☼ অজেয় রায় ☼
মিস্টার বাসুর ফরমুলা
ছয়
অন্ধকার প্যাসেজ। সিঁড়ি হাতড়ে হাতড়ে এগোতে সময় নিল। নিচের সদর দরজা খুলে দুজনে ছুটল সিঁড়ির কাছে। কেউ কোথাও নেই। বিমূঢ় হয়ে এদিকে সেদিকে তাকাচ্ছে, কানে এল ভারী কিছু পড়ার শব্দ। তারপরই ধস্তাধস্তির আওয়াজ। ডান পাশে শব্দ লক্ষ্য করে দৌড়ে গেল তারা।
পাঁচিলের কাছে দুজন ঝটাপটি করছে। একজন মাটিতে। অন্যজন তার বুকের ওপর।
সুনন্দরা পৌঁছনোর আগেই ওপরের লোকটি হেঁচকা টানে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটল পাঁচিলের দিকে। চাঁদের আলোয় চেনা গেল তাকে–মিস্টার বাসু।
ওকে ধর। চেঁচিয়ে উঠল বাসুর বাধাদানকারী কুণাল।
মিস্টার বাসু পাঁচিলের গায়ে লাফ দিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সুনন্দ ও অসিত।
বাপরে, বাসুর গায়ে কী প্রচণ্ড শক্তি। প্রথম ঝটকায় দুজনকে প্রায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু একটু পরে তারা বাসুকে মাটিতে পেড়ে ফেলল। রুমাল দিয়ে পিছমোড়া করে বাঁধল তার হাত।
একটা টর্চের আলো ছুটে আসছে। পিল্লাই এবং মামাবাবু। বাসুকে টেনে তুলে দাঁড় করানো হল। আলো পড়ল বাসুর মুখে। একি!
মিস্টার বাসুর নিখুঁত সাহেবি মূর্তি এখন বিপর্যস্ত। নেই তার চশমা। বোম ছিঁড়ে কোট আলগা। টুপিহীন মাথার চুল এলোমেলো। সেজন্য অবাক হয়নি কেউ। কিন্তু তার পরু গোঁফের এক অংশ খুলে ঝুলে পড়েছে কেন? এ যে নকল গোঁফ। আর মুখের শ্যামলকান্তির জায়গায় জায়গায় চটা উঠে নিচের চামড়ার ফরসা রং বেরিয়ে পড়ে অদ্ভুত দেখাচ্ছে! সবাই স্তম্ভিত নয়নে দেখল, মিস্টার বাসুর ছদ্মবেশ ভেদ করে যেন পরিচিত কারো আদল ফুটে উঠছে।
কুণাল এগিয়ে এল। তার কপাল কেটে রক্ত গড়াচ্ছে। কিন্তু বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই।
মেক-আপখানা খোলো তো চাঁদু–বলতে বলতে সে হাত বাড়িতে এক টানে ছিঁড়ে নিল বাসু সাহেবের বাকি গোঁফ। যন্ত্রণায় কুঁচকে উঠল বাসুর মুখ।
একি! এ যে বঙ্কিম হাজরা!!
বঙ্কিমবাবু আপনি! ইউ স্কাউনড্রেল, মামাবাবু গর্জন করে ওঠেন। তিনি মিস্টার বাসু ওরফে বঙ্কিমবাবুর চুলে হাত দিয়ে পরীক্ষা করে বললেন, কালো রং মেখেছে। কিন্তু সামনের দাঁত দুটো উঁচু করল কী করে? দেখি। হু, ফল্স টুথ। প্লাস্টিকের দাঁত বসিয়েছে আসল দাঁতের ওপর।
অসিত হাঁ হয়ে থেকে বলল, হাঁটা-চলা পালটে ফেলেছিল কেমন! এমনকি গলার স্বর অবধি। বাস্রে!
