে একসময়ে তার মনে হয়েছে জগতের সব নারীর শরীরই আসলে একইরকম। বছরের পর বছর আলীসাহেবের বিকৃতি দেখতে দেখতে একজন পুরুষ হিসেবে নারী শরীর ভোগ করার যে স্বাভাবিক বাসনা সেটাই সমূলে বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে সাহিলের। কিন্তু জীবনে এই প্রথম রূপমঞ্জরীতে এসে ও পুরো হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। এমনও হয়! এ যেন প্রাচীন ভারতবর্ষের এক নগরী। জলজ্যান্ত এক ইতিহাসের মধ্যে ঢুকে পড়েছে ও।

মালিক ওকে যখন ছুটি দিয়েছেন তখন আপন মনে এই প্রেমকুঞ্জের আনাচে- কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছে সাহিল। ভারী অদ্ভুত! সত্যিই অদ্ভুত। কার মাথা থেকে এমন অভিনব ভাবনা এসেছিল কে জানে! এখানের হাওয়াতেও যেন প্রাচীনত্বের গন্ধ। হরিণের দল, পাখির ঝাঁক, সরোবরের সাঁতাররত রংবেরঙের মাছ সকলেই নির্ভয়, স্বাধীন। আর মালিক এবার যাকে সঙ্গিনী করেছেন সেই রূপসা নামের মেয়েটিকে দেখেও জীবনে হয়তো প্রথমবারের জন্য অবাক হয়ে তাকিয়েছে সাহিল। সে যেন পাথর কুঁদে তৈরি করা এক ভাস্কর্য, সহসা প্রাণ পেয়ে জেগে উঠেছে। ত্বক শ্বেতশুভ্র নয়, বরং শ্যামলবরণ। কিন্তু কী তার দীপ্তি! আলো যেন পিছলে যায়! আর তার থেকেও যা দেখে রীতিমতো চমকে গিয়েছে সাহিল তা হল রূপসার সঙ্গমকালীন শীৎকার, মালিকের দেওয়া প্রতিটি আঘাতের যে করুণ আর্তনাদ রূপসা প্রতিবার ফিরিয়ে দিয়েছে তা যেন হূদয়ের উৎস থেকে উৎসারিত। কী নিদারুণ সেই আর্তনাদ অথচ…অথচ কী সুরেলা! যেন আরেকটি সারেঙ্গি থেকে অচেনা একটি সুর বেজে উঠছে। এমনটা প্রথমদিনই খেয়াল করেছিল সাহিল। মালিক এবং রূপসা যখন সঙ্গমে উত্তাল তখন সাহিল চোখ বুজে সারেঙ্গির তারে মারু বেহাগের আরোহী-অবরোহীতে বিভোর। নিজের শরীরে ঠেস দেওয়া সারেঙ্গির তিলক থেকে সওয়ারি পর্যন্ত যে তারগুলি বিস্তৃত তারা সকলে সাহিলের প্রথম বন্ধু, প্রতিটি স্পর্শকে তারা মেনে চলে। তখনও চলছিল, আচমকাই অন্যমনস্ক হয়ে উঠেছিল সাহিল, এই গণিকার যন্ত্রণার শব্দে অবিকল যেন সারেঙ্গির বেদনার সুর! হাত কেঁপে উঠেছিল সাহিলের। প্রথমে মনে হয়েছিল ভুল ভাবনা। কিন্তু না, আবার…আবারও তাই। সেই রাতে নিজের আঙুল যেন নিজের কথা শুনছিল না, বারবার অন্যমনস্ক হয়ে সুর কেটে যাচ্ছিল। কখনও আঙুল থেমে যাচ্ছিল, কখনও ছড়। আশ্চর্য, এমন তো হয় না কখনও! মালিক চিরকাল সারেঙ্গির সুরের সঙ্গে নারী সম্ভোগ করেন, এটা অনেককাল আগেই অভ্যাস হয়ে গিয়েছে সাহিলের…তাহলে আজ…ওই সময়টায় চোখ মেলতে চায় না সাহিল। মালিকের সঙ্গমকালীন বীভৎসতা, নিষ্ঠুরতা ও নিতে পারে না। সেই কারণেই মূলত চোখ বন্ধ রেখে নিজের সঙ্গীতে ডুবে যেতে চায়, যায়ও। কিন্তু সেদিন রাতে সেই যে অন্যমনস্কতা ধরল সাহিলকে তা আর কিছুতেই কাটল না। আলীসাহেবের পাকা কান, সুর সামান্য বিচ্যুত হলে তিনি ওই অবস্থাতেও ঠিক ধরে ফেলেন, সাহিলকে পরে জিজ্ঞাসাও করেছেন, কী হয়েছে বেটা? তোমার হাত কেঁপে যাচ্ছিল কেন? তবিয়ত ঠিক আছে তো?

