☼ অজেয় রায় ☼
মিস্টার বাসুর ফরমুলা
পাঁচ
দিনান্তে সন্ধ্যার আগমনে কলকাতা শহরের চৌরঙ্গী অঞ্চলের পথ-ঘাট দোকান-পাট ঝলমল করে উঠল নানা রঙের বৈদ্যুতিক আলোর বন্যায়।
এই চৌরঙ্গীর বিলাসবহুল প্রিন্স হোটেলের সামনে একটু ট্যাক্সি এসে থামল। গাড়ি থেকে নামলেন এক ব্যক্তি–নিখুঁত সাহেবি পোশাকে সজ্জিত, একটু সামনে ঝোকা কজো ধরন, দাঁতে কামড়ানো পাইপ, হাতে একটি ব্রিফকেস। এই ভদ্রলোকের সাক্ষাৎ পাঠক আগেও কয়েকবার পেয়েছেন। ইনি মিস্টার বাসু।
মিস্টার বাসু গটগট করে ঢুকলেন হোটেলে। রিসেপসনিস্টের কাছে গিয়ে বললেন, মিস্টার কার্পেন্টারের সঙ্গে দেখা করতে চাই। কুড়ি নম্বর সুইট।
আপনার নাম? জানতে চাইল রিসেপসনিস্ট মেয়েটি।
মিস্টার বি বাসু।
আঃ, মিস্টার বাসু। ইউ আর ওয়েলকাম। আপনি সোজা চলে যান কুড়ি নম্বরে। মিস্টার কার্পেন্টারের নির্দেশ আছে আপনি এলেই পাঠিয়ে দিতে। আমি ফোনে ওনাকে আপনার খবর দিচ্ছি।
কুড়ি নম্বর ঘরের বেল টিপলেন মিস্টার বাসু।
আপনি কি মিস্টার বাসু? দরজা খুলে ইংরেজিতে প্রশ্ন করলেন এক লম্বা ফর্সা সুদর্শন প্রৌঢ়।
ইয়েস।
গুড ইভনিং। আমি কার্পেন্টার। তিনি সাদরে করমর্দন করলেন বাসুর সঙ্গে। আজান জানালেন, দয়া করে ভিতরে আসুন।
চেয়ারে বসলেন বাসু। লক্ষ করে দেখলেন মিস্টার কার্পেন্টারকে। ভদ্রলোকের চোখে-মুখে প্রখর বুদ্ধির ছাপ। তবে কথা বা ভাবভঙ্গি বেশ সহজ। ভারত কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের মতো বড় ওষুধ কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর আরও ভারিক্কি জাঁদরেল-দর্শন হবেন বলে তিনি আশা করেছিলেন।
আপনার ফরমুলার কাগজ-পত্র এনেছেন? আর সলিউশনের সাল? মিস্টার। কার্পেন্টার কথা বলছিলেন চোস্ত ইংরেজিতে।
হ্যাঁ।–মিস্টার বাসু ব্রিফকেস খুললেন। একতাড়া টাইপ করা কাগজ বের করলেন এবং ছোট একটি শিশি। শিশি ভর্তি কোনো তরল পদার্থ। কাগজ ও শিশি রাখলেন সামনের টেবিলে।
এবার আপনার দর বলুন মিস্টার বাসু।
সামান্য ইতস্তত করলেন বাসু। বললেন, আগে পেপারস পরীক্ষা করুন। সলিউশন টেস্ট করুন। তারপর না হয় দর-দাম নিয়ে কথা হবে।
পরীক্ষা করা হবে বইকি! কিন্তু ওসব হচ্ছে স্রেফ ফরম্যালিটি। আমি জানি আপনার ফরমুলা খাঁটি। কাজেই আসল কথাবার্তা যত তাড়াতাড়ি এগোয় ততই ভালো।
একটুক্ষণ চুপ করে, ভেবে বাসু বললেন, মাই প্রাইস ইজ টুয়েন্টি-ফাইভ থাউজেন্ড। রয়ালটি চাই না। পেটেন্ট রাইট আপনাদের দিয়ে দেব।
দ্যাটস অল রাইট। কোম্পানির এক্সপার্টকে পেপারস এবং সলিউশন পরীক্ষা করিয়ে আশা করছি দু-সপ্তাহের মধ্যে আমরা ফাইনাল এগ্রিমেন্ট করে ফেলতে পারব।
মিস্টার বাসুর ভাব দেখে মনে হল যে কার্পেন্টার এত সহজে রাজি হয়ে যাবে তিনি ভাবেননি।
লেট আস সেলিব্রেট। ড্রিঙ্কস? অথবা চা-কফি?
