» » মুঙ্গু

বর্ণাকার

অজেয় রায়

মুঙ্গু

আট

ঘটনাটায় আমাদের দ্বীপের জীবনযাত্রা এক নতুন পথে মোড় নিল।

প্রত্যেকদিন সকালে একবার গ্রামের হাসপাতালে হাজির হই, দু-একটি রুগী মজত থাকে প্রত্যেকদিন।

দ্বীপের প্রত্যেকটি লোকের মধ্যেই বোধহয় ম্যালেরিয়ার জীবাণু সংক্রামিত হয়েছে। শিশু ও বালক-বালিকারাই ভোগে বেশি। এদের জীবনীশক্তি খুব জোরালো। তাই দু-এক ডোজ ওষধ খেয়েই গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠে। কিন্তু এভাবে কতদিন যাবে? সাময়িকভাবে প্রতিরোধ করে কী লাভ! বারবার জ্বর হয়ে প্রাণশক্তি যে ক্ষয় হয়ে যাবে। মামাবাবু বললেন, ফিরে গিয়ে স্বাস্থ্যদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। ওষুধপত্র নিয়ে দল পাঠাতে হবে। ডিডিটি ছড়িয়ে ম্যালেরিয়ার বিষবাহী মশা ধবংস করতে হবে, নইলে এরা মরবে।

আমাদের খাতির এখন দেখে কে?

নাচ-গানের আসরে সর্দারের পাশেই আমাদের আসন নির্দিষ্ট হয়েছে। তাদের সঙ্গে নাচে যোগ দিতে আমাদের সাধাসাধি করে। তাল বুঝে সুনন্দ একদিন লাফিয়ে উঠে নাচ শুরু করে দিল। আধঘণ্টা নেচে-কুঁদে বেদম হয়ে সে বসে পড়ে। সকলে খুব তারিফ কল, তোমার হবে। কদিন অভ্যেস করলেই হবে। ফার্স্ট ক্লাস নাচিয়ে হয়ে যাবে। শুনে সুনন্দের কী গর্ব!

আমার বাবা নাচার শখ নেই! তবে ওদের নাচের তালে পা আপনি নেচে ওঠে। তখন চুপ করে বসে থাকা যায় না। আমি তাল ঠুকি। টিনের কৌটো বাজাই। মামাবাবুকেও দেখেছি ঘাড় নেড়ে তাল দিচ্ছেন।

নাচ এদের রক্তে। ছেলে-বুড়ো মা-মেয়ে সবাই নাচের নামে পাগল। থুথুরে বুড়ো, বয়সের ভারে বেঁকে গেছে, সেও পা ঠোকে। হাততালি দেয় নাচের সাথে। এদের সমস্ত সুখ-দুঃখের প্রকাশ নাচের মাধ্যমে।

সমুদ্রে একটা বড় মাছ উঠল। অমনি তীরে যারা ছিল একপাক নেচে নিল। শুয়োর মারা হয়েছে, ভালো খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা আজ, ব্যস, নাচ চলবে দু-গুণ। আবার একজন বুড়ো মরল, তার শ্রাদ্ধেও দেখি সবাই নেচে নেচে শোক প্রকাশ করছে।

সর্দার নাচে। কামাউও নাচে। চত্বরের একটু বাইরে এদের এক মন্দির আছে। উঁচু টিলার ওপর ছোট্ট ঘর। দেয়াল ও মাথার ছাউনি অন্য ঘরের মতো। কোমর সমান উঁচু এক প্রবেশপথ। তার ওপর তক্তা দিয়ে বন্ধ থাকে। কামাউ প্রত্যেক দিন সন্ধেবেলা সেই দরজা খুলে ভিতরে দেবতার উদ্দেশে মন্ত্র-টন্ত্র পড়ে। সেই দেবতার চেহারা আমরা দেখিনি। কামাউ একা যায়, অন্য কেউ যায় না। বিশেষ উৎসবে নাকি দেবতাকে বের করা হয়। আমাদের দেবভক্তি তেমন প্রবল না হওয়ায় ও-বিষয়ে মাথা ঘামাইনি।

তবে যে-কথাটা বলতে যাচ্ছিলাম তা হল, কামাউয়ের পুজোর পদ্ধতি।

দু-চার লাইন মন্ত্রপাঠ। তারপর সে মন্দিরের চারপাশে বারকয়েক নেচে নেচে ঘুরবে। পুজো শেষ। এইবার সে আসবে চত্বরে। মজলিসে যোগ দেবে। সেখানেও সে নাচে। তবে রোজ নয়, বিশেষ উপলক্ষে। তার নাচের বিশেষত্ব আছে।

