এদিকে মাতঙ্গিনী স্বামীকৃত তিরস্কারের পর শ্বশ্রূস্বসা কর্ত্তৃক নিজ শয়নকক্ষে আনীত হইলে কক্ষের দ্বার অর্গলবব্ধ করিয়া মনের দুঃখে শয্যাবলম্বন করিলেন। রাত্রে পাকাদি সমাপন হইলে শ্বশ্রূস্বসা তাঁহাকে আহারার্থে ডাকিলেন, কিন্তু মাতঙ্গিনী শয্যাত্যাগ করিলেন না। ননন্দা কিশোরী আসিয়া পিতৃষ্বসার সংযোগে অনেক অনুনয় সাধনাদি করিলেন; কিন্তু তাহাতে কোন ফল হইল না। অবশেষে তাঁহারা নিরস্ত হইলেন-মাতঙ্গিনী অনশনা রহিলেন।
মাতঙ্গিনী শয্যায় শুইয়া আপন অদৃষ্টের বিষয় চিন্তা করিতে লাগিলেন। মাতঙ্গিনীর প্রতি রুষ্ট হইলে রাজমোহন প্রায় শয়নাগারে আসিত না, সুতরাং অদ্য রাত্রে যে আসিবে না, ইহা মাতঙ্গিনী উত্তমরূপে জানিতেন না।
ক্রমে রজনী গভীরা হইল। একে একে গৃহস্থ সকলে নিদ্রামগ্ন হইলেন। সর্ব্বত্র নীরব হইল। মাতঙ্গিনীর শয়নকক্ষে প্রদীপ ছিল না। গবাক্ষরন্ধ্রের আচ্ছাদনীয় পার্শ্ব হইতে চন্দ্রালোক আসিয়া কক্ষতলে পড়িয়াছিল; তদ্ধেতু কক্ষের অংশবিশেষ ঈষৎ আলোকিত হইয়াছিল। তদ্ব্যতীত সর্ব্বত্র অন্ধকার।
প্রকৃত অপরাধে অপমানের যন্ত্রণা সততই এত তীক্ষ্ণ যে, যতক্ষণ না তৎসম্বন্ধীয় বিষময়ী স্মৃতি বিলোপিত হয়, ততক্ষণ মানবদেহে নিদ্রা অনুভূত হইতে পারে না। গ্রীষ্মাতিশয্যপ্রযুক্ত বক্ষঃস্থল হইতে অঞ্চল পদতলে প্রক্ষিপ্ত করিয়া উপাধান-ন্যস্ত বাম ভুজোপরে শিরঃ সংস্থাপন করিয়া মাতঙ্গিনী অশ্রুপূর্ণ লোচনে গৃহতলশোভিনী চন্দ্রপদরেখা প্রতি দৃষ্টি করিতেছিলেন। কেন? সে অমৃত শীতল কিরণ দৃষ্টে কত যে পূর্ব্বসুখ স্মৃতিপথগামী হইল, তাহা কে বর্ণনা করিতে পারে? কৈশোরে কত দিন প্রদোষকালে হেমাঙ্গিনীর সহিত গৃহ-প্রাঙ্গনে এক-শয্যায় শায়িনী হইয়া শিশু-মনোরঞ্জিনী উপকথা কখন বা শ্রবন করিতে করিতে নীলাম্বরবিহারী এই নিশানাথ প্রতি চাহিয়া থাকিতেন, তাহা মনে পড়িল। নীলাম্বর হইতে এই মৃদুল জ্যোতিঃ বর্ষিত হইয়া কত যে হৃদয়-তৃপ্তি জন্মাইত, এ বৃন্তোৎপন্ন কুসুমযুগলবৎ কণ্ঠলগ্না দুই সহোদরা তখন কত যে আন্তরিক সুখে উচ্চহাস্য হাসিতেন, তাহা স্মরণপথে লাগিল।
সেই এক দশা আর এই এক দশা। সে উচ্চহাস্য আর কাহার কণ্ঠে? সেই সকল প্রিয়জনই বা কোথায়? আর কি তাঁহাদের মুখ দেখিতে পাইবেন? আর কি তাঁহাদের সেই স্নেহপূর্ণ সম্বোধন কর্ণকুহরে সুধাবর্ষণ করিবে? মনঃপীড়াপ্রদান-পটু স্বামীর হস্তজ্বালিত কালাগ্নি অন্তর্দাহ ব্যতীত আর কিছু কি অদৃষ্টে আছে?
