» » মুঙ্গু

বর্ণাকার

অজেয় রায়

মুঙ্গু

বার

এরপর ক-দিন ধরে আমরা প্রবল উৎসাহে নৌকো চালানো প্র্যাকটিস করলাম। কামাউকে দেখতাম দূরে থেকে বাঁকা দৃষ্টি দিয়ে আমাদের কার্যকলাপ লক্ষ করছে। সুনন্দ মাঝে মাঝে কটমটিয়ে তাকে দেখে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ব্যাটা শকুনি, ব্যাটা শয়তান। একবার বাগে পাই তো দেখাই মজা।

দিন চারেক পর মামাবাবু তার প্ল্যান উপস্থিত করলেন।

সকালবেলা চা খেতে খেতে বললেন, আমরা পরশু পালাব।

পরশু কেন?

কারণ ঐ দিন দ্বীপে এক উৎসব আছে। হই-হল্লাটা একটু গুরুতর হবে। উৎসবের শেষে সবাই নিঃসাড়ে ঘুমোবে, সেই ফাঁকে–

মুঙ্গু? বন্দী মাঝি দুজন?

হুঁ, বলছি সব। মাঝিদের সঙ্গে আমি যোগাযোগ করেছি। দেখেছ রাত্রিতে তারা একটা কুটিরে বন্দী থাকে। হাত শক্ত করে দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকে খুঁটোর সঙ্গে। দুজনে ঘরের দুপ্রান্তে। এক হাতে সে গিট খোলা অসম্ভব। কিন্তু একখানা ধারালো ছুরি পেলে তারা অনায়াসে বাঁধন কেটে প্রস্তুত হয়ে থাকবে। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে শিসের সংকেত শুনলেই বেরোবে।

বেরোবে কী করে? আমি বলি, বাঁশ মাটির দেওয়াল বেশ মজবুত। দরজা ঝাঁপ দিয়ে আটকানো থাকে—

বেরোবে চাল ফুটো করে। ঘাস-পাতার চাল ফাঁক করা শক্ত নয়। হা, ওদের একটা ছুরি দিয়ে আসতে হবে। অসিত, তুমি এই ভার নাও। সুযোগমতো কুটিরের পিছনে দক্ষিণ কোণে গিয়ে আস্তে দু-বার শিস দেবে। ভিতর থেকে উত্তর আসবে–একবার শিস। দেখবে মাটি থেকে দু-ফুট ওপরে দেওয়ালের গায়ে ছোট ফুটো। আমি করে রেখেছি। পাশে ক্রশ চিহ্ন। তুমি খোলা ছুরিটা ফোকরের মধ্য দিয়ে গলিয়ে ফেলে দেবে। ব্যস, ছুরি পড়বে আবদুলের পাশে। পালাবার চরম সংকেত পাওয়ামাত্র ওরা বেরিয়ে এসে সোজা সমুদ্রতীরে হাজির হবে।

এইবার আসছে মুঙ্গু অপহরণপর্ব। এইটাই সবচেয়ে জটিল কাজ। তোমরা দেখেছ মঙ্গুর কুটিরের দরজা খোলা হয় দিনে একবার। সান্ধ্য আসর বসবার মুখে। কামাউ তার পুজো করে। তারপর চব্বিশ ঘণ্টা নিশ্চিন্ত। কেউ মুঙ্গুর খোঁজ করে না। অতএব এই সময়ের মধ্যে কাজ হাসিল করতে হবে। গিরগিটি অবতারকে সরাতে হবে উৎসবের শেষে। যখন সকলে নেচে-কুঁদে ক্লান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে। দিনের বেলা বা উৎসব চলার সময় চুরি করা অসম্ভব, কারণ যে কারো চোখে পড়ে যেতে পারি। চত্বর থেকে পরিষ্কার দেখা যায় কুটিরটা। সুনন্দ, এটা তোমার ডিউটি। পাতলা দেয়াল কেটে ভিতরে ঢুকবে। তারপর ফসিলটা নিয়ে সোজা সমুদ্রতীরে চলে যাবে, নৌকোর কাছে। আমি আর অসিত যাব ক্যাম্প থেকে। দু-চারটে প্রয়োজনীয় জিনিস শুধু সঙ্গে নেব। আর আহত মাঝিদের ডেকে নেব। অতঃপর নৌকো জলে নামানো ও দুর্গা বলে সাগরের বুকে পাড়ি।

