কী করব ঘরে গিয়ে। মোবাইল, ট্যাব, ল্যাপটপ সবই তো জমা করে দিতে হল! এটা কিন্তু খুব বিরক্তিকর।
কিছু করার নেই। টার্মসেই ছিল এগুলো কিছুই ব্যবহার করা যাবে না।
হুঁ, আসলে ওই পরিবেশটাকে পুরোনো বানিয়ে রাখার চেষ্টাতেই এমন পদ্ধতি। তবে বলেছে তো একটা ক্যাফে রয়েছে, সেখানে গিয়ে নেট ব্যবহার করতে পারব।
হুঁ, তা বলেছে। আমার তো ফেসবুকের পুরো ভরপুর নেশা। বলল অপালা। প্রতি দশ মিনিট পর পর ফেসবুক দেখি। ওখান থেকে অনেক ক্লায়েন্টও পেতাম। সত্যি বলতে আমি আমার ক্লায়েন্ট ধরতাম মূলত ফেসবুক, ফ্রেন্ডবুক, ডেটক্লাব এইসব সাইট থেকেই। আগে কাজ করতাম একটা ফ্রেন্ডস ক্লাবে। সেখানে ঝামেলা করে বেরিয়ে এলাম। তারপর একবছর ধরে নিজেই নিজের ক্লায়েন্ট জোগাড় করেছি। একটু চাপ হয়ে যাচ্ছিল। মানে রিস্কি। বিকল্প খুঁজছিলাম, তখনই যোগাযোগ হল এখানে। ওয়েবসাইট দেখে অ্যাপ্লাই করেছিলাম।
ওয়েবসাইট দেখে! অবাক হল বিশাখা। কিন্তু এদের যে ওয়েবসাইট রয়েছে আমি দেখেছি, সেখানে কেরিয়ার অপশনে তো আমাদের…
না না, গণিকা চাই বলে কি আর সরাসরি দিতে পারে? ঘুরিয়ে বলা ছিল। ও ঠিক বুঝতে পেরেছিলাম কী চাইছে, তোমরাও বুঝতে পারবে। ইন্টারভিউতেও অনেক বুঝে-শুনে তারপর আসল কথায় এসেছিল ওরা।
কথার মাঝেই চিরশ্রী বলে উঠল, উফ! আমার কি সিগারেট খেতে ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু এখানে আবার সিগারেট নিষিদ্ধ। মানে ক্লায়েন্ট খেতে পারবে, আমরা পারব না, যদি না ক্লায়েন্ট অফার করে।
হুঁ, আমারও তো এইসময় দুই চুমুক লাগে। বরফ দিয়ে কিন্তু…
ঘরে রয়েছে তো। কিন্তু নিজে নিয়ে খাওয়া বারণ। ক্লায়েন্ট খেলে তবে।
হুঁ, চলো এবার যে যার ঘরে যাওয়া যাক। রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ব। কাল ভোরে ওঠা।
ওদের চারজনের ঘর খুব কাছে না হলেও এক ঘর থেকে অন্য ঘরটি দেখা যায়। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্রায় দশ-বারোটি ঘর রয়েছে। সবকটাই একই ধরনের।
আমাদের ঘরগুলো কিন্তু দারুণ তাই না? বলল চিরশ্রী।
হুঁ, মিলনকক্ষ, স্নানকক্ষ দুটোই জব্বর।
কেন, ছাদটা দেখোনি?
বিশাখার প্রশ্নে রূপসা অবাক হয়ে বলল আবার ছাদেও যাওয়া যায় নাকি?
হ্যাঁ, খুব সুন্দর ছাদ তো। বারান্দার এক কোণে দেখো একটা সিঁড়ি রয়েছে। ছাদেও বেশ সুন্দর একটা খাট, আরও সব টুকটাক জিনিস রাখা রয়েছে। মানে নাগরের ছাদে করার ইচ্ছে হলে ওখানে উঠেও পক পক করতে হবে বলে হাত দিয়ে সঙ্গমের ইঙ্গিত করল বিশাখা।
কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম। বলল রূপসা।
এবং সেটাও শাস্ত্রীয় পদ্ধতিতে।
আবার হাসির রোল।
কিন্তু এত আয়োজন, তেমন লোক কিন্তু দেখছি না। সবই ফাঁকা ফাঁকা।
দাঁড়াও, রয়েছে নিশ্চয়ই। কতটুকুই বা দেখেছি একদিনে? জায়গাটা যে পেঁয়াজের খোসার মতো সেটা বুঝে গেছি। একের পর এক লেয়ার। এখানেই পৌঁছেছি কতগুলো গেট পেরিয়ে বলো।
তা ঠিক। আরও অন্দরমহল রয়েছে নির্ঘাত।
বিচিত্র জায়গা সত্যিই! এখানে থাকতে থাকতে কয়েকদিন পর আমি কোন যুগের মানুষ সত্যিই ভুলে যাব। অপালা বলল।
যা বলেছ, বিচিত্র জায়গাই বটে, নইলে কোনওদিন ভাবতেও পারিনি সেক্স করানোরও স্কুল হতে পারে! বলে নিজেই হেসে উঠল রূপসা।
চিরশ্রী বলল, না গো, এমন স্কুল ভারতে প্রথম হতে পারে, বা থাকলেও এমন পুরোনো স্টাইলের এটাই হয়তো প্রথম কিন্তু অন্য দেশে এমন স্কুল শুধু নয়, ইউনিভার্সিটিও রয়েছে, এবং সেখান থেকে রীতিমতো সার্টিফিকেট কোর্স করা যায়।
মানে! অপালার গলায় বিস্ময়।
চিরশ্রী হেসে বলল, পর্নস্টার হওয়ার কোর্স। তোমরা কেউ রকো সিফ্রেদির নাম শুনেছ?
