» » মিস্টার বাসুর ফরমুলা

বর্ণাকার

অজেয় রায়

মিস্টার বাসুর ফরমুলা

চার

মিত্র কেমিক্যালস-এর সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ হরিধনের রহস্যময় অন্তর্ধান সম্পর্কে কুণাল যা বলল তার সারমর্ম এই–

হোটেল কুতুবের সামনে এক পার্কের বেঞ্চে বসে হোটেলের ওপর নজর রাখাছল হরিধন। বিকেল পাঁচটা নাগাদ মিস্টার বাসু এলেন ট্যাক্সিতে। আধ ঘণ্টার মধ্যে তিনি বেরিয়ে আসেন। ট্যাক্সি ডাকলেন না। পাইপ ধরিয়ে ধীরে সুস্থে হাঁটতে শুরু করলেন চৌরঙ্গীর দিকে।

সুবিধেই হল হরিধনের। অফিস-ফেরতা জনস্রোতে গা-ঢাকা দিয়ে সে হাত কুড়ি পিছনে থেকে বাসুকে অনুসরণ করল।

চৌরঙ্গী ছাড়িয়ে অনেক রাস্তা ঘুরে বাসু ঢোকেন চীনে পট্টিতে। পথে একবার মাত্র থেমেছিলেন–দেশলাই কিনতে।

একটা সরু গলি। দুপাশে পুরনো আমলের বড় বড় বাড়ি। পথচারী কম। মিস্টার বাসু টপ করে এক বাড়ির দরজা দিয়ে ঢুকে গেলেন। মিনিট পনেরো গলির মোড়ে অপেক্ষা করে হরিধনও ঢুকল সেই বাড়িতে।

সরু প্যাসেজ–দুধারে সার-সার ঘর। নোনা-ধরা ইট বের করা দেওয়াল। প্যাসেজে মিটমিট করছে বৈদ্যুতিক আলো। কোনো ঘর তালাবন্ধ। কোনোটা খোলা–মানুষজনের কথার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে ভিতরে। দু-চার জন লোক ঢুকছে বা বেরুচ্ছে। ঘরগুলোয় লোক বাস করে না। গুদাম বা অফিস হিসেবে ব্যবহার হয়। খোলা দরজা পেলেই ভিতরে। উঁকি দেয় হরিধন।

প্যাসেজের শেষ প্রান্তে একটা লোক দাঁড়িয়েছিল। হরিধনকে দেখছিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। হরিধন জিজ্ঞেস করল তাকে–একজনকে দেখেছেন যেতে? কোট-প্যান্ট পরা।

লোকটি আঙুল তুলে দেখাল-হ্যাঁ, ওই দিকে।

বাড়ির এ অংশ একেবারে নির্জন। হঠাৎ থামের আড়াল থেকে যেন মন্ত্রবলে আরি হল এক ব্যক্তি–দীর্ঘকায়, বলিষ্ঠ, পরনে রঙচঙে লুঙ্গি ও শার্ট। চোখের নিচে হতে মহেব বাকি অংশ রুমাল বেঁধে ঢাকা।

মুহূর্তে সে হরিধনের বুকের ওপর উঁচিয়ে ধরল একখানা লম্বা ঝকঝকে ছোবা। কর্কশ স্বরে বলল–খবরদার, চেঁচালেই মরবি।

আর তখুনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হরিধনের ঘাড় পেছন থেকে দৃঢ়মুষ্টিতে আঁকড়ে গত কেউ। এবং আর একখানা হাত ভিজে কাপড়ের টুকরো সমেত তার মুখ চাপা দিল। ঝাঝাল মিষ্টি গন্ধ ঢুকল নাকে। হরিধনের মাথা ঝিমঝিম করে উঠল এবং সে জ্ঞান হারান।

হরিধন যখন চেতনা পেল তখন বুঝতে পারল যে একটা দরজা-জানলা বন্ধু অন্ধকার ঘরে সে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মেঝেতে শুয়ে রয়েছে। মুখও বাঁধা, গালের ভিতর কাপড় ঠাসা। চেঁচাবার উপায় নেই। ঘুলঘুলি দিয়ে সামান্য আলো ঢুকছে।

