সপ্তম পরিচ্ছেদ—স্থূল কথা1
বাঙ্গালী জাতির উৎপত্তির অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইয়া আমরা যাহা পাইয়াছি, তাহার পুনরুক্তি করিতেছি।
ভাষাবিজ্ঞানের সাহায্যে ইহা স্থিরীকৃত হইয়াছে যে, ভারতীয় এবং ইউরোপীয় প্রধান জাতিসকল এক প্রাচীন আর্য্যবংশ হইতে উৎপন্ন। যাহার ভাষা আর্য্যভাষা, সেই আর্য্যবংশীয় বাঙ্গালীর ভাষা আর্য্যভাষা, এজন্য বাঙ্গালী আর্য্যবংশীয় জাতি।
কিন্তু বাঙ্গালী অমিশ্রিত বা বিশুদ্ধ আর্য্য নহে। ব্রাহ্মণ অমিশ্রিত এবং বিশুদ্ধ আর্য্য সন্দেহ নাই; কেন না, ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণ হইতেই উৎপত্তি ভিন্ন সঙ্করত্ব সম্ভবে না, সঙ্করত্ব ঘটিলে ব্রাহ্মণত্ব যায়। বিশুদ্ধ ক্ষত্রিয় বৈশ্য সম্বন্ধে ঐরূপ হইলে হইতে পারে, কিন্তু ক্ষত্রিয় বৈশ্য যে, বাঙ্গালায় নাই বলিলেই হয়। অতি অল্পসংখ্যক বৈদ্য ও বণিক্দিগকে বাদ দিলে দেখা যায় যে, বাঙ্গালী কেবল দুই ভাগে বিভক্ত, ব্রাহ্মণ ও শূদ্র। ব্রাহ্মণ বিশুদ্ধ আর্য্য, কিন্তু শূদ্রদিগকে বিশুদ্ধ আর্য্য, কি বিশুদ্ধ অনার্য্য বিবেচনা করিব, কি মিশ্রিত বিবেচনা করিব, ইহারই বিচার আমরা এতদূর বিস্তারিত করিয়াছি। কেন না, বাঙ্গালী জাতির মধ্যে সংখ্যায় শূদ্রই প্রধান।2
অনুসন্ধানে ইহাও পাওয়া গিয়াছে যে, আর্য্যেরা দেশান্তর হইতে বাঙ্গালায় আসিয়াছিলেন। তখন আমরা এই তত্ত্ব উত্থাপন করিয়াছিলাম যে, তাঁহারা আসিবার পূর্ব্বে বাঙ্গালায় বসতি ছিল কি না?
বিচারে পাওয়া গিয়াছে যে, আর্য্যেরা বাঙ্গালায় আসিবার পূর্ব্বে বাঙ্গালায় অনার্য্যদিগের বাস ছিল। তারপর দেখিয়াছি যে, সেই অনার্য্যগণ একবংশীয় নহে। কতকগুলি কোলবংশীয়, আর কতকগুলি দ্রাবিড়বংশীয়। দ্রাবিড়বংশের পূর্ব্বে কোলবংশীয়েরা বাঙ্গালার অধিকারী ছিল। তারপর দ্রাবিড়বংশীয়েরা আইসে। পরে আর্য্যগণ আসিয়া বাঙ্গালা অধিকার করিলে কোলীয় ও দ্রাবিড়ী অনার্য্যগণ তাঁহাদিগের তাড়নায় পলায়ন করিয়া বন্য পার্ব্বত্য প্রদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে।
কিন্তু সকল অনার্য্যই আর্য্যের তাড়নায় বাঙ্গালা হইতে পলাইয়া বন্য ও পার্ব্বত্য দেশে আশ্রয় লইয়াছিল, এমত নহে; আমরা দেখিয়াছি যে, অনার্য্যগণ আর্য্যের সংঘর্ষণে পড়িলে আর্য্যধর্ম্ম ও আর্য্যভাষা গ্রহণ করিয়া হিন্দুজাতি বলিয়া গণ্য হইয়া হিন্দুসমাজভুক্ত হইতে পারে, হইয়াছিল ও হইতেছে। অতএব বাঙ্গালী শূদ্রদিগের মধ্যে এইরূপে হিন্দুত্বপ্রাপ্ত অনার্য্য থাকা অসম্ভব নহে। আছে কি না—তাহার প্রমাণ খুঁজিয়া দেখিয়াছি।