জি মালিক, আমি ঠিক আছি। বলে মালিকের প্রশ্ন এড়াতে চেয়েছিল সাহিল। কিন্তু তারপরের দিন সকালে রূপসাকে দেখে আরও চমকিত হয়েছিল। আগের রাতে মালিকের করা অত্যাচারের বিন্দুমাত্র চিহ্ন এই গণিকার শরীরে নেই, সামান্য ক্লান্তিও নেই! বরং সদ্য ফোটা ফুলের মতো তরতাজা। এমনও হয়! এইরকম আগে কখনও দেখেনি সাহিল। আজ পর্যন্ত আলীসাহেব যত মেয়েকে ভোগ করেছেন তাদের শরীরকে প্রায় ছিঁড়ে খেয়েছেন, কেউ অর্থের জন্য মুখ বুজে শত অত্যাচার সহ্য করে প্রায় আধমরা হয়েছে, কেউ মাঝপথেই প্রাণভিক্ষা করে পালিয়েছে, কারও গোটা শরীরে কালশিটে, আঁচড়, কামড় অথবা ফোস্কার দাগ, চোখে ক্ষত, ঠোঁট খোবলানো, রক্তাক্ত যোনি, পায়ু। এমন দেখেই অভ্যস্ত সাহিল কিন্তু এই মেয়েটি যেন মানবী নয়, অন্য কিছু। তা না হলে আলীসাহেবের দেওয়া এত আঘাতের কোনও চিহ্নমাত্রই তার শরীরে পরদিন নেই! দংশন, আঁচড়, প্রহারের সামান্য ক্ষতও নেই শরীরে বরং একইরকম। আলীসাহেব নিজেও বেশ অবাক হয়েছিলেন। সাহিলকে আলীসাহেব পুরুষ তো দূরের কথা মানুষ বলেও মনে করেন না, আসলে মনিবরা তাঁদের চাকর-বাকরকে কোনওকালেই মানুষ বলে ভাবেন না, কীটপতঙ্গ ধরনের কিছু একটা ভাবেন, আর তাই এদের কাছে মনিবদের কোনও গোপনীয়তা থাকে না। ভৃত্যদেরও মন হয়ে ওঠে পাথরের মতো।

গতকাল দুপুরে রূপসার স্নানঘরে যখন দুইজনে স্নান করছিল তখন পাশের ঘরে বসে সারেঙ্গি বাজাচ্ছিল সাহিল। গোটা স্নানঘর জুড়ে সত্যি বৃষ্টির মতোই ঝরঝর করে ঝরে পড়ছিল সুগন্ধী জলের ফোঁটা। সাহিল তখন একটা ঠুংরির গৎ বাজাচ্ছিল। হঠাৎই কানে এসেছিল আলীসাহেব রূপসাকে বলছেন, মাশাল্লাহ তোমার সম্পর্কে যা শুনেছিলাম তা সত্যিই। আমি আজ পর্যন্ত বহু নারী দেখেছি, তোমার মতো কাউকে দেখিনি। এর রহস্য কী? কীভাবে নিজেকে এমন অক্ষত অটুট রাখো?

মনিব যতবার প্রশ্নটা করছিলেন ততবারই রূপসা খিল খিল করে হেসে এড়িয়ে যাচ্ছিল নিজস্ব পটুতায়।

কিন্তু এই অক্ষত থাকার মধ্যে যে একটা বিশেষ রহস্য রয়েছে তা বুঝতে আলীসাহেব এবং সাহিল কারও বাকি ছিল না এবং আলীসাহেব যে রূপসার এই অলৌকিক ক্ষমতার কথা আগে জেনেই ওকে সঙ্গিনী হিসেবে পছন্দ করেছেন সেটাও বুঝতে পেয়েছে আলীসাহেবের ওই কথাতেই।

