» » মুঙ্গু

বর্ণাকার

অজেয় রায়

মুঙ্গু

দশ

দুপুর থেকেই ঢাক বাজছিল। দুম দুম দুম–

বেলা যত পড়তে থাকে ঢাকের আওয়াজ বেড়ে চলে। দ্বীপের আকাশ-বাতাস ধ্বনিত হতে থাকে, দুম দুম দুম…

বোধহয় কোনো বড় উৎসব আজ।

সন্ধে নামতেই আকাশের গায়ে মস্ত রুপোর থালার মতো পূর্ণিমার গোল চাঁদ উঠল। আমি আর সুনন্দ সমুদ্রের তীরে বেড়াতে গেলাম।

জোয়ারের বেগে সাগর উথাল-পাথাল। বড় বড় ঢেউ নাচছে, তাদের মাথায় ফসফরাসের ঝিকিমিকি। ওপর থেকে গড়িয়ে নামছে তরল রুপোলি জ্যোৎস্নাধারা। নীল-সবুজ জলের সঙ্গে মিশে সে এক অপূর্ব দৃশ্য।

মনে হয় ঐ বুঝি পাতাল রাজ্য। অগাধ জলরাশির নিচে লুকিয়ে আছে অপরূপ পাতালপুরী। এই নির্জন সাগরবেলা থেকে আমরা সরে গেলেই বুঝি জল থেকে উঠে আসবে জলকন্যারা।

পিছনে আমাদের সাদামাটা গাছপালা ভরা দ্বীপটাকে লাগছে রীতিমতো রহস্যময়। গাছের ফাঁকে ফাঁকে ছোপ ছোপ চাঁদের আলো মাটিতে লুটোচ্ছে। মাটি পাথরের রঙ বদলিয়ে দেখাচ্ছে কেমন চকচকে তকতকে। নারকেল গাছগুলির পাতায় পাতায় ঝমাঝম বাজনা। তারা ছায়া দুলিয়ে প্রাণপণে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কাকে? ঐ জ্যোৎস্নাভরা পূর্ণিমার চাঁদ, না উত্তাল সমুদ্রকে?

খানিকক্ষণ বসে থেকে মনটা ভারি স্নিগ্ধ হয়ে উঠল। কথা কইতে ইচ্ছে করে না। কান পেতে শুনি প্রকৃতিরাজ্যে নানান আনন্দধ্বনি। কতরকম কীটপতঙ্গ ডাকছে মনের খুশিতে। আর অবিশ্রান্ত জলরাশির আনন্দ উচ্ছ্বসিত কলধ্বনি।

চুপচাপ দুজনে বসে থাকি।

ফিরে আসতে মামাবাবু বললেন, আজ জমজমাট ব্যাপার। কী ঢাক বাজছে! শুনলাম, ওদের মুঙ্গু অর্থাৎ দেবতাকে আজ বের করবে। জানো তো, সোয়াহিলি ভাষায় মুঙ্গু মানে দেবতা। চলো দেখে আসি।

সুনন্দ বলল, আমি যাব না। তার বিরক্তি কাটেনি।

আমার মনটা কিন্তু উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে। দ্বীপের আনন্দ উৎসবে যোগ দিতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু সুনন্দকে ফেলে যাই কী করে? অতএব আমিও বললাম, থাক, আজ যাব না। তখন মামাবাবু একলাই গেলেন।

রাত্রে আবার কিছুক্ষণ সমুদ্রতীরে এসে বসি। তরঙ্গের কলরোল ছাপিয়ে সমানে কানে আসছে ঢাকের দুম দুম দুম…। মাঝে মাঝে অট্টরোল। কুটিরবাসী মুঙ্গুকে এরা সহজে বের করে না। চোখেই দেখিনি তাকে! ইস, সুনন্দ না বেঁকে বসলে যাওয়া যেত।

বিকেলে দেখেছি নাচিয়েরা নানারকম সাজপোশাক করে প্রস্তুত হচ্ছে। কত রকম মুখোশ, বিদঘুঁটে সাজ।

তাঁবুতে ফিরে এসে শুয়েছি। ঢাকের বাদ্যিতে ঘুম আসা দায়। সুনন্দ তো দিব্যি নাক ডাকাতে লাগল। এপাশ ওপাশ করছি, হঠাৎ দেখি মামাবাবু ফিরে এলেন।

তিনি শুলেন না। তাঁবুর মধ্যে একটু খুটখাট করেই আবার বেরিয়ে গেলেন। কী দরকার কে জানে! তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি।

পরদিন মামাবাবুকে কিঞ্চিৎ গম্ভীর দেখলাম। অন্যমনস্কভাবে কী জানি ভাবছেন।

অবশ্য দৈনন্দিন প্রোগ্রামে কোনো বদল হয়নি। যথারীতি সকালে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা করেছেন। তারপর বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। দুপুরে বই পড়েছেন। স্পেসিমেন সাজিয়েছেন। তবে কথাবার্তা বলছেন কম।

তার এই ভাবটা সুনন্দরও চোখে পড়েছিল। বলল, কী ব্যাপার রে?

বললাম, কিছু বুঝছি না।

পরদিন মামাবাবুর মুড ঐ একই খাতে বইল।

একটা নতুন জিনিস লক্ষ করলাম, তার বই পড়ার সময় বেড়েছে। ব্যস্তভাবে এ-বই সে-বই ঘাঁটছেন।

সাধারণত প্রাণিবিজ্ঞানের কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামালে তিনি সুনন্দর সঙ্গে আলোচনা করেন। কিন্তু এ দুদিন সুনন্দকে তিনি মোটেই আমল দিলেন না।

আমার মন বলছিল কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে!

