☼ অজেয় রায় ☼
ফেরোমন
পাঁচ
বিল অনেকটা সামনে এগিয়ে চললেন। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মাটির ওপর। আমরা পিছনে চললাম। বিল বললেন, আমায় ট্র্যাকারের বিদ্যে শিখিয়েছিল এক ঝানু মাসাই। সে যে-কোনো পশু বা মানুষের পায়ের চিহ্ন ধরে তাকে মাইলের পর মাইল অনুসরণ করতে পারত। পাথর বা শক্ত মাটির বুকেও ঠিক তার চিহ্ন খুঁজে বের করত। চিহ্ন দেখে বলে। প্রাণীটির ওজন কত, বয়স ইত্যাদি খুঁটিনাটি। আমিও কিছুটা পারি, তবে তার মতো নয়।
ঘণ্টা দই এগোবার পর বিল সহসা থামলেন। মখে আঙুল দিয়ে আমাদের চুপ করতে ইঙ্গিত করলেন। কানে কতগুলো বিচিত্র শব্দ এল। খটখট, ধুপধাপ। নিঃশব্দে গিয়ে একটা। ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়ালাম। বন্য-প্রকৃতিরাজ্যের এক অদ্ভুত ছবি আমাদের সামনে ফুটে উঠল।
এক টুকরো সমতলভূমিতে দুটো প্রকাণ্ড পুরুষ-হরিণ মত্ত হয়ে যুদ্ধ করছে। খানিক দূরে সাত-আটটা মেয়ে-হরিণ ও তিন-চারটে বাচ্চা। মেয়ে-হরিণগুলো কৌতূহলী চোখে লড়াই দেখছে। কখনও আবার নির্বিকারভাবে ঘাস-পাতা চিবুচ্ছে।
বিল বললেন, ইলান্ড। কে দলপতি হবে তাই নিয়ে লড়াই লেগেছে। যতক্ষণ না একটা হেরে দল ছেড়ে পালাবে ততক্ষণ যুদ্ধ চলবে।
এই দ্বন্দ্ব কখন আরম্ভ হয়েছিল জানি না। আরও আধঘণ্টা চলল। ক্রমে একটা হরিণ। পিছু হটতে লাগল। সে অবসন্ন হয়ে পড়েছে। গা দিয়ে রক্ত ঝরছে। একবার গুঁতো খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল। অন্য হরিণটা তাকে শিং-এর ধাক্কায় ঠেলে নিয়ে চলল। শেষে পরাজিত হরিণটি পিছন ফিরে দৌড় লাগাল। বিজয়ী কয়েক কদম তার পিছনে তেড়ে গিয়ে, দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল।
ঠিক এই সময় আমাদের ডান ধারে এক ঝোঁপের ভিতর থেকে একজন বিচিত্র লোক মাথা তুলে দাঁড়াল। ঢেঙ্গা, রোগা, লম্বাটে মুখ। ঘাড় অবধি রুক্ষ কঁকড়া চুল। মুখভর্তি গোঁফ-দাড়ি। গায়ে ময়লা জামা ও কার্লো প্যান্ট। কাঁধে তিন-চারটে বড় বড় থলি। হাতে একটা মুভি ক্যামেরা। কে রে বাবা! হিপি নাকি? আফ্রিকার এই গহনে?
লোকটি নিশ্চয় আমাদের আসা দেখেছিল? একগাল হেসে হেঁকে বলল, “হাল্লো, কেমন দেখলে? ভয় হচ্ছিল, বেরসিকের মতো গুলি করে বসবে বুঝি। খুব লড়েছে। ফার্স্ট ক্লাস ছবি উঠল।
লোকটির গলা শুনে হরিণের দল চকিতে দৌড়ে হাওয়া হয়ে গেল।
লোকটি আমাদের কাছে এসে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে নিজের পরিচয় দিল—জুসেপি আন্তোনিও। শখের ফোটোগ্রাফার। তোমরা? শিকারী নাকি?
আমরাও নিজেদের পরিচয় দিলাম। বিল বললেন, অতগুলো ঝুলি কেন কাঁধে। পোর্টার নেই?
ছিল একজন। পালিয়েছে। একজনকে ধার দাও না তোমরা।
আরে আমাদেরও তো পালিয়েছে। পোর্টারের খোঁজেই তো চলেছি।
শুনে আন্তোনিওর কি হাসি–বাঃ বাঃ! বেশ বেশ! তা তোমাদের সঙ্গে কয়েকটা দিন কাটানো যাক, আপত্তি আছে? তোমাদের লোক জোগাড় হলে আমারও হয়ে যাবে। তাছাড়া অনেকদিন কথা বলার লোক পাইনি। একটু আড্ডা দেওয়া যাবে। তবে আমি কিন্তু বাপু আইন মেনে চলতে পারব না, বলে রাখছি।
মানে?
মানে, ঠিক সময় খাওয়া, শোওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। দেশে ভালো চাকরি করতাম। সময়মতো অফিস যেতে হত বলে কাজ ছেড়ে দিলাম। আগে অবসর সময়ে ফোটোগ্রাফি করতাম, এখন মনের সুখে দিনরাত ওই নিয়ে মেতে আছি। এ দেশটাও চমৎকার। সাবজেক্টের অভাব নেই। কতরকম জন্তু-জানোয়ার, কীটপতঙ্গ।
আন্তোনিও বয়সে যুবক। তার হাতমুখ নেড়ে চুল ঝাঁকিয়ে কথা বলার ধরন ভারি মজার। বোঝা যায়, লোকটি বেজায় দিলখোলা। সুনন্দ রসিকতা করল–আপনার নিশ্চয় অনেক পয়সা! চাকরি ছেড়ে দিলেন।
মোটেই না।
তাহলে চলে কী করে?
মাঝে মাঝে দেশে ফিরে ছবি বিক্রি করি। আরে, হলিউডের সিনেমা কোম্পানিগুলো তো আমার ছবি কেনার জন্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। জীবজন্তুর এমন অ্যাকশন ফোটোগ্রাফি কি সহজে পাওয়া যায়?
সুনন্দ বলল, মিস্টার আন্তোনিও, প্রথম আলাপে আপনি আশা করি আমাদের একটা ছবি তুলবেন। অসিতের চেহারাটা পছন্দ না হলে আমার তুলন। বলেন তো পোজ করি।
আন্তোনিও গম্ভীরভাবে বলল, সরি! মানুষের ছবি তুলে আমি ফিল্ম নষ্ট করি না।
সুনন্দর দমে যাওয়া মুখ দেখে আমি সুযোগ বুঝে ফোড়ন কাটলাম, মিস্টার আন্তোনিও। আপনি অনায়াসে ওর ছবি নিতে পারেন। ওকে মানুষ ভাববার কোনো কারণ নেই।
মামাবাবু ও বিল হো-হো করে হেসে উঠলেন। আন্তোনিও আমার কথা শুনে যেন কথাটা যাচাই করবার জন্যে সুনন্দকে একবার আপাদমস্তক জরিপ করে নিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ছবি তুলল না।
আবার চললাম। বিল সামনে, আমরা তাকে অনুসরণ করছি। আন্তোনিও প্রায়ই দলছাড়া হয়ে পড়ছিল। কখনো গাছের ওপর বাঁদরের দাঁত খিঁচুনি দেখে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছিল। কখনো বিচিত্রবর্ণ প্রজাপতি দেখে ক্যামেরা তাক করছিল। আবার ছুটতে ছুটতে এসে আমাদের সঙ্গ ধরছিল।
আট-নয় মাইল যাবার পর বিল দাঁড়ালেন। বললেন, ওই দূরে ছোট ছোট ঝোঁপের ঘন জঙ্গল দেখা যাচ্ছে, ওখানে নিশ্চয়ই তেসি ফ্লাই আছে। দেখ, বনের চারপাশের জমির ঘাস পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। সমস্ত ঝোঁপঝাড় কেটে ফেলা হয়েছে। তেসি মাছি ওই রকম বনে আড্ডা গাড়ে। বড় পাতাবহুল গাছের বন বা ছোট ছোট ঘাসবনে থাকে। এখানকার লোকে তাই তেসি ফ্লাই এলাকার চারপাশের বড় ঘাস পুড়িয়ে, ঝোঁপঝাড় কেটে দেয়। যাতে এই মাছি ছড়িয়ে না পড়ে। টেলর দেখছি বনটা এড়িয়ে ডান পাশ দিয়ে ঘুরে গেছে।
আমরা চক্রাকারে তেৎসি মাছির এলাকাটা ঘুরে বনের উল্টো দিকে উপস্থিত হলাম। দূরে বড় বড় গাছে ছাওয়া একখণ্ড সবুজ বন দেখা যাচ্ছিল। বিল সোজা সেই দিকে এগিয়ে গেলেন।
বনের মধ্যে এক পায়ে-চলা পথ ধরে মাত্র পঞ্চাশ গজ মতো ঢুকেই দেখি বন শেষ হয়ে গেছে। সামনে ছোট ছোট ঘাসে ঢাকা পরিষ্কার এক টুকরো জমি এবং তার ভিতর উঁচ পাঁচিলে ঘেরা একটি মাটির বাড়ি। মনে হল, বড় বড় গাছের বেড়া দিয়ে বাড়িটিকে যেন ইচ্ছে করেই লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
বিল বললেন, টেলর ওই বাড়িতে ঢুকেছে।
প্রাচীর-সংলগ্ন মস্ত কাঠের গেটটা একটু ফাঁক করা ছিল। আমরা ভিতরে ঢুকে পড়লাম। বাড়ির দরজায় কয়েকবার করাঘাত করতে শুনলাম ভিতরে খটখট আওয়াজ। দরজা খুলে একটি মুখ উঁকি মারল। সে-মুখ টেলরের নয়।
পুরু চশমার কাঁচে ঢাকা দুটো বিস্ফারিত রাগী চোখের সামনা-সামনি হয়ে আমরা চমকে দু-পা পিছিয়ে গেলাম।
মুখখানা এক বৃদ্ধের। মাথাজোড়া টাক। টিয়াপাখির মতো নাক। তার বাঁ গালের ওপর এক বীভৎস চিহ্ন। পোড়ার দাগ। গালের মাংস কুঁচকে মুখের রূপ বিকৃত করে। তুলেছে।–কাকে চাই? বৃদ্ধ কড়া গলায় প্রশ্ন করল।
এখানে মিস্টার টেলর থাকেন?
হ্যাঁ, কিন্তু সে এখন নেই।
কোথায় গেছেন?
জানি না।
কবে ফিরবেন? আমাদের বিশেষ দরকার।
ও। বৃদ্ধ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাদের দেখল। তারপর বলল, বোধহয় দু-একদিনের মধ্যে। আর কিছু জিজ্ঞাস্য আছে? বৃদ্ধ দরজার ফাঁকটা কমিয়ে আনল।
বলবেন, ঘোষ এসেছিল, আর বিল। একটু দরকার।
বেশ, বলব। জাম্বো কোথায় গেলি। যত উটকো লোক ঢুকে পড়ে–বলতে বলতে সে দরজাটা বন্ধ করে দিল। চকিতে দেখলাম লোকটির হাতে একটি লাঠি। সে লাঠিতে ভর দিয়ে একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছে।
আমরা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। টেলরের আস্তানায় এ কোন বদমেজাজি বুড়ো? টেলরের কোনো অ্যাসিস্টেন্ট নাকি? মনে হয়, লোকটার মাথার গোলমাল আছে। যা হোক, টেলর ফেরা অবধি অপেক্ষা করতে হবে।
পাঁচিলের বাইরে একটি উপজাতীয় লোকের সঙ্গে দেখা। এই বোধহয় জাম্বো। সে আমাদের অবাক হয়ে দেখছিল। বিল বলল, “তুমি টেলরের কাছে কাজ করো?,
হ্যাঁ, বানা।
টেলর কবে ফিরবেন?
দু-একদিনের মধ্যে।
আচ্ছা, এখানে খাবার জল কোথায় পাওয়া যাবে, কাছাকাছি?
ওই দিকে একটা ঝর্না আছে। সে বাড়ির পিছন দিকে দেখাল।
বেশ। টেলর এলে বলবে তার বন্ধুরা ওখানে অপেক্ষা করছে। আমরা তাঁবু ফেলছি।
লোকটি ঘাড় নেড়ে জানাল–বলব।
হঠাৎ–কোত্থেকে আন্তোনিও হাজির হল। সে কখন সটকে পড়েছিল খেয়াল করিনি।পোর্টারের ব্যবস্থা হল?
বললাম, টেলর নেই। দু-একদিন অপেক্ষা করতে হবে।
বেশ বেশ। জায়গাটা খাসা। অনেক সাবজেক্ট পাওয়া যাবে। সে উৎসাহিতভাবে চারদিক দেখল।
ঝর্না খুঁজে পেতে অসুবিধা হল না। বাড়ির আধ মাইলের মধ্যেই। কয়েকটা বড় বড় পাথরের চাঙড়ের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে ক্ষীণ জলস্রোত। পরিষ্কার টলটলে জল নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে। স্রোত ক্রমশ চওড়া হয়ে এঁকেবেঁকে কিছু দূরে ঘন বনের মধ্যে প্রবেশ করেছে। উৎসের কাছেই আমরা তাঁবু ফেললাম।
মামাবাবু বেজায় গম্ভীর হয়ে গেলেন। কথাবার্তা নেই, কী জানি ভাবছেন। তাঁবু খাঁটিয়ে, রান্নার জোগাড় করছি, হঠাৎ তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন–মনে পড়েছে–কার্লো! ডক্টর ফিলিপ কার্লো!
কার্লো কে?
ওই বৃদ্ধ। কেবল ভাবছি, কোথায় দেখেছি। সেই নাক। কথা বলার ভঙ্গি। গলার স্বর। বড্ড চেনা। তবে দশ বছর আগে দেখেছিলাম। তখন মাথায় অনেক চুল ছিল; আর গালের পোড়া দাগটা ছিল না। এখন ভীষণ বড়োটে হয়ে গেছেন। কিন্তু কা্ররলো এখানে কী করছেন?
কার্লো কে? বিল বললেন।
একজন প্রাণিবিজ্ঞানী। ট্রপিকাল অঞ্চলের পোকামাকড-বিশেষজ্ঞ। কলকাতায় এক কনফারেন্সে দেখেছিলাম। বেজায় রাগী। তবে অসাধারণ পণ্ডিত। শুনেছিলাম, তান ট্রপিকাল অরণ্যে প্রচুর ঘোরেন। কয়েক বছর ওঁর কোনো লেখা আমার চোখে পড়েনি। কার্লো কি টেলরের সঙ্গে রিসার্চ করছেন?
বদরাগী বুড়ো কার্লোর রহস্য আমাদের সবার মনে কৌতূহল জাগাল। কিন্তু টেলরের সঙ্গে দেখা না হলে এ-রহস্য সমাধানের উপায় নেই।