দারুণ তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছিল। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। গড়িয়ে গড়িয়ে দরজার কাছে গেল হরিধন। দুম দুম্ করে জোড়া পায়ে লাথি মারতে লাগল কবাটে। বাইরে তালা খোলার আওয়াজ। সেই মুখ-ঢাকা লোকটা ঢুকল ঘরে। হিংস্রভাবে দাবড়ানি দিল–টু শব্দ করলে গলা কেটে পুঁতে ফেলব।

হরিধন ইঙ্গিতে বোঝাল–জল।

লোকটা এক মগ জল এনে হরিধনের বাঁধন খুলল। হরিধন হাঁ করতে ঢেলে দিল জলটুকু। তারপর বেরিয়ে গিয়ে দরজায় তালা দিল। দরজার বাইরে আলো। দেখে হরিধনের মনে হয়েছিল তখন সকালবেলা।

খানিকক্ষণ পরে তার কানে এল দরজার বাইরে দুজন লোকের কথাবার্তা।

ফেউটাকে নিয়ে কী করব স্যার?

দেখি ভেবে।

খতম করে পাচার করে দিই। ঝামেলা চুকে যায়।

উহুঁ ব্যস্ত হয়ো না। আমি আসছি ঘুরে।

একজনের গলা চিনেছিল হরিধন–মুখ-ঢাকা গুণ্ডাটা। দ্বিতীয় জনকে চিনতে পারেনি।

ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল হরিধন। আর কোনো শব্দ করতে সাহস পায়নি। ঘণ্টার পর ঘন্টা ঠায় একভাবে পড়ে থেকে তার সর্বাঙ্গ অসাড় হয়ে গিয়েছিল।

আবার দরজা খুলল সেই গুণ্ডাটা। তখন নিশুতি রাত। হরিধনের মুখ খুলে দিয়ে এক গ্লাস দুধ দিল তাকে খেতে। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল। তাই বিনা আপত্তিতে দুধটুকু খেয়ে ফেলল হরিধন। একটুক্ষণ পরেই তার চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে। অবশ অচেতন হয়ে পড়ল তন্দ্রায়।

কণাল বলল, ভোরবেলা হরিধনের দেহ আবিষ্কার হল। ওই বাড়িরই এক নোংরা উঠানে। প্রথমে লোকে ভেবেছিল মৃত। তারপর বুঝল অজ্ঞান। তখন ওকে হাসপাতালে পাঠাল। পরে ওর জ্ঞান হল। ডাক্তার বলেছে কড়া ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল।

কিছু খোয়া গেছে হরিধনের? জিজ্ঞেস করল সুনন্দ।

হুঁ। ওর মনিব্যাগ এবং রিস্টওয়াচ। পুলিশ ওই বাড়ি সার্চ করেছে। কিন্তু হরিধনের আততায়ীর সন্ধান পায়নি। এমনকি কোন ঘরে বন্দী ছিল তাও ঠিক করে বলতে পারেনি হরিধন। কয়েকজনকে জেরা করে আপাতত হাল ছেড়ে দিয়েছে। কী করতে হরিধন ওই বাড়িতে ঢুকেছিল তার আসল কারণ অবশ্য পুলিশের কাছে চেপে গেছি। কে জানে, তাহলে হয়তো আমাদেরই অযথা হয়রানি করত পুলিশ।

অল্পক্ষণ নীরব থেকে কুণাল বলল, “আমার কিন্তু মনে হয় এ অর্ডিনারি ছিনতাই কেস নয়। মিস্টার বাসুই গুণ্ডা লাগিয়েছিল।

তোর ধারণার কারণ?

কারণ হরিধনের প্যান্টের পকেটে একটা চিঠি ছিল, সেটা উধাও হয়েছে। এমনি অফিস চিঠি। অফিসিয়াল প্যাডে আমি লিখেছিলাম হরিধনকে কিছু কাজ সংক্রান্ত বিষয়ে। আমার সই ছিল তাতে। এ চিঠি সাধারণ গুণ্ডা নেবে কী করতে? তাছাড়া ওকে ফেউ বলাছল

হতে পারে। বাসু সন্দেহ করেছিল ওকে ফলো করা হচ্ছে, তাই। লোকটা তাহলে ডেনজারাস–

সদর দরজার কলিং বেল বাজল।

দরজা খুলে সুনন্দ দেখে বঙ্কিমবাবু।

বঙ্কিমবাবু বললেন, “নমস্কার। প্রফেসর ঘোষ আছেন?