তৃতীয় দিন চা-পানের পর। এবার আমাদের দৈনিক ডিউটি দ্বীপের হাসপাতালে যাওয়া। যদি কোনো রুগী থাকে।

সেদিন মামাবাবুর গাত্রোত্থানের কোনো লক্ষণ দেখলাম না। বেশ নিশ্চিন্ত মনে গাছের তলায় পা ছড়িয়ে খুঁড়িতে ঠেসান দিয়ে বসে বই পড়ছেন।

আমাদের কী? যাই, নৌকো চাপি। গুটিগুটি উঠছি, একজন লোক এসে দাঁড়াল।

লোকটাকে চিনি, সর্দারের এক পার্শ্বচর। বলল, শীগগির চলো। সর্দারের ছেলের হোমা হয়েছে। গা তেতে, পুড়ে যাচ্ছে। সবাই তোমাদের জন্য সেই কুটিরের সামনে অপেক্ষা করছে। যাচ্ছ না দেখে সর্দার আমায় ডাকতে পাঠাল। চলো চলো–

আমি ও সুনন্দ দাঁড়িয়ে পড়ি। দূর ছাই অযাত্রা কোথাকার! মামাবাবু একা যাবেন, না আমাদেরও সঙ্গে যেতে হবে ভাবছি, এমন সময় মামাবাবুর গম্ভীর গলা শুনতে পেলাম, যাইনি, কারণ গেলে কোনো লাভ হত না। আমাদের ওষুধে সর্দারের ছেলে বা অন্য কোনো কাঁপুনি রুগীই আর সেরে উঠবে না।

তার মানে? লোকটির চক্ষু বিস্ফারিত হয়ে যায়।

মানে ওষুধের গুণ নষ্ট হয়ে গেছে। ওষুধ যখন বানানো হয় তখন একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তার মধ্যে শক্তি সঞ্চারিত করা হয়। সেই সময় পেরিয়ে গেলে ওষুধ হয়ে পড়ে প্রাণহীন, অকেজো। আমাদের ওষুধে কাল অবধি শক্তি ছিল, আজ ঐ বড়িগুলোর শক্তি মৃত। বড়িতে আবার নতুন করে শক্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। পুজো-আর্চা করতে হবে। অনেক সরঞ্জাম চাই। সেসব এখানে পাব কোথায়? তুমি সর্দারকে বলো, ছেলের জন্যে কামাউকে ডাকতে। আমার দ্বারা হবে না।

লোকটা এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ল।

আমরা দুজন হতভম্ব। এ কী কাণ্ড! মামাবাব হাঁডিপানা মখ করে বসে আছেন। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হচ্ছে না। দেখা যাক কী ঘটে।

দূরে দেখা গেল সর্দার আসছে। সদলবলে হন্তদন্ত হয়ে।

সে এসেই উত্তেজিত স্বরে বলল, কী ব্যাপার? শুনলাম নাকি ওযুধ দেবে না? ওষুধের শক্তি শেষ হয়ে গেছে! পুজোটুজো করতে হবে?

হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ।

তবে বসে আছ কেন, পুজো লাগাও। কী কী লাগবে বলো, কটা বলি? এক্ষুনি আনিয়ে দিচ্ছি। মন্ত্র-টস্ত্র তোমাদের জানা আছে তো?

হ্যাঁ, তা আছে কিন্তু যে বস্তুটি নইলে হাজার মন্ত্র পড়েও কাজ হবে না, ওষুধে একফোঁটা শক্তিও ফিরিয়ে আনা যাবে না, সে জিনিসটি এখানে কই?

কী সে জিনিস?

একটি দৈবশক্তিসম্পন্ন পাথর। সেটা আছে আমাদের দেশে। সেরকম পাথর না পেলে শুধু মন্ত্র পড়ে কী হবে? বরং কামাউয়ের ওষুধ খাওয়াও তোমার ছেলেকে।

ধুত্তেরি! এ কামাউয়ের কম্ম নয়। ভীষণ জ্বর, ওর সাধ্য নেই এমন রুগীকে সারায়। এত জ্বরে কামাউয়ের ওষুধ খাওয়ানো হলে দেখেছি রুগী প্রায়ই সারেনি। মরে গেছে। তোমরা যাহোক কিছু ব্যবস্থা করো।

কী আর করব? মামাবাবু হতাশ কণ্ঠে জানান।

অমন জাঁদরেল সর্দার হাউমাউ করে প্রায় কেঁদে ফেলল, ওঃ, কী হবে! আমার অমন জোয়ান ছেলেটা বেঘোরে মরবে নাকি? ও যে আমার সেরা ছেলে। কী কব্জির জোর! কী বর্শার তাক! উৎসবের দিন থেকে জ্বর হয়েছে। আমাকে বলেনি। ওষুধ খায়নি। বন্ধুদের বলেছিল, ও আপনি সেরে যাবে। এখন উঠতে পারছে না। চোখ দুটো রক্তের মতো লাল, শুধু গোঙাচ্ছে, ছটফট করছে। থরথর করে কাঁপছে। ধরে রাখা যাচ্ছে না। গায়ে হাত দেওয়া যায় না, এত তাত! ওঃ! ওঃ!।

সর্দারকে দেখে আমার কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু মামাবাবু নির্বিকার। শুধু মাথা দুলিয়ে বললেন, তাই তো! আহা, তোমার অমন ছেলেটা!

সর্দার বলল, খুঁজে দেখেছ এ-দ্বীপে তেমন কোনো পাথর আছে কিনা।

না, তা দেখিনি অবশ্য। মামাবাবু বলেন।

বেশ, বলো কীরকম দেখতে। দ্বীপের সমস্ত লোক যত রাজ্যের পাথর আছে তোমার। সামনে হাজির করবে। দেখ পাও কিনা।

না না, আমার কাছে পাথর আনতে হবে না। আর সে পাথর কি বাইরে থেকে দেখে চেনা যায়? আচ্ছা আমি গণনা করে দেখছি, যদি তেমন কোনো পাথর থাকে, ঠিক জানতে। পারব। কোথায় আছে তাও জানব। কিন্তু যদি না থাকে তো আমি নিরুপায়।

দেখ, দেখ শীগগির। সর্দারের ধৈর্য আর বাঁধ মানে না।

বেশ। মামাবাবু উঠে দাঁড়ান। হাঁক পাড়েন, সুনন্দ, তাঁবু থেকে দাবার বোর্ড আর গুটি নিয়ে এস তো।

সুনন্দ বোর্ড আর গুটির বাক্স নিয়ে এল।

মামাবাবু বললেন, সাজাও। এক দান খেলা যাক।

সত্যি খেলবেন? সুনন্দ ভয়ে ভয়ে বলে।

নিশ্চয়। মামাবাবু বসে পড়ে গুটি সাজাতে থাকেন।

সুনন্দ আমার দিকে আড়চোখে তাকায়। তার চোখে কৌতুক ঝিলিক দিয়ে ওঠে।

খেলা আরম্ভ হয়।

সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে দুজনকে ঘিরে। স্তম্ভিত বিস্ময়ে দেখতে থাকে খোপ খোপ ঘর কাটা বোর্ড। অদ্ভুত দেখতে গুটিগুলো।