বিশাখা বলল, শুনিনি আবার! ইতালিয়ান পর্নস্টার, ওয়ার্ল্ড ফেমাস। উফফ! কী হার্ড কক, একবার যদি পেতাম! ভারতে এমন ফিজিকও নেই, এত দমও কোনও ব্যাটাছেলের দেখিনি। আমি ওর টার্জান এক্স শেম অফ জেন অন্তত একশোবার দেখেছি, দেখে পুরো ফিদা হয়ে গেছিলাম উফফ, বলে শূন্যে একটা চুমু ভাসিয়ে দিল বিশাখা।
চিরশ্রী বলল, হ্যাঁ, তেরোশোর বেশি পর্নো মুভির নায়ক ওই রকো সিফ্রেদিকে ইতালির স্ট্যালোন বলা হয়। সেই উনিই বছর দুয়েক আগে ইতালিতে একটা ইউনিভার্সিটি তৈরি করেছেন হার্ড অ্যাকাডেমি নামে। যারা পর্নস্টার হতে চায়, তাদের সবরকমের শিক্ষা দেওয়ার জন্য। এবং মজার ব্যাপার হল…বলে একটু থামল, আমি নিজে ওই ইউনিভার্সিটি থেকে স্পেশাল ট্রেনিং নিয়ে এসেছি।
মানে! কী বলছ! প্রায় চিৎকার করে উঠল অপালা আর বিশাখা। রূপসাও নিজের বিস্ময় চেপে রাখতে পারল না। বলে উঠল, সত্যি!
হ্যাঁ, সত্যিই। আসলে আমার এই ছাব্বিশ বছরের জীবনে অনেক ব্রথেল ঘুরেছি আমি। তেরো বছর বয়েসে ইন্ডিয়ার সব থেকে ভয়ঙ্কর ব্রথেল এলাহাবাদের মীরগঞ্জে পাচার হয়ে গিয়েছিলাম। পাড়ার এক দাদা কাজ দেবে বলে আমাকে ওখানে নিয়ে গিয়ে বেচে দিয়েছিল, সেখান থেকে কখনও মুজফফরপুর, কখনও মুম্বই যখন যেখানে বিক্রি হয়েছি সেখানে চলে যেতে হয়েছে, এই বাংলার সোনাগাছিতেও কাজ করেছিলাম ছয় মাস, ওখান থেকেই সুযোগ বুঝে পালাতে পেরেছিলাম এক কাস্টমারের সাহায্যে।
কাস্টমারের সাহায্যে! বলো কী! প্রেমে পড়েছিল নাকি?
হি হি হি! তা পড়েছিল, বিয়েও করতে চেয়েছিল আমাকে, আমি বারণ করেছিলাম। বেশ্যাকে বিয়ে করতে নেই বলে বুঝিয়েছিলাম। তা রাজিও হয়েছিল। সত্যি কথা বলতে ওসব বিয়ে-টিয়ের বাঁধনে পড়ার আমার আর ইচ্ছেও ছিল না। যে লাইনে একবার চলে এসেছি বুঝে গিয়েছি এই লাইনে যদি উন্নতি করতে পারি আমার পয়সা খাবে কে? তাই প্রাণপণে চেষ্টা করছিলাম উন্নতির। অনেক যোগাযোগ ছিল ছেলেটার, ওই আমাকে নামকরা একটা এসকর্ট সার্ভিসে ব্যবস্থা করে দিল। খুব দ্রুত ওখানে হাইপ্রোফাইল হয়ে উঠলাম আমি। কোম্পানির নিজস্ব পর্নো মুভি মেকিং-এর ইউনিট ছিল, আমাকে সেখানে নিয়ে নেওয়া হল। তোমরা জানো নিশ্চয়ই ওয়ার্ল্ডে পর্নো মার্কেটে ভারতীয় পর্নোর বিশাল কদর। আমি সেখানেও খুব উন্নতি করে ফেললাম। আমার পর্নোর সিডি খুব বিক্রি হতে থাকল। বেশ ভালোই কামাচ্ছিলাম। কিন্তু ইয়োরোপিয়ান বা নিগ্রো ছেলেগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছিলাম না, কারণ বিশাখা তুমি যা বললে ওটা ঠিক, ইন্ডিয়ান ছেলেদের অ্যাভারেজ পেনিসের সাইজ বলো বা সেক্স করার সময়সীমা যথেষ্টই কম, আর কায়দা-কানুনও বিশেষ জানা নেই। কয়েকজন হাইপ্রোফাইল জিগালো দিয়ে চেষ্টা করা হল কিন্তু ক্যামেরার সামনে ওরা আড়ষ্ট হয়ে যাওয়ায় ব্যাপার জমল না, আমিও সত্যি বলতে নাকের ডগায় ক্যামেরা নিয়ে খুব বেশি সহজ হতে পারতাম না। কোম্পানির ম্যানেজার একদিন আমাকে ডেকে অ্যাপ্লাই করতে বলল হার্ড অ্যাকাডেমিতে। আমারও ধারণার বাইরে ছিল এমন কোনও ইউনিভার্সিটি হতে পারে বলে…, তো নিজের প্রোফাইল ইত্যাদি সমেত অ্যাপ্লাই করলাম, তিনমাস পর ওখান থেকে রিপ্ল্যাই এল আমাকে ইতালি যেতে হবে ইন্টারভিউয়ের জন্য। আমার মাথায় হাত! বলে কী! জীবনে কোনওদিন বাংলাদেশই যাইনি তো ইতালি! পাসপোর্টও নেই। কিন্তু কোম্পানিই আমার সব ব্যবস্থা করে দিল। পাসপোর্ট, ভিসা, টাকাপয়সা সবকিছু দিয়ে পাঠিয়ে দিল সেই ইতালি। কী বলব ভাই, জীবনে কত রিস্ক নিয়ে কাজ করেছি, কিন্তু দেশের মাটি ছেড়ে প্রথমবার অন্য দেশে যাওয়ায় যে কী ভয় লাগে বলে বোঝাতে পারব না।
উফফ! এ তো টানটান থ্রিলার দেখছি, তারপর কী হল? উত্তেজনায় টগবগ করে উঠল অপালা।
তারপর পৌঁছলাম। এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে যাওয়া থেকে হোটেল, খাওয়া-দাওয়ার সমস্ত খরচ দিয়েছিল ওই ইউনিভার্সিটি। আর অ্যাকাডেমির কথা কী বলব! দেখে আমার দুই চোখ ছানাবড়া। ছেলে-মেয়ে মিলিয়ে প্রায় দুশো ক্যান্ডিডেট এসেছিল ইন্টারভিউতে। চারজন ইন্টারভিউয়ার ছিলেন তারমধ্যে রকো নিজেও ছিলেন।
তুমি দেখলে রকোকে! উফ! কী সৌভাগ্য! লাফিয়ে উঠল বিশাখা।
বাবা, তুমি তো দেখছি রকোর বিশাল ফ্যান!