ভোররাত্রে বেরোলে একটা মাত্র বিপদ থেকে যাচ্ছে যে আমরা দ্বীপ থেকে বেশি দূরে সরে যেতে পারছি না। ভোরে উঠে দ্বীপবাসীরা যখন টের পাবে পাখি পালিয়েছে, তারা তৎক্ষণাৎ ছিপ নিয়ে তাড়া করবে। হয়তো মাঝপথে ধরেও ফেলতে পারে। যাহোক, এ ঝুঁকিটুকু আমাদের নিতেই হচ্ছে, উপায় নেই। আরও আগে বেরোতে পারলে ভালো হত। এদের মুঠো থেকে অনেক দূরে সরে যেতে পারতাম।

সুনন্দ বলল, যদি উৎসব ছাড়া অন্য কোনোদিন পালাই। সেসব দিন অনেক আগে এদের আসর ভাঙে।

সেসব দিন সম্ভব নয় ঐ কামাউ বুড়োর জন্যে।

কেন?

কামাউয়ের ঘর মুঙ্গুর কুটিরের একদম লাগোয়া। আমি লক্ষ্য করেছি, বুড়োটা রাত্রে ভালো ঘুমোয় না। প্রায়ই জেগে থাকে। খক খক করে কাশে। লোকটার আবার কান ভারি সজাগ। তবে উৎসবের দিন প্রচুর নেচে-কুঁদে আর কড়া নেশার পানীয় গিলে ঘুমটা নিশ্চয় ওর গাঢ় হবে। তাছাড়া উৎসবের পর বেশিরভাগ সময়ই এরা কুটিরে ঘুমোতেই যায় না, চত্বরেই লম্বা হয়। সুতরাং পরশুই উপযুক্ত দিন।

বুঝলাম সব দিকে হুঁশ রেখেই মামাবাবু পরিকল্পনা তৈরি করেছেন।

মামাবাবু বললেন, সাবধান! খুব সতর্ক হয়ে কাজ করবে। একটু সন্দেহ হলেই সঙ্গে সঙ্গে কাবার!

সমস্ত দিন এক চাপা উত্তেজনার মধ্যে আছি। নানা সম্ভব-অসম্ভব আশঙ্কা মনের মধ্যে ঘরপাক খাচ্ছে। কাউকে বলছি না। ভাববে ভীতু। সুনন্দও ঘাবড়েছে। তবে ভান করছে। যেন এ তো ছেলেখেলা। শুধু একবার মনের ক্ষোভ প্রকাশ পেল।

ব্যাজার মুখে বলল, যত শক্ত কাজ দেখছি আমার ঘাড়ে। ঐ ভারী পাথরখানা বয়ে নিয়ে অতটা পথ হাঁটা! বাপরে! দেশি-বিদেশি যত জানা দেবদেবী আছেন সবাইকে স্মরণ করছি। হে মা, হে বাবা, ভালোয় ভাসোয় পার করে দিও।

সত্যি বলতে কি একটু উৎসাহও লাগছে। অ্যাডভেঞ্চারের বই পড়েছি কত। এবার একেবারে হাতেনাতে এক্সপেরিমেন্ট। যেমন বিচিত্রভাবে আমাদের এই দ্বীপে আগমন, তেমনি রোমাঞ্চকর প্রস্থান (পলায়নও বলতে পারেন। দেশে ফিরলে নির্ঘাত হিরো বনে যাব। খবরের কাগজে ছবিটবি বেরিয়ে যাবে। অবশ্য যদি ফিরি।