আমিও হাঁ করে দেখছি। হঠাৎ এমন সাড়ম্বরে দাবা খেলার শখ কেন মামাবাবুর? গভীর উদ্দেশ্য একটা আছে নিশ্চয়, কিন্তু রহস্যটা কী? মাথামুণ্ডু কিছুই ধরতে পারছি না। গম্ভীর মুখে মামাবাবু চাল দিচ্ছেন।

মামাবাবু দুর্ধর্ষ দাবাড়ু। সুনন্দ কতক্ষণ টিকবে তার সামনে? তারপর ব্যাপার-স্যাপার দেখে সে নার্ভাস। দেখতে দেখতে বোড়ে, ঘোড়া, গজ ইত্যাদি ঝপাঝপ কাটা পড়তে লাগল। পাঁচ মিনিটে মাৎ। সুনন্দর রাজাকে নিয়ে মামাবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন সোয়াহিলিতে, পেয়েছি, পেয়েছি। ইউরেকা! হা হা, আছে। এই দ্বীপেই আছে। সেরকম এক দৈবশক্তি সম্পন্ন পাথর। তার সাহায্যে আমার ওষুধের গুণ ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

কোথায়? কোথায়? সমস্ত জনতা চিৎকার করে ওঠে।

দাঁড়াও সেটা গুণে দেখি।

মামাবাবু এবার পকেট থেকে বের করলেন একখণ্ড সাদা কাগজ। মাটিতে বিছিয়ে পাতলেন। তারপর পেন ঘুলে খসখস করে এঁকে চললেন বৃত্ত, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, পঞ্চভূজ–যত রাজ্যের জ্যামিতিক নকশা।

মাঝে মাঝে বিড়বিড় করছেন। কখনো কী গুণছেন। সবাই গোল গোল চোখ করে দেখছে। দারুণ টেনশন।

হঠাৎ তিনি বলে ওঠেন, ই পেয়েছি। কাগজের ওপর চোখ রেখে তিনি জোরে জোরে হিসেব করেন–চত্বরের পুব-দক্ষিণ কোণ বরাবর পঞ্চাশ হাত। একটা ছোট কুটির। কেউ থাকে না তাতে। না না ভুল হল, থাকে। তবে মানুষ নয়। মূর্তি। এ হচ্ছে তোমাদের মুঙ্গুর কুটির। ভিতরে আছে পাথরটা।

মুঙ্গুর কুটিরের ভিতর? সর্দার আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে।

হ্যাঁ, কালো রঙের বেশ বড় পাথর।

কই সেরকম কোনো পাথর তো নেই কুটিরে। একজন বলে।

নেই? মামাবাবু অবাক হন। আবার কয়েকবার আঁচড় কাটেন কাগজে। তারপর বলেন, আচ্ছা, তোমাদের মুঙ্গু কী দিয়ে তৈরি? পাথরের? কালো রঙ, চৌকো গড়ন?

হ্যাঁ হ্যাঁ।

মামাবাবুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ব্যস, তবে ঐ মুহূকে আমার চাই। মুই একমাত্র পারে আমার ওষুধের গুণ ফিরিয়ে দিতে। আর কোনো তেমন পাথর নেই এখানে। মুঙ্গুর সামনে আমি পুজো করব। মন্ত্র পড়ব। তারপর ওষুধ ছোঁয়াব তার গায়ে। অমনি ওষুধে। আবার নতুন প্রাণ পাবে। সেই ওষুধ খেলেই সর্দারের ছেলে চাঙ্গা হয়ে উঠবে।

সমস্ত জনতা কেমন আড়ষ্ট অসাড় হয়ে যায়। কারো মুখে কোনো কথা নেই। এ ওর দিকে তাকাচ্ছে।

বুঝলাম কোথাও একটা গরমিল হয়ে গেছে।

ভেবেছিলাম মুঙ্গুর নাম শুনেই সর্দার হুকুম দেবে–লে আও মুকে। আভি। কিন্তু এই দ্বিধা কেন? প্রস্তাবটি কাজে পরিণত করতে কোথায় যেন বাধা আছে।

সর্দার এগিয়ে এল। আমতা আমতা করে বলল, কিন্তু মূহুর সামনে পুজো হবে কী করে? বিদেশিদের পক্ষে এই দেবতাকে দর্শন যে বারণ। নিষিদ্ধ।

মামাবাবু আশ্চর্য হয়ে বলেন, তাই নাকি! বিশেষ কারণেও দেখা চলবে না?

না।

তাহলে আমি নিরুপায়। মামাবাবু উদাসভাবে মুখ ফেরান। তোমার ছেলের জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে। বেচারার দেখছি নেহাতই প্রাণটা যাবে। কী কড়া তোমাদের নিয়ম! দেখো ভেবে, কোনো রকমেই কি সম্ভব নয় মুম্বুর সামনে আমার পুজো করা? তাহলে ছেলেটা বাঁচত।

না না না। এ অসম্ভব। একেবারে অসম্ভব। একটা তীক্ষ্ণ, তীব্র গলা মামাবাবুর কথা শেষ করতে দেয় না।

সচকিতে তাকিয়ে দেখি কামাউ।

তার দীর্ঘ বাঁকানো শরীরটা উত্তেজনায় সোজা হয়ে উঠেছে। চোখ দুটো ধকধক করে জ্বলছে রাগে।

অপবিত্র বিদেশির দৃষ্টি মুঙ্গুর গায়ে লাগলে সর্বনাশ হবে। ধ্বংস হয়ে যাবে সবাই।

কামাউ সর্দারের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলে, মাহিন্ডির শয়তানি। ওরা আমার দেবতাকে অপমান করতে চায়।

মামাবাবু সঙ্গে সঙ্গে জিভ কেটে হাতজোড় করেন, আরে ছি ছি! তোমার পবিত্র মুঙ্গুকে অপমান করতে কি পারি? মুঙ্গুকে দেখা নেহাত যদি নিষিদ্ধ হয় তবে থাক। কিন্তু এও শোনো সর্দার–আমরা সাধারণ বিদেশি নই। অনেক শক্তি আমাদের। অনেক মন্ত্র জানি। তার প্রমাণ তো তোমরা পেয়েছ, বিদেশির দৃষ্টি গায়ে লাগলে মুঙ্গ যাতে অসন্তুষ্ট না হন তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা আমরা করব। পুজো দেব। তোমরাও ভালো করে পুজো লাগিও তার রাগ কমাতে। আমি নিশ্চিত জানি সর্দারের প্রিয় ছেলের প্রাণরক্ষার চেষ্টা করতে এই সামান্য নিয়মভঙ্গ হলে মুঙ্গু অপরাধ নেবেন না। দ্বীপের কারো কোনো ক্ষতি হবে না। এখন তোমরা ভেবেচিন্তে কী করতে চাও–