না, বেরিয়েছেন। আপনি বসুন। ফিরবেন এবার।

ডানকান সাহেব কি চলে গেছেন?

হ্যাঁ।

ওঃ দুর্দান্ত লোক মশাই। এই প্রথম স্বচক্ষে একজন পর্যটককে দেখলাম। বইয়ে পড়েছি। কত।

সুনন্দ জবাব দিতে যাচ্ছিল–কেন, মামাবাবু? কিন্তু তার নজরে পড়ল বঙ্কিমবাবু হা করে চেয়ে আছেন বৈঠকখানার খোলা দরজা দিয়ে কুণালের দিকে।

সুনন্দ বলল, আমার বন্ধু কুণাল মিত্র।

ও, ইনিই বুঝি মিস্টার বাসুর খোঁজ করছিলেন? চাপা গলায় বললেন বঙ্কিমবাবু।

“না না, সে অন্য লোক।

ওঃ সরি। আচ্ছা আমি এখন চলি। পরে আসবখন। নমস্কার।

দরজা বন্ধ করে এসে সুনন্দ বলল, কুণাল, ভদ্রলোক কী বলছিলেন জানিস?

কী?

ইনিই কি মিস্টার বাসুর খোঁজ করছেন?

অ্যাঁ! কুণাল আঁতকে ওঠে।

ভয় নেই। আমি বলেছি সে অন্য লোক। সুনন্দ আশ্বাস দিল।

কে ভদ্রলোক?

বাবু বঙ্কিম হাজরা। মামাবাবুর চেলা। লোক খারাপ নয়, তবে মগজ কিঞ্চিৎ নিরেট।

সত্যি, বোকা লোকগুলো এক-একসময় এমন বেফাঁস কথা বলে ফেলে!

কুণাল বিদায় নেবার ঘণ্টাখানেক পরে এল অসিত।

সুনন্দ অসিতকে সংক্ষেপে জানাল হরিধনের অন্তর্ধান-কাহিনি। তারপর বলল, বল শুনি, বঙ্কিমবাবুর রহস্যময় আচরণ সম্বন্ধে কী জানি বলছিলি?

অসিত বলতে শুরু করে–কোপাই নদীর তীরে গাছতলায় শুয়ে আছি। খানিক পরে কাৎ হয়ে দেখি, অন্য পাবে ঝোঁপের আড়ালে বঙ্কিমবাবু। আমার দিকে একটু পাশ ফিরে বসেছেন। তার হাতে একটা পাখি,–তিতির। আমি ভাবলাম পাখিটাকে রিং পরাবেন, তাই কৌতূহল নিয়ে তাকিত রইলাম।

উনি কিন্তু কী করলেন জানিস? ব্যাগ থেকে ছোট একটা শিশি বের করলেন। তারপর আঙুল শিশির মধ্যে ঢুকিয়ে কী জানি তুলে পাখিটার ঠোঁটে, মুখে, ডানায়, পায়ে ঘষে দিতে লাগলেন। বারবার এমনি করলেন। এমনকি সেটা খাওয়ানোর চেষ্টাও করলেন। আমি তো হাঁ। করছেন কী? এরপর তিনি তিতিরটা উড়িয়ে দিলেন।

রিং পরালেন না? প্রশ্ন করল সুনন্দ।

না। আমি দুরবিন ফোকাস করে লক্ষ করেছি। রিং দেখতে পাইনি পাখির পায়ে। বঙ্কিমবাবু এরপর আর একটা তিতির নিলেন হাতে। এবং আগের মতোই উদ্ভট কাণ্ড করে সেটাকেও ছেড়ে দিলেন।

রিং?

