☼ অজেয় রায় ☼
ফেরোমন
ছয়
ব্রুস টেলর পরদিন ভোরেই হই-হই করে হাজির হলেন।
কী ব্যাপার? আপনারা? বললেন যে পশ্চিমে যাবেন?
বিশেষ প্রয়োজনে এলাম। আপনার সাহায্য দরকার।
কিন্তু এলেন কী করে?
আপনার পদচিহ্ন অনুসরণ করে।
বিল নিয়ে এসেছেন।
বটে, বটে! তা দরকারটা কী শুনি?
মামাবাবু আমাদের পোর্টারদের কাহিনি শোনালেন।
শুনে টেলর বেজায় হাসলেন। একটা বুড়ো গোসাপ ওই পাহাড়ে থাকে জানি, কিন্তু সে যে দেবতা জানতাম না। তিনি গোরোর ওপর চটে উঠলেন, ব্যাটারা বড় বাজে বকে। এখন বুঝুন ঠেলা! ঠিক আছে, আমি আজই তোক পাঠাচ্ছি কাছের গ্রামে। তবে ভয় হয়, সংস্কার বড় মারাত্মক জিনিস। ওখানে কাজ করতে কেউ রাজি হবে কিনা জানি না। যা হোক, আমি সবরকম চেষ্টাই করে দেখব।
টেলর কুণ্ঠিতভাবে বললেন, “আমি কাল ছিলাম না। অতিথি সৎকার করতে পারলাম না। তা আমি নেই খবরটা দিল কে?
এক বৃদ্ধ। বিল জানালেন।
আলাপ হল তার সঙ্গে?
আলাপ! বিল আঁতকে ওঠেন, “বাপরে কী মেজাজ! বলল–নেই। শিগগিরি ফিরবে। ব্যস! মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল। দুটোর বেশি প্রশ্ন করলে মেরেই বসত।
টেলর লজ্জিতভাবে বললেন, ছিঃ ছিঃ, কী কাণ্ড!
মামাবাবু এবার প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা, বৃদ্ধটির নাম কি ফিলিপ কার্লো?
টেলর অবাক। আপনি চেনেন কার্লোকে? আলাপ আছে?
না। একবার মাত্র দেখেছিলাম। অনেক দিন আগে। উনি কি আপনার সঙ্গে কাজ করছেন?
হুঁ, কাজ করছেন বটে, কিন্তু তাতে লাভ না হয়ে বরং আমার ক্ষতিই হচ্ছে।
কেন? অমন পণ্ডিত লোক।
তা ঠিক। কিন্তু ডক্টর কার্লো এখন রুগ্ণ। ওঁর শরীর মন কোনোটাই সুস্থ নয়। দেখলে তো, আপনাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করলেন!
ব্যাপারটা কী?
ব্যাপার খুবই দুঃখজনক। এত বড় প্রতিভার ওই পরিণতি হবে ভাবিনি। টেলর বিষণ্ণভাবে একটু চুপ করে থেকে বলতে শুরু করলেন, প্রায় আড়াই বছর আগে ডক্টর কার্লোর সঙ্গে আমার আলাপ হয় এক উপজাতি গ্রামে। বিষাক্ত পোকার কামড়ে আদিবাসীরা কী কী টোটকা ব্যবহার করে তিনি এ বিষয়ে অনুসন্ধান করছিলেন। কয়েকদিন পর আমি সে-গ্রাম ছেড়ে চলে যাই। মাত্র তিন দিন পরে ওই গ্রামের একজন এসে আমায় খবর দিল কার্লোর গুরুতর দুর্ঘটনা ঘটেছে। কীভাবে তার কুটিরে আগুন লাগে। জ্বলন্ত পোশাকে উদভ্রান্ত অবস্থায় দৌড়ে পালাতে গিয়ে তিনি এক খাদের মধ্যে পড়ে যান। পায়ে আঘাত লাগে। গ্রামের লোক তাঁকে তিরিশ মাইল দূরে এক মিশনারি হাসপাতালে নিয়ে গেছে।