মামাবাবু কলমটা পকেটে গুঁজলেন। সযত্নে বৃত্ত, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ অঙ্কিত জ্যোতিষচর্চার নিদর্শন কাগজটি ভাঁজ করে পকেটে রাখলেন, তারপর গালে হাত দিয়ে উদাস হয়ে বসে রইলেন।

দাবার গুটি বোর্ড সুনন্দ ইতিমধ্যে গুছিয়ে ফেলেছিল।

দেখি, কামাউয়ের মুখ আক্রোশে বিকৃত হয়ে উঠেছে। মুঙ্গুর সম্মান রক্ষা করতে সে বদ্ধপরিকর।

সর্দার দ্বিধাগ্রস্ত। ধর্মবিশ্বাস ও প্রিয় ছেলের প্রাণ, এই দোটানায় দুলছে তার হৃদয়। সর্দার কামাউয়ের দিকে এগিয়ে গেল। সমস্ত ভিড়টা তাদের ঘিরে ধরল।

সর্দার ও কামাউয়ের মধ্যে কথা আরম্ভ হল। বুঝলাম, কামাউ সম্মতি দিলেই সর্দার আমাদের মুঙ্গুর সাক্ষাতে হাজির করবে।

প্রথমে নিচু স্বরে কথাবার্তা হচ্ছিল, কিন্তু ক্রমে দুজনের গলাই চড়তে থাকে। কামাউয়ের এক কথা বার বার কানে আসছিল, আপানা আপানা, অর্থাৎ না না।

সর্দারের মেজাজও গরম হচ্ছিল।

অন্যদের হাবভাব দেখে মনে হল তারাও সর্দারের পক্ষে। অসুস্থ ছেলেটি তাদের পরম প্রিয়। তার প্রাণ বাঁচাতে তাদের আগ্রহ বেশ বোঝা যাচ্ছিল। তাছাড়া মুঙ্গুর মেজাজ শান্ত করতে যে দাওয়াই মামাবাবু বাতলেছেন সেটাও তাদের মনে ধরেছে। কামাউয়ের চেয়ে আমাদের শক্তির ওপরই তাদের বেশি আস্থা।

মিনিট দশেক পর সর্দার গটগট করে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। গম্ভীর স্বরে বলল, আমি আদেশ দিচ্ছি, যাও তোমরা মুঙ্গুর সামনে পুজো আরম্ভ করো। কেউ বাধা দিতে এলে তার মাথাটা আর ধড়ের ওপর আস্ত থাকবে না, মনে রেখো।

মুখ ঘুরিয়ে সর্দার কামাউ এবং তার গুটিকতক ভক্তকে ক্রুদ্ধ চোখে দেখে নেয়।

কামাউ তখন রাগে ফুলছে। চিৎকার করে অভিশাপ দিচ্ছে, সবংশে নিপাত যাবি।

মুঙ্গু কাউকে রক্ষা রাখবে না। শয়তান বিদেশিগুলোকে এখুনি খতম কর। কী, তোরা দাঁড়িয়ে দেখছিস কী? বাধা দে।

কিন্তু কেউ বাধা দিল না। প্রতিবাদ করল না। কামাউয়ের দুই চেলা ত্যাড়া-বাকা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছিল। কিন্তু তারাও এগোলো না।

উঃ অসহ্য! নিষ্ফল ক্রোধে ফুলতে ফুলতে কামাউ দ্রুত পায়ে সেই স্থান ত্যাগ করে চলে গেল।

সর্দার বলল, কী কী দরকার বলো, আনিয়ে দিচ্ছি।

মামাবাবু বললেন, থাক, আমরা নিজেরাই জোগাড় করে নেব! তারপর গলা নামিয়ে আশ্বাসের সুরে বললেন, কিছু ঘাবড়িও না। মুত্যুকে আমি ঠিক ম্যানেজ করে দেব। চটবে না।

সুনন্দ শীগগির বেশ কিছু নারকেল ছোবড়া জোগাড় করো। আর একটা পাত্র। ধোঁয়া দিতে হবে।

কার বুদ্ধির গোড়ায় কে জানে! আমার কানে ফিসফিসিয়ে কথা কটা বলে সুনন্দ, এই যাচ্ছি মামাবাবু! বলে একলাফে এগোলো।

মুঙ্গুর মন্দিরের দরজায় চাপা কাঠের তক্তাটা আগে থাকতেই ভোলা ছিল। মন্দিরের কাছে পৌঁছে মামাবাবু অর্ডার দিলেন, এবার ছোবড়ায় আগুন লাগাও। খুব ধোঁয়া হয় যেন।

একটা হাতলওলা স্টিলের ডেকচি ঠেসে নারকেল ছোবড়া ভরা হয়েছিল। সুনন্দ লাইটার জ্বেলে আগুন দিল। তারপর দুজনে ফুঁ দিয়ে দিয়ে ধোঁয়ার মেঘ তৈরি করে ফেললাম।

মামাবাবু হঠাৎ হাঁ রে রে রে বলে বিকট এক হুঙ্কার ছাড়লেন। তারপর দরজার মুখে গিয়ে দাঁড়ালেন। আমাদের বললেন, আমি ভিতরে ঢুকছি। তোমরা দরজার মুখে বসে পড়ো। খুব ধোঁয়া ওঠাও আর যা ইচ্ছে মন্ত্র আওড়াও। জোরে জোরে।

মন্ত্র! কীসের মন্ত্র?

আহা, ঐ কবিতা-টবিতা যা হয় কিছু। বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত যা মনে আসে। থামবে । এই বলে তিনি দৃঢ় পদক্ষেপে মুজুর মুখোমুখি হলেন।

একনজরে একবার দেখে নিলাম মুঙ্গুকে।

ঘরটার সামনে তখন সমস্ত দ্বীপের বাসিন্দা এসে জড়ো হয়েছে। থমথমে আবহাওয়া। মুহূকে বিদেশি চর্মচক্ষে দেখল–না জানি কী অঘটন ঘটবে। বজ্রপাত না ভূমিকম্প! এক অজানিত আশঙ্কায় তাদের হৃদয় আচ্ছন্ন। মুখগুলো বিবর্ণ। চোখে ভয় বিস্ময়।

বুঝছি যে সমস্ত ব্যাপারটায় এক বিরাট প্যাঁচ খেলছেন মামাবাবু। কিন্তু কেন? উদ্দেশ্য কিছু ধরতে পারছি না। জিজ্ঞেস করারও উপযুক্ত সময় নয় এটা। অতএব প্রতীক্ষা করা যাক। ধীরে ধীরে সব রহস্যই উঘাটিত হবে।

সুনন্দকে বললাম, আমি বাংলা চালাচ্ছি, তুই দেবভাষা ঝাড়।

অলরাইট! সংস্কৃতে আমার লেটার ছিল ম্যাট্রিকে, শুনবি?

