রূপসা ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
বিলু গাল চুলকোতে চুলকোতে বলছে, কোনও টেনশন নিবি না। চন্দনদা খুব ভালো লোক।
রূপসা প্রথমটায় বুঝতে পারছিল না দাদা কী বোঝাতে চাইছে। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল।
বিলু জড়তাহীন গলায় তার বোনকে বুঝিয়ে যাচ্ছিল, দেখ, বাবার কাজকম্ম করার দিন শেষ, আমি বিজনেসের ট্রাই মেরে যাচ্ছি, শুধু ভালো ক্যাপিটাল নেই বলে এখনও সুবিধা করে উঠতে পারছি না, ফালতু আচার, চাটনি বানিয়ে টাইম ওয়েস্ট কেন করবি? এতে তিনথালা ভাতও হচ্ছে না। আর পার্টি ধরলে দীপু-ফিপুর মতো ক্যালানেকে করে কোনও লাভ নেই। ধরলে শাঁসালো পার্টি ধর। আজ বিকেলে চন্দনদা আসবে। কথা বলে নিস। বাবাকে আমি সেটিং করে নেব। বলে বিলু বেরিয়ে গিয়েছিল।
রূপসার বুঝতে একটু অসুবিধা হচ্ছিল। দাদা হয়ে বোনের জন্য কাস্টমার ধরে আনবে…এতটা কি সম্ভব? যদিও বিলুর প্রতি ঘৃণা ছাড়া রূপসার মধ্যে কোনওদিন আর কোনও অনুভূতিই জন্মায়নি, তবু এই ব্যাপারটাই একটু যেন সংস্কারে বাধছিল ভেবে নিতে। কিন্তু বিলু সমস্ত সংস্কারের ঊর্ধ্বে। দুপুরবেলায় এসে নিজে হাতে ঘর ভালো করে চেক করে বাবাকে একপ্রকার জোর করেই সাইকেলে বসিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। যাওয়ার আগে শুধু রূপসাকে বলেছিল, কোনও টেনশন নিবি না। চন্দনদা লোক খারাপ না। বলে পাক্কা দালালের মতো খৈনির দলাটা নীচের ঠোঁটের ফাঁকে ভরে নিয়ে বিলু বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা বাবাকে ধমকে বলেছিল, এখানে হাঁ করে দাঁড়িয়ে কী শুনছ? যাও, সাইকেলটা রাস্তায় বার করো।
দাদা…
বল…। আরে ধুর, ভয় পাচ্ছিস কেন? চন্দনদা খুব ভালো লোক। প্রচুর টাকা। একটু সেবাযত্ন করবি, একটু গল্প-টল্প করতে আসবে আর কি। কোনও ভয় নেই। বড় হয়ে গেছিস, এত ভয় কিসের? বলে বোনের শরীরের দিকে ভালো করে চোখ বুলিয়েছিল বিলু।
রূপসার ওই মুহূর্তে ঠিক কী হচ্ছিল ঠিক নিজেও বুঝতে পারছিল না, একবার মনে হচ্ছিল বাড়ি ছেড়ে ছুটে পালিয়ে যেতে, একবার মনে হচ্ছিল দাদার গায়ে কেরোসিনের বোতলটা ঢেলে দিয়ে দেশলাই কাঠি ছুঁড়ে ফেলতে। বাবার দিকে একবারের জন্যই তাকিয়েছিল রূপসা, বাবা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল। রূপসার দিকে একবারের জন্যও তাকায়নি।
এসব ছেঁড়া-খোঁড়া ফ্রক না পরে বরং…কিছু একটা বলতে গিয়েও থমকেছিল তারপর একটু গলা নামিয়েই বলেছিল, আলমারিতে দেখিস কোনও শাড়ি-টাড়ি থাকলে…
মায়ের শাড়ি? বেশ স্পষ্ট উচ্চরণেই প্রশ্নটা করেছিল রূপসা।
দেখ কিছু আছে কি না। বলে আর দাঁড়ায়নি বিলু। বাবাকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল।
বিকেলে চন্দনদা এসেছিল। রূপসার থেকে পনেরো বছরের বড় চন্দনদা। অনেক কিছু নিয়ে এসেছিল রূপসার জন্য। ফল, সন্দেশ, কেক, চুড়ি, হার, সালোয়ার কামিজ, সেন্ট, পাউডার।
সেদিন দুপুরে একা ভাত খেতে বসে গা গুলোচ্ছিল রূপসার। খেতে পারেনি। দুই গ্রাস ভাত মুখে দিতেই ভেতর থেকে ঠেলা আসছিল। কাঁঠালবাগানের চন্দনদার বিশ্রী চেহারাটা বারবার মনে পড়ছিল। কী করতে হবে, চন্দন বিশ্বাস কেন আসছে বুঝতে আর সময় লাগেনি রূপসার। একবার মনে হয়েছিল বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবে কোথাও। নিজের বিজনেসের তিনশোটা টাকা আলাদা লুকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু তারপরেই একটা অদ্ভুত জেদ চেপে বসেছিল মনের ওপর। অকারণ একটা আক্রোশ, জগতের সবকিছুর প্রতি। ইচ্ছে করছিল সব ব্যাটাছেলেকে আগুনে পুড়িয়ে দিতে, বাবাকেও। তারপরেই মনে হয়েছিল ওইভাবে নয়, যে শরীর ওর সব থেকে বড় শত্রু তাকে দিয়েই প্রতিশোধ নিতে হবে।
তাই সেদিনের পর আরও বারকয়েক চন্দন আসার পর যখন রূপসা বুঝতে পেরেছিল চন্দনের বত্রিশ বছরের বেঢপ শরীরটা ওকে আর ঘেন্না দিচ্ছে না, স্পর্শই করতে পারছে না, তখন রূপসা ঠিক করে নিয়েছিল ওকে কী কী করতে হবে। চোদ্দ-পনেরো বছরের একটি মেয়ে ঝড়ের বেগে দ্রুত ম্যাচিয়োর হয়ে উঠছিল। পোষা ভেড়ার মতো হয়ে উঠেছিল চন্দন। যতবার বাড়িতে আসত মুঠোভর্তি টাকা নিয়ে আসত। কেরোসিন তেলের ডিলার চন্দন বিশ্বাসের বউটা ছিল দজ্জাল, চার বছরের ছেলেটা হাবা। আর চন্দন কেরোসিন এবং রসের সন্ধানী। প্রথম দিকে বাবাকে বিলু নিয়ে যেত, তারপর বাবা নিজেই চন্দনকে আসতে দেখে, ‘ভালো আছ তো বাবা?’ শরীরের কুশল জেনে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যেত। সংসারের শ্রী ফিরছিল। বছর দুয়েকের মধ্যেই রূপসার নামডাক ছড়িয়ে পড়েছিল পাড়ায়-বেপাড়ায়। স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। পাড়ার বন্ধুরা আর কেউ কথা বলত না ওর সঙ্গে। বিলু প্রথমদিকে যাকে পারত নিয়ে আসত ধরে, তারপর একসময় রূপসা বুঝল এবার ওর টার্ন এসেছে। ততদিনে লোকাল এম এল এ কিংবা এলাকার নামী দাদা পর্যন্ত রূপসা বলতে অজ্ঞান। কার কেমন দম, কোন দেবতা কীভাবে খুশি শিখে নিয়েছিল রূপসা। বাড়ি পাকা করে ফেলেছিল। নতুন চওড়া খাট, সোফা কাম বেড, গ্যাসের লাইন—অনেক কিছু এসে গিয়েছিল ঘরে। কিন্তু বিলুর অত্যাচার বাড়ছিল। যখন-তখন এসে পয়সা চাওয়া, হুড়তাল ফুর্তি করা, মাঝে মাঝে রূপসাকে শাসানো। রূপসা অপেক্ষা করছিল। তারপর একদিন সময় এসেও গেল। এলাকার খতরনাক প্রমোটার সুশান্ত মল্লিক তখন রূপসার রসে হাবুডুবু খাচ্ছে। প্রায় দুই বেলার খদ্দের। যখন খুশি বাড়িতে চলে আসে। এক এক রাতে থেকেও যায়। রূপসার তখন আলাদা ঘর। এক রাতে রূপসার সঙ্গে বিছানায় তুমুল দাপাদাপির সময় সুশান্ত আবিষ্কার করল সেদিন রূপসার মন ভালো নেই। খুনখুন করে কাঁদছে।
এ কী রে? কী হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন?
