অষ্টম পরিছেদ
উদ্যানে
মনিরুদ্দীন সৃজান বিবিকে লইয়া নিরুদ্দেশ হইয়াছেন; কিছুদিন পরে যখন জোহিরুদ্দীন ইহা জানিতে পারিলেন; তখন তাঁহার সুর একেবারে বদলাইয়া গেল। এ সময়ে যদি জোহেরা তাহার অভিভাবকের নিকটে মজিদকে বিবাহ করিবার প্রস্তাব উপস্থিত করিতে পারিত, তিনি নিশ্চয়ই জোহেরাকে নিজের অপেক্ষা বুদ্ধিমতী জ্ঞান করিতেন—আর অন্যমত করিতে পারিতেন না।
এই বৃদ্ধ বয়সে অপমানে, ঘৃণায় মুন্সী জোহিরুদ্দীনের মাথটা যেন কাটা গেল; তিনি একেবারে মুমূর্ষুর মত হইয়া পড়িলেন। তিনি আর বাটীর বাহির হইতেন না। কাহারও সহিত দেখা করিতেন না। তিনি সৃজান বিবিকে অত্যন্ত ভালবাসিতেন; যাহাকে একদণ্ড চোখের অন্তরাল করিতে প্রাণ চাহিত না, সে আজ এই বিশ্বাসঘাতকতা করিল! আর মনিরুদ্দীন যে তাঁহার বুকে এমনভাবে বিষমাখা বাঁকা ছুরিকা বসাইবে, তাহাও তিনি একবার স্বপ্নেও ভাবেন নাই।
জোহেরাও ইহাতে অত্যন্ত অপমান বোধ করিল। যদিও সৃজান তাহার কোন আত্মীয়া নহে; তথাপি সে তাহার অভিভাবকের বিবাহিতা পত্নী এবং সকলের এক বাটীতে বাস। পাছে কাহারও সহিত দেখা হইলে কেহ এই সকল কথা উত্থাপন করে, এই ভয়ে জোহেরাও আর বাড়ীর বাহির হইত না; এবং কাহারও সহিত দেখা করিত না। কেবল মজিদকে কয়েকবার আসিবার জন্য গোপনে পত্র লিখিয়াছিল। পত্রত্তোরে একটা-না-একটা অজুহত দেখাইয়া মজিদ নিশ্চিত হইলেন; আসিতে পারিলেন না। জোহেরা মজিদের এরূপ ভাব বৈলক্ষণ্যের কারণ বুঝিতে না পারিয়া, অত্যন্ত চিন্তিত ও বিমর্ষ হইল। যখন জোহেরার মনের এইরূপ অবস্থা, এমন সময়ে মজিদের প্রেরিত সেই পত্র তাহার হস্তগত হইল। এ পত্রে মজিদ তাহাকে রাত্রে গোপনে তাঁহার সহিত দেখা করিবার জন্য অনুরোধ করিতেছেন। তিনি নিজেই আজ দেখা করিতে আসিতেছেন। ইহার অর্থ কি? জোহেরা পত্র পড়িয়া আরও চিন্তিত হইল। এবং মজিদের সহিত দেখা করিবার জন্য তাহার মন নিরতিশ্রয় ব্যগ্র হইয়া উঠিল।
বাটীর পশ্চাদ্ভাগে প্রকাণ্ড উদ্যান। জোহেরা যথাসময়ে সেই উদ্যানে প্রবেশ করিল। কিছুদূর গিয়া দেখিল, পুষ্করিণীর নিকটে লতামণ্ডপ পার্শ্বে মজিদ খাঁ দাঁড়াইয়া। পরে পরষ্পর সাক্ষাৎ হইল; এবং নির্জ্জন স্থান পাইয়া নির্ভয়ে স্বাভাবিক স্বরে কথোপকথন আরম্ভ করিয়া দিলেন। তাঁহারা ঘুণাক্ষরে জানিতে পারিলেন না, বাহিরে অন্তরালে দাঁড়াইয়া দেবেন্দ্রবিজয়-প্রেরিত শ্রীশচন্দ্র নামক একটি চতুর বালক অত্যন্ত মনোযোগের সহিত তাঁহাদিগের কথোপকথন শ্রবণ করিতেছে।
