» » ফেরোমন

বর্ণাকার

অজেয় রায়

ফেরোমন

আট

অঘোরে ঘুমোচ্ছিলাম। হঠাৎ শুনলাম মামাবাবুর কণ্ঠস্বর, সুনন্দ, অসিত। ওঠো, ওঠো।

ধড়মড় করে উঠে বসলাম–কী ব্যাপার?

কেমন শব্দ হচ্ছে শুনতে পাচ্ছ? মামাবাবু বললেন।

গভীর রাত। বাইরে হালকা চাঁদের আলো, অগ্নিকুণ্ডের কাঠগুলো নিবুনিবু। তাঁবুর পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকালাম। কান পাতলাম। হ্যাঁ, কতগুলো অস্বাভাবিক শব্দ। খড়-খড়, মড়-মড়। বনের ভিতর কারা যেন ছুটোছুটি করছে। মাঝে মাঝে ভীত বাঁদরের কিচিমিচি। পাখির ডাক। শব্দগুলো যেন ক্রমশ এগিয়ে আসছে। কে বা কারা আসছে? কোন জানোয়ার? রহস্যময় আফ্রিকায় এ কোন্ অজ্ঞাত বিপদের পদধ্বনি? বন্দুক এগিয়ে রাখি। বিল নেই তাই অসহায় লাগছিল।

অগ্নিকুণ্ডের ক্ষীণ আলোয় দেখলাম, কয়েকটা মেঠো ইঁদুর লাফাতে লাফাতে পালাল। সঙ্গে সঙ্গে দুটো শেয়াল ও পরেই একটা হায়না দ্রুত তাঁবুর গা ঘেঁষে ছুটে গেল। এরা ভয় পেয়েছে। কিন্তু কেন?

মামাবাবু নিশ্চল। সর্ব ইন্দ্রিয় উন্মুখ। একদৃষ্টে বনের দিকে চেয়ে আছেন। সহসা তিনি টর্চ জ্বাললেন। কয়েক মুহূর্ত টর্চের জোরালো আলো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হল। তারপরই তিনি সভয়ে বললেন, ওই দেখো!

দেখলাম, অদুরে বনের প্রান্তের মাটির ওপর একটা চওড়া কালো দাগ। ও কি, দাগটা যে সচল। যেন প্রকাণ্ড এক আলকাতরার স্রোত বনের মধ্য থেকে বেরিয়ে ধীরে গড়িয়ে আসছে। স্রোতের মুখ অন্তত দশ গজ চওড়া, বস্তুটি যে কী বুঝতে পারছিলাম না।

মামাবাবু উত্তেজিতভাবে দ্রুত বলতে লাগলেন-আর্মি-অ্যান্ট। বুঝতে পারছ না? লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি পিঁপড়ের বাহিনী। ঠিক সৈন্যবাহিনীর মতো সারিবদ্ধভাবে মার্চ করে চলে। হিংস্র মাংসাশী ক্ষুধার্ত এই পিঁপড়েদের খপ্পড়ে পড়লে দুনিয়ার ছোট-বড় কোনো প্রাণীর নিস্তার নেই। সামনে যাকে পায় আক্রমণ করে। প্রাণভয়ে তাই সবাই পালায়। মনে হয় আন্তোনিও এই বাহিনীটাকেই গাছের গায়ে বিশ্রাম নিতে দেখেছিল। কিন্তু এরা এদিকে এল কেন? আশ্চর্য! এরা বনের ছায়া বা বড় ঘাসবনের মধ্য দিয়ে চলে। উন্মুক্ত প্রান্তর, শুকনো মাটি, পাথরের ওপর দিয়ে চলে না। দেখ দেখ, পিঁপড়ের ঝাক সোজা তাঁবুর দিকে এগিয়ে আসছে। চল পালাই, সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত!

তাঁবু ছেড়ে বেরোব, হঠাৎ মামাবাবু দাঁড়িয়ে পড়লেন। সুনন্দ, বাঁদর বাচ্চাটা কি দড়ি ছিঁড়ে পালিয়েছে?

না, দড়ি খুলে। অত শক্ত গেরো কী করে যে খুলল!

হুম! চল। বিলের পিস্তলটা সঙ্গে নাও! মামাবাবু অন্ধকারে চলতে শুরু করলেন। একবার জিজ্ঞেস করলাম–কোথায় যাচ্ছেন?