আমায় নিয়ে কী করতে চান?বললেন বঙ্কিম হাজরা। সাংঘাতিক নার্ভ বটে লোকটার। এখনো দমেনি। তবে ভক্ত বঙ্কিমের গদগদ বিনয়ের মুখোশ খসে পড়েছে। মারমুখী তেরিয়া ভাব।
অ্যারেস্ট। এতক্ষণে কথা বললেন মিস্টার পিল্লাই। তিনি খানিক দূরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে টর্চের আলো ফোকাস করে রেখেছিলেন বঙ্কিমবাবুর ওপর।
প্রশ্ন হল, কেন?
পিল্লাই উত্তর দিলেন, একনম্বর চার্জ তপনবাবুর ওপর অত্যাচার। দু-নম্বর–তার ভাইকে অপহরণ। তিন নম্বর–দেশের ক্ষতিকারক অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ।
“ননসেন্স! আপনার তৃতীয় অভিযোগের কোনো প্রমাণ নেই।
আছে। তপনবাবু তার সাক্ষী। এবং দ্বিতীয় সাক্ষী আমি। কি, চিনতে পারেন?
পিল্লাই টর্চের আলো ঘুরিয়ে নিজের মুখে ফেললেন।
ভূত দেখার মতো আঁতকে উঠল বঙ্কিম হাজরা, অ্যাঁ, মিস্টার কার্পেন্টার।
সরি। আমি ভারত কেমিক্যালস-এর ডিরেক্টর কার্পেন্টার নই। আমি ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের স্পেশাল অফিসার নারায়ণ পিল্লাই। ডিউটির খাতিরে মিস্টার কার্পেন্টারের ভূমিকায় অভিনয় করতে হয়েছিল। আপনাকে দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, প্রিন্স হোটেলের কুড়ি নম্বর ঘরে কার্পেন্টারের সঙ্গে আপনার সমস্ত গোপন কথাবার্তা, ষড়যন্ত্র, টেপ-রেকর্ডে ধরা আছে। রেকর্ডটা লুকনো ছিল সোফার নিচে।
বঙ্কিম হাজরার চোখে-মুখে এবার সত্যিকার ভয়ের ছাপ দেখা গেল।
সুনন্দ অসিত ছুটল তপনকে আনতে।
বঙ্কিমবাবুকে দেখে আহত শ্রান্ত তপন হতভম্ব–। একি, মিস্টার বাসু! না-না, এ যে বঙ্কিমবাবু!
মামাবাবু বললেন, তুমি চেনো একে?
চিনি। তবে আলাপ নেই। স্যার, মানে ডক্টর তালকদারের কাছে আসতেন মাঝে মাঝে, দেখেছি। কিন্তু উনি?
হ্যাঁ, মিস্টার বাসুই ছদ্মবেশী বঙ্কিম হাজরা। উত্তর দিলেন মামাবাবু।
সবার মনেই উদগ্র কৌতূহল, কী করে তপন এই লোকটির খপ্পরে পড়ল। কিন্তু তখন আর এ-প্রশ্নের জবাব পাবার সুযোগ ছিল না।
বাড়ি সার্চ করা হল। একটি উল্লেখযোগ্য জিনিস আবিষ্কার হল–একটা ছোট ল্যাবরেটরি।
মামাবাবু কুণালের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, সাবাস কুণাল। খুব সময়ে আটকেছ বাসুকে। একবার নাগালের বাইরে ফসকে গেলে বাসু সাহেব নির্ঘাত চিরকালের মতো অদৃশ্য হত। অর্থাৎ সে খোলস ছেড়ে বঙ্কিম হাজরা বনে যেত। আর এই অপরাধে বঙ্কিম হাজরার যোগ আছে সন্দেহ করলেও তাকে শাস্তি দেবার মতো প্রমাণ আমাদের হাতে ছিল। না। আর ওই যে স্বয়ং মিস্টার বাসু এ কার মাথায় আসবে?