সেদিন রাতে টোটোর সঙ্গে গল্প হচ্ছিল তাঁবুর সামনে বসে। ছেলেটার ওপর মায়া পড়ে গেছে। বেচারা হঠাৎ জানবে তার বন্ধু মাহিণ্ডিরা পালিয়েছে। পেটুক মানুষ, ভালো-মন্দ বিদেশি খানা আর জুটবে না।

টোটো বলছিল তাদের জাতির অতীত গৌরবের কাহিনি।

বাবা-জ্যাঠারা বলে, দূর দূর এ কী জীবন? শিকার নেই। যুদ্ধ নেই। তোরা ছাগল বনে গেছিস। কী সব দিন ছিল আমাদের সেই জঙ্গলের দেশে। বর্শা দিয়ে সিংহ শিকার দেখেছিস? তির ছুঁড়ে প্রকাণ্ড দাঁতাল হাতিকে পেড়ে ফেলতাম। হায়, সেসব দিন গেল কোথায়! এইটুকু দ্বীপে বন্দী হয়ে আছি। কাজের মধ্যে কেবল নৌকো চড়া। ছছাঃ ছেঃ! যতসব মেয়েলিপনা! তার চেয়ে তির ছুঁড়ে নারকেল পাড়া ঢের শক্ত।

এ-দ্বীপে তোমরা এলে কেন? আমি প্রশ্ন করি।

বাধ্য হয়ে, যুদ্ধে হেরে। আমার তো এখানেই জন্ম। শুনেছি পাশের গ্রামের ওঙ্গামিদের সঙ্গে ছিল আমাদের দারুণ শত্রুতা। বার বার যুদ্ধ হত। ওঙ্গামিরা পারত না। শেষে একবার তারা অতর্কিতে আক্রমণ করল। আমরা প্রস্তুত হবার সুযোগটুকু পেলাম না। আমাদের বেশির ভাগ পুরুষ মরল। বাকিরা মেয়ে আর বাচ্চাদের নিয়ে পালালো। ওসামিরা সহজে ছাড়েনি। সমুদ্রতীর অবধি পিছন পিছন তেড়ে এসেছিল। একেবারে ঝাড়ে-বংশে শেষ করে দেবার মতলব আর কী! ওদের ভয়েই আমরা এই দ্বীপে পালিয়ে আসি। দেখ না, আজও ওপারে গিয়ে আমরা বেশিদিন থাকি না। ঐ ওঙ্গামিদের ভয়ে। তবে আবার ফিরব।

কবে?

সর্দার বলেছে। আমরা আরও সংখ্যায় বাড়ি। যুদ্ধ জানা যুবকে যখন আমাদের দল বেশ ভারী হবে তখন ফিরব সেই জঙ্গলের দেশে। ওঙ্গামিদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে। কিন্তু ইদানীং সবাই খুব মুষড়ে পড়েছে। এই মারাত্মক কাঁপুনি জ্বরে আমাদের গায়ের জোর কমে যাচ্ছে। লোকও মরছে। ওঙ্গামিদের সঙ্গে লড়ব কী করে?

ওঙ্গামিদের সঙ্গে তোমাদের শত্রুতার কারণ কী?

কেন জানো? ওগামিরা ছিল ঐ অঞ্চলের প্রভু। আমরা গিয়ে জমিতে ভাগ বসাতে ভয়ানক চটে যায়। ফলে প্রাণপণে আমাদের তাড়াতে চেষ্টা করে।

ও তোমরা বুঝি অন্য দেশ থেকে এসেছিলে? কোথায় ছিলে আগে?

আমরা আগে ছিলাম আরও গভীর বনের রাজ্যে। আকাশছোঁয়া এক পাহাড়ের গায়ের কাছে আমাদের গ্রাম। সেই তো আমাদের আসল দেশ।

সেখান থেকে এলে কেন?

ভয়ে।

কীসের ভয়?

