☼ অজেয় রায় ☼
ফেরোমন
দুই
পরদিন খুব ভোরে উঠে রওনা দিলাম। সারাদিন হাঁটলাম। কয়েকটা বড় বড় তৃণভূমি পেরোলাম। দেখলাম অজস্র জন্তুর ভিড়–নানারকম অ্যান্টিবোপ হরিণ, জিরাফ, জেব্রা, উটপাখি। একটা গাছের ছায়ায় দেখি কর্তা-গিন্নি দুই বাচ্চা নিয়ে এক সিংহ পরিবার। সিংহ-সিংহী পা ছড়িয়ে দিবানিদ্রা দিচ্ছে, দুটো বাচ্চা পাশে লুটোপুটি করছে। তাদের মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে কতগুলো জেব্রা নিশ্চিন্ত মনে ঘাস খাচ্ছে। বিল বললেন, সিংহদের এখন খিদে নেই। তাই জেব্রারা নির্ভয়। সিংহ অযথা শিকার করে না।
সমতল তৃণভূমির মাঝে মাঝে এক-একটা ছোট পাহাড়। পাহাড়ে গাছপালা খুব কম। ক্ষীণস্রোতা কয়েকটি নদী দেখলাম। উপজাতি গ্রামেরও দেখা পেয়েছিলাম। মাত্র কয়েকটি গ্রামের কাছে আমরা যাইনি।
তৃতীয় দিন ভূপ্রকৃতির চেহারা বদলে গেল। রুক্ষ উঁচু-নিচু মাঠ। পাথুরে জমি। নেড়া ছোট পাহাড়। বাবলাজাতীয় কাটাবন। দু-একটা বাওবাব গাছ বেঁটে মোটা শরীরের ওপর ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঘাসবন কম।
সকাল ৯টা নাগাদ বিল একজায়গায় থামলেন। চারদিক দেখে বললেন–এইখানে এক গ্রাম ছিল। আমি যে গ্রামে গিয়েছিলাম তাদের সঙ্গে এই গ্রামের লোকেরই যুদ্ধ হয়। দেখছি এ গ্রামও ধ্বংস হয়ে গেছে।
চারদিকে উঁচু-নিচু মাটির ঢিপি। শুকনো গর্ত। এগুলি কোনো পরিত্যক্ত গ্রামের চিহ্ন সন্দেহ নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা চলে গেল কেন?
বোধ হয় জলের অভাবে। গ্রামের পাশ দিয়ে একটা খাল ছিল। দেখ তার শুকনো খাত। টাঙ্গানিকার এ অঞ্চলে জলের বড় অভাব।
যে জায়গায় যাচ্ছি সেটা আর কদ্দূর? মামাবাবু প্রশ্ন করলেন।
কাছেই। মাত্র মাইল তিনেক।
আমরা আবার এগোলাম।
লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে আমরা উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। এখানেও জনবসতির চিহ্ন ছড়ানো রয়েছে। বিল দেখালেন–ওই যে কিছু দূরে এ্যানিটের স্তূপ দেখা যাচ্ছে, ওর পাদদেশে আমি কার্লো পাথরের স্তর দেখেছিলাম।
শিলাস্তূপের কাছে গেলাম। স্কুপের পূর্বদিকে এক বড় গোল চত্বর। চত্বরের পাথরে রঙ কালচে। মামাবাবু দেখে বললেন, মনে হয় বহু যুগ আগে এখানে জলাশয় ছিল। কাদামাটি জমে শ্লেট-পাথর হয়ে গেছে। এ ধরনের শ্লেট-পাথরে নানা রকম ফসিল পাওয়া যায়। হঠাৎ কাদায় ডুবে গিয়ে প্রাণিদেহ অবিকৃত অবস্থায় ক্রমে ফসিল হয়ে যায়।
চত্বরের মাঝখানে বেশ বড় ফাটল। অনেকখানি গভীর। এইখানেই বোধহয় সেই অতি প্রাচীন পাখির ফসিল পাওয়া গিয়েছিল।
ঠিক হল আমরা গ্রামের কাছে তাঁবু ফেলব। কারণ ওখানে জল ছিল। একটা বড় পাথরের গর্তে পরিষ্কার টলটলে জল জমে ছিল। কাল থেকে খোঁড়াখুঁড়ি আরম্ভ হবে। মামাবাবু চলে গেলেন খাদটা ভালো করে পরীক্ষা করতে। আমরা তাব খাটালাম, রান্নার জোগাড় করলাম। তারপর কফি খেতে খেতে গল্প শুরু হল।