প্রফেসর নবগোপাল ঘোষ অর্থাৎ মামাবাবুর বালিগঞ্জের বাড়ির বৈঠকখানা।
একে একে সেখানে হাজির হল অনেকে–অসিত, কুণাল, সুনন্দর ডানপিটে বন্ধু মিন্টু, মিত্র কেমিক্যালস-এর সেলসম্যান হরিধন এবং সব শেষে এলেন আই. বি. ইন্সপেক্টর মিস্টার নারায়ণ পিল্লাই, সঙ্গে তপন দত্ত। মামাবাবু ও সুনন্দ তো উপস্থিত রয়েছেনই।
ব্যারাকপুরে বাগানবাড়িতে মিস্টার বাসু ওরফে বঙ্কিম হাজরা ধরা পড়ার দুদিন পরে এক বিকেলে এই জমায়েত। ইতিমধ্যে তপন ছিল পিল্লাইয়ের হেফাজতে। পুলিস তাকে জেরা করেছে, নানা জায়গায় নিয়ে ঘুরেছে। ফলে তার সঙ্গে সুনন্দ অসিত ইত্যাদির সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি। এই জটিল রহস্যের বহু প্রশ্নই তাই এখনো তাদের অজানা। শুধ একটি সুসংবাদ জানতে পেরেছে–তপনের বন্দী ছোট ভাই বিমানকে অক্ষত দেহে উদ্ধার করেছে পুলিস।
অতিথিদের জন্য চা এবং কিঞ্চিৎ টা সরবরাহ হল।
গরম চায়ে চুমুক দিয়ে মামাবাবু বললেন, প্রথমে শোনা যাক তপনের কথা। কী করে সে মিস্টার বাসু, মানে বঙ্কিম হাজরার পাল্লায় পড়ল! বলো তপন–
তপন বলতে শুরু করল।
প্রায় চার বছর আগে ডক্টর তালুকদার যখন হঠাৎ মারা গেলেন বিদেশে চোখ অন্ধকার দেখলাম। আবার নিঃসহায় হয়ে পড়লাম। ডক্টর তালুকদারের কাছে কাজ পেয়ে বর্তে গিয়েছিলাম। তার আগে বেশ কয়েক বছর আমার বড় করুণ অবস্থায় কেটেছিল। ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি নেই। নেই সহায় সম্বল। বাবা মারা গেছেন। সংসারের পুরো দায়িত্ব আমার কাঁধে। প্রাণপণে চাকরির চেষ্টায় ঘুরেছি। কখনো জুটেছে কিছু। কখনো বেকার। ডক্টর তালুকদারের সঙ্গে আলাপ হয় শিল্পমেলায়। অতি মহৎ ব্যক্তি। আমার দুঃখের কাহিনি শুনে সঙ্গে সঙ্গে একটা চাকরি জুটিয়ে দিলেন। কোনো প্রতিষ্ঠান বা সরকারি অফিসে নয়। তেমন কিছু তার হাতে ছিল না। ওঁর নিজস্ব রিসার্চ অ্যাসিসট্যান্ট করে নিলেন। এ বাড়িতে একটা ল্যাবরেটরি ছিল–সেখানে কাজ।
শুধু যে খেয়ে বাঁচলাম তাই নয়। আরও বড় উপকার হল–আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম। কাজটা ভালোবেসে ডুবে গেলাম ওই রিসার্চে।
কী নিয়ে রিসার্চ? জানতে চাইল কুণাল।
মানুষের প্রয়োজনীয় ফলমূল শস্যের বোগ অর্থাৎ উৎপাদন নষ্টের কারণ যেসব পোকামাকড়, ব্যাকটিরিয়া, ফাঙ্গাস, ভাইরাস তাদের নিয়ে ছিল তাঁর গবেষণা। শুধু আমাদের দেশের চেনাশোনা ফসল-রোগ নিয়ে মাথা ঘামানো নয়, আরও সুদূরপ্রসারী ছিল তাঁর চিন্তা। যেসব ফসল-রোগ আমাদের দেশে সম্পূর্ণ অজানা বা সামান্য দেখা গেছে। তাদের নিয়েও স্টাডি করতেন। উদ্দেশ্য ছিল–ভবিষ্যতে ওইসব রোগ যদি এখানে ছড়ায় তখন তাদের রোধ করা।