থ্যাঙ্ক-য়্যু। কফি।
মিস্টার কার্পেন্টার বেয়ারাকে ডেকে কফির অর্ডার দিলেন।
কফি খেতে খেতে কার্পেন্টার বললেন, “আচ্ছা মিস্টার বাসু রিসার্চের খরচ নিশ্চয় অনেক?
হ্যাঁ।
আপনার বোধহয় অনেক টাকা?
মোটেই না।
একটা কথা বলি, যদি আপনাকে আমাদের কোম্পানির রিসার্চ ডিপার্টমেন্টের ভার নিতে অনুরোধ করি, রাজি আছেন? আপনি কত মাইনে চান বলুন, হোয়াটস ইওর প্রাইস?
সরি। আপনার অফার আমি গ্রহণ করতে পারলাম না, জানালেন মিস্টার বাবু।
মিস্টার বাসু বুঝলেন এই কারণেই জোনাল ম্যানেজারের বদলে ম্যানেজিং ডিরেষ্টম স্বয়ং আজ তার সঙ্গে দেখা করেছেন। ভারত কেমিক্যালসকেই তিনি গত বছর ধানের রাক্ষুসে পোকা মারার ওষুধের ফরমুলা বিক্রি করেছিলেন। কিন্তু সেবার তার সঙ্গে ব্যবসায়িক কথা বলেন জোনাল ম্যানেজার মিস্টার গুরদেব সিং। এবার এই কোম্পানিকে গমের নেতানো রোগের জীবাণুনাশক ওষুধের ফরমলা বিক্রির প্রস্তাব দিতে জোনাল ম্যানেজারের উত্তর আসে স্বয়ং ম্যানেজিং ডিরেক্টর তার সঙ্গে কথা বলবেন এ-বিষয়ে। তিনি যেন মিস্টার কার্পেন্টারের সঙ্গে এই হোটেলে দেখা করেন। সাক্ষাতের সময় নিদেশ করা ছিল চিঠিতে।
চিঠি পেয়ে বেশ অবাক হয়েছিলেন বাসু। এবার বোঝা গেল হেতু।
মিস্টার কার্পেন্টার হাসলেন, আমি জানতাম আপনি রাজি হবেন না। বৈজ্ঞানিকরা কারো অধীনে কাজ করতে চান না বড়। অবশ্য এতে আপনার লোকসান হত না। বরং উভয়পক্ষের লাভ। আপনাকে গবেষণার পূর্ণ স্বাধীনতা এবং সুযোগ দিত কোম্পানি।
নো। ভেরি সরি। ঘাড় নাড়লেন বাসু।
“ঠিক আছে। আপনার সঙ্কোচের কোনো কারণ নেই। আমার প্রস্তাব দিলাম। এখন আপনার অভিরুচি। যদি মত পরিবর্তন করেন, আমায় জানাবেন।
কফি খেতে খেতে স্যাম্পলের শিশিটা নাড়াচাড়া করতে করতে অন্যমনস্ক হয়ে যান কার্পেন্টার। মিস্টার বাসু কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকে লক্ষ করেন। মিস্টার কার্পেন্টার বুঝতে পারেন। অপ্রস্তুতভাবে হেসে বললেন, “আমি একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। এক বিরাট আশাভরা স্বপ্ন।
কী স্বপ্ন, শুনতে পারি?
