» » দ্বিতীয় খণ্ড : নিয়তি—লীলাময়ী

বর্ণাকার

পাঁচকড়ি দে

নীলবসনা সুন্দরী

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

আর এক রহস্য

প্রথমে দেবেন্দ্রবিজয়ই স্তব্ধতা ভঙ্গ করিলেন। বলিলেন, “আমি আপনার অপরিচিত— আমার নাম দেবেন্দ্রবিজয় মিত্র। আমি একজন ডিটেক্‌টিভ-ইনস্পেক্টর।”

শুনিয়া মজিদের মলিনমুখ আরও মলিন হইয়া গেল। আর একবার দেবেন্দ্রবিজয়ের দিকে চকিত-দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া সংবাদ-পত্রখানা ফেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “আসুন— আসুন, আপনার নাম দেবেন্দ্রবিজয় বাবু! নাম শুনিয়াছি, আপনাকে দেখি নাই। তা’ আজ এখানে কি মনে করিয়া?”

দেবেন্দ্রবিজয় একখানি স্বতন্ত্র চেয়ার টানিয়া বসিয়া বলিলেন, “কোন একটা বিশেষ কারণে আমি আপনার নিকটে আসিয়াছি। বোধ করি, আপনি নিজে তাহা মনে মনে বুঝিতে পারিয়াছেন।”

মজিদ উভয় ভ্রূ সঙ্কুচিত এবং মস্তক সঞ্চালিত করিয়া বলিলেন, “কই, আমি কিছুই ত বুঝিতে পারি নাই।”

দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “তবে আমিই স্পষ্টবাক্যে বুঝাইয়া দিই, মেহেদী-বাগানের খুনের তদন্তে আমি এখানে আসিয়াছি।”

কথাটা শুনিয়া সহসা মজিদের যেন শ্বাসরুদ্ধ হইল। স্তম্ভিতভাবে উঠিয়া দাঁড়াইলেন; মুখের পূর্ব্বভাব একেবারে পরিবর্ত্তিত হইয়া দারুণ উদ্বেগের চিহ্ন ফুটিয়া উঠিল। তাড়াতাড়ি তিনি দেবেন্দ্রবিজয়ের তীক্ষ্ণদৃষ্টি হইতে মুখ ফিরাইয়া লইলেন। সংবাদপত্রখানা টেবিলের নীচে পড়িয়া গিয়াছিল; সেখানা তুলিয়া ধূলা ঝাড়িয়া নতমস্তকে ভাঁজ করিতে লাগিলেন। কিছু প্রকৃতিস্থ হইয়া শুষ্কহাস্যের সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন, “খুনের তদেন্তে আমার কাছে আসিয়াছেন কেন? আমি ইহার কি জানি? আমার সহিত ইহার কি সংশ্রব আছে?”

একটু কঠিনভাবে দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কি সংশ্রব আছে, আমি তাহাই জানিতে আসিয়াছি।”

মজিদ খাঁ অত্যন্ত তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে একবার দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিলেন। তাহার পর পকেট হইতে একটা চুরুট বাহির করিয়া অগ্নি সংযোগ করিলেন। এবং চুরুটে দুই-একটী টান দিয়া নিজের চেয়ারে ভাল হইয়া বসিলেন। অবিচলিতকণ্ঠে কহিলেন, “আপনি হেঁয়ালির ছন্দ ছাড়িয়া দিন।”

দেবেন্দ্রবিজয় সহাস্যে কহিলেন, “আপনার নিকটে এই হেঁয়ালি ছন্দের অর্থ দুরূহ নহে।”

মজিদ খাঁ বলিলেন, “অত্যন্ত দুরূহ— আপনার অভিপ্রায় স্পষ্টবাক্যে প্রকাশ করুন।”

উভয়ে বাগ্‌যুদ্ধে নিপুণ। মজিদ এই খুন সম্বন্ধে এমন কিছু অবগত আছেন, যাহা দেবেন্দ্রবিজয় তাঁহার মুখ হইতে বাহির করিয়া লইতে চাহেন; কিন্তু মজিদ তাহা প্রাণপণে চাপিয়া যাইতে চেষ্টা করিতেছেন। উভয়ের মধ্যে যিনি অধিকতর দক্ষ, তাঁহারই জয়লাভ অবশ্যম্ভাবী। প্রথমে দেবেন্দ্রবিজয় বাগ্‌যুদ্ধে অগ্রসর হইলেন। বলিলেন, “যে স্ত্রীলোকটি মেহেদী-বাগানে খুন হইয়াছে, সে আপনাদের মনিরুদ্দীনের রক্ষিতা— নাম দিলজান।”

“বটে! আপনি ইহা কিরূপে জানিলেন?” বলিয়া মজিদ অত্যন্ত চকিতভাবে দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিলেন।

দে। সে কথা এখন হইতেছে না। তবে এইমাত্র আপনি জানিয়া রাখুন, মেহেদী-বাগানে যে লাস পাওয়া গিয়াছে, তাহা দিলজানেরই। আপনি তাহাকে শেষ-জীবিত দেখিয়াছেন।

ম। বটে, এমন কথা!

দে। হাঁ, গত বুধবার রাত এগারটার পর মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে আপনার সহিত দিলজানের দেখা হইয়াছিল।

ম। কে আপনাকে এমন সুচারু মিথ্যাকথা বলিয়াছে? কে এমন সত্যবাদী?