গমের নৈতানো রোগ এদেশে এল কোত্থেকে? জিজ্ঞেস করলেন মামাবাবু।
দক্ষিণ আমেরিকা। দেখা গেছে, ফসলের শত্ৰু কোনো কোনো কীট, জীবাণু, ছত্রাক ইত্যাদি এক দেশ থেকে অন্য দেশে গিয়ে পরিবেশ বদলের ফলে ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে। গমের নেতানো রোগের জীবাণু দক্ষিণ আমেরিকায় গমের অল্পস্বল্প ক্ষতি করে কিন্তু ভারতের আবহাওয়ায় কী ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে।
এ জীবাণু আনল কে? বললেন মামাবাবু।
স্যার। মানে ডক্টর তালুকদার। গবেষণার উদ্দেশ্য নিয়ে আসেন।
আচ্ছা, ধানের রাক্ষুসে পোকার ব্যাপারটা কী? ফের প্রশ্ন করলেন মামাবাবু।
এও স্যারের এক আশ্চর্য রিসার্চের ফল। আপনারা হয়তো জানেন, ফসল-রোগ ঠেকাতে কয়েকটি রাসায়নিক বস্তু ক্রমাগত ব্যবহার করতে করতে এমন অবস্থায় পৌঁছয় যখন রোগের কারণ পোকামাকড় বা জীবাণু ইত্যাদি দমন করতে ওইসব ওষুধে আর কাজ দেয় না। কারণ তাদের শরীরে ওই ওষুধকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা গড়ে ওঠে। তখন অন্য রাসায়নিক বা আর কোনো উপায় খুঁজতে হয়। ডক্টর তালুকদার এই লাইনেও গবেষণা করতেন। উনি রাক্ষুসে পোকা ল্যাবরেটরিতে এমনভাবে লালন করেছিলেন যে তাদের শরীরে ওই কীটনাশকগুলির বিরুদ্ধে প্রতিরোধশক্তি তৈরি হয়েছিল। তারপর ফের তাদের দমন করার জন্য তিনি ওষুধ তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন। অনেকখানি এগিয়েছিল রিসার্চ। আমি তা শেষ করি।
অতি বিপজ্জনক গবেষণা। এসব স্পেসিমেন কোনোক্রমে বাইরে ছড়িয়ে পড়লে দেশের উৎপাদনে মহামারী ঘটাতে পারে।
হ্যাঁ, তাই তিনি এই ধরনের রিসার্চ বা এক্সপেরিমেন্ট করতেন খুব গোপনে। নিজের বাড়ির ল্যাবরেটরিতে। ডক্টর তালুকদারের এই গবেষণায় আমি ছিলাম তার সহকারী। ক্রমে স্বাধীন গবেষণা করার মতো খানিক বিদ্যে-বুদ্ধিও আমার হয়েছিল। স্যার আমায় উৎসাহ দিতেন। কাজ শেখাতেন। এ বিষয়ে বই দিতেন পড়তে।
তপন চোখ বন্ধ করে অল্পক্ষণ চুপ করে রইল। বুঝি পরম শ্রদ্ধেয় সেই পরলোকগত বিজ্ঞানীর স্মৃতিচারণ করল। তারপর আবার বলল–
প্রায় ছ-মাস বেকার হয়ে ছিলাম। নিজের দঃখের চেয়ে মা-ভাই-বোনের কষ্টটাই বেশ পাগল করে তুলেছিল। সেই সময় মিস্টার বাসুর সঙ্গে আলাপ হল। মানিকতলায় একটা বস্তির খুপরি ঘরে থাকতাম। আমার পাশে থাকত এক রাজমিস্ত্রি। বাসু সেই মিস্ত্রির খোঁজে এলেন এক দুপুরে। মিস্ত্রি নেই, কাজে বেরিয়েছে। বাসু আমাকে ডেকে অনুরোধ করলেন মিস্ত্রিকে কটা কথা বলে দিতে। ব্যস, এই সূত্র ধরেই ভাব করে ফেললেন আমার সঙ্গে। এখন বুঝি উনি ওই মতলব নিয়েই এসেছিলেন। মিস্ত্রির খোঁজ করতে আসা স্রেফ ছুতো।