উঁহু, তার পায়েও রিং ছিল না। বঙ্কিমবাবু এরপর চলে গেলেন উঠে। শিশিটা ফেলে দিয়ে গেলেন একটা গর্তে। আমি পরে গিয়ে শিশিটা তুলে নিলাম। কিন্তু শিশিতে যে কী ছিল ধরতে পারছি না।

কই দেখি শিশিটা।

অসিত পকেট থেকে একটা ছোট্ট কাঁচের শিশি বের করল। চ্যাপ্টা ক্রিমের শিশির মতো সাইজ। স্বচ্ছ কাঁচের তৈরি। প্লাস্টিকের ঢাকনা–তাতে সূক্ষ্ম কয়েকটি ছিদ্র। শিশির ভিতরে কাঁচের গায়ে পাতলা সরের মতো কী জানি লেগে রয়েছে জায়গায় জায়গায়।

সুনন্দ শিশিতে নাক লাগিয়ে শুকল। কেমন বোটকা গন্ধ। চোখের কাছে এনে পরীক্ষা করল। কিন্তু ভিতরে যে কী বস্তু ছিল আন্দাজ করতে পারল না। অবাক হয়ে বলল, “কী ছিল এতে? আশ্চর্য! এটা কী লেগে আছে?

জানিস, এই শিশিটা আমি আগেও একবার দেখেছিলাম। বলল অসিত।

কখন?

সেই যখন বাঁদরে বঙ্কিমবাবুর জিনিস ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলল। আমি তার জিনিস খুঁজতে খুঁজতে এই শিশিটা পাই। ওটা হাতে পেয়ে একটুক্ষণ লক্ষ করেছিলাম। ঢাকনা খুলিনি। তখনও কিন্তু মনে হয়েছিল শিশিটা প্রায় খালি শুধু অল্প ক্রিম জাতীয় কী বস্তু রয়েছে ভিতরে।

দুই বন্ধু হতভম্ব হয়ে বসে থাকে শিশিটার দিকে তাকিয়ে।

সুনন্দ বলল, “আমি তো ভাই কিছু কূল পাচ্ছি না।

আমিও না।

একটা কাজ করব?

কী?

মামাবাবুকে বলি ব্যাপারটা। উনি যদি কোনো ক্লু—

হুঁ, আমিও তাই ভাবছিলাম। তুই রাখ শিশিটা। মামাবাবুকে দেখাস।

তবে মামাবাবু পাখি নিয়ে যা মেতে আছেন। হয়তো কানেই তুলবেন না। দেখা যাক।

বিকেলে মামাবাবুর স্টাডিতে ঢুকল সুনন্দ। সামান্য ইতস্তত করে বলে ফেলল বঙ্কিমবাবুর শিশি-রহস্য।

মামাবাবু শিশিটা দেখলেন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। বললেন-বেশ, দেখব পরীক্ষা করে। তবে তোমাদের বোধহয় নিরাশ হতে হবে। হয়তো শুনবে নেহাত ছেলেমানুষী ব্যাপার।

মামাবাবুর হাতে ওই শিশি তুলে দেওয়ার তিন দিন পরের ঘটনা।

সবে ব্রেকফাস্ট সেরে পড়ার টেবিলে এসে বসেছেন প্রোফেসর ঘোষ অর্থাৎ মামাবাবু। সামনে মুখোমুখি বসে সুনন্দ ও অসিত। টেবিলের ওপরে রাখা বঙ্কিমবাবুর সেই রহস্যময় শিশি।

এই শিশিতে কি ছিল জান? বললেন মামাবাবু।

কী?

একরকম ব্যাকটিরিয়া। জীবাণু।

সে কী!! মহা বিস্ময়ে অসিত ও সুনন্দ হতভম্ব। কীসের? প্রশ্ন করল তারা।

একে একে বলছি। মামাবাবু শিশিটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন, প্রথমে আমি শিশির ভিতরে কাঁচের গায়ে লাগা আঠাল বস্তু একটু নিয়ে স্লাইডসয়ে লাগিয়ে মাইক্রোস্কোপের তলায় পরীক্ষা করি, এবং একরকম ব্যাকটিরিয়ার অস্তিত্ব আবিষ্কার করি। ওই বস্তু বারবার বিশ্লেষণ করলাম নতুন করে নিয়ে। প্রত্যেক বারই পেলাম সেই একই জাতের ব্যাকটিরিয়া–প্রচুর পরিমাণে। অবাক হলাম। বুঝলাম, ওই সরের মতো আঠাল বস্তু কোনো কালচার মিডিয়া। এবং তার মধ্যে এই ব্যাকটিরিয়ার বংশ বৃদ্ধি ঘটানো হয়েছে। কিন্তু এ-জীবাণু যে কী জাতীয় বুঝে উঠতে পারলাম না।