আমি ব্যবসায়ী মানুষ। আমার স্বপ্ন আর আপনার মতো বৈজ্ঞানিকের স্বপ্নের প্রকৃতি আলাদা। আমার স্বপ্ন, আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা, আমার ব্যবসাকে ঘিরে।
মিস্টার বাসু জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকিয়ে থাকেন।
কার্পেন্টার বলে চলেন, আমি ভাবছিলাম এই সলিউশন আমাদের কোম্পানিকে নিশ্চয় লাভ এনে দেবে। কিন্তু তা আর কতটুকু? এমনি আরও কয়েকটা আশ্চর্য প্রোডাক্ট যদি বাজারে ছাড়তে পারতাম। তাহলে-ওঃ, কী বিপুল লাভ! ভারত কেমিক্যালসের চেহারা পালটে যেত। সারা দুনিয়ায় তার নাম ছড়িয়ে পড়ত।
মিস্টার বাসু হেসে বললেন, অর্থাৎ প্রথমে ঘটা চাই ফসলের মহামারী। তারপর চাই তাদের প্রতিরোধক ওষুধ। তবে আপনার স্বপ্ন সার্থক হবে। তাই না?
তা বটে। হতাশভাবে মাথা নাড়েন কার্পেন্টার। আমার স্বপ্ন একটু অবাস্তব মানছি। তবু ভাবি যদি তা সম্ভব হত–তিনি কেমন যেন উৎসুকভাবে তাকিয়ে থাকেন মিস্টার বাসুর চোখে।
মিস্টার বাসু চোখ সরিয়ে নিলেন। মাথা নিচু করে চিন্তা করলেন কী জানি। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, মিস্টার কার্পেন্টার, বৈজ্ঞানিক যেমন রোগ দমন করার উপায় আবিষ্কার করে, তেমনি সে ইচ্ছে করলে রোগের বীজও তৈরি করতে পারে।
কার্পেন্টার তীব্র কণ্ঠে বলে ওঠেন, মিস্টার বাসু, আমি জানি বিজ্ঞানের ক্ষমতা সীমাহীন। আমি জানি, আপনি ইচ্ছা করলে মানুষের খাদ্য ফসল ধ্বংসের জীবাণু আবিষ্কার করতে পারেন এবং সেই জীবাণুকে রোধ করার ওষুধ। কি, পারেন না? সত্যি করে বলুন?
হয়তো পারি। মৃদু কণ্ঠে জবাব আসে।
তাহলে দিন আমাদের। অন্তত একটা কোনো জুৎসই শস্য রোগের জীবাণু। আর তাকে প্রতিরোধ করার ওষুধ। ভারত কেমিক্যালস আপনার বৈজ্ঞানিক প্রতিভার যথাযোগ্য মূল্য দিতে প্রস্তুত।
বুঝলাম। কিন্তু আমি নিঃসঙ্গ বৈজ্ঞানিক। আপনি যে বিরাট এলাকা জুড়ে ব্যবসার কথা ভাবছেন, এইসব জায়গায় মাঝে মাঝে চাষের ক্ষেতে ওই রোগের বীজকে ছড়িয়ে দিতে হবে। কিন্তু সে ক্ষমতা আমার নেই।
লোকবল আপনার না থাক আমার আছে। কার্পেন্টার উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, ভারত কেমিক্যালসের টাকা বা অনুগত বিশ্বাসী কর্মচারীর অভাব নেই। আপনি শুধু অস্ত্রটি আমার হাতে তুলে দিন। বিকট উল্লাসে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন তিনি।
আচ্ছা, রোগটা কোন্ শস্য নষ্ট করবে? জিজ্ঞেস করলেন কার্পেন্টার।
ধান।
রোগ সৃষ্টির কারণ কী হবে? পোকা না জীবাণু?
পোকা বা জীবাণু নয়। একরকম ছত্রাক।
ভেরি গুড। কবে পাওয়া যাবে?