এই সাহিলকেও দেখে অবাক হয়েছে রূপসা। এমন রূপবান পুরুষ ও জীবনে খুব কম দেখেছে। কাঁধ পর্যন্ত ঘন কোঁকড়া চুল, চোখ দুটিতে অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা মাখানো ঔদাসীন্য। জীবনে যত পুরুষ দেখেছে রূপসা তাদের চোখে লালসা, কামনা ছাড়া আর কিছু দেখেনি, কিন্তু এই ছেলেটি যেন রূপসাকে দেখেই না, বা দেখলেও কেমন অবাক মানি চোখ, এই চোখে শরীরের বেশি অতিরিক্ত যেন কিছু খোঁজা, কী খোঁজে ছেলেটা? আর…আর সঙ্গীত! এই রূপমঞ্জরীতে বহু সঙ্গীত শুনেছে রূপসা, আজও নিয়মিত শোনে। এখানে গান, বাদ্যযন্ত্র, নৃত্যের মধ্যে যে কোনও একটি কলা শিখতেই হবে সেটা নিজের পছন্দ। রূপসা নৃত্যকে বেছেছিল। নাচের কারণে ওর প্রায় প্রতিদিনই সেতার, পাখোয়াজ, তবলা ইত্যাদির সঙ্গে ওঠাবসা। রূপমঞ্জরীর গাইয়ে-বাজিয়েরা যথেষ্ট দক্ষ, পেশাদার, কিন্তু এই সাহিল নামের ছেলেটির আঙুলে যে কী রয়েছে বুঝে পায় না রূপসা। যতবার তারের ওপর ছড় টানে, বুকের ভেতরে কী যেন একটা দুমড়ে-মুচড়ে যায়, কী রয়েছে ওই সুরে? কেন এমন মন কেঁদে কেঁদে ওঠে? নারী শরীরের প্রতি ছেলেটির এই ঔদাসীন্যে রূপসার মাঝে মাঝে যেমন বিরক্তি লাগে তেমনও বিস্ময়ও জাগে। এ এমন কেন? সারেঙ্গি যখন বাজায় তখন যেমন নিজের সঙ্গীতে ডুবে যায় ছেলেটি, যখন বাজায় না তখনও যেন নিজের ভাবজগতে বিভোর। অন্যমনস্ক। কত পুরুষ তো দেখেছে রূপসা কিন্তু এমনটি…তবে এটাও ভেবে আশ্চর্য লাগে যার আঙুলে এমন জাদু রয়েছে সে কেন এই আলীসাহেবের খিদমতগিরি করে কে জানে! কিসের বাধকতা?

আগামীকাল ফিরে যাবেন আলীসাহেব। এই কয়েকদিন যেন একটা ঝড় বয়ে গেল। আলীসাহেব আসলে একটি ত্রাস। মানুষের যৌনবিকৃতি যে কত ভয়ংকর হতে পারে তার সাক্ষাৎ নিদর্শন হলেন এই আলী হায়দর। রূপসার ওপরে এই ক’দিনে উনি অতরকমের অত্যাচার চালিয়েছেন, অন্য কেউ হলে এক বেলার মধ্যে আধমরা কিংবা পুরোই মরে যেত। শুধুমাত্র রূপসার অলৌকিক শক্তির জোরে টিকে রয়েছে। এই ক’দিনের মধ্যে আলীসাহেব রূপসার সঙ্গেই অধিকাংশ সময়টা ব্যয় করলেও অন্যান্য গণিকার সঙ্গেও মিলিত হয়েছেন। তবে বারবার রূপসাকে বলেছেন তোমার মতো কেউ নেই। এই কথা অবশ্য রূপসা প্রথমবার শোনেনি। দীর্ঘকাল ধরে শুনে আসছে। এখন যে খুব আনন্দ লাগে তা নয়। আনন্দ, দুঃখ কোনও অনুভূতিই আর হয় না। শুধু মনের খুব ভেতরে একটা ক্লান্তি, সারাক্ষণের ক্লান্তি অপেক্ষা করে থাকে খুব লম্বা একটি ঘুমের।