সে নাচবে একা। অন্যরা তখন ওঠে না। ঢাক আর ডামের আওয়াজ চতৃর্তণ হয়ে ওঠে। কী সমস্ত সাংঘাতিক অঙ্গভঙ্গি ও মুদ্রা, তেমনি বিকট মেকআপ! মুখে বুকে হাতে পায়ে লাল কালো সাদা হলদে রঙের ছড়াছড়ি। হঠাৎ দেখলে বুক ধড়াস করে ওঠে। কী বাবা ওটা? মানুষ না রাক্ষস?

ভাঁটার মতো চক্ষুতারকা ঘুরছে। গায়ে হাড়ের গয়নায় খটাখট আওয়াজ। মাথায় লম্বা লম্বা পালকের মুকুটে ঝোড়ো কাপন। থেকে থেকে হুহুঙ্কার।

ভূতপ্রেত অপদেবতা বশ করা হচ্ছে কিনা, তাই এইসব ভয়ঙ্কর কলাকৌশল।

সুনন্দ আপসোস করে, ইস একটা মুভি ক্যামেরা থাকলে যা হত! কোথায় লাগত হলিউডের ছবি!

আমাদের তাঁবু উপহারে ভরে যেতে লাগল। আমরা সর্দারের প্রিয়পাত্র, তাদের মহা উপকারী বন্ধু, সবাই চায় আমাদের সন্তুষ্ট করতে। উপহার যা আসে বেশির ভাগই খাদ্যবস্তু। মাছ, মাংস, পাখি, কচ্ছপের ডিম, কাঁকড়া। ফলটলও আসে। একরকম শিম আসত, দেশি শিমের মতো স্বাদ। আর আসত কাড়িকাড়ি নারকেল ও জল-ভরা কচি মিষ্টি ডাব।

একটা চিংড়িমাছ দিয়েছিল, খোলাটা বাঁশের মতো মোটা। দুহাত লম্বা। একটির কালিয়াতে বাড়িসুন্ধুর পেট ভরে যাবে। সুন্দর তো চোখে জল আসার উপক্রম। আহা। এমন জিনিসটি যদি-মাসিমার (আমার মার) হাতে পড়ত! যাহোক নারকেল দিয়ে চিংড়িমাছের মালাইকারি গোছের কী একটা যে বানাল!

খেতে খেতে মামাবাবু বললেন, বাঃ, চমৎকার হয়েছে মাছটা!

সত্যি সুনন্দর কৃতিত্ব আছে। আমাদের সঙ্গে আনা যৎসামান্য মশলা দিয়ে কত কত কী নতুন রান্না খাইয়ে মুখের একঘেয়েমি কাটিয়ে দেয়।

টোটো এখন বুক ফুলিয়ে আসে। কামাউকে ঘোড়াই কেয়ার করে। বরং আমাদের সঙ্গে

দোস্তি আছে বলে বন্ধুমহলে তার খাতির বেড়েছে।

আমাদের দিন কাটছে প্রায় একই ধাঁচে। মামাবাবু সকালে বেরিয়ে ফেরেন দুপুরে। পোকা-মাকড়, ফল-ফুল-পাতা কত কী যে জোগাড় করে আনেন! দুপুরে একটু বিশ্রাম নিয়েই বসেন স্পেসিমেনগুলির পরিচয় উদ্ধার করতে। বই ঘাঁটেন, নোট করেন। যত্ন করে স্পেসিমেন বাক্সবন্দী করেন।

একদিন ফিরলেন, হাতে কয়েকটা ধুঁধুল।

এখানে ধুঁধুল পেলেন কোত্থেকে?

বনের মধ্যে লতা আছে।

কিন্তু এখানে ধুঁধুল এল কী করে? আমি আশ্চর্য হয়ে বলি।

বাঃ, বঁধুল তো এখানকারই ফল! এখান থেকে ভারতে গিয়েছে। শুধু ধুঁধুল কেন, আরও অনেক ফল-ফুল বাইরে থেকে ভারতবর্ষে গিয়েছে। আজ আমরা তাদের ভাবি খাঁটি দেশি।

গেল কী করে?

বণিকরা এনেছে। পর্যটকরা এনেছে। অবশ্য ভারত থেকেও অনেক ফল-ফুল বিদেশে। গেছে।

ধুঁধুল ভাজা (তেল নয়, মাখন দিয়ে) খেয়ে একটু চেনা খাবারের স্বাদ পেলাম। বাড়ির কথা, মার হাতের রান্নার কথা মনে পড়ছিল। আহা কতদিন খাইনি!