মিস্টার বাসু ভুরু কুঁচকে ভেবে উত্তর দিলেন, আমার রিসার্চ এখনো সামান্য বাকি। সাত-আট দিন বাদে আমি জানাব এই ছত্রাক এবং তার উপযুক্ত ওষুধের ফরমুলা কবে নাগাদ আপনাদের দিতে পারব।
মিস্টার কার্পেন্টার বললেন, বেশ। আমি আপনার খবরের প্রতীক্ষায় থাকব। আর চিঠিটা দেবেন আমার নামে–কোম্পানির বোম্বাই হেড অফিসের ঠিকানায়। খামের ওপর লিখে দেবেন–পার্সোনাল।
ম্যানেজিং ডিরেক্টর কার্পেন্টার চুরুট ধরিয়েছেন। মিস্টার বাসু গম্ভীরভাবে টানছেন পাইপ। অল্প উসখুস করে কার্পেন্টার বললেন, আর একটি অনুরোধ।
বলুন।
আমার এক বন্ধু। বিদেশি। ওদের ফল-মূলের বিরাট কারবার। দেশে-বিদেশে চালান দেয়–বিশেষত আলু। গত দু-বছর ধরে ওদের কারবার মন্দা যাচ্ছে। কারণ প্রধানত যে দেশে ওরা আলু চালান দিত তারা অনেক কম কিনছে। ওই দেশে নাকি আলুর উৎপাদন বেড়েছে। ফলে বন্ধুর ফার্মের গুদামে প্রচুর আলু জমে গেছে। সে আল বাজারে বিক্রি করতে হলে অনেক কম দামে ছাড়তে হবে। বেজায় লোকসান। বন্ধু বলছিল, যদি কোণে উপায়ে অন্তত এক বছর ওই দেশে আলুর ফলন মার খেয়ে যায় তাহলে ওই দেশ ফের তার ফার্ম থেকে বেশি করে আলু কিনতে বাধ্য হবে। তাদের বাড়তি আলুর স্টকের সদগতি হয়ে যাবে। আমার বন্ধু ভাবছিল, দৈবের ওপর নির্ভর না করে কোনো কৃত্রিম উপায়ে যদি খদ্দের দেশটির আলুর ফলন নষ্ট করা যায়? আপনি কি এ-ব্যাপারে তাকে সাহায্য করতে। পারেন না? এজন্য সে যথেষ্ট খরচ করতেও রাজি।
কত? প্রশ্ন করলেন বাসু।
যদি মোটামটি তিরিশ ভাগ আলর ফলন নষ্ট করার ব্যবস্থা করতে পারে কেশ দুই দিতে আটকাবে না।
দ-লাখ টাকা! লোভে জ্বলজ্বল করে ওঠে মিস্টার বাসুর চোখ। কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বাঁকা হেসে শান্ত কণ্ঠে বললেন, “হয়তো এরকম ব্যবস্থাও আমি করতে পারি। একরকম ভাইরাস আমার নজরে এসেছে–যা আলুর পক্ষে মারাত্মক। এবং অতি দ্রুত তার বংশবৃদ্ধি ঘটে।
ও ভাইরাস? আচ্ছা ভাইরাস তো একরকম জীবাণু? গম্ভীর ভাবে বললেন কার্পেন্টার।
মনে মনে হাসলেন বাসু। বুঝলেন, মিস্টার কার্পেন্টার জাঁদরেল পরিচালক হতে পারেন কিন্তু ভদ্রলোকের প্রাণবিজ্ঞানের জ্ঞান কম। মিস্টার বাসু বললেন, ভাইরাসকে জীবাণু বলতে পারেন, আবার নাও বলতে পারেন। এদের কেউ বলে জড়। কেউ বলে জীব। বরং বলা যায় এই দুইয়ের মাঝামাঝি। এমনিতে এরা জড় অবস্থায় থাকে। কিন্তু কোনো সজীব প্রাণী বা উদ্ভিদকোষের আশ্রয় পেলেই এরা বংশ বৃদ্ধি করে। অর্থাৎ জীবন্ত হয়। আকারে অতি ক্ষুদ্র। খুব জোরালো মাইক্রোস্কোপ ছাড়া দেখা যায় না। এরা জীবন্ত প্রাণী ও উদ্ভিদের মধ্যে নানা ধরনের রোগ ছড়ায়। এ যাবৎ অনেক রকম ভাইরাস আবিষ্কৃত হয়েছে। আমি যে ভাইরাসের খোঁজ পেয়েছি তা আলুর ক্ষেতে ছড়ালে শতকরা ত্রিশ কেন চল্লিশ ভাগ ফসল ধ্বংস হতে বাধ্য।