আজ সন্ধেবেলায় মজলিশ বসেছে প্রেমকুঞ্জে। নাচ-গান অনেককিছু চলছে। নায়কেরা দেদার টাকা ওড়াচ্ছেন, নামী-দামি সুরা, সুখাদ্যের বন্যা বইছে। মুজরার হলঘরে যেখানে আলীসাহেব আয়েশ করে বসেছিলেন তারই পিছনে চুপ করে বসেছিল সাহিল। চুপ করে গান শুনছিল, নাচ দেখছিল। একটু আগে হিন্দুস্থানি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালে তালে রূপসা যখন হলের মধ্যে নাচছিল তখন বার বার ওই অত চোখের ভিড়ে ওর চোখ পড়ে যাচ্ছিল সাহিলের সমুদ্রের মতো গভীর আর নীলচে তারার চোখ দুটির দিকে। কী অপরিসীম মুগ্ধতা সেই চোখে! কী যে ভালো লাগছিল রূপসার! ইচ্ছে করছিল নেচেই যায়। আর সাহিলও পুরো ডুবে গিয়ে দেখছিল সাক্ষাত সঙ্গীতই যেন মানবীর রূপ পেয়ে নৃত্যে বিভোর। দেখতে দেখতে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল সাহিল। তার এই জীবনটিতে শুধু সঙ্গীত ছাড়া আর কোনও বাঁচার পথ নেই। অনেকবার ইচ্ছে করেছে এই বন্দি জীবন, ভৃত্যের জীবন থেকে কোথাও একটা পালাতে। কিন্তু সুযোগ পেয়েও চলে যেতে পারেনি শেষ পর্যন্ত। বাঁধা পড়ে গিয়েছে নিজের আদর্শ এবং বিবেকের কাছে। সাহিলের বয়স তখন মাত্র নয়। কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিল সে। বাঁচার কোনও আশাই ছিল না। চিকিৎসার ব্যয়ও ছিল প্রচুর। বংশের একমাত্র সন্তান সাহিলের জন্য মনে-প্রাণে ভেঙে পড়েছিলেন সাহিলের বাবা রহমত। ঘরে চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ আর নেই। একদিন আলীসাহেবের কাছে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। হাতজোড় করে প্রার্থনা করলেন আলীসাহেব যেন তাঁর পুত্রের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন, যদি সাহিল সুস্থ হয়ে ওঠে তবে আজীবন আলীসাহেবের সেবা করবে এই জবান দিয়ে ফেলেন তিনি। আলী হায়দর চিরকাল মর্জির রাজা। এবং রহমতের সঙ্গীতের সমঝদার। তিনি বলে দিলেন, রহমত, তুমি মন খারাপ কোরো না, অর্থের কারণে তোমার ছেলের চিকিৎসা বন্ধ হবে না, যদি ওর পরমায়ু থাকে তাহলে আমার শেষ টাকাটাও ওর চিকিৎসার জন্যই ব্যয় করব আমি কথা দিলাম।

আর সত্যিই তিনি সেই কথা রাখলেন। দেশের সব থেকে নামী চিকিৎসকদের দিয়ে সাহিলের চিকিৎসা শুরু করালেন আলীসাহেব। তারপর যখন এই দেশের ডাক্তাররা জানালেন এই রোগের চিকিৎসা এই দেশে সম্ভব নয়, তখন তিনি সাহিলকে লোক সমেত পাঠালেন আমেরিকায়। প্রায় একমাস সেখানে বহু অর্থব্যয়ে চিকিৎসা হল সাহিলের। এবং সে সুস্থ হয়ে ফিরে এল।

এই ঘটনার পরই রহমত তাঁর নিজের দেওয়া জবান রক্ষার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। ছেলে সাহিল পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার পর ছেলেকে বললেন, বাবা সাহিল, মনে রাখবে আলীসাহেব তোমাকে জীবন দান করেছেন। তাই তুমি আজীবন ওঁর সঙ্গ ছাড়বে না। মনে রেখো, তোমার জীবনের ওপর তাঁর পূর্ণ অধিকার রয়েছে। ওঁকে সঙ্গ দান করা, আনন্দ দান করাই তোমার জীবনের একমাত্র কাজ। আমি তোমাকে আলীসাহেবের কাছে সমর্পণ করেছি।

বাবার কথা রেখেছে সাহিল। রহমত অসুস্থ হয়ে পড়ার পর আলীসাহেবের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল কারণ উনি সঙ্গীত ছাড়া থাকতে পারতেন না। সাহিলও ততদিনে বাবার কাছে সারেঙ্গির শিক্ষা অনেকটাই নিয়ে ফেলেছে, ফলে একদিন নিজে বাবার সারেঙ্গিটি কোলে নিয়ে আলীসাহেবের বাড়িতে এসে বলেছিল, আববু আর আসতে পারবেন না, আজ থেকে আমি আপনার খিদমত দেব।

তুমি পারবে?