দাদার জ্বালায় আমি আর পারছি না, সুশান্তদা। রোজ মারধোর করে। আমি এবার কোনদিন গায়ে আগুন দিয়ে মরব দেখো।
সুশান্ত তখন মালের ঘোরে। দাঁত ঘষে বলে উঠেছিল, তুই মরবি কেন? ওই শুয়োরটার বহুত বাড় বেড়েছে, স্রেফ তোর দাদা বলে এতদিন ছেড়ে দিয়েছি। দেখছি এবার।
খুব বেশি দিন দেখতে হয়নি রূপসাকে, দুই দিন পরেই রেললাইনের ধার থেকে মর্গে পাঠানো বিলুর ক্ষতবিক্ষত বডিটা একবার শনাক্ত করতে মর্গে যেতে হয়েছিল রূপসাকে। ব্যস!
তারপর থেকে বাবার কী যেন হল। ভীষণ ভয় পেতে শুরু করল রূপসাকে। কোনও কথা বলত না, শুধু ভয়ে ভয়ে তাকাত। রূপসার মাঝে মাঝে কষ্ট হত আবার এক এক সময় ভালো লাগত বাবার এই ভয়। বাবার মাথাটা বিগড়োতে শুরু করেছিল। মাঝে মাঝেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ত। ফিরত না। খেতে-নাইতে ভুলে যেত। তারপর একদিন আর ফিরল না। সত্যি বলতে আর কেউ না জানুক, বাবা, শুধু বাবার জন্যই ওই পাড়ায় তখনও আটকে ছিল রূপসা। দিন পনেরো পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যখন বাবা ফিরল না, রূপসা তারপর আর দেরি করেনি। এক বিকেলে বাড়িতে তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল কলকাতার পথে।
সেখান থেকে কখনও মুম্বই, কখনও দিল্লি, এলাহাবাদ, গোয়া আবার কলকাতা। এক অদ্ভুত জীবন। যত দিন গিয়েছে নিজেকে আরও শাণিত করেছে রূপসা। নিজের শরীরকে করে তুলেছে আরও ঐশ্বর্যময়ী। এসকর্ট সার্ভিস, প্লেজার ট্রিপে রোজগার বেশি। সেগুলোই প্রেফার করত রূপসা। দুই-তিনটে সল্প পর্নোতে কাজ করে বুঝেছিল অতি অখাদ্য। ইউরোপ-আমেরিকান পর্নোর ধারে-কাছ দিয়েও যায় না ইন্ডিয়ান পর্নো অ্যাক্টররা। সস্তায় বাজিমাত করার চেষ্টা। কয়েকটা এজেন্সিতে নাম লেখানো ছিল রূপসার। তাদের কলে যতবার শহর ছেড়ে ক্লায়েন্টের সঙ্গে শহরের বাইরে যেতে হয়েছে, বেশ ভয়ই করত। দুই-একবার প্রাণে মরতে মরতে বেঁচেছিল। তবে শেষবার যখন এক ক্লায়েন্ট ব্যাঙ্গালোরের এক হোটেলের রুমে রূপসার ওপরে অনেক নির্যাতন করার পরে ওর ভেতরে বোতল ঢোকানোর চেষ্টা করছিল তখন ওই বোতল কেড়ে নিয়ে ক্লায়েন্টের মাথায় বাড়ি দিয়ে তাকে আহত করে ওই রাতেই হোটেল ছেড়ে পালিয়েছিল। ঠিক করে নিয়েছিল আর শহরের বাইরে নয়। অন্য কিছু ভাবতে হবে। তখন যোগাযোগ হয়ে গিয়েছিল এই রূপমঞ্জরীর সঙ্গে। প্রায় দশ বছরের অভিজ্ঞতায় রূপসা একটা জিনিস বুঝেছে এই প্রফেশনে সেই মেয়েদের চাহিদা বেশি যারা অত্যাচারী পুরুষদের নানারকম অত্যাচার সহ্য করতে পারে। ধর্ষকাম পুরুষের সংখ্যাই যেন পৃথিবীতে বেশি। নারীশরীরে যন্ত্রণা দিয়ে, তাকে ক্ষতবিক্ষত করাই যেন একমাত্র সুখ। আর সেই সুখের যে কতরকমের বিকৃতি! এক একটা রাত যেন সাক্ষাৎ নরকের মতো বিভীষিকা হয়ে উঠেছে রূপসার কাছে। কত গোপন অশ্রু, হতাশা, যন্ত্রণার সাক্ষী হয়েছে তার একা বালিশ, স্নানঘর। কিন্তু কাঁদতে রূপসার লজ্জা হয়। নিজের প্রতি ঘৃণা আসে। প্রতিটি অশ্রুকেই আগুনের কণা বানিয়ে আরও জ্বলে উঠতে চায় ও। পুড়ে যেতে চায়। এ যেন নিজের প্রতিই এক প্রতিশোধ, কিসের প্রতিশোধ? জানা নেই।
স্বপ্নের মধ্যে আজ বহুকাল পর দাদার মৃত মুখটা একঝলক মনে এল। বিকৃত মুখ, গলার নলি কাটা সেই মুখটা। ঘুমের রেশটা কেটে গেল রূপসার। উঠে বসল। গোটা শরীরে অসহ্য ব্যথা। আজ আবার ওষুধ নিতে হবে।
রূপমঞ্জরীতে যত রকমের রূপচর্চা এবং ওষুধ ব্যবহার করা হয় সবই প্রাচীন এবং ভেষজ। তিনজন কবিরাজ রয়েছেন এখানে চিকিৎসার জন্য। এবং যাবতীয় ভেষজের চাষও এই রূপমঞ্জরীর জমিতেই হয়।
ফিলিপেরও ঘুম ভাঙল। উঠে বসে রূপসাকে বলল, সময় হয়ে গিয়েছে কি?