স্পেনডিড! টেবিল চাপড়ালেন কার্পেন্টার। আমার বন্ধুর এজেন্টের হাতে ওই ভাইরাস তুলে দেওয়া মাত্র অর্ধেক পেমেন্ট পেয়ে যাবেন। বাকি অর্ধেক পাবেন কার্যসিদ্ধির পর।
আমার কিন্তু সময় চাই–অন্তত কয়েক মাস। ল্যাবরেটরিতে কালচার করে প্রচুর ভাইরাস তৈরি করতে হবে–এ তাড়াহুড়োর ব্যাপার নয়।
বেশ-বেশ। নিন সময়। আমি আমার বন্ধুকে সুসংবাদটি জানিয়ে দিচ্ছি। তবে হ্যাঁ, আমার কোম্পানির ইন্টারেস্ট কিন্তু প্রথম। আগে আমার অর্ডারটা সাপ্লাই করে তারপর আমার বন্ধুর ব্যবস্থা।
নিশ্চয়। সম্মতি জানালেন মিস্টার বাসু।
বাইরে নির্বিকার দেখালেও মিস্টার বাসুর হৃদয়ে আনন্দের জোয়ার। আঃ, আজ বড় শুভ দিন! কী বিরাট উপার্জনের সুযোগ এসে গেল–কত সহজে।
এবার মিস্টার বাসু বিদায় নিলেন।
প্রিন্স হোটেলের ঠিক উল্টো দিকে এসপ্লানেড। এলাকাটা তখন গমগম করছে। ফুটপাত ঘেঁষে লাগানো সারি সারি অপেক্ষমাণ মোটরগাড়ির পিছনে তিন ব্যক্তি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে সুনন্দ, অসিত এবং মামাবাবু। তাদের দৃষ্টি ওই হোটেলের গেটে নিবদ্ধ। মিস্টার বাসুকে ঢুকতে দেখেছিল তারা। দেড় ঘণ্টা বাদে তাকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল।
সুনন্দ অসিতকে নিয়ে মামাবাবু যখন এইখানে লুকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন তখন অবাক হয়ে গিয়েছিল দুই বন্ধু। তারপর সামনের হোটেলে হঠাৎ মিস্টার বাসুকে ঢুকতে দেখে আঁচ করল ব্যাপার। তাকে দেখে মামাবাবু একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, মিস্টার বাসু না?–হ্যাঁ–তারা ঘাড় নেড়েছিল। কিন্তু মামাবাবু কী করে এখানে এই সময়ে বাসুর আগমন হবে টের পেলেন সে-রহস্য তাদের কাছে পরিষ্কার হয়নি। বাসু ট্যাক্সি ধরার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কাছে দাঁড়ানো এক ট্যাক্সির চালক ঘাড় ফিরিয়ে মামাবাবুর দিকে চাইল। মামাবাবু কী জানি ইঙ্গিত করলেন তাকে। অমনি তার গাড়ির ইঞ্জিন সচল হয়ে উঠল। এবং সুনন্দরা লক্ষ করল যে বাসুর ট্যাক্সির পিছন ধরল এই ট্যাক্সিটা। দুটো গাড়িই মিলিয়ে গেল রাজপথে।
চলো ফিরি। বললেন মামাবাবু।
ঘণ্টাখানেক পরে টেলিফোন বাজতেই মামাবাবু ঝাঁপিয়ে পড়ে তুলে নিলেন রিসিভার। মিনিট পাঁচ কথা হল কারো সঙ্গে। রিসিভার নামিয়ে তিনি ডেকে বললেন, সুনন্দ রেডি হও। এখুনি বেরোতে হবে। মিস্টার পিল্লাই গাড়ি নিয়ে আসছেন আমাদের তুলে নিতে।