ফ্যান মানে! সেই ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময় প্রথম রকোর পর্নো দেখেছিলাম, ওই জিনিস দেখে আমার কয়েক রাত ঘুম হয়নি। পরে যখন প্রফেশনে এলাম, প্রথম দিকে কত ওইরকম চিজ খুঁজেছি, ধারেকাছে কেউ গেল না। পুরো শাল গাছের ডাল! উফ! একটা শটও যদি পেতাম…
বিশাখার এমন উচ্ছ্বাস, এমন আফশোস দেখে আর চুপ থাকতে পারল না রূপসা। বলে ফেলল, এতদিনেও তোমার শখ মেটেনি? মন থেকে ইচ্ছে জাগে?
হ্যাঁ, আমি আমার কাজটাকে ভালোবাসি, রীতিমতো উপভোগ করি আজকের দিন পর্যন্ত। বলল বিশাখা।
বিশাখার ইংরেজি উচ্চারণ খুব স্পষ্ট এবং কাটাকাটা।
চিরশ্রী বলল, ঠিক এই কথাটাই ট্রেনিং-এর প্রথম দিনে রকো আমাদের বলেছিলেন। যদি সব পেশার মতো এই পেশাটিকে মন থেকে না নিতে পারো, যদি ভেবে থাকো এই পেশা ঘৃণ্য, যদি প্রতিটি সঙ্গমকে উপভোগ না করার ক্ষমতা থাকে তোমার, দায়সারা শুধু অর্থ উপার্জন বলে মনে হয়, তাহলে এই পেশা তোমার জন্য নয়, তুমি কখনোই একজন ভালো পর্নস্টার হতে পারবে না।
ঠিক কথা। আমিও এটাই মানি। তারপর বলো, তারপর কী হল? রকোর সঙ্গে করলে?
আরে, এই মেয়ে তো রকো রকো করে অস্থির! রকো রকো। না করিনি, মানে ওঁর সঙ্গে সেক্স করার সুযোগই পাইনি। উনি আমাদের চোদ্দদিনের ট্রেনিং দিয়েছিলেন। মোট সতেরোশো ছেলে-মেয়ে ওখানে ভর্তির আবেদন করেছিল, সেখান থেকে মাত্র সাতজন ছেলে আর সাতজন মেয়েকে বেছেছিলেন উনি। এবং আমার সৌভাগ্য আমি মনোনীত হয়েছিলাম। এবং সত্যি বলছি ওই কয়েকটা দিনে আমি যা শিখেছি তা সত্যিই অসাধারণ! তোমরা হয়তো আমার অভিনয় করা মুভি দেখোনি, না দেখাই স্বাভাবিক। কারণ আমার ভিডিওগুলো নেটে ফ্রিতে পাওয়া যায় না। দেখলে বুঝতে পারবে পারফরম্যান্সে আমি সানি লিওনের থেকে কোনও অংশে কম নই। কিন্তু ওর যে ব্র্যান্ড রয়েছে তা আমার নেই। ফলে…
আহা, ওসব ছাড়ো। তুমি তো আমাদের অবাক করে দিলে! মানে তুমি একজন ইতালি থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়া পর্নস্টার!