সুনন্দের বেশ সুবিধে হয়েছে। সমুদ্রে নৌকো চালানোর শখ এতদিনে মিটেছে। এখন তাকে সাধাসাধি করতে হয় না, বরং কার নৌকোয় সে উঠবে সেই নিয়ে টানাটানি।

সুনন্দ আগে নদীতে ডিঙিনৌকো চালিয়েছে, কাজেই সমুদ্রে ডিঙি বাওয়া রপ্ত করতে তার সময় লাগল না। আমিও চাপি। তবে ওর মতো দাঁড়িয়ে বল্লম দিয়ে মাছ শিকারে সাহস হয় না। পারতপক্ষে আমি সুনন্দর সঙ্গে এক নৌকোয় উঠি না। যা দাপাদাপি করে। প্রায়ই তার জন্যে নৌকো উল্টোয়। সাঁতরাতে সাঁতরাতে নৌকো সোজা করতে হয়। জলে হাঙর আছে, কোনোদিন ঘ্যাঁক করে ঠ্যাংখানা কেটে নিলে বুঝবে ঠ্যালা।

সুনন্দ একজনের কাছে বেজায় জব্দ। লুম্বাকে দেখলেই তার মুখ শুকিয়ে যায়। আমাকে বলেনি ব্যাপারটা, কিন্তু একদিন ঘটনাচক্রে জেনে ফেললাম।

বনপথে আসছি দুজনে। সারা সকাল ধরে মাছ ধরেছি। সাঁতার কেটেছি। পেটে চনচনে ক্ষিদে। হঠাৎ সুনন্দ বলল, এই খেয়েছে! বলেই সে চট করে একটা গাছের পাশে লুকোয়। তুই এগিয়ে যা, আমার দিকে তাকাসনি।

বেশ। আমি এগোলাম। সামনে দেখি একটি যুবক। ওকে চিনি, লুম্বা।

লুম্বাকে দেখেই লুকোল নাকি?

লুম্বাও আমাদের দেখেছে। দুজনকেই। কারণ সে আমার দিকে একবার তাকিয়েই সোজা সুনন্দকে লক্ষ্য করে দৌড়ল।

আমি হাঁ করে দেখছি ব্যাপারখানা।

লুম্বা ছুটে গিয়ে খ করে সুনন্দর হাত চেপে ধরল। এ্যা। মারবে-টারবে না কি?আমি বাধা দিতে এগোই।

আরে দূর দূর! এই জন্যে এত কাণ্ড! আমি হেসে ফেলি।

লুম্বা সুনন্দের ঘড়িসুদ্ধ কব্জিটা টেনে নিয়ে ঘড়িটা তার ডান কানের ওপর চেপে ধরেছে। তার চোখ বোজা, নাক-মুখ কুঁচকে প্রাণ ঢেলে শুনছে–

সুনন্দ অসহায়ভাবে বলে, দেখছিস, এই এক যন্ত্রণা! যখনই দেখবে টিক্ টিক্ শোনা চাই।

কিন্তু রহস্যটি টের পেল কী করে! তুই শুনিয়েছিলি বুঝি?

হুঁ। সুনন্দ বিরসবদনে বলে। একদিন মজা দেখতে ওর কানে ঘড়ি চেপে ধরেছিলাম। ব্যাটা তো আঁতকে উঠে মারল ডিগবাজি। তারপর বুঝিয়ে শুনিয়ে ভয় ভাঙিয়ে টিক্ টিক্‌ শোনালাম। ব্যস, সেদিন থেকে আরম্ভ হয়েছে এই গেরো।

এই ছাড় ছাড়! হাত ব্যথা হয়ে গেল যে।–আর একটু, আর একটু। লুম্বা এবার বাঁ কানের ওপর ঘড়ি চেপে ধরে।

সুনন্দ রেগেমেগে ঘড়ি খুলে দেয়! নাও শোনো।

পনেরো মিনিট পর অনেক ঝুলোকুলি করে তবে ঘড়ি ফেরত পাওয়া যায়। সবাই খুশি, শুধু কামাউ আর তার গুটিকয়েক ভক্তের মুখ দিন দিন থমথমে হচ্ছে। কামাউয়ের কয়েকজন ভক্ত ছিল। সর্বদা তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরত। তাদের মধ্যে দুটিকে আমরা খুব চিনেছি। দুটি যেন মানিকজোড়। সর্বদা একসঙ্গে থাকবে। তাদের নাম দিয়েছিলাম ত্যাড়া-বাকা। আসলে বলা উচিত ছিল ট্যারা-বাকা। কারণ একজনের চোখ কিঞ্চিৎ ট্যারা এবং অন্যটির পা দুটো ধনুকের মতো বাঁকা।