বোধহয় হয়নি। এখনও বার্তাবাহী আসেনি…।
আমি আবার আসব এখানে। তোমার আকর্ষণেই আমাকে ভারতে আসতে হবে। সামনের মাসে আমার এক বন্ধু ভারতে আসবে। এখানে ওকে অবশ্যই আসতে বলব।
বিছানার পাশে থালায় কিছু ফল রাখা ছিল। সেখান থেকে একটা আপেল তুলে কামড় বসাল ফিলিপ। নিজে দুটো কামড় দিয়ে রূপসার মুখের সামনে ধরল। রূপসাও কামড় দিল একটা।
ঘরের ভেতরে হঠাৎই সেতারের শব্দ। কলিং বেল বেজে উঠেছে। মানে দূত এসে গেছে। ফিলিপকে মনে করাতে যে তার বেরোনোর সময় হয়ে গিয়েছে।
রূপসা সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থাতেই উঠে গিয়ে দরজা খুলল। সামনে পরিচারিকা দাঁড়িয়ে।
প্রণাম করে বলল, ফিলিপ মহাশয়ের বেরোনোর সময় হয়ে গিয়েছে।
হ্যাঁ, ঠিক আছে। ধন্যবাদ।
আবার নমস্কার করে চলে গেল পরিচারিকা।
এখানে সকল পরিচারক-পরিচারিকার অন্যতম কাজ হল কোন গণিকা কোথায় রয়েছে তার সম্পর্কে প্রতিমুহূর্তে খবর রাখা। সকল পরিচারক-পরিচারিকার কানের ফুটোয় একটি মাইক্রোফোন গোঁজা থাকে। অফিস রুম থেকে তাদের যাবতীয় নির্দেশ ওই চিপের মাধ্যমে দেওয়া হয়ে থাকে।
রূপসা পিছন ফিরে দেখল ফিলিপ উঠে পড়েছে। রূপসা মনে মনে ভাবল, উফফ! এবার মুক্তি। এবার পুরো একটা দিন বিশ্রাম নিতে হবে। এই বিশ্রাম ম্যানেজমেন্ট অ্যালাউ করে।
বিশ্রাম পাবে এই ভাবনার আনন্দেই ফিলিপকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল রূপসা। ফিলিপও ওকে চেপে ধরে চুমু খেল। দুই স্তনে কঠোরভাবে মর্দন করে নিজের শিশ্নটি ঠেসে ধরল রূপসার পেটে।
এই রে, আবার শিশ্ন শক্ত হয়ে উঠছে! কিন্তু ভয় বা বিরক্তি দেখালে চলবে না। রূপসা ফিলিপের দৃঢ় ও দীর্ঘ লিঙ্গটি ধরে ঝুঁকে একটি চুমু খেল। তারপর খিলখিল করে হেসে ফিলিপকে পরিয়ে দিল সাদা সিল্কের ধুতি। গায়ে খানিকটা কস্তুরী তেল মাখিয়ে জড়িয়ে দিল উত্তরীয়। বাইরে রথ অপেক্ষা করছে। ফিলিপ রূপসাকে বিদায় জানিয়ে উঠে পড়ল রথে। প্রেমকুঞ্জ ছাড়িয়ে বাইরের অংশে একটি মস্ত বিল্ডিং রয়েছে, সেখানে ক্লায়েন্টদের নিজেদের লাগেজ, জামাকাপড় রাখার এবং তাদের কেয়ারটেকার, বা পি এ ইত্যাদিদের থাকার ব্যবস্থা। ফিলিপকে আগে ওখানে নিয়ে যাওয়া হবে। তারপর সেখানে এই পোশাক ছেড়ে নিজের পোশাক পরে কাউন্টারে পেমেন্ট মিটিয়ে রূপমঞ্জরীর গাড়িতে সোজা এয়ারপোর্ট।
রূপসা আবার শুয়ে পড়ল বিছানায়। আরও ঘুম দরকার। শরীর জুড়ে ব্যথা, ভীষণ ব্যথা।
বেশ রাত হয়েছে। চিত্রলেখার ঘরে বসেছিল রূপসা। রিপোর্ট নিচ্ছিল। এটাও প্রেমকুঞ্জের নিয়ম। কোনও নির্দিষ্ট গণিকার কাছে যদি কোনো ক্লায়েন্ট চব্বিশ ঘণ্টার অধিক সময় থাকে, তাহলে শেষে ক্লায়েন্ট এবং সেই গণিকা উভয়ের কাছ থেকেই ফিডব্যাক নেওয়া হয়। সেই অনুসারে রিপোর্ট তৈরি হয়। ভবিষ্যতের প্ল্যানিং হয়।
চিত্রলেখা খুব মন দিয়ে শুনছিলেন রূপসার কথা।
রূপসা বলে যাচ্ছিল। আমি এইভাবে আর পারছি না মা, বড় যন্ত্রণা। ছেলেগুলো এত যন্ত্রণা দিয়ে কী সুখ পায় জানি না। রূপসার বিবিধ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ফিলিপের রেখে যাওয়া আঘাতের চিহ্নগুলো পরম মমতায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দেখছিলেন চিত্রলেখা। কোথাও কালশিটে, কোথাও আঁচড়ে রক্ত জমে রয়েছে। গত রাতে সঙ্গমের সময়ে ফিলিপ রূপসার ডানহাতটা এমনভাবে মুচড়ে দিয়েছিল যে তখনই যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠেছিল রূপসা। তারপর থেকে ডানহাতটা নাড়াতেও কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু ফিলিপের কাছে এই ব্যথা প্রকাশ করার উপায় ছিল না। তাহলে ওর মনে খারাপ প্রভাব পড়তে পারত। আসলে ইন্ডিয়ান ক্লায়েন্টদের নিয়ে রূপসার খুব বেশি সমস্যা হয় না, কিন্তু ভয় লাগে ইওরোপিয়ান দৈত্যগুলোকে। শালাদের গায়ে যেন অসুরের শক্তি। আর রূপসার এমন কপাল এরা বেশিরভাগই রূপসাকে পছন্দ করে নায়িকা হিসেবে। আসলে রূপসার চেহারার মধ্যে এমন একটি ভারতীয় লালিত্য রয়েছে যা এক দর্শনেই যে কেউ মুগ্ধ হয়। আর হরিণের মাংসই তার শত্রু।
আমি কোনোদিন এবার মরেই যাব। আর বেঁচে থেকেই বা কী লাভ, মা? অনেকদিন হয়ে গেল পৃথিবীতে। আমার কোনও পিছুটান নেই, কাউকে কোনও কৈফিয়ত দেওয়ার নেই। অনেক বছর হয়ে গেল পৃথিবীতে বেঁচে রয়েছি, আর ভালো লাগছে না।