অপালার কথায় যোগ দিয়ে বিশাখা বলল, এবং বিশ্ববিখ্যাত রকোর শিষ্যা।
হ্যাঁ, ওঁর শিক্ষা সত্যিই আমার কাজে লেগেছে এবং রকো আমাকে একদিন একটা কথা বলেছিলেন, তুমি তো ইন্ডিয়া থেকে এসেছ যে দেশ কামকলার পীঠস্থান। এবং আমার অভিজ্ঞতা বলে আজও ভারতীয় মেয়েদের মতো কামোদ্দীপক এবং কামকুশলী আর হয় না। যৌনতা কীভাবে করে সেটা তুমিও জানো, আমিও জানি, কিন্তু ভারতবর্ষই প্রথম একটি দেশ যে শিখিয়েছিল যৌনতা আসলে একটি ভাষা, একটি সংস্কৃতি। সত্যি বলছি, রকোর মুখ থেকে ভারতের এমন প্রশংসা শুনে কী যে ভালো লেগেছিল আমার। তাই দেশে ফিরে বেশ কিছুদিন আমার কোম্পানিতে কাজ করার পর যখন এই রূপমঞ্জরীর হদিশ পেলাম আমি আর অপেক্ষা করিনি। আবেদন করে দিয়েছিলাম। এবং মনোনীত হওয়ার পর যখন আমার কোম্পানিতে ইস্তফাপত্র জমা দিলাম, সিইও স্যর নিজে আমাকে এই রূপমঞ্জরীর প্রায় দ্বিগুণ মাইনে দিয়ে রেখে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলাম ভারতীয় কামকলা আমাকে শিখতে হবে। আর সেটার সুযোগই এখানে ছিল। তাই চলে এলাম। এবার দেখা যাক, জীবন কোনদিকে গড়ায়।
উফ! দারুণ দারুণ…কিন্তু একবারও রকোর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেলে না! তোমার জায়গায় আমি থাকলে তো একবার হলেও ওকে রাজি করাতামই, বলে বিপাশা ওর ঠোঁটদুটো সরু করে চোষার ভঙ্গি করল।
এই মেয়েটা খুব ফাজিল তো! বলল চিরশ্রী।
যাক, এবার চলো অনেক গল্প হল। নিজ নিকেতনে ফেরা যাক। পরে আরও গল্প হবে।
হ্যাঁ, কাল ভোরবেলায় দেখা হচ্ছে। শুভরাত্রি।
চারজনই পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে যে যার ঘরের দিকে চলে গেল।
নিজের ঘরের বারান্দায় উঠে থমকে দাঁড়াল রূপসা। আবার নীচে নেমে খোলা আকাশের দিকে তাকাল, ঘন কালো প্রশস্ত আকাশ। লম্বা শ্বাস নিল ও। বসন্তের রাতের মিঠে হাওয়া শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। আগামীকাল থেকে আবার এক অজানা জীবনে ঝাঁপ। জীবন কখন কোনদিকে যায় কে জানে…।
একটু আগেই ভোর হয়েছে। সূর্যের সোনালি আলো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীতে। পাখির কলকাকলিতে শুরু হতে চলেছে একটি দিন। ওই সোনাগলা নরম আলোতে সবুজ ঘাসে মোড়া এক প্রশস্ত মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে চার তরুণী রূপসা, অপালা, বিশাখা এবং চিরশ্রী, চারজনেই সম্পূর্ণ পোশাকহীন, একটি সুতোও তাদের শরীর স্পর্শ করে নেই। মন্দিরগাত্রে খোদিত পাথরের নারীমূর্তির মতো স্থির প্রত্যেকে। সূর্যের প্রথম আলো স্পর্শ করছে তাদের খোলা চুল, গলা, স্তন, জঙ্ঘা, ঊরু, নিতম্ব, পায়ের প্রতিটি আঙুলকে। তাদের চারজনই স্থির হয়ে রয়েছে নৃত্যের ভিন্ন চারটি মুদ্রায়। আর তাদের খুব খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন চিত্রলেখা। কখনও খুব কাছে এসে, কখনও একটু দূরে গিয়ে। মাঝে মাঝে নির্দেশ দিচ্ছেন মুদ্রা বদলের। তাঁর পরনে রেশমের সাদা শাড়ি ধুতির মতো করে পরা, বুকের কাঁচুলিটিও সাদা। নানা অলংকারে সজ্জিত তিনি। চারজনের মধ্যে একমাত্র রূপসাই উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা, বাকি তিনজনই যথেষ্ট ফর্সা, বিশেষ করে অপালার গায়ের রঙ যেন দুধে-আলতায়, বিশাখার ত্বক কাঁচা হলুদের মতো উজ্জ্বল। স্বর্ণাভ সূর্যালোকে এই চার রমণীকে অপ্সরার মতো সুন্দর লাগছে। চিত্রলেখা ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে তাদের কাঁধ, স্তন, ঊরু, করতল স্পর্শ করছেন, কিছু বুঝতে চাইছেন।
আজ ঠিক ভোর পাঁচটায় চারজন উপস্থিত হয়েছিল কলাকুঞ্জে। চিত্রলেখা ওদের জন্য তার আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন। ওদের নিয়ে এলেন কুঞ্জের পাশের মাঠে। চারজনকে পাশাপাশি পূর্বদিকে মুখ করে দাঁড়াতে বললেন। দাঁড়াল ওরা। তারপর বললেন, তোমরা নিরাবরণ হও।
একটু অবাক হয়েছিল চারজনেই। যদিও বিবস্ত্র হওয়া তাদের কাছে নতুন কিছু নয়, নিরাবরণ শরীর নিয়ে তাদের অহংকার রয়েছে কিন্তু লজ্জাবোধ নেই। তবু এই ভোরবেলায় ফাঁকা মাঠে হঠাৎই বিবস্ত্র হওয়ার নির্দেশ বেশ চমকিত করেছিল ওদের। কিন্তু শিক্ষকের নির্দেশকে প্রশ্ন করেনি কেউ। নিঃশব্দে ছেড়ে ফেলেছিল নিজেদের পোশাক। তারপর মায়ের দেখানো মুদ্রায় দাঁড়িয়েছিল সকলে।
চিত্রলেখা অন্তত পনেরো মিনিট ধরে ওদের শরীরকে দেখে তারপর বললেন, তোমরা এবার বসো।
চারজনকেই চিত্রলেখা নগ্ন অবস্থায় ওই মাঠের ওপরে বসতে নির্দেশ দিলেন। নিজেও বসলেন। তারপর বললেন, আমি তোমাদের প্রকৃতি বুঝে নিলাম। আচার্য বাৎসায়ন বলেছেন রূপ, শীল ও গুণ অনুযায়ী নারী চারপ্রকার। হস্তিনী, পদ্মিনী, চিত্রিণী এবং শঙ্খিনী। তোমাদের গুণ আমার এখনও জানা হয়নি, বাহ্যিক রূপটি দেখলাম। তবে আমার এতদিনের অভিজ্ঞতায় তোমাদের বাহ্যিক রূপ দেখেই তোমাদের চরিত্র এবং রতির প্রকৃতি আন্দাজ হয়ে গিয়েছে। প্রথমে তোমরা খেয়াল করো অপালাকে। বলে উনি অপালাকে উঠে দাঁড়াতে বললেন।
উঠে দাঁড়াল অপালা।
তোমরা খেয়াল করো ওর শরীরের দিকে। ও দীর্ঘাঙ্গিনী। ওর দুই হাত এবং পা যথেষ্ট লম্বা, কপাল ছোট, স্তনের আকৃতিও বড় নয়। হাতের এবং পায়ের পাতার শিরা স্পষ্ট, ওর হাতের তালু এবং শরীর ছুঁলে তোমরা বুঝতে পারবে উষ্ণ অর্থাৎ পিত্তপ্রধান। আচার্য বাৎসায়ন এই আকারের নারীকে চিহ্নিত করেছেন শঙ্খিনী রূপে। বোসো তুমি। বিশাখা আর চিরশ্রী এবার দাঁড়াও।
বিশাখা আর চিরশ্রী উঠে দাঁড়াল।
চিত্রলেখা বললেন, রূপসা আর অপালা তোমরা এই দুজনকে খেয়াল করো। দেখো বিশাখার ও চিরশ্রীর ত্বক যেমন শুভ্র ততোধিক কোমল। এতটাই কোমল যে তোমাদের শরীরের যে কোনও অংশ একটু চেপে ধরলেই সেখানে আঙুলের ছাপ পড়ে যায়, লাল হয়ে ওঠে। তাই তো?