দুজনে আচমকা এমন বিটকেল হেঁড়ে গলায় আওয়াজ ছাড়লাম যে সামনের লোকগুলো চমকে সাত হাত পিছিয়ে গেল। দুটো তালপাতার পাখা দিয়ে প্রাণপণে ধোঁয়া ওড়াই আর মুঠি পাকিয়ে কী ভীমবিক্রমে কাব্যপাঠ। বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছিল কারণ ভিতর থেকে মামাবাবুর চাপা স্বর শুনলাম, একটু আস্তে।

ঝাড়া পনেরো কুড়ি মিনিট চিৎকার করে গলাটা আমার ধরে এল। দম নিতে থামলাম।

মামাবাবু কী করছেন? কৌতূহলী হয়ে পিছনে তাকালাম।

ভীষণ অবাক হয়ে দেখলাম তিনি সেই অদ্ভুতদর্শন বিগ্রহের পরে ঝুঁকে পড়েছেন। হাতে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস। গ্লাসে চোখ লাগিয়ে কী দেখছেন। একেবারে তন্ময়। পাশে মাটির ওপর খোলা একখানা সাদা কাগজ, কী সব ছবি আঁকা। একটা পেন্সিল মাটিতে পড়ে।

একটা নিচু মাটির বেদির ওপর শিলের মতো একখণ্ড কালচে পাথর চিৎ করে শোয়ানো। পাথরের ওপর খোদাই করা এক মূর্তি। প্রায় হাতখানেক লম্বা। মানুষের মূর্তি নয় এটুকু বুঝলাম। কোনো জন্তু বা কোনো কাল্পনিক বস্তু। অদ্ভুত আকৃতি।

আমার দেখাদেখি সুনন্দও পিছনে তাকিয়েছে। দুজনেরই চিৎকার বন্ধ হয়ে গেছে।

মামাবাবু মুখ তুললেন, কী ব্যাপার? দেখলেন, আমরা হাঁ করে তাকিয়ে আছি। আঙুল নেড়ে ডাকলেন, দেখে যাও।

ধুনুচিটা দরজার গোড়ায় রেখে আমরা পায়ে পায়ে যাই।

এবার স্পষ্ট করে খুঁটিয়ে দেখলাম।

উপাস্য বিগ্রহ যে এমন ভয়াবহ বিকট হতে পারে ধারণাই ছিল না। উপজাতিদের কাণ্ডকারখানাই আলাদা! এটাকে কী বলব? কোনো জন্তু? না। মনে হল কোনো টিকটিকি বা গিরগিটি জাতীয় জীবের কঙ্কাল যেন পাথরের ওপর সেঁটে দেওয়া হয়েছে। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই স্মৃতি-কোঠায় একটি বর্ণনা বিদ্যুতের মতো চমক দিয়ে যায়।

জঙ্গলের মধ্যে আগুন ঘিরে অসভ্য আদিবাসীদের উৎসব হচ্ছে। আগুনের পাশে রাখা হয়েছে এক মূর্তি–বিচিত্র। বীভৎসাকৃতি। আর দুর থেকে লুকিয়ে দূরবীন চোখে দেখছে–বিল। ডেয়ারিং বিল।

মামাবাবু বললেন, মনে পড়েছে কারো কথা?

হা হা। দুজনে প্রায় একসঙ্গে বলে উঠি।

আমার মনে হয় এটা সেই মূর্তি। সেই দেবতা। কিন্তু কী বস্তু এটা বুঝতে পেরেছ? প্রশ্নটা তিনি করেন সুনন্দকে।

এ তো খোদাই করা মূর্তি নয়। ফসিল। সুনন্দ বলে।

কারেক্ট। কিন্তু কীসের?

কোনো সরীসৃপের বোধহয়। গিরগিটি বা কুমীরের ছানা।

তোমার মুণ্ডু। মামাবাবু চাপা গলায় ধমকে ওঠেন। সুনন্দ থতমত খেয়ে যায়।

ব্যস ব্যস, দেখা হয়েছে। এবার তোমাদের ডিউটি করো। দরজায় লোক উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। বেশিক্ষণ নয়, আর পাঁচ মিনিট। আমি স্কেচটা শেষ করে নিই।

এক অজানিত রহস্যের গন্ধে আমার মন আনচান করে ওঠে। খোদাই করা মূর্তি, না ফসিল! সুনন্দের প্রাণিবিজ্ঞান চর্চা করা চোখ সেটুকু আবিষ্কার করতে ভুল করেনি। কিন্তু কীসের? সুনন্দও ভুল করেছে। যাক আপাতত মামাবাবুর কথামতো আবার মন্ত্রপাঠ আরম্ভ করি। ধোঁয়া ওড়াই।

উত্তেজনার বশে এবার আমি ধরেছি ইংরেজি আর সুনন্দ বাংলা।

পাতার পর পাতা হ্যামলেট বলে যাচ্ছি। দু-এক টুকরো অভিনয়ও দেখাচ্ছি সামনের স্তম্ভিত মুগ্ধ দর্শকবৃন্দকে। কলেজ লাইফে অসিত রায় হ্যামলেট করে মেডেল পেয়েছিল। সুনন্দ আউড়াচ্ছে নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ। এক কবিতাতেই পাঁচ মিনিট কাবার করে দেবার মতলব।

সহসা যবনিকা পতন।

পিছন থেকে মামাবাবুর গলা পেলাম, ব্যস, থামো এবার। চলো, সর্দারের ছেলেকে দেখতে যাই।

তাঁবুতে ফেরার পথে মামাবাবুকে দেখলাম চুপচাপ, অন্যমনস্কভাবে পথ চলছেন। ক্যাম্পে পৌঁছে তিনি আমাদের সঙ্গে একটি কথা না বলে বই হাঁটকাতে আরম্ভ করলেন। দেখলাম, মুঙ্গুর ছবিটা পিচবোর্ডের ওপর ক্লিপ দিয়ে আটকে পাশে রেখেছেন।

এরকম গুরুগম্ভীর ভাবগতিক দেখে আমার প্রশ্ন-টশ্ন করার সাহস উবে গেল। যদিও প্রচণ্ড কৌতূহল। নিজেদের মধ্যে নিচুস্বরে কথা কই। বাইরে রান্নার জোগাড়যন্ত্র করি আর লুকিয়ে লুকিয়ে দেখি মামাবাবুর হালচাল।

একদফা চা হল।

মামাবাবুকে দিলাম এক কাপ। মুখ না তুলেই তিনি কাপ নিলেন।

চারদিক নিস্তব্ধ! শুধু টুপটাপ পাতা ঝরার শব্দ। টুংটাং বাসনের আওয়াজ। সুনন্দকে জিজ্ঞেস করি, হারে, ওটা বুঝি খোদাই করা মূর্তি, না ফসিল?

