পঞ্চম পরিছেদ
বালক শ্রীশচন্দ্র
যাঁহারা আমার “মনোরমা” উপন্যাস পাঠ করিয়াছেন, তাঁহাদিগকে এই বুদ্ধিমান ছোক্রা শ্রীশচন্দ্রের পরিচয় দিতে হইবে না।
অদ্যাপি শ্রীশ, সুযোগ্য ডিটেক্টিভ দেবেন্দ্রবিজয়ের নিকটে প্রতিপালিত হইতেছে। এখন সে আরও কাজের লোক হইয়া উঠিয়াছে। ঝুনা নারিকেলের ন্যায় দেবেন্দ্রবিজয় বাহিরে যতই কঠিন হউন, কিন্তু তাঁহার হৃদয় মায়া-মমতায় পূর্ণ ছিল। তাঁহার পরম নারী-শত্রু জুমেলিয়ার মৃত্যু-সময়েও আমরা একদিন চক্ষুর্দ্বয় সজল দেখিয়াছিলাম। তিনি শ্রীশকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। বালক শ্রীশও তাঁহার একান্ত অনুরক্ত। দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে যখন যাহা আদেশ করেন, শ্রীশচন্দ্র তাহা সুচারূপে সম্পন্ন না করিয়া ছাড়ে না।
শ্রীশের বয়স এখন পনের বৎসর। অতি শৈশবে সে মাতৃহীন হইয়াছে। মাতাপিতার কথা এখন আর তাহার মনেই পড়ে না। নিজের সম্বন্ধে যখন তাহার কোন চিন্তা উপস্থিত হয়, মনে হয়, সে আকাশ হইতে পড়িয়াছে, নয় মাটি ভেদ করিয়া উঠিয়াছে। তাহার পিতামাতা এমন কিছুই রাখিয়া যায় নাই— কোন চিহ্ন নাই— যাহাতে তাহাদের কথা এই দীন বালকের মনে একবার উদয় হইতে পারে।
শৈশবকাল হইতে এই সংসারের অনেক দুঃখ-কষ্টের সহিত যুদ্ধ করিয়া নিরাশ্রয় বালক শ্রীশচন্দ্রের বুদ্ধিটা অত্যন্ত প্রখরতা লাভ করিয়াছিল। দেবেন্দ্রবিজয়ের আদেশমত সে কখন কোন সন্দেহজনক গাড়ীর পশ্চাতে ছুটিত, প্রয়োজনীয় খবরাখবর লইয়া আসিত, এইরূপ আরও অনেক কাজ শ্রীশ এমন আশ্চর্য্যরূপে, অতি সত্বরে এবং অতি সহজে সুসম্পন্ন করিত যে, অনেক সময়ে দেবেন্দ্রবিজয়কেও বিস্ময়াপন্ন করিয়া তুলিত। দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিতে পারিয়াছিলেন, কালে শ্রীশ একজন পাকা, নামজাদা গোয়েন্দা হইয়া দাঁড়াইবে। শ্রীশ যাহাতে কিছু লেখাপড়া শিখিতে পারে, তিনি এমন বন্দোবস্ত করিয়াও দিয়াছিলেন। পাছে শ্রীশ, বাবু বনিয়া যায় মনে করিয়া, কখনও তিনি তাহাকে ভাল কাপড়, জামা কি জুতা কিছুই পরিতে দিতেন না— সেদিকে তাঁহার বিশেষ দৃষ্টি ছিল। সকল সময়েই শ্রীশকে একখানি মোটা, খাটো কাপড় পরিয়া থাকিতে দেখা যাইত; অধিকন্তু একখানি ছোট লাল গাত্রমার্জ্জনী তাহার স্কন্ধে সতত শোভা পাইত। দেবেন্দ্রবিজয় মনে করিয়াছিলেন, শ্রীশের এখনকার মনের ভাব ঠিক রাখিতে পারিলে, কালে সে নিশ্চয়ই উন্নতি করিতে পারিবে।
অতি দ্রুতপদে সন্ধ্যার পূর্ব্বেই দেবেন্দ্রবিজয় ঘর্ম্মাক্ত কলেবরে বাটী ফিরিলেন। সারাদিন পরিশ্রমের পর তিনি অত্যন্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন। গৃহিণী রেবতীসুন্দরী তাড়াতাড়ি আসিয়া, পাখা লইয়া ব্যজন করিতে বসিলেন। বলিলেন, “সেই কখন বাহির হইয়াছিলে, আর এতক্ষণের পর সময় হইল?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কাজ ছিল।”
রে। সারাদিনই কি কাজ?
দে। আবার বাহির হইতে হইবে।
রে। আজ আর নয়, বোধ হয়।
দে। এখনই।
রে। তবে না আসিলেই হইত।
দে। সারাদিন ঘুরিয়া ঘুরিয়া অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছিলাম, তাই ঐ সুন্দর মুখখানি একবার দেখিতে আসিলাম। মনে আবার নূতন বল পাইলাম— যে কাজ বাকী আছে, তাহা এখন অনায়াসে শেষ করিতে পারিব।
রে। পরিহাস কেন?
দে। পরিহাস নয়—খুব সত্যকথা।
রে। খুব মিথ্যাকথা।
দে। না বিশ্বাস করিলে নাচার।
রে। আজ আর কোনখানে গিয়ে কাজ নাই।
দে। কেন?
রে। কেন আবার কি?
দে। না গেলে নয়। কাজ আছে।
রে। তবে আসা কেন?
দে। তা ত পূর্ব্বেই প্রকাশ করিয়াছি। এখন বল দেখি, শ্রীশ ছোঁড়াটা কোথা?
রে। কেন? তাকে আবার কেন?
দে। প্রয়োজন আছে।
রে। নীচের ঘরে বোধ হয় ব’সে আছে।
দেবেন্দ্রবিজয় উচ্চকণ্ঠে ‘শ্রীশ’ বলিয়া একবার হাঁক দিতেই, একেবারে দ্বিতলে-তাঁহার সম্মুখে শ্রীশচন্দ্রের আবির্ভাব।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কি খবর?”
শ্রীশ বলিল, “আপনার একখানা চিঠি এসেছে।”
দে। কখন?
শ্রীশ। এই কতক্ষণ!
দে। কোথায় সে চিঠি?
শ্রী। শচীদাদার কাছে।
দে। তাহাকে এখন ডাক। আসিবার সময়ে যেন চিঠীখানা সঙ্গে লইয়া আসে।
শ্রীশচন্দ্র চলিয়া গেল। অনতিবিলম্বে শচীন্দ্রনাথকে সঙ্গে লইয়া ফিরিয়া আসিল। শচীন্দ্রনাথ দেবেন্দ্রবিজয়ের ভাগিনেয়।