» » ফেরোমন

বর্ণাকার

অজেয় রায়

ফেরোমন

দশ

মামাবাবু টেলরকে প্রশ্ন করলেন, কার্লোর পেপার্স কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন?

আমি লুকোইনি। টেলরের মিষ্ট ভদ্রতার মুখোশ খসে পড়েছে। চোখে ক্রুর হিংস্র দৃষ্টি।

ও, ভালো কথায় কাজ হবে না। বেশ আপনার দাওয়াই আপনারই ওপর প্রয়োগ করব। দেখি, কথা বেরোয় কিনা? সুনন্দ অসিত, টেলরকে ওই গাছটার সঙ্গে বাঁধে।

ফেরোমন-এর শিশিতে সামান্য তলানি পড়েছিল। মামাবাবু তাতে খানিক জল মেশালেন। তারপর আমাদের তাঁবুর কাছে গেলেন।

তখন তাঁবুতে খোলা খাবার একটুকরোও অবশিষ্ট ছিল না। বিল একটা হরিণ মেরে। গাছে ঝুলিয়ে রেখেছিল। শুধু কঙ্কালটা দুলছে। তাঁবুর কাপড়টা অবধি কেটে কুটিকুটি করেছে ক্ষুধার্ত পিপীলিকারা।

মামাবাবু সাবধানে তাঁবুর কাছে গিয়ে পিপীলিকা ব্যুহের গা থেকে ফেরোমন ঢালতে ঢালতে পিছিয়ে এলেন। থামলেন টেলরের সামনে। তারপর সরে আমাদের কাছে এসে বললেন, দেখা যাক।

গভীর আগ্রহে লক্ষ করি। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম কয়েকটা পিঁপড়ে ফেরোমন-এর গল্প শুঁকে শুঁকে আস্তে আস্তে এগোচ্ছে। দেখতে দেখতে চারদিক থেকে দলে দলে পিঁপড়ে ছুটে এসে তাদের অনুসরণ করতে লাগল। কয়েক মিনিটের মধ্যে এক বিশাল বাহিনী ফেরোমনের গন্ধ বেয়ে সড়সড় করে এগিয়ে চলল। আন্তোনিও চট করে তার ক্যামেরা বাগিয়ে ধরল।

মামাবাবু বেশ দার্শনিকভাবে বলতে লাগলেন–বুঝলে অসিত, আর্মি-অ্যান্টরা হল যাযাবর। দল বেঁধে কেবল ঘোরে। দিনের বেলায় গাছ বা পাথরের ছায়ায় বিশ্রাম নেয়। রাতে পথ চলে। এদের আর এক নাম ড্রাইভার অ্যান্ট।

আঁ-আঁ! চমকে উঠে দেখি টেলর প্রাণপণে বাঁধন ছেড়বার চেষ্টা করছেন। তার বিস্ফারিত দৃষ্টি আগুয়ান পিঁপড়ে বাহিনীর ওপর নিবদ্ধ।

মামাবাবু বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে বললেন, আমি-অ্যান্ট-এর এই প্রজাতির নাম ডরিলাস। এদের সাউথ আমেরিকান জাতিভাইদের নাম হল অ্যাকিটন। এদের সম্বন্ধে অনেক গল্প আছে।

আমায় ছেড়ে দাও! আমি বলছি। টেলর আর্তনাদ করে ওঠে। পিঁপড়ের স্রোত তখন মাত্র হাত কুড়ি দূরে।

কোথায়?

গুদোম ঘরে, মাটির নিচে সিন্দুকে।

উত্তম। সুনন্দ, ওকে খুলে সরিয়ে আনো।

সুনন্দ বলল, মিস্টার আন্তোনিও, তুমি কখনও আর্মি-অ্যান্ট-এর ভোজের ছবি তুলেছ? দারুণ সাবজেক্ট। টেলর যদি অনুগ্রহ করেন–

খুলে দাও! টেলর উন্মাদের মতো চেঁচালো। পিঁপড়ে বাহিনী তখন দশ হাত তফাতে। সুনন্দ দ্রুত তার বাঁধন খুলে সরিয়ে আনল।

মামাবাবু বাকি ফেরোমনটুকু গাছের চারপাশে গোল করে ছড়িয়ে দিলেন। টেলরকে বললেন, আশা করি সত্যি কথা বলছেন। মিথ্যে হলে কিন্তু এবার নির্ঘাৎ আপনাকে পিঁপড়ের ভোজে লাগাব।

একটা মজার ব্যাপার দেখলাম। সারিবদ্ধ পিঁপড়েরা এসে গাছের গুঁড়ির চারধারে ক্রমাগত গোল হয়ে ঘুরতে শুরু করল। চক্কর খেয়েই চলেছে! কখন থামবে কে জানে!