দেখিয়াছি যে, বাঙ্গালা ভাষার এমন একটি ভাগ আছে যে, অনার্য্যভাষাই তাহার মূল বলিয়া বোধ হয়। আরও দেখিয়াছি যে, বাঙ্গালী শূদ্রদিগের মধ্যে এমন অনেকগুলি জাতি আছে যে, অনার্য্যগণকে তাহাদের পূর্ব্বপুরুষ বলিয়া বোধ হয়।
পরিশেষে ইহাও প্রমাণ করা গিয়াছে যে, বাঙ্গালী শূদ্রের কিয়দংশ অনার্য্যসম্ভূত হইলেও অপরাংশ আর্য্যবংশীয়। কেহ বিশুদ্ধ আর্য্য, যেমন অম্বষ্ঠ, কায়স্থ; কেহ আর্য্য অনার্য্য উভয়কুলজাত, যেমন চণ্ডাল।
এক্ষণে এই বাঙ্গালী জাতি কি প্রকারে উৎপন্ন হইল, তাহা আমরা বুঝিয়াছি। প্রথম কোলবংশীয় অনার্য্য, তারপর দ্রাবিড়বংশীয় অনার্য্য, তারপর আর্য্য; এই তিনে মিশিয়া আধুনিক বাঙ্গালী জাতির উৎপত্তি হইয়াছে। সাক্সন্, ডেন্ ও নর্ম্মান্ মিশিয়া ইংরেজ জন্মিয়াছে। কিন্তু ইংরেজের গঠনে ও বাঙ্গালীর গঠনে দুইটি বিশেষ প্রভেদ আছে। টিউটন্ হউক বা নির্ম্মাণ হউক যতগুলি জাতির সংমিশ্রণে ইংরেজ জাতি প্রস্তুত হইয়াছে, সকলগুলিই আর্য্যবংশীয়। বাঙ্গালী যে কয়েকটি জাতিতে গঠিত হইয়াছে, তাহার কেহ আর্য্য, কেহ অনার্য্য। দ্বিতীয় প্রভেদ এই যে, ইংলণ্ডে টিউটন্ ও ডেন্ ও নর্ম্মান্, এই তিন জাতির রক্ত একত্রে মিশিয়াছে। পরস্পরের সহিত বিবাহাদি সম্বন্ধের দ্বারা মিলিত হইয়া তাহাদিগের পার্থক্য লুপ্ত হইয়াছে। তিনে এক জাতি দাঁড়াইয়াছে, বাছিয়া তিনটি পৃথক্ করিবার উপায় নাই। মোটের উপর এক ইংরেজজাতি কেবল পাওয়া যায়। কিন্তু ভারতীয় আর্য্যদিগের বর্ণধর্ম্মিত্বহেতু বাঙ্গালায় তিনটি পৃথক্ স্রোত মিশিয়া একটি প্রবল প্রবাহে পরিণত হয় নাই; আর্য্যসম্ভূত ব্রাহ্মণ অনার্য্যসম্ভূত অন্য জাতি হইতে সম্পূর্ণ পৃথক্ রহিয়াছেন। যদি কোন স্থানে আর্য্যে অনার্য্যে বৈধ বিবাহ বা অবৈধ সংসর্গের দ্বারা সংমিশ্রণ ঘটিয়াছে, সেখানে সেই সংমিশ্রণে উৎপন্ন সন্তানেরা আর্য্য অনার্য্য হইতে আর একটি পৃথক্ জাতি হইয়া রহিয়াছে। চণ্ডালেরা ইহার উদাহরণ। ইংরেজ একজাতি, বাঙ্গালীরা বহুজাতি। বাস্তবিক এক্ষণে যাহাদিগকে আমরা বাঙ্গালী বলি, তাহাদিগের মধ্যে চারি প্রকার বাঙ্গালী পাই। এক আর্য্য, দ্বিতীয় অনার্য্য হিন্দু, তৃতীয় আর্য্যান্যার্য্য হিন্দু, আর তিনের বার এক চতুর্থ জাতি বাঙ্গালী মুসলমান। চারি ভাগ পরস্পর হইতে পৃথক্ থাকে। বাঙ্গালীসমাজের নিম্নস্তরেই বাঙ্গালী অনার্য্য বা মিশ্রিত আর্য্য ও বাঙ্গালী মুসলমান; উপরের স্তরে প্রায় কেবল আর্য্য। এই জন্যে দূর হইতে দেখিতে বাঙ্গালীজাতি অমিশ্রিত আর্য্যজাতি বলিয়াই বোধ হয় এবং বাঙ্গালার ইতিহাস এক আর্য্যবংশীয় জাতির ইতিহাস বলিয়া লিখিত হয়।