চিত্রলেখা তাঁর অত্যন্ত গুণী ছাত্রীটির দিকে তাকিয়ে শুনছিলেন। জীবনে বহু গণিকা তিনি তৈরি করেছেন। তাদের অনেকেই আজ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছে। আবার কেউ অন্ধকারে তলিয়েও গিয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত যাদের তৈরি করেছেন তাদের মধ্যে নিজের মনের মতো ছাত্রী পেয়েছেন মাত্র গুটিকয়েক। রূপসা সেই গুটিকয়েকের মধ্যে একজন। মেয়েটির মধ্যে শেখার আশ্চর্য ক্ষমতা রয়েছে। আত্মবিশ্বাস, শেখার আগ্রহ এবং সেই শিক্ষাকে কাজে লাগানোর নিপুণ ক্ষমতা তো রয়েছেই, তার সঙ্গে রয়েছে অদম্য জেদ, পরিশ্রম করার ক্ষমতা। চিত্রলেখা টের পান মেয়েটির অনেক গভীরে একটি গনগনে আগুন রয়েছে, তার জ্বলনেই ওর এই শক্তির প্রকাশ। বেশ্যা অনেক প্রকারই হয়, কুলটা, রূপজীবী, স্বৈরিণী, কিন্তু একজন আদর্শ গণিকার মধ্যে শুধু শরীরের রূপ নয়, শিল্প-শাস্ত্র সম্পর্কেও জ্ঞান থাকা আবশ্যিক। আর রূপসা এই কয়েক মাসে নিজেকে এইসব বিষয়ে যে পরিমাণে উন্নত করেছে তা অসাধারণ। এবং আগামীদিনে রূপসা যে চিত্রলেখার জায়গাটিও নিতে পারে, সেই ভাবনাও ম্যানেজমেন্টের কানে চিত্রলেখাই দিয়েছে। একজন গণিকার অন্যতম গুণ হল তার অন্তরে পুরুষের প্রতি কোনও আসক্তি, কোনও প্রেম থাকবে না অথচ প্রেমের অভিনয়ে অনন্যা সে হবে শ্রেষ্ঠতমা। নায়কের কাছ থেকে ছলাকলায় যত বেশি সম্ভব ধনসম্পদ আদায় করতে জানতে হবে। সঙ্গীত, নৃত্য, কাম, অঙ্গরাগে সে হবে অসামান্যা। এইসব গুণই রূপসার মধ্যে রয়েছে। মেয়েটি বাধ্য। তাই ওকে বেশ নিজের মতো করে তৈরি করছেন চিত্রলেখা। কোনও গভীর যন্ত্রণা ওর রয়েছে অন্তরে যা ও কখনোই স্বীকার করে না, কিন্তু এই যন্ত্রণার তুষের আগুনেই সারাক্ষণ জ্বালিয়ে রাখে নিজেকে। চিত্রলেখা তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় জানেন অধিকাংশ মেয়েই বিশেষ করে ভারতবর্ষের মতো দেশগুলিতে মেয়েরা শরীরকে বিক্রয়যোগ্য করে বা বেশ্যাবৃত্তিতে আসে নেহাত দায়ে পড়ে। তাই এই বৃত্তিটির প্রতি তাদের না রয়েছে কোনও সম্মানবোধ, না রয়েছে ভালোবাসা, সেই কারণে পেশাদারিত্বও নেই। কিন্তু পৃথিবীর আদিমতম এই পেশায় কোনও অসম্মানের ব্যাপার নেই, বাকি আর পাঁচটি পেশার মতো এটিও যথেষ্ট সম্মানজনক এবং রীতিমতো পরিশ্রম করেই নিজেকে এই পেশার যোগ্য করে তুলতে হয়, তা নিয়ে কেউ ভাবে না। এই কাজটিই চিত্রলেখা করে আসছেন।
রূপসার চিবুক ধরে নিজের মুখের সামনে ধরলেন তিনি। ওর কপালে একটা চুমু খেলেন। তারপর মায়ের মতোই মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, খুব কষ্ট, তাই না?
চিত্রলেখার এমন স্পর্শে বুকের ভেতরটা এক মুহূর্তে কেমন যেন করে উঠল রূপসার। চোখ ঝাপসা হয়ে উঠতে চাইল। খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিতে চাইল রূপসা, সেটা চিত্রলেখার নজর এড়াল না। বললেন, তুমি খুব অল্প বয়সেই অনেককিছু সহ্য করে ফেলেছ। বুঝি কিছুটা। দেখো রূপসা, গণিকা যখন অল্পবয়স তখন সে বালা, তারপর যুবতী এবং প্রৌঢ়া আর সব শেষে বৃদ্ধা। যুবতী পর্যন্ত একজন গণিকার মূল্য। এই পেশায় পেনশন, গ্র্যাচুইটি, পি এফ কিছুই নেই। নিজেরটুকু এই কয়েক বছরের মধ্যেই গুছিয়ে নিতে হয়। এবং খেয়াল রাখতে হয় যেন অসুস্থ না হয়ে পড়ে। তুমি একজন সচেতন, বুদ্ধিমতী মেয়ে আমি জানি, কিন্তু তোমার আবেগকে তুমি লুকিয়ে রেখেছ যা কাউকে দেখাতে দাও না। কী, ঠিক বলছি তো?
রূপসার চোখ এবার সত্যিই ঝাপসা হয়ে গেল। দুই হাতে চিত্রলেখাকে জড়িয়ে ধরল। বহু যুগ রূপসার চোখে জল আসে না, অশ্রু শুকিয়ে গেছে কতকাল আগে। আজও এল না, শুধু ঝাপসা। চোখ বন্ধ করে ফেলল রূপসা।
চিত্রলেখা রূপসাকে আলিঙ্গনরত অবস্থাতেই গভীর কিছু একটা ভাবছিলেন। বেশ কিছুদিন আগে থেকেই তিনি ভাবছিলেন কথাটা কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। একটি ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত। যে সিদ্ধান্ত সঠিক না হলে তার পরিণতি ভয়ংকর। একবার সেই ভুল তিনি করেছেন যার খেসারত দিতে হচ্ছে একজনকে এই রূপমঞ্জরীর বাইরে। তারপরে তিনি ঠিক করে নিয়েছিলেন আর নয়, কিন্তু অনেকদিন পর আজ আবার কী করা উচিত ভাবতে ভাবতে শেষে ভেবে নিলেন তাঁর এই প্রিয় ছাত্রীটির জন্য সত্যিই এই ঝুঁকি আরও একবার তাঁকে নিতে হবে।
রূপসাকে নিজের শরীর থেকে সরিয়ে তার দুই কাঁধে হাত রেখে চিত্রলেখা বললেন, শোনো, তোমার সঙ্গে আজ আমার অত্যন্ত গোপন এবং গুরুত্বপূর্ণ কথা রয়েছে।
অনেক রাত। রূপসা বসে রয়েছে চিত্রলেখার ঘরে। ঘরে শুধু একটি হলদে বাতি জ্বলছে। দরজা বন্ধ। দুজনেই ঘরের মেঝেতে মুখোমুখি বসে। এক আশ্চর্য কাহিনি রূপসাকে শোনাচ্ছেন চিত্রলেখা। পলিনের কাহিনি।
