» » মুঙ্গু

বর্ণাকার

অজেয় রায়

মুঙ্গু

চৌদ্দ

স্থির হল কাল আমরা ফিরে যাব। হাইনে দ্বীপটা দেখতে উৎসাহ প্রকাশ করলেন। মামাবাবু তাকে ঘুরিয়ে দেখাবেন।

সকাল থেকে যাবার তোড়জোড় শুরু হল।

দফায় দফায় মালপত্র লঞ্চে নিয়ে যাওয়া হতে লাগল। মামাবাবু বললেন, আমি একদম শেষে যাব স্পেসিমেনের বাক্সগুলি এবং ফসিল নিয়ে। আমরাও একে একে লঞ্চে উঠি। মাঝি চারজন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। বাব্বাঃ, জংলিগুলোর খপ্পর থেকে বেঁচে বেরোলাম তাহলে?

হাইনের ইচ্ছে ছিল মামাবাবুর সঙ্গে যাবেন। কিন্তু মামাবাবু আপত্তি করলেন, না না আপনি আগে চলে যান। জিনিসগুলো গুছিয়ে রেখে স্পেসিমেন আর ফসিলের জন্য একটু ভালো জায়গা করে রাখবেন। ঢেউয়ের দোলায় কোনো ভারী জিনিস যেন ওদের ঘাড়ে গড়িয়ে না পড়ে।

লাস্ট ট্রিপ।

লঞ্চ চালক পেড্রো ইঞ্জিন চালু করেছে। ঘোর গর্জনে থরথর করে কাঁপছে লঞ্চ। মামাবাবু এলেই সে লঞ্চ ছেড়ে দেবে।

বালির ওপর শোয়ানো মুঙ্গুকে মামাবাবু আস্তে আস্তে তুলে ধরলেন। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় ফসিলের গায়ে জড়ানো কাপড়ের টুকরোটা হুস্ করে উড়ে গেল। মুহূর্তে ডানা মেলে উধাও হয়ে গেল কাপড়টা। মামাবাবু বোকার মতো চেয়ে রইলেন। লঞ্চে আমরা খুব একচোট হেসে উঠি এই দৃশ্য দেখে।

আমাদের হাসি থামতে না থামতে শুনি এক চিৎকার। মামাবাবু বা খালাসিদের গলা নয়। অপরিচিত কণ্ঠস্বর। এক নয়, একাধিক।

সমুদ্রতীরে মামাবাবুর কাছ থেকে প্রায় শতখানেক গজ দূরে কিছু ঝোঁপঝাড়ের অন্তরাল থেকে যেন জাদুবলে আবির্ভূত হল দুটি কৃষ্ণকায় মূর্তি। তারা চেঁচিয়ে ওঠে, মুঙ্গু মুঙ্গু! তারস্বরে কী সব জানি বলতে লাগল।

হাইনে আশ্চর্য হয়ে বলেন, কে লোক দুটো? দ্বীপের আদিবাসী? এরা বুঝি পালায়নি? কী বলছে?

আমরা দেখেই চিনেছি–সেই মানিকজোড়। ত্যাড়া-ব্যাঁকা। ত্যাড়াকে চিনতে না পারলেও ব্যাঁকার ধনুকের মতো পা ভুল হবার নয়। মুঙ্গুকে চুরি করতে দেখলে অন্য কেউ বোধ হয় খুশিই হত। কিন্তু এ দুটো কামাউয়ের চেলা। হয়তো বাধা দেবে।

আমরা বললাম, ওরা মুঙ্গুকে চিনতে পেরেছে। এতক্ষণ লুকিয়ে দেখছিল। মুঙ্গুকে ফিরিয়ে দিতে বলছে। শাসাচ্ছে।

ত্যাঁড়া-ব্যাঁকা দ্রুতবেগে বালির ওপর দিয়ে দৌড়ে আসতে লাগল।

মামাবাব মুহূর্তে হৃদয়ঙ্গম করলেন ব্যাপারটা। চটপট ফসিল বগলদাবা করে জলে নামলেন। ঝপঝপ করে ঢেউ ভেঙে এগোতে থাকেন। নৌকো রয়েছে প্রায় এক কোমর জলে।