গুদোমঘরের আবর্জনা সরিয়ে, মেঝের তক্তা উঠিয়ে সিন্দুক আবিষ্কার করতে দেরি হল । মস্ত সিন্দুক। অনেক খোপ। একটা খোপ খুলে মামাবাবু বললেন, এই যে পেয়েছি। তিনি ফাইলটা বাইরে-দাঁড়ানো কার্লোর হাতে দিলেন। ভিতরের কাগজপত্রে চোখ বুলিয়েই কার্লো, পেয়েছি, পেয়েছি বলে মামাবাবুকে আনন্দে জাপটে ধরলেন।

আমি দেখলাম, বিল সিন্দুকের অন্য খোপগুলো ঘাঁটছেন। কয়েকটা বড় বড় মোড়ক খুলে মন দিয়ে দেখলেন। ঘরের তাক ও কোণগুলো তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলেন। একটু পরে আমরা বেরিয়ে এলাম।

টেলরকে ল্যাবরেটরিতে একটা চেয়ারে বসিয়ে আমরা ঘিরে বসলাম। টেলরের মুখ ভাবলেশহীন। যেন বেকায়দা অবস্থাটা সে খানিক সামলে নিয়েছে। বলল, “আপনাদের কার্যসিদ্ধি হয়েছে। এবার আমায় ছেড়ে দিতে পারেন। মনে রাখবেন, আমার বিরুদ্ধে আপনাদের অভিযোগগুলো একটাও কোর্টে টিকবে না। বরং উল্টে আমি আপনাদের বিরুদ্ধে মানহানির মোকদ্দমা আনতে পারি।

উঃ, সাংঘাতিক লোক! কী নার্ভ! একটু হকচকিয়ে গেলাম।

বিলের গম্ভীর গলা শুনলাম–মিস্টার টেলর, আইন-কানুন সম্বন্ধে আপনার বেশ জ্ঞান আছে দেখছি। কিন্তু চোরা কোকেন-কারবারিকেও কি আইন ছেড়ে দেবে? কী বলেন?

টেলরের মুখ দেখলাম ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

মোহোরাতে আমার এক পুলিশ ইন্সপেক্টর বন্ধু বলেছিল, টাঙ্গানিকায় চোরা কোকেন। চালান খুব বেড়ে গেছে। দলটাকে কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না। এদের ব্রেন একজন শ্বেতাঙ্গ। দলের খুব কম লোক তাকে চেনে। বিখ্যাত  বৈজ্ঞানিক টেলর বোধহয় সেই লোক। কি, ঠিক বলছি?

টেলর রেগে বললেন, আমায় মিথ্যে মামলায় জড়াবার চেষ্টা করছেন।

বেশ বেশ, পুলিশ আসুক। গুদোম-ঘর সার্চ করুক। তারপর আমার কথার সত্যি-মিথ্যে তারা বিচার করবে। টেলর গোঁজ মেরে বসে রইল।

টেলরকে একটা খালি ঘরে বন্দী করে বাইরে থেকে তালা দেওয়া হল।

মামাবাবু কার্লোকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এখন কী করবেন?

ভাবছি ফিরে যাব। আপনারা কবে ফিরছেন?

আপনি সঙ্গে গেলে এখুনি ফিরতে পারি।

বেশ তাই যাব। আমার কাজ প্রায় শেষ। বাকিটুকু না হয় নাইরোবিতে বসে করব। সেখানে মার্টিন নামে এক ছোকরা প্রাণিবিজ্ঞানী আছে। বহুবার সে আমার অধীনে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাকে অ্যাসিস্ট্যান্ট করে নেব। আচ্ছা ঘোষ, এই ল্যাবরেটরির কী হবে?