হ্যাঁ।

দেখতে কিন্তু অবিকল খোদাই করা মূর্তির মতন। যেন পাথর কুঁদে একটা কঙ্কাল তৈরি করেছে কেউ।

হুঁ, পুরো দেহটা কাদায় পড়ে ডুবে যায়। তারপর প্রাণিদেহের নরম অংশগুলো গলে গিয়ে পুরো হাড়ের অংশটুকু জমে শক্ত পাথর হয়ে গেছে। আর যে কাদায় ডুবেছিল সেই কাদায় হয়েছে কাদা পাথর। দেখলি না পাথরটার রঙ কালো কিন্তু মূর্তিটার রঙ সাদাটে। দুটো তো এক পাথর নয়।

কিন্তু কীসের ফসিল?

সেইটেই তো ধরতে পারছি না! সুনন্দ চিন্তিত স্বরে বলে।

দু-ঘন্টা কেটে গেছে।

রান্না তৈরি। আজ সুনন্দ বানিয়েছে ভুট্টার ছাতুর সঙ্গে মাংস মিশিয়ে সুরুয়া, নুন মাখানো সিদ্ধ ধুঁধুল। কাছিমের সিদ্ধ ডিম এবং সামুদ্রিক শ্যাওলা।

এই শ্যাওলা মামাবাবুর আবিষ্কার। সমুদ্রের ধারে পাথরের খাঁজে দেখেই বলেছিলেন, এ শ্যাওলা আমি খেয়েছি, জাপানে। খুব উপকারী। অতএব আমরাও খাচ্ছি, কাঁচাই। ভালো করে ধুয়ে নিয়ে সামান্য টমাটো সস মাখিয়ে। আমার তত উপাদেয় ঠেকে না, কিন্তু সুনন্দ খুব ভক্ত হয়ে পড়েছে।

মামাবাবুর সাড়াশব্দ নেই। খেতে ডাকা উচিত হবে কি না ভাবছি। এমন সময় ডাক শুনলাম, সুনন্দ শুনে যাও। অসিত তুমিও এসো।

দুজনে এক ছুটে তাঁবুর ভিতরে ঢুকলাম।

দেখি, মামাবাবু মাটিতে কম্বল পেতে বসে, সামনে একখানা খোলা বই। পাশে বিছানো রয়েছে সেই স্কেচটা বইয়ের যে পাতা খোলা সেটার পাতা জোড়া কোনো ফোটোগ্রাফের ছবি। কোনো অদ্ভুত আকৃতির প্রাণী বা প্রাণীর কঙ্কাল।

মামাবাবু বইয়ের ছবিটা দেখিয়ে সুনন্দকে বললেন, চিনতে পারো? এখন মিলিয়ে দেখ এর সঙ্গে এদের দেবতাকে।

সুনন্দ তাকিয়ে রইল। এক-দুই…প্রায় দশ সেকেন্ড। চোখের পলক পড়ছে না। তারপরই সে চেঁচিয়ে ওঠে, আর্কিঅপটেরিক্স! এ তবে আর্কিঅপটেরিক্স-এর ফসিল?

না। মামাবাবু মাথা নাড়েন। আমিও প্রথমে তাই ভেবেছিলাম। ভালো করে পরীক্ষা করো। তফাত ধরতে পারছ?

আমি তখন বইয়ের ছবি খুঁটিয়ে দেখছি–

কোনো জীবন্ত প্রাণী নয় বুঝলাম, ফসিলের ছবি। পাথরের গায়ে কোনো প্রস্তরীভূত কঙ্কাল। দেহের রক্তমাংস মাটির তলায় চাপা পড়ে গেছে। শুধু হাড়ের কঙ্কাল জমে পাথর হয়ে গেছে।

লম্বা গলা। ছোট মাথার খুলি। চোয়াল ক্রমশ ছুঁচলো হয়ে গেছে, অনেকটা কুমীরের চোয়ালের মতো গড়ন। চোয়ালের মধ্যে দু-সারি দাঁত দেখা যাচ্ছে। চার পা। সামনের পা দুটো অপেক্ষাকৃত ছোট। বাঁকানো আঙুলের মাথায় তীক্ষ্ণ নখ। প্রাণীটার লম্বা লেজও ছিল। এখন মাংস তো নেই। ছোট ছোট অস্থিখণ্ড জোড়া পাথরের লেজটা দেখতে বীভৎস।

একটা জিনিস দেখে চমকে উঠি। ছবির নিচে লেখা Archaeopteryx (ancient bird)। এই সেই প্রাচীন পাখি–

দেখলে গিরগিটির মতো কোনো সরীসৃপের ফসিল বলেই মনে হয়।

মামাবাবুর হাতে আঁকা মুঙ্গুর ছবির সঙ্গে আরকিঅপটেরিক্স-এর ফসিলের ছবিটা মিলিয়ে দেখলাম, দুই-ই একরকম। অমনি গলা, মাথা, মুখের ভিতর দাঁতের সারি। লম্বা লেজ, চারটে পা, দুটো এক ভাবাই স্বাভাবিক। কিন্তু দুটো যে এক জাতের নয় সে তো কানেই শুনলাম। কিন্তু বইয়ের ঐ ছবি পাখির ফসিল হয় কী করে?

