» » মুঙ্গু

বর্ণাকার

অজেয় রায়

মুঙ্গু

পাঁচ

দ্বীপটাতে শুছিয়ে বসলাম।

মেয়াদ অবশ্য বেশিদিন নয়, মাত্র দশদিন। সর্দার বলেছে আমরা যেদিন দ্বীপে এসেছি তারপর ঠিক এগারো দিনের দিন ময়োজিমাকুবা অর্থাৎ পূর্ণিমা। আকাশে সেদিন মস্ত গোল চাঁদ উঠবে। পূর্ণিমার আগের দিন তাদের নৌকো যাবে ওপারে। আমাদেরও তখন সঙ্গে নিয়ে যাবে।

সূচনায় বেঘোরে প্রাণ যাবার উপক্রম হলেও পরের ব্যাপারটা মন্দ দাঁড়াচ্ছে না। বরাতে শিকে ছিঁড়ে খাসা একটা অ্যাডভেঞ্চার জুটে গেছে। দশটা দিন তো দেখতে দেখতে কেটে যাবে। অতএব প্রাণভরে এই হঠাৎ-পাওয়া রোমাঞ্চের স্বাদ উপভোগ করে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

আমাদের থাকার ব্যবস্থাটি ভালোই হয়েছে। আর খাওয়ার ভাবনা মামাবাবু সুনন্দের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন, কারণ রান্নার ব্যাপারে সুন্দর দারুণ উৎসাহ।

ঠিক করা হল প্রথমে দ্বীপটা সার্ভে করা যাক।

সকালে একবার সপারিষদ সর্দার এসেছিল খোঁজ নিতে। আসা মাত্র সুনন্দ তাকে একটা পেন-নাইফ প্রেজেন্ট করল। ছুরিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে সর্দার মহাখুশি। এখন তাদের ব্যবহার বেশ সহজ, বন্ধুত্বপূর্ণও বলা যায়। শুধু ঐ কামাউ হল ব্যতিক্রম। সেও এসেছিল, কিন্তু দূরে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল। মামাবাবু এগিয়ে তাকে নমস্কার জানালেন–জাম্বো বানা। কিন্তু তার সন্দিগ্ধ আচরণ কিছু সরল হল বলে মনে হল না। যাক বাবা মিশতে না চায় ক্ষতি নেই, কোনো বাগড়া না করলেই বাঁচোয়া।

সর্দার সুনন্দকে অনুরোধ করল, মাহিন্ডি, তোমার জাদুটা একবার দেখাও তো। সেই যে। হঠাৎ অগ্নির আবির্ভাব, ছোট্ট একখানা নীল বাক্স থেকে।

সনন্দ গেরামভারি চালে পকেট থেকে লাইটার বের করল। দেখেই জনতা সাত হাত তফাতে সরে গেল।

সুনন্দ বার কয়েক হিংটিং-ছট মন্ত্র আউড়াল, শূন্যে বহু আন্দোলিত করল, তারপর খ করে লাইটার টিপল।

মোটো, মোটো–আগুন, আগুন,ভীত বিস্মিত দর্শকদের মধ্যে থেকে কোলাহল ওঠে। বিদেশি ভারতীয়দের জাদুর মাহাত্ম নিয়ে জোর একচোট আলোচনা হয়।

এই ফাঁকে সুনন্দ আমাদের দেশে ফেরার কথাটা তোলে।

সর্দার বলল, হ্যাঁ-হ্যাঁ যাবে বইকি! তবে ক-দিন অপেক্ষা কর। আমরা যখন-তখন সমুদ্রযাত্রা করি না। ওপারের দেশ ভালো নয়। ওখানে আমাদের অনেক শত্রু। শিকো কুমি অর্থাৎ দশ দিন অপেক্ষা কর।

তাদের ভালোমতো লোভ দেখালে বা জেদাজেদি করলে হয়তো আগেই আমাদের পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা হতে পারত, কিন্তু এ নিয়ে আমরা বেশি চাপাচাপি করলাম না। ক-টা দিন এই অজানা দ্বীপে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার আকর্ষণ কম নয়।

সর্দার দলবল নিয়ে চলে গেলে আমরাও বেরলাম। স্থির হল সমুদ্রের ধারে ধারে গোটা। দ্বীপটা চক্কর দিয়ে আসব। একজন দ্বীপবাসীকে সঙ্গে নিলাম পথ দেখাতে।