শুধু সুনন্দ নয়, মামাবাবুর সঙ্গে আরও দুজন যাবার জন্য প্রস্তুত। অসিত এবং কুণাল। বাড়ি ফিরেই সুনন্দ কুণালকে ফোনে ডেকে বলেছিল, মিস্টার বাসুর দেখা পাওয়া গেছে। একটা সিরিয়াস কিছু ঘটতে যাচ্ছে। চলে আয় এখানে। কুইক।
রাত প্রায় আটটা।
ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড ধরে তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে এক ধূসর রঙা ফিয়াট গাড়ি।
গাড়ির সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে বসে আছেন মামাবাবু এবং মিস্টার পিল্লাই। পিছনের সিটে–সুনন্দ, অসিত ও কুণাল।
মিস্টার পিল্লাই মাঝবয়সী, শক্তসমর্থ মানুষ। মাঝে মাঝে তিনি ও মামাবাবু নিচু সুরে কী সব পরামর্শ করছেন, কখনো ইংরেজিতে কখনো বা বাংলায়। পিল্লাইয়ের বাংলা ঝরঝরে। যদিও সামান্য অবাঙালি টান আছে। পিছনের তিন আরোহী বাক্যহারা। টানটান হয়ে একাগ্র চিত্তে লক্ষ্য রাখছে সামনের দুজনের হাব-ভাব।
হু-হু করে এগোয় মোটর। পেরিয়ে যায় সোদপুর, খড়দা, টিটাগড়–ক্রমে পৌঁছয় পথের শেষ প্রান্তে। ব্যারাকপুর।
গঙ্গার ধারে চওড়া পিচ-ঢাকা নির্জন রাস্তা। দু-পাশে বড় বড় কম্পাউন্ডওলা বাড়ি। বেশিরভাগ খুব পুরনো। এক রাস্তার মোড়ে গাড়ি থেমে পড়ল। গাছের ছায়া থেকে বেরিয়ে একজন কাছে এল। সেই ট্যাক্সি ড্রাইভার। চৌরঙ্গীর প্রিন্স হোটেল থেকে মিস্টার বাসুর ট্যাক্সিকে অনুসরণ করেছিল যে।
মামাবাবু ও মিস্টার পিল্লাইয়ের সঙ্গে লোকটির কী জানি কথা হল। মামাবাবু সুনন্দদের ডাকলেন, নেমে এসো।
পিল্লাইয়ের গাড়ি সহ ড্রাইভার রইল সেখানে। বাকি ছয়জন হেঁটে চলল। পথ দেখিয়ে চলেছে সেই ট্যাক্সিচালক। একটা গেটের সামনে থামল ওরা। লোহার প্রকাণ্ড গেট। উঁচু পাঁচিল ঘেরা বাড়ি। দোতলা। বিশাল বিশাল গাছে অন্ধকার হয়ে আছে মস্ত বাগান। আবছা চাঁদের আলোয় ভূতুড়ে লাগছে বাড়িখানা।
গেট ঠেললেন পিল্লাই। কাঁচ–শব্দ হল।
হঠাৎ কোত্থেকে সামনে এসে দাঁড়াল একটা লোক।
রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোতে দেখা গেল–লোকটা রীতিমতো গাঁট্টাগোট্টা। গায়ে স্পোর্টস গেঞ্জি ও ফুলপ্যান্ট। রুক্ষ মুখ।
মিস্টার বাসুর সঙ্গে দেখা করতে চাই। বললেন মামাবাবু।
এখানে মিস্টার বাসু বলে কেউ থাকে না। কড়া সুরে বলল লোকটা।
মামাবাবু অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে চাইলেন তাদের গাইডের দিকে। নিঃশব্দে মাথা হেলাল লোকটি। এবার মামাবাবু দৃঢ় স্বরে বললেন, মিস্টার বাসু এখানে থাকেন কিনা জানি না। তবে আপাতত তিনি এ-বাড়িতে আছেন। আমরা তার সঙ্গে দেখা করব।
না, বাড়িতে ঢোকা চলবে না। লোকটি ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে পথ আগলে দাঁড়াল। বোঝা গেল সে সহজে কাউকে ঢুকতে দেবে না। দরকার হলে হাঙ্গামা বাঁধাতেও প্রস্তুত।