দে। গনির মা।

মজিদের ওষ্ঠাধর কুঞ্চিত হইল। বলিলেন, “আপনি ইতিমধ্যে সকল সংবাদই সংগ্রহ করিয়া ফেলিয়াছেন দেখিতেছি। এখন আপনি আমার কাছে কি জন্য আসিয়াছেন, প্রকাশ করুন। কিছু জিজ্ঞাসা করিবার থাকে, বলুন।”

দে। গত বুধবার রাত্রিতে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে দিলজানের সহিত আপনার দেখা হইয়াছিল?

ম। হইয়াছিল— সন্ধ্যার সময়ে— রাত্রিতে নহে।

দে। গনির মা’র মুখে শুনিলাম, রাত্রেও আপনার সহিত দিলজানের দেখা হইয়াছিল।

ম। গনির মা মিথ্যা বলিয়াছে— সে ভুল করিয়াছে—রাত্রে দিলজানের সহিত আমার দেখা হয় নাই।

দে। আর কাহারও সহিত দেখা হইয়াছিল?

ম। সে কথা আমি বলিব না; তাহাতে আপনার কোন প্রয়োজন নাই।

দে। রাগ করিবেন না— খুব প্রয়োজন আছে। আপনি বুঝিতে পারিতেছেন না— আপনার মাথার উপরে কি ভয়ানক বিপদ্‌ উপস্থিত। যদি আপনি সরলভাবে আমার সকল প্রশ্নের উত্তর না করেন, আমি আপনাকে এখনই বিপদ্‌গ্রস্ত করিতে পারি— তাহা জানেন?

ম। তাহা হইলে আপনি দিলজানের হত্যাপরাধটা আমারই স্কন্ধে চাপাইতে মনস্থ করিয়াছেন দেখিতেছি।

দে। তাহা পরে বিবেচ্য। এখন বলুন দেখি, গত বুধবারে কেন আপনি মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে গিয়াছিলেন?

মজিদ নিজের বিপদের গুরুত্ব বুঝিতে পারিলেন। মনে মনে বড় বিরক্ত হইলেন। বিরক্তভাবে বলিলেন, “খুন করিবার উদ্দেশ্যে নহে; অন্য কাজ ছিল। মনিরুদ্দীনের সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিলাম।”

“দেখা হইয়াছিল?”

“না।”

“কেন?”

“রাত নয়টার ট্রেনে তিনি ফরিদপুর যাত্রা করিয়াছিলেন।”

“মনিরুদ্দীনের সহিত যদি আপনার দেখা হয় নাই, কিরূপে আপনি জানিতে পারিলেন, তিনি ফরিদপুর-যাত্রা করিয়াছেন?”

“দুই-একদিন পূর্ব্বে আমি তাঁহার মুখে শুনিয়াছিলাম, তিনি ফরিদপুর যাইবেন।”

“সৃজান বিবিকে সঙ্গে লইয়া?”

“সে সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না। ফরিদপুরে তাঁহার জমিদারী; জমিদারীতে কাজকর্ম্ম দেখিতে যাইবেন, এইমাত্র আমি জানি।”

“আপনি কেন বুধবার রাত্রে তাঁহার সহিত দেখা করিতে গিয়াছিলেন?”

“আমি তাঁহার বৈষয়িক আয়ব্যয়ের হিসাব রাখি। দুই-একটা হিসাব বুঝাইয়া দিতে গিয়াছিলাম।”

“সেদিন রাত্রিতে সেখানে কাহারও সহিত আপনার দেখা হয় নাই?”

(ইতস্ততঃ করিয়া ) “হইয়াছিল।”

“হাঁ, কোন স্ত্রীলোকের সহিত কি?”

“হাঁ, কোন স্ত্রীলোকের সহিত।”

“দিলজান।”

“দিলজান নহে। আপনার অনুমান ভুল।”

“তবে কে তিনি?”

“যিনিই হউন না কেন, আপনার এই খুনের মামলার সহিত তাঁহার কোন সংশ্রব নাই।

“তা’ না থাকিলেও তাঁহার নামটা আমার জানা দরকার; অবশ্যই আপনাকে তাহা প্রকাশ করিতে হইবে।”

“কিছুতেই নহে— আমি বলিব না।”

উভয়ের পরস্পরের মুখপ্রতি স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলেন। দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, মজিদ কিছুতেই সেই স্ত্রীলোকের নাম প্রকাশ করিবেন না। তখন তিনি সে সঙ্কল্প পরিত্যাগ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপত্তি থাকে— নাম না বলিলেন; তবে সেই স্ত্রীলোকের সহিত আপনার কি বচসা হইয়াছিল, বলিতে কোন আপত্তি আছে কি?

ম। আছে, সে কথায় আপনার কোন আবশ্যকতা নাই।

দে। কতক্ষণ সেই স্ত্রীলোকটি সেখানে ছিল?

ম। প্রায় রাত্রি বারটা পর্য্যন্ত।

দে। সে বাহির হইয়া গেলে আপনি কতক্ষণ সেখানে ছিলেন?

ম। আমিও তখনই চলিয়া আসি।

দে। বরাবর এখানে— আপনার এই বাড়ীতে?

ম। না, এখানে ফিরিতে রাত হইয়াছিল।

দে। সেখান হইতে বাহির হইয়া আপনি আবার কোথায় গিয়াছিলেন?”

ম। তাহা আমি আপনাকে বলিতে পারি না।

দে। আপনি না বলিতে পারেন, আমি বলিতে পারি— মেহেদী-বাগানে।