লোক দুটো বেজায় লোভী এবং ধড়িবাজ। আমাদের কাছে প্রায়ই এটা-সেটা চাইত। আবার কখনো চাইত কামাউয়ের নাম করে। পরে খবর পেয়েছি সেসব উপহার বেশির ভাগ সময় কামাউয়ের হাতে পৌঁছয়নি। দুই শিষ্যই গাপ মেরে দিয়েছে।

যেদিন আমাদের চিকিৎসাপাট আরম্ভ হয়, তার দুদিন পরে। বিকেলে ক্যাম্পের বাইরে বসে আছি, হঠাৎ দেখি একজন আসছে এদিকে। ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম–কামাউ। কামাউয়ের হাঁটা ভুল হবার নয়। ব্যাপার কী?

কামাউয়ের দীর্ঘ শরীর সামনের দিকে নোয়ানো। যখন চলে দেহ সামনে আরও ঝুঁকে পডে ধনুকের মতো বেঁকে যায়। লম্বা লম্বা পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে এগোয় যেন রণ-পা চড়ে হাঁটছে। আর হাত দুটো তার পেণ্ডুলামের মতো ক্রমাগত সামনে পিছনে দোল খায়।

জাম্বো, বানা অর্থাৎ নমস্কার।

কামাউ হাসি হাসি মুখে সম্ভাষণ জানায়। কিছু একটা মতলব আছে নিশ্চয়। মনের ভাব চেপে রেখে বলি, কুজা কুজা, অর্থাৎ আসুন আসুন। কী সৌভাগ্য! খেতি হিকো (এখানে বসুন)।–একটা প্যাকিং বাক্স এগিয়ে দিই।

কামাউ বসল না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলে, বিদেশি মাহিন্ডি তোমরা দেখছি অনেক দৈবশক্তি-টক্তি রাখো। ওষুধ-টষুধ জানেনা। তা আমাকে ঐ হোমার দাওয়াই তৈরি শিখিয়ে দাও। তোমরা চলে গেলে আমাকেই তো চিকিৎসা করতে হবে।

ওঃ, এই মতলব!

সুনন্দ বাংলায় মামাবাবুকে বলে, দেখছেন কী ধড়িবাজ! এসে পর্যন্ত পিছনে লাগবার চেষ্টায় আছে, ভদ্রভাবে দুটো কথা অবধি বলেনি, এখন ওষুধ শিখে নাম কেনার ধান্দা। কী মিষ্টি মিষ্টি কথা বলা হচ্ছে!

মামাবাবুকে কিছু বলতে না দিয়ে সুনন্দ মেজাজের মাথায় বলল, ওষুধ তৈরি কী করে শেখাব? সেসব অনেক জিনিসপত্র লাগে। এখানে পাব কোথায়?

তাই বুঝি? কামাউ একটু দমে যায়। সেসব এখানে পাওয়া যাবে না?

না।

কামাউ খানিক ভাবে। তারপর বলে, বেশ তোমাদের কাছে কত ওষুধ আছে? কতদিন চলবে?

খুব বেশি দিন নয়। আমরা ডাক্তারি করতে হবে জেনে আসিনি। এই ধরো আর এক চাঁদ (অর্থাৎ একমাস)।

সুনন্দ বাড়িয়ে চলল। এই রেটে খরচ হলে ট্যাবলেট আর পনেরো দিন চলবে বড়জোর।

বেশ, যা ওষুধ আছে আমায় দিয়ে দাও। এবার থেকে আমিই চিকিৎসা করব। কামাউ বলে।

বটে, আবদার তো মন্দ নয়! কেন টোটোকে এখানে আসতে, আমাদের সঙ্গে মিশতে বারণ করার সময় মনে ছিল না? সুনন্দ বাংলায় জানায়।

তারপর কামাউকে বলে, তা তো সম্ভব নয়।

কেন? কামাউয়ের মুখ গম্ভীর।

ওষুধের গুণ নষ্ট হয়ে যাবে। গুরুর কাছে অনেক দিনের চেষ্টায় ওষুধ তৈরি শিখেছি। গুরু বলেছে এ-ওষুধ অন্য কারও হাতে পড়লে আর কাজ হবে না!