হ্যাঁ পারব। গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে উঠেছিল সাহিল।

মুখের কথা মানব না, বাজিয়ে শোনাও দেখি।

সাহিল বাজিয়েছিল শিবরঞ্জনী।

সাবাশ বেটা! ও তোমার হাতে সত্যিই জাদু রয়েছে, তোমাকে সুস্থ করে তোলার জন্য আল্লাহকে শতকোটি সালাম। আজ থেকে তুমি আমার হলে।

সেই থেকে রয়ে গেল সাহিল। কিছুদিন পরেই জানতে বুঝতে শুরু করেছিল সঙ্গীতঅন্ত প্রাণ, দরাজ দিল মানুষটার ভেতরে আরও একটা সত্তা রয়েছে যে ধর্ষণকারী, যৌননিপীড়নে সুখ পায়। কপাল তবু ভালো লোকটা সমলিঙ্গে আকর্ষণ বোধ করে না, তা না হলে সাহিলের যা রূপ তাতে ওর কপালেও অশেষ দুঃখ ছিল। মনিবের নারী সঙ্গমের সময়ে সামনে বসে সারেঙ্গি বাজানোর সময়ে প্রথম দিকে যে কী ভয় লাগত সাহিলের, হাত কেঁপে উঠত অমন অত্যাচার দেখে, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে নামত মেয়েটির প্রতি অত্যাচার দেখে, বমি পেত, দৌড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করত, কিন্তু উপায় ছিল না কোথাও যাওয়ার। বাবার দেওয়া বচন এবং নিজের ফেরত পাওয়া জীবনের কৃতজ্ঞতার জন্য শেষ পর্যন্ত সঙ্গ ছাড়তে পারেনি সাহিল। নিজেকে বোঝাতে শুরু করেছিল তোমার নিজের কোনও আলাদা জীবন নেই, আলীসাহেব যতদিন থাকবেন ততদিন তাঁর জন্যই তোমার বেঁচে থাকা। সেই মতো নিজের মনকে স্থির করে নিয়েছিল। প্রেমহীন, বান্ধবহীন, সামাজিকতাহীন একটি জীবন। বন্ধু বলতে শুধু নিজের সারেঙ্গিটি, ওখানেই তার সবকিছু সমর্পিত, নিজের মনে কোনও কথা জমলে সারেঙ্গিকেই সেই কথা ফিসফিস করে বলে সাহিল। সারেঙ্গি নিশ্চুপ হয়ে শোনে সেই কথা।

নাচঘরে রূপসার নাচ দেখতে দেখতে জীবনে এই প্রথম মনের ভেতর কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠল। এমন কেন হচ্ছে? এখানে এসে রূপসাকে দেখার পর থেকেই তার মনের ভেতর কেমন যেন হচ্ছে। আলীসাহেবের অনুমতি নিয়ে নিঃশব্দে উঠে পড়েছিল সাহিল। বাইরে বেরিয়ে খোলা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছিল। আজ পূর্ণিমা। তখন সবে রাত আটটা, গোল থালার মতো চাঁদ আকাশের মাঝে। চারদিকে আলো ছড়িয়ে পড়েছে। লম্বা শ্বাস নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল সাহিল। মনে মনে গুনগুন করছিল একটি সুর। আঠাশ বছর বয়স পেরিয়ে গেল, আরও কতদিন বেঁচে থাকতে হবে কে জানে….

আপনি উঠে এলেন যে? কণ্ঠ শুনে চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকাল সাহিল। রূপসা এসে দাঁড়িয়েছে।

প্রথমে কিছু বলতে পারল না ও, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল রূপসার দিকে।

অমন তাকিয়ে থাকা দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল রূপসা।

আপনি অমন বোকার মতো শুধু তাকিয়ে থাকেন কেন বলুন তো? বোবা নাকি? কথা বলতে পারেন না?

আচমকা এমন কথা শুনে থতমত খেয়ে গেল স্বভাবলাজুক সাহিল। কোনওক্রমে বলল, না না মানে…একটু বাইরে এলাম।

চাঁদ দেখতে?