ঘাড় নেড়ে সায় দিল দুজনেই।
চিত্রলেখা রূপসা আর অপালাকে বললেন, এবার ওদের মুখমণ্ডলের দিকে তাকাও। দেখো, দুজনেরই মুখের গড়ন গোলাকার, চোখ দীঘল এবং অক্ষিগোলক হরিণের মতো চঞ্চল। ওদের দুইজনের শরীর থেকে সবসময় সুগন্ধ বের হয়। ঘামের গন্ধটিও সুন্দর। গায়ের রং যেমন চাঁপা ফুলের মতো, চোখের পাতাও পদ্মের পাপড়ির রঙের। ওদের দুজনেরই নাক টিকলো এবং স্তন উন্নত, কটি ক্ষীণ এবং চলন রাজহাঁসের মতো ধীর। কণ্ঠস্বর মধুর। এই প্রকৃতি হল পদ্মিনী। আমি নিজেও পদ্মিনী। এবার রূপসা এসো।
উঠে দাঁড়াল রূপসা। অনেক আগে একবার এসব শঙ্খিনী, পদ্মিনী শুনেছিল কিন্তু সেসব কী তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। আজ মায়ের কাছে এমন ব্যাখ্যা শুনে বেশ মজা লাগছে। দেখা যাক মা কী বলে।
রূপসাকে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াতে বললেন চিত্রলেখা। রূপসা তেমনই দাঁড়াল। চিত্রলেখা বললেন, তোমাদের মধ্যে একমাত্র শ্যামাঙ্গী হচ্ছে রূপসা। কিন্তু কী আশ্চর্য রূপময়ী দেখো! প্রকৃতির যে কোনও কিছুকে সর্বোত্তম দেখার শ্রেষ্ঠ সময় হল এই ভোর। সূর্যের প্রথম আলোতে তুমি যাকে দেখবে সেটাই তার প্রকৃত রূপ। সেই কারণেই সূর্যদেবের এই প্রথম রশ্মিতে তোমাদের দেখার আয়োজন। এই রূপমঞ্জরীতে যে গণিকারাই এসেছে তাদের প্রকৃতি নির্ধারণের জন্য আমি এই স্থান এবং এই সময়ই নির্বাচন করেছি। বলে চিত্রলেখা বললেন, রূপসার কণ্ঠ দেখো শঙ্খের মতো সুন্দর এবং তিনটি ভাঁজবিশিষ্ট। চুল কোঁচকানো, ওর স্তন, নিতম্ব, জঙ্ঘা সবই পুরুষ্টু এবং আকর্ষণীয়। তনুখানি নির্মেদ অথচ অতীব কোমল। এই প্রকৃতি হল চিত্রিণী। বলে চিত্রলেখা ডানহাতটি সামান্য তুলে বলে উঠলেন—
শ্যামপদ্মমুখী কুরঙ্গনয়না অভোদরীবৎসল্য
সঙ্গীতাগমোবোদিনী বরনতনুজং স্ত্রীণি শিল্পিনী॥
বাহ্যালাপরতা মবদজগতি সক্তং কুমাদ স্তনো।
মত্তেয়ং কবি সাধবেন কথি তো চিত্রেপনা চিত্রিণী॥
যেমন স্পষ্ট ইংরেজিতে চিত্রলেখা কথা বলেন, তেমনই জড়তাহীন সংস্কৃত উচ্চারণ।
রূপসার দিকে তাকিয়ে চিত্রলেখা বললেন, তুমি নাচ-গান জানো?
গান জানি না, তবে নাচ বলতে ওই আর কি…তেমন কিছু না।
বেশ দেখব তোমার নাচ। আচার্য বলছেন, চিত্রিণী প্রকৃতির রমণী তার নায়কের কাছে বসে গল্প শুনতে ভালোবাসে, আর ভালোবাসে শৃঙ্গার করতে, নিজেকে পোশাকে, অলংকারে, ফুলে-মালায়-গন্ধে সাজাতে। আর সব থেকে মজার হল এরা রতিক্রিয়ায় আগ্রহী কম হয়, কিন্তু প্রেমের অভিনয়ে চৌখস।
শুনে চমকে গেল রূপসা। এতক্ষণ চিত্রলেখার কথাগুলো শুনে নেহাৎই কথার কথা ভেবে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছিল না, কিন্তু ও যে কোনওকালেই ছেলেদের ভালোবাসতে পারেনি, শুধু একরাশ ঘৃণা ছাড়া ছেলেদের জন্য ওর কাছে আর কিছুই নেই সেটা ও ছাড়া আজ পর্যন্ত আর কেউ জানে না। না জানে…একজন শুধু জেনেছিল, দীপুদা। মন থেকে সঙ্গে সঙ্গে ভাবনাটাকে তাড়াল রূপসা।
চিত্রলেখা বললেন, আরও একপ্রকার নারী রয়েছে হস্তিনী। এদের দেহ স্থূল, রোমশ এবং দাঁত বড়, এবং গাত্রবর্ণ রক্তাভ। এরা স্বভাবে বাচাল, অতিরিক্ত কামুক এবং ক্রোধী হয়। ঝাল-মশলা দেওয়া খাবার খেতে ভালোবাসে। আমাদের রূপমঞ্জরীতে তিনজন গণিকা রয়েছে হস্তিনী গোত্রের।
বিম্বোষ্ঠী বহুভোজনরুচি রুষ্টৈশ্চ সাধ্যয়াতে
গৌরাঙ্গী করিয়ান গন্ধ রুচিরা সেয়ং সত্য হস্তিনী।
চিত্রলেখা শ্লোকটি শেষ করা মাত্র বিশাখা বলে উঠল, কিন্তু মা, আচার্য কি শুধু হস্তিনী আর চিত্রিণীর জন্যই শ্লোক রচনা করেছেন? আর আমরা বাদ?