মোটো। মালিমা ইয়া মোটো।

মামাবাবু! সুনন্দ ডাকে।

কি? মামাবাবু বই থেকে মুখ তোলেন।

মোটো। মালিমা ইয়া মোটো মানে কী?

মোটো মানে আগুন। মালিমা ইয়া মোটো মানে হচ্ছে আগ্নেয়গিরি বা অগ্ন্যুৎপাত। কোথায় শুনলে কথাটা?

টোটো বলছে, ওদের আদি বাসস্থান নাকি ছিল গভীর জঙ্গলে। পাহাড়ের কোলে। সেখান থেকে পালিয়ে আসে আগুনের ভয়ে।

তাই নাকি? মামাবাবু কৌতূহলী হলেন, ব্যাপারটা কী হয়েছিল টোটো?

টোটো বলল, আমি ঠাকুমার মুখে শুনেছি। উঃ, সে এক ভীষণ ব্যাপার। আমার বাবা তখন ছোট, এই আমার মতো। ঠাকুমার মুখে সে-গল্প শুনলে বুঝতে কী সাংঘাতিক কাণ্ড! আমি তেমন জমিয়ে বলতে পারব না। কিন্তু ঠাকুমাকে আর পাবে কোথা? ঠাকুমা তো মরে গেছে।

বেশ তুমিই বলো শুনি।

টোটো বলল, ঐ পাথরের মধ্যে ছিল অগ্নিদেবতার বাস। মাঝে মাঝে গুড়গুড় আওয়াজ উঠত। চোঙার মতো মাথা দিয়ে বেরতো কালো ধোঁয়া। গরম হাওয়া। শব্দটা বাড়তে লাগল। সবাই বলল, দেবতা রেগেছে। ভালো করে পুজো দিতে হবে। কিন্তু পুজো দেবার আর সময় পাওয়া গেল না। সেদিন রাত্তিরে পাহাড়ের মাথা থেকে ঝলকে ঝলকে অগ্নিদেবের গরম নিশ্বাস বের হতে লাগল। মাটি তেতে উঠল। আকাশে ধোঁয়া, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। সবাই বলল, পালাও। এক্ষুনি। দেবতার রোষে নইলে কেউ রক্ষা পাবে না। গ্রামসুদ্ধ পালিয়ে চলল। পালাতে পালাতে আরম্ভ হল আগুনবৃষ্টি। জ্বলন্ত পাথর ছুটতে লাগল। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এল শত শত আগুনের ধারা। মানুষ পশুপাখি সবাই ছুটল দিশেহারা হয়ে, প্রাণের ভয়ে। অনেকে মরল পাথরের ঘায়ে। আমার ঠাকুর্দা এক হাতে ঠাকুমাকে অন্য হাতে বাবাকে ধরে হিচড়াতে হিচড়াতে টেনে নিয়ে চলল। উঃ! কী ভীষণ রাত্রি! যারা বাঁচল, কোনোরকমে গিয়ে উঠল দূরে এক পাহাড়ে।

পরদিন দুপুর নাগাদ এক বিকট শব্দ। সে কী কান-ফাটানো আওয়াজ! মনে হল সৃষ্টি বুঝি ভেঙে গুঁড়িয়ে উড়ে গেল। প্রচণ্ড আলোর ঝলক ও ভয়ঙ্কর শব্দে অনেকক্ষণ সবাই হতবুদ্ধি হয়ে রইল। সম্বিত ফিরতে দেখল আগুন দেবতার বাসা সেই উঁচু পাহাড়ের ডগাটা ফেটে চুরচুর হয়ে উড়ে গেছে। আর সেই মাথাভাঙা পাহাড়ের ভিতর থেকে নেমে আসছে অজস্র জ্বলন্ত স্রোত। মস্ত মস্ত পাথর ছিটকাচ্ছে। আবার ছোট ছোট। অনেক দূরে এক সমতলে এসে সবাই থামল। সেখানে তৈরি করল নতুন গ্রাম। জায়গাটা চমৎকার ছিল। প্রচুর শিকার। কিন্তু জুটল এক নতুন হাঙ্গামা,–ওঙ্গামি। তাদের সঙ্গে ঝগড়া আর কিছুতেই মিটল না।