ওই আর কি…

আজ পূর্ণিমা তাই না?

হ্যাঁ। চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলল সাহিল। তারপর ওর মনে হল রূপসাকে কিছু বলা উচিত। জিজ্ঞাসা করল, আপনি চলে এলেন?

হ্যাঁ। এখন দুই ঘণ্টা আমার বিশ্রামের সময়। বলে একটু থামল রূপসা। তারপর নিচু গলায় বলল, জানেন, আমি জীবনে অনেক মানুষ দেখেছি। আপনার মতো এমন অদ্ভুত লোক দেখিনি। বলে আর দাঁড়াল না। পায়ে বাঁধা নূপুরের ছম ছম শব্দ করতে করতে হেঁটে গেল। সাহিল একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল সেই চলে যাওয়ার দিকে।

অনেক রাত। আজ চাঁদের আলোয় রূপসা নিজের কুটিরের ছাদে শুয়েছিল। আলীসাহেবের নির্দেশে আজ রাতে চাঁদের আলোতেই শয্যা পাতা হয়েছিল। ফুরফুরে হাওয়া ছিল আজ বিকেল থেকেই। বেশ অনেক রাত পর্যন্ত হুল্লোড় করে আলীসাহেব ফিরেছিলেন মজলিশ থেকে। পানাহার ওখানেই সেরে নিয়েছিলেন। তারপর রূপসার কুটিরে ফিরে শুরু হল শেষপ্রস্থ রমণ। চূড়ান্ত উদ্দামতা। সাহিল আজ বাজাচ্ছিল রাগ বাহার। আজ বাজানোর সময় রূপসার সঙ্গমকালীন কাতর শব্দ সাহিলকে অন্তরে আঘাত দিচ্ছিল তীব্রভাবে। মন বসছিল না বাজনায়। ইচ্ছে হচ্ছিল আলীসাহেবের পা দুটি জড়িয়ে ধরে বলে, ওকে ছেড়ে দিন, দয়া করে ছেড়ে দিন, কিন্তু এসবই অলীক ভাবনা। আজ রাতের সারেঙ্গির তারে জগতের সকল বেদনা যেন আছড়ে পড়ছিল…রূপসার পাথর হয়ে যাওয়া মনও যেন সেই উত্তাপে গলে যাচ্ছিল, কান্না পাচ্ছিল। হূদয়ের অতল গভীর থেকে একটা হাহাকার, আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। আলীসাহেবের সঙ্গে শেষবার মিলনের সময়েই তাঁর অলক্ষে চোখ থেকে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে নেমেছিল রূপসার। নিজেই চমকে উঠেছিল রূপসা। এমন তো তার হয় না, অন্তত বহুযুগ তার চোখ থেকে জল পড়েনি। অশ্রু কী সেটাই মনে নেই তার অথচ এই সারেঙ্গি যেন তার শরীরের প্রতিটি রোমকূপে এক অনির্বচনীয় বেদনা জাগিয়ে তুলছিল।