শুনে হেসে উঠলেন চিত্রলেখা। রূপসা খেয়াল করল মহিলা এমন সুন্দর করে হাসেন যে কেউ দেখে ওই হাসির প্রেমে পড়ে যাবে। এটাও কি ট্রেনিং নেওয়া হাসি?
না না, সকলের ক্ষেত্রেই বলেছেন আচার্য। বলব তোমাদের। এখন তো শুধু শরীরের গঠনগত দিক বললাম, যোনির গভীরতা ভেদেও মৃগী, বড়বা ইত্যাদি। আসলে নারীর যেমন এমন ভেদ রয়েছে ঠিক তেমনই প্রকারভেদ রয়েছে পুরুষদের ক্ষেত্রেও। এমন প্রকারভেদের কারণ হল, এক এক প্রকার পুরুষের সঙ্গে এক এক প্রকার নারীর রতিসুখ সর্বাপেক্ষা সুখকর হয়।
পুরুষেরও বিভাগ?
নিশ্চয়ই। কাম কি শুধু নারীর একক? নারীর যেমন চারপ্রকার ভেদ, পুরুষের রয়েছে তিন। শশক, বৃষ এবং অশ্ব। পুরুষের শিশ্নর আকৃতি, দেহসৌষ্ঠব এবং স্বভাবদ্বারা এই প্রকারভেদ তৈরি করেছিলেন বাৎসায়ন। আচার্য বলছেন শশক জাতীয় পুরুষের সঙ্গে পদ্মিনী নারীর মিলন সুখের হয়, তেমনই বৃষজাতীয়র সঙ্গে শঙ্খিনী এবং অশ্বজাতীয়র সঙ্গে হস্তিনীর সঙ্গম সর্বাপেক্ষা সুখদায়ক। তোমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে আমরা হলাম গণিকা, আমাদের আবার বাছাবাছি কিসের? অর্থের বিনিময়ে নিরোগ যে প্রকার পুরুষই মিলনেচ্ছুক হবে তাকেই সঙ্গ দেব। সেটাই গণিকার ধর্ম। কিন্তু বলি, আমাদের এই রূপমঞ্জরীতে এমনও মক্কেল আসেন যিনি আমাদের ওপর দায়িত্ব দেন তাঁর উপযুক্ত সঙ্গিনী বাছাই করে দেওয়ার জন্য। তখন আমরা সেই মক্কেলের রূপ ও প্রকার বিচার করে তার সঙ্গে রমণে সর্বোচ্চ সুখপ্রদানকারী সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে নির্বাচন করে দিই।
সঙ্গিনী?
হ্যাঁ, রূপমঞ্জরীতে পুরুষ এবং নারী উভয়প্রকার বেশ্যাই রয়েছে। পুরুষদেরও প্রশিক্ষণের কিছু অংশ আমিই দিয়ে থাকি। তোমাদের আগামী পনেরো দিন হবে শুধুমাত্র তত্ত্বগত শিক্ষা। এরপর ব্যবহারিক শিক্ষার সময়ে পুরুষদেরও প্রয়োজন হবে। রূপমঞ্জরীতে মোট নয়জন পুরুষ এবং ষোলোজন নারী বেশ্যা রয়েছে। ভারতবর্ষের নানা প্রান্ত থেকে তাদের এখানে কাজে যোগ দেওয়ানো হয়েছে। তোমাদের চারজন সমেত মোট সাতজন এই মুহূর্তে প্রশিক্ষণ পর্যায়ে। তারা অবশ্য এখন তত্ত্বগত শিক্ষা শেষ করে ব্যবহারিক শিক্ষা নিচ্ছে। বাকিদের শিক্ষা শেষ। তারা নিয়মিত কাজ করছে। একটা কথা মনে রাখবে রূপমঞ্জরীর প্রশিক্ষণ শেষ করার পর তোমরা কিন্তু কেউই আর সাধারণ নারী থাকবে না। প্রত্যেকে হয়ে উঠবে পুরাকালের ঊর্বশী, মেনকা, রম্ভার মতো বিদুষী গণিকা। রূপমঞ্জরীতে যোগদানের সুযোগ পেয়েছ মানেই তোমাদের রূপ এবং গুণ অনন্যসাধারণ, এবার তাকে চূড়ান্ত উৎকর্ষ দেওয়ার দায়িত্ব আমার এবং তোমাদের নিজেদের। সবার প্রথমে একটা কথা ভালো করে মাথায় গেঁথে নাও, সেটা হল একজন আদর্শ বেশ্যা হল সে, যার অন্তরে প্রেম না থাকলেও প্রেমকলায় পটু। পুরুষ তার কাছে আসবে শুধু রতিসুখ নয়, প্রেম পেতে। শুধু যৌনতার জন্য নয়। পশুর সঙ্গে মানুষের রতিক্রিয়ার পার্থক্য এখানেই। মানুষ রতির সময় শুধু নিজ সুখের কথা ভাবে না, তার সঙ্গীকে সুখ দেওয়াও তার কর্তব্য বলে মনে করে। কিন্তু পশু শুধুমাত্র নিজ সুখের কারণেই রমণে লিপ্ত হয়, সে তার সঙ্গী সুখ পাচ্ছে কি না তা নিয়ে ভাবে না এবং রেতঃপাত হওয়া মাত্রই সে সঙ্গীকে ছেড়ে চলে যায়। রমণে এই যে অপরের সুখের কথা ভাবা তাই প্রেম যা পশুর মধ্যে নেই। এবং পশুর অভিনয়-ক্ষমতাও নেই। তাই সে ভান করতে জানে না। মানুষ প্রেমহীন হলেও প্রেমের অভিনয় করতে জানে, আর এই অভিনয়ে সর্বাপেক্ষা পটু হল একজন বেশ্যা। তোমরা কামসূত্রের নাম শুনেছ?
