» » রূপনগরের পিশাচিনী

বর্ণাকার

আজ সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। কাল শেষ রাতে বেশ এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। ঘুমের মধ্যেই টিনের চালে সেই বৃষ্টির শব্দ শুনেছে রূপসা। ঝমঝম করে সেই শব্দ মনে হয় যেন ঠিক গায়ের ওপরেই ঝরে পড়ছে। লোকে বলে নয়নপুরের মাটি বৃষ্টিখেকো। হয়তো কথাটা কিছুটা হলেও সত্যি। এই নয়নপুরে বৃষ্টি যেন একটু বেশিই হয়। বর্ষা আসার আগেই এখানে বৃষ্টি নেমে যায় আবার বর্ষা ফেরত চলে গেলেও বৃষ্টি নয়নপুরের মায়া ছাড়তে চায় না। গাছগাছালিতে ঘেরা এই ছোট জায়গাটি কলকাতা শহর থেকে রেলপথে ঘণ্টাতিনেক দূরে। এই জায়গার অধিকাংশ মানুষ নিজের জায়গা ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়নি। ফলে অনেক পুরোনো বাসিন্দার বাস। জঙ্গল, ঝিল, জলাভূমি, শীতে পরিযায়ী পাখির আনাগোনা এবং টাটকা শাকসবজি, মাছের কারণে এই অঞ্চলের মানুষ দিব্যি সুস্থ এবং হাসিখুশি। লোকে খুব দরকার না পড়লে শহরে যায় না। কয়েক বছর আগেও এই নয়নপুরে মানুষের পাওয়া-চাওয়া কম ছিল, জীবন নিয়ে অভিযোগ কম ছিল।

কিন্তু এই বছর কয়েক ধরে খুব ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করেছে নয়নপুর। প্রথমে রত্নেশ্বরী মন্দিরের পাশে বিশাল ঝিল সংলগ্ন বনে শীতকালীন পিকনিক হত। সেটা একসময় শুধুমাত্র অঞ্চলের মানুষরাই সপরিজন মিলে করত। প্রতি বছর নভেম্বর থেকে শুরু হত পিকনিক। চলত ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত। রত্নেশ্বরী বহু প্রাচীন এক দুর্গামন্দির। অন্তত পাঁচশো বছরের পুরোনো মন্দিরটি এককালে ঘন জঙ্গলের মধ্যেই ছিল। পরে জঙ্গল বেশ কিছুটা কেটে একসময় ওই মন্দিরের চারপাশ সাফসুতরো করে নিয়মিত পুজোআচ্চা করা শুরু হয়। সেও প্রায় পঞ্চাশ বছর হতে চলল। মন্দির থেকে কিছুটা পায়ে হেঁটে গিয়ে ঝিলের ধারে যে পিকনিক নয়নপুর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষ করত সেটা লোকমুখে ছড়াতে ছড়াতে একসময় আর স্থানীয় রইল না। ধীরে ধীরে শহর থেকেও লোকজন আসতে শুরু করল। সারাদিন ঝিলের ধারে-জঙ্গলে ঘুরে, ঝিলে স্নান করে, বক্স বাজিয়ে গান চালিয়ে হুল্লোড় করার পর সন্ধে নামতে আবার ফিরে যেত, ঝিলের ধারে পড়ে থাকত এঁটো শালপাতা, মাংসের হাড়গোড়, মদের শূন্য বোতল। মাঝে মাঝে শহরের পয়সাওলা লোকেরা এসে গ্রামের মানুষদের কাছ থেকে প্রায় ডবল দামে দেশি মুরগি, কচি পাঁঠা, শাকসবজি কিনত। গরিব মানুষগুলো দুটো অতিরিক্ত পয়সার মুখ দেখে বেমালুম খুশি হয়ে উঠত। অপেক্ষা করত বনভোজনের ঋতু ও শহুরে মানুষদের জন্য যারা দু’টাকার জিনিস অনায়াসে পাঁচ টাকায় কিনতে পারে।

চাহিদা তৈরি হলে জোগানও হবে। নয়নপুরের গায়েও হালকা ঝাপটা মারল আধুনিকতা। স্টেশনের ধারে বিলিতি মদের দোকান তৈরি হল আর পঞ্চায়েত এবং স্থানীয় দাদাদের সিদ্ধান্তে তৈরি হল ঝিলের ধারে বেশ কয়েকটি কটেজ। উদ্দেশ্য পিকনিক পার্টিরা যদি খোলা জায়গায় পিকনিক করতে না চায় তাহলে রুম ভাড়া করেও করতে পারে এবং রাতে যদি থেকে যেতে চায় সেটাও ভাড়ার বিনিময়ে থেকে যেতে পারে। নাম হল নিরালা। চারটে ছোট ছোট কটেজ। সিঙ্গল রুম। অ্যাটাচড টয়লেট, কিচেন। টুকটাক বাসনপত্র। শহরের পিকনিক পার্টি মাঝে মাঝে এসে থাকতেও শুরু করল। সেবাযত্নের দায়িত্ব পেল পঞ্চায়েত থেকে রিক্রুট করা কয়েকজন স্থানীয় মানুষ। তার মধ্যে রূপসার থেকে ছয় বছরের বড় দাদা বিলুও কাজ পেয়ে গেল। পাক্কা হারামি বলতে যা বোঝায় বিলু হল তাই। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়ে স্কুল ছেড়ে দিয়েছিল বিলু। বাজে সঙ্গে মেলামেশা শুরু করল। মাঝে মাঝেই রাতে বাড়ি ফিরত না। কখনো অনেক রাতে ফিরত নেশা করে। বাবা কাজ করত ভূতনাথ রাইসমিলে। প্রচুর খাটুনি, পয়সা সামান্য। বাড়িতে চারটে পেটের জোগাড় দিতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে যেত বাবা। অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে গিয়ে শরীর গেল ভেঙে। মা-ও তখন কাজ করতে শুরু করল। সংসারের কাজ সামলে মুড়িভাজা, আচার বানানো। সেইগুলো বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি। এক একসময় সব সামলে উঠতে পারত না মা। তখন রূপসাকে পাঠাত। রূপসার তখন ক্লাস সিক্স। একদিন রতনকাকার বাড়িতে আচারের কৌটো দিতে গিয়েছিল রূপসা। রতনকাকার একটা পা ছিল বাঁকা। খুঁড়িয়ে হাঁটত। বাড়ির সামনে ছোট একটা মুদির দোকান ছিল। ওই দিয়েই একার সংসার চালাত। রূপসার মায়ের কাছ থেকে আচার কিনত রতন। দোকানে বিক্রি করত নিজের লাভ রেখে। সেদিন দুপুরে রূপসা রতনের ঘরের দরজায় কড়া নাড়ার পর দরজা খুলে রতন তাকিয়েছিল রূপসার দিকে। ফ্রক পরা রূপসার চেহারাটা ক্লাস সিক্সের তুলনায় অনেক বেশি বাড়ন্ত। রতন বলেছিল, বাইরে কেন, আয় ঘরে আয়। ঘরটা পুরো অন্ধকার। রূপসার কেন কে জানে ইচ্ছে হয়নি ঘরের ভেতর ঢুকতে। সহজাত সাবধানতায় বলেছিল, না গো, পরে আসব।

আরে আয় না, ভালো একটা জিনিস খাওয়াব তোকে। বলে আচারের বয়ামের সঙ্গে রূপসার হাতটাও ধরেছিল রতনকাকা।

সেই ধরাটা ভালো লাগেনি রূপসার। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড় লাগিয়েছিল রূপসা। হাঁফাতে হাঁফাতে বাড়ি ফিরে মাকে আচারের শিশি ভরা ব্যাগটা ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিল, আমি আর কখনও রতনকাকার বাড়ি যাব না।

মা কিচ্ছু জিজ্ঞাসা করেনি, শুধু একদৃষ্টে মেয়ের মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে কিছু একটা আন্দাজ করে নিয়ে বলেছিল, ঠিক আছে, আর যাস না। আর একটা কথাও জিজ্ঞাসা করেনি মা, কিন্তু তাই বলে রতনের দোকানে আচার দেওয়াও বন্ধ করেনি। নিজেই যেত।

বাবার চালকল ধুঁকতে শুরু করল একসময়। খাবি খেতে খেতে একসময় যখন প্রায় চলে কি চলে না, তখন মা-ও সদর হাসপাতালের বেডে জায়গা না পেয়ে মেঝেতে শুয়ে। মায়ের জ্বর কমছিল না। আর সঙ্গে অসহ্য পেটে ব্যথা, বমি। মাকে দেখে চেনা যেত না। একটা কঙ্কালে চামড়া জড়ানো। রূপসা মায়ের কাছে যেতেও ভয় পেত। একবার মাত্র শুনতে পেয়েছিল হাসপাতালের ডাক্তারবাবু বাবাকে বলছে, এই পেশেন্টকে তো মেরেই এখানে নিয়ে এসেছেন। এতদিন কী করছিলেন?

খুব বেশিদিন থাকেওনি মা। দিন সাতেকের মধ্যেই চলে গিয়েছিল। বিলু মায়ের মুখাগ্নি করছিল যখন তখনও মুখে বাংলা মদের গন্ধ। শ্মশানযাত্রী বন্ধুদের খাওয়াতে গিয়ে নিজেও দুই ঢোক মেরে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারেনি।

মা চলে যাওয়ার পরদিন থেকেই যেন সংসারটা কমজোরি দর্মার ঘর যেভাবে প্রবল ঝড়ে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে সেইভাবেই পড়ে গিয়েছিল। বাবার চালকল পুরো বন্ধ। হাতে একটা টাকাও নেই। বিলু নানারকমের বেনিয়মে রোজগারের ধান্দাই চালাতে থাকল। কখনও দালালি, কখনও সাট্টার ঠেকে নাম্বার লেখা, কখনও পার্টির ফাইফরমাশ। বিলুর সুপারিশেই ওই রত্নেশ্বরী ট্যুরিস্ট লজে বাবার একটা কাজ জুটে গেল। কেয়ারটেকার টাইপ কাজ। মাইনে সামান্যই। পঞ্চায়েত থেকে দেওয়া হত। তবু যাই হোক, কোনওমতে চলে যেত। বিলুর রোজগার সংসারে ঢুকত না। পারলে মাঝে মাঝে বাবার কাছে এসে বলত, শ’ দুয়েক দাও তো। টাইমে শোধ দিয়ে দেব।

টাকা কোথায় পাব? লজ্জা করে না তোর বাপের কাছে এই বয়েসে টাকা চাইতে? বোনটা পর্যন্ত পড়াশোনার খরচ নিজে চালিয়ে আচার বানিয়ে, মুড়ি ভেজে ঘরে দুটো পয়সা আনছে আর তুই…

আরে ধুর ভাই, অত জ্ঞান মারাচ্ছ কেন? লোন চাইছি। দিতে পারলে দেবে, না হলে বলে দেবে স্টকে মাল নেই। অত হ্যাজানোর কী আছে? আর তোমার মেয়ে কী করে রোজগার করছে সেইসব আমাকে শুনিও না। বলে চলে গিয়েছিল বিলু।

রূপসা ঘরে বসে কুলের আচার প্লাস্টিকের ছোট ছোট প্যাকেটে ভরতে ভরতে শুনেছিল বাবা দাঁতে দাঁত ঘষে বলছে, শুয়োর…জানোয়ার একটা!

বছর গড়িয়ে গেল। পড়াশোনা আর টানছিল না রূপসাকে। ভালো লাগছিল না। আম, কুল, চালতা, লঙ্কা—মায়ের কাছ থেকে শেখা আচার বানানোর বিদ্যেটা কাজে লাগিয়ে সংসারের জন্য কিছু পয়সা তুলছিল ঠিকই, কিন্তু ভালো লাগছিল না। বরং পাড়ায়-বেপাড়ায় যেখানেই যেত নানা বয়সের ছেলের হাঁ করে তাকিয়ে থাকাটায় প্রথম দিকে ভয় ভয় একটা অস্বস্তি লাগলেও একদিন কে যেন কানে কানে ফিস ফিস করে মন্ত্র পড়ে দিল, ভালোবাসতে শেখ, এই দেখাটাকে ভালো লাগাতে শেখ। তাই শিখতে শুরু করল রূপসা। এটা সত্যি, অভাবের অযত্নের ঘরে, সঠিক বয়েসের আগেই বড্ড বেমানানভাবে সুন্দর আর পরিপূর্ণ মেয়েদের মতো হয়ে উঠছিল ও। ঘরের কাজের কারণে স্কুলে রোজ যেতে পারত না, কিন্তু যেদিন যেত, আটোসাঁটো স্কুল ইউনিফর্ম পরা রূপসাকে দেখে কয়েকজন বন্ধু বলেই ফেলত, তুই তো হিরোইন হয়ে যাচ্ছিস, কী খাস? কী মাখিস গায়ে?

রূপসা হাসত, বুঝতে পারত বন্ধুদের এইসব প্রশ্নে যতটা না মুগ্ধতা, ভালোলাগা রয়েছে তার থেকে ঢের বেশি রয়েছে হিংসা। এই হিংসাকেও ভালো লাগাতে শুরু করল রূপসা। বুঝতে শুরু করল ঈশ্বর ওকে অন্য ঐশ্বর্য দিয়েছেন। সেই ঐশ্বর্যের মূল্য কিছুটা অন্তত যাচাই করার জন্যও মাঝে মাঝে ইচ্ছে হত রূপসার। কিন্তু ভয় হত।

মায়ের বন্ধু ছিল পদ্মকাকিমা। রূপসাদের পাড়া থেকে আরও বেশ কিছুটা পশ্চিমে। সাইকেলে মিনিট কুড়ি লাগে। প্রতি দুই মাস অন্তর কাকিমার বাড়ি গিয়ে কয়েক রকমের আচার দিয়ে আসত মা। রূপসাও গিয়েছে মায়ের সঙ্গে। মা মারা যাওয়ার পর রূপসা দুই-তিনবার একাই সাইকেল চালিয়ে গিয়েছে আচার দিতে। পদ্মকাকিমার মন বড় ভালো। গেলে অনেক কিছু খাওয়ায়, শুধু তাই নয়, কিছু না কিছু জামাকাপড় কিনে রেখে দেয় রূপসার জন্য। আচারের দাম ছাড়াও দু-দশ টাকা বেশি গুঁজে দিয়ে বলে, নিজের ইচ্ছেমতো খরচ করিস। মা নেই তো কী হয়েছে, এই কাকিমাও কিন্তু তোর মায়ের মতোই। মনে রাখিস।

সত্যিই পদ্মকাকিমা মস্ত একটা ভরসার জায়গা। বাবার শরীরের যা অবস্থা তাতে মনে হয় না আর খুব বেশিদিন কাজ করতে পারবে। আর গেস্ট হাউজের মাইনের নিয়ম যেদিন কামাই সেদিনের পয়সা বাদ। বাবার রোজগার তলানিতে। দাদার ওপর বিন্দুমাত্র আস্থা নেই। ছেলেটা এখন বাড়িতে থাকলেই বিরক্ত লাগে রূপসার। মনে হয় আপদটা ঘর থেকে কখন বেরোবে। মাঝে মাঝে বাড়িও ফেরে না। আবার কখনো সারাদিন ঘরের ভেতর শুয়ে থাকে। এক এক সময় উটকো ছেলেরা আসে মটোর বাইক চালিয়ে। ‘বিলু’, ‘এই বিলু’—বলে বাইরে থেকে হাঁক মারলে দাদা তাড়াতাড়ি গায়ে জামা গলিয়ে বেরিয়ে যায়। বাবা কখনও জিজ্ঞাসা করলে ইচ্ছে হলে উত্তর দেয়, বিজনেস করছি।

কিসের বিজনেস কে জানে? একটা পয়সা তো চোখে দেখা যায় না। নিজের সাইকেলটা সারানোর জন্যও অনেক সময় রূপসার কাছে পয়সা চায়। একটাই ডায়লগ, লোন হিসেবে নিচ্ছি, পরে ইন্টারেস্ট সমেত ফেরত দিয়ে দেব।

আজ সারা সকাল ধরে আচার বানানোর পর দুপুরে ভাত খেয়ে একটু শুতেই চোখ লেগে গিয়েছিল রূপসার। হঠাৎই ঘুম যখন ভাঙল বেশ বিকেল হয়ে গিয়েছে। বাবা ডিউটি গিয়েছে। ফিরতে সন্ধে হবে। আজ পদ্মকাকিমার বাড়ি যাবে বলে চারটে শিশিতে চার রকমের আচার ভরে ব্যাগে রেখে দিয়েছিল। জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল রূপসা। আকাশ সেই কালো। আর গুমোট গরম। কী করবে একটু ভেবে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, বেরোনো যাক। রাস্তায় ভিজলে ভিজবে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিয়ে সাইকেলের হ্যান্ডেলে আচারের থলে ঝুলিয়ে রওনা দিয়ে দিল রূপসা। খুব জোরে সাইকেলের প্যাডেল ঘোরাতে থাকল। হাঁটু পর্যন্ত ফ্রক মাঝে মাঝেই দমকা হাওয়ায় উপরে উঠে যাচ্ছিল আর সেই মুহূর্তে কোনও পথচারী যতটা সম্ভব দেখে নিচ্ছিল রূপসার মসৃণ পা দুটিকে। এসব দৃষ্টিগুলোয় গা ঘিনঘিন করে না রূপসার। বরং মজা লাগে। নিজেকে আরও সুন্দর করে সাজাতে ইচ্ছে করে।

মিনিট পনেরো দ্রুত সাইকেল চালিয়ে পদ্মকাকিমার বাড়িতে যখন পৌঁছল ততক্ষণে ঘেমে-নেয়ে অস্থির। কপালে, গলায়, কাঁধে ঘাম ঝিলিক দিচ্ছে।

কাকিমা বলল, আহারে ঘেমে একেবারে স্নান করে গিয়েছিস! একটু জিরো। একগ্লাস জল আর বাটিতে দুটো নাড়ু এনে রাখল রূপসার সামনে। রূপসার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। ঢকঢক করে জল খেয়ে টের পেল ক্ষিদেও পেয়েছে বেশ। ওর ক্ষিদে বরাবরই বেশি। এত ক্ষিদে কেন কে জানে। নাড়ু দুটো টপাটপ মুখে পুরে খেয়ে আবার একগ্লাস জল খেল।

খুব খিদে পেয়েছে না রে? জিজ্ঞাসা করল কাকিমা।

রূপসা উত্তর না দিয়ে শুধু হাসল।

দাঁড়া, দুটো মুড়ি দিই তোকে।

পদ্মকাকিমার বর মানে অসীমকাকা রেলক্যান্টিনে কাজ করে। কাজ করে মানে ক্যান্টিনটাই ওর। রেলের সঙ্গে কন্ট্রাক্টে কাজ। ভালোই পয়সা রোজগার করে। গোলগাল অসীমকাকু বেশ ভালো মানুষ। রোজ বাড়ি ফিরতে পারে না। শুক্রবার রাতে বাড়ি এসে শনি-রবিবার থেকে আবার সোমবার ভোরে বেরিয়ে যায়। ওদের একমাত্র ছেলে দীপু পড়াশোনায় বেশ ভালো। মাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্ট করেছে।  সায়েন্স নিয়ে ইলেভেনে ভর্তি হয়েছে মাদারিহাট হাই স্কুলে। স্বভাব লাজুক দীপুদা সাত কথায় একবার উত্তর দেয়। লোকের সঙ্গে কথা বলতেও যেন ওর কষ্ট। খুব মজা লাগে রূপসার।

বারান্দায় বসে কথা বলছিল দুজনে। ঘরের ভেতর থেকে দীপুদার গুনগুন শব্দ আসছে। পড়া মুখস্থর। একটা ছেলে সারাক্ষণ কী করে বই পড়তে পারে সেটা ভেবেই গায়ে জ্বর আসে রূপসার।

কাকিমা এক বাটি মুড়ি নিয়ে এল। নে খা। রূপসা দেখল সর্ষের তেল আর চানাচুর মাখা মুড়ি। বড় লোভনীয় খাবার। চকাম চকাম শব্দে খেতে শুরু করল। রাক্ষুসে ক্ষিদে।

অনেক কথা হল কাকিমার সঙ্গে। সব খোঁজখবর নিল। পড়াশোনা যেন বন্ধ না করে, যা দরকার পড়ে নিজের মা ভেবে যেন কাকিমাকে বলে ইত্যাদি আরও অনেক কিছু বলল পদ্ম।

মুড়ি শেষ করে ফাঁকা বাটিটা যখন দাওয়াতে রাখল ততক্ষণে শেষ বিকেল। যেতে যেতেই সন্ধে নেমে যাবে।

আমি আসি, কাকিমা।

তোর দেরি হয়ে গেল। একা যাবি এতটা রাস্তা?

ও কিছু হবে না। বলল রূপসা।

এখান থেকে রূপসার বাড়ি যেতে মাঝে বেশ অনেকটা রাস্তা নির্জন। রাস্তার ধারে কয়েকটা বট-অশ্বত্থ গাছ ছাড়া আর কিছু নেই। কাকিমার কাছ থেকে আচারের দাম নিয়ে সেটাকে বুকের বাঁদিকে গুঁজে নিল।

ওখানে রাখলে পড়ে যাবে না তো?

নাহ, পড়বে না।

শোন…বলে একটু থামল কাকিমা। রূপসার চেহারার দিকে এক ঝলক চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, তুই এইভাবে টাকা রাখিস না, ফ্রকের ভেতরে কী পরিস?

রূপসা বলল, টেপজামা পরি তো।

টেপজামার ভেতর দিয়ে গলে গেলে?

গলবে না। জামাটা ভেতরে প্যান্টের মধ্যে গোঁজা, বলে ফিক করে হাসল রূপসা।

না, তুই আর টেপজামা পরিস না, বলে একটু ভেবে বলল, দাঁড়া। ঘরের ভেতরে গিয়ে আবার মিনিট কয়েক পর কাকিমা একটা প্যাকেট নিয়ে এসে নিচু গলায় বলল, এখানে আমার কয়েকটা পুরোনো ব্রেসিয়ার রয়েছে। তোর সাইজে হবে না হয়তো। আবার হতেও পারে। দেখিস তো পরে। সাইজে বড় হলে ফেলে দিস আর আমার কাছে এসে বলিস। আমি দোকানে নিয়ে যাব তোকে। নে, ব্যাগে ভরে নে। আর একা যাস না। আমি দীপুকে বলছি ও তোকে খানিকটা এগিয়ে দেবে।

প্যাকেটটা হাতে নিয়ে কেমন গা সিরসির করে উঠল রূপসার। ব্রেসিয়ার! হ্যাঁ, ব্রেসিয়ার জিনিসটা খুব ভালো করেই জানে রূপসা। এটাও বোঝে যে ফ্রকের আড়ালে থাকা ওর স্তনদুটি বন্ধুদের তুলনায় অনেক বেশি পরিণত, পুরুষ্টু। বন্ধুদের আলোচনায় এর মধ্যেই ওর জানা হয়ে গিয়েছে ব্রেসিয়ার পরার উপকারিতা। কিন্তু ক্লাসে কেউই এখনও ওটা পরা শুরু করেনি। স্কুলে ক্লাস এইট পর্যন্ত সাদা জামা আর সবুজ ফ্রক। ক্লাস নাইন থেকে শাড়ি। তখন ব্লাউজের ভেতরে সকলে ওই পরা শুরু করে। তবে ক্লাস নাইন পর্যন্ত আর পড়ার ইচ্ছে নেই রূপসার। ভালো লাগে না।

এই দীপু, তোর সাইকেলটা বার কর তো। রুপুকে একটু এগিয়ে দে। বলে আকাশের দিকে তাকিয়ে কাকিমা বলল, আকাশের অবস্থাও ভালো নয়। তাড়াতাড়ি যা।

দীপু বেরোল ঘরের ভেতর থেকে। একবার তাকাল রূপসার দিকে। পড়া ছেড়ে উঠতে হয়েছে বলে চোখেমুখে সেই বিরক্তি স্পষ্ট। দেখে বেজায় রাগ হয়ে গেল রূপসার। পদ্মকে বলল, থাক না কাকিমা, দীপুদা পড়ছে। আমি ঠিক চলে যাব।

ও তো সারাক্ষণই পড়ছে। একটু সময় নষ্ট হলে এমন কিছু হবে না। যা দেরি করিস না।

দীপু বাধ্য ছেলের মতো বারান্দা থেকে নিজের রেসিং সাইকেলটা নামিয়ে নিয়ে রূপসাকে বলল, চল তাড়াতাড়ি।

দুজনে পাশাপাশি সাইকেল চালাতে থাকল। কারও মুখেই কথা নেই। দীপু নিজের বাকি পড়ার কথা ভাবতে চাইছিল কিন্তু ওর অবাধ্য চোখ বার বার চলে যাচ্ছিল হাওয়াতে ফ্রক উঠে গিয়ে রূপসার পা-দুটোর দিকে। হাঁটু পর্যন্ত ফ্রক হাওয়ায় এক এক সময় থাই পর্যন্ত উঠে যাচ্ছিল আর দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল দীপুর। নির্লোম, মসৃণ থাই দুটো দীপুকে অস্থির করে তুলছিল। রূপসা শুধু মনে মনে ভাবছিল বাড়ি ফিরে আগে টাকাগুলো যত্নে গুছিয়ে রাখতে হবে। দাদার নজরে যেন না পড়ে, তারপর কাকিমার দেওয়া ব্রেসিয়ারগুলো পরে দেখতে হবে। জীবনে কোনওদিন পরেনি, আদৌ পারবে তো পরতে? কেমন দেখতে লাগবে পরার পর? আয়নার সামনে নিজেকে কল্পনা করতে করতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল রূপসা। হঠাৎই দমকা হাওয়া দিল একটা, আর সঙ্গে সঙ্গে ধুলোর ঝড়। সাইকেল থামিয়ে ফেলতে হল দুজনকেই। এত ধুলো যে চোখ মেলে রাখা যাচ্ছে না। ঝড় চলতে চলতেই গায়ে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি এসে পড়ল। এই সর্বনাশ! এখন যেখানে রয়েছে না যাবে এগোনো না যাবে ফেরা। কী করা যায় ভাবতে ভাবতেই মুষলধারে বৃষ্টি নেমে এল। কড় কড় করে ডেকে উঠল মেঘ।

রূপসা দীপুর দিকে তাকিয়ে বলল, কী হবে এখন?

দুত্তেরি ভাল্লাগে না, আর কী হবে? ওই বটগাছটার নীচে এখন চল দাঁড়াই গিয়ে।

রাস্তার একপাশে অদূরেই একটা মস্ত বটগাছ তার দীর্ঘ ডালপালা ছাতার মতো ছড়িয়ে যেন ওদের দুইজনের জন্যই অপেক্ষারত।

হুড়মুড় করে দুজনেই ওই গাছের নীচে গিয়ে দাঁড়াল। ততক্ষণে দুজনেই অনেকটা ভিজে গিয়েছে।

ইস! পুরো ভিজে গেছিস তো তুই!

তুমিও তো তাই। হেসে ফেলে বলল রূপসা।

দীপুর গালে কচি দুবেবাঘাসের মতো দাড়ি-গোঁফে জলকণা লেগে। একমাথা ঘন চুলও জলে ভেজা। গায়ের জামা আর সাদা পায়জামাটা ভিজে গায়ে সেঁটে রয়েছে।

প্রবল বৃষ্টি আর তেমনই হাওয়া ওদের বার বার ভিজিয়ে দিতে চাইল। বটগাছ চাইছিল যতটা সম্ভব আড়াল দিতে। নিজেদের বাঁচাতে বাঁচাতে প্রায় দুজনে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে গাছের কোটরের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল, হঠাৎ দীপু বলে উঠল, গাছের কোটরে যদি সাপ থাকে।

সাপের কথা শুনতেই ‘ও মা’ বলে দীপুর বুকের কাছটা খামচে ধরল রূপসা। ওর গরম নিঃশ্বাস পড়ল দীপুর বুকে। খুব শীত করে উঠল দীপুর। আবার তাকাল রূপসার দিকে। ওর ফুলছাপ ফ্রকটা শরীরে লেপ্টে রয়েছে। কিশোরী বুকের স্তনবৃন্ত দুটি ফ্রক, টেপ-জামার আবরণ ভেদ করে স্পষ্টভাবে জেগে উঠেছে জলস্পর্শে, নাভির গভীরতাও সুস্পষ্ট। দীপুর কেমন যেন করতে থাকল। রূপসাও অস্থির হয়ে যাচ্ছিল। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল সব। দীপুদার সাদা পায়জামা লেপটে গিয়ে ফর্সা সুগঠিত রোমশ পা দুটো কী সুন্দর লাগছে!

দীপু কী করবে বুঝতে না পেরে রূপসার ভিজে কাঁধে একবার হাত রাখল। রূপসাও যেন শুধু এই ইঙ্গিতটুকুরই অপেক্ষায় ছিল। দুই হাতে দীপুর মাথাটাকে ধরে নিজের মুখের সামনে নিয়ে এল। প্রবল বৃষ্টিতে বটগাছের দুটি ঝুরির মতোই একে অপরকে জড়িয়ে থাকল দুজনে। জীবনের প্রথম অনভ্যস্ত চুম্বনে মিশল বৃষ্টির ফোঁটা। দুটি হূদয়ের শব্দ মেঘের ডাককেও ম্লান করে দিচ্ছিল। রূপসা আলিঙ্গনরত অবস্থাতেই বুঝতে পারল পায়জামার আড়ালে দীপুদা প্রবলভাবে জেগে উঠেছে। দীপু যেন উন্মত্ত হয়ে উঠল। রূপসার মুখে, ঘাড়ে এলোপাথাড়ি চুমু খেতে খেতে ওকে আরও সজোরে নিজের মধ্যে চেপে ধরছিল। মাতাল হয়ে উঠছিল রূপসাও। আহ! এত সুখ…এত সুখ জীবনে পায়নি কখনও… দীপুর অস্থির হাতদুটো ফ্রকের ওপর দিয়ে আছাড়িপিছাড়ি খাচ্ছিল আর শিউরে শিউরে উঠছিল রূপসা। হঠাৎই বুঝতে পারল দীপু ওর ফ্রকের ভেতরে হাত ঢোকানোর চেষ্টা করছে। গায়ের জোরে হাত ঢোকাতে গিয়ে পুরোনো ফ্রকের কিছুটা ফেঁসে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দুই-পা সরে এল রূপসা। কেন সরে এল নিজেও জানে না। রূপসা সরে যেতে দীপুও থতমত খেয়ে গেল। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল রূপসার দিকে। তারপর বাকি বৃষ্টির সময়টুকু দুজনেই একে অপরের থেকে খানিক দূরত্বে দাঁড়িয়ে রইল।

রূপসার আবার তীব্র ইচ্ছে হচ্ছিল দীপুদার শরীরের মধ্যে নিজেকে পিষে দিতে কিন্তু ভেতর থেকে কে যেন বার বার ওকে আটকে দিচ্ছিল, কিছুতেই আর পারল না কাছে যেতে।

বৃষ্টির তোড় একটু কমতে দীপুকে রূপসা বলল, তুমি চলে যাও দীপুদা, বাকিটুকু আমি চলে যেতে পারব।

দীপু কিছু না বলে শুধু তাকাল রূপসার দিকে। সেই চোখে কিছুক্ষণ আগের সেই আগুন, সেই মুগ্ধতা নেই, বরং ভয় জড়িয়ে রয়েছে। মায়া লাগল রূপসার।

দীপুর হাত ধরে আবার কাছে টেনে নিয়ে চুমু খেল। ঠোঁটে ঠোঁট, জিভে জিভ ঠেকল। কিন্তু এবার যেন দীপু নিভে গিয়েছে। শুধু বলল, তোর জামাটা ছিঁড়ে দিলাম।

ভয় পেও না, দীপুদা, আমি কাউকে কিছু বলব না। কথাটা কেন বলল রূপসা কে জানে।

দীপু আবার তাকাল, চোখ থেকে সেই ভয়টা যায়নি। ধীরে ধীরে গাছের কাছ থেকে নেমে নিজের সাইকেলের দিকে গেল। তারপর সিটে বসে নিজের বাড়ির দিকে প্যাডেল চালাল। রূপসার দিকে একবারও ফিরে তাকাল না। বৃষ্টি পড়ছিল তখনও। রূপসা ভিজছিল, বাইরে, অন্তরে…

আচমকাই শাওয়ারটা বন্ধ করে দিল রূপসা। আহ! এতদিন পর আবার কেন? কেন যে বৃষ্টি হলেই এতকাল পরেও সেই স্মৃতি এসে মনে ঘা দেয়। অস্থির করে তোলে। সেই পুরোনো রূপসা তো আর সে নেই, কবে বদলে গিয়েছে। কেউ তাকে জোর করে বদলায়নি, স্বেচ্ছায় নিজেকে বদলেছে রূপসা। অন্তত নিজে তাই মনে করে। খরগোশের শরীরের মতো নরম আর সাদা তোয়ালে দিয়ে নিজেকে যত্ন করে মুছে টয়লেট থেকে নিজের ঘরে এল। তারপর ব্যাগ থেকে পছন্দসই একসেট নীল সালোয়ার বার করে পরে নিল। চুল ভালো করে ঝেড়ে খোঁপা পাকাতে গিয়ে শুনতে পেল গরে ভেতরে সিলিঙে একটা ছোট পিতলের ঘণ্টা টুং করে বেজে উঠল। তারপর দরজায় মৃদু করাঘাত।

রূপসা গিয়ে দরজা খুলল। সামনে একটি লোক দাঁড়িয়ে। খালি গা, মাথায় রঙিন পাগড়ি, রঙিন ধুতি। কানে মাকড়ি, দুই হাতে বালা। একহাতে একটি থালা লাল কাপড়ে ঢাকা।

আপনার খাবার এনেছি।

ওহ হ্যাঁ, আসুন আসুন। দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল রূপসা।

খাবারের থালাটা টেবিলের ওপর রেখে লোকটি বলল, আপনার খাওয়া শেষ হয়ে গেলে, জানাবেন, আমি নিয়ে যাব।

আচ্ছা, অনেক ধন্যবাদ। বলল রূপসা। উত্তর পেল, স্বাগতম। লোকটি দুই হাত জড়ো করে রূপসাকে প্রণাম জানিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেল। রূপসার বেজায় হাসি পেল। মনে হল ও যেন এখানে কোনও নাটক দেখতে এসেছে। সকলে মিলে কোনও ঐতিহাসিক পালা করছে। বেশভূষা, কথাবার্তা সবই খুব মাপা। হয়তো এটাই নিয়ম।

যাক গে, খেতে বসা যাক। থালার ওপর থেকে লাল কাপড়টা সরিয়ে দিল রূপসা। মস্ত একটা থালা। সম্ভবত জার্মান সিলভারের। থালার মাঝখানে ছোট সুন্দর একটি ওলটানো বাটির মাপে ভাত, সাদা ধপধপে, লম্বা চালের ভাত। আর কম করে ছয়-সাতটা বাটি। তাতে হরেকরকম তরকারি, মাছ, মাংস সবই রয়েছে। চমৎকার গন্ধ বেরোচ্ছে। ক্ষিদেটাও পেয়েছে জাঁকিয়ে। খেতে বসে রূপসা বুঝল ওর মন ভারী হয়ে উঠেছে। শালা এতগুলো বছর পেরিয়ে গেল তবু বৃষ্টিতে ভিজলেই সেই কত বছর আগের বৃষ্টিভেজা দিনটার কথা মনে পড়ে! আর তারপরেই অনিবার্যভাবে মনে পরে তারপরের দিনের দুপুরের কথাটা! রূপসা মনে করতে চায় না। তবু পড়ে। দীপু পরের দিন দুপুরে আচমকাই এসেছিল রূপসার বাড়িতে। তখন ভাত খেতে বসেছিল রূপসা। বাড়িতে কেউ ছিল না।

দীপুদা তুমি! গত সন্ধে থেকে সারা রাত কাটিয়ে পরদিন দুপুর পর্যন্ত যে অপূর্ব এক ভালোলাগায় ভরেছিল রূপসা তা দীপুকে দেখামাত্র যেন কোটিগুণ বেড়ে গিয়েছিল। ওর মন বলছিল, হ্যাঁ, দীপুদা আসবে, আবার আসবেই ওর কাছে। আন্দাজ মিলে গিয়েছিল।

খাওয়া ছেড়ে উঠে আসতে গিয়েছিল রূপসা।

দীপু বাধা দিয়েছিল, না না, তুই খেয়ে নে। আমি অপেক্ষা করছি।

রূপসা গোগ্রাসে ভাতটুকু খেয়ে হাত ধুয়ে দীপুর সামনে এসে একগাল হেসে বলেছিল, হ্যাঁ দীপুদা, বলো।

বলছি যে…ইতস্তত করছিল দীপু। রূপসার দিকে ভালো করে তাকাতেও পারছিল না।

আমি জানতাম তুমি আসবে। বলে ফেলেছিল রূপসা।

রুপু, তুই প্লিজ কাউকে কিছু বলিস না, কেউ জানতে পারলে আমি মরে যাব।

থমকে গিয়েছিল রূপসা। কথাগুলো কেমন অদ্ভুত শুনতে লাগছিল।

এ মা কাকে বলব! কেন বলব?

তুই এটা রাখ, বলে প্যান্টের পকেট থেকে ভাঁজ করা দুটো দশ টাকার নোট রূপসার হাতে গুঁজে দিয়েছিল দীপু।

এটা কী? টাকা কেন দিচ্ছ?

তুই রাখ। প্লিজ কাউকে বলিস না রুপু। যা খুশি করিস এটা নিয়ে। বলবি না তো কাউকে কালকের কথা!

রূপসার বুকের ভেতরে তখন নদীর পাড় ভেঙে পড়ার মতো শব্দ হচ্ছিল ক্রমাগত।

খুব শান্তভাবে বলেছিল, আমি কাউকে বলব না, দীপুদা। তার জন্য আমার টাকা লাগবে না, নিয়ে যাও টাকা। বলে মুঠিতে ধরা টাকাটা ছুঁড়ে মেরেছিল দীপুর দিকে। দলাপাকানো কাগজ দীপুর বুকে ঠোক্কর খেয়ে মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল। দীপু তোলেনি, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। তীব্র কান্না পাচ্ছিল রূপসার, কিন্তু কান্না আসছিল না। বরং অসহ্য একটা জ্বালা শরীরময় ছোটাছুটি করছিল। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল খুব। বিছানায় শুয়ে পড়েছিল। আর ঠিক মিনিট কয়েক পরেই ঘরে ঢুকেছিল বিলু। প্রথমেই মেঝেতে পড়ে থাকা দোমড়ানো নোটদুটোকে নিজের পকেটে ভরে নিয়ে রূপসার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, পদ্মকাকিমার ছেলেটা এসেছিল নাকি রে?

হুঁ।

কেন?

আচারের টাকা দিতে।

শুধু টাকা দিতে?

তা’লে ওকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করো কেন এসেছিল, ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল রূপসা।

বোনকে আচমকা এমন জ্বলে উঠতে দেখে ভুরু কুঁচকে উঠেছিল বিলুর। ঠোঁট সরু করে ভুরু নাচিয়ে বলেছিল, এই মাটিতে যে টাকাটা পড়েছিল ওটা?

হুঁ।

এমন ছুঁড়ে দিয়ে গেল?

কেন, তোর কিছু বলার আছে? ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল রূপসা।

বিলু ঠোঁট চেটে চোখ ছোট করে বিশ্রী হেসেছিল, তারপর রূপসাকে বলেছিল, টাকাটা আমি লোন হিসেবে নিলাম। দুইদিনের মধ্যে দিয়ে দেব।

উত্তর দেয়নি রূপসা। ভেবেছিল আর জীবনে কোনওদিন পদ্মকাকিমার বাড়িতে যাবে না। কিন্তু তারপরেও যেতে হয়েছিল, কারণ একটাই।