বিল বললেন, আমি যখন কুড়ি বছর আগে এসেছিলাম, তখন জায়গাটা এত রুক্ষ অনুর্বর ছিল না। বেশ ঘাস আর গাছ ছিল।
কেন এমন হল? সুনন্দ বলল।
ঠিক জানি না। তবে উপজাতিরা অতিরিক্ত গরু-ছাগল চরিয়ে অনেক সময় ওপরের মাটি আলগা করে ফেলে। বৃষ্টি হলে সেই মাটি ধুয়ে পাথর বেরিয়ে পড়ে।
বিকেলের দিকে বিল রাইফেল নিয়ে বেরোলেন। মাইল দুই-তিন ঘুরে তিনি একটা মস্ত শুয়োর মারলেন। পোর্টাররা শুয়োরটার ছাল ছাড়িয়ে খণ্ড খণ্ড করে কেটে তাঁবুতে এসে আগুনে ঝলসাতে শুরু করে দিল। বিল বড় একখণ্ড মাংস নিয়ে নিজের হাতে রোস্ট করলেন। আমরা খেলাম। চমৎকার স্বাদ হয়েছিল।
মামাবাবু, আমি, সুনন্দ এবং তিনজন পোর্টার সকালে সেই কার্লো পাথরের চত্বরে হাজির হলাম। আমাদের সঙ্গে পাথর খোঁড়ার জন্য গাঁইতি, শাবল, ছেনি ইত্যাদি সরঞ্জাম ছিল। মামাবাবু ফাটলের মধ্যে একটা জায়গা দেখিয়ে দিতে পোর্টাররা পাথর খসাতে শুরু করল। মামাবাবু মাঝে মাঝে পরীক্ষা করতে লাগলেন। কয়েক জায়গায় এইভাবে খোঁড়াখুঁড়ি চলল। কয়েকটা শামুকের ফসিল বের হল। মামাবাবু বললেন, সাবধানে কাজ করতে হবে। সময় লাগবে। এ যাত্রায় আমরা যা খুঁজছি পাব কিনা জানি না। তবে জায়গাটায় নানা রকম ফসিল আছে সন্দেহ নেই। এবার না পাই পরে আবার আসব।
সারাদিন কাজ করে আমরা ফিরে এলাম।
বিল বেরিয়েছিল চারিদিকটা একটু দেখতে। পুরনো গ্রামের চারপাশ ঘরেছে। একটা ছোট হরিণ মেরে এনেছিল। আমাদের সঙ্গে নানারকম টিনের খাবার আছে কি পোর্টারদের টাটকা মাংস চাই। সেদিনও বিল নিজের হাতে মাংসের রোস্ট তৈরি করে খাওয়ালেন। বুঝলাম ডেয়ারিং বিল কেবল নামকরা শিকারী নন, পাকা রাঁধনিও বটে। বললেন, বছরের পর বছর বনে-জঙ্গলে মাঠে-ঘাটে ঘুরেছি। শিকারের মাংসই চল একমাত্র খাদ্য। সবরকম জন্তুই খেতাম। আর উপজাতির লোকদের কাছে শিখতাম কোন মাংস কী করে রাঁধতে হয়। তার সঙ্গে সভ্য জগতের মশলাপাতি লাগিয়ে জিভে স্বাদ আনতাম। কেমন হয়েছে রান্না?
পরদিন সকাল দশটা নাগাদ।
মামাবাব পোর্টারদের নিয়ে খাদের ভিতর। আমি ও সুনন্দ ওপরে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেখলাম, শিলাস্তপের পাশ দিয়ে একজন শ্বেতাঙ্গ এই দিকে আসছে। আশ্চর্য হলাম। হঠাৎ এ কোত্থেকে? ভ্রমণকারী না শিকারী? চাপাস্বরে ডাকলাম–মামাবাবু, এক সাহেব এদিকে আসছে।
মামাবাবু তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে এলেন।
লোকটি ক্রমশ কাছে এগিয়ে এল।
বেশ লম্বা। বয়সে যুবক। সুপুরুষ। শক্ত জোয়ান চেহারা। পরনে খাকি ফুলপ্যান্ট। রঙচঙে হাফশার্ট। মাথায় শোলার টুপি। লোকটি দরাজ গলায় হেঁকে বলল, “আপনাদের দেখতে এলাম। এখানে বিদেশি কাউকে দেখব ভাবিনি। খোঁড়াখুঁড়ি করছেন? কিছুর সন্ধান পেয়েছেন নাকি?