এই দ্বীপেও অগ্নিদেব আছে নাকি? মামাবাবু মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করেন।

কে জানে, থাকতে পারে! তবে শুনিনি তো কখনও। থাকলে তো মরেছি। ঠাকুমা বলত, অগ্নিদেব ঘুমিয়ে থাকে মাটির নিচে, একদিন হঠাৎ জাগে। তখন তার মেজাজ হয় অগ্নিশর্মা। ধারে কাছে কারো তখন রক্ষা নেই।

টোটো, তুমি দেখছি বড্ড ভয় পাও অগ্নিদেবকে। মামাবাবু ঠাট্টা করতে লাগলেন।

ডরাব না? কী রাগী দেবতা! আমি আর কী ডরাই! আমার বাপ-জ্যাঠা, ঐ দারুণ সাহসী বীর সর্দার সব্বাই অগ্নিদেবের নামে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে। একটা দড়াম করে শব্দ হোক, খানিকটা আগুন দেখা যাক, দু-চারটে পাথর ছুটুক–আর চেঁচিয়ে বলুন–অগ্নিদেব সাবধান! ঊর্ধ্বশ্বাসে সব পালাবে, অন্ধের মতো। একবার পিছন ফিরে দেখতে ভরসা পাবে, গাছ পড়ল না মশাল ছুঁড়ল কেউ। আমরা ছয় চাঁদ অন্তর একবার ঘটা করে অগ্নিদেবের পুজো দিই।

টোটো ফিরে যেতেই মামাবাবু বলে উঠলেন, আমাদের প্ল্যান কিছু বদলাতে হবে।

কীরকম? আমরা উদ্বিগ্ন হই।

পরশু আমরা সমুদ্রযাত্রা করছি না। সেদিন হবে শুধু এক অংশ-মুঙ্গু অপহরণ পর্ব।

তারপর?

তারপর সমুদ্রে ভাসছি, মানে ফাইনালি চম্পট দিচ্ছি যে কোনোদিন সুবিধা মতো।

সুনন্দ বলল, পরদিন কুটিরের দরজা খুলে যখন দেখবে মুঙ্গু নেই, তখন যদি আমাদের সন্দেহ করে?

দরজাই থাকবে না, তো খুলবে কী? মুঙ্গুর কুটির বা দরজার কোনো চিহ্নই থাকবে না।

সেকি! আমরা তো অবাক।

কী করে?

মাফিয়া-যাত্রার সময় ডক্টর হাইনের অর্ডারমাফিক কয়েকটা ডিনামাইট স্টিক সঙ্গে নিয়েছিলাম মনে আছে? মনে হয় স্টিকগুলো নষ্ট হয়নি, ফাটবে। পরশু উৎসবের শেষে যখন এরা অচেতন হয়ে ঘুমোবে, তোমরা দুজনে মুঙ্গুর কুটিরের দেয়াল ফুটো করে। ফসিলটা সরাবে। নিয়ে আসবে ক্যাম্পে। না, ক্যাম্পে রাখা ঠিক হবে না। কাছাকাছি কোনো গর্তটর্ত আছে, ফসিলটা লুকিয়ে রাখা যেতে পারে?