যখন মজিদ এখানে আসিতেছিলেন, পথে দেবেন্দ্রবিজয় শ্রীশকে দূর হইতে তাঁহাকে দেখাইয়া দিয়াছিলেন। শ্রীশচন্দ্র অলক্ষ্যে মজিদের অনুসরণে বাগানের মধ্যে আসিয়া যথাস্থানে লুক্কায়িতভাবে অপেক্ষা করিতেছিল।
রাত্রি প্রহরাতীত। চন্দ্রোদয়ে চারিদিকে জ্যোৎস্না ফুটিয়াছে। বড় অনুজ্জ্বল জ্যোৎস্না; কিন্তু তাহা বিশ্বজগতের স্বপ্নময় আবরণের মত বড় মধুর! মলিন জ্যোৎস্নামণ্ডিত আকাশের স্থানে স্থানে তরল মেঘখণ্ড রহিয়াছে—ম্রিয়মাণ চন্দ্রের ম্লান কিরণে শুভ্রকায় মেঘ-সন্ততিগুলি স্নান করিতেছে। বিমলিনজ্যোৎস্নার-গুণ্ঠনমণ্ডিতা নিসর্গসুন্দরী মৃদুহাস্যে উর্দ্ধনেত্রে সেইদিকে চাহিয়া রহিয়াছে। ঝিল্লিরবে সেই বিজন উদ্যানভূমি মুখরিত। অগণ্য-তরুলতা-ফলপুষ্পবিশোভিত উদ্যানভূমি ছায়ালোক-চিত্রিত হইয়া সুচিত্রকর-অঙ্কিত একখানি উৎকৃষ্ট চিত্রের ন্যায় প্রতীয়মান হইতেছে। সম্মুখে স্বচ্ছ দর্পণের ন্যায় নীলজলপূর্ণ প্রকাণ্ড দীর্ঘিকা অনেকদূর পর্য্যন্ত বিস্তৃত রহিয়াছে; এবং তাহার উর্ম্মি চঞ্চল বক্ষে চন্দ্রকর-লেখা খেলা করিতেছে। যে লতাবিতানে বসিয়া মজিদ ও জোহেরা কথোপকথন করিতেছিল, সেখানে পত্রান্তরাল ভেদ করিয়া চন্দ্রকিরণ প্রবেশ করায় ঈষদালোক সঞ্চিত হইয়াছিল। সেই ঈষদালোকে শ্রীশ বহির হইতেও লতামণ্ডপমধ্যবর্ত্তী দুইজনকে দেখিতে পাইতেছিল। কিরূপ ভাবে হাত-মুখ নাড়িয়া, কোন্ কথা কিরূপ ভঙ্গীতে তাঁহারা বলিতেছিল, শ্রীশ তাহাও নিবিষ্টচিত্তে লক্ষ্য করিতেছিল। ইতিপূর্ব্বে লতামণ্ডপের বাহিরে দাঁড়াইয়া তাঁহাদিগের কি কথাবার্ত্তা হইয়াছিল, তাহা শ্রীশ শুনিবার জন্য সুবিধা করিতে পারে নাই। লতামণ্ডপমধ্যে প্রবেশ করিয়া তদুভয়ে যাহা বলাবলি করিতে লাগিলেন, শ্রীশ তাহার প্রত্যেক শব্দটি যেন গলাধঃকরণ করিতে লাগিল।
লতামণ্ডপ মধ্যস্থ শিলাখণ্ডের উপরে বসিয়া জোহেরা জিজ্ঞাসা করিল, “তাহা হইলে তোমার উপরেই কি লোকটার সন্দেহ হইতেছে?”
বিষণ্ণভাবে মজিদ বলিলেন, “আমার ত তাহাই বোধ হয়। দেবেন্দ্রবিজয় লোকটা বড় সহজ নহে। আমি যে কিরূপে আত্মপক্ষ-সমর্থন করিব, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। দায়ে পড়িয়া আমাকে মুখবন্ধ করিয়া থাকিতে হইবে, দেখিতেছি।”
জো। কেন?