যেতে যেতে লোকটির মুখে শুনলাম এ-দ্বীপে বড় হিংস্র জন্তু নেই। বন্য বড় জন্তু বলতে আছে কেবল শুয়োর। তবে সংখ্যায় বেশি নয়। প্রায়ই তাদের শিকার করা হয় কিনা! আমাদের সঙ্গে বন্দুক-টন্দুক ছিল না, কাজেই সংবাদটা শুনে আশ্বস্ত হলাম।

লোকটি বলল, অবশ্য ছোট জানোয়ার বা সাপখোপের অভাব নেই। খটাসগুলো আকারে ছোট, কিন্তু শয়তানিতে বড় জন্তুকে হার মানায়। প্রায়ই তাদের পোষা ছাগলছানা মারে।

খটাস বা ছোট জন্তু নিয়ে আমরা মাথা ঘামালাম না। তবে কিছুদূর গিয়েই এক দৃশ্য দেখে আমাদের টনক নড়ল। বুঝলাম দুশ্চিন্তার কিছু কারণ আছে বটে।

দেখি একটি লোক বল্লমের ডগায় একটা প্রকাণ্ড মরা সাপ বিধিয়ে ঝুলিয়ে আনছে। লম্বায় সাপটা অন্তত সাত ফুট হবে। মামাবাবু দেখে বললেন, গ্রিন মাম্বা। অতি বিষাক্ত। গোখরো-কেউটের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

দ্বীপের যেদিকে আমাদের তাঁবু পড়েছে, তার উল্টো দিকে গাছপালা ঘন। একটা অগভীর জলাশয় রয়েছে। চারপাশ ঘিরে নিবিড় জঙ্গল। জলাশয়ের ধারে ম্যানগ্রোভ গাছের দুর্ভেদ্য বেষ্টনী। একটু শুকনো জায়গায় বাঁশ-ঝাড় ও খাটো আকারের প্রচুর ডালপালাওলা কাঁটাঝোঁপ। ম্যানগ্রোভ বনে অসংখ্য কাঁকড়া। সন্ন্যাসী কাঁকড়া ও বীণাবাদক কঁকড়াই বেশি। পুরুষ বীণাবাদক কাকড়াগুলো ভারি মজার দেখতে। একটা দাঁড়া ছোট্ট, অন্যটা বিরাট। বড় দাঁড়াটা মুখের সামনে বাগিয়ে ধরে রাখে, যেন বীণা, আর ছোট হাতটা দিয়ে যেন বাজাচ্ছে।

মামাবাবু সন্ধানী দৃষ্টিতে চারদিকে চাইছিলেন। বললেন, এখানকার কীট-পতঙ্গ লক্ষ করো। কতকগুলো দেখছি একেবারে নতুন, অচেনা। ভালো করে সাজসরঞ্জাম নিয়ে পরে আসতে হবে। বনে ঢুকব। স্পেসিমেন নিয়ে যাব।

কয়েকটা কীট-পতঙ্গ তিনি আমাদের দেখালেনও। খটমট ল্যাটিন নাম বললেন তাদের। একবার মামাবাবু হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন, একী! আঙুল দিয়ে দেখালেন, গাছের গুঁড়িতে বসা একটা গোবদা গঙ্গাফড়িং।

ভালো করে দেখ। মাথায় দুটো শিং রয়েছে। এ-জাতের ফড়িং তো কেবল মাদাগাস্কারে পাওয়া যায় জানতাম! এখানে এল কী করে!

ধরার চেষ্টা করতেই ফড়িংটা ফড়ফড় করে উড়ে পালাল।

সমুদ্রের কিনার ঘেঁষে চলেছি। দেখলাম, আমাদের নৌকো দ্বীপের যে-পাশে আছড়ে পড়েছিল সে-ধারের সৈকতভূমিই সবচেয়ে চওড়া। অন্য সব ধারে সমুদ্রতীর অপরিসর, খানাখন্দে ভরা পাথুরে। আমাদের নৌকো তীরের এসব অংশে আঘাত করলে আর প্রাণে বাঁচতে হত না।