সবকিছু মিটে যাওয়ার পর আলীসাহেব ঘুমিয়ে পড়লেন। গভীর ঘুম। সাহিল উঠে চলে গেল। তার শয্যা আজ রূপসার কুটিরের দালানে। রূপসার ঘুম আসছিল না। চাঁদের দিকে তাকিয়ে চিত হয়ে শুয়ে আনমনা হয়ে ভাবছিল নানা কথা। সম্পূর্ণ নগ্ন শরীরে চাঁদের আলো পড়ে অপরূপ দেখাচ্ছিল ওকে। নিজের পুরোনো জীবনের নানা মুহূর্ত টুকরো টুকরো মনে পড়ছিল, মনে পড়ল যেদিন এই রূপমঞ্জরীতে প্রথম পা দেওয়ার দিনটি। সেই কথা মনে পড়তেই স্মরণে এল এখানে প্রবেশের ঠিক আগের মুহূর্তে ঘায়ে গলিত শরীর পূতিগন্ধময় ছিন্ন বস্ত্র সেই পাগলিনীর কথা, যে ছুটে এসে বলেছিল, যাস না, যাস না, মরবি। সেই উন্মাদিনী এখন কেমন রয়েছে কে জানে। রূপসা জানে না মাস কয়েক আগে সেই পাগলি রূপমঞ্জরীর ম্যানেজমেন্টের নির্দেশে এই পৃথিবী থেকে বহুদূরে চলে গিয়েছে কারণ এখানে প্রবেশকারীকে সে বাধা দিত, সাক্ষাৎ এক দৃষ্টিদূষণ ছিল সে অথচ কোনও এক সময়ে চিত্রলেখার অন্যতম প্রিয় ছাত্রী ছিল সেই পাগলিনী, রূপমঞ্জরীতে তার নাম ছিল অম্বালিকা যাকে ভরসা করে প্রথমবার সেই বিশেষ ওষধি প্রয়োগের জন্য দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু….এমনই দুর্ভাগ্য শেষ পর্যন্ত অম্বালিকা সেই ওষধির নিয়ম বজায় রাখতে পারেনি। কীভাবে সেইসব যে ঘটেছিল কেউ জানে না। অম্বালিকাকে বের করে দেওয়া হল রূপমঞ্জরী থেকে, কিন্তু এর মায়া সে কাটাতে পারল না, ওই প্রধান ফটকের পাশ দিয়ে যে মেন রাস্তা তারই উলটোদিকের ফুটপাতে একটি গাছের নীচে আস্তানা গেড়েছিল সে। ওখানেই সারাদিন থাকত আর কোনও মেয়ে এখানে প্রবেশ করতে গেলে ছুটে এসে তাকে প্রবেশে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করত।

এসব কিছুই জানে না রূপসা। চিত্রলেখাও কিছুই বলেননি তাকে।

অনেক অনেক কথা মনে করতে করতে চোখে ঘুম জড়িয়ে এল। ঠিক ঘুম নয় আধো অচেতন, ওইভাবে কতক্ষণ কেটে গেল কে জানে। রাত আরও গভীর হতে আকাশের চাঁদ যখন পশ্চিমে ঢলে পড়েছে, আকাশে পৃথিবীর প্রতি কোনা জ্যোৎস্নার অকৃপণ আলোয় ভেসে যাচ্ছে, তখন রূপসা যেন ঘুমের মধ্যেই অনুভব করল ওর সামনে কে যেন এসে দাঁড়িয়েছে, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। রূপসা চোখ মেলে দেখতে গেল কিন্তু কেন জানা নেই পারল না, কিছুতেই পারল না চোখ মেলে তাকাতে, অথচ স্পষ্ট বুঝতে পারছে কে এসেছে…সাহিল…সাহিল এসেছে ওর কাছে, ঝুঁকে দেখছে রূপসাকে। রূপসার আপ্রাণ ইচ্ছে হল দুই হাত বাড়িয়ে সাহিলকে নিজের বুকে টেনে নেয়, তারপর দীর্ঘক্ষণ ওকে জড়িয়ে কাঁদে, তীব্র কান্নায় ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করে জগতের সবকিছুকে কিন্তু কিছুতেই পারে না, ওই তো সাহিল, হ্যাঁ, চাঁদের আলোতে গন্ধর্বের মতো অপরূপ দেখতে লাগছে সাহিলকে। চন্দনের গন্ধ বের হচ্ছে ওর শরীর থেকে। সাহিলের শরীরের ছায়া পড়েছে রূপসার ওপর, যেন জুঁইফুলের তৈরি কোনও চাদর বিছিয়ে দিয়েছে রূপসার শরীরে এমনই নরম স্পর্শ সেই ছায়ার। গায়ে কাঁটা দিল রূপসার। প্রাণপণে একবারের জন্য চোখ মেলতে গেল আর ঠিক তখনই শরীরের প্রতিটি রোমকূপ দিয়ে অনুভব করল সাহিল ওর কপালে আলতোভাবে হাত রেখেছে। আহ! আঙুলগুলি রূপসার কপালে বেয়ে দুই চোখে আর ঠোঁটের ওপর এমনভাবে বুলিয়ে গেল যেন নিজেকে সারেঙ্গি মনে হল রূপসার, সাহিল সেই সারেঙ্গির তারে হাত বোলাচ্ছে, আর জগতের সব থেকে মধুর সঙ্গীতটি বেজে উঠছে, ছড়িয়ে পড়ছে এই খোলা পৃথিবীর প্রতিটি কোণে। আহ!