নৌকোয় পৌঁছে ফসিলটি সাবধানে ভিতরে শুইয়ে তিনি লাফিয়ে উঠলেন। খালাসি দজন তৈরি ছিল। ঝপাং করে দাঁড় পড়ল। ঢেউ কেটে তীব্রবেগে বোট গভীর জলে এগিয়ে গেল।

লোক দুটো যখন জলের ধারে হাজির হল নৌকো অনেকখানি এগিয়ে গেছে। সাঁতার কেটে ধরা যাবে না তাকে।

ওকি! হতবাক আমরা লক্ষ করি লোক দুটো ধনুকে তির বসিয়ে জ্যা টানছে।

উল্কাগতিতে তির ছুটল। অব্যর্থ নিশানা।

আ আ আ! একজন খালাসি কাতর আর্তনাদ করে উঠল। তার বাহুমূলে তির লেগেছে। ফলাটা গেঁথে গেছে মাংসে। তার সঙ্গী একটানে তিরটা তুলে নেয়। জামাটা লাল হয়ে ওঠে তাজা রক্তে। মুঠো আলগা হয়ে তার দাঁড়টা জলে ভেসে গেল।

আবার তির ছুটল।

মামাবাবুরা সাবধান হয়ে গেছেন। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছেন পাটাতনে। চালকহীন নৌকো পাক খেতে খেতে অন্ধের মতো ভেসে চলল।

আমরা প্রাণপণে চিৎকার করছি। ঘুঁসি দেখাচ্ছি–যদি লোকগুলো ভয় পায়। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। তারা মরিয়া। গুরুদেব কামাউয়ের দেবতাকে কিছুতেই নিয়ে যেতে দেবে না।

দেখলাম, তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে, মাছের মতো সাঁতরে চলল নৌকোর দিকে।

মামাবাবু সাবধান! ওরা আসছে!

আমাদের চিৎকার তার কানে পৌঁছয়নি কিংবা তিরের ভয়ে খানিকক্ষণ মাথা তুলতে সাহস পায়নি। আমরা প্রাণপণে ডাকতে থাকি।

ত্যাঁড়া-ব্যাঁকা নৌকোর কাছে এসে পড়েছে–

বলি ব্যাপারখানা কী? পেড্রোর বাজখাঁই গলা শোনা গেল। সে এতক্ষণ ইঞ্জিনঘরে ব্যস্ত ছিল। ইঞ্জিনের প্রচণ্ড শব্দে কিছুই তার কানে ঢোকেনি। চিৎকার চরমে উঠলে শুনতে পেয়ে বেরিয়ে এসেছে।

ওই জংলি দুটো বোট আক্রমণ করেছে। সাঁতরে আসছে। তির ছুঁড়েছে। একজন আহত।

তবে রে! দৈত্যাকার পেড্রো ব্যাঘ্রলম্ফ দিয়ে তার কেবিনে ঢুকল। পরমুহূর্তে ফিরে এল, হাতে বন্দুক।

বন্দুকে টোটা ভরে সে তাক করল।

হাইনে তাড়াতাড়ি তার হাত চেপে ধরলেন, আরে করছ কী? দেখছ না লোকগুলো আর নৌকো এক লাইনে। যদি নৌকোয় গুলি লাগে?

ওঃ! অসহায় রাগে পেড্রো সজোরে পা ঠুকতে লাগল।

মামাবাবু ও খালাসিরা মাথা তুলেছে কিন্তু নৌকো এগোয় না। একটা মাত্র দাঁড। ক্রমাগত পাশে সরে যেতে লাগল। ত্যাড়া-বাকা ধরে ফেলেছে নৌকো। তারা নৌকোর চারপাশে সাঁতরায় আর সুযোগ খোঁজে ওঠবার।