মামাবাবু জবাব দিলেন, হ্যাঁ, একটু পরীক্ষা করছি জায়গাটা। এখনও কিছু পাইনি। আপনি?
লোকটি হেসে উঠল। তাই তো, এখনও পরিচয় দিইনি। অভদ্রের মতো প্রশ্ন করছি। অনেক দিন সভ্যজগতের বাইরে কাটাচ্ছি কিনা, ভব্যতা ভুলে গেছি। হ্যাঁ, আমার নাম টেলর। ব্রুস টেলর। পেশা প্রাণিবিজ্ঞান চর্চা।
মামাবাবু একটু ভ্রু কুঁচকে ভাবলেন। তার মুখ দেখলাম উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। উৎসাহিত হয়ে বললেন, আচ্ছা, আপনিই কি ফেরোমন বিশেষজ্ঞ ব্রুস টেলর? যাঁর প্রবন্ধ এই সেদিন পড়লাম জুওলজি পত্রিকায়?
ভদ্রলোক একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ, লেখাটা আমারই বটে। পড়েছেন? কেমন লেগেছে?
মামাবাবু রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। এ লেখাটা তো দারুণ হৈ-চৈ ফেলেছে বিজ্ঞানীমহলে। ফেরোমন নিয়ে এত গভীর গবেষণা কেউ করেনি। আপনার আর একটা লেখা বোধহয় বছরখানেক আগে জুওলজি পত্রিকায় বেরিয়েছিল। সেটাও আমি পড়েছি। ফেরোমন যে জীবজন্তু, বিশেষত কীটপতঙ্গের জীবন-যাত্রাকে এতখানি নিয়ন্ত্রিত করে, আগে কেউ ভাবতে পারেনি। অন্তত ভাবলেও, আপনিই প্রথম প্রমাণ দিয়েছেন। আচ্ছা, আপনি লিখেছেন যে, কয়েক রকম শস্যরক্ষায় কৃত্রিম ফেরোমন দ্বারা পেস্ট কনট্রোল সম্ভব। আপনি কি ল্যাবরেটরিতে তেমন কৃত্রিম ফেরোমন তৈরি করেছেন?
ঢেলর মৃদু হেসে বললেন, হ্যাঁ, করেছি। তাদের ফলাফল মোটামুটি সন্তোষজনক। তবে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন আছে।
মামাবাবু বললেন, যদূর জানি, কয়েকটি ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে আপনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, কিন্তু আপনি যাননি। লোকের ধারণা, আপনি একজন রহস্যময় এবং দাম্ভিক ব্যক্তি। যাক, আমার ভুল ভাঙল। আর আপনি যে বয়সে এত নবীন, সেটাও ভাবতে পারিনি।
টেলর বললেন, আমার পরিচয় তো পেলেন। এবার আপনাদেরটা জানতে পারি কি? মনে হচ্ছে, আমরা একই লাইনের লোক।
মামাবাবু বললেন, প্রায় তাই। আমি ভারতীয়। কলকাতায় প্রাণিবিজ্ঞানের অধ্যাপনা করি। যদিও বিদ্যা অতি সামান্য। নাম–নবগোপাল ঘোষ। এটি আমার ভাগনে সুনন্দ। আর এই ছেলেটি সুনন্দর বন্ধু অসিত। আমাদের সঙ্গে আরও একজন আছেন। আমাদের গাইড। বিখ্যাত শিকারী মিস্টার হার্ডি। তিনি আপাতত বন্দুক নিয়ে কিঞ্চিৎ খাদ্য-সংগ্রহ করতে বেরিয়েছেন।
টেলর চোখ বড় বড় করে বললেন, “বাপরে, আপনি প্রোফেসর! তবে তো বুঝে-শুনে কথা বলতে হবে।
মামাবাবু বললেন, আপনি তো আমার ছাত্র নন যে, নম্বর কাটব। বরং আমি আপনার ছাত্র হতে রাজি আছি।
টেলর বললেন, দলবল বেঁধে এসেছেন যখন, তখন এখানে কিছু পাবার আশা আছে মনে হচ্ছে। কীসের ফসিল? অবশ্য ওই ব্যাপারে আমার বিশেষ উৎসাহ নেই।
