ঘুম ভাঙল সেই সুরেলা ঘণ্টার শব্দে। দরজায় কলিং বেল বাজাচ্ছে কেউ। দু’বার বেজে উঠতেই ধড়মড় করে উঠে বসল। ঘরে এসির ঠান্ডা হাওয়া আর নরম বিছানা, চোখ যেন খুলতে ইচ্ছে করছে না। নিজেকে প্রায় টেনে তুলে, দরজা খুলল। সেই ড্রেস পরা সারথি। রূপসাকে দেখামাত্র দুই হাত জড়ো করে প্রণাম করে লোকটি বলল, শুভ সন্ধ্যা, আপনি কি প্রস্তুত?
হ্যাঁ, একটু অপেক্ষা করুন।
নিশ্চয়ই, আপনি প্রস্তুত হয়ে, রথে আসুন। আমি অপেক্ষা করছি। বলে আবার প্রণাম করে লোকটি ঘোড়ার গাড়িতে গিয়ে বসল। আবার হাসি পেল রূপসার। ছোটবেলায় টিভিতে মহাভারত সিরিয়াল দেখত। কর্ণ, অর্জুনরা যেমন মাথায় ছাতা দেওয়া ঘোড়ায় টানা রথে চলত। জীবনে কখনও ভাবেনি নিজেকেও এমন রথে চড়তে হবে! মানুষের ভাগ্য যে কখন কাকে কোনদিকে নিয়ে যায়…
পোশাক পরাই ছিল। শুধু চুল ভালো করে আঁচড়ে, কপালে একটা টিপ পরে বেরিয়ে এল রূপসা। দরজায় শুধু একটি শিকল। সেটাই তুলে দিল। তারপর চড়ে বসল রথে। আবার সুন্দর ছন্দে ছুটতে থাকল কালো রঙের ঘোড়া। মোরাম বিছানো লাল রাস্তা। আবার সেই দুইধারে ফুল-ফলের বাগান, ছোট ছোট পুকুর। পুকুরে পদ্ম ফুটে রয়েছে। সাদা রাজহাঁস ঘুরছে। কোথাও নিশ্চিন্তে ঘুরছে হরিণের পাল। এমন পরিবেশে এলে যে কারোরই থেকে যেতে মন করবে।
সামান্যই রাস্তা। মাত্র মিনিট পাঁচেক। এবার রথ এসে থামল একটি বিল্ডিং-এ। একতলা, কিন্তু বেশ উঁচু। সেই ইতিহাস বইয়ের ছবির মতো পাথরের বাড়ি। বাইরে ফলকে দেবনাগরী হরফে লেখা, কলাকুঞ্জ।
এখানেই নামব? সারথিকে জিজ্ঞাসা করল রূপসা।
হ্যাঁ, এই দ্বার দিয়ে সোজা চলে যান, মা আপনার জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন।
মা! শব্দটা কট করে কানে লাগল রূপসার। রথ থেকে নেমে সেই বাড়িতে ঢুকল। পাঁচ ধাপ চওড়া সিঁড়ি ওঠার পর মস্ত চওড়া বারান্দা। তারপর বিশাল উঁচু সদর দরজা। দেওয়ালে, দরজায় খিলানে সর্বত্র খাজুরাহোর মন্দিরের গায়ের মতো মৈথুন ভাস্কর্য। সবই সিমেন্ট-বালি বা প্লাস্টার প্যারিসে তৈরি কিন্তু দেখলে মনে হবে পাথর কুঁদে গড়া। তবে কারুকাজ করা দরজা সত্যিই কাঠের। দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল রূপসা। বিশাল একটা হলঘর। এতটাই বড় যে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে দ্রুত পৌঁছতে গেলে দৌড়তে হবে। সেই ঘরে কম করে জনা পনেরো বিভিন্ন বয়সের মেয়ে। প্রত্যেকেই ছবির শকুন্তলার সাজে। বুকে কাঁচুলি বাঁধা, চুলে খোঁপা কিংবা বিনুনিতে ফুলের মালা জড়ানো। গলায়, হাতে ফুল অথবা সোনার অলংকার। নাক, কান, পাও আভরণহীন নয়। শাড়ি পরার ধরনটি এমনই যে শরীরের অধিকাংশ অনাবৃত। কেউ বসে মালা গাঁথছে, কেউ একে অপরের গায়ে চন্দনের প্রলেপ দিচ্ছে, কপালে কুমকুম পরিয়ে দিচ্ছে। একদিকে সেতার আর পাখোয়াজ বাজাচ্ছেন দুইজন শিল্পী আর সেই তালে দুটি মেয়ে নাচের পোশাকে পায়ে ঘুঙুর পরে নাচছে। অন্যদিকে একটি মেয়ে বীণা বাজাচ্ছে আর তার মুখোমুখি বসে গান গাইছে আরেকজন। সব মিলিয়ে বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দেওয়ার মতো ব্যাপার। যেন কোনও নাটক মঞ্চস্থ করার আগে কুশীলবরা শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। একটি মেয়ে, বছর কুড়ি বয়স হবে একেবারে বনবালার সাজ, রূপসার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তার হাতে একটি সাজিতে ফুল ভরা।
রূপসাকে সম্ভবত সালোয়ার পরা এবং জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে থমকে দাঁড়িয়ে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?
হ্যাঁ, মানে…মা…
ওই তো মা, আসুন আমার সঙ্গে। বলে মেয়েটি নিজেই রূপসাকে নিয়ে গেল এক মহিলার দিকে। সেই বিশাল ঘরের একপ্রান্তে একটা বেঁটে সিংহাসনে বসে রয়েছেন এক মহিলা। তাঁর সামনে মাটিতে বসে রয়েছে চারজন মেয়ে। তার মধ্যে তিনজন ওই পুরোনো স্টাইলের পোশাকে আর একজন জিন্স আর টপ। রূপসার দিকে তাকিয়ে মহিলা হেসে চোস্ত ইংরেজিতে বললেন, তুমি রূপসা, তাই তো?