তাড়াতাড়ি হাসপাতালে গেলাম। কার্লো মাস দুই ভুগে সুস্থ হলেন, কিন্তু একটা পা জখম হয়ে গেল। তাছাড়া মুখটা পুড়ে গিয়ে বিকৃত হয়ে গেল। আমি অনুরোধ করলাম–ফিরে যান। কিন্তু কার্লো রাজি হলেন না। উনি জেদ ধরলেন আমার সঙ্গে যাবেন। আমি একটু সাহায্য করলে এখানে রিসার্চ চালাতে পারবেন।
বাধ্য হয়ে সঙ্গে নিয়ে এলাম। ল্যাবরেটরিতে এনে রাখলাম। দুঃখের বিষয়, কিছুদিন পরে বুঝলাম কার্লো ভীষণ মানসিক শ পেয়েছেন। কোনো কঠিন গবেষণা ওঁর পক্ষে সম্ভব নয়। দিনের পর দিন গুম্ হয়ে থাকেন। কারো সামনে বেরোতে চান না। রাতে ঘুম হয় না। অকারণে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন।
ওঁকে ডাক্তার দেখালেন না কেন? মামাবাবু বললেন।
চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু কিছুতেই ডাক্তারের কাছে যেতে রাজি হলেন না। মনে হয়, ধারণা হয়েছিল, ওঁকে পাগলা গারদে রাখা হবে।
কোনো আত্মীয়কে যদি খবর দিতেন।
তেমন কারও ঠিকানা পেলাম না। ডারবান থেকে ওঁর পরিচিত এক ভদ্রলোককে ডেকে এনেছিলাম, কার্লো তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেন। জোর করতে সাহস হল না। যদি স্ট্রোক হয়ে যায়! ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। এত বড় ব্রেন, সত্যি কি পাগল হয়ে যাবে? তাই আমার কাজের মধ্যে ওঁকে ডাকতে লাগলাম। আমার গবেষণা নিয়ে আলোচনা করতাম। একটু একটু করে দেখি উনি ফেরোমন সম্বন্ধে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। তখন ভালোই লেগেছিল। যদি এত বড় পণ্ডিতের সাহায্য পাই! আমিই প্রস্তাব দিই, আসুন আমরা একসঙ্গে কাজ করি। পরে বুঝলাম, নিজের পায়ে কুড়ুল মেরেছি। কার্লো ফেরোমন নিয়ে মেতে গেলেন এবং ল্যাবরেটরি অধিকার করে বসলেন। আমাকে একা কিছুতেই কাজ করতে দেবেন না। সব সময় আমার ওপর সর্দারি করবেন। কার্লোকে পেয়ে আমার কোনো উপকার হল না। কারণ, কোনো সমস্যা নিয়ে টানা কাজ করার মতো শরীর বা মনের অবস্থা উনি হারিয়ে ফেলেছিলেন। বিষয়টা ওঁর কাছে নতুন। শুধু নানারকম উদ্ভট কল্পনা করেন আর আমাকে তার কল্পনামাফিক কাজ করতে বলেন। আজ বছরখানেকের ওপর এই অবস্থা চলছে। আমার কাজের খুব ক্ষতি হচ্ছে। যতটা পারি ওঁকে লুকিয়ে কাজ করি। উনি উপস্থিত থাকলে বড় ডিসটার্বেন্স হয়। মহা সমস্যায় পড়েছি। কী যে করি–
টেলর মাথায় হাত দিয়ে হতাশভাবে বসে রইলেন। সত্যি, এত নামী বৈজ্ঞানিকের এই শোচনীয় পরিণতি ভাবতে কষ্ট হয়।
মামাবাবু বললেন, যদি অনুমতি করেন তো ডক্টর কার্লোর সঙ্গে আমি একবার আলাপ করব। চেষ্টা করব ওঁকে শহরে ভালো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে।
খুব ভালো কথা। যদি পারেন তো মহা উপকার হয়। আমার অবস্থাটা তো বুঝছেন। তবে দয়া করে ওঁর কাছে ফেরোমন প্রসঙ্গ তুলবেন না।
কেন?