একজন খালাসী দাঁড় তুলে জলের মধ্যের মাথাগুলো লক্ষ্য করে ঘা কষায়। তারা টুপটাপ ডুব দিয়ে সরে যায়। একজন হঠাৎ নৌকোর তলায় মারল ধাক্কা। খালাসিটি হুমডি খেয়ে পড়ল নৌকোর কানায়। অমনি তার ঘাড় ধরে মেরেছে টান। ব্যস, দাঁড় সুদ্ধ সে জলের মধ্যে গোত্তা খেয়ে পড়ল। অমনি লেগে গেল জাপটা-জাপটি।

মামাবাবু অন্যমনস্ক হয়েছিলেন জলযুদ্ধ দেখতে। অন্য লোকটা সেই সুযোগে নৌকোয় উঠে পড়ল। মারল তাঁকে এক প্রচণ্ড ধাক্কা। লোকটাকে নৌকোয় ওঠামাত্র চিনেছি–বাকা।

মামাবাবু ঠিকরে পড়লেন জলে।

আহত খালাসিটিও বাধা দেবার চেষ্টা করল। তার জামা-প্যান্ট রক্তে লাল। এক হাতে ঘুষি চালাল। কিন্তু এক প্রচণ্ড লাথি খেয়ে সে উল্টে পড়ল জলে।

ব্যাঁকা এবার নিচু হয়ে মুঙ্গুকে দুহাতে তুলে ধরল, বিজয়োল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল, পেয়েছি।

গুড়ুম! হঠাৎ কানের কাছে প্রচণ্ড শব্দ। চমকে দেখি পেড্রোর বন্দুকের নল দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। মুখে তার তৃপ্তির হাসি। খতম।

বাঃ, চমৎকার লক্ষ্যভেদ। টু শব্দটি করার ক্ষমতা হয়নি। ব্যাঁকা উল্টে পড়েছে নৌকোর বাইরে জলে। হাতের ফসিল নৌকোর পাটাতনে সজোরে আছড়ে পড়ল—ঠকাস্‌।

আমাদের দৃষ্টি মামাবাবুকে অনুসরণ করল। দেখি তিনি আহত খালাসিটিকে নিয়ে কোনো রকমে পাড়ে যাবার চেষ্টা করছেন।

দ্বিতীয় খালাসিটি ফিরে আসছে দেখলাম। নিশ্চয় যুদ্ধে তার জয়লাভ হয়েছে। সে দ্রুত সাঁতার কেটে এসে আহত সঙ্গীকে ধরল লঞ্চ থেকে একজন ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে। তাদের সাহায্য করতে ছুটল।

নৌকো আটকাও। মামাবাবুর গলা ভেসে এল।

সত্যি তো, নৌকো কোথায়? এতক্ষণ ভুলেই গিয়েছিলাম নৌকোর কথা, লক্ষ্য করতে গিয়ে শিউরে উঠি।

দূরে নৌকোটা ঢেউয়ের মাথায় নাচতে নাচতে হেলেদুলে ছুটে চলেছে এক সর্বনাশা নিয়তির উদ্দেশে। তার লক্ষ্য কুফানি।

কুফানি? একটা ভয়ঙ্কর ঘূর্ণি। নামটা দ্বীপের লোকের দেওয়া। কুফানি মানে মৃত্যুদ্বার। যমের দক্ষিণ দুয়ারই বটে। কতগুলো ডুবো পাহাড়ের মাঝখানে সমুদ্রের জল লাটুর মতো বন বন করে পাক খাচ্ছে। একবার তার ভিতরে গিয়ে পড়লে আর রক্ষা নেই। স্রোতের টানে পাতালে তলিয়ে যাবার আগেই স্রেফ পাথরে ধাক্কা খেতে খেতেই টুকরো হয়ে যাবে।

এ-দ্বীপের ওস্তাদ মাঝিদেরও দেখেছি সভয়ে এড়িয়ে চলত এই ঘূর্ণিকে। সুতরাং আমরা। শঙ্কিত হয়ে উঠি।

বোট বাঁচাও! মামাবাবু চিৎকার করে ওঠেন।

অসম্ভব। নৌকো এখন আমাদের নাগালের বাইরে। দেখতে দেখতে নৌকোর গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হল। তারপর সোজা গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল কুফানির গর্ভে।