কালচার মিডিয়া কী? প্রশ্ন করল অসিত।

মামাবাবু জবাব দিলেন, একরকম রাসায়নিক পদার্থ। ল্যাবরেটরিতে যার মধ্যে জীবাণুকে কালচার অর্থাৎ পালন করা হয়।

হ্যাঁ, তখন গেলাম মাইক্রোবায়োলজিস্ট ডক্টর আয়ারের কাছে। জীবাণু নিয়েই তার গবেষণা। ডক্টর আয়ারও ধরতে পারলেন না। তিনি আমায় নিয়ে গেলেন আর একজন বিশেষজ্ঞের কাছে–কৃষিবিজ্ঞানী ডক্টর সাহা।

ডক্টর সাহারও বেশ সময় লাগল জিনিসটা কী সেটা বুঝতে। তারপর যা রিপোর্ট দিলেন সেটা অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য।

ডক্টর সাহা বলেছেন–এই ব্যাকটিরিয়া হচ্ছে গমের নেতানো রোগের কারণ। গমের পাতা ও শিষের নরম অংশের কোষ থেকে এই জীবাণু খাদ্য আহরণ করে। ফলে পুষ্ট গাছ যায় শুকিয়ে। সাহা বলেছেন–এই গমের রোগ ভারতবর্ষে একেবারে নতুন। কৃষিবিজ্ঞানীরা এ-রোগ নিয়ে খুব মাথা ঘামাচ্ছেন। কিন্তু এখনো এর প্রতিরোধের কোনো উপায় বের হয়নি।

ডক্টর সাহা ভেবেছিলেন, কেউ বুঝি এই ব্যাকটিরিয়া নিয়ে রিসার্চ করছে। তিনি তার নাম জানতে চাইছিলেন।

গমের নেতানো রোগ। সুনন্দ লাফিয়ে ওঠে।

 ঠিক এই রোগের ওষুধের ফরমুলা তো বিক্রি করতে চাইছেন মিস্টার বাসু।

কে মিস্টার বাসু? মামাবাবু প্রশ্ন করলেন।

সুনন্দ ও অসিত পালা করে বলে গেল মিস্টার বাসুর কাহিনি–একেবারে শুরু থেকে। কুণালের কাছে গত বছর রহস্যময় মিস্টার বাসুর চিঠি–ফরমুলা বিক্রির প্রস্তাব–কুণালের সন্দেহ–প্রকৃত বৈজ্ঞানিকের খোঁজে তাদের বারবার অভিযান এবং ব্যর্থতা—সমস্ত খুটিনাটি।

মামাবাবু ভুরু কুঁচকে শুনে গেলেন আগাগোড়া। সুনন্দদের বর্ণনা শেষ হলে উত্তেজিত ভাবে বলে উঠলেন, “বটে বটে। শোনো, আমি কুণালের সঙ্গে কথা বলতে চাই। ওকে আসতে বলো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

আধঘণ্টার মধ্যেই কুণাল হাজির হল।

মামাবাবু কুণালকে মিস্টার বাসুর ধরন-ধারণ ও তার ফরমুলাগুলি সম্পর্কে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। ধানের রাক্ষুসে পোকা বা গমের নেতানো রোগের ইতিহাসও জেনে নিলেন। সব শুনে গুম মেরে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। অতঃপর সুনন্দকে ছক দিলেন–বঙ্কিমবাবুর বাড়ি যাও। ওনাকে ডেকে আনো আমার কাছে। তবে এ-ব্যাপারে কিছু ফাঁস কোরো না। বলবে, আমি বার্ড-ওয়াচিংয়ে বেরোচ্ছি। তাই ওঁর সঙ্গে প্রোগ্রাম করতে চাই।

বঙ্কিম হাজরার এন্টালির বাসায় আগে যায়নি সুনন্দ। ঠিকানা খুঁজে বের করল। মস্ত পাঁচতলা বাড়িতে তিন কামরার এক ফ্ল্যাট নিয়ে বাস করেন বঙ্কিমবাবু। নিজের বাড়ি নয়, ভাড়া।