আছে। সামনের ঐ প্রকাণ্ড গাছটার গুঁড়ির ওপর দিকে একটা মস্ত গর্ত আছে। ফসিলটা পুরো ঢুকে যাবে।

বেশ। ভালো করে শুকনো পাতা চাপা দিয়ে রাখবে। তারপর আবার ফিরে যাবে মুঙ্গুর কুটিরে। কুটিরের নিচে একটা গর্ত খুঁড়ে তোমরা পয়লা নম্বর ডিনামাইটটা ফিক্স করবে। তারপর আরও দুটো লাগাবে কুটিরের পিছনে যে ঢিবি আছে তার নিচে। ঢিবির ওপর মস্ত একটা গাছ আছে। আমার আশা ডিনামাইট ফাটলে হয়তো উল্টে পড়বে। ব্যস, রাত্তিরে এই অবধি। কারণ বিস্ফোরণ ঘটবে সকালে। স্টিকের পলতেগুলো বেশ লম্বা নেবে আর ঘাস-পাতা দিয়ে চাপা দিয়ে রাখবে, যাতে কারও চোখে না পড়ে।

পরদিন আমরা যাব রুগী দেখতে, আমি আর অসিত। সুনন্দ গোপনে গিয়ে ডিনামাইটের পলতেতে আগুন লাগাবে। তারপর চট করে আমাদের কাছে চলে আসবে। পলতের আগুন স্টিকে পৌঁছতে লাগবে বড়জোর চার-পাঁচ মিনিট। তুমি প্রথমে মুঙ্গর কুটিরের নিচে লাগানো ফিউজে আগুন দেবে, আর তার দশ-পনেরো সেকেন্ড পরে আগুন দিও বাকি দুটো পলতেয়। এরপর কী ঘটবে স্বচক্ষেই দেখতে পাবে।

সুনন্দ বলল, কিন্তু এত কষ্ট করার কারণ তো বুঝছি না? পরশুদিন সবাই মিলে কেটে পড়লেই তো হাঙ্গামা চুকে যায়।

কারণ শেষ রাতে সমুদ্রযাত্রাটা এড়াতে চাই। যদি মাঝপথে ধরা পড়ি? মুস্তুকে আগে থাকতে সরিয়ে রাখলে প্রথম রাতেই পালাতে পারব। অবশ্য ফেরা দু-একদিন পিছিয়ে যাবে। তাতে কিছু এসে যায় না, অনেক নিরাপদে ফিরব।

ব্যাপারটা ঠিক মাথায় ঢুকছিল না। ডিনামাইট ফাটিয়ে আমাদের কী উপকার হচ্ছে? বললাম, যদি ওরা বিস্ফোরণের জন্য আমাদের দায়ী করে?

না করবে না। মামাবাবু বলেন, কী শুনলে এতক্ষণ টোটোর গল্প? ভাববে অগ্নিদেবের কাণ্ড। কোনো মানুষ যে এমন ব্যাপার ঘটাতে পারে মাথায়ই আসবে না। বরং লেগে যাবে অগ্নিদেবের ক্রোধ নিবারণের জন্য ঘটা করে পুজো দিত। এই তালেগোলে আমরা পালাব।

উৎসবের রাতে আমি ও সুনন্দ কীভাবে মহামান্য মুলুকে অপহরণ করলাম, কীভাবে ডিনামাইটগুলি বসালাম, তার বিশদ বিবরণ দেবার দরকার নেই। শুধু বলে রাখি, সে-রাতে ঘুম আমাদের ভাগ্যে জোটেনি এবং কাজ শেষে তাঁবুতে যখন ফিরেছি হাত-পিঠ টনটন করছিল, সারা গায়ে ঘাম।

পরদিন সকালে চত্বরে গিয়ে দেখি অনেকেই তখনও নাক ডাকাচ্ছে বা ঝিমুচ্ছে। গত রাত্রের ফুর্তির ধকল সামলে উঠতে পারেনি। রুগী দেখা হল। মামাবাবু সর্দারের সঙ্গে খোশগল্প জুড়ে দিলেন। কামাউকে দেখলাম এক কোণে বসে ঢুলছে।

সুনন্দ একটু পরেই এল।

মামাবাবু বাংলায় বললেন, কি, সব রেডি?

