» » মুঙ্গু

বর্ণাকার

অজেয় রায়

মুঙ্গু

নয়

দেখতে দেখতে ন-টা দিন কেটে গেল। আজ দশ দিনের দিন। কাল আমরা উপকূলে ফিরে যাব।

সকালে সমুদ্রতীরে গিয়ে দেখলাম দুটো বড় বড় ছিপনৌকো সাজানো হচ্ছে। সেগুলোকে জলের ধারে টেনে আনা হয়েছে। নানারকম জিনিস বোঝাই হচ্ছে নৌকোতে। নারকেল, ছোবড়া, শাঁখ, ঝিনুক, কড়ি, হাঙরের দাঁত, পশুচর্ম, প্রবাল প্রভৃতি হরেক রকম তাদের রপ্তানির জিনিস। টোটো বলল, এই সবের বদলে আনা হবে শস্য, কাপড়, লোহার ফলা, সৌখিন গয়নাগাঁটি, নুন।

আমাদের মন খুব উৎফুল্ল হবার কথা, কিন্তু জানি না মন কেমন করছে চলে যেতে।

মামাবাবু একবার বললেন, ইস, এত তাড়াতাড়ি যাব! আমার কাজ তো কিছুই এগোয়নি। দ্বীপের কতটুকু বা সার্ভে হল? এক কাজ কর না, তোমরা চলে যাও, আমি ক-দিন পরে যাব। নৌকো পাঠিয়ে দিও।

আমাদেরও ইচ্ছে করছে না যেতে। দিব্যি রাজার হালে ছিলাম। সুনন্দর আপশোস, নৌকো চালানোটা ভালো করে শেখা হয়নি। বড্ড তাড়াতাড়ি যেন কেটে গেল দিনগুলো।

টোটো শুকনো মুখে ঘুরছে, বেচারার মন খারাপ। বলেছি, বাকি টিনফুড ও বিস্কুটগুলো ওকে দিয়ে যাব। উপকূল অবধি সে অবশ্য আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে। সেখান থেকে সুনন্দ : তাকে রান্নার প্রয়োজনীয় মশলাপাতির জোগাড়যন্ত্র দিয়ে দেবে।

তড়িঘড়ি তাকে কতগুলো রান্না শিখিয়েছে সুনন্দ। রান্নার ফরমুলা মুখস্থ করিয়েছে। হাতে-কলমে দেখিয়ে দিয়েছে।

আমি বলেছিলাম, কী দরকার এত ঝাটে! দু-দণ্ডে তো ভুলে মেরে দেবে। তার চেয়ে অনেকগুলো টিনের খাবার কিনে দে।

না না, ওর রান্নার ন্যাক আছে। ঠিক রাঁধবে। সুনন্দ বলে।

বন্দী মাঝি দুজনেরও ব্যবস্থা করেছি। একফাঁকে সর্দারকে বলে রাজি করিয়ে রেখেছি। সর্দার বলেছে, বেশ, যখন তোমরা বলছ ছেড়ে দেব। কিন্তু লোক দুটো চোর। আপাতত বন্দী থাক, যখন যাব, সঙ্গে যাবে।

সুনন্দ বিকেলে বলল, যাই জেনে আসি কখন নৌকো ছাড়বে। সেই বুঝে মালপত্র গোছাব।

সুনন্দ ফিরে এল প্রায় আধ ঘণ্টা পরে। দেখি সে হনহন করে আসছে। চোখ-মুখ লাল। কী ব্যাপার!

আমার সঙ্গে কোনো কথা না বলে সে গটগট করে তাঁবুর ভিতরে ঢুকে প্রায় চিৎকার করে ডাকল, মামাবাবু! মামাবাবু!

মামাবাবু বই পড়ছিলেন শুয়ে শুয়ে। চমকে উঠে বললেন, কী হয়েছে?

সর্দার কী বলছে জানেন? এখন নাকি আমাদের যাওয়া হবে না।

কেন?