যাহোক মিস্টার বাসু আমাকে সাহায্য করতে চাইলেন। আমি যদি একটা নার্সারি কার তাহলে জমি ও বাড়ি দেবেন, এবং ব্যবসার প্রয়োজনীয় টাকা–ধার হিসেবে।
নার্সারি সম্বন্ধে তুই কিছু জানতিস? সুনন্দর প্রশ্ন।
কিছু না। কিন্তু আমি তখন মরিয়া। নার্সারির ব্যাপার, তাই সই। আগের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না বটে, তবে ফুল-ফল গাছের যত্ন ও তত্ত্বাবধান শিখছিলাম স্যারের কাছে। মস্ত বাগান ছিল তার।
–আর একটা লোভ দেখিয়েছিলেন বাসু। তাই না? মুচকি হেসে বললেন পিল্লাই।
–হা। অতি লোভনীয় প্রস্তাব।–বলেছিলেন ইচ্ছে হলে, নার্সারিতে ল্যাবরেটরি তৈরি করে আমি নিজে রিসার্চ করতে পারি। ডক্টর তালুকদারের অসমাপ্ত গবেষণা চালিয়ে যেতে পারি। ডক্টর তালুকদারের অনেকগুলি গবেষণা অর্ধসমাপ্ত বা প্রায় সমাপ্ত অবস্থায় ছিল। ল্যাবরেটরি বানাবার খরচও ধার দেবেন মিস্টার বাসু। তখন অবশ্য বুঝেছিলাম, ডক্টর তালুকদারের গবেষণার মূল্য বাসু জানেন।
কেন ডক্টর তালুকদারের ল্যাবরেটরির কী হল? জানতে চাইলেন মামাবাবু।
বন্ধ হয়ে গেছিল। ওঁর একমাত্র ছেলে থাকত দিল্লিতে। বিজ্ঞানের ধার ধারে না। সে ল্যাবরেটরির দামি যন্ত্রপাতি বিক্রি করে বাকি জিনিস বিলিয়ে দিতে চাইল। আমায় বলল–যা ইচ্ছে হয় নিয়ে যাও। এমনকি বাবার গবেষণা সংক্রান্ত নোটও দিয়ে দিল আমায়। আসলে সে যত তাড়াতাড়ি পারে বাড়িটা খালি করে ভাড়া দিতে চাইছিল। আমি মহা খুশি। আমার ভবিষ্যৎ গবেষণার সমস্ত উপকরণ নিয়ে এসে রেখেছিলাম সেই বস্তির কুঠুরিতে। তবে দিনে দিনে ভয় হচ্ছিল, হয়তো এগুলি আমার আর কাজে লাগবে না। ল্যাবরেটরিতে গবেষণার সুযোগ আমি আর পাব না। এক-একবার ভাবতাম নষ্ট করার চেয়ে এসব বরং দিই অন্য কোনো গবেষককে। তাই বাসুর প্রস্তাব লুফে নিলাম। তার কাছে ধার নিয়ে ল্যাবরেটরি খাড়া করে ফেললাম নার্সারিতে। ফসলের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মতো জমিও পেলাম খানিকটা।
বঙ্কিম হাজরা কি প্রথম থেকেই তোমার রিসার্চ সম্বন্ধে আগ্রহ দেখিয়েছিল? জিজ্ঞেস করলেন মামাবাবু।
না। প্রথম দ-তিন মাস তিনি এ-বিষয়ে কোনো ইন্টারেস্টই দেখাননি। তারপর খোঁজ নেন।
ক্রমে ওর কাছে আমার ধার আরও বাড়ল। আমার ছোট ভাই মরণাপন্ন হল। শিগগিরই হার্ট অপারেশন করতে বললেন ডাক্তার। প্রচুর খরচ। মিস্টার বাসু তৎক্ষণাৎ পাঁচ হাজার টাকা দিলেন। এরপর আমায় আরও পাঁচ হাজার ধার দিলেন একরকম গায়ে পড়ে–আমার বোনের বিয়ের খরচের জন্য। আমি তো মুগ্ধ। বললাম–কী করে যে শোধ দেব জানি না। তিনি বলেছিলেন–কেন, তোমার গবেষণা আছে। তার কথার তাৎপর্য সেদিন ধরতে পারিনি।