কারণ, এটা হল টপ সিক্রেট, মানে কার্লোর ভাষায়। উনি স্থির করেছেন, ফেরোমন নিয়ে কয়েকটা যুগান্তকারী আবিষ্কার করবেন। কিন্তু যতদিন না রিসার্চ কমপ্লিট হয়, আমায় বারণ করেছেন যেন এ-বিষয়ে কেউ জানতে না পারে। তাহলেই নাকি অন্য বৈজ্ঞানিকরা এই লাইনে রিসার্চ শুরু করে দেবে। হয়তো আমাদের গবেষণার সূত্র চুরি করার ষড়যন্ত্র। হবে।
কিন্তু জুওলজি পত্রিকায় যে আপনি পেপার পাবলিশ করেছেন? সুনন্দ একটু মজা করে।
লুকিয়ে। জানতে পারলে বৃদ্ধ কেলেঙ্কারি করবে। আচ্ছা বলুন তো প্রোফেসর, আমার এত দিনের সাধনা কি ওঁর খামখেয়ালিপনার জন্য বৃথা যাবে? এতটা আত্মত্যাগ কি সম্ভব? কেন আমি আমার গবেষণার ফল প্রকাশ করব না? কেন আমি আমার একান্ত নিজস্ব পরিশ্রমলব্ধ গবেষণায় অন্যকে ভাগ বসাতে দেব? আমার লেখায় অন্যের নাম যুক্ত করব?
মামাবাবু সায় দিলেন, আপনি ঠিকই বলছেন। আপনার কোনো অন্যায় হয়নি। আপনি যথেষ্ট করছেন। কিন্তু এভাবে চললে তো আপনাদের দুজনেরই ক্ষতি। আমি একবার চেষ্টা করবই। আপনি কার্লোর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেবেন?
নিশ্চয়! তবে সুযোগ বুঝে, যেদিন ওঁর মন বেশ শান্ত থাকবে।
টেলর বিদায় নিলেন। আমরা কীভাবে টেলরকে কার্লোর কবল থেকে উদ্ধার করা যায় তাই নিয়ে গবেষণা শুরু করে দিলাম। মামাবাবু বারবার বলতে লাগলেন, এত বড় বৈজ্ঞানিক প্রতিভাকে এভাবে নষ্ট হতে দেওয়া কক্ষনো উচিত নয়। চেষ্টা করতেই হবে। ওঁকে ভালো করে তোলার।
.
পরদিন সকালে মামাবাবু, সুনন্দ ও আমি বেড়াতে বেরিয়েছিলাম। ল্যাবরেটরির কাছে টেলরের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। টেলর বললেন, প্রভাতে বায়ুসেরন ও কিঞ্চিৎ পদচারণ। আমার অভ্যাস। চলুন ভিতরে।
কার্লো? আমি সভয়ে প্রশ্ন করি।
ঘুমোচ্ছেন। ঘুম আসছিল না, তাই মাঝরাতে ঘুমের বড়ি খেয়েছেন। চলুন ল্যাবরেটরি দেখাব।
ল্যাবরেটরিতে ঢুকে আমরা অবাক। শহর থেকে এত দূরে, গহনে এমন আধুনিক নানা জায়গায় আমার আরও কয়েকটা ল্যাবরেটরি আছে। তবে এটাই সেরা।নিজনে কাজ করতে আমার ভালো লাগে।
মামাবাবু ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন। কতগুলো লেবেল-আঁটা শিশি দেখিয়ে বললেন, এগুলোর মধ্যে কি ফেরোমন আছে?
হ্যাঁ। কৃত্রিম উপায়ে বানিয়েছি।
টেলর জাম্বোকে ডেকে কফি বানাতে বললেন। বিদায় নেবার সময় আশ্বাস দিলেন, আশা করছি আপনাদের পোর্টারের খবর শিগগিরি পাবেন।
রাত্রে আন্তোনিও জানাল, প্রোফেসর ঘোষ, আজ পাগলা বৈজ্ঞানিককে দেখলাম।
কে, কার্লো?
হ্যাঁ! পাঁচিলের বাইরে একটা পাথরের ওপর বসেছিলেন। আমায় দেখেই চট করে ভিতরে ঢুকে গেলেন। জানেন, ওঁকে আমি আগে দেখেছি।
কোথায়?
লিবিয়ায়। চার বছর আগে। সাহারার প্রান্তে এক মরূদ্যানে। আলাপ হয়নি। দূর থেকে দেখেছিলাম। সেদিনও ওই এক ভঙ্গিতে বসেছিলেন। বেদুইন শেখরা বলেছিলেন–সাহেব বেশ কিছুদিন ওই মরূদ্যানে আছে। পোকামাকড় নিয়ে কী সব পরীক্ষা করে। বেজায় রাগী।
আর কোনো শ্বেতাঙ্গ ছিল সেখানে?
না। তখন অবশ্য কার্লোর গালে পোড়া দাগ ছিল না। তবে আমার ফোটোগ্রাফারের চোখ ঠিক চিনেছে।