কেন সেটা তো স্পষ্ট করে কিছু বলছে না। নানান আবোল-তাবোল বকছে। নৌকোয় জায়গা কম। তোমরা সাতুজন। হেনতেন।

আবার বলছে এত তাড়াহুড়ো কীসের? থাক না আরও কিছুদিন। পরের বারে যাবে। মোট কথা যেতে দেবার ইচ্ছে নেই এবং মতলব বোঝা যাচ্ছে না।

সুনন্দ ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে সর্দারের নামে যা-তা বলতে লাগল, ধাপ্পাবাজ, ভণ্ড, মিথ্যেবাদী, ওরাংওটাং। নিশ্চয় ওই কামাউটা দুর্বুদ্ধি দিয়েছে। ওটাই নাটের গুরু। ওকে আমি দেখে নেব…

মামাবাবু চিন্তিতভাবে বললেন, দাঁড়াও দেখে আসি। ঠিক বুঝতে পারছি না। তোমরা বসো, মাথা গরম করে কোনো কাজ হবে না।

মামাবাবু ফিরে এসে বললেন, বুঝলে হে, ম্যালেরিয়া আমাদের ডুবিয়েছে। পরোপকার করতে গিয়ে ফেঁসে গেছি।

মানে?

ম্যালেরিয়ার ভয়ে ওরা আমাদের ছাড়তে চাইছে না। ওদের ধারণা আমরা চলে গেলে হোমার হাত থেকে কে রক্ষা করবে?

কিন্তু আমাদের ওষুধ তো দুদিন পরে শেষ হয়ে যাবে, তখন?

বলেছি সে কথা। বলছে, শেষ হলে যেও। ততদিন বাঁচাও।

তার চেয়ে সর্দারের হাতে বাকি ট্যাবলেটগুলো দিয়ে যাই। ওপারে পৌঁছে আরও কিনে দেব। নিজেরাই চিকিৎসা করুক, আমাদের থাকার দরকার কী?

তাও বলেছি। কোনো লাভ হয়নি। তুমিই ভেলকি দেখিয়ে, মন্ত্র, গুরু, এইসব বলে-টলে গণ্ডগোল পাকিয়ে বসে আছ। ওষুধ ওরা ভয়ে ছুঁতেই চায় না। পাছে তার গুণ নষ্ট হয়ে যায়। আর এতে কামাউয়ের কোনো হাত নেই। সে বরং চাইছিল আমরা চলে যাই। আইডিয়াটা সর্দারের মাথায় হঠাৎ খেলেছে। কামাউয়ের কথা শোনেনি।

একটু বুদ্ধি করে বললেন না কেন, নতুন কায়দায় ওষুধ বানিয়ে দেব যাতে ওদের হাত লাগলে গুণ নষ্ট না হয়ে যায়।

তাও বলেছি। কিন্তু ওদের দৃঢ় ধারণা উপকূলে একবার পা দিলে আমরা ঠিক পালাব। কাজেই যতক্ষণ ওষুধ আছে আমাদের আটকাও।

যাকগে মন খারাপ কোরো না। বলেছিলে তো আরও কটা দিন থাকলে হয়। পাকেচক্রে ঘটে গেল।

মামাবাবু দিব্যি নিশ্চিন্ত মনে চলে গেলেও আমরা দুজনে বেশ ভড়কে গেলাম। কটা দিন বেশি থাকতে আপত্তি নেই কিন্তু এভাবে জোর করে আটকে রাখা ভালো চোখে দেখলাম না। ওষুধ ফুরোলে সত্যি সত্যি যেতে দেবে তো, না আবার ফাঁকড়া বের করবে?

সুনন্দের রাগ। ভণ্ডামি করল কেন? ভালোভাবে অনুরোধ জানালেও তো পারত। সর্দারটা মোটেই তেমন সরল লোক নয়, হাড়ে হাড়ে প্যাঁচালো।

পরদিন ভোরবেলা আমাদের নাকের ডগা দিয়ে দুখানা ছিপনৌকো সমুদ্রের জল কেটে তীব্র গতিতে বেরিয়ে গেল। নৌকোয় গেল দশ-বারোজন, বাকিরা তীরে দাঁড়িয়ে বিদায় জানাল। বারবার দেবতার উদ্দেশে প্রার্থনা জানাল, হে ভগবান, ভালোয় ভালোয় যেন ফিরে আসে।

নৌকো দুটি ফিরল পরদিন দুপুর নাগাদ।

সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। নৌকো ফিরতেই জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল। যাক, সকলে ফিরেছে ভালোভাবে।

দ্বীপের নোক ঝুঁকে পড়ল, দেখি দেখি, কী সওদা এনেছে?