মামাবাবু তাড়াতাড়ি বললেন, না, না, সঠিক কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে বেরোই্নি। আফ্রিকায় এসেছিলাম কয়েকটা লেকচার দিতে। স্রেফ কেতাবি বক্তৃতা। হাতে ক-দিন সময় পেলাম তাই বেরিয়ে পড়লাম। আফ্রিকা দেখা হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে সামান্য অনুসন্ধান। যদি লেগে যায় বরাতে, নাম-টাম হয়ে যায়! এত বয়সেও তো তেমন কিছু করে উঠতে পারলাম না। এই পাথরের স্তরটা দেখে মনে হল ফসিল থাকতে পারে। তাই খুঁড়ছি। আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলে কত বৈজ্ঞানিক প্রাগৈতিহাসিক যুগের জীব-জন্তুর ফসিল পেয়েছে। তবে আমার আসল লক্ষ্য প্রস্তরচিত্র। আদিম মানবের আঁকা ছবি।
মামাবাবুর আসল লক্ষ্য শুনে ব্রুস টেলরের মতো আমরাও চমকালাম, এ উদ্দেশ্য তো কখনও টের পাইনি। সুনন্দ ও আমি চোখাচোখি করলাম। বুঝলাম, টেলরের কাছে তার আগমনের উদ্দেশ্য চেপে যাচ্ছেন মামাবাবু।
টেলর চিন্তিতভাবে বললেন, রক-পেন্টিং? রকপেন্টিং তো উত্তরে আছে শুনেছি। টাঙ্গানিকার কলডোয়া, কিলোসা, ফেঙ্গা পর্বতে অনেক প্রাচীন চিত্র আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু এধারে কই–
মামাবাবু বলে ওঠেন, হ্যাঁ, এধারে পাওয়া যায়নি, সেই জন্যেই তো খুঁজছি। পেলে নাম হবে।
পেন্টিং আর কোথায় খুঁজছেন? আপাতত তো দেখছি ফসিলের সন্ধানে লেগে গেছেন। টেলরের কণ্ঠে যেন সামান্য রহস্য।
মামাবাবু হাসেন।দেখি কয়েকটা দিন এখানে কাজ করে। কিছু না পাই তো চলে যাব।
কোন দিকে যাবেন? টেলর বলেন।
ভাবছি দক্ষিণ-পশ্চিমে যাব।
দক্ষিণ-পশ্চিমে? টেলর যেন আঁতকে ওঠেন। তেসি বেল্টের মধ্য দিয়ে যাবেন? সাধ করে বিপদ ডেকে আনবেন? তাছাড়া ওদিকে কোনো রক-পেন্টিং আছে বলে তো জানি না। বরং সোজা পশ্চিমে যান। ওদিকে অনেক ছোটখাটো পাহাড় আছে। হয়তো পেন্টিং দেখতে পাবেন।
দক্ষিণ-পশ্চিমে বুঝি তেসি মাছির এলাকা? হুঁ। তাহলে তো বিপজ্জনক রাস্তা। মামাবাবু চিন্তিত হয়ে বললেন, আপনি ও-এলাকাটা চেনেন?
হ্যাঁ, কারণ আমি আপাতত তেসি ফ্লাই নিয়ে কিঞ্চিৎ গবেষণা করছি।
তাই নাকি? মামাবাবু উৎসাহিত হয়ে ওঠেন।
টেলর গম্ভীর স্বরে বলেন, টাঙ্গানিকার এই অভিশাপকে তাড়ানো যায় কিনা চেষ্টা করছি। আর এ ব্যাপারে ফেরোমন কতটা সাহায্য করতে পারে পরীক্ষা করছি।
মামাবাবু হঠাৎ বললেন, আপনি এখানে কি কোনো রিসার্চের কাজে রয়েছেন? কাছাকাছি কোথাও উঁবু ফেলেছেন?
টেলর বললেন, না, তেমন কোনো কাজে আসিনি। শ-খানেক মাইল দূরে এক তেসি ফ্রাইবেল্ট থেকে ফিরছিলাম, পথে রেস্ট নিচ্ছি। আর আশপাশের ঝোঁপগুলো পরীক্ষা করছি। কালই পাততাড়ি ওঠাতাম, তবে ইচ্ছে হচ্ছে আপনাদের যখন পেয়ে গেলাম, কাল একবার আড্ডা মারতে আসব। কথা বলার লোক পাই না। পরশু পালাব।
আপনার তাঁবু কোন দিকে?
ওই দিকে। মাইল দুই দূরে। আচ্ছা, আজ চলি। কাল আসব। টেলর যেন একটু ব্যস্ত। হয়ে পা বাড়ালেন। বোধহয় কোনো কাজের কথা মনে পড়ে গেল।
লম্বা লম্বা পা ফেলে টেলর ফিরে চললেন। শিলাস্তূপের গা ঘেঁষে বাঁক নেবার আগে একবার ফিরে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে হাত নাড়লেন। তারপর পাথরের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
সুনন্দ বলে উঠল, এর লেখাই সেদিন পড়ছিলেন, না মামাবাবু?