হ্যাঁ।
আমার কলাকুঞ্জে তোমাকে স্বাগত। বোসো বোসো। ভারী আপন করে নেওয়া কথা বলার ধরন।
রূপসা বসল হাঁটু মুড়ে।
তোমার নামটি ভারী সুন্দর। তাই তোমার নামে কোনও পরিবর্তন ঘটাইনি। এসো, ওদের সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দিই। ও বিশাখা, ও অপালা, ও চিরশ্রী আর তুমি হলে রূপসা। বিশাখা আর অপালা গতকাল এসেছে, তুমি আর চিরশ্রী আজই যোগ দিলে। আমি হলাম চিত্রলেখা। এই যে দেখছ এই ঘরে সব মেয়েদের, এরা সকলে আমার হাতে তৈরি। ওরা সবাই আমাকে মা ডাকে। তোমরাও তাই ডেকো। বলে স্মিত হাসলেন মহিলা।
রূপসা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল পঞ্চাশোর্ধ্বা মহিলার দিকে। বয়সটা মোটের ওপর আন্দাজ করা গেলেও রূপ যেন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। মিস রেহানার মতো কি তার থেকেও অধিক সুন্দর বললে অত্যুক্তি হবে না। চোখে যেন ধাঁধা লেগে যায়। কাজল পরা দীর্ঘ চোখ, বেণীতে ফুলের মালা জড়ানো, নানারকমের সোনার গয়না যেগুলোর নামই জানা নেই রূপসার। একটা ঘনসবুজ রঙের তসরের শাড়ি এবং মসলিন কাঁচুলি পরে রয়েছেন তিনি। অনাবৃত পেটে একটিমাত্র ভাঁজ, কিন্তু সেই ভাঁজে তাঁর অসামান্য নাভিটি ঢাকা পড়ে যায়নি।
গোটা পরিবেশটাই ভারী অদ্ভুত। একদিকে তবলা, পাখোয়াজের সঙ্গে নূপুরপরা পায়ের থেইই…তা তা থেই তা থেই তা-র বোল। অন্যদিকে সেতার বাজছে, সঙ্গে এস্রাজ। ফুলের গন্ধে ভরে রয়েছে ঘরখানি।
তোমরাও আমাকে আজ থেকে মা বলেই ডেকো। মা যেভাবে তার সন্তানকে সবকিছু শেখায় আমিও আগামী একমাস ধরে তোমাদের প্রশিক্ষণ দেব। তোমাদের এই প্রশিক্ষণপর্বে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দুইটি বিষয়েই প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। তোমাদের প্রশিক্ষণ শুরু হবে আগামীকাল ভোর পাঁচটা থেকে। তার মধ্যে তোমরা স্নান পর্ব সেরে এখানে উপস্থিত হবে। তবে সবার আগে যেটা আজ থেকেই তোমাদের একেবারে নিজের আত্মাকে বিশ্বাস করতে শুরু করাও যে, তুমি ভুলে যাবে তোমার পূর্ব পরিচয়, কে তোমার মা-বাবা, কোথায় তোমার জন্ম, তোমার পুরোনো জীবনযাত্রা—সবকিছু মনে-প্রাণে ভুলে যাওয়ার অনুশীলন করো। কোনও স্মৃতিচারণ করবে না। মনকে স্বচ্ছ রাখো, কারণ মন সুন্দর থাকলে তবেই দেহপট সুন্দর থাকবে। তোমরা নিজেদের মনে করো এই যে প্রাচীন ভারতের পরিবেশ তোমরা ইতিমধ্যে এই রূপমঞ্জরীতে দেখেছ, আগামীতে আরও অনেক কিছু দেখবে, মনে করবে এটাই সত্য। তুমি আসলে আজ থেকে হাজার বছর পূর্বের ভারতবর্ষের এক নারী, সামান্যা নারী নয়, রূপ এবং গুণের দিক থেকে অতি কাঙ্ক্ষিত এক নারী। রূপ তোমাদের মধ্যে রয়েছে, কিছু গুণাবলীও রয়েছে যে কারণে তোমরা রূপমঞ্জরীতে প্রবেশাধিকার পেয়েছ। এবার বাকি কলাগুলির প্রয়োজনীয় কিছু কলা আমি আগামীকাল থেকে তোমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করব। আশা করি তোমরা সেই শিক্ষাকে অন্তর থেকে গ্রহণ করবে। আবারও বলছি আজ এই মুহূর্ত থেকে তোমরা ভুলতে শুরু করো তোমাদের অতীতকে। মনে করো তুমি সেই প্রাচীন ভারতবর্ষের একজন। কেননা মন থেকে তুমি যদি বিশ্বাস না করতে পারো তাহলে তোমার প্রশিক্ষণ বৃথা যাবে। এই যে আমার মেয়েদের দেখছ, এদের অনেকেরই শিক্ষা সমাপ্ত, এদের অধিকাংশই কিন্তু ভুলে গিয়েছে তাদের অতীত জীবন। তোমরা কথা বলে দেখো ওদের সঙ্গে। নিজেরাই বুঝতে পারবে।
এতটুকু বলে হাসলেন তিনি। তারপর বললেন, বিশাখা, অপালা এবং চিরশ্রী তোমাদের যে এই নতুন নামকরণ করা হয়েছে, আজ থেকে তোমরাও এই নামেই নিজেকে সম্পৃক্ত করতে শুরু করবে। ভুলে যাও নিজেদের পুরোনো নাম কী ছিল। আর রূপসা, তোমার নামটি পুরোনো বলেই অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে আপাতত, কিন্তু যদি দেখো তোমার এই নাম তোমার অতীতকে ভুলতে বাধা দিচ্ছে তাহলে আমাদের অকপটে জানিও। আমি তোমারও নাম বদলে দেব। আর হ্যাঁ, আরও একটা কথা, আমাকে যেমন তোমরা মা বলে ডাকবে সেটা মনেপ্রাণে বিশ্বাসও করবে, যখন যা সমস্যা, যা জানার আগ্রহ, যা তোমার মনের প্রশ্ন তা নিশ্চিন্তে আমার কাছে রাখবে। আমি চেষ্টা করব তোমাদের কৌতূহল মেটানোর। আমার কাছে কোনওপ্রকার আড়াল তোমরা রাখবে না।
বিশাখা নামের মেয়েটি বলল, মা, আমি কি রূপমঞ্জরী সম্পর্কে কিছু জানতে পারি? মানে আমি এখানে সুযোগ পেয়েছি ঠিকই কিন্তু খুব বেশি কিছু ধারণা নেই। যদি একটু বলেন।
চিত্রলেখা মৃদু হাসলেন। সেই হাসিটিও বড় মোহময়। রূপসা চিত্রলেখার প্রতিটি নড়াচড়া, কথা বলার ধরন খুব মন দিয়ে খেয়াল করছিল। মহিলার সবকিছুর মধ্যে অদ্ভুত একটা ছন্দ রয়েছে। আর সেই ছন্দ খুব আকর্ষণীয়। এটা এক-দুই দিনে রপ্ত হওয়ার নয়। অনেক শ্রম রয়েছে।
আমার ধারণা এই প্রশ্ন তোমাদের সকলেরই কম-বেশি মাত্রায় রয়ে গিয়েছে, কী তাই তো?