এই সকল দুঃখ চিন্তার মধ্যে একটি গূঢ় বৃত্তান্ত জাগিতেছিল। সে চিন্তা অনুতাপময়ী হইয়াও পরম সুখকরী। মাতঙ্গিনী এ চিন্তাকে হৃদয়-বহিষ্কৃত করিতে যত্ন করিলেন, কিন্তু পারিলেন না। এই গূঢ় ব্যাপার কি তাহা কনক ব্যতীত আর কেহ জানিত না।
দুঃখ-সাগর মনোমধ্যে মন্থন করিয়া তৎস্মৃতিলাভে মাতঙ্গিনী কখন মনে করিতেন, রত্ন পাইলাম; কখন বা ভাবিতেন, হলাহল উঠিল। রত্নই হউক, আর গরলই হউক, মাতঙ্গিনী ভাবিয়া দেখিলেন, তাঁহার কপালে কোন সুখই ঘটিতে পারে না। চক্ষুর্দ্বয় বারিপ্লাবিত হইল।
ক্রমে গ্রীষ্মাতিশয্য দুঃসহ হইয়া উঠিল; মাতঙ্গিনী গবাক্ষ-রন্ধ্র মুক্ত করিবার অভিপ্রায়ে শয্যা ত্যাগ করিয়া তদভিমুখে গমন করিলেন। মুক্ত করেন, এমত সময়ে যেন কেহ শনৈঃ পদসঞ্চারে সেই দিকে অতি সাবধানে আসিতেছিল-এমত লঘু শব্দ তাঁহার কর্ণপ্রবিষ্ট হইল।
জানেলাটি যেমন সচরাচর এরূপ গৃহে ক্ষুদ্র হয়, তদ্রূপই ছিল,-দুই হস্ত মাত্র দৈর্ঘ্য, সার্দ্ধেএক হস্ত মাত্র বিস্তার। এ প্রদেশে চালাঘরে মৃত্তিকার প্রাচীর থাকে না, দরমার বেষ্টনীই সর্ব্বত্র প্রথা। রাজমোহনের গৃহেও সেইরূপ ছিল; এবং জানালার ঝাঁপ ব্যতীত কাষ্ঠের আবরণী ছিল ন।
পার্শ্বে যে ছিদ্র দিয়া গৃহমধ্যে জ্যোৎস্না প্রবেশ করিয়াছিল, পদসঞ্চার শ্রবণে ভীতা হইয়া মাতঙ্গিনী সেই ছিদ্র বহির্দ্দিকে দৃষ্টিপাত করিতে যত্ন করিলেন, কিন্তু নীলাম্বরস্পর্শী বৃক্ষশ্রেণীর শিরোভাগ ব্যতীত আর কিছুই দেখিতে পাইলেন না।
মাতঙ্গিনী জানিতেন, যে দিক্ হইতে পদসঞ্চার শব্দ তাঁহার কর্ণাগত হইল, সে দিক্ দিয়া মনুষ্য যাতায়াতের কোন পথ নাই; সুতরাং আশঙ্কা জন্মান বিচিত্র কি? মাতঙ্গিনী নিস্পন্দ শরীরে কর্ণোত্তলন করিয়া তথায় দণ্ডায়মান রহিলেন।
ক্রমশঃ পদক্ষেপণ শব্দ আরও নিকটাগত হইল; পরক্ষণেই দুই জন কর্ণে কর্ণে কথোপকথন করিতেছে শুনিতে পাইলেন। দুই-চারি কথায় মাতঙ্গিনী নিজ স্বামীর কণ্ঠস্বর চিনিতে পারিলেন। তাঁহার ত্রাস ও কৌতূহল দুই-ই সম্বর্দ্ধিত হইল। যথায় মাতঙ্গিনী গৃহমধ্যে দণ্ডায়মানা ছিলেন, আর যথায় আগন্তুক ব্যক্তিরা বিরলে কথোপকথন করিতেছিল, তন্মধ্যে দরমার বেষ্টনীমাত্র ব্যবধান ছিল। সুতরাং মাতঙ্গিনী তৎকথোপকথনের অনেক শুনিতে পাইলেন; আর যাহা শুনিতে পাইলেন না, তাহার মর্ম্মার্থ অনুভবে বুঝিতে পারিলেন।
এক ব্যক্তি কহিতেছিল, “অত বড় বড় করিয়া কথা কহ কেন? তোমার বাড়ীর লোকে যে শুনিতে পাইবে।”
দ্বিতীয় ব্যক্তি উত্তর করিল, “এত রাত্রে কে জাগিয়া থাকিবে?”
মাতঙ্গিনী কণ্ঠস্বরে বুঝিলেন, এ কথা রাজমোহন কহিল।
প্রথম বক্তা কহিল, “কি জানি যদি কেহ জাগিয়া থাকে, আমাদের একটু সরিয়া দাঁড়াইলে ভাল হয়।”
রাজমোহন উত্তর করিল, “বেশ আছি; যদি কেহ জাগিয়াই থাকে, তবে এ ছেঁচের ছায়ার মধ্যে কেহ আমাদিগকে ঠাওর পাইবে না, বরং সরিয়া দাঁড়াইলে দেখিতে পাবে।”
প্রথম বক্তা জিজ্ঞাসা করিল, “এ ঘরে কে থাকে?”
