চতুর্থ পরিচ্ছেদ
সন্দেহ প্রবল হইল
দেবেন্দ্রবিজয় কিছুদূর গিয়াছেন, এমন সময়ে দেখিলেন, হামিদা বিবি একখানি কাগজে অঞ্চলাগ্রে বাঁধিতে বাঁধিতে বাটীর বাহির হইল। দেখিয়া দেবেন্দ্রবিজয় মনে করিলেন, খুব সম্ভব, ইহা মজিদের পত্র। দেখিতে হইবে, পত্রখানি কোন্ উদ্দেশ্যে, কাহার নামে, কোথায় যাইতেছে।
যেদিকে হামিদা বিবি যাইতেছিল, সেইদিক্কার পথে, সহজে ঠাহর হয়, এমন জায়গায় একটি টাকা ফেলিয়া দিয়া দেবেন্দ্রবিজয় কিছুদূরে গিয়া দাঁড়াইলেন। পথ চলিতে চলিতে হামিদা বিবি পথিমধ্যে সেই টাকাটিকে অভিভাবকশুন্য দেখিয়া তুলিয়া লইল। দেবেন্দ্রবিজয় দূর হইতে তাহা দেখিয়া হামিদা বিবির নিকটে ছুটিয়া আসিয়া বলিলেন, “কে রে মাগী তুই, দে আমার নোট দে—টাকা দে—আমার নোট আর টাকা হারিয়েছে।”
বৃদ্ধা হামিদা বিবি থতমত খাইয়া বাহির করিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের হাতে দিয়া বলিল, “এই বাবু, তোমার টাকা।”
দেবেন্দ্রবিজয় গলাবাজি করিয়া বলিলেন “নোট—আমার নোট কোথা? তুই মাগী নিয়েছিস্। চালাকি বটে! এখনই থানায় চালান্ দিব, জান না বটে?”
হামিদা বিবিও তদপেক্ষা গলাবাজি করিতে জানে। আঘাতপ্রাপ্ত কাংস্যপাত্রের ন্যায় তাহার কণ্ঠ ঝন্ঝন করিয়া উঠিল; বলিল, “আ মর্ মিন্সে! মর্বার আর জায়গা পাও না— পথের মধ্যে বেইজ্জৎ করতে এসেছ। তোমার নোট কোথা, তা’ আমি কি জানি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আমি নিজের চোখে তোকে নোট তুলে নিতে দেখেছি, এখন, ‘কি জানি’ বল্লে চল্বে না। ঐ যে মাগী, এরই মধ্যে আঁচলে বেঁধে ফেলেছিস্। বেশী চালাকী কর্লে এখনই পাহারাওয়ালা ডেকে হাজির করব।”
হামিদা বুড়ী রাগিয়া, চোখমুখ কপালে তুলিয়া, অস্থির হইয়া উঠিল, “আসুক না পাহারাওয়ালা—পাহারাওয়ালার নিকুচি করেছে! আমি সেই ভয়ে ম’রে গেলুম আর কি! আমি নোট নিয়েছি, এখানা কি তোমার নোট? চোখের মাথা একেবারে খেয়েছ? বলিয়া তাড়াতাড়ি আঁচল হইতে সেই পত্রখানা বাহির করিয়া ফেলিল।
“কই দেখি, কেমন নোট কি না,” বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় সেই পত্রখানি হামিদা বিবির হাত হইতে টানিয়া লইলেন। পত্রখানি খামে বন্ধ না থাকায় দেবেন্দ্রবিজয়ের সুবিধা হইল। ভাঁজগুলি তাড়াতাড়ি খুলিয়া ফেলিয়া দেখিলেন, দুই-তিন ছত্রমাত্র লিপিবদ্ধ। খুলিতে-না-খুলিতে পাঠ শেষ হইয়া গেল। লিখিত ছিল:—
“জোহেরা,
আমি অত্যন্ত বিপদ্গ্রস্ত। অদ্য সন্ধ্যার পর তোমাদের বাগানে অতি অবশ্য আমার সহিত গোপনে দেখা করিবে—কথা আছে।
মজিদ।”
দেবেন্দ্রবিজয় পত্রখানি হামিদাকে ফেরৎ দিয়া বলিলেন, “না গো, কিছু মনে ক’রো না—আমারই ভুল হয়েছে— তুমি ভাল মানুষের মেয়ে— তুমি কেন নোট নিতে যাবে? টাকাটি পেয়েছিলে, তখনই আমাকে ফেরৎ দিলে— তা’ কিছু মনে ক’রো না।”
হামিদা বিবি দেবেন্দ্রবিজয়ের মিষ্টবাক্যে একেবারে দ্রবীভূত হইয়া গেল। পত্রখানি আঁচলে বাঁধিতে বাঁধিতে বলিল, “না মনে আর কর্ব কি? টাকা খোয়া গেলে সকলেরই গায়ের জ্বালা হয়— গায়ের জ্বালায় দু’কথা যাকে তাকে ব’লেও ফেলে— সে কথা কি আর মনে করতে আছে, বাপু?” বলিয়া হামিদা বিবি নিজের পথ দেখিল।
দেবেন্দ্রবিজয় চিন্তিতভাবে আপন মনে বলিলেন, “জোহেরার সহিত মজিদের কি কথা আছে? জোহেরার সহিত মজিদের বিবাহ হইবে, শুনিয়াছি। আজ সন্ধ্যার পর কোন্ অভিপ্রায়ে মজিদ গোপনে তাহার সহিত দেখা করিবে, তাহাও আমাকে দেখিতে হইবে; কিন্তু নিজের দ্বারা সে কাজ হইবে না— মজিদ আমাকে চিনে। শ্রীশের দ্বারা কাজটা যাহাতে ঠিক করিয়া লইতে পারি, সেই চেষ্টা দেখিতে হইবে।”