হ্যাঁ।

বেশ এখন কথা বলতে বলতে গাছের আড়ালে সরে যাও। পাথর ছিটকাতে পারে।

গুড়ম্‌-ম্‌-ম্‌।

ঘড়ির ওপর চোখ রেখে প্রস্তুত হয়েই ছিলাম, তবু এত কাছে ডিনামাইট ফাটায় চমকে কান চেপে বসে পড়লাম। মাটি, পাথর, বাঁশের টুকরো ছিটকে পড়ল চারপাশে। দেখলাম মুঙ্গুর কুটির বেমালুম নিশ্চিহ্ন।

প্রথম কয়েক মুহূর্ত হতভম্ব অবস্থা। তারপরই শুরু হল চিৎকার দৌড়াদৌড়ি। সদ্য ঘুমভাঙা লোকগুলো দিশাহারার মতো এদিক সেদিক ছুটল। তাদের বিপর্যস্ত স্নায়ু ধাতস্থ হবার আগেই আবার বিস্ফোরণ দু-দুটো।

ছোট-বড় পাথরের খণ্ড দুমদাম্ করে পড়ল চারপাশে। একটা গাছ মড়মড় শব্দে মুখ থুবড়ে পড়ল। কয়েকজন দেখলাম আহত হয়েছে।

আতঙ্কে সবাই প্রায় উন্মাদ হয়ে গেল। মালিমা ইয়া মোটো–মালিমা ইয়া মোটো বলে চেঁচাতে চেঁচাতে সবাই উর্বশ্বাসে দৌড়ল। আমরাও ছুটলাম সঙ্গে-বাবাগো মাগো, বলে চিল্লাতে চিল্লাতে। তারপর টুক করে একসময় কেটে পড়ে ক্যাম্পে ঢুকে পড়লাম। দ্বীপের লোকেরা ছুটে চলল সমুদ্রের তীরে। প্রায় পনেরো-কুড়ি মিনিট ধরে শুনলাম সমুদ্রতীর থেকে ভেসে আসছে তুমুল হট্টগোল হইচই। আস্তে আস্তে কোলাহল শান্ত হল।

ঘণ্টাখানেক পরে মামাবাবু বললেন, কী ব্যাপার? একটা লোকেরও গলার আওয়াজ পাচ্ছি না যে! চল তো দেখে আসি।

সমুদ্রতীরে এসে আমরা থ।

বেলাভূমি খাঁ-খাঁ করছে। জনমনিষ্যি নেই। গা একেবারে ফাঁকা নয় অবশ্য। কয়েকজন বুড়োবুড়িকে দেখলাম পাথরের খাঁজে, গাছের তলায় লুকিয়ে বসে। কিন্তু বাকিরা কই!

এবার নজর পড়ল। একটাও নৌকো নেই। ডিঙি ছিপ সব উধাও, দেখি অনেক দূরে সমুদ্রের জলে কালো কালো বিন্দুর মতো সার সার নৌকো, ভেসে চলেছে উপকূলের দিকে।

যাব্বাবা! সুনন্দ বলে, এ যে গুষ্টিসুদ্ধ হাওয়া! যাক ভালোই হল, এখন থেকে আমরাই দ্বীপের রাজা।

হুঁ রাজা বটে! তবে নির্বাসিত। মামাবাবু মন্তব্য করলেন।

কেন?

বাঃ, সবকটা নৌকো যে নিয়ে গেছে। দ্বীপ থেকে বেরোবার রাস্তা বন্ধ।

তাইতো! আমরা একটু মুষড়ে পড়ি।

এরা আর ফিরবে না? আমি জিজ্ঞেস করি।

ফিরতে পারে। অগ্নিদেবের ধ্বংসলীলা কতদূর গড়ায় দেখেশুনে হয়তো ফিরবে। তবে কবে ফিরবে কে জানে! যাহোক, সুনন্দ অসিত তোমরা পালা করে সমুদ্রতীরে পাহারা দাও। আমার ধারণা শব্দ উপকূল অবধি পৌঁছেছে। কিংবা দ্বীপের রিফিউজিদের কাছ থেকে খবর পেয়েও উপকূল থেকে খোঁজ নিতে আসতে পারে–ব্যাপারখানা কী!