দুঃখের বিষয় ফ্ল্যাটের দরজায় তালা ঝুলছে।

দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে সুনন্দ জানল, বঙ্কিমবাবু কলকাতার বাইরে গেছেন। কবে ফিরবেন ঠিক নেই।

সুনন্দর রিপোর্ট পেয়ে মামাবাবু আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন। পরের দিন তিনি কোথায় কোথায় জানি ঘুরলেন। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরেই সুনন্দকে ডেকে বললেন, কাল ভোরে তোমাদের বন্ধু তপন দত্তর সঙ্গে দেখা করতে যাব। অসিতকেও নিয়ে চলো।

মানে সুরভি নার্সারি?

হুঁ। এই তপন দত্তর পরিচয় জানো? জান ওর ইতিহাস?

কেন, তপন কী করেছে?

ঠিক কী করেছে সেটাই জানতে চাই। যেটুকু জানতে পেরেছি তপন দত্ত ছিল প্রোফেসর তালকদারের রিসার্চ অ্যাসিস্টেন্ট। বহুদিন কাজ করেছে ডক্টর তালুকদারের ল্যাবরেটরিতে। তালুকদার একবার তপন সম্বন্ধে ডক্টর সাহার কাছে খুব প্রশংসাও করেছিলেন।

ডক্টর তালুকদার মানে বিখ্যাত উদ্ভিদ বিজ্ঞানী, যিনি বছর চারেক আগে আমেরিকায় ভিজিটিং প্রোফেসর হয়ে গিয়ে হঠাৎ মারা যান হার্ট অ্যাটাকে?

হ্যাঁ। ওঁর অকালমৃত্যুতে দেশের মস্ত ক্ষতি হয়েছে। ডক্টর তালুকদারের সাবজেক্ট ছিল মানুষের খাদ্যশস্য ও ফলমূলের নানান ক্ষতিকারক রোগের কারণ অনুসন্ধান এবং তাদের প্রতিরোধ করার উপায় আবিষ্কার। এই মানুষের কাছে যে অনেক দিন কাজ করেছে সে এসব রোগ সম্বন্ধে অনেক কিছু জানে বলেই আমার ধারণা।

সুরভি নার্সারির রূপ এর মধ্যে বিশেষ পালটায়নি। শুধু দেখা গেল প্রধান বাড়ি। দরজা-জানালা সব বন্ধ।

মামাবাবুর সঙ্গে সুনন্দ ও অসিত নার্সারির গেট খুলে ঢুকতে চেনা সেই মালিটি এগিয়ে এল।

তপনবাবু আছে? জিজ্ঞেস করল সুনন্দ।

আজ্ঞে না। বাইরে গেছেন।

কোথায়?

আজ্ঞে জানি না।

থমকে গেল তিনজনে। এ-সম্ভাবনা কারো মনে জাগেনি। অসিত প্রশ্ন করল–কবে ফিরবেন?

তা জানি না হুজুর।

মামাবাবুর মুখের দিকে তাকাল ওরা, এবার কী করা?

মামাবাবু মালিকে প্রশ্ন করলেন, তোমার কাছে চাবি আছে বাড়ির?

মালি একটু ইতস্তত করে বলল–আছে।

শোনো আমরা এই বাড়ির ভিতরটা দেখতে চাই।

ভয়মাখা চোখে মালি বলল, “আজ্ঞে, হুকুম নেই। বাবু বকবেন।

কোন্ বাবু?

বাসু সাহেব।

ও, বাসু সাহেবের সঙ্গে বুঝি গেছে তপনবাবু?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

তোমার নাম কী?

আজ্ঞে, বলরাম।

কদ্দিন আছ এখানে?

আজ্ঞে তিন বছর। নার্সারি খোলর গোড়া থেকে।

বাড়িতে আর কেউ আছে?