কেন, যা-যা দরকারি জিনিস আছে সঙ্গে নিয়ে চলুন।

কিন্তু এসব তো টেলরের সম্পত্তি।

তাতে কী হয়েছে? টেলর আপনাকে ঠকাতে চেয়েছিল। তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বৈকি! মামাবাবু নির্বিকারভাবে মন্তব্য করলেন।

পরদিন সকালে টেলরের ঘর খুলে দেখা গেল, পাখি পালিয়েছে। ঘর ফাঁকা। আবিষ্কার হল, ঘর থেকে পাঁচিলের বাইরে অবধি এক গোপন সুড়ঙ্গপথ। বিল আপশোস করলেন, ঘরটা পরীক্ষা করে দেখা উচিত ছিল।

সুনন্দর মন খারাপ হয়ে গেল। ইস, লোকটাকে শাস্তি দেওয়া গেল না। এত বড় জোচ্চোর! তার ওপর আমাদের মারার চেষ্টা করেছিল।

বিল সুনন্দর পিঠ চাপড়ে বললেন, ব্রাদার, শাস্তি ও পাবে। আর কোনো দিন টেলর সভ্যজগতে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে না। জেলের ভয়ে পালিয়ে বেড়াবে। হয়তো ধরাও পড়বে। এও কি কম শাস্তি?

ঠিক হল, এখান থেকে আমরা যাব সেই খাদের কাছে। যে কদিন হাতে সময় অন্য ফসিলের অনুসন্ধান করব। বিল পোটার জোগাড় করে ফেললেন। গোসাপ দেবতার বাপারটা ছিল টেলরের কারসাজি। স্থানীয় লোকদের সে ভয় দেখিয়ে রেখেছিল, যাতে তারা খাদে খোঁড়াখুঁড়ি করতে রাজি না হয়। টেলর পালিয়ে যেতে তাদের ভয় ভেঙে গেল।

মামাবাবুর সঙ্গে কার্লোও মহা উৎসাহে ফসিলের সন্ধানে লেগে গেলেন। কয়েকটি দুষ্প্রাপ্য ফসিল উদ্ধার হল কিন্তু দুঃখের বিষয়, মামাবাবু যে ফসিলটি খুঁজতে এসেছিলেন তা পাওয়া গেল না।

ছ-দিন পর আমরা ডার-এস-সালাম ফিরে যাবার জন্য তাঁবু ওঠালাম।

ফসিল পেলেন না বলে মামাবাবুর দেখলাম মোটেই দুঃখ নেই। আমি সমবেদনা জানাতে গিয়েছিলাম। হেসে বললেন, আরে, এসব আবিষ্কার কি সহজে হয়! লাক চাই। কেউ সারা জীবন খুঁজেও পায় না, আবার কেউ দুদিনেই আবিষ্কার করে ফেলে। তবে হার মানছি না, পরের বছর আবার আসব। আর, শূন্য হাতে ফিরছি কে বলল? এত বড় একটা আবিষ্কার করে ফেললাম যে!

কী আবিষ্কার? আমার ধাঁধা লাগে।

কেন, ব্রুস টেলরের প্রকৃত পরিচয় আবিষ্কার করলাম। এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র ফাস করে দিলাম। আর ফাউ হিসাবে কেমন এক অ্যাডভেঞ্চার জুটে গেল বরাতে।

তা বটে! সুনন্দ সায় দিল, আফ্রিকায় আমাদের দ্বিতীয় অ্যাডভেঞ্চারটা ভালোই হল! আমি বললাম, যদিও কিঞ্চিৎ বিপজ্জনক!

আন্তোনিও আমাদের অনেক দূর অবধি পৌঁছে দিল। তারপর একজন পোর্টার সঙ্গে নিয়ে বিদায় নিল। তাকে যেন একটু মনমরা দেখাচ্ছিল। যাবার আগে বিনা অনুরোধে আমাদের সবাইকার ফোটো তুলে সে একগাদা ফিল্ম নষ্ট করে ফেলল!