মিস্টার পিল্লাই এবার পকেট থেকে একখানি কার্ড বের করে লোকটির চোখের ওপর তুলে ধরলেন। পুলিস–তাঁর মৃদু স্পষ্ট উচ্চারণ কারোরই কান এড়াল না।
লোকটা চমকে পিছিয়ে গেল কয় পা।
খবরদার পালাবার চেষ্টা কোরো না। পিল্লাইয়ের ডান হাতে আবির্ভূত হল এক চকচকে রিভলভার। তিনি ডাকলেন, ফাগুলাল।
ইয়েস স্যার। গাইড এসে লোকটির হাত চেপে ধরল। যাও এর সঙ্গে, কঠিন স্বরে আদেশ দিলেন পিল্লাই। লোকটা সুড়সুড় করে ফাগুলালের সঙ্গে চলে গেল যেদিকে পিল্লাই গাড়ি রেখে এসেছেন। সুনন্দদের বুঝতে অসুবিধে হল না যে পিল্লাই এবং ফাগুলাল পুলিসের লোক।
পাঁচজনে এবার এগিয়ে চলল দোতলা বাড়িখানা লক্ষ্য করে।
বাড়ির বাইরে মিটমিট করে জ্বলছে একটা বৈদ্যুতিক বাতি। নিচের তলা ঘুটঘুট করছে। মাথার ওপর ঝুলবারান্দা। দোতলায় একটিমাত্র জানলায় আলোর রেখা। সদর দরজা বন্ধ।
বাড়ির চারপাশে ঘুরতে থাকে দলটা। পকেট থকে টর্চ বের করেছেন পিল্লাই। আলো। ফেলে দেখছেন একতলার প্রত্যেকটি জানলা। জানলাগুলো প্রকাণ্ড। খড়খডি লাগানো পাল্লাগুলো বন্ধ। তার পেছনে কাঁচের শার্শি আঁটা। গরাদ নেই। প্রত্যেক জানলার খড়খডি তুলে ভিতরে হাত ঢুকিয়ে পরীক্ষা করছিলেন পিল্লাই। হঠাৎ তিনি সামান্য খুটখাট করে একটা জানলার পাল্লা খুলে ফেললেন। দেখা গেল সেই শার্শির একজায়গায় ভাঙা। পিল্লাই বললেন, একজন নিচে থাকুন পাহারায়। অন্যরা ভিতরে ঢুকবে। কে থাকবেন? আপনি? তিনি কুণালকে জিজ্ঞেস করলেন।
বেশ। কুণাল সম্মতি জানাল।
হাতে ভর দিয়ে জানলার আলসেয় উঠে ঘরের মধ্যে নেমে পড়ল একে একে চারজন। ভাগ্য ভালো, ঘরের দরজা ভেজানো। ঠেলতে খুলে গেল। মনে হল সেটা রান্নাঘর।
ঘর থেকে বেরিয়ে চওড়া প্যাসেজ। দু-পাশে ঘর। বেশিরভাগ দরজা হাট করে খোলা বা ভেজানো। ক্রমে সিঁড়ির মুখে হাজির হল তারা। দোতলায় কাদের কথা শোনা যাচ্ছে। পা টিপে টিপে চারজন ওপরে উঠল।
দোতলায় মুখোমুখি দুই দুই চারখানা ঘর। একটা ঘর থেকে ভেসে আসছিল মানুষের গলার আওয়াজ। অন্য ঘরগুলোয় জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই। সবাই গিয়ে দাঁড়াল ওই ঘরের সামনে। দরজার কবাট বন্ধ। কবাটের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভিতরের আলোর ক্ষীণ রেখা। মামাবাবুর দল দরজার গায়ে কান পাতল।
আর একবার ভালো করে ভেবে দেখ, তপন। কর্কশ ক্রুদ্ধ কণ্ঠে কথা বলল কেউ।
আমি ভেবে দেখেছি মিস্টার বাসু। এ-গলা তপনের। চিনতে ভুল করেনি সুনন্দ বা অসিত।
অর্থাৎ আমার প্রস্তাব তুমি মানবে না?
সুনন্দর মনে হল এ-গলাও যেন তার চেনা। কোথায় শুনেছে।
মূর্খ! নিজের পায়ে কুড়ুল মারতে চাও? আমি এই শেষ বারের মতো জিজ্ঞেস করছি। বল রাজি কি না?