ছ-সাত মাস পরে তিনি নিজ মূর্তি ধরলেন। অর্ডার দিলেন। ধানের রাক্ষুসে পোস চাই। কালচার করে প্রচুর পরিমাণে স্পেসিমেন দিতে হবে। এবং এই রোগ দমন করার কীটনাশক ওষুধের ফরমুলা–যা আমি আবিষ্কার করেছি। এ-বিষয়ে সমস্ত গবেষণাগত তথ্যসুদ্ধ। উৎসাহ ও কৃতজ্ঞতাবোধে আমার রিসার্চ সম্বন্ধে ইতিমধ্যে অনেক কিছু বলে ফেলেছিলাম বাসুকে।
ওনার দাবি শুনে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম–কেন? এ নিয়ে কী করবেন আপনি? উত্তরে বললেন–আমিও এ-বিষয়ে একটু কাজ করতে চাই।
খুব বিশ্বাস হয়নি তার কথা। কারণ মোটামুটি বিজ্ঞান জানেন বুঝলেও এত দুরূহ গবেষণা করার যোগ্যতা ওঁর কাছে আছে কিনা আমার সন্দেহ ছিল। ভেবেছিলাম, হয়তো আমার রিসার্চ উনি নিজের নামে ছাপিয়ে নাম কিনতে চান। অথবা ভবিষ্যতে ভারতে এই পোকার উপদ্রব বাড়লে ওই কীটনাশকের ফরমুলা গোপনে বিক্রি করে পয়সা কামাবার তালে আছেন।
তবু দিলি? রেগে বলল অসিত।
কী করব? আমি তখন নিরুপায়। বাসুর কাছে দেনায় মাথার চুল পর্যন্ত বিকিয়ে আছে। তাই হুকুম তালিম করতে বাধ্য হলাম। মনে হল, এইভাবে যদি আমার ঋণ শোধ হয় তোক।
কিছুদিন পরে তিনি গমের নেতানো রোগের জীবাণু চাইলেন। এবং তার প্রতিরোধক ওষুধের ফরমুলা। শুধু যে শস্য রোগের বীজ এবং তাদের ওষুধ তৈরির ফরমুলা নিলেন তাই নয়। কী করে ওইসব রোগ সৃষ্টিকারী পোকা জীবাণু ইত্যাদির ল্যাবরেটরিতে কালচার করে বংশ বৃদ্ধি ঘটানো হয় সে পদ্ধতিও আমার কাছে শিখে নিলেন বাসু। আবার মাঝে মাঝে এসে যে গবেষণাগুলি নিয়েছিলেন সে-বিষয়ে অনেক প্রশ্ন করতে লাগলেন আমাকে এবং আমার রিসার্চ সম্পর্কে কাউকে কিছু বলতে একদম নিষেধ করে দিলেন।
নানান প্রশ্ন দেখা দিল মনে। তবু ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না ওঁর আসল উদ্দেশ্য কী। বাইরের খবরাখবর তো প্রায় রাখতামই না। মাসান্তে একবার বাড়ি যেতাম। দু-একদিন থাকতাম বড় জোর। এদেশের কৃষি-পত্রিকাগুলো আসত বাসু মারফত। আমার সন্দেহ জাগতে পারে এমন খবর থাকলে নিশ্চয় উনি সেসব সংখ্যা চেপে গিয়েছেন।
তুমি প্রথম হাজরা আই মিন বাসুকে সন্দেহ করলে কখন? মামাবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
যখন সুনন্দ আর অসিত এল নার্সারিতে, ওদের কথা শুনে আমার চোখ ফুটল। বুঝতে পারলাম, কী জঘন্য ষড়যন্ত্র করছেন মিস্টার বাসু, আমারই আবিষ্কারকে হাতিয়ার বানিয়ে। কারণ বাসু আমার কাছ থেকে রাক্ষুসে পোকা নিয়ে যাওয়ার পরই এর উপদ্রব দেখা দেয়। তাছাড়া গমের নেতানো রোগ এদেশে এল কী করে?