টেলরের তাঁবুতে। কথা বোলো না।

নিঃশব্দে আমরা টেলরের তাঁবুর কাছে এসে দাঁড়ালাম। দেখি অত রাতেও টেলর জেগে। তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। মামাবাবু যে কাণ্ড করলেন তাতে আমরা তে স্তম্ভিত। টেলরের পিছনে গিয়ে বন্দুক তাক করে বলে উঠলেন, কী শুনছেন মিস্টার টেলর?

টেলর বিদ্যুৎবেগে ফিরে দাঁড়াতেই মামাবাবু বললেন, “উঁহু, এগোবেন না, তাহলে গুলি করতে বাধ্য হব। সুনন্দ, তুমি একে পিস্তল নিয়ে পাহারা দাও। নড়লেই গুলি করবে। অসিত, খেয়াল রেখো–গোরো আছে কি না। আমি আসছি–

টেলর রাগে অগ্নিশর্মা। চিৎকার করে উঠলেন, আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে প্রোফেসর ঘোষ! মামাবাবু ভ্রূক্ষেপ না করে টেলরের তাঁবুর ভিতর ঢুকলেন।

একটুক্ষণ পরে বেরিয়ে এলেন। হাতে একটা বড় শিশি। মিস্টার টেলর, আর্মি-অ্যান্ট-এর ফেরোমন-এর শিশি এখানে কেন? আর শিশিটা খালি কেন?

তার জন্যে কি আপনাকে কৈফিয়ত দিতে হবে? আমাকে যেতে দিন। টেলর অপমানে ফুলছে।

যাদের পিঁপড়ে লেলিয়ে দিয়ে মারবার চেষ্টা করেছিলেন, তারা কৈফিয়ত দাবি করতে পারে বৈকি!

কী যা-তা বলছেন!

ঠিকই বলছি। বোগাস রকপেন্টিং দেখেই বুঝলাম আপনার কোনো মতলব আছে। তাঁবু থেকে কিছুক্ষণ আমাদের সরিয়ে রাখলেন। কোনো ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের আভাস পেলাম। তাই সতর্ক ছিলাম। যাক, আপনি এখন আমাদের বন্দী। ষড়যন্ত্রের কারণ কাল অনুসন্ধান করব। সুনন্দ ওর হাত বাঁধো।

টেলর জ্বলন্ত দৃষ্টিতে মামাবাবুকে দেখতে লাগলেন। কোনো কথা বললেন না।

বন্দী টেলর সমেত আমরা আমাদের তাঁবুর কাছে আশ্রয় নিলাম। টর্চের আলোয় দেখলাম, তাঁবু এবং তার চারপাশে থিকথিক করছে পিঁপড়ে। যেন কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে জায়গাটা।

মামাবাবুর নির্দেশে টেলরের পা-ও বাঁধলাম। বলা যায় না যদি দৌড়ে পালায়। তারপর ভোর হওয়ার প্রতীক্ষা করতে লাগলাম।

পুবের আকাশ সামান্য ফর্সা হবার সঙ্গে সঙ্গে পাখ-পাখালির কলতান শুরু হল। ঠিক তখুনি কানে এল আন্তোনিওর শিস। মেজাজে সুর ভাঁজতে ভাজতে আসছে। চেঁচিয়ে ডাকলাম, আন্তোনিও, মিস্টার হার্ডি, আমরা এখানে।

আমাদের ওই অবস্থায় দেখে বিল অবাক। কী ব্যাপার, টেলরকে বেঁধে রেখেছেন?

কারণ উনি আমাদের প্রাণনাশের চেষ্টা করেছিলেন!

কীভাবে?

পিঁপড়ে লেলিয়ে দিয়ে।

অ্যাঁ, পিঁপড়ে লেলিয়ে দিয়ে! লোকটা যাদুবিদ্যা জানে নাকি? বিস্ময়ে বিলের চোখ গোল হয়ে ওঠে। আন্তোনিও মাথা নেড়ে বলল, “হুঁ, উইচ-ক্রাফট। আমি শুনেছি। উপজাতীয় ওঝারা মন্ত্রের সাহায্যে সিংহ লেলিয়ে দিতে পারে।