চারজনের মধ্যে শুধু বিশাখা বলল, হ্যাঁ মা, শুনেছি। কপিল বাৎসায়নের লেখা বই। তবে পড়িনি কখনও।
বেশ, ওই গ্রন্থে আচার্য বলছেন, ভরতের নাট্যশাস্ত্রে লিখিত আছে যে নারী বিভিন্ন কলার প্রয়োগ জানে, যে বিবিধ শাস্ত্র ও কাব্যাদিতে পারদর্শী, চৌষট্টি কলায়, বিশেষ করে নৃত্যগীত ও বাদ্যাদিতে উৎকর্ষ লাভ করেছে, গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, লাবণ্যময়ী, যার মনের জোর এবং উদ্দেশ্যের দৃঢ়তা আছে কিন্তু সে নম্র ও মাধুর্যশালিনী, সাধারণ রমণীর যে সব দোষ থাকে তা থেকে যে মুক্ত, বক্রোক্তিতে নিপুণা, ভাষায় যার জড়তা নেই এবং যে সহজে ক্লান্ত না হয়ে মাধুর্যের সঙ্গে কাজ করে তাকে গণিকা বলে। তাহলে বুঝতে পারছ তোমরা একজন আদর্শ গণিকার মধ্যে কত গুণ থাকে। এই কারণেই প্রাচীন ভারতবর্ষে গণিকার যথাযথ সম্মান ছিল। রাজা তাদের সম্মান করতেন, গুণবান মানুষ তার স্তুতি করতেন। কিন্তু সময় বদলের চক্রে গণিকারা হয়ে উঠেছে নেহাতই নির্গুণা, এমনকি কামকলাটিও তাদের ভালো করে রপ্ত নয়। ফলে তার স্থানও হয়ে গিয়েছে সমাজের সবচেয়ে নীচে। রূপমঞ্জরীর অন্যতম উদ্দেশ্যও হল ভারতের গণিকাদের যে হূতগৌরব তাকে আবার সসম্মানে নিজ আসনে প্রতিষ্ঠা করা। পৃথিবীর বৃহত্তম বেশ্যালয়গুলির মধ্যে কলকাতার সোনাগাছি অন্যতম। প্রায় এগারো হাজার বেশ্যা সেখানে কর্মরত কিন্তু ক’জন জানে ভারতীয় কামকলা? কেউ না। আমি নিজে ওখানে দীর্ঘদিন ঘুরেছি, নামী বেশ্যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, নাহ কেউ জানে না। গান বলতে চটুল হিন্দি গান আর নাচ বলতে কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি। শুধু কলকাতা নয়, গোয়া, এলাহাবাদ, মুম্বই, মুজফফরপুর, বেনারস এবং ভারতের আরও যেসব জায়গায় বৃহৎ বেশ্যালয় রয়েছে আমি সেখানেও রূপমঞ্জরীর জন্য গিয়েছি, উপযুক্ত বেশ্যার সন্ধান করেছি, কিন্তু পাইনি। ইয়োরোপ, আমেরিকায় ভারতবর্ষের গণিকালয় বলতে বোঝানো হয় সোনাগাছির মতো অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকা, অশিক্ষিত বেশ্যাদের, তারা জানে না আজ আমস্টারডাম, লাসভেগাস পেন্টাহাউজের মতো কিছু বিখ্যাত বেশ্যালয় নিয়ে তারা আদিখ্যেতা করলেও ভারতবর্ষে গণিকাবৃত্তি একসময় যে উৎকর্ষে পৌঁছেছিল তা কোনওদিনই তারা পারবে না।
খুব ধীরে ধীরে কথাগুলো একটানা বলে গেলেন চিত্রলেখা। এমনভাবে বললেন যে, প্রতিটি শব্দ ওদের চারজনের অন্তর পর্যন্ত পৌছল। রূপসা খুব মন দিয়ে খেয়াল করছিল চিত্রলেখার বাচনভঙ্গি, এবং কথা বলার সময় তাঁর চোখ, হাতের মনোমুগ্ধকর সঞ্চালনকে। সবই আপাতস্বতঃস্ফূর্ত হলেও আসলে তা দীর্ঘ অনুশীলনের ফসল। রূপসা-অপালাদের থেকে চিত্রলেখা অন্তত কুড়ি বছরের বেশি বয়স্কা হবেন, কিংবা হয়তো তারও বেশি, কিন্তু তাকিয়ে থাকলে কেমন যেন ঘোর লেগে যায়।
সকাল হয়ে গিয়েছে। সূর্যের রশ্মি এখন আর সোনালি নয়, সাদা। কিন্তু সে আলোয় এখনও তেজ ধরেনি, কঠোরতা আসেনি।
চিরশ্রী, তুমিই তো রোকোর আকাদেমিতে প্রশিক্ষণে ছিলে তাই না?
হ্যাঁ, মা।
তোমার কষ্টটাই সব থেকে বেশি হবে, কারণ ওখানে যা শিখেছ সব তোমাকে আগে ভুলতে হবে। পারবে তো?
নিশ্চয়ই পারব। খুব জোরের সঙ্গে বলল চিরশ্রী।
বাহ। হ্যাঁ, আমিও জানি তুমি পারবে। সেই ক্ষমতা তোমার রয়েছে। তোমরা এমন বারাঙ্গনা তৈরি হবে যে দেশ-বিদেশের নায়কেরা পাগল হয়ে যাবে তোমাদের জন্য।
নায়ক?
অবাক হলে? আচার্য গণিকাকে সম্বোধন করেছেন নায়িকা বলে আর তার মক্কেলকে নায়ক। আমিও তোমাদের বোঝাব নায়ক এবং নায়িকা সম্বোধন করেই। চিত্রলেখা তাঁর পুরো ইংরেজিতে কনভারসেশনের মধ্যে নায়ক ও নায়িকা শব্দকে ইংরেজিতে ট্রান্সলেট করে হিরো বা হিরোয়িন ইত্যাদি করলেন না। যেমন কাম শব্দটিকেও ‘কামা’ বলে উচ্চারণ করছিলেন।
আরে বাহ! তার মানে আমি হব ক্যাটরিনা আর আমার জন্য সলমন খানেরা আসবে!
বিশাখার ইয়ার্কিতে হেসে উঠল সবাই। চিত্রলেখাও হাসলেন তারপর বললেন, উঁহু, ক্যাটরিনা নয়, চেষ্টা করো হেমামালিনী কিংবা শ্রীদেবীর মতো হয়ে উঠতে। মানে ওদের শরীর যেমন খাঁটি ভারতীয় তেমন। তবে হ্যাঁ, সলমন খানও আসতে পারেন আবার ব্র্যাড পিটও আসতে পারেন। আবার এঁদের মতো চলচ্চিত্রের নায়ক কেউ না এলেও যাঁরা আসেন তাঁরা আর্থিক সচ্ছলতায় এঁদের থেকে কয়েকগুণ বেশি ছাড়া কম নয়, তাই এঁরাই হবেন তোমাদের নায়ক। এখানে কেমন ধরনের মক্কেল আসেন তার দুই-একটা উদাহরণ দিলে তোমরা আন্দাজ পাবে। ধরো আরবের কোনও ধনকুবের যাঁর দশটা তেলের খনি রয়েছে কিংবা কোনও আইটি কোম্পানির সিইও অথবা কোনো জাহাজ কোম্পানির মালিক। এরকম দুই-তিনটেই বললাম। এর থেকে বুঝে নাও কারা এখানে আসেন, কারণ রূপমঞ্জরীতে থেকে তার মজা নিতে হলে প্রতিদিন যা খরচ করতে হয় তা সামলানোর ক্ষমতা সাধারণ মানুষ তো বাদ দাও, অনেক ধনী ব্যক্তিরও নেই। এবং আমাদের মক্কেলদের মধ্যে অধিকাংশই আসেন ইউনাইটেড আরব অথবা আমেরিকা, ইউরোপের বিভিন্ন ধনী দেশ থেকে। ভারতীয় খুব কম। তোমাদের মনে রাখতে হবে রূপমঞ্জরীর রোজগারের উপায় হচ্ছ তোমরা। মক্কেলরা আসবেন প্রাচীন ভারতীয় প্রেমের স্বাদ নিতে এবং সেই স্বাদ দেওয়ার দায়িত্ব তোমাদের। একটা কথা মাথায় রেখো, রূপমঞ্জরী একটি গণিকালয়, তোমরা গণিকা। তোমরা তোমাদের মক্কেলের কাছ থেকে যতটা আদায় করতে পারবে তা রূপমঞ্জরীর লাভ এবং তার মানে তোমাদের বেতন এবং লভ্যাংশ ইত্যাদি।
কয়েকটা প্রশ্ন রয়েছে, মা। বলল রূপসা।
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই করবে, আমি আগে একটু বলে নিই কেমন? তোমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, মক্কেলদের সমস্ত খরচ করানোর দায়িত্ব কি তোমাদের? না, মক্কেলের ঘর, পানাহার এবং যাবতীয় খরচের হিসাব নেবে রূপমঞ্জরীর ব্যবস্থাপনা। তোমরা তাকে আরও অতিরিক্ত যতটা খরচ করাতে পারবে সেটাই তোমাদের কৃতিত্ব এবং তার থেকেই তোমাদের বেতন ছাড়া লভ্যাংশ, বেতনবৃদ্ধি ইত্যাদি নির্ভর করবে। সেই খরচগুলো কীভাবে করাবে সেটা আমি তোমাদের প্রশিক্ষণের অন্য দিনে বুঝিয়ে দেব। হ্যাঁ রূপসা, বলো কী বলছিলে?
আমরা কাল থেকে এখানে রয়েছি কিন্তু কাউকেই তো দেখতে পেলাম না তেমন। মানে কাল রাতে শুধু একজন ইয়ে মানে নায়ককে দেখেছিলাম এক নায়িকাকে কোলে নিয়ে নৌকোয় উঠল। কিন্তু আর কাউকে তো তেমন…
এবার একটু শব্দ করেই খিলখিল করে কিশোরী মেয়ের মতো হেসে উঠলেন চিত্রলেখা। তারপর বললেন, তোমরা এখন রয়েছ কলাকুঞ্জে। প্রেমকুঞ্জ আরও গভীরে রয়েছে। তবে এটাও প্রেমকুঞ্জের মধ্যেই পড়ে যদিও রাত ছাড়া এবং সরোবরে নৌবিলাস ছাড়া নায়করা প্রেমকুঞ্জের অন্দরমহল থেকে খুব বেশি বেরোয় না। যাই হোক। এবার তোমরা ওঠো। আমরা ভবনে যাব।