নেপোলিয়ন বোনাপার্টের অত্যন্ত আদরের বোন পলিন ছিলেন অপরূপ সুন্দরী। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সৌন্দর্যও চাঁদের আলোর মতো ছড়িয়ে গেল চারদিকে। নিজের সৌন্দর্যের প্রতিও পলিন ছিলেন খুব অল্পবয়স থেকে সচেতন। সুন্দরী এবং কামুকতা এই দুইয়ের মেলবন্ধন কিশোরী বয়স থেকেই পলিনকে করে তুলেছিল স্বেচ্ছাচারী। মাত্র তেরো বছর বয়স থেকেই নানা বয়সের পুরুষের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে। ব্যভিচারের চূড়ান্ত নিদর্শন হয়ে ওঠেন পলিন। নেপোলিয়নও নাজেহাল হয়ে ওঠেন তাঁর বোনের এমন আচরণে। কিন্তু কখনোই তিনি তাঁর বোনের প্রতি নির্দয়, কঠোর হয়ে উঠতে পারেননি। ফলে পলিনও যখন যা খুশি তাই করে গিয়েছেন। বোনের আচরণকে সংযত করার জন্য নেপোলিয়ন খুব অল্প বয়েসে প্রিন্স কামিলোর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেন। কিন্তু পলিনের উদ্দামতা, স্বেচ্ছাচারিতা তাতে একটুও কমল না। ১৮০৪ সালের ১৮ মে নেপোলিয়ন নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেছিলেন। তারপর থেকে পলিনের উদ্দামতা আরও বেড়ে যায়। দুই হাতে উজাড় করে ঢালতে থাকেন ধনসম্পদ, যৌনতার প্রতীক হয়ে ওঠেন তিনি। বলে একটু থামলেন চিত্রলেখা। তারপর আবার বললেন, এতটাই কামুক প্রকৃতির এবং নিজের শরীরী ঐশ্বর্য দেখানোর জন্য লালায়িত ছিলেন পলিন যে প্রাসাদে তাঁর অতিথিদের সঙ্গে দেখা করতেন স্নানরতা অবস্থায়। প্রতিদিন কুড়ি লিটার দুধে স্নান করতেন তিনি। এবং সেই অতিথিদের সামনেই স্নান সেরে গা মুছে পোশাক পরতেন। যে পুরুষ অতিথিকে তাঁর মনে ধরত তার সঙ্গে সঙ্গম করতেন। এইভাবেই চলতে চলতে পলিন একদিন নিজেকে আয়নার সামনে আবিষ্কার করলেন তাঁর গলার চামড়ায় বয়সের ভাঁজ দেখা যাচ্ছে। হাহাকার করে উঠলেন তিনি। দেশের তাবড় বৈদ্যদের ডেকে বললেন, নিজের যৌবনকে অটুট রাখা যায় এমন কোনও ওষধি যদি কেউ দিতে পারে তাকে তিনি ধনসম্পদে ভরিয়ে দেবেন।
শুধু তাই নয়, পলিন যৌনতার সময়ে পুরুষের শারীরিক অত্যাচারকে উপভোগ করতেন, ধর্ষকামী পুরুষ ছিল তাঁর প্রিয়, কিন্তু তার ফলে শরীরে যে নানাবিধ ক্ষত তৈরি হত সেটা আবার তাঁর না-পসন্দ। তাই দিকে দিকে পলিনের বার্তা ছড়িয়ে গেল এমন কোনও ঔষধ প্রয়োজন যা পলিনের যৌবনকে যেমন অনন্তকাল ধরে রাখবে তেমনই সঙ্গমকালীন কোনওপ্রকার ক্ষতচিহ্ন তাঁর শরীরে সঙ্গমশেষে স্থায়ী হবে না। কিন্তু চিকিৎসাশাস্ত্রে এমন কোনও ওষধি ছিল না, ফলে বৈদ্যরা ব্যর্থ হলেন, পলিন মনমরা হয়ে পড়লেন। নাওয়া-খাওয়া প্রায় বন্ধ। তখন তাঁর এক বিশ্বস্ত দাসী খোঁজ আনল এক পিশাচসিদ্ধের। সে জানে এই ওষধির সন্ধান। পলিন পালকি চেপে গেলেন তার কাছে। গভীর অরণ্যের মধ্যে সেই পিশাচসিদ্ধের বাস। পলিনের কথা শুনে তিনি তাঁকে আহ্বান করলেন সঙ্গমে। সেই বিকটদর্শন পুরুষকে দেখেই বিবমিষা হচ্ছিল পলিনের, কিন্তু তিনি তখন নিজের রূপ-লাবণ্য এবং নিজেকে অক্ষত রাখার চেষ্টায় মরিয়া। কাজেই তাঁর সঙ্গেও সঙ্গমে লিপ্ত হলেন পলিন। দীর্ঘক্ষণ সেই সঙ্গম চলার পর তৃপ্ত হলেন সেই পিশাচসিদ্ধ। পলিনকে বললেন, তোমাকে এমন এক জিনিস দেব আমি তাতে তুমি অনন্তকাল নিজের রূপ-যৌবনকে ধরে রাখতে পারবে। এবং তোমার শরীরে পুরুষের তৈরি কোনও ক্ষত সঙ্গম শেষে আর স্থায়ী হবে না, মিলিয়ে যাবে। বলে তিনি ছোট একটি শিশি পলিনের হাতে দিয়ে বললেন, এই ওষধিতে স্বয়ং পিশাচ অবস্থান করে। ঊষাকালে ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে এই শিশি থেকে মাত্র একফোঁটা হাতে নিয়ে নিজের গোটা শরীরের সর্বত্র ভালো করে মালিশ করবে। পায়ু, যোনি, নাক-কানের ফুটোর ভেতরেও আঙুলের সাহায্যে এই ওষধি স্পর্শ করাবে। জীবনে আর কখনও সঙ্গমকালীন কোনও আঘাত তোমাকে আহত করবে না, রূপ এবং যৌবন অটুট থাকবে। কিন্তু তুমি হয়ে উঠবে পিশাচিনী।
পলিন শিশিটি পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলেন। ফিরে আসতে যাবেন তখন পিশাচসিদ্ধ বললেন, কিন্তু সাবধান, জীবনে যদি কখনও কোনও পুরুষের স্পর্শ অনুভব করো তাহলে কিন্তু ভয়ংকর বিপদ নেমে আসবে তোমার জীবনে।
মানে? এ আপনি কী বললেন? আমি সম্ভোগ করতে পারব না?
সে কথা বলিনি। ইচ্ছেমতো সম্ভোগ করো কিন্তু পুরুষ যেন তোমাকে না ছোঁয়। তাহলেই সর্বনাশ।
আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। পুরুষ না ছুঁলে মিলন কী করে হবে? জিজ্ঞাসা করলেন পলিন।
তার উত্তর দিলেন না পিশাচসিদ্ধ। বললেন, এর উত্তর ব্যবহারকারীকে নিজেকেই বুঝতে হবে।
পলিন আবার জিজ্ঞাসা করলেন, পুরুষকে সম্ভোগে কোনও সমস্যা নেই তো?