ম। কেন? তাহার সন্দেহভঞ্জন করিতে হইলে আমাকে সে রাত্রের সমূদয় ঘটনা প্রকাশ করিতে হইবে। কিছুতেই আমি তাহা পারিব না।
জো। কেন পারিবে না?
মজিদ কোন উত্তর করিতে পারিল না—নীরবে নতমুখে রহিলেন। তাঁহার ভাব দেখিয়া জোহেরার মুখ ম্লান হইয়া গেল—জোহেরা চিন্তিত হইল। ক্ষণপরে বলিল, “ইহার ভিতর একটা কারণ আছে—কোন বিশেষ কারণ, কেমন?”
মজিদ মুখ না তুলিয়া বলিলেন, “হাঁ, জোহেরা।”
জোহেরা জিজ্ঞাসা করিল, “এই কারণটার ভিতরে কোন স্ত্রীলোকের অস্তিত্ব আছে কি?”
মজিদ মাথা নাড়িয়া জানাইলেন, ‘আছে’। মুখে কিছুই বলিলেন না।
জোহেরার মলিনমুখে যেন আর একখানা বিষাদের মেঘ ঘনাইয়া আসিল।
একটু পরে ঘৃণাভরে উঠিয়া কঠিন হাস্যের সহিত বলিল, “এ বড় মন্দ রহস্য নহে, মজিদ! এই খোস-খবর দিবার জন্য কি তুমি আজ আমার সঙ্গে দেখা করিতে চাহিয়াছিলে? আমি মনে জানি, তুমি আমাকে আন্তরিক ভালবাস—আমি তোমার মুখ চাহিয়া রহিয়াছি—আর তুমি—তুমি মজিদ, আমার কাছে অনায়াসে অন্য একজন স্ত্রীলোকের নাম লইয়া—”
বাধা দিয়া বিচলিতভাবে মজিদ বলিলেন, “নির্ব্বোধের ন্যায় কি বলিতেছ? আমি যে স্ত্রীলোকের কথা বলিতেছি, তাহার সহিত প্রণয়ের কোন সংশ্রব নাই। কোনবিশেষ কারণে আমি কোন বিষয়ে তাহার নিকট প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়াছি। প্রতিজ্ঞাভঙ্গ ভিন্ন দেবেন্দ্রবিজয়ের ও তোমার সন্দেহ-ভঞ্জনের আর কোন উপায় দেখি না; কিন্তু আমি কিছুতেই তাহা পারিব না। আমার কথায় কি তোমার বিশ্বাস হয় না? সত্য কি তুমি মনে করিতেছ, আমি তোমার সহিত প্রবঞ্চনা করিতেছি? এত সহজে আমাকে অবিশ্বাসী ভাবিয়ো না। আমি তাহা নহি।”
জোহেরা সন্দেহপূর্ণদৃষ্টিতে ক্ষণেক মজিদের মুখপ্রতি চাহিয়া বিষণ্ণভাবে অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া কহিল, “পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করিতে নাই।”
দুই হাতে জোহেরার হাত দুইখানি ধরিয়া মজিদ হাসিয়া বলিলেন, “সকলেই কি সমান? আমাকে অবিশ্বাস করিতে হয়—এখন না। যতক্ষণ না, আমি মুখ ফুটিয়া সে সকল কথা প্রকাশ করিতেছি, ততক্ষণ তুমি আমাকে অবিশ্বাসী ভাবিয়ো না। আমি একান্ত তোমারই।”
সাগ্রহে জোহেরা জিজ্ঞাসা করিল, “তাহা হইলে তুমি সে সকল কথা প্রকাশ করিতে সম্মত আছ?”
মজিদ বলিলেন, “যখন দেখিব, বিপদ্ অত্যন্ত গুরুতর—আর গোপন করিলে চলিবে না—তখন অবশ্যই আমাকে তাহা প্রকাশ করিতে হইবে; কিন্তু সহজে আমি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিব না—সহজে আমি বিচলিত হইব না।”