না না। তপন আর্তস্বরে বলে উঠল।
মিস্টার বাসু ধমকে উঠলেন, বোকামি কোরো না। বেশ! তোমায় আরও দু-হাজার। বেশি দিচ্ছি। মোট সাত হাজার টাকা। আর পুরনো ধার সব ছেড়ে দেব। এবং ভবিষ্যতে তোমার কাছে এ-ধরনের কিছু আর কখনো চাইব না।
আমায় মাপ করুন। আমার গুরু ডক্টর তালুকদার বলতেন, মানুষের মঙ্গলের জন্য বিজ্ঞান। এ কাজ করলে তিনি স্বর্গ থেকে আমায় অভিশাপ দেবেন।
সাট-আপ! আবার লেকচার। বটে সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। তোমার মতো একগুয়েকে ঢিট করার রাস্তা আমি জানি। শোনো, তোমার ছোট ভাই বিমান, আপাতত তাকে গায়েব করে এনে লুকিয়ে রেখেছি এক গুণ্ডার আড্ডায়। যদি আমার কথামতো না। চলো, তাকে আর কোনোদিন ফিরে পাবে না।
মিস্টার বাসু, প্লিজ! তপন কাতর অনুনয় জানাল। আপনি আমার অনেক উপকার করেছেন, আমি কৃতজ্ঞ। আমায় দয়া করুন।
দয়া? অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন বাসু।
দয়া-দাক্ষিণ্য বিতরণ আমার ব্যবসা নয়। আমি যা করেছি তার প্রতিদান চাই।
বলুন কীভাবে আপনার ঋণ শোধ করব। শুধু জেনেশুনে মানুষের ক্ষতি করতে পারব না। এইটুকু ভিক্ষা চাই। তাছাড়া যা আদেশ করেন। আচ্ছা আপনার তো টাকা চাই? আমায় একটু সময় দিন। এখনো আমাদের দেশে ফসলের কত রোগ দমন করার কোনো ভালো ব্যবস্থা নেই। আমি ওইসব রোগ প্রতিরোধের ওষুধ আবিষ্কার করব। তার সমস্ত স্বত্ব দিয়ে দেব আপনাকে। তাই থেকে প্রচুর রোজগার করতে পারবেন।
নো। অত অপেক্ষা করার সময় আমার নেই। আমি এখুনি টাকা চাই। অনেক–অনেক টাকা। এবং তার উপায় তোমায় বলেছি। কি রাজি?
না।
অল রাইট। তোমার জেদের ফল কী হবে জানো।
কী?
তোমার ভাইয়ের সর্বনাশ। ওকে জোর করে মরফিয়া ইনজেকশন দিয়ে নেশা ধরাব। নেশার জিনিসের লোভ দেখিয়ে তখন ওকে দিয়ে যে-কোনো কুকর্ম করানো যাবে। ভেবেছি, ওকে বানাব-ফার্স্ট ক্লাস খুনে গুণ্ডা। অবশ্য মরফিয়ার অভ্যেস ভালোমতো। ধরলে মানুষ বেশি দিন আর সুস্থ থাকে না। কয়েক বছরের মধ্যেই ও জড়বুদ্ধি বিকলাঙ্গ হয়ে মরবে।
শয়তান। ধড়াম করে শব্দ হল ঘরে।
উঃ! কাতরে উঠলেন মিস্টার বাসু। বিকৃত তর্জন শোনা গেল তার কণ্ঠে, “কী। আমার গায়ে হাত। দাঁড়াও, চাবকে তোমার ছাল তুলে দিচ্ছি।
সপাং সপাং। বাতাস কেটে চাবুকের হিংস্র হোবলের শব্দ শোনা গেল দু-দুবার। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল তপন।
ঘরের বাইরে চারজন রুদ্ধশ্বাসে শুনছিল। সুনন্দ আর স্থির থাকতে পারল না। দরজায় ধাক্কা মারতে মারতে চিৎকার করে উঠল-খবরদার। দরজা খুলুন মিস্টার বাসু। ভয় নেই তপন! আমি সুনন্দ।
মুহূর্তে ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল। দপ করে নিবে গেল ঘরের আলো।
খুট করে শব্দ হল। যেন ছিটকিনি খুলল কেউ। তারপর কবাট খোলর মৃদু আওয়াজ। সুনন্দ যেটা ঠেলছে সেটা কিন্তু খুলল না। মামাবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, ও পালাচ্ছে। বারান্দার দরজা খুলে। নিশ্চয়ই বাইরে সিঁড়ি আছে নামার।
সুনন্দ অসিত দুড়দাড় করে ছুটল নিচে। তাদের মনে পড়েছে–একটা সরু ঘোরানো লোহার সিঁড়ি দেখেছিল বাড়ির পিছনে। বাইরে থেকে ওই সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠা-নামা করা যায়।