না। উত্তর দিলেন পিশাচসিদ্ধ।
ব্যস, আর কিছু আমার জানার দরকার নেই।
দরকার আছে। এই জিনিস তুমি যদি সহ্য করতে না পারো তাহলে নিজে হাতে ফেলে দিতে পারবে না, তাহলে তোমার কাছে আবার ফিরে আসবে। তোমাকে এটা তুলে দিতে হবে যোগ্য কোনও নারীর হাতে যা সে সবকিছু তোমার মুখ থেকে শুনে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করতে রাজি হবে। মনে থাকবে?
পলিন ঘাড় নেড়ে খুশি হয়ে ফিরে এলেন। আর এই পুরো ঘটনার সাক্ষী থাকল পলিনের বিশ্বস্ত পরিচারিকা রুসভেলা। সর্বক্ষণের ছায়াসঙ্গী রুসভেলাই খবর এনেছিল এই পিশাচসিদ্ধের। তারপর যা হওয়ার তাই হল, ওই ওষধি হাতে পেয়ে পলিন যেন স্বর্গলাভ করলেন। একের পর এক পুরুষ সঙ্গী। উদ্দাম যৌনাচার। নেপোলিয়ন খুবই বিব্রত হতেন তাঁর বোনের এমন আচরণে, কিন্তু অতিরিক্ত স্নেহের কারণে বোনকে কড়াভাবে কিছু বলতে পারতেন না। পলিন নিজে একটি প্রমোদশালাও খুলে ফেলেছিলেন, সেখানে তিনি অবাধে চালাতেন নিজের স্বেচ্ছাচার। পুরুষের দল পতঙ্গের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ত তাঁর শরীর-আগুনের আকর্ষণে। কিন্তু ওষধির গুণে পলিন ক্লান্তিহীন, অক্ষত, বয়ঃবৃদ্ধি থেমে গেল তাঁর। এমনই চলতে থাকল দিন-মাস-বছর। তারপর একদিন পলিনের শখ হল তিনি গান শিখবেন। সঙ্গীত শিক্ষক নিযুক্ত হলেন ফেলিস ব্লানজিনি। কিন্তু সঙ্গীতের পাঠ নেওয়ার থেকে প্রেমের পাঠেই আগ্রহ তাঁর বেশি। ফলে ফেলিসের সঙ্গেও শুরু হল শরীরী সম্পর্ক। আর ফেলিসের সূত্রেই একদিন পরিচয় হল ওই সময়ের প্রখ্যাত সুরকার অতীব সুদর্শন পুরুষ জিওভোননি পাকিনির সঙ্গে। পরিচয় ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করল, পলিন পাকিনিকে আদর করে ডাকতেন নিনো নামে। কিন্তু নিনোকে কিছুতেই কাছে টানতে পারেন না। কেমন যেন পিছলে চলে যায়। এ যেন সকলের মতো নয়। জীবনে এমন কখনও হয়নি যে পলিন যাকে কামনা করেছেন তাকে কাছে পাননি, বরং পুরুষের দল তাঁকে একবার স্পর্শ করার জন্য পাগল। আর সেখানে পাকিনি যেন…নিজের সুরের জগতেই বিভোর। পলিন মরিয়া হয়ে উঠলেন, জেদ ধরলেন যেভাবেই হোক নিনোকে পেতেই হবে। নিনোও কিছুতেই ধরা দেবেন না। অদ্ভুত নির্লিপ্ত। পলিনের রূপ যেন তাঁর চোখে কোনও আগুনই তৈরি করে না। এই পরাজয়, হীনম্মন্যতায় শেষে অসুস্থ হয়ে পড়লেন পলিন। শয্যাশায়ী। একদিন গভীর রাতে, পলিন নিজের শয্যায় আধোঘুমে। পালঙ্কের নীচে বসে রয়েছে দাসি রুসাভেলা। এমন সময় পাকিনি এলেন পলিনের কাছে। শুধু একটিবারের জন্য পলিনের জ্বরতপ্ত কপালে নিজের করতল স্পর্শ করে আবার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
আর সেই ঘটনার কিছুদিন পর থেকেই দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেন পলিন। গোটা শরীর জর্জরিত। বহু চিকিৎসা হল, কিন্তু পলিন বাঁচলেন না। শেষ দিকে মাথাটাও বিগড়ে গিয়েছিল। আবোল-তাবোল বকতেন। মরে যাওয়ার আগে ওই শিশিটা রুসাভেলাকে দিয়েছিলেন। রুসাভেলা ওই শিশি রেখে দিয়েছিল। সে নিজে কখনও এই ওষধি ব্যবহার করেনি, কিন্তু তার হাত থেকে এই শিশি ঘুরতে ঘুরতে একসময় পৌঁছল আমার হাতে। আমি তখন এথেন্সে। নিজের কাজের কারণেই ওখানে ট্যুর করছি। একটি অতি প্রাচীন পানশালায় আলাপ হয়েছিল এক বৃদ্ধা গণিকার সঙ্গে। দেখেই মনে হয়েছিল তিনি বেশ অসুস্থ। তাঁর জীবনের অনেক কাহিনি শুনতে শুনতে আমি নোট নিচ্ছিলাম। কামকলায় তাঁর নিজস্ব কিছু বিশেষ ভাবনা ছিল সেগুলো খুব আগ্রহব্যঞ্জক। মহিলা আমার প্রতি কেন জানি না বেশ সদয় হয়ে ওঠেন, আমাকে ওঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ করেন। বেশ অনেক কথার পর আমাকে বললেন, তাঁর মৃত্যুর আর খুব বেশি দেরি নেই। মারণরোগে আক্রান্ত তিনি। পোশাকের ভেতরে তাঁর শরীরের অনেকটাই নাকি দূষিত ঘায়ে ভরা। অনেক চিকিৎসায় তা সারেনি। আর বেশিদিন তাঁর আয়ু নেই। আরও দুই-চার কথার পর তিনি আমাকে একটি শিশি দেন। খুব ছোট স্ফটিকের শিশি। তার মধ্যে টলটল করছে সামান্য কয়েক ফোঁটা তরল। আমার হাতে ওইটি দিয়ে বললেন, এইটি রাখো তুমি। তারপর এর ইতিহাসটুকু এবং তিনি কীভাবে এটা পেয়েছিলেন ইত্যাদি জানিয়ে বললেন যদি এর সঠিক ব্যবহার করা যায় তবে এটা আলাদিনের চিরাগ, নইলে এর থেকে ভয়ঙ্কর জিনিস আর নেই। আর সব থেকে বড় কথা এ জিনিস কারও হাত থেকে নিলে তা নিজে ফেলে দেওয়া যায় না। অন্য কারও হাতে তাকে সবকিছু জানিয়ে তুলে দিতে হয়, এটাই নিয়ম।
আমি নিয়ে এলাম। তাঁর কাহিনি সত্যি বলতে খুব যে বিশ্বাস করেছিলাম তা নয়, তবে জগতে কতকিছুই তো ঘটে যা আমাদের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বাইরে। আমি শিশিটা রেখে দিয়েছিলাম নিজের কাছে। কোনওদিন নিজে ব্যবহার তো করার কথা তো ভাবিইনি, কাউকে দিইওনি। কিন্তু একবার মাত্র…থেমে গেলেন চিত্রলেখা।