না। রাঁধুনি আর ধ্রুব মালি বাড়ি গেছে।

মামাবাবু বেশ অন্তরঙ্গ সুরে বললেন, শোনো বলরাম, আমি খবর পেয়েছি এই নার্সারি বিক্রি করে দেওয়া হবে। আমি নার্সারিটা কিনব ভাবছি। ঘরগুলো একটু দেখতে চাই। নইলে বুঝব কী করে কত দরে পোষাবে। অনেক দূর থেকে এসেছি। এজন্যে বারবার আসা অসুবিধে। তুমি একটু ইচ্ছে করলেই কাজটা আজ চুকে যায়। ভয় নেই বাসু সাহেব বা কেউ জানতে পারবে না একথা। এই নাও রাখো এটা, ছেলেদের মিষ্টি কিনে দিও। মামাবার মানিব্যাগ থেকে একখানা পাঁচ টাকার নোট বের করে বলরামের নাকের সামনে ধরলেন।

বলরামের সসেমিরা অবস্থা। তক্ষুনি হাত বাড়াল বটে, কিন্তু লোভী জুলজুল চোখে দেখতে লাগল।

মামাবাব উৎসাহ দিলেন, “আরে কোনো ভয় নেই। তুমি আমাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। একটিবার ঘুরে দেখে নেব। কোনো জিনিস নেব না। হ্যাঁ, নার্সারি যদি কিনি তোমাকে আমার চাই। তোমার মতো পাকা লোককে ছাড়ছি না। মাইনে এখন যা পাও তাতেই হবে তো? ঠিক আছে, তখন দেখা যাবে।

ব্যস ওতেই কেল্লা ফতে। বলরাম একগাল হেসে ঘাড় নাড়ল এবং নোটটি টেনে ট্যাঁকে গুঁজে বলল, আসুন বাবু।

বাড়িতে নিচের তলা সুনন্দরা আগে যেমন দেখে গিয়েছিল তেমনি রয়েছে—গুদাম, অফিস, বীজ পরীক্ষার সামান্য আয়োজন।

দোতলার সিঁড়ির মুখে তপনের শোওয়ার ঘর। তক্তপোশ খালি। কোনো বাক্স-প্যাঁটরা বা বিছানার চিহ্ন নেই। কেবল বুকসেলফে কতকগুলো ইংরেজি-বাংলা বই ও পত্রিকা। প্রায় সবই কৃষি বা রসায়ন বিদ্যার।

দ্বিতীয় ঘরে ঢুকে তিনজনে থ।

এ যে পুরোদস্তুর ল্যাবরেটরি!

বেশ বড় ঘর। দুধারে লম্বা টেবিল-লাগোয়া র‍্যাক। টেবিলে গ্যাসবার্নার। টেবিল ও র‍্যাকে রকমারি মাপের শিশি-বোতল, টেস্টটিউব, বিকার, বকযন্ত্র প্রভৃতি গবেষণার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। কাঁচ বা প্লাস্টিকের পাত্রে নানা রঙের চূর্ণ তরল পদার্থ, শস্যদানা, শুকনো পাতা ইত্যাদি। কোনোটা বা খালি। তবে বোঝা যায় এই গবেষণাগার গত কিছুদিন যাবৎ ব্যবহার করা হয়নি। কেমন এলোমেলোভাবে ছড়ানো জিনিসগুলো। ধুলো জমেছে। কয়েকখানা কাঁচের স্লাইড রয়েছে টেবিলে, কিন্তু মাইক্রোস্কোপ নেই। বড় আলমারি রয়েছে। দেওয়ালের গায়ে। তাতে নিচের তাকে কয়েকটা খালি শিশি। ওপরের তাক সব ফাঁকা।

মামাবাবু টেবিল থেকে একটা শিশি তুলে নিলেন। বঙ্কিমবাবুর কাছে যে শিশিটা পাওয়া গিয়েছিল অবিকল সেরকম। আরও চার-পাঁচটা শিশি রয়েছে। অসিত তাকাল সুনন্দর। পানে। চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দিল–যে বৈজ্ঞানিকের খোঁজে তাদের অ্যাডভেঞ্চার শুরু, এতদিনে বুঝি তার হদিস মিলল। কিন্তু এত লুকোচুরির কারণ কী?

সুরভি নার্সারির বাড়িঘর বাগান ইত্যাদি ঘুরে দেখে ঘণ্টাখানেক পরে সকলে বিদায় নিলেন।

ট্রেনে মামাবাবু প্রায় কথাই বললেন না। কপালে চিন্তার ভাঁজ। সুনন্দরা তাকে কোনো প্রশ্ন করতে সাহস পেল না। এরকম মুডে থাকলে মামাবাবু কথাবার্তা পছন্দ করেন না। হাওড়া স্টেশনে যখন পৌঁছাল তখন বিকেল প্রায় তিনটে।

ট্রেন থেকে নেমেই মামাবাবু বললেন, পানিহাটি চলো। বঙ্কিমবাবুর সেই বাগানবাড়ি।

এখনই?