দেখলাম চরকির মতো পাক খাচ্ছে নৌকো। তারপরই কোনো শিলাস্তূপের সঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হল।

নৌকোটা অন্ধের মতো ঘুরছে আর বার বার ঢুঁ মারছে কঠিন পাথরে। যেন সেই নিষ্ঠুর ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে প্রাণপণ চেষ্টা করছে। ক্রমশ সেটা জলের ভিতর ডুবে যেতে লাগল, তারপর হঠাৎ দেখি আর নেই। অদৃশ্য। শুধু কয়েকটা ছোট তক্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।

সবাই হায় হায় করে উঠলাম।

একটা নৌকো গেলে কী এসে যায়? কিন্তু ওর সঙ্গে যে তলিয়ে গেল মামাবাবুর আবিষ্কার। বিজ্ঞানজগতের এক অমূল্যনিধি। কেমব্রিজের মিলারকে শায়েস্তা করার হাতিয়ার। কামাউয়ের মুঙ্গু!

পেড্রো দুম করে পা ঠুকে খালাসিদের উদ্দেশে গর্জন ছাড়ে, তোরা উজবুক, অকম্মার ধাড়ি! একটু সময় থাকতে ডাকতে পারলি না? পেড্রোর বন্দুকের কথা মনেই পড়ল না। হতভাগাদের? দেখতাম ঐ জংলি দুটো কী করে নৌকোর কাছে ঘেঁষে! ওফ্‌!

মামাবাবু লঞ্চে উঠে টলতে টলতে এক কোণে বসে পড়লেন। তার সারা গা থেকে জল ঝরছে, চোখে বিষণ্ণ উদাস দৃষ্টি। যেন সর্বহারা। আমরা স্তব্ধ হয়ে দেখছিলাম। কাছে যেতে বা কথা কইতে সাহস হচ্ছিল না।

আহত খালাসিটিকে লঞ্চে তোলা হল। মামাবাবু একবার বলে ওঠেন, অ্যানটিসেপটিক দিয়ে ভালো করে ব্যান্ডেজ করো। ব্যান্ডেজ ওষুধ কোথায় আছে?

সুনন্দ বলল, জানি। ব্যস, মামাবাবু আবার চুপ মেরে গেলেন।

আহত লোকটিকে ড্রেস করে শুইয়ে দিয়ে বেরিয়ে এসে দেখি মামাবাবু তখনও একভাবে বসে।

ডক্টর হাইনে গিয়ে মামাবাবুর সামনে দাঁড়ালেন। প্রোফেসর ঘোষ এবার উঠুন। পোশাক চেঞ্জ করে নিন। সবই বুঝছি, কিন্তু কী করবেন? মামাবাবু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন।

হুঁ, যা বলেছেন। দুর্ভাগ্য। অতি দুর্ভাগ্য। আমার, আপনার, সারা বিজ্ঞানজগতের। কিন্তু হারানো সূত্রের আর একটি স্পেসিমেন আমি নিশ্চয় জোগাড় করব। তবে খাটতে হবে, সময় লাগবে।

কী করে? ডক্টর হাইনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন।

কেন? সেই উপত্যকার কথা ভুলে যাচ্ছেন? ডেয়ারিং বিল যার উল্লেখ করেছিল। বিল সেখানে দেখেছিল কালো পাথরের স্তর। সেখানেই ফাটলের মধ্যে কামাউ খুঁজে পেয়েছিল মুঙ্গুকে–এই ফসিল। ডার-এস-সালাম ফিরে গিয়ে আমাদের কাজ হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নাইভাসা হ্রদের দিকে যাত্রা করা। বিলের কুটির হ্রদের কাছে। তাকে সঙ্গে নিয়ে যাব। সেই উপত্যকায়। ভালো করে খুঁজে দেখলে এই প্রাণীর আরও দু-একটা ফসিল আবিষ্কার করা হয়তো অসম্ভব হবে না। কী বলেন হের হাইনে?

হাইনে বললেন, রাইট!