নবম পরিচ্ছেদ
বিশ্রম্ভালাপে
জোহেরা কোমল বাহুদুটি প্রসারণ করিয়া সবেগে মজিদের কণ্ঠ বেষ্টন করিয়া ধরিল। মজিদ সাগ্রহে জোহেরার সুন্দর মুখখানি লইয়া তদুপরি দুইটী চুম্বনরেখা অঙ্কিত করিয়া দিলেন। জোহেরা অনেকক্ষণ বাহ্যজ্ঞানপরিশূন্যা হইয়া রহিল। এইরূপে তাঁহাদিগের বিবাদ একেবারে মিটিয়া গেল। তাহার পর উভয় প্রেমিক-প্রেমিকার প্রেমালাপে কত কথাই হইল—কত প্রাণের কথা—কত মানাভিমানের কথা, কত বিরহের কথা, বালক শ্রীশচন্দ্র তাহার একটি বর্ণও হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিল না; এবং যুক্তাক্ষরসঙ্কুল বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগের ন্যায় তাহা শ্রীশচন্দের নিকটে একান্ত কঠিন ও দুর্ব্বোধ্য অনুমিত হইল।
তাহার পর মজিদ খাঁ পুনরায় নিজের কাজের কথা পাড়িলেন। এখন বিপদের বজ্র তাঁহার মাথার উপর ছুটিতেছে। তিনি বুঝিয়াছিলেন, নিশ্চিন্তে প্রেমালাপের সময় ইহা নহে। বলিলেন, “জান কি জোহেরা, গত বুধবার রাত্রে সৃজান বিবি কখন কোথায় গিয়াছিল, কোথায় কি করিয়াছিল?”
জোহেরা বলিল, “কিছু কিছু খবর আমি বলিতে পারি। সেদিন রাজাব-আলির বাড়ীতে আমাদিগের নিমন্ত্রণ ছিল। সৃজান আর আমি দুইজনেই একসঙ্গে সেখানে যাই।”
ম। কখন গিয়াছিলে?
জো। রাত নয়টার পর।
ম। রাজাব-আলির বাড়ী হইতে কখন তোমরা ফিরিয়া আসিলে?
জো। সৃজান বিবির মাথা ধরায় বেশিক্ষণ সেখানে আমরা থাকিতে পারি নাই। রাত সাড়ে দশটার সময়ে আমরা সেখান হইতে চলিয়া আসিলাম।
ম। বাড়ীতে ফিরিয়া সৃজান বিবি কি করিল?
জো। তাহার সহিত দেখা করিবার জন্য একটি স্ত্রীলোক অপেক্ষা করিতেছিল। সৃজান বিবি তখনই তাহার সহিত দেখা করিতে গেল।
ম। (সবিস্ময়ে) স্ত্রীলোক! কে সে?
জো। তা’ আমি ঠিক জানি না। তাহাকে আমি দেখি নাই। তাহার পর সৃজান বিবির সহিত আমার আর দেখা হয় নাই। বোধ হয়, সেই স্ত্রীলোকটি মনিরুদ্দীনের কোন সংবাদ আনিয়া থাকিবে। রাত সাড়ে এগারটার সময়ে সে চলিয়া যায়।
ম। কিরূপে জানিলে।
জো। সাখিয়ার মুখে শুনিয়াছি।
ম। সাখিয়া কে?
জো। সৃজান বিবির বাঁদী।
ম। তাহার কাছে আর কি শুনিয়াছ? মুন্সী জোহিরুদ্দীন সাহেব তখন কোথায় ছিলেন?
জো। তখন তিনি বাড়ীতে ছিলেন না; কোন কাজে তিনি বাহিরে গিয়াছিলেন; রাত বারটার সময়ে তিনি ফিরিয়া আসেন। জানিতে পারিয়া, সৃজান বিবি অভিমানের ভাণে তখন অন্য একটা ঘরে গিয়া দ্বাররুদ্ধ করিয়া শয়ন করে। তাহার পর সে কখন উঠিয়া চলিয়া গিয়াছে, কেহ তাহা জানে না। বোধ হয় শেষ রাত্রিতে, সৃজান বিবি পলাইয়া গিয়াছে।
ম। কাহারও জন্য কোন পত্র রাখিয়া গিয়াছিল?