সুনন্দ একদৃষ্টে চেয়ে ভাবছে। একবার বইয়ের ছবি, একবার মুজুর স্কেচটাকে লক্ষ্য করছে।

মামাবাবু নীরব।

মামাবাবু বললেন, এই পাখি জুরাসিক যুগ, অর্থাৎ প্রায় আঠারো কোটি বছর আগেকার জীব। এর চেয়ে প্রাচীন পাখির ফসিল এখনও আবিষ্কার হয়নি।

তখনও এরা পুরোপুরি আধুনিক পাখি হয়ে উঠতে পারেনি। সরীসৃপের অনেক চিহ্ন তখনও তাদের দেহে বর্তমান।

জীবন্ত আরকিঅপটেরিক্স দেখার সৌভাগ্য অবশ্য কোনো মানুষের হয়নি। বৈজ্ঞানিকরা আন্দাজে স্থির করেছেন কেমন দেখতে ছিল সরীসৃপের অতি নিকট-আত্মীয় পক্ষি-জগতের এই আদিপুরুষ।

মামাবাবু বই খুলে একখানা ছবি দেখান—

আরেব্বাস! বলে না দিলে কে একে পাখি ভাববে? ভাবতাম নির্ঘাত সেই রূপকথার ড্রাগন। কঙ্কালের গায়ে মাংস লাগানো হয়েছে। অক্ষিকোটরে বসেছে একজোড়া হিংস্র চক্ষুতারকা। ফাঁক করা ঠোঁটের মধ্যে দু-সারি করাতের মতো দাঁত দেখা যাচ্ছে। পাখির চিহ্ন বলতে দেখলাম, একজোড়া ডানা। সামনের দু-পায়ের সঙ্গে আটকানো। আর তার পাখায়, লম্বা লেজে বড় বড় মোটা মোটা পালক। পালকগুলো নরম নরম নয়। কেমন শক্ত শক্ত, সোজা সোজা। গায়ে ওগুলো কী? আঁশ, না পালক?

মামাবাবু বললেন, দুই-ই ছিল।

ছবিতে গাছের ডাল আঁকড়ে ঝুলছে পাখিটা।

কত বড় হত এই পাখি? আমি জিজ্ঞেস করি।

বেশি বড় নয়। ধরো এই কাক বা পায়রার সাইজ। কই হে সুনন্দ, কিছু বলছ না যে? মামাবাবু অধীর হয়ে ওঠেন।

না, মানে কয়েকটা তফাত ধরতে পারছি, তবে ঠিক–সুনন্দ আমতা আমতা করতে থাকে।

কি, আমার স্কেচটা বুঝতে কষ্ট হচ্ছে? বেশ এই দেখ।

একটা পেন্সিল নিয়ে উল্টো পিঠ দিয়ে তিনি পয়েন্ট আউট করতে থাকেন।

এই হচ্ছে বার্লিন মিউজিয়ামে যে ফসিলটা রয়েছে তার ফোটো। আরকিঅপটেরিক্স-এর বেস্ট স্পেসিমেন। আমি নিজের চোখে দেখেছি। এখন লক্ষ্য করো, প্রথমে গলা–মুর গলা দেহের তুলনায় অনেক লম্বা এবং সরু। তারপর মাথা।

এই গিরগিটি-অবতারের মাথার খুলি বেশি বড়। চোয়াল চওড়া, দাঁতগুলোও বড় বড়। অর্থাৎ এই প্রাণীর পাখির সঙ্গে আদল আরও কম এবং পূর্বপুরুষ সরীসৃপের অনেক কাছাকাছি।

হ্যাঁ, লেজ দেখ।

এই ফসিলের লেজ বার্লিন ফসিলের তুলনায় কিছুটা লম্বা। আঙুলও এর মোটা মোটা। সোজা সোজা, আরকিঅপটেরিক্স-এর মতো বাঁকানো বাঁকানো নয়। নখ ভেঁতা। ওড়ার চেয়ে হাঁটত বেশি, তাই এইরকম আঙুলের গঠন। যেমন উটপাখির হয়।

ছবি দেখে ঠিক বুঝতে পারবে না। আরকিঅপটেরিক্স-এর ফসিল চোখে দেখলে বুঝতে দ্বীপের ফসিলের সামনের পায়ের হাড় মোটা ও লম্বা। অর্থাৎ তখনও সামনের পা দুটো একেবারে অকেজো হয়ে যায়নি। পরে দিনে দিনে সামনের পা ডানার সঙ্গে জুড়ে ডানার অংশ হয়ে যায়।

আর এই প্রাণী যে আরকিঅপটেরিক্স থেকে পুরনো তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এর ডানা এবং পালক। মুঙ্গুর ডানাটি এঁকেছি আরকিঅপটেরিক্স-এর থেকে ঢের ছোট। কাদা পাথরের গায়ে ডানার ছাপ স্পষ্ট পড়েছে, হয়তো এই প্রাণী একেবারেই ডানা নেড়ে উড়তে পারত না। মাঝে মাঝে ছুটে এসে দু-ডানা মেলে খানিকক্ষণ বাতাসে ভাসত। অবশ্য আরকিঅপটেরিক্স কিছু ওড়ায় ওস্তাদ ছিল না, আধা-ওড়া আধা-হাঁটার ওপর থাকত বলে অনুমান করা হয়েছে।

মামাবাবু বলেন, এবার লক্ষ করো পালক। সবচেয়ে ইমপর্ট্যান্ট পয়েন্ট। স্কেচটা অবশ্য তেমন নিখুঁত হয়নি, তাড়াহুড়োয় এঁকেছি। আগুনের আভায় মুঙ্গুকে দূর থেকে দূরবিনে দেখে আমিও ভেবেছিলাম আরকিঅপটেরিক্স। অবশ্য একদম প্রথমে আমারও সরীসৃপ বলে ভুল হয়েছিল। তারপরই ডানার ছাপটা লক্ষ করলাম। কিন্তু কুটিরে ঢুকে কাছ থেকে দেখে চমকে গেলাম। একি! আরকিঅপটেরিক্স তো মনে হচ্ছে না–কিছু কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গড়ন যেন অন্যরকম। পাথরের দেহের কোমল অংশের ছাপ পরীক্ষা করে বুঝলাম এ আরকিঅপটেরিক্স নয়, তার পূর্বপুরুষ। কাদা পাথরে আঁশ এবং পালকের ছাপ পরিষ্কার পড়েছে। দেখলাম এটায় আরকিঅপটেরিক্স-এর তুলনায় পালক অনেক কম, আঁশ বেশি।

আপনি বুঝি লুকিয়ে দেখেছিলেন মুস্তুকে?এতক্ষণে সুযোগ বুঝে আমি প্রশ্ন করি। ঐ জন্যে তাঁবুতে এসেছিলেন রাত্তিরে? দূরবিন নিতে?