দ্বিতীয় বক্তা রাজমোহন উত্তর করিল, “সে কথায় দরকার কি?”
প্র ব। বলিতেই বা ক্ষতি কি?
দ্বি ব। এ আমার ঘর, আমার স্ত্রী ভিন্ন আর কেহ থাকেন না।
প্র ব। তুমি ঠিক জান ত, তোমার স্ত্রী ঘুমাইয়াছে?
দ্বি ব। বোধ করি ঘুমাইয়াছে, কিন্তু সেটা ভাল করিয়া জানিয়া আসিতেছি, তুমি এখানে ক্ষণেক দাঁড়াও।
মাতঙ্গিনী পুনরায় পদক্ষেপণ শব্দ শুনিতে পাইলেন; বুঝিলেন, রাজমোহন বাটীর ভিতর আসিতেছে। মাতঙ্গিনী নিঃশব্দে গবাক্ষ সন্নিধান হইতে সরিয়া শয্যায় আসিলেন; এবং এমত সাবধানে তদুপরি আরোহণ করিলেন যে, কিঞ্চিন্মাত্র পদশব্দ হইল না। তথায় নিমীলিত নেত্রে শয়ন করিয়া একান্ত নিদ্রাভিভূতার ন্যায় রহিলেন।
রাজমোহন আসিয়া দ্বারে মৃদু মৃদু করাঘাত করিল। পত্নী আসিয়া দারোদ্ঘাটন করিল না। তখন রাজমোহন মৃদুস্বরে মাতঙ্গিনীকে ডাকিতে লাগিল; তথাপি দ্বারোন্মোচিত হইল না। রাজমোহন বিবেচনা করিল, মাতঙ্গিনী নিদ্রিতা। তথাপি কি জানি এমনই হয় যে, মাতঙ্গিনী সন্ধ্যাকালে ব্যাপারে অভিমানিনী হইয়া নীরব আছেন, এই সন্দেহে রাজমোহন কৌশলে কক্ষাভ্যন্তরে প্রবেশ করিতে যত্ন করিল। পাকাশালায় গমন করিয়া তথাকার প্রদীপ জ্বালিয়া আনিল; দ্বারের নিকটে প্রদীপ রাখিয়া এক হস্তে একখানা কপাট টানিয়া রাখিয়া এক পদে দ্বিতীয় কবাট ঠেলিয়া ধরিল,-এইরূপে দুই কবাটমধ্যে অঙ্গুলিপ্রবেশের সম্ভাবনা হইলে, দ্বিতীয় হস্তের অঙ্গুলি দ্বারা পরীক্ষা করিয়া দেখিল যে, মাতঙ্গিনী, রাজমোহন স্বেচ্ছাকৃত শয়নাগারে প্রবেশ করিতে পারে, এই অভিপ্রায় কেবলমাত্র কাষ্ঠের “খিল” দিয়া দ্বার বন্ধ করিয়াছিলেন। রাজমোহন অনায়াসে “খিল” বাহির হইতে উদ্ঘাটিত করিল, এবং প্রদীপহস্তে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিল।
রাজমোহন দেখিল যে, মাতঙ্গিনীর মুখকান্তি যথার্থ সুষুপ্তি-সুস্থিরের ন্যায় রহিয়াছে। বার কয়েক তাঁহাকে ডাকিল; কোন উত্তর পাইল না। যদি পত্নী অভিমানে নিরুত্তরা থাকে তবে অভিমান ভঞ্জনার্থ দুই চারিটা মিষ্ট কথা কহিল; তথাপি মাতঙ্গিনী নিঃশব্দ রহিয়াছেন, ও ঘন ঘন গভীর শ্বাস বহিতেছে দেখিয়া মনে নিশ্চিত বিবেচনা করিল, মাতঙ্গিনী নিদ্রিতা। সে নিদ্রার ছল করিবে কেন? অতঃপর নিঃসন্দিগ্ধমনে পূর্ব্ব কৌশলে দ্বার বন্ধ করিয়া অন্য কক্ষদ্বারে গমন করিলে দ্বারে দ্বারে সকলকে মৃদুস্বরে ডাকিল, কেহই উত্তর দিল না; সুতরাং সকলেই নিদ্রামগ্ন বিবেচনায় রাজমোহন প্রদীপ নির্ব্বাপিত করিয়া আগন্তুক ব্যক্তির নিকট গমন করিল।