লক্ষ করলাম দ্বীপের চারপাশে তীরের কাছাকাছি অনেক শিলাখণ্ড ও প্রবাল প্রাচীর জলের মধ্যে থেকে মাথা তুলে রয়েছে। ঢেউ এসে সবেগে আছড়ে পড়ছে তাদের ওপর। চোখে দেখা যায় না এমনি ডুবো পাহাড় না জানি আরও কত লুকিয়ে আছে সমুদ্রগর্ভে। বোধহয় এইসব বিপজ্জনক শিলাস্তূপ ও প্রবাল প্রাচীরের ভয়েই দ্বীপের কাছ দিয়ে জাহাজ বা নৌকো চলে না। আমরা সর্বক্ষণ সমুদ্রের পানে নজর রেখেছিলাম। কিন্তু বৃথা আশা, কোনো নৌকো-চৌকো চোখে পড়ল না।

একটা আশ্চর্য জিনিস দেখলাম।

এক প্রাচীন ভগ্নস্তূপ। কেল্লা জাতীয় বাড়ি ছিল মনে হল। বড় নয়, ছোট আকারের বাড়ি তৈরি হয়েছিল আগাগোড়া পাথরে। ইটের চিহ্নমাত্র নেই। অজস্র পাথরের টুকরো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আছে। ছাদ ভেঙে পড়েছে, তবে দেয়ালগুলো এখনও খাড়া। বৃক্ষ, লতাগুল্মে ঢেকে ফেলেছে ভগ্নাবশেষ।

এখানে বাড়ি কে তৈরি করল? দ্বীপে সভ্য মানুষের বসতি ছিল বলে তো মনে হয়নি। তাহলে আরও বাড়িঘরের চিহ্ন চোখে পড়ত। মাত্র একটি কেন?

মামাবাবু বললেন, জলদস্যুদের আড্ডা হতে পারে। নির্জন দ্বীপে আরব বা পর্তুগিজ জলদস্যুদের গোপন ঘাঁটি ছিল।

সুনন্দ আমার কানে কানে বলল, পরে খুঁজে দেখব, যদি গুপ্তধন পাওয়া যায়।

কাজ নেই আমার গুপ্তধনে। ঐ সাপের আড্ডায় আমি ঢুকছি না।

যেতে যেতে মামাবাবু আদিবাসীটির সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ করছিলেন। এই দ্বীপ ও এখানকার অধিবাসীদের খবরাখবর নিচ্ছিলেন। দ্বীপের গাছপালা পশুপাখি সম্বন্ধে তথ্য জোগাতে তার আপত্তি নেই, কিন্তু নিজেদের সম্পর্কে বেশি কথা বলতে সে নারাজ।

আশ্চর্য হয়ে দেখছিলাম, কত পাখি। জলের ধারে উড়ছে নানান সামুদ্রিক পাখি। গাছে গাছে রঙ-বেরঙা পাখির কাকলি। বাঃ-চেনা শিস, তাকিয়ে দেখি গাছের ডালে ঝুটি মাথায় বুলবুলি। ভারি আপনজন মনে হল পাখিটাকে।

একজাতের ক্ষুদে বাঁদর আমাদের দেখে মহা হল্লা জুড়ে দিল। বোধকরি শার্ট-প্যান্ট পরা মানুষ এই প্রথম দেখছে।

পুরো দ্বীপটা একপাক ঘুরে আসতে আমাদের ঘণ্টা চারেকের বেশি লাগল না।

ছোট্ট ভূখণ্ড। কোনো রকমে জলের ওপর মাথা জাগিয়ে রেখেছে। মনে হয়, যে কোনো সময় সমুদ্র তাকে গ্রাস করে ফেলতে পারে। এইটুকু সামান্য জমি এবং এখানের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্যই বোধ হয় এখন পর্যন্ত সভ্য মানুষ এ-দ্বীপে বসতি স্থাপনে উদ্যোগী। হয়নি।

মামাবাবু বললেন, একটা উঁচু গাছের মাথায় চড়ে দেখ তো চারদিক।

আমি ছোটবেলায় গাছে চড়তে ওস্তাদ ছিলাম, কাজেই আমিই উঠলাম।

পরিষ্কার ঝকঝকে দিন। যেদিকে তাকাই চারপাশে চঞ্চল সমুদ্র। নীলচে-সবুজ ঢেউগুলি ফেনার মুকুট পরে নাচতে নাচতে ছুটে চলেছে। পশ্চিমদিকে দেখলাম বহু দরে একটা কালো রেখা। অস্পষ্ট। নিশ্চয় আফ্রিকা মহাদেশের পূর্ব উপকূল। কত দুর হবে? সাত-আট মাইল। যাক, খুব বেশি দূরে এসে পড়িনি। নেমে এসে রিপোর্ট করলাম।