না, জাদু নয়। অতি সূক্ষ্ম  বৈজ্ঞানিক কৌশল। এই শিশিটা দেখছেন, এর মধ্যে ফেরোমন ছিল। কৃত্রিম উপায়ে তৈরি। শিশির গায়ে লেখা রয়েছে আর্মি-অ্যান্ট। তার নিচে লেখা দেখুন–Trail Substance। আর্মি-অ্যান্ট অন্ধ। প্রত্যেক পিঁপড়ে চলার সময় পিছনের। দিকের একটি শুড়ের সাহায্যে মাটিতে একরকম ফেরোমন লাগাতে লাগাতে যায়। এই ফেরোমন-এর নাম Trail Substance। সেই ফেরোমন-এর গন্ধ শুঁকে পিছনের পিঁপড়ে সামনের পিঁপড়েকে অনুসরণ করে দলবদ্ধভাবে এগোয়। আমাদের অনুপস্থিতির সুযোগে টেলর আন্তোনিওর দেখা আর্মি-অ্যান্ট-এর আস্তানা থেকে আমাদের তাঁবু অবধি এই ফেরোমন ছড়িয়ে রেখেছিল। রাতে পিঁপড়ের ঝক চলতে শুরু করে গন্ধ অনুসরণ করে। আমাদের তাঁবুর দিকে এগিয়ে আসে।

উঃ, খুব বেঁচে গেছেন। টের পেলেন কী করে! ঘুম ভেঙে গিয়েছিল বুঝি? বিল বললেন।

আমি জেগেছিলাম। সুনন্দ, অসিত ঘুমোচ্ছিল। নানা কারণে টেলরের ওপর আমার সন্দেহ দানা বাঁধছিল। আজ রক-পেন্টিং দেখেই বুঝলাম, হয়তো আজই বিপদ আসবে।

কেন, রক-পেন্টিংয়ে কী ছিল?

বাজে ছবি। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে আঁকা। হয়তো টেলরের নিজস্ব শিল্পচর্চা। বুঝলাম, আমাদের কায়দা করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘুম আসছিল না। মন কোনো বিপদের আশঙ্কা করছিল। তবে আক্রমণ যে এমন বিচিত্র উপায়ে হবে তা অবশ্য আন্দাজ করতে পারিনি! টেলর আঁটঘাট বেঁধেই কাজে নেমেছিলেন। বাঁদরটাকে অবধি ছেড়ে দিয়েছিলেন, পাছে সে চিৎকার করে আমাদের জাগিয়ে দেয়। আমার আর একটা সন্দেহ হয়, আমাদের খাবার জলে কিছু মিশিয়ে দিয়েছিলেন টেলর। খুব সম্ভব ঘুমের ওষুধ। টেলর, সত্যি করে বলুন তো কী করেছিলেন?

টেলর কোনো উত্তর দিল না।

মামাবাবু বললেন, রক-পেন্টিং দেখতে বেরোবার আগে আমি তাঁবুর জিনিসপত্র ভালো করে পরীক্ষা করে যাই। ফিরে এসে তাঁবুতে ঢুকে লক্ষ করে দেখলাম মাটিতে বসানো খাবার জলের জগটা যেন একটু সরানো হয়েছে। জলের রঙও কেমন সামান্য ঘোলা। কোনো রিস্ক না নিয়ে জলটা ফেলে দিই।

অর্থাৎ ওই জল খেলে? আমি সভয়ে বলে উঠি।

হ্যাঁ, আমাদের ঘুম আর কোনো দিনও ভাঙত না।

আমার ইচ্ছে হচ্ছে শয়তানটাকে এক্ষুনি গুলি করে মারি। বিলের ক্রুদ্ধ গর্জনে টেলর যেন শিউরে উঠল। কিন্তু প্রোফেসর, একটা রহস্য বুঝতে পারছি না। আপনাদের হত্যা করে ওর লাভ কী? বিল প্রশ্ন করলেন।

সেটা বোধহয় ডক্টর কার্লোর সঙ্গে কথা বললে বুঝতে পারব। সুনন্দ, আন্তোনিও, তোমরা টেলরকে পাহারা দাও। বিল, অসিত আমার সঙ্গে এসো।

গেট বন্ধ ছিল। পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢুকে ঘরের দরজায় করাঘাত করলাম। গোরা কবাট খুলে দিল। তাকে এক ধাক্কায় সরিয়ে আমরা ভিতরে প্রবেশ করলাম। বিল গোরোকে কঠোর গলায় বললেন, চালাকির চেষ্টা করলেই গুলি খাবে। বিল তাকে একটা খালি ঘরে পুরে শিকল লাগিয়ে দিলেন। তারপর কার্লোর খোঁজে আমরা ল্যাবরেটরি ঘরে হাজির হলাম।