বুঝতে পারলাম, আমারই কালচার করা ফসলের শত্রু, কীট, জীবাণু বাসু ছাড়য়ে দিচ্ছেন ক্ষেতে। ফসল নষ্ট হতে শুরু করলে তখন বিক্রি করছেন প্রতিরোধের ওষুধ। কিন্ত রোগ আটকাবার আগেই যে প্রচুর ফসল নষ্ট হয়। দেশের কত বড় ক্ষতি। ঠিক করলাম, এইসব ভয়ঙ্কর ধ্বংসের বীজ আমি আর কিছুতেই বাসর হাতে তুলে দেব না।
–বাকিটুকু আমি বলি। আপনি রেস্ট নিন তপনবাবু। বললেন মিস্টার পিল্লাই। বাসু আবার চাইতে এলেন ধানের ক্ষতিকারক একজাতের ছত্রাক এবং আলুর পক্ষে মারাত্মক একরকম ভাইরাস। তপনবাবু দিতে অস্বীকার করলেন। তখন ভীষণ চাপ দিতে লাগলেন। প্রথমে দেখালেন লোভ। কাজ না হতে আরম্ভ হল অত্যাচার। তাইতো?
ক্লান্তভাবে মাথা নাড়ে তপন।
ইস, সেদিন আমি থাকলে–লোকটাকে এমন উত্তম-মধ্যম–তোরা কিস্সু কাজের নস! মিন্টু দীর্ঘশ্বাস ফেলল আফশোসে। কী করব? মামাবাবুরা এসে পড়লেন যে। ত, নইলে–সাফাই গাইল সুনন্দ।
তোমাকে বাগানবাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল কেন? কুণাল জিজ্ঞেস করল তপনকে।
দুজন পুরনো বন্ধুর সঙ্গে হঠাৎ আমার দেখা হয়েছে জানতে পেরে। নিশ্চয় মালিদের কাছে শুনেছিলেন। তখন আমায় নার্সারি থেকে সরিয়ে আনেন। তবে বন্ধুদের সঠিক পরিচয় আমি বলিনি।
আমি কিন্তু সত্যি সত্যি ওঁর ঋণ শোধ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এই উপায়ে? নাঃ, অসম্ভব।
তোর ঋণ শোধ হয়ে গেছে। বলে উঠল সুনন্দ।
কী করে? তপন অবাক।
তোর তৈরি ফরমুলা বেচে উনি পাক্কা বিশ হাজার টাকা কামিয়েছেন।
তাই নাকি? তপন যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
আচ্ছা পুলিস, মানে মিস্টার পিল্লাই ব্যাপারটা জানলেন কী করে? প্রশ্ন করল অসিত। আমি জানিয়েছি, বললেন মামাবাবু। যখন তিন-তিনটে সাসপেক্ট বেপাত্তা হয়ে গেল তখন আমার পরিচিত এক পুলিস কমিশনারকে বললাম সমস্ত ঘটনা। তিনি মিস্টার পিল্লাইকে কেসটা তদন্ত করার ভার দিলেন। আমরা পরামর্শ করে কলকাতা বোম্বাইয়ের যত নামকরা ওষুধ কোম্পানিকে জানিয়ে রাখি, কেউ গমের নেতানো রোগ দমনের ওষুধের ফরমুলা বিক্রি করতে চাইলে যেন তৎক্ষণাৎ পিল্লাইকে খবর দেওয়া হয়। কয়েক দিনের মধ্যেই বাসুর প্রস্তাব এল ভারত কেমিক্যালস-এর কাছে। মিস্টার পিল্লাই ওই কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর সেজে বাসুর সঙ্গে দেখা করলেন। আচ্ছা মিস্টার পিল্লাই বঙ্কিম হাজরার অতীত ইতিহাস কিছু জানতে পারলেন?