হ্যাঁ, বাধ্য হয়ে। শুনলে তো মুঙ্গুকে বিদেশিদের দেখা বারণ। ডেয়ারিং বিলকেও দেখতে দেয়নি। নাচের আসরে যাওয়া মাত্র কামাউ আমাকে ভাগিয়ে দেয়। আমিও ছাড়ব না। তবু থেকে দুরবিন নিয়ে গিয়ে বিলের মতোই আড়াল থেকে লুকিয়ে দেখি। চত্বরের এককোণে পাথরটা খাড়া করা ছিল।

ও তারপরে আরও ভালো করে দেখবার জন্য এই ফন্দি আঁটলেন? সুনন্দ বলে।

হ্যাঁ। মামাবাবু হাসেন। এত সহজে খেটে যাবে প্ল্যানটা ভাবিনি। যাক এ-প্রাণী যে আরকিঅপটেরিক্স থেকে কয়েক কোটি বছরের পুরনো আশা করি তা প্রমাণ হচ্ছে।

মামাবাবু বলেন, আমি এই প্রাণীকে পুরোপুরি পাখি বলব না। আবার পুরোপুরি সরীসৃপও নয়। বলব সরীসৃপ এবং পাখির মধ্যে এটাই হচ্ছে মিসিং লিঙ্ক–হ্যারানো সূত্র। আই ওয়াজ রাইট!

মামাবাবু শেষ করতেই সুনন্দ লাফিয়ে ওঠে, ওঃ এটা যে দারুণ একটা আবিষ্কার হবে মামাবাবু। চারদিকে একেবারে হইচই পড়ে যাবে!

তা একটু পড়বে। তবে আমি সবচেয়ে খুশি হয়েছি কেন জানো?

কেন? সুনন্দ বলে।

এইবার ডক্টর মিলার ধরাশায়ী হবেন। তার ধারণা, পাখি নাকি ইউরোপেই প্রথম হয়েছিল। কারো কথা মানে না। বেজায় দাম্ভিক। ফসিল দেখে বাছাধন কী করবেন তাই ভাবছি।

কিন্তু ফসিল দেখাবেন কী করে? এখান থেকে নিয়ে যাবেন কী উপায়ে? সুনন্দ বলল।

সে নিয়ে পরে মাথা ঘামানো যাবে। আপাতত খেতে দাও। বকবক করে বেজায় খিদে পেয়ে গেছে।

মামাবাবু আশ্চর্য লোক।

অমন উত্তেজনার দিনেও তার দৈনন্দিন প্রোগ্রামে বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত হল না। খেয়ে উঠে যথারীতি নিশ্চিতভাবে বই খুলে শুয়ে পড়তে লাগলেন।

আমরা এদিকে ছটফট করছি। কথা বলতে চাইছি, কিন্তু মামাবাবুর যেন ও-বিষয়ে কোনো আগ্রহই নেই। আমি ও সুনন্দ অনেকক্ষণ বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করি। কথা বলতে পারছি না পাছে মামাবাবুর ডিসটার্বেন্স হয়। তবু ফিসফিস করে বললাম, ওঃ মামাবাবু সাংঘাতিক ফেমাস হয়ে যাবে, বুঝলি। মিসিং লিঙ্ক আবিষ্কার! সোজা ব্যাপার?–তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি।

ঘুম থেকে উঠে দেখলাম মামাবাবু নেই। সুনন্দ, ভেঁস ভেঁস করে ঘুমোচ্ছে। তাকে ধাক্কা দিলাম, এই ওঠ ওঠ। তিনটে বাজে।

কী হয়েছে! সুনন্দ তড়াক করে উঠে বসল।

আর কতক্ষণ ঘুমোবি! শোন না–তোকে কতগুলো জিনিস জিজ্ঞেস করব।

কী? সুনন্দ চোখ কচলাতে কচলাতে বলে।

আচ্ছা, ফসিলের বয়স জানা যায় কী করে?

আধুনিক পদ্ধতি হচ্ছে তেজস্ক্রিয়তা পরীক্ষা করা। রেডিও-অ্যাক্টিভিটি টেস্ট। প্রস্তরীভূত কঙ্কাল অথবা যে পাথরের ভিতর ফসিলটা আটকে আছে তার মধ্যে ইউরেনিয়াম, পটাশিয়াম, থোরিয়াম ইত্যাদি কোনো তেজস্ক্রিয় পদার্থ থাকলে রাসায়নিক পরীক্ষা করে সহজেই ফসিলের বয়স ঠিক করা যায়।

আর যদি তেজস্ক্রিয় পদার্থ না থাকে?

তখন দেখতে হবে কোন ভূ-স্তরে ফসিলটা পাওয়া গেছে। সেই স্তরের বয়স কত? অথবা সেই স্তরে অন্য যেসব উদ্ভিদ বা জীবের ফসিল পাওয়া যাচ্ছে তারা কত পুরনো। ইতিমধ্যে বিজ্ঞানীরা অনেক পাথর এবং ফসিলের বয়স বের করে ফেলেছেন। সেরকম কোনো জানা ফসিল বা পাথরের সঙ্গে মিলিয়ে যে ফসিলটা আবিষ্কার হল তারও বয়স অনেকটা জানা যাবে।

কিন্তু ঐ মুঙ্গু মানে দ্বীপের ফসিলের বয়স বুঝবি কী করে? রাসায়নিক পরীক্ষা হল না, কোথায় পাওয়া গেছে জানা নেই। তবে?

এফসিলটা জলের মতো সহজ। এর জন্যে পরীক্ষার দরকার হয় না। স্রেফ দেখেই বলা যায়। কারণ আরকিঅপটেরিক্স-এর বয়স বের করা আছে। এটা যে তারই পূর্বপুরুষ তোর মতো গাধাও চোখে দেখে বলে দিতে পারে!

ও! তা তুই বলতে পারলি না কেন? বললি গিরগিটি।

মামাবাবুর মতো আমার অত অভিজ্ঞতা নেই। তাছাড়া আরকিঅপটেরিক্স-এর ফসিল আমি চোখে দেখিনি, শুধু ছবি দেখেছি। তারপর অন্ধকার ঘর, ধোঁয়া, কিন্তু পরে ঠিক বলেছিলাম, মামাবাবুর স্কেচ দেখেই। তবে তফাতটা ধরতে দেরি হচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম দুটো এক নয়, কিন্তু নার্ভাস লাগছিল। আর একটু সময় পেলেই–