আমাদের ডেরার কাছাকাছি আসতে দেখি তাঁবুর সামনে ভিড়। দ্বীপবাসীরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে। সর্দারও রয়েছে। মাঝখানে আমাদের নৌকোর দুজন মাঝি, যে দুজন দুর্ঘটনায় অক্ষত আছে। কী ব্যাপার? তাদের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। দ্বীপের লোকেরা উত্তেজিত স্বরে কথা বলছে। মনে হচ্ছে কোনো কারণে খুব চটেছে।

এর মধ্যে আবার কী ফ্যাসাদ বাধল রে বাবা।

মামাবাবু আমাদের অপেক্ষা করতে বলে ভিড়ের মাঝে ঢুকে গেলেন।

অনেকক্ষণ তিনি সর্দার ও অন্যান্যদের সঙ্গে কথা বললেন। মাঝিদের কী সব জিজ্ঞাসা করছেন দেখলাম। মনে হল ধমকাচ্ছেন। তারপর ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এলেন। সঙ্গে সঙ্গে সর্দার ও তার লোকজনরা মাঝি দুটিকে নিয়ে গ্রামের দিকে রওনা দিল।

মামাবাবু বললেন, আর বল কেন, লোক দুটো এক নম্বর বুন্ধু। এক কাণ্ড বাধিয়েছে। ওদের বিশ্বাস হয়নি যে সত্যি এরা কদিন পরে আমাদের দেশে ফেরত পাঠাবে। তাই সকালবেলা নিজেরাই একটা নৌকো চুরি করে পালাবার তাল করছিল। কিন্তু তীর থেকে জলে নৌকো নামাবার আগেই দ্বীপের লোকেরা দেখে ফেলে। ব্যস, ছুটে গিয়ে ধরে-বেঁধে আনে। আমাদের কাছে এসেছিল এই চক্রান্তে আমাদেরও কোনো হাত আছে কিনা জানতে। ওদের কাছে নৌকো অত্যন্ত মূল্যবান সম্পত্তি, তাই নৌকো চুরির চেষ্টা করায় দারুণ চটেছে। তারপর আবার মাঝিরা আরব। আরবদের এরা মোটেই সুনজরে দেখে না। উপজাতিদের ওপর তো কম অত্যাচার করেনি আরবরা! যাহোক, ভাগ্যিস ঠিক সময় এসে পড়েছি, নইলে একটা খুন-খারাপি হয়ে যেত। অনেক বলে-কয়ে ওদের শারীরিক অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচিয়েছি। কিন্তু ছাড়বে না, বন্দী করে রাখবে! বিশ্বাসভঙ্গ এদের কাছে মারাত্মক অপরাধ।

কিন্তু আমাদের সঙ্গে শেষে ফিরে যেতে দেবে তো? আমি জিজ্ঞেস করি।

দেবে। মানে যাতে দেয়, সে-চেষ্টা নিশ্চয় করতে হবে। রাগ কমুক। তারপর বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করাব।

অন্য দুজন মাঝি কাণ্ড দেখে ভীষণ ঘাবড়েছিল। তারা আমাদের কিছুতেই ছাড়বে না। সঙ্গী দুজনের দুরভিসন্ধির কথা তারা বিন্দুবিসর্গ জানত না। অসহায় বন্ধুদের ফেলে কেটে পড়ছিল শুনে গালিগালাজ করে বেইমানদের চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করতে লাগল।

আমরা অনেক বুঝিয়ে তাদের অভয় দিলাম। খবরদার! লুকিয়ে পালাবার চেষ্টা কোরো না। দেখলে তো কী সাংঘাতিক ফল হতে পারে! আমরা যদি ফিরি তোমাদের ফেলে রেখে যাব না।

যার কোমরে ব্যথা, সে-বেচারা হাঁটাচলা করতে পারে না। শুয়ে থাকে। অন্যজনের অবস্থা মোটামুটি ভালো। তার ব্যান্ডেজ বাঁধা ডান হাতটা গলায় দড়ি দিয়ে ঝোলানো। তার ওপরেই কোমর ভাঙা লোকটির দেখাশোনার ভার দিলাম।

মধ্যাহ্নভোজন সারলাম। মেনুটিনের মাংস ও নারকেল। খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে মামাবাবু বুট, টুপি, চামড়ার জারকিন ইত্যাদি ধড়াচূড়া এঁটে ব্যাগে স্পেসিমেন সংগ্রহের নানারকম সরঞ্জাম নিয়ে জঙ্গল ছুঁড়তে বেরোলেন। আমি ও সুনন্দ গেলাম সমুদ্রতীরে মাছধরা দেখতে।