জো। তাহা আমি ঠিক জানি না। কেন মজিদ, এ সকল কথা তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছ?
ম। ফাঁসীর দড়ী থেকে নিজের গলাটা বাঁচাইবার জন্য, আর কেন? আমি বিভ্রাটে পড়িয়াছি; জোহেরা! কি করিব, কিছুই ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিতেছি না। শুনিলাম, মেহেদী-বাগানে যে স্ত্রীলোকটি খুন হইয়াছে, তাহার নাম দিলজান। সে মনিরুদ্দীনের রক্ষিতা। গত বুধবার সন্ধ্যার পূর্ব্বে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে তাহাকে আমি একবার দেখিয়াছিলাম। সেইদিনই রাত এগারটার পর সেখানে আমার সহিত আর একটি স্ত্রীলোকের দেখা হইয়াছিল। দেবেন্দ্রবিজয়ের ধারণা, রাত্রে যাহার সহিত আমার দেখা হইয়াছিল, সে স্ত্রীলোক দিলজান ভিন্ন আর কেহই নহে; কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সে দিলজান নহে। সেইদিন রাত বারটার সময়ে আমি মনিরুদ্দীনের বাড়ী হইতে বাহির হইয়া যাই। মেহেদী-বাগানেই আমাকে যাইতে হইয়াছিল; সেইখানে মোবারক উদ্দীনের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। যেখানে সাক্ষাৎ হয়, তাহার অল্পদূরেই দিলজানের লাস পাওয়া গিয়াছে। যদি এখন আমি এই হত্যাপরাধে ধৃত হই, ঘটনাচক্রে আমাকেই দোষী হইতে হইবে। রাত্রে আমার সহিত যে, দিলজানের আর দেখা হয় নাই, এ কথা আমি কিছুতেই সপ্রমাণ করিতে পারিব না—কেহই ইহা বিশ্বাস করিবে না। প্রতিজ্ঞালঙ্ঘন ভিন্ন তখন নিজের নির্দ্দোষতা সপ্রমাণ করিবার আর কোন উপায়ই থাকিবে না।
জো। সকলই বুঝিলাম; কিন্তু ইহাতে সৃজান বিবির কি সংশ্রব আছে, বুঝিতে পারিলাম না।
ম। না, তা’, আমি মনে করি নাই। (চিন্তিতভাবে) প্রকৃতপক্ষে তা’ আমি মনে করি নাই। তবে আমি জানিতে চাই, মনিরুদ্দীন সে রাত্রে কখন কোথায় ছিল—কি করিয়াছিল—কোথায় গিয়াছিল, এ সকল সংবাদ সংগ্রহ করা এখন আমার অত্যন্ত দরকার হইতেছে। আমি এখন ঘটনাচক্রে কিরূপ অবস্থাধীন হইয়া পড়িয়াছি, কি গুরুতর বিপদ্ চারিদিক্ হইতে আমাকে গ্রাস করিবার জন্য ব্যগ্র হইয়া উঠিয়াছে—বুঝিতে পার নাই কি? যদি আমি এখন ধরা পড়ি, অথচ মনিরুদ্দীন ফিরিয়া না আসে, তাহা হইলে আর আমার নিস্তার নাই।
জো। কেন?
ম। মনিরুদ্দীন ফিরিয়া না আসিলে, কিছুতেই আমি নিজেকে নির্দ্দোষ বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে পারিব না।
জো। তুমি কি সত্যই নির্দ্দোষ?
ম। আমাকে কি সন্দেহ হয়?
জো। না।
ম। তবে আর বেশি কিছু জিজ্ঞাসা করিয়ো না।
তাহার পর অন্যান্য দুই-একটি কথার পর মজিদ খাঁ বিদায় গ্রহণ করিলেন। জোহেরা দ্রুতপদে বাটীমধ্যে প্রবেশ করিল। এবং শ্রীশচন্দ্র অত্যন্ত উৎসাহের সহিত দেবেন্দ্রবিজয়ের সহিত দেখা করিতে ছুটিল।