হাত সরিয়ে নিল সাহিল। কী এক আবেশে আচ্ছন্ন তার মন। কী তীব্র ইচ্ছে হচ্ছিল এই নারীমূর্তির কপালে আর ঠোঁটে একবার স্পর্শ করতে, সেই ইচ্ছেকে অবদমন করতে করতে শেষে হার মেনে ঘোরের মধ্যেই ফের উঠে এসেছিল ছাদে। চাঁদের আলোয় রূপসার খোলা শরীরটিকে অবিকল একটি দীর্ঘ সারেঙ্গি মনে হচ্ছিল তার, যেন স্পর্শমাত্র বেজে উঠবে মালকোষ কিংবা দরবারি। আর সত্যিই তাই হল, রূপসার কপালে নিজের আঙুল ছোঁয়ানোমাত্র সাহিল স্পষ্ট শুনতে পেল চরাচর জুড়ে অপূর্ব এক সঙ্গীত ছড়িয়ে পড়ছে। সে সুর বড় বেদনার, বড় অশ্রুমাখানো।

জীবনে এই দ্বিতীয়বার শরীরী স্পর্শে শিহরিত হল রূপসা, প্রথমবার হয়েছিল বহুকাল আগে দীপুর কাছে। প্রতিটি রোমকূপ জেগে উঠল তার সাহিলের জাদুস্পর্শে, এ কেমন ছোঁয়া! কেন এমন…ভাবতে ভাবতে চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল রূপসার আর দেখতে পেল সাহিল তার সামনে থেকে সরে যাচ্ছে। চলে যাচ্ছে আজীবনের মতো। সাহিল বলে ডাকতে চেষ্টা করল রূপসা, পারল না। রাত শেষ হয়ে গেল।

মাস ছয়েক পরের ঘটনা। শরতের শেষ দুপুরে রূপমঞ্জরীর সামনে এসে দাঁড়াল একটি ট্যাক্সি। সেখান থেকে বেরিয়ে এল বছর কুড়ি-বাইশের এক তন্বী সুন্দরী। গায়ের রঙ সূর্যের আলোয় যেন ঝলসে উঠছে। চোখে রোদ চশমা, পরনে হলুদ স্লিভলেস টি-শার্ট আর ডেনিমব্লু জিন্স। ঠোঁটে চড়া লিপস্টিক। হাতে একটি ট্রলি ব্যাগ। মেয়েটির নাম পিঙ্কি শর্মা, উত্তরপ্রদেশ থেকে এসেছে সে। রূপমঞ্জরীর মেন গেটের এককোণে সিকিউরিটি অফিসে কথা বলার জন্য এগোতে যাবে অমনই রাস্তার ওপর থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এল এক উন্মাদিনী। তেলহীন উস্কোখুস্কো চুল। পরনের শাড়িটি কোনও একসময় মূল্যবান ছিল কিন্তু এখন শতচ্ছিন্ন, মলিন, গোটা শরীরে গলিত ঘা। দুর্গন্ধে বমি চলে আসবে যে কারও। বয়স বোঝা দায়। দুই চোখ অস্থির আর রক্তবর্ণ।

যাস না। যাস না। মরবি, মরবি। বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে সেই পাগলি।

‘এই ভাগ’ বলে এক প্রহরী বল্লম উঁচিয়ে দূরে সরাতে যায়।

মেয়েটি রুমাল বার করে নাক চাপা দিয়ে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে সেই উন্মাদিনীকে।

প্রহরীর ধমক আর বল্লমের খোঁচার ভয়ে পাগলি আবার দূরে সরে যায় কিন্তু ক্রমাগত বলে যেতে থাকে, মরবি, মরবি, যাস না…।

পিঙ্কি নিজের নাম, আইডি ইত্যাদি জানিয়ে ঢুকে পড়ে ভেতরে। আজ ওর জয়েনিং। চলে যাওয়ার পর সিকিউরিটি অফিসে সদ্য জয়েন করা এক তরুণ ওই পাগলিকে উদ্দেশ করে তার সিনিয়রকে জিজ্ঞাসা করে, এই পাগলিটা কে, স্যার?

সিনিয়র কাজ করতে করতে আলগোছে উত্তর দেন, ওর নাম রূপসা। প্রেমকুঞ্জে একসময় সব থেকে নামী গণিকা ছিল, একদিন কী যে হল…

গল্প এগোতে থাকে আর বিকেল নামতে থাকে রূপনগরীতে।