☼ অজেয় রায় ☼
ফেরোমন
চার
টেলর চলে যাবার পর মামাবাবু নিশ্চিন্তে কাজ শুরু করলেন।
রাত্রে মামাবাবু বললেন, জানেন বিল, পোর্টারদের হাবভাব সুবিধের মনে হচ্ছে না।
কেন?
লোকগুলো মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করছিল। পাথরের টিলাটার দিকে বারবার তাকাচ্ছিল। কেমন ভয়-ভয় ভাব।
ভয়! কেন, স্তূপটাকে ভয় পাবার কী আছে? ওখানে কোনো বন্য জন্তু থাকার কথা নয়। বেশ, কাল আমি যাব। রহস্যটা বোঝার চেষ্টা করব?
পরদিন বিল মামাবাবুদের সঙ্গে গিয়ে খাদের কাছে একটা পাথরে বসে পাইপ টানতে লাগলেন।
কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ একটা আর্তনাদ। তাড়াতাড়ি খাদের ভিতর উঁকি দিয়ে দেখি একজন পোর্টারের হাত থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছে। ফাস্ট-এড-এর বাক্স সঙ্গে ছিল। লোকটির হাতে ব্যান্ডেজ করে দিলাম। সামান্য কেটেছে।
মামাবাব জানালেন, একজনের হাত থেকে গাঁইতি ছুটে গিয়ে লেগেছে। ভাগ্যিস মাথায় লাগেনি। লোকগুলো কেবল নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। অসাবধান হয়ে কাজ করছে। তাই ফস্কেছে।
পোটাররা এদিকে কাজ বন্ধ করে খাড়া দাঁড়িয়ে গেল। কী ব্যাপার? তোমাদের তন লাগেনি, সাবধানে কাজ করো।
তারা মাথা নেড়ে বলল, “না, বানা (সোয়হিলি ভাষায়–হুজুর), এখানে আমরা খুঁডতে পারব না।
কেন?
এই পাহাড়ে এক পুণ্যাত্মা থাকেন। তিনি বিরক্ত হচ্ছেন। এবার অঙ্গের ওপর দিয়ে ফাঁড়া কেটেছে। এরপর বিষম বিপদে পড়ব।
পুণ্যাত্মা? তিনি আবার কে? বিল বললেন।
আছেন বানা। তিনি গোসাপের রূপ নিয়ে আছেন। বহুকাল এই জায়গায় বাস করছেন। তার দয়ায় এ অঞ্চলে বৃষ্টি হয়। বিষাক্ত মাছিরা এখানে আসে না।
কে বলল তার কথা? তোমরা তো এ অঞ্চলের লোক নও।
গোরা, হুজুর।
বঝন কাণ্ডটা, বিল বললেন, টেলরের সঙ্গীটি কেমন উপকার করে গেছে। এরা খুব সাহসী, কিন্তু বড় সংস্কারাচ্ছন্ন। দেবতা, অপদেবতা সবাইকেই বেজায় ভয়। এখন এদের দিয়ে এখানে কাজ করানো খুব শক্ত ব্যাপার।
বিল অনেক চেষ্টা করলেন। ভয় দেখালেন। লোভ দেখালেন। কিন্তু পোর্টাররা অনড়। শেষে বললেন, বেশ, খুড়তে হবে না। আপাতত কদিন এখানে থাকো। আমি অন্য লোক খুঁজছি, তখন তোমাদের ছেড়ে দেব।
বিল আমাদের বললেন, দেখি কাল আর একবার চেষ্টা করব। ভালো পুজোটুজো দিলে যদি হয়।
কিন্তু পরদিন ভোরে উঠে আবিষ্কার করলাম সব ক-জন পোর্টার পালিয়েছে। বোধহয় মাঝরাতে সরে পড়েছে। এরা কিছু টাকা আগাম নিয়েছিল। হয়তো ভাবল, আমরা যদি জোর করে কাজ করাই, তাই পালিয়েছে।
আমরা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। ভারী ভারী শাবল, গাঁইতি ইত্যাদি খোঁড়ার যন্ত্র। মাসখানেকের রসদ। মামাবাবুর বৈজ্ঞানিক জিনিসপত্র। এত মাল চারজনে বয়ে নিয়ে ফিরে যাওয়াও তো অসম্ভব। তাছাড়া এদূর এসে কিছু চেষ্টা না করে ফিরে যাব? এত আয়োজন বৃথা যাবে?
বিল রাইফেল ঘাড়ে বেরোলেন। যদি কাছাকাছি কোনো গ্রাম থেকে লোক জোগাড় করা যায়। ফিরলেন সন্ধের সময়।
নাঃ, পেলাম না। প্রায় দশ মাইল ঘুরে একটা গ্রাম পেয়েছিলাম, কিন্তু তারাও রাজি হল এখানে কাজ করতে।
পরামর্শসভা বসল, কী করা যায়?
বিল বললেন, এখন একমাত্র উপায় বৈজ্ঞানিক টেলর। উনি এ অঞ্চল ভালো করে চেনেন। হয়তো চেষ্টা করলে পোর্টার জোগাড় করে দিতে পারবেন। মানে, এরা যাতে এখানে কাজ করে তার ফন্দি বাতলে দিতে পারবেন।
আমাদের এত খোঁড়ার আগ্রহ দেখে টেলরের এই জায়গা সম্বন্ধে সন্দেহ বাড়বে না তো? আমি বললাম।
কী উপায়! মামাবাবু জানালেন। কিন্তু টেলরের আস্তানায় পৌঁছব কী করে? সুনন্দ বলল।
পায়ের চিহ্ন অনুসরণ করব, বিল বললেন, কিছু কিছু ট্র্যাকারের বিদ্যে আমার জানা। আছে। মাত্র দুদিন আগে ওরা ফিরে গিয়েছে। চিহ্ন পাওয়া যাবে। কাল ওদের তাঁবু কোথায় ছিল খুঁজে বার করব। তারপর অনুসরণ আরম্ভ হবে। ওর আস্তানা তো বেশি দূরে নয়।
টেলরের তাঁবুর চিহ্ন খুঁজে পেতে অসুবিধা হয়নি। একটা বড় গাছের তলায় দেখলাম খুঁটি পোঁতার গর্ত, পোড়া কাঠ। কাছেই এক ছোট পাহাড়। বিল মাটির ওপর চোখ রেখে ধীরে ধীরে ঘুরতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন, চলুন, এগোনো যাক। ওদের ট্র্যাক পেয়েছি। তবে টেলর যাবার আগে আর একদল এখান থেকে একই পথে গিয়েছিল। পায়ের চিহ্ন কতগুলো কিছু পুরনো। রোদের তেজ বাড়ার আগে রওনা দিই। যতটা পারি জিনিস বয়ে নিয়ে যাই, বাকি কোনো গুহার মধ্যে লুকিয়ে রেখে যাই।