পেরেছি কিছু কিছু। বললেন পিল্লাই। লোকটা শিক্ষিত। সায়ান্স গ্র্যাজয়েট। এককালে শখের থিয়েটারে অ্যাকটিং করে বেশ নাম করেছিল। নানারকম ব্যবসা করত। বছর দশ আগে এক নামকরা কোম্পানির ফাউন্টেন পেনের কালি জাল করার ব্যাপারে সন্দেহ করে পুলিস ওকে ধরেছিল। কিন্তু প্রমাণের অভাবে খালাস পেয়ে যায়। বছর পাঁচেক আগে বোম্বেতে স্মাগলিং শুরু করে। ছদ্মবেশে এবং ছদ্মনামে। তারপর একটা খুনের কেসে পুলিস ওর পিছ নিতেই বেমালুম উবে যায়। আর তার পাত্তাই পাওয়া যায়নি। তবে পলিস রেকর্ডে স্মাগলার শাহাজাদার ফিঙ্গার প্রিন্ট আছে। বঙ্কিম হাজরার আঙুলের ছাপের সঙ্গে তা মিলে গেছে। সে-মামলাও এবার ওর ঘাড়ে চাপবে।
লোকটা অসাধারণ চতুর। বললেন মামাবাবু। আমার ধারণা, ও প্রথম দিকে নিজে হাতেই লুকিয়ে লুকিয়ে ধান আর গমের রোগের বিষ ছড়িয়েছে ক্ষেতে। কিন্তু স্যার ডেভিডের বোর্নিও অ্যাডভেঞ্চার শোনার পরে যাযাবর পাখির মাধ্যমে ব্যাকটিরিয়া ছড়ানোর আইডিয়া ওর মাথায় আসে। কারণ তারপরেই ও আমার কাছ থেকে মাইগ্রেটরি বার্ড সম্বন্ধে কয়েকটা বই নিয়েছিল। আর আমাদের সঙ্গ ধরার হেতু, নিরীহ পক্ষিবিদদের দলে ঘুরলে কেউ ওর মতলব টের পাবে না।
রাইট। সায় দিলেন মিস্টার পিল্লাই। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, এমন এক ধূর্ত ক্রিমিনালকে গ্রেফতার করতে সাহায্য করার জন্য পুলিস ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
সবাই খুশিতে ভরপুর। সবার মুখে হাসি। শুধু তপন কেমন বিমর্ষ।
সুনন্দ অসিত কুণালের চোখে-চোখে কী জানি ইশারা খেলে গেল।
সুনন্দ বলল, তপন এবার কী করবি? সুরভি নার্সারি তো গণেশ ওলটাল।
হুঁ, ভাবছি তাই। ম্লান হাসে তপন। আমার কপালই খারাপ।
কুণাল উঠে গিয়ে বসল তপনের পাশে। বলল–ভাই তপন, তুমি তো শুনেছ আমার একটা ছোট ফার্ম আছে। ফসল রোগের কীট বা জীবাণুনাশক ওষুধও তৈরি করি। আমার কারখানার ল্যাবরেটরিতে যদি তোমায় চিফ কেমিস্টের পোস্ট দিই, নেবে? তোমার। প্রতিভার যোগ্য মূল্য দেবার ক্ষমতা আমার নেই। তবু যথাসাধ্য দেব।
সুনন্দ ফট করে চেঁচিয়ে উঠল–খবরদার তপন। নিস্নে ও চাকরি। কুণালটা মহা ধড়িবাজ। তোকে বেকায়দায় পেয়ে ঠকাচ্ছে। সস্তায় সারছে। আরে তোর টাকার ভাবনা কী? স্বয়ং ভারত কেমিক্যালস-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর মিস্টার কার্পেন্টার এখানে হাজির। ওঁর অফারটা শুনেছিস। দু-লাখ তো তোর হাতের মুঠোয়।
হো-হো করে হেসে উঠলেন পিল্লাই। হেসে উঠল অন্যরা। তপন পরম কৃতজ্ঞভাবে– কুণালের ডান হাতখানি জড়িয়ে ধরল নিজের হাতে। অতিরিক্ত উচ্ছ্বাসের আবেগে মুখে তার কথা সরল না। তবে আনন্দ উজ্জ্বল চোখে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল কুণালের প্রস্তাবে।