কামাউয়ের কুঞ্চিত। বলল, মনে রেখো আমিও মন্ত্রট জানি। আমার হাতে ওষুধের গুণ নষ্ট হবে কেন?

হবে হবে। সুনন্দ বলে। তুমি তো আর আমাদের গুরুর কাছে মন্ত্র নাওনি। কামাউয়ের মুখে অবিশ্বাস। বলল, বেশ দেখি পরীক্ষা করে। দাও তোমাদের ওষুধ।

উত্তম। সুনন্দ তাঁবুর ভিতর ওষুধ আনতে যায়।

আমি ও মামাবাবু চুপচাপ শুনছিলাম। সুনন্দটা তো আচ্ছা প্যাচালো বুদ্ধি রাখে। মামাবাবুর মুখে চাপা হাসি।

সুনন্দ ফিরে এসে দুটো বড়ি কামাউয়ের হাতে দিল, কি, কোনো রুগী আছে নাকি হাতে? তাহলে এখুনি খাইয়ে দেখতে পারো।

কামাউ বলল, আছে।

দীর্ঘ শরীরটা সামনে ঝুঁকিয়ে, পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে কামাউ হাঁটতে লাগল। আমরা তিনজনও সঙ্গে চললাম।

একটি কুটিরে একজন জ্বরে কাতর হয়ে শুয়েছিল। কামাউ তাকে বড়ি দুটো খাইয়ে দিল। দু-চারবার নিজস্ব মন্ত্রও আউড়াল।

সুনন্দ বলল, কাল জানতে পারবে ফলাফল। আজ চলি।

খেতে খেতে মামাবাবু বললেন, কী দিলে?

মাথাধরার ট্যাবলেট। সাদা, একরকম দেখতে, ধরতে পারেনি।

কাজটা ভালো করলে না। ও কিন্তু তোমার কথায় বিশ্বাস করেনি। বুঝেছে ঠকাচ্ছে। ওষুধ শেখাবার ইচ্ছে নেই। কাল যখন দেখবে জ্বর নামল না, চটে যাবে। আমাদের বিপদে ফেলবার চেষ্টা করবে।

ফুঃ, ঘোড়ার ডিম করবে। ওকে কিছু দিচ্ছি না। ব্যাটা মহা হিংসুটে। যদি যাবার সময় কিছু বাঁচে তো সর্দারকে বরং দিয়ে যাব।

পরদিন দ্বীপের হাসপাতালে গিয়ে দেখি রাত্তিরের সেই লোকটি আমাদের চিকিৎসার অপেক্ষা করছে। তার জ্বর কমেনি, বরং বেড়েছে। তাকে ম্যালেরিয়ার ওষুধ দিলাম।

কামাউ পাশে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাদের কার্যকলাপ দেখছিল। সুনন্দ তাকে হেসে বলল, কী হে, বলেছিলাম না? বিশ্বাস হল তো?

কামাউ উত্তর দিল না। পাঁচন খাওয়া মুখ করে অন্য দিকে দৃষ্টি ফেরাল।

কামাউ যদিও গোপনে এসেছিল আমাদের গুপ্তবিদ্যা জানতে, কিন্তু কথাটা পাঁচকান হতে দেরি হল না। ঐ রুগীই সব্বাইকে বলে দিল তার ব্যর্থতার কাহিনি। ফলে সমাজে কামাউয়ের প্রেস্টিজ বেশ ক্ষুণ্ণ হল।

টোটো খবর দিল কামাউ নাকি আমাদের বিরুদ্ধে লোকজনকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করেছে। মাহিন্ডিদের ওষুধ খেও না। ভবিষ্যতে ফল ভালো হবে না।

কিন্তু দুঃখের বিষয় কেউ কান দেয়নি তার কথায়। উল্টে তারা বলেছে, বিদেশিদের মন্ত্রের জোর বেশি। অপদেবতা তাদের ওষুধে তাড়াতাড়ি পালায়। ফলে কামাউয়ের পসার ভীষণ নষ্ট হচ্ছে।

সর্দার নাকি ধমকেছে। বিদেশিদের পিছনে লাগছ কেন? তোমার দৌড় তো দেখলাম এতদিন। খবরদার! ওদের কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করলে তোমাকে আমি আস্ত রাখব না।

কামাউ আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে না, ধারে কাছে আসে না। জ্বলন্ত চোখে দূর থেকে তাকায়। ক্ষমতা থাকলে নির্ঘাত ভস্ম করে দিত।