রূপসা বলল, আমার সত্যিই খুব আগ্রহ রয়েছে। যার মাধ্যমে এখানে যোগাযোগ তার কাছ থেকে সামান্যই জানতে পেরেছিলাম, কিন্তু ওই সামান্যই এত কৌতূহল তৈরি করেছিল আমার মনে, যে ইন্টারভিউ দেওয়ার লোভ সামলাতে পারিনি, এবং কাজটা হয়েও গেল।
বেশ, তাহলে তোমাদের কিছুটা ধারণা দিই, সামান্য তোমরা জানো ঠিকই, তবু আমার কাছ থেকে শোনো। আর বাকিটা থাকতে থাকতে নিজেই জেনে যাবে। বলে চিত্রলেখা শুরু করলেন।
আজ থেকে মাত্র সাত বছর আগে রূপনগরে এই রূপমঞ্জরীর স্থাপনা হয়। প্রথম পরিকল্পনা করা হয়েছিল একশো বিঘা জমির ওপরে তৈরি করা হবে এক প্রাচীন ভারতবর্ষের রেপ্লিকা। গোটা পৃথিবীর মানুষ দেখতে আসবেন, থাকবেন, আমাদের ভারতবর্ষের প্রাচীন ঐতিহ্যকে বুঝবেন। সেই ভাবনামতোই কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু তারপর কর্তৃপক্ষ ভাবলেন শুধু কি ঐতিহ্যের রেপ্লিকা দেখিয়ে সারা বছর ট্যুরিস্ট টানা যাবে? ভারতে এখনও বহু প্রাচীন স্থাপত্য থেকে ঐতিহ্যের নানা নিদর্শন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, যেমন নালন্দা, যেমন তাজমহল কিংবা অজন্তা, ইলোরা, খাজুরাহো ইত্যাদি। তো সেই আসলগুলিকে ছেড়ে নকল দেখতে মানুষ কেন আসবেন? তখন ভাবা হল ভারতের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যগুলির মধ্যে এমন কোনটি রয়েছে যা পৃথিবীর সকল ধর্ম, সম্প্রদায়, জাতি, ভাষা, সংস্কৃতি নির্বিশেষে সমান আকর্ষণীয়। জগতে একটি জিনিস রয়েছে যার মধ্যে সকল নারী-পুরুষ যুগ যুগ ধরে সুখ খুঁজে পায় তা হল কাম। শাস্ত্রে বলছে মানবজীবনের মূল লক্ষ্য হল তিনটি। এক ধর্ম, দুই অর্থ ও তিন কাম। এদের একত্রে ত্রিবর্গ বলে। মানবজীবনে সাফল্য পেতে হলে এই তিনটি অতি আবশ্যক। আর মৃত্যুর পর পরলোকের কামনা হচ্ছে মোক্ষ। অর্থাৎ বার বার জন্ম-মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাওয়া। যাই হোক, এসব তোমাদের প্রশিক্ষণের সময়ই বিস্তারিত বলব, তো কামই যদি যুগ যুগ ধরে মানুষের প্রধান আকর্ষণ হয় এবং একমাত্র ভারতবর্ষ হল সেই দেশ যে দেশে এই কামকে নিয়ে সেই হাজার বছর আগেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিপুল পরিমাণে গবেষণা হয়েছে। বাৎসায়নের কামসূত্রের কথা তো তোমরা শুনেইছ, শুধু আমরা কেন গোটা বিশ্ব শুনেছে। কারণ কামের ওপর এত অসামান্য শাস্ত্র পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত রচিত হয়নি। কাম যে এক শিক্ষণীয় এবং অতি প্রয়োজনীয় কলা তা প্রথম অনুভব করেছিলেন এই ভারতবর্ষেরই বাৎসায়ন। তাঁর সম্পর্কেও আমি পরে তোমাদের জানাব। বলে একটু থেমে পাশে রাখা লম্বা স্ফটিকের গ্লাস হাতে নিয়ে তার ঢাকনা সরিয়ে এক চুমুক জল খেলেন। তারপর আবার গ্লাসটি যথাস্থানে রেখে দিয়ে বললেন, তো ঠিক হল সেই হাজার বছরের পুরোনো পরিবেশ এবং ভারতীয় কামকলার যে অসামান্য প্রকাশ একসময়ে ভারতবর্ষের গৌরব ছিল তাকেই যদি ফিরিয়ে আনা যায় তাহলে সব উদ্দেশ্য সফল হবে। অর্থাৎ এই রূপমঞ্জরীকে এমন একটি নগররূপে নির্মাণ করতে হবে যেখানে প্রবেশমাত্র যে কেউ বিশ্বাস করতে বাধ্য হবেন যে তিনি আসলে চলে এসেছেন হাজার, দুই হাজার বছরের পুরোনো ভারতবর্ষে। আড়ালে কাজ করবে আধুনিক প্রযুক্তি, আধুনিকতার সব রকম ব্যবস্থাই থাকবে, কিন্তু তা প্রকাশ্যে নয়। শুরু হয়ে গেল নির্মাণের কাজ। এবার প্রয়োজন হল কামকলায় পটিয়সী নায়িকার। সত্যি বলতে যে ভারতবর্ষ অন্যান্য সংস্কৃতির মতো কামকলাতেও চূড়ান্ত উৎকর্ষ লাভ করেছিল তা বাকি সবকিছুর মতো সেই উৎকর্ষ, সেই গরিমাও হারিয়েছে।
এবার আমি নিজের সম্পর্কেও তোমাদের কিছু বলি। আমি জন্মসূত্রে একজন কেরালিয়ন। অল্প বয়স থেকেই পড়াশোনায় মেধা ছিল আমার। আমার বাবা একজন ধার্মিক পুরুষ হলেও কিন্তু আমার মা ছিলেন বহুগামিনী। তিনি বহু পুরুষের সঙ্গ পছন্দ করতেন, এবং সঙ্গ করতেন। মায়ের এমন স্বভাবের কারণে আমাদের সংসারে সুখ-শান্তি কিছুই ছিল না, কিন্তু আমার মা বহুগামিনী হলেও নিজের সংসারের প্রতি, আমার এবং বাবার প্রতি কর্তব্যে কোনও ত্রুটি রাখতেন না। অপরূপ সুন্দরী ছিলেন আমার মা। এবং দিনের একটা বড় অংশ তিনি ব্যয় করতেন নিজের শরীর-রূপচর্চায়। আমি সামান্য বড় হওয়ার পর তিনি আমারও রূপচর্চায় যত্ন নিতে শুরু করেন। মায়ের কাছেই আমি শিখতে শুরু করি কীভাবে নিজের অঙ্গসৌষ্ঠবকে আরও আকর্ষণীয় এবং দীর্ঘস্থায়ী করা যায়। বাবা এইসব একেবারেই পছন্দ করতেন না। এবং মাকে মাঝে মাঝেই বেশ্যা বলে গালাগাল করতেন। আমি ওই বয়সে বেশ্যা শব্দের মানে জানতাম না। মাকে একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, বেশ্যা কী? মা বললেন, বেশ্যা একজন শিল্পী। একজন গায়ক, একজন কবি কিংবা একজন নৃত্যশিল্পীর মতো বেশ্যাও একজন কলাকার। তার কলার মাধ্যম হল তার শরীর এবং প্রেম। মায়ের কাছে এমন কথা শুনে আমি অবাক হয়েছিলাম। আর আমার বাবা হয়েছিলেন চূড়ান্ত ক্রুদ্ধ। তিনি আমাকে মায়ের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতেন, কিন্তু পেরে উঠতেন না। কারণ আমার বাবা ধার্মিক এবং পেশায় একজন পুরোহিত হলেও তিনি ছিলেন একজন অলস এবং জুয়াড়ি। পাশা খেলায় তীব্র আসক্তি ছিল বাবার। পৌরোহিত্যের সামান্য উপার্জন, কিন্তু জুয়ায় মাঝে মাঝে সেই টাকাটুকুও খুইয়ে বসতেন বাবা। তখন সংসার চলত মায়ের টাকায়। মা যেসব পুরুষসঙ্গ করতেন তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন ধনী এবং সমাজে যথেষ্ট প্রভাবশালী। তাঁদের কাছ থেকে মা নিয়মিত অর্থ বা উপহার এবং নিরাপত্তার আশ্বাস পেতেন, ফলে বাবা মনেপ্রাণে মাকে ঘৃণা করলেও নিজের বাড়ি থেকে মাকে দূর করে দেওয়া বা আমাকে মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে ফেলার সাহস দেখাতে পারতেন না। শুধু তর্জন-গর্জনই সার ছিল। বাবা সুযোগ পেলেই আমাকে বোঝাতেন আমি যেন মায়ের সংসর্গ থেকে দূরে থাকি, নইলে খারাপ হয়ে যাব। কিন্তু আমাকে মা-ই বেশি টানতেন। মা শুধু সুন্দরীই ছিলেন না, বিদুষীও ছিলেন। আমার গৃহশিক্ষার দায়িত্বও ছিল তাঁর ওপর। স্কুলে পড়াশোনায় আমি বরাবরই প্রথম দিকের ছাত্রী ছিলাম তা মায়ের কারণেই। যখন বাল্যকাল পেরিয়ে আমি কৈশোরে এলাম, অনেককিছু বুঝতে শিখলাম, আমি মায়ের রূপের পাশাপাশি মায়ের জ্ঞান-বিদ্যার প্রতি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এমনও হয়েছে মায়ের কাছে এসেছেন কোনও ব্যক্তি, মা তাঁর সঙ্গে শাস্ত্র আলোচনা করছেন। এবং সংস্কৃত ভাষায়। আমি মায়ের কাছে সংস্কৃত শিখতে শুরু করেছিলাম অনেক অল্প বয়স থেকেই। এবং ইংরেজি শিখতাম স্কুলে। মা ইংরেজি জানতেন চলনসই। আমি ঋতুমতী হওয়ার কিছুদিন পরেই মা আমাকে মানব শরীর, স্ত্রী ও পুরুষের কাম, সঙ্গম ইত্যাদি বিষয়ে জানাতে শুরু করেন এবং শুধু তাই নয়, কাম যে এক অসামান্য কলা সেই বিষয়েও তিনি আমাকে শিক্ষা দিতে শুরু করেন। ষোল বছর বয়সের আগেই আমি কপিল বাৎসায়নের ভরত নাট্যশাস্ত্র থেকে শুরু করে আরও নানা বিষয়ে জেনে ফেলি। নৃত্য এবং সঙ্গীতের চর্চা আমার পাঁচ বছর বয়স হতেই শুরু হয়েছিল, তার ওপর এইসব শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার ফলে আমি অচিরেই বিভিন্ন মহলে জনপ্রিয় হয়ে উঠলাম। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পার করেছি যখন ততদিনে আমারও মায়ের মতো একাধিক পুরুষসঙ্গ হয়ে গিয়েছে এবং বুঝতে পেরে গিয়েছি কাম যে একটি কলা তা নারী এবং পুরুষ কেউই জানে না এবং তার ফলে এই কামকে ভালো করে উপভোগ থেকেও বঞ্চিত থাকে। আমি ওই সময়ে নিজ উদ্যোগে আমার বাড়িতেই ছোট একটি স্কুল তৈরি করি যেখানে সঙ্গীত, নৃত্যের প্রশিক্ষণ তো দিতামই তার সঙ্গে শেখাতাম কামকলার বিভিন্ন মুদ্রা। পাছে সামাজিক আক্রোশে পড়তে হয় তাই নৃত্যের বা অভিনয়ের ছলে এইগুলি শেখাতাম। ভেবেছিলাম কেউ আসবে না শিখতে, কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে খুব কম দিনের মধ্যেই বহু ছেলেমেয়ে আমার স্টুডেন্ট হয়ে উঠল।
আমার স্কুলের পরিচিতি বাড়তে থাকল এবং তারপরেই যা হয় আর কি, সমাজের হোতাদের নজর গেল আমার দিকে। তাঁরা আমার দিকে আঙুল তুলে বললেন, আমার মা ছিলেন একজন গণিকা এবং আমি তাঁর সুযোগ্যা কন্যা এখন ভদ্র ঘরের ছেলে-মেয়েদের বেশ্যাবৃত্তি শিখিয়ে উচ্ছন্নে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। ভারতের সংস্কৃতির বারোটা বাজিয়ে নতুন প্রজন্মকে পশ্চিমী সংস্কৃতিতে তাদের দীক্ষিত করছি, আমি আসলে তাদের দালাল, আমি নারী-পাচারকারি ইত্যাদি ইত্যাদি আরও অনেক কিছু…তাঁদের কিছুতেই বোঝানো গেল না আমি যা শেখাচ্ছি তা সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতিরই অঙ্গ। আমি বরং সেই কলাকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছি, কিন্তু কে কার কথা শোনে? সামাজিক, রাজনৈতিক চাপে আমার স্কুল গেল বন্ধ হয়ে। ইতিমধ্যে আমার মা মাত্র কয়েকদিনের অসুস্থতায় গত হলেন। আমি পুরো একা হয়ে গেলাম। কী করব বুঝতে পারছি না। ওই বাড়িতে একা বাবার সঙ্গে থাকার কোনো প্রশ্নই নেই, কারণ আমাদের দুজনের ভাবনা-আদর্শে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। ওই অবস্থায় আমাকে বাঁচিয়ে দিল একটি ফেলোশিপ। আমেরিকার একটি ইন্সিটিটিউটে আমি ফেলোশিপের জন্য অ্যাপ্লাই করেছিলাম। আমার বিষয় ছিল ভারতীয় চৌষট্টি কলার আধুনিকীকরণ। ফেলোশিপটা যেন আমাকে বাঁচার দিশা দেখাল। চলে গেলাম। দুই বছর সেখানে থেকে নিজের কাজ শেষ করলাম। তারপর ওখানেই একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পেয়ে গেলাম কাজ। সেখানে ভারতীয় কামশাস্ত্র পড়াতাম ছেলে-মেয়েদের। দেখতাম কী অসীম আগ্রহে তারা আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতিকে জানছে, শিখছে। অথচ আমার এমনই পোড়া দেশ যেখানে নিজের সম্পদের প্রতিই কোনও সম্মান নেই।
একটানা কথাগুলো বলে চিত্রলেখা থামলেন, হেসে বললেন, তোমরা ভাবছ আমি রূপমঞ্জরীর কথা বলতে গিয়ে শুধু নিজের জীবনের কথাই কেন বলে চলেছি? কারণ রয়েছে। তোমরা আমাকে আজ থেকে মা বলে ডাকবে, তোমরা হলে আমার সন্তান। একজন সন্তান যদি তার মাকে ভালো করে না জানে, না বুঝতে পারে তবে তার প্রতি শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা ততটা জন্মায় না। এই শিক্ষা পেয়েছিলাম আমি আমার মায়ের কাছ থেকে। কী অসামান্য স্পষ্ট ছিলেন তিনি আমার কাছে, সেই কারণেই তাঁকে আমার খুব কাছের মনে হত। যাই হোক, জীবনের তিরিশটা বছর আমি কাটিয়ে ফেললাম নিউ জার্সিতে। অবশ্য শুধু নিউ জার্সি বলা ভুল হবে। আমেরিকার বহু কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে স্পিচ দিতে যাওয়ার কারণে ওই দেশের নানা শহরে তো বটেই, ইয়োরোপেরও অনেক দেশ ভ্রমণ করতে হয়েছে আমাকে। এক এক দেশে থাকতেও হয়েছে কখনও এক মাস, কখনো বা দুই-তিন মাস। বলতে পারো এক পর্যটকের জীবন। নিজের কাজের কারণে পরিচিতিও বেড়েছিল ঢের। বিয়ে করিনি, কারণ কোনও এক পুরুষের প্রতি আমাকে আজীবন লায়াবল থাকতে হবে এমন রীতিতে আমি বিশ্বাসী নই। আবার আমার কারণে অন্য কেউ আঘাত পাবেন সেটাও কাম্য নয়। নিজের পরিবারের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝেছি বাবা-মায়ের নিয়ত অশান্তি হলে সন্তানের বড় যন্ত্রণা হয়। আর সেই দম্পতিও আজীবন প্রেমহীন জীবন যাপন করে। প্রেমহীন জীবন আসলে মৃত জীবন। তাই আমি মায়ের মতো ভুল করিনি। নিজের পছন্দমতো চাহিদামতো বিভিন্ন সময়ে পুরুষসঙ্গী নির্বাচন করেছি, প্রেমে পড়েছি, অসামান্য সুখের কিছু মুহূর্ত কাটিয়েছি। তারপর আবার যে যার মতো সরে গিয়েছি। এটাই আমার দর্শন।
ভেবেছিলাম বাকি জীবনটা প্রবাসেই কেটে যাবে। তখন একদিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করল এই রূপমঞ্জরীর ম্যানেজমেন্ট। কনসেপ্টটা বোঝানো হল আমাকে। খুব অভিনব লাগল আমার। ভারতবর্ষ এমন এক প্রাচীন সভ্যতার দেশ যেখানে যুগ যুগ ধরে পর্যটকরা আসেন, ভবিষ্যতেও আসবেন। এই রূপনগরে তৈরি করা হচ্ছে প্রাচীন ভারতের আদলে এক নগর যার কিছুটা অংশ হবে আবার গ্রাম। এবং সেখানে এমন এক গণিকালয় তৈরি করা হবে যার গণিকারা হবেন ভারতীয় কামকলায় শিক্ষিত। শুধু কামকলা নয়, চৌষট্টি কলার মধ্যে বিবিধ কলায় তাঁরা পটিয়সী হবেন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে বাছাই করে আনা হবে তাদের যারা আগ্রহী এবং যোগ্য। কারণ, সমীক্ষা বলে ভারতের আধুনিক গণিকাদের প্রায় কেউই ভারতের প্রাচীন কামকলায় শিক্ষিত নয়। তারা হয় আনাড়ি অথবা পাশ্চাত্যের অনুকরণ করে। কামের মধ্যে প্রেম না মিশলে সেই মিলন সুখকর হয় না। সঙ্গমকে প্রেমময় করে তোলার মধ্যেই রয়েছে জীবনের প্রকৃত আনন্দ। রূপমঞ্জরীর ম্যানেজমেন্টের এক উচ্চপদস্থ কর্ত্রী অনামিকা পাণ্ডে আমার দীর্ঘদিনের বিশেষ বন্ধু, আমার কাজ সম্পর্কে সে জানত, অনেক দেশে আমি যে ছেলেমেয়েদের ভারতীয় কামকলার প্রশিক্ষণ দিয়েছি সেটাও তার জানা ছিল। ফলত এমন একটি পরিকল্পনার গণিকাদের প্রশিক্ষক হিসেবে যুক্ত হওয়ার জন্য অনুরোধ করল আমাকে। সত্যি বলতে আমি দীর্ঘ তিরিশ বছর দেশের বাইরে থাকলেও একটি মুহূর্তের জন্যও আমার দেশের মাটি আমার স্মৃতি থেকে বিচ্যুত হয়নি, তার অন্যতম কারণও হয়তো আমার কাজটিই ছিল ভারতীয় সংস্কৃতি নিয়ে। সত্যি বলতে, দেশে ফিরে আসার টানও মাঝে মাঝে অনুভব করতাম, কিন্তু ফিরে এসে করব কী? এই দেশে গণিকার আইনি বা সামাজিক স্বীকৃতি নেই, নিরাপত্তা নেই, মানুষ গণিকালয়কে অস্পৃশ্য ভাবে। তাই এখানে এলে আমার কোনও কাজ হত না। তাই এমন অভিনব প্রস্তাব পাবার পর আমি খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিই এই দেশে চলে আসব। অবশ্য তার আগে আমি তিনবার এই দেশে এসে ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে মিটিং করেছি। আমার প্রস্তাব, তাঁদের পরিকল্পনা ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। তারপর পাকাপাকি চলে এলাম এই দেশে।
একটানা কথাগুলো বলে যাচ্ছিলেন চিত্রলেখা, কিন্তু কথা বলার স্টাইলও কী অসামান্য! এক মুহূর্তের জন্যও শ্রোতা বোর হবে না। বরং হাঁ করে শুনবে, আরও শোনার আগ্রহ জাগবে।
এই সেশনে তোমরা চারজন মনোনীত হয়েছ। আগামীকাল থেকে ঠিক এক মাস তোমাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ চলবে। এই একটি মাস কিন্তু যথেষ্ট শ্রমসাধ্য, তোমরা মানসিকভাবে আজই তার জন্য প্রস্তুত হও। প্রাচীনকালে গণিকাদের বাল্যকাল থেকেই প্রশিক্ষণের রেওয়াজ ছিল ফলে তারা যৌবন প্রাপ্তির শুরুতেই একজন প্রকৃত নায়িকা হয়ে উঠতে পারত, কিন্তু তোমাদের ক্ষেত্রে সেই সুযোগ নেই। কারণ, তোমরা প্রত্যেকেই ইতিমধ্যে যুবতী, ফলে আগে নায়িকারা যতটা শিক্ষালাভ করতে পারত তা তোমাদের পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়, আর সত্যি কথা বলতে এখন যারা তোমাদের নায়ক হবে তাদের মধ্যেও কামকলার রসবোধ প্রায় নেই-ই। সে কারণে প্রথম একমাস তোমরা শুধুমাত্র শিক্ষা এবং তারপরের একমাস কিছুটা কাজ এবং শিক্ষা এবং তারপরে কাজ এবং অনুশীলন—এই হল তোমাদের আগামীদিনের কর্মসূচি। আজ এইটুকুই। কাল থেকে তোমাদের প্রতিটি মুহূর্তের হিসেব আমি নিয়ন্ত্রণ করব, কখন কী করবে তার সবটাই হবে আমার নির্দেশে। অবশ্য ভেবো না এটা কোনও ফৌজি প্রশিক্ষণ, কিন্তু জানো তো কিছু শিখতে গেলে সবার আগে প্রয়োজন শৃঙ্খলা। তাই আশা করি তোমরা মন দিয়ে সবকিছু শিখবে এবং ভালোবেসে শিখবে। কী শিখবে তো? বলে ধনুকের মতো বাঁকা ভুরুদুটি অতি দ্রুত একবার নাচিয়ে মৃদু হেসে জিজ্ঞাসা করলেন চিত্রলেখা।
চারজনেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল।
বেশ, তোমরা তাহলে আসতে পারো। নিজেদের সঙ্গে একটু আলাপ-পরিচয় করে নাও। ঘুরে চারদিক দেখো। কাল ভোরবেলায় তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে।
রূপসা উঠতে গিয়ে কী মনে করে চিত্রলেখার পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। ওর দেখাদেখি বাকি তিনজনও প্রণাম করল চিত্রলেখাকে।
চিত্রলেখা আপত্তি করলেন না। এই প্রণামে তিনি অভ্যস্ত। সকলের মাথায় আলতো করে হাত ছুঁয়ে বললেন, আশীর্বাদ করি চমৎকার নায়িকা হয়ে ওঠো।
রূপসার কানে বার বার এই নায়িকা শব্দটা বাজছিল। নায়িকা মানে? হিরোইন? সে তো সিনেমা-থিয়েটারে হয়…অবশ্য এখানেও প্রায় সেইরকমই। যাক গে, পরে জানা যাবে।
ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল চারজনে।
প্রথম শব্দটাই ‘উফ’ করল চিরশ্রী। তারপর ইংরেজিতে বলে উঠল, হে ভগবান! কী কঠিন সব ব্যাপার! পুরো ঘেঁটে গেছি।
ওর কথায় হেসে উঠল তিনজনে।
অপালা বলল, আমি তো পুরো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছি। এ কোথায় এলাম? রামোজি ফিল্মিসিটি মনে হচ্ছে।
হি হি হি! আমার তো মনে হচ্ছে টাইম মেশিনে চেপে গুপ্তযুগে চলে এসেছি। হেসে বলল রূপসা।
সে টাইম মেশিনে বৈদিক যুগেই আসি বা রামোজি সিটিতে এবার আমাদের জীবন, ভাগ্য সবই এখানে লেখা। কেউই জানি না আমাদের সঙ্গে কী ঘটতে চলেছে। তবে এইটুকু বুঝে গেছি পুরো দুর্ভেদ্য জায়গা। বিপদে পড়লে পালানোর কোনও রাস্তা নেই।
বিশাখার কথায় সায় দিল রূপসা।
ওরা মোরাম বিছনো রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল। সন্ধে নেমে এসেছে। রাস্তার দুইপাশে কিছু দূর অন্তর ল্যাম্পপোস্ট। পোস্টগুলো অবিকল মশালের মতো দেখতে।
আচ্ছা, আমরা এবারে নিজেদের পরিচয় পর্বটা সেরে ফেলি, কাল থেকে তো চারজনেরই জীবন একই নিয়মে বাঁধা পড়তে চলেছে।
রূপসার কথায় বিশাখা বলল, হ্যাঁ, আমি বলি। আমার নাম রিয়া কোহলি, পাঞ্জাব থেকে এসেছি। এখানে নাম পেলাম বিশাখা।
আমারও অপালা নাম এখান থেকে দেওয়া, আমার নাম অদিতি আকুলা। অন্ধ্রের মেয়ে আমি।
আর আমিও দক্ষিণেরই মেয়ে। তামিলনাড়ুর। আসল নাম জুলিয়ান চন্দ্রশেখর। এখানে চিরশ্রী নাম পেয়েছি।
শুধু আমার নামটাই অক্ষুণ্ণ থেকে গেল।
হ্যাঁ, তুমি তো বাঙালি তাই না? জিজ্ঞাসা করল অপালা।
হ্যাঁ, আমি বাঙালি, রূপসা দাশ। তবে আমার বাড়ি এই শহরে নয়। অনেকটাই দূরে। বলল রূপসা। আমি আসলে কাজ করতাম একটা বারে। সন্ধেবেলায় গান করতাম আর তারপর ক্লায়েন্ট সার্ভিস। প্লেজার ট্রিপেও যেতে হত। যে রেটে পরিশ্রম করতে হত, রোজগার হচ্ছিল না। সিনেমায় ট্রাই করেছিলাম। প্রোডিউসার, ডায়রেক্টর শুধু আমাকে নেড়েচেড়ে ছেড়ে দিল, চান্স পেলাম না। আবার সেই পুরোনো ধান্দা। হঠাৎই আমার এক সহেলি এই রূপনগরের কথা জানাল। অ্যাপ্লাই করলাম, ইন্টারভিউ হল, তারপর জয়েনিং, ব্যাস। বলে থামল রূপসা।
বিশাখা বলল, উফ এখানকার ইন্টারভিউ! কী কঠিন!
সত্যিই যা বলেছ! আমি তো কল্পনাই করতে পারিনি আমাদের প্রফেশনেও এমন পরীক্ষা দিতে হবে।
চিরশ্রীর কথায় রূপসার মনে পড়ল সেই দিনের কথা। একদিন ইন্টারভিউ আর আরেকদিন মেডিকেল হয়েছিল। শহরের একটি নামী ক্লিনিকে শরীরের সবকিছু টেস্ট হয়েছিল ওর। সকাল থেকে বিকেল গড়িয়ে গিয়েছিল সেদিন ওই ক্লিনিকে। পেমেন্ট রূপমঞ্জরী থেকেই করা হয়েছিল এবং কোনও টেস্টেরই রিপোর্ট রূপসাকে জানানো হয়নি। শুধু দিন সাতেক পর একটা ফোন এসেছিল মোবাইলে, অভিনন্দন, আপনি রূপমঞ্জরীতে ট্রেনি হিসেবে মনোনীত হয়েছেন। আগামী তিনমাস আপনার প্রবেশন পিরিয়ড। আপনার স্যালারি…আপনার অমুক আপনার তমুক… আপনাকে এই জমা রাখতে হবে…গড়গড় করে ফোনে কথাগুলো বলে চলেছিল মেয়েটি আর রূপসার হাসি পাচ্ছিল খুব, শালা বেশ্যার চাকরি তার জন্য আবার ট্রেনিং এই সেই অমুক তমুক…। কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার ছিল না শুধু মোবাইলে একটা কোড দেওয়া মেসেজ এসেছিল। ওটাই নাকি অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। কিন্তু শহরের যে নামী পাঁচতারা হোটেলটিতে রূপসার ইন্টারভিউ নেওয়া হয়েছিল সেটা যথেষ্ট কঠিন। ইংরেজিতে কথা বলার ধরন, ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্পর্কে কেমন জ্ঞান থেকে কারেন্ট ইস্যু এবং তারপর সেক্স সম্পর্কে জ্ঞান, কতরকমের পশ্চার জানা রয়েছে তা প্র্যাকটিক্যাল দেখানোর জন্য ওই হোটেলেই কোম্পানির আনা দুটি পুরুষের সঙ্গে সারাদিনে চারবার নানা ভঙ্গিতে সেক্স করতে হয়েছিল আর পুরোটাই ভিডিওশু্যট হয়েছিল। তিনজন ইন্টারভিউয়ার ছিলেন যার মধ্যে দুজন মহিলা এবং একজন পুরুষ। টানা দু’দিন থাকতে হয়েছিল ওই হোটেলে। রূপসার হাঁটাচলা, খাওয়া, স্নান, লোকের সঙ্গে কথা বলা, ঘুমোনো, সুইমিংপুলে সাঁতার কাটা সবকিছু ওয়াচ করেছিলেন তাঁরা। ব্যাপারটা নেহাত সহজ ছিল না। রূপসাকে জানিয়েই ওর রুমে বসানো হয়েছিল ক্যামেরা যাতে ওর প্রতিটি মুহূর্তের মুভমেন্ট খেয়াল করা যায়। অলকা নামের যে মহিলা সিনিয়র ইন্টারভিউয়ার ছিলেন কম করে ষাট বছরেরও বেশি বয়স। স্লিম, অসম্ভব ফরসা, খুব সাজতেন। মাথার চুল ছিল ডাই করা। চড়া লালরঙের লিপস্টিক, অত্যন্ত অমায়িক ব্যবহার। ওই ইন্টারভিউতে রূপসা একা ছিল না। আরও দুটি মেয়ে এসেছিল। তবে তাদের কেউই মনোনীত হয়নি।
ইন্টারভিউ শেষে পরদিন বিকেলে চেক-আউটের সময় অলকা ম্যাডাম রূপসার কাঁধে হাত রেখে মুচকি হেসে বলেছিলেন, তুমি ট্যালেন্টেড, কিন্তু পুরুষকে এত ঘৃণা করলে কী করে চলবে? পুরুষ প্রেম চায়, আসলে ভিখিরি তো।
কথাগুলো শুনে চমকে উঠেছিল রূপসা। উনি কী করে বুঝলেন এত কথা! রূপসা পালটা প্রশ্ন করেছিল, আমি কি তাহলে মনোনীত?
তার উত্তর কিন্তু উনি সরাসরি দেননি। শুধু বলেছিলেন, হোপ ফর দ্য বেস্ট।
ওই ইঙ্গিতেই রূপসা যা বোঝার বুঝে গিয়েছিল। ফোন এসেছিল ঠিক সাতদিন পরে।
চারজনে হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়াল একটা সরোবরের সামনে। বেশ বড় সরোবর। অন্ধকার নেমে আসার ফলে ওপার দেখা যাচ্ছে না। শান বাঁধানো ঘাটের পাশে একটা নৌকো দাঁড়িয়ে। নৌকোয় একটি কেরোসিন বাতি জ্বলছে। সেই আলোয় চারপাশ সামান্য আলোকিত। নৌকোটির সামনের অংশ ময়ূরকণ্ঠী। রঙিন কাপড়ে সাজানো একটি ছাউনিও রয়েছে। নৌকোর একপ্রান্তে চুপ করে বসে রয়েছে মাঝি। ওদের দিকে একবার তাকাল, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, যাবেন?
এখানে সকলেরই ভাষা ইংরেজি। বাংলা তো নয়ই, হিন্দিও নয়। এর কারণ কী কে জানে! এখানে যতদিন থাকতে হবে বাংলা ভুলে থাকতে হবে, বঙ্গদেশে থেকেও বাংলাহীন। যাক গে বাংলা নিয়ে আদিখ্যেতা করার কিছু নেই, স্পোকেন ইংলিশটা বুদ্ধি করে শিখেছিল বলে এই কাজটা হয়েছে, শুধু এটা কেন? অনেক কিছুই হয়েছে।
অপালা ওদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে বলল, ঘুরতে যেতে বলছে, যাবে নাকি সান্ধ্য নৌকাবিহারে?
বাকি তিনজন কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই দেখল এক মধ্যবয়সী দীর্ঘ পুরুষ একটি মেয়েকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে এল ঘাটে। মেয়েটি নিজের অনাবৃত পা দুটি দোলাচ্ছে, এবং নিজের দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে রয়েছে সেই পুরুষের কণ্ঠ। রূপসা দেখল লোকটার বয়স যথেষ্ট, টাক মাথা, ফ্রেঞ্চকাট, খালি গায়ে, পরনে শুধু একটি ধুতি, মেয়েটির গায়ে অনেকরকম গয়না, বুক অনাবৃত। পুরুষটি বার বার মুখ ঝুঁকিয়ে মেয়েটির ঠোঁটে, বুকে গভীরভাবে চুমু খাচ্ছে। আর ওহ বেবি উমম…হ! বলে উঠছে।
একঝলক দেখেই বোঝা যায় খাঁটি ইউরোপিয়ান। লোকটা ওদের দিকে দেখলও না, মেয়েটিকে ওই কোলে নিয়েই সোজা উঠে পড়ল নৌকোতে। ছেড়ে দিল নৌকো, খুব ধীরভাবে ভাসতে শুরু করল সরোবরে। মেয়েটির খিলখিল হাসি আর গয়নার শব্দ মিশতে থাকল হাওয়াতে। খুব বেশিদূর গেল না নৌকো। পুরুষটি নৌকোর ছাউনির ভিতরে ঢুকল না, বাইরেই চিত হয়ে শুয়ে পড়ল, মেয়েটি চেপে বসল পুরুষটির ওপর। শুরু হল ফোরপ্লে। দুজনের শীৎকার এবং উদ্দামতায় নৌকো দুলতে থাকল। মাঝি নির্বিকার ভাবে বৈঠা বাইছে, কখনও থামছে।
চিরশ্রী বলল, ওয়াও! এ তো পুরো শ্রীকৃষ্ণের নৌকাবিলাস! দারুণ তো!
আমাদেরও করতে হবে। হেসে বলল অপালা। তবে নৌকোয় কাজ আমিও অনেকবার করেছি। না, এমন পুরোনো নৌকোয় নয়, হাউসবোটে। ওড়িশার এক ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের ছেলের সঙ্গে গিয়েছিলাম চিল্কায়। দুইরাত্রি ছিলাম লেকের মাঝে। দারুণ অভিজ্ঞতা। ছেলেটা বেশ ফুর্তিবাজ ছিল। দিব্যি মজায় কাটিয়েছিলাম দুটো দিন।
এবার এখানে কেমন কাটাও দেখো। হয়তো বাকি জীবন এই লেকেই কাটাতে হবে।
রূপসার কথায় হেসে উঠল তিনজনেই।
তা তুমি কীভাবে এলে এখানে, তোমার গল্পটা শুনি? রূপসাকে জিজ্ঞাসা করল বিশাখা।
আমার আর গল্প! আমাদের সকলের গল্পই তো এক তাই না? সামান্য এদিক- ওদিক। বলল রূপসা।
তা ঠিক বলেছ। আমাদের গল্পগুলো একই। তবে যেটুকু বুঝেছি, আমরা এখানে অনেক কঠিন পরীক্ষা দিয়েই মনোনীত হয়েছি, কারণ আমি যার মাধ্যমে এখানকার খোঁজ পেয়েছিলাম সে একজন এজেন্ট। ফ্রেন্ডশিপ কোম্পানির এজেন্সি রয়েছে।
মানে ওই শুট অ্যান্ড বোল্ড বন্ধু পাতা কোম্পানি? ফিক করে হেসে জিজ্ঞাসা করল চিরশ্রী।
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল বিশাখা—আমি নিজেও বছর তিনেক ওই কোম্পানিতে ছিলাম। ক্লায়েন্ট বলতে সব বুড়ো ভাম, এমনি রিলেশনই পারে না তো আবার বোল্ড…একদিকে ভালো, খুব বেশি পরিশ্রম করতে হত না আমাকে। অল্পেই দম বেরিয়ে যেত ওদের। শুধু একবার পুনাতে যেতে হয়েছিল এক ক্লায়েন্টের কাছে। ওরে বাব্বা আমার জীবন প্রায় বার করে দিয়েছিল, এই একহাত লম্বা পেনিস। দেখলেই ভয় লাগত, কাজ করব কী? আর তেমনি গায়ে ষাঁড়ের মতো শক্তি, কী খেয়ে বড় হয়েছে কে জানে, আধঘণ্টা পেরিয়ে যেত শালার বীর্যপাত হত না। ভালো পেমেন্ট পেয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু ওখান থেকে ফিরে তিনদিন বিছানায় শুয়েছিলাম, সারা গায়ে ব্যথা। বেশ কয়েকদিন কাজে বেরোতে পারিনি।
রূপসা ওদের কথা শুনছিল আর ভাবছিল নিজের কথা। সকলকে মনে নেই, অনেকের মুখই ঝাপসা, সেটাই চায় রূপসা, পুরোনো সব মুখগুলো প্রাণপণে ভুলে যেতে চায়। আগেও যে একটা জীবন ছিল, কয়েকটা মানুষ ছিল সেই জীবনে, তার স্মৃতি মনে রাখতে চায় না ও। কোনও ঘটনা, কোনও মানুষ কিচ্ছু না। এমনকি মাকেও ভুলে যেতে চেষ্টা করে। কিন্তু এমনই অভিশপ্ত কপাল যে কিছুই মন থেকে মুছে যায় না। টাটকা ক্ষতের মতো প্রতিনিয়ত জেগে থাকে।
নৌকোটা বেশ খানিক দূরে চলে গিয়েছে। ঝাপসা অন্ধকারে শুধু নৌকোর লণ্ঠনের আলোটা মিটমিট করে জ্বলছে।
চলো, কাল থেকে আমাদেরও সব লক্ষ্মী-সরস্বতী সেজে স্টেজে নামতে হবে। মাঝে মাঝে যা হাসি পেয়ে যাচ্ছে না! মাইরি কী বলব! পুরো যাত্রাপার্টির মতো লাগবে আমাকে। আমি যে ঘরটা পেয়েছি সেই ঘরে একটা আলমারি রয়েছে। খুলে দেখলাম সব মোগল আমলের শাড়ি-কাপড় সাজিয়ে রাখা রয়েছে। ওগুলোকে পরতে হবে। কীভাবে পরে কে জানে?
আমার আলমারিতেও রয়েছে। শিখিয়ে দেবে নিশ্চয়ই। আচ্ছা, আমাদের কাল ভোরে কি ওইগুলো পরে যেতে হবে? মানে সেসব তো কিছু…
রূপসা মাথা নেড়ে বলল, আমার মনে হয় না। তাহলে সেটা উল্লেখ করে দিতেন উনি।
মা!
হ্যাঁ, আমাদের নতুন মা। আবার হি হি করে হেসে উঠল তিনজন।
চলো, এবার ফেরা যাক।
হ্যাঁ, চলো। চারজন হেঁটে ফিরতে থাকল। একটি ঘোড়া মৃদুমন্দ ছন্দে ওদের পাশ দিয়ে গেল। ঘোড়ায় চড়ে বসে থাকা পুরুষটি সম্পূর্ণ উলঙ্গ এবং তার দিকে মুখ করে কোলে বসে থাকা যুবতীটিও পোশাকহীন। মেয়েটি জড়িয়ে রয়েছে পুরুষটিকে। ঘন ঘন চুমু খাচ্ছে।
ওরেব্বাস! যা বুঝছি ঘোড়ায় চড়েও কাজ করতে হবে আমাদের।
হা হা হা! সেটাই মনে হচ্ছে। পুরো আর্মি ট্রেনিং।
ঘোড়া আর হরিণ দেখেছি কিন্তু হাতি দেখলাম না, রূপসা বলল।
না না, হাতিও রয়েছে, আমি সকালে দেখেছি। সেই মহাভারত সিরিয়ালের মতো সাজানো হাতি।
আহা! আমার খুব শখ হাতির পিঠে চাপার। মনে হয় এবার পূর্ণ হবে। বলল অপালা।
হ্যাঁ, এখানে হাতি-ঘোড়া সকলের পিঠে চেপেই ডিউটি করতে হবে মনে হচ্ছে।
দেখো ভাই, এখানে যা পে প্যাকেজ তা যদি সত্যিই দেয় তাহলে হাতি-ঘোড়া কেন, আমি শজারুর পিঠে চেপেও কাজ করতে রাজি।
রূপসার কথায় হি হি করে হেসে উঠল তিনজনেই।
তোমার তো দেখছি খুব রস!
হুঁ, কোথায় আর রস? সব তো নীচ দিয়েই গলে গেল।
আবার হাসির তোড়।
আমাদের ঘরগুলো কিন্তু খাসা।
হ্যাঁ, সত্যি দারুণ। কিন্তু কার কোনটা খেয়াল করিনি।
আমিও দেখিনি, তবে আমার মনে হয় সব ঘরগুলোই কাছাকাছি হবে।
ওরা গল্প করতে করতে যেদিকটায় হাঁটছিল সেটা ওদের ঘরে ফেরার রাস্তা নয়। রাস্তাটা ফাঁকা জায়গা ছাড়িয়ে বেশ ঘন জঙ্গলের ভেতর চলে গিয়েছে। জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে মশালের আলো দেখা যাচ্ছে।
কী হচ্ছে ওখানে, যাবে নাকি দেখতে?
থাক। একদিনে সব দেখে লাভ নেই। অনেক কিছুই দেখার রয়েছে। ধীরে ধীরে দেখা যাবে। এবার ঘরে ফেরা যাক।