হুঁ। সময় নষ্ট করা চলবে না। অলরেডি লেট।

মামাবাবর স্বভাব এমনি। একবার ঝোঁক চাপলে নাওয়া-খাওয়া চুলোয় যায়। সুনন্দ অসিতও উত্তেজিত। টুকরো টুকরো ঘটনাগুলি ক্রমে যেন একটি সূত্রে বাঁধা পড়ছে। ঘটনাপ্রবাহ ছুটে চলেছে কোন রহস্যময় পরিণতির দিকে, কে জানে?

পানিহাটির বাগানবাড়ি আগের মতোই নিস্তব্ধ। গেট খুলে ভিতরে ঢুকল তিনজনে। সুনন্দ অসিত লক্ষ করল গেট থেকে বাড়ি অবধি পথ চেঁছে পরিষ্কার করা হয়েছে। বাগানও আগের তুলনায় ছিমছাম। বঙ্কিম হাজরা কি বাড়ি আছেন? থাকার কথা নয়। কলকাতার বাইরে গেছেন। তাহলে, এখানে কী করতে এসেছেন মামাবাবু?

সদর দরজার কাছাকাছি পৌঁছে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে কারো দেখা পাবার আশায়। গেট খোলার শব্দ হল। এক ভদ্রলোক ঢুকলেন বাড়িতে। সন্দিগ্ধ চোখে দেখতে লাগলেন তাদের। লম্বা শুটকো, টাক মাথা, নাকের ডগায় চশমা-ঝোলা এক বৃদ্ধ। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। হাতে শৌখিন লাঠি।

কী চাই? তীক্ষ্ম সুরে প্রশ্ন করলেন তিনি।

নমস্কার। বঙ্কিমবাবু আছেন? মানে শ্রীবঙ্কিম হাজরা। বললেন মামাবাবু।

এখানে কোনো হাজরা-ফাজরা থাকে না। আমি থাকি। আমার নাম শ্রীদোলগোবিন্দ ঢোল।

ও। কিন্তু তিনি ছিলেন আগে। আমরা এসেছি একবার,বলল সুনন্দ।

হতে পারে। কত লোকই তো ছিল এখানে। একশো বছরের বাড়ি। আমি ছ-মাস হল ভাড়া নিইচি।

বঙ্কিমবাবু কোথায় থাকেন জানেন? জিজ্ঞেস করলেন মামাবাবু।

“আজ্ঞে না।

“আচ্ছা সেই পুরনো মালি আছে? সে হয়তো বলতে পারে।

ও, সেই আপিংখোর বুড়ো। তাকে ছাড়িয়ে দিইচি। বলল, পুরনো লোক তাই রেখেছিলাম গোড়ায়। দেখি, বেটা অকম্মার টেকি। কেবল বসে বসে ঝিমোয়। ওকে কী কত্তে যে পুষেছিল মাইনে দিয়ে?

অগত্যা তিনজনে ফিরে চলল।

দোলগোবিন্দ অতি অভদ্র। গেট অবধি পৌঁছে তো দিলই না, বরং পেছন থেকে খনখনে গলায় হেঁকে বলল, “ও মশাই, গেটটা বন্ধ করে যাবেন। নইলে গরু-ছাগল ঢুকবে।

ট্যাক্সিতে মামাবাবু চোখ বুজে চুপচাপ বসে রইলেন। একবার কেবল বলে উঠলেন, বুঝলে হে, তিনটে শয়তান ক্রিমিনাল। একসঙ্গে চক্রান্ত করেছে। অথচ বাইরে থেকে তাদের প্রায় যোগাযোগই নেই। কাউকে ধরাছোঁয়া যাবে না। চমৎকার প্ল্যান।

মামাবাবু দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করলেন, “বেশ দেখা যাক, কদুর দৌড়। যেন তিনি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন ওই তিনজনের উদ্দেশে।