হ্যাঁ। অদ্ভুত লোক। দু-এক বছর আগেও কেউ এর নাম জানত না। পর পর কয়েকটা লেখায় বৈজ্ঞানিক মহলে আলোড়ন তুলে দিয়েছে। ভালো করে এর পরিচয়টা অবধি কেউ জানে না। তবে লেখা পড়ে মনে হয়, লোকটি অতি পণ্ডিত। দীর্ঘ সাধনা আছে। পঙ্গপালের ফেরোমন যে তাদের বংশবৃদ্ধির জন্য দায়ী, এ এক আশ্চর্য আবিষ্কার। আরও কয়েকটি কীটপতঙ্গের জীবনযাত্রায় তাদের ফেরোমন কীভাবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়, টেলর লেখায় তার উল্লেখ করেছেন। তবে বিশদভাবে কিছু বলেননি। লিখেছেন, তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এক্সপেরিমেন্ট শেষ হলে বিষয়টির ওপর একটি প্রামাণিক বই লিখবেন। পথিবীর অনেক বৈজ্ঞানিক টেলরের গবেষণার ফলাফল জানার জন্য সব অপেক্ষায় আছেন।
তাঁবুতে ফিরে দেখলাম, বিল আরাম করে কফি খাচ্ছেন। আমাদের দেখে চোরে উঠলেন।হ্যালো সায়ান্টিস্টস, তারপর, পাখির গ্রেট গ্রেট গ্রেট অ্যানসেসটরের ফসিলের হদিস মিলল?
মামাবাবু বললেন, অত সোজা নাকি? সময় লাগবে। আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?
একটা রাউন্ড মেরে এলাম মাইল কয়েক।
বিলকে টেলরের কথা বলা হল। কালকে আবার টেলর আসবেন শুনে বিল বললেন, খেয়েছে! ওসব বৈজ্ঞানিক আলোচনার মধ্যে আমি নেই। কাল আমি সন্ধের পর ফিরব।
আমরা আশ্বাস দিলাম, কোনো ভয় নেই। টেলর মোটেই খিটখিটে পণ্ডিত নন। দিব্বি হাসি-খুশি, আমুদে।
একা-একা ঘুরতে আপনার ভালো লাগে? একটা মতলব ছিল আমার প্রশ্নে। বিল বললেন, একজন সঙ্গী পেলে তো ভালোই লাগত। পাচ্ছি কই? তুমি আসবে?
মাথা নেড়ে সায় দিলাম। আসলে আমারও রোদে দাঁড়িয়ে পাথর কাটা দেখতে আগ্রহ ছিল না। বিলের সঙ্গে ঘোরায় কত মজা!
সুনন্দ আর কী করে! কটমট করে আমাকে দেখে নিল। কিন্তু সে প্রাণিবিজ্ঞানের ছাত্র। আমার মতো ফাঁকি দেওয়া তার শোভা পায় না।
রাত্তিরে খাবার সময় মামাবাবু বললেন, সবাই মনে রেখো আমাদের এখানে আগমনের আসল উদ্দেশ্য যেন টেলর টের না পায়।
কেন? টেলরকে জানাতে আপত্তি কীসের? আমি প্রশ্ন করলাম, উনি তো অন্য বিষয় নিয়ে কাজ করছেন। বললেন তো ফসিলের ব্যাপারে ওঁর আগ্রহ নেই।
মুখে বলছেন বটে, কিন্তু ওঁর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, বেশ আগ্রহ আছে। মিসিং-লিঙ্ক- এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ফসিল এখানে পাবার সম্ভাবনা আছে বলা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আমরা তো আপাতত কদিন পরে চলে যাব। হয়তো খালি হাতে ফিরতে হবে, তারপর উনি যদি এসে ফসিল খুঁজতে শুরু করেন?
বিল হো-হো করে হেসে উঠলেন। বাঃ, আপনারা বৈজ্ঞানিকরা তো সহজ মানুষ নন। কত লুকোচুরি!
হ্যাঁ,–-তা তো আছেই। বৈজ্ঞানিক জগতে জোচ্চুরির অভাব নেই। কত লোক অন্য লোকের গবেষণার ফল মেরে দিয়ে নিজের নামে প্রকাশ করে বিখ্যাত হয়ে গেছে। তাই সাবধান হতে হয়।