তিনটি ছোট ছোট ডিঙিনৌকো চেপে সাত-আটজন লোক সমুদ্রে মাছ ধরছিল। তাদের কারও হাতে ছোট দড়ির জাল, কারও হাতে বল্লম, মাছ ভাসলেই গেঁথে ফেলবে। বল্লমের পিছনে দড়ি বাঁধা। শিকারকে বিদ্ধ করবার পর টেনে আনা যাবে। অদ্ভুত ব্যালান্স এদের। সরু নৌকোর ওপর বসছে, দাঁড়াচ্ছে। ঢেউয়ের মাথায় টলমল নৌকোগুলো অপূর্ব দক্ষতায় চালনা করছে। জলের জায়গায় জায়গায় শিলাস্তূপ। নৌকো তাদের গায়ে ধাক্কা খেলে। চুরমার হয়ে যাবে। এরা অনায়াসে সেসব বাধা এড়িয়ে নৌকো নিয়ে ঘুরছিল।

সুনন্দের শখ হল নৌকো চাপবে। পারে কয়েকজন দাঁড়িয়েছিল, তাদের ভাঙা ভাঙা সোয়াহিলিতে অনুরোধ করল। কিন্তু তারা তৎক্ষণাৎ মাথা নেড়ে আপত্তি জানাল, আপানা অর্থাৎ না না।

আমি ক্ষেপালাম, যদি অতিথি দেবতা জলে ডুবে অক্কা পায়। গেরস্তের অকল্যাণ হবে। তাই রাজি হচ্ছে না।

সুনন্দ রেগে বলে, যা যাঃ। আমি পূর্ব বাংলার ছেলে। পদ্মায় অমন ঢের ঢের নৌকা বাইসি। জলে ডোবা অত সস্তা নয়।

কিন্তু এটা নদী নয়, সমুদ্দুর।

জানি। তবে পদ্মার ঢেউও খুব সোজা নয়। তাছাড়া আমি তো আর একা চাপতে চাইছি না। ওদের সঙ্গে থেকে একটু প্র্যাকটিস করতাম।

অজস্র ছোট-বড় নানা রঙের কাঁকড়া। বালির ভিতর গর্ত থেকে উঠে দৌড়াদৌড়ি বা পদচারণা করতে করতে আবার টুক করে গর্তে সেঁধুচ্ছিল। সুনন্দ বলল, আয়, ধরি।

প্রাণপণ চেষ্টায় গলদঘর্ম হয়ে আট-দশটা কাঁকড়া ধরলাম।

দ্বীপের লোকেরা আমাদের লক্ষ করছিল। একজন এগিয়ে এসে আমাদের একটা কাঁকড়া উপহার দিল।

প্রকাণ্ড সামুদ্রিক কাকড়া। খোলাটা যেন একখানা ছোট কড়াই। দাঁড়াগুলো তেমনি লম্বা ও মোটা, সাঁড়াশির মতো। নিশ্চয় শাঁসে ভরা।

সুনন্দ আহ্লাদে আটখানা হয়ে উপহারদাতাকে বারবার হ্যান্ডসেক করে পিঠ চাপড়ে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল।

প্রতিদানে কী দেওয়া যায়?

সে পকেট হাতড়ে বের করল একটা রঙচড়ে রাংতা। চকোলেটের। দুঃখের বিষয় চকোলেটটি সে খেয়ে ফেলেছে। আর কিছু নেই। রাংতাই দেব? তাই সই।

লাইটারের ম্যাজিক দেখাবার পর থেকে এরা সুনন্দকে রীতিমতো সমীহ করে। তাই মাহিন্ডি জাদুকরের কাছে এমন খাতির পেয়ে এবং এমন চমৎকার চকচকে একখানা উপহার লাভ করে লোকটি তত বেজায় খুশি হয়ে গেল।

ফেরার সময় সুনন্দ বলল, ইস, কী যে আপশোস লাগছে! সঙ্গে মশলাপাতি নেই, এমন পেল্লাই কঁকড়াটা জুত করে রান্না করা যাবে না। চল সিদ্ধ করি, নুন-গোলমরিচ দিয়ে শাসটা খাই। নেহাৎ মন্দ লাগবে না।