পরদিন সকালে আরও দুটি ডিনামাইট ফাটানো হল। সেই বিকট বজ্রনিনাদ দ্বীপের চারপাশের জলবেষ্টনীর তরঙ্গে তরঙ্গে কাঁপুনি জাগিয়ে ছুটে গেল দূর দিগন্তে। মহাভয়ে পশুপাখিরা দিভ্রান্ত হয়ে পালাতে লাগল। মানুষ তো আগেই পালিয়েছে।

বন্দী মাঝি দুজন আবদুল ও রশিদ মহানন্দে দ্বীপময় চষছে। কতদিন পরে তারা স্বাধীনভাবে ঘুরছে। একটা নতুন খবর দিল তারা–শুধু কিছু বুড়োবুড়ি নয়, কয়েকজন জোয়ান পুরুষও নাকি রয়েছে দ্বীপে। কী কারণে তারা পালাতে পারেনি জানি না। হয়তো ভয় পেয়ে বনের মধ্যে লুকিয়ে ছিল, অন্যরা তখন ভেগেছে।

মাঝিরা বলল, বনের মধ্যে হঠাৎ দুটো লোক তাদের সামনে পড়ে। অমনি তারা তোক দুটোকে লাঠি বাগিয়ে তাড়া করে। দ্বীপের লোকের ওপর তাদের ভীষণ রাগ। লোক দুটোও তৎক্ষণাৎ ভোঁ দৌড়।আবদুলরা খুব বাহাদুরি নিল, ব্যাটারা ভিতুর একশেষ। সঙ্গে তির-ধনুক ছিল, কিন্তু দেখেই পালাল। একবার ধরতে পারলে

আমাদের ধারণা ওরা মোটেই ভীতু নয়। আকস্মিক দুর্যোগে বেচারারা ঘাবড়ে গেছে। হয়তো ভেবেছে–বিস্ফোরণের পিছনে ভারতীয় জাদুকরদের কোনো কারসাজি আছে। কারণ কাল থেকে দ্বীপের কোনো লোক আমাদের ধারে কাছে ঘেঁষেনি। দেখলেই লুকিয়ে পড়েছে।

দুপুর বারোটা নাগাদ।

আমি ও সুনন্দ সমুদ্রতীরে রাউন্ড দিচ্ছি। সুনন্দের চোখে দূরবিন। হঠাৎ সে চেঁচিয়ে ওঠে, লঞ্চ! একটা লঞ্চ আসছে এদিকে!

কই দেখি, দেখি। আমি তার হাত থেকে দূরবিন কেড়ে নিই। সত্যি তো লঞ্চ! কয়েকজন মানুষ রয়েছে। ঠিক চেনা যাচ্ছে না তাদের।

দে দে। সুনন্দ কাড়াকাড়ি করে। কিন্তু আমি শক্ত হাতে দূরবিন ধরে থাকি।

একটু একটু করে স্পষ্ট হতে থাকে লঞ্চ। দূরবিনের মধ্য দিয়ে মানুষগুলোকে দেখি।

সুনন্দ! ডক্টর হাইনে! ঐ তো ওকেলো! আরও তিন-চারজন লোক দেখছি, বোধহয় খালাসি।

সুনন্দ দূরবিন কেড়ে নিল। তারপর বলে চলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। হাইনে, ওকেলো।

সুনন্দ তার শার্টটা খুলে প্রাণপণে নাড়তে লাগল। আর গলা ফাটিয়ে চেঁচায়, ও-কে-লো! হাইনে!

দুম্‌দুম্‌। লঞ্চ থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে এল। অর্থাৎ তারা আমাদের দেখেছে।

দাঁড়া মামাবাবুকে ডেকে আনি। সুনন্দ পাই-পাঁই করে দৌড়ল।