☼ অজেয় রায় ☼
মিস্টার বাসুর ফরমুলা
তিন
আফ্রিকা সফর সেরে হইহই করে উপস্থিত হলেন স্যার ডেভিড ডানকান। ডানকান গিয়েছিলেন মধ্য আফ্রিকার কঙ্গো নদীর অববাহিকায় অতি দুর্গম অরণ্য অঞ্চলে—ওকাপি নামে এক দুর্লভ প্রাণী দর্শনের আশায়। ওকাপি জিরাফের জ্ঞাতি। ১৯০০ সালে এই জন্তুটি প্রথম আবিষ্কার হয়। বন্য ওকাপির স্বভাবের বৈচিত্র্য আজও জানা যায়নি। তার কারণ শুদ্ধ গভীর জঙ্গল, অল্প সংখ্যা বা তাদের লাজুক স্বভাব নয়–ওই একই জঙ্গলে বাস করে বর্বর পিগমি বা বামন জাতি। তাদের বিষাক্ত তিরকে সবাই ডরায়।
স্যার ডেভিড লুকিয়ে ওকাপির ছবি তুলেছেন, পিগমিদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে তাদের সাথে নাচ-গান করেছেন এবং নিতান্ত উপস্থিতবুদ্ধির জোরে চিতাবাঘের কবল থেকে প্রাণে বেঁচে গেছেন। গোটা সন্ধে সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনল তাঁর গল্প।
পরদিন খুব ভোরে হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে রওনা হল পাঁচজন—মামাবাবু, ডানকান, সুনন্দ, অসিত এবং বঙ্কিম হাজরা। তিনি ঠিক ম্যানেজ করে ঢুকে পড়েছেন দলে। বীরভূমে যে ঝিল দেখতে যাওয়া হচ্ছে, শীতকালে সেখানে প্রচুর যাযাবর হাঁস নামে। ডানকানের ইচ্ছে পশ্চিমবাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করবেন, সঙ্গে খানিক বার্ডওয়াচিং হলে তো সোনায় সোহাগা।
এই ঝিলে আগে কয়েকবার গেছেন মামাবাবু। উন্মুক্ত প্রান্তরের মধ্যে জলাভূমি। কিছুদুর দিয়ে বইছে সরু পাহাড়ি নদী কোপাই। ঝিলের কাছে একটি মাত্র গ্রাম বৈকুণ্ঠপুর। গ্রামের লোকরা বৈষ্ণব, তারা ঝিলের পাখি মারে না, বাইরের কাউকেও মারতে দেয় না। অতএব ঝিলের জলে এবং আশেপাশে পাখিরা নির্ভয়ে চরে।
বোলপুর স্টেশনে সকাল এগারোটা নাগাদ ট্রেন থেকে নামল পাঁচজনে।
বৈকুণ্ঠপুরের শ্রীমন্ত বৈরাগী মামাবাবুদের অভ্যর্থনা জানাতে এসেছিল স্টেশনে। শ্ৰীমন্ত মামাবাবুর পুরনো পরিচিত। বছর চল্লিশ বয়স। ভারি বিনয়ী। সর্বদা মুখে মিষ্টি হাসি লেগে রয়েছে। মামাবাবুর সঙ্গে ঘুরে বার্ডওয়াচিং সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা আছে শ্ৰীমন্তর।
তিনটে সাইকেল রিকশা ভাড়া করা হল। শ্ৰীমন্ত চলল বাইসাইকেলে। মাইল দুই যাবার পর রাস্তা খারাপ হয়ে উঠল। এই মেঠো রাস্তায় রিকশা চলে না–গরুর গাড়ি চলে। শুধু মালপত্র নিয়ে রিকশা চালকরা চলল গাড়ি ঠেলে ঠেলে।
শীতের রোদ্দুরে হাঁটতে কষ্ট নেই। গল্প করতে করতে এগোল সবাই। দুপাশে বিস্তীর্ণ ক্ষেতি জমি। বর্ষাকালে সারা মাঠে ধান চাষ হয়। শীতে অবশ্য অনেক জমি খালি পড়ে আছে। তবে যে জায়গায় জলসেচের সুবিধে আছে সেখানে টুকরো টুকরো জমিতে চাষ হয়েছে। কোথাও ধান কোথাও বা গম।
পথের ধারে এক ছোট্ট গ্রাম পড়ল। বট অশ্বত্থ আম জাম তেঁতুল গাছে ছায়াচ্ছন্ন। ঝুপড়ি চায়ের দোকানও রয়েছে একটা। একটু বিশ্রাম নেওয়া যাক। চায়ের অর্ডার দিয়ে দোকানের বাইরে বেঞ্চে বসল সবাই। রিকশাওলারাও রিকশা রেখে এসে দোকানের পাশে ঘাসে বলে পড়ল।
দেখতে দেখতে ছোটখাটো এক ভিড় জমে গেল মামাবাবর পার্টিকে ঘিরে। ছোট ছেলেমেয়ে, অকর্মা লোক তো আছেই–যারা কাজে যাচ্ছিল তারাও হাঁ করে দাঁড়িয়ে গেল। রিকশাওলা ও শ্ৰীমন্তকে হাজারো প্রশ্ন করতে লাগল আগন্তুকদের সম্বন্ধে। ডানকান সাহেবই তাদের প্রধান আকর্ষণ। সাহেব নিজে কিন্তু বিন্দুমাত্র অস্বস্তি বোধ করলেন না। বললেন–এ আমার অভ্যেস আছে। অচেনা জায়গায় এমনও হয়েছে যে কয়েকশো লোক গা ঘেঁষে বসে আমায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লক্ষ্য করেছে। শোওয়ার সময় অবধি রেহাই দেয়নি। আবার গায়ে আঙুল ঘষে যাচাই করে দেখছে রংটা আসল না নকল। একবার হয়েছিল কী জানো? ইস্টার্ন তুর্কিস্থানে গোবি মরুভূমির প্রান্তে মঙ্গোলিয়ানদের এক গ্রামে সন্ধের ঠিক আগে পৌঁছলাম আমি আর তেহেরান ইউনিভার্সিটির আর্কিওলজির প্রোফেসর ডক্টর বেন গাজি–
গেল গেল, নিয়ে গেল। ধর ধর! হেট হেট–ইত্যাদি বহু কণ্ঠের উত্তেজনাময় বাক্যস্রোতে ডানকানের গল্পে অকালে ছেদ পড়ল।
সচকিত হয়ে দেখল সবাই একপাল ছোট ছেলে তারস্বরে চেঁচাতে চেঁচাতে একদিকে ছুটে গেল। তারা ঘাড় তুলে কাছে এক বিরাট তেঁতুল গাছের ডালে তাকিয়ে দেখছে, উত্তেজিতভাবে অঙ্গভঙ্গি করছে এবং ঢিল ছুঁড়ছে ওপরে।
তাদের উত্তেজনার কারণ প্রথমে ধরা গেল না।
তারপরই শ্ৰীমন্ত লাফ দিয়ে উঠে ছুটল গাছের দিকে–হেই বাবা, সব্বনাশ হয়ে গেল।
মামাবাবুরাও হাজির হলেন গাছের নিচে। ব্যাপার বুঝে সবার চক্ষুস্থির।
এক মস্ত লালমুখো বাঁদর গাছের উঁচু ডালে গ্যাট হয়ে বসে আছে। তার হাতে একটা ক্যাম্বিসের ব্যাগ। ব্যাগের মালিক-বঙ্কিমবাবু।
বাঁদরটা ব্যাগের স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে ফেলেছে। এবং হাটকে হাটকে ব্যাগের ভিতরকার জিনিস বের করে প্রত্যেকটি চোখের সামনে একবার ঘুরিয়ে দেখে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। বোঝা গেল খাদ্যদ্রব্য ভিন্ন অন্য কিছুতে তার রুচি নেই।
বঙ্কিমবাবু তো এই দৃশ্য দেখে বিকট আর্তনাদ করে নৃত্য জুড়ে দিলেন।
গ্রামের একজন বলল, ভারি শয়তান বাঁদর, বাবু। কী উৎপাত যে করছে! একজন এনেছিল পