মাতঙ্গিনী পুনর্ব্বার নিঃশব্দে পদসঞ্চারে শয্যা ত্যাগ করিয়া গবাক্ষসান্নিধ্যে গমন করিলেন; এবং নিম্নোদ্ধৃত মত কথোপকথন শ্রবণ করিলেন।
সকলেই নিদ্রিত, এ সংবাদ রাজমোহন প্রমুখাৎ শ্রবণ করিয়া আগন্তুক কহিল, “তুমি আমাদের এ উপকার করিতে তবে স্বীকার আছ?”
রাজমোহন কহিল, “বড় নহি-আমি কিন্তু তা বলিয়া ভালমানুষির বড়াই করিতেছি না; তবু নেমকহারামি; আমি লোকটাকে দু’চক্ষে দেখিতে পারি না বটে, কিন্তু আমার উপকার অনেক করিয়াছে।”
অপরিচিত ব্যক্তি কহিল, “উপকার করিয়াছে, তবে দেখিতে পার না কেন?”
রাজ। উপকার করেছে, কিন্তু মন্দও করেছে। আমার ভাল কর, কর, না কর-সে তোমার ইচ্ছা; কিন্তু আমায় যে দুঃখ দেয়, সে শত উপকার করিলেও তার মাপ নাই।
অপরিচিত। তবে আর নেমকহারামি কি? আমাদের কাজে লাগিবে?
রাজ। লাগি, যদি যা চাই, দাও। আমার ইচ্ছা এখানকার বাস উঠাই-ওর কাছে না থাকিতে হয়। কিন্তু যাই কি নিয়ে-হাত খালি; দেশে গেলে বাঁচি কি মরি। তাই আমি এমন এক হাত মারিতে চাই যে, সেই টাকায় অন্যত্র আমার কিছুকাল গুজরাণ হয়। যদি তোমাদের এ কর্ম্মে এমন হাত মারিতে পারি, তা হলে লাগিব না কেন? লাগিব।
অপ। আচ্ছা, কি নেবে বল?
রাজ। তুমি আগে বল দেখি আমায় কি করিতে হইবে?
অপ। যাহা বরাবর করেছ তাহাই করিবে; মাল বই করিয়া দিবে। এইবার মনে করিতেছি যে, নগদ ছাড়া যা কিছু পাইব তা তোমার কাছে রেখে যাব।
রাজ। বুঝেছি, আমি নইলে তোমার কাজ চলিবে না। তোমরা বেশ বুঝেছ যে, এত বড় বাড়ীতে একটা কর্ম্ম হইলে এ দিকেও বড় গোলযোগ হইয়া উঠিবে; রাঁড়ী বালতির বাড়ী নয় যে, দারোগা বাবু কিছু প্রণামী লইয়া স্বচ্ছন্দে দেখনহাসির বাড়ীতে বসিয়া ইয়ারকি মারিবে। একটা তল্লাস তাগাদার বড় রকম সকমই হইয়া উঠিবে; তাহা হইলে সোণা কোলে করিয়া বসিয়া থাকিলে ত হইবে না। তাই তোমরা চাও যে, যত দিন না লেঠাটা মিটে তত দিন আমার কাছে সব থাকে। তা বড় মন্দ মতলব নয়; আর আমারও এমত যুত বরাত আছে যে, কোন শালা খড়্কে গাছটিও টের পাবে না। বিশেষ আমি ভায়রা ভাই, আমাকে কোন্ শালা শেষ করবে? অতএব আমার দ্বারা যে কাজ হবে, আর কাহারও দ্বারা তেমনটি হবে না। কিন্তু আমার সঙ্গে বনিয়া উঠা ভার।
অপ। যদি ভাই এতই বুঝিতেছ, তবে কেন বনাইয়া লও না।
রাজ। আমি দশ কথা পাঁচ কথার মানুষ নই; প্রাণ চায় দাও-না হয়, আপনার কর্ম্ম আপনি কর,-সিকিভাগ চাই।
দস্যু। ভালরূপ জানিত যে, রাজমোহনের এ বিষয়ে কাজে কথায় এক, অপহৃত দ্রব্যের চতুর্থাংশের ন্যূন সে সহায়তা করিতে স্বীকার হইবে না; অতএব বাক্যব্যয় বৃথা। কিয়ৎক্ষণচিন্তা করিয়া কহিল, “আমি সম্মত হইলাম। তাদের একবার জিজ্ঞাসার আবশ্যক, তা তারা কিছু আমার মত ছাড়া হবে না।”
রাজমোহন উত্তর করিল, “তাতে সন্দেহ কি? কিন্তু আর একটা কথা আছে। যা আমার কাছে থাকিবে, তার আমরা একটা মোটামুটি দাম ধরিব; ইহারই সিকি তোমরা আমাকে নগদ দিয়া যাবে; তার পর মহাজনে কম দেয় আমি কম্তির সিকি ফেরত দিব, আর বেশী দেয় তোমরা আমাকে বেশীটা দেবে।”
দস্যু। তাই হবে; কিন্তু আমারও আর একটি কথা আছে। তোমাকে আর একটি কাজ করিতে হইবে।
রাজ। আর এক মুঠো টাকা।
দস্যু। তা ত বটেই। আমরা মাধব ঘোষের যথাসর্ব্বস্ব লুঠিব, সে কেবল আমাদের আপনাদেরই জন্য; কিন্তু পরের একটা কাজ আছে।
রাজমোহন কৌতূহলী হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কি কাজ?”
দস্যু। তাহার খুড়ার উইলখানা চাই।
রাজমোহন কিছু চমকিয়া কহিল, “হুঁ।”
দস্যু। কহিল, “হুঁ, কিন্তু উইলখানা কোথায় আছে আমরা তা জানি না। আমরা ত সমস্ত রাত্রি কেবল কাগজ উটকাইয়া বেড়াইতে পারব না। কোথায় আছে সে খবরটা তুমি অবশ্য জান।”
রাজ। জানি; কিন্তু কাহার জন্য উইল চাই?
দস্যু। তাহা কেন বলিব?
রাজ। কেন, আমাকেও বলিবে না?-আমার কাছে লুকাইবার আবশ্যক?
দস্যু। তোমাকেও বলিতে বারণ।
রাজ। মথুর ঘোষ?
দস্যু। যেই হউক-আমাদের বাদশার মুখ নিয়ে কাজ। যেই হউক, কিছু মজুরি দেবে, আমরা কাজ তুলে দেব।
রাজ। আমারও ঐ কথা।
দস্যু। উইল পাব কোথায়?
রাজ। আমায় কি দিবে বল?
দস্যু। তুমি বল না।
রাজ। পাঁচ শত খানি দিও; তোমরা পাবে ঢের, দিলেই বা।
দস্যু। এটা বড় জিয়াদা হইতেছে; আমরা মোটে দুই হাজার দক্ষিণা পাইব, তার মধ্যে সিকি দিই কেমন করে।
রাজ। তোমাদের ইচ্ছা।
দস্যু। পুনর্ব্বার চিন্তা করিয়া কহিল, “আচ্ছা, তাই সই; আমার ঢের কাজ আছে, আমি কাগজ হাঁটকাইয়া বেড়াইলে চলিবে না। নয়ত কোনও ছোঁড়া ফোঁড়ার হাতে পড়িবে, আর পুড়াইয়া ফেলিবে-পাঁচ শতই দেব।”
রাজ। মাধবের শুইবার খাটের শিয়রে একটা নতুন দেরাজ-আলমারি আছে; তাহার সব নীচের দেরাজের ভিতর একটা বিলিতী টিনের ছোট বাক্সতে উইল, কবালা, খত ইত্যাদি রাখিয়া থাকে; আমার গোপন খবর জানা আছে।
দস্যু। ভাল কথা; যদি এ লেঠা চুকিল, তবে চল জুটি গিয়া। কর্ম্ম হইয়া গেলে যেখানে আসিয়া তোমার সঙ্গে দেখা করিব, তাহা সকলে থেকে স্থির করা যাইবে। এস, আর দেরি করে কাজ নেই; চাঁদনি ডুবিলে কর্ম্ম হবে-এখনকার রাত ছোট।
এই কহিয়া উভয়ে ধীরে ধীরে গৃহের ছায়াবরণ হইতে বনের দিকে প্রস্থান করিল। মাতঙ্গিনী বিস্মিত ও ভীতি-বিহ্বলা হইয়া ভূতলে বসিয়া পড়িলেন।