রূপসা পিঠ সোজা করে চিত্রলেখার মুখের দিকে তাকিয়ে এই আশ্চর্য কাহিনি শুনছিল।
চিত্রলেখা এক চুমুক জল খেয়ে বললেন, রূপসা, তুমি যদি চাও তোমাকে এই ওষধি আমি দিতে পারি, কিন্তু এর ফলাফল যেমন ভালো দেখেছি, ভয়ঙ্করও আমার নিজের চোখে দেখা। তাই তুমি ভেবে দেখো। সিদ্ধান্ত তোমার ওপর। আসলে আমি তোমাকে বিশেষ স্নেহ করি, তোমার আগে আরেকজন এমনই এক প্রিয় ছাত্রী ছিল আমার। অম্বালিকা নাম ছিল তার। সেও ছিল তোমার মতোই প্রতিভাময়ী। আমার অত্যন্ত স্নেহের পাত্রী ছিল সে। এই তোমার মতোই চেহারার গড়ন এবং অন্তরে পুরুষ-বিদ্বেষী। অত্যন্ত কোমল শরীর। সামান্য আঘাতও তার ত্বক সইত না। ফুটে উঠত। একবার এক নায়কের রেখে যাওয়া ক্ষত অন্য নায়ক সহ্য করে না তুমিও জানো। এতে সবদিকেই সমস্যা তৈরি হচ্ছিল। তাই আমি বাধ্য হয়ে একদিন ওকে এই ওষধির শিশি দিলাম। সেই প্রথম। সে নিয়ে এটা ব্যবহারের পরের দিন থেকে সত্যিই আশ্চর্য ঘটনা ঘটতে শুরু করল। অম্বার শরীরে আর কোনও ক্ষত তৈরি হত না; শুধু তাই নয়, কোনও যন্ত্রণাবোধও আর ছিল না অম্বার।
বাকি কথা আর শুনল না রূপসা। হাতজোড় করে বলল, মা, এটা আমি নেব।
তোমাকে দেব বলেই আজ ডেকেছি, কিন্তু ভাবছি কোনও ক্ষতি না হয়, আমার এক প্রিয় ছাত্রীকে এই জিনিসটির জন্য হারিয়েছি।
অম্বাই কি আপনাকে এটা ফেরত দিয়ে গেছে?
হ্যাঁ। ওই দিয়ে গেছিল যাওয়ার আগে। তুমি শুনবে না ওর কি হয়েছিল?
থাক মা, আমি আর কিছু জানতে চাই না। শুনলে হয়তো মনে ধন্দ আসবে। ভয় আসবে। আমি তার জীবনের পরিণতি জানতে চাই না, শুধু এই যন্ত্রণা থেকে একটু রেহাই চাই। একটা সময় ভাবতাম মরে গেলেই বুঝি মুক্তি। কিন্তু ওপরওলা আমাকে কঠিন জীবনসংগ্রামে ফেলবে বলেই হয়তো আমার মনকে খুব কঠিন বানিয়ে পাঠিয়েছে, তাই নিজের দাদাকে খুন করাতে আমার কষ্ট হয়নি। বাবা নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ায় আমার কোনও বেদনাবোধ ছিল না, কোনওদিন কারো ভালোবাসা পাইনি বলে অভাববোধ হয়নি, বরং আমার প্রেমহীনতা আমার জেদ বাড়িয়েছে। লড়াইয়ের জেদ, জেতার জেদ। আপনি আমায় ভরসা করুন, মা।
বেশ। চিত্রলেখা উঠে অন্য ঘরে গেলেন। তারপর ফিরে এলেন হাতে খুব ছোট একটি শিশি। খাঁজকাটা কাচের শিশি, আতরের শিশি যেমন হয়। ভেতরে খুব সামান্য কয়েক ফোঁটা গাঢ় লাল রঙের তরল।
কাল ভোরে সরোবরে স্নান সেরে ঠিক এক ফোঁটা পরিমাণ ডানহাতের তালুতে নেবে, তারপর দুই হাতের তালুতে সেটা ঘষে গোটা শরীরের সর্বত্র মাখবে।
কিন্তু ওই এক ফোঁটা পরিমাণে কি সর্বত্র মাখানো সম্ভব?
হ্যাঁ, শুধু কড়ে আঙুলে তরলটি স্পর্শ করবে তারপর দুই হাতে সেটা মেখে নেবে। ওতেই হবে। কিন্তু শিশিটা খুব সাবধানে রাখতে হবে। কারো নজরে না পড়ে।
তাই হবে, মা। আমি এলাম তবে।
হ্যাঁ, এসো।
চিত্রলেখাকে প্রণাম করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল রূপসা। বাইরে ঘন অন্ধকার। মিহি হাওয়া দিচ্ছে। অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে রূপসার মনে হল আজ যদি মুক্তিরই রাত হবে তাহলে এমন চারদিক অন্ধকার কেন?
শুধু রূপসা আর রূপসা। দেশ-বিদেশ থেকে ক্লায়েন্টরা যেন অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকল রূপমঞ্জরীতে। ত্বরিৎগতিতে চারদিকে ছড়িয়ে গেল রূপনগরের কথা। রূপমঞ্জরীতে এমন এক গণিকা রয়েছে যার নাম রূপসা, পুরুষের শত অত্যাচার, সে সহাস্যে গ্রহণে সক্ষম। ধর্ষকাম, মর্ষকাম, যৌনতায় আরও যতরকমের যন্ত্রণাদায়ক বিকৃতি রয়েছে পুরুষের তাই নিয়ে তারা ছুটে আসতে থাকল রূপসার কাছে। দিনরাত শুধু পুরুষের নানাবিধ লালসাকে চরিতার্থ করতে রূপসা তৎপর। তার ক্লান্তি নেই, ঘুম নেই, প্রতি মুহূর্তে সে উচ্ছ্বাসময়ী, উত্তরোত্তর বাড়তে থাকল তার লাস্যময়তা। সকল নায়কই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। শুধু একক নায়ক নয়, একাধিক নায়কের সঙ্গে সঙ্গমেও রূপসা একইরকম সাবলীল, সকলকে সুখ দিতে সক্ষম। রূপমঞ্জরীর ম্যানেজমেন্ট আবার নজর করল অম্বালিকার পর আবার এই রূপসার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে প্রতি মাসে বিপুল পরিমাণে ইনসেনটিভ জমা পড়ছে। রূপমঞ্জরীর নামও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। সকলেই রূপসাকে বুক করতে চায়। একদিনের জন্যও ফুরসত নেই রূপসার। সকলেই খুশি। শুধু চিত্রলেখা মাঝে মাঝে ভাবেন আবারও তিনি ভুল করলেন না তো? পুরুষ মানুষের ছোঁয়া—এই শব্দের মানে কী তিনি নিজেও জানেন না, একমাত্র যে টের পেয়েছে সে জানে…গণিকার শরীরকে শত শত পুরুষ ছোঁয়, তার মধ্যে আবার পুরুষের ছোঁয়া মানে কী তা বোঝা বড় কঠিন!
রূপসা কোনওদিনই নিজের জীবনকে নিয়ে খুব বেশি কিছু ভাবেনি। যখন যে মুহূর্তে যা মনে হয়েছে তাই করে গিয়েছে। শিশিটা হাতে পাওয়ার পর রূপসার জীবনটা যেন মুহূর্তের মধ্যে বদলে গিয়েছিল। তারপর পেরিয়ে গিয়েছে তিনটে বছর। রূপমঞ্জরীর অন্যতম প্রধান গণিকা রূপসা, তার সামান্য সঙ্গ কামনা করে দেশ-বিদেশের ধনকুবেররা লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে। রূপমঞ্জরীর বাইরে যে একটা পৃথিবী রয়েছে তা অনেকদিন আগেই ভুলে গিয়েছে রূপসা। অপালা, বিশাখারাও ভুলে গিয়েছে, আরও অনেক নতুন গণিকা এসেছে এখানে।
এইভাবে দিন চলতে চলতে একদিন এক শরৎকালের দুপুরে রূপমঞ্জরীর প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকল একটি বিশাল বিলাসবহুল গাড়ি। রূপমঞ্জরীর রিসেপশন অফিসে থামল সেই গাড়ি। দারোয়ান দ্রুতপায়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে দিল। নেমে এলেন এক সত্তর বছর বয়েসি বৃদ্ধ। বয়সের কারণে সামান্য ন্যুব্জ হলেও, পদক্ষেপের রাজকীয়তাটি চোখে পড়ার মতো। পরনে হালকা গোলাপি রঙের গরদের পাঞ্জাবি এবং চোস্ত। পায়ে জরির কাজ করা নাগরা। গলায় সোনার মোটা চেন। মাথার টুপিটি কাশ্মীরি। গালের দাড়িতে হেনা করা। চুলেও তাই। চোখে সুর্মা। সোনার ফ্রেমের গোল চশমা। কালো সিল্কের পাঞ্জাবির ওপর সাদা সুতোর অসামান্য কাজ করা হাতকাটা জ্যাকেটটি চাপানো। তার বুকপকেট থেকে ঝুলে রয়েছে সোনার ঘড়ির চেন। বৃদ্ধের হাতে ধরা একটি কারুকাজমণ্ডিত ছড়ি যার হাতলটি হাতির দাঁতের তৈরি।
বৃদ্ধের সঙ্গে নামলেন মোট চারজন। প্রত্যেকের হাতে বেশ কয়েকটি ব্যাগ। বেশ ভারী ভারী ব্যাগই রয়েছে। বছর তিরিশের এক যুবক বৃদ্ধের ঠিক পাশেই হেঁটে উঠল রিসেপশনে। তার পিঠে একটি লম্বামতো ব্যাগ, আর হাতে আরেকটি। যুবক ছয় ফুটের অধিক লম্বা, ছিপছিপে চেহারা। লম্বাটে মুখের গড়ন, চোখ দুটি তার অপূর্ব সুন্দর। যেন এই জগতে থেকেও সে ডুবে রয়েছে তার নিজস্ব অন্যমনস্কতায়। সরু গোঁফ আর থুতনিতে অল্প দাড়ি। তার পরনে সাদা শেরোয়ানি। মাথায় তারও ওই একইরকম কাশ্মীরি টুপি। বৃদ্ধ খুব নিচু গলায় যুবকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। রূপমঞ্জরীর কর্মচারীরা যথারীতি ব্যস্ত তাদের নবাগত নায়ককে নিয়ে। না যুবক নয়, ওই সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধটি রূপমঞ্জরীর প্রেমকুঞ্জে ‘নায়ক’ হতে এসেছেন।
খুব দ্রুত সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। বৃদ্ধের সঙ্গে আগত তিনজন ব্যক্তির স্থান হল গেস্ট হাউজে আর সেই সুপুরুষ যুবক তার কাঁধে লম্বা ঝোলাটি নিয়ে বৃদ্ধের সঙ্গে রথে চড়ে রওনা দিল প্রেমকুঞ্জের দিকে।
কারা এই দুজন? বৃদ্ধ হলেন লখনৌ-এর বিখ্যাত কুতুব আবু হায়দরের একমাত্র এবং শেষ বংশধর আলী হায়দর। আবু হায়দরের বিলাসিতার কথা এখনও পুরোনো লখনৌ-বাসীদের মুখে মুখে ঘোরে। শৌখিনতার জন্য টাকা কীভাবে ওড়ানো যায় তার নিদর্শন ছিলেন হায়দর সাহেব। শোনা যায় পারস্যের এক রক্ষিতার জন্য তিনি দর হেঁকেছিলেন তিন লক্ষ টাকা। সেই বংশেরই আলীসাহেব। আগের মতো আর সেই পুঁজি না থাকলেও রক্তে সেই ঠাটবাঁট ধরে রেখেছেন যথাসাধ্য। লখনৌতে তাঁর নিজের হাভেলিতে তিনজন স্ত্রী, চারজন রক্ষিতা তো রয়েছেই, এ ছাড়াও ভারতের নানা প্রান্তে আলীসাহেবের মাসোহারা প্রাপ্ত গণিকার সংখ্যা নেহাত কম নয়। দেশ-বিদেশের দামি মদ এবং নানা রূপের গণিকার স্বাদ নেওয়াই আলীসাহেবের শখ। সঙ্গে আসল অম্বুরী তামাক। আলীসাহেবের জন্য সেইকালে পারস্য থেকে আসত বিশেষ তামাক। এক জাতের তিমির পেটে জমা হওয়া প্রাকৃতিক সুগন্ধী থেকে তৈরি হত সেই তামাকের সুগন্ধী। তারপর দিন গিয়েছে, সেই তামাক আর মেলে না। তবে আলীসাহেবের তামাকেও আসল কস্তুরী থাকে। রুপোর আলবোলায় টান দেওয়া মাত্র গুরুক গুরুক শব্দের সঙ্গে যে ধোঁয়া নির্গত হয় তার খুশবুতে মানুষ তো কোন ছার কীট-পতঙ্গরাও মাতোয়ারা হয়ে পড়ে।
রথ এসে থামল প্রেমকুঞ্জের দরজার সামনে। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছে দুইজন গণিকা। আলীসাহেবকে তোয়াজ করে রথ থেকে নামাল তারা। আলীসাহেবের সঙ্গে সেই পিঠে লম্বা ঝোলা যুবকটিও নামল কিন্তু তাকে খাতির করার জন্য কেউ নেই। কে ক্লায়েন্ট, কেমন দেখতে ইতিমধ্যেই প্রেমকুঞ্জের অফিসরুমে ছবি সহ ডিটেল পৌঁছে গিয়েছে। আলীসাহেব নিজের ছড়িটি যুবকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে দুই হাত প্রসারিত করলেন, এবং দুই গণিকার কাঁধে হাত দিয়ে প্রবেশ করলেন প্রেমকুঞ্জে। ভেতরে অপেক্ষা করছে রূপসা। রূপসাকে পছন্দ করেছে আলীসাহেব। আগামী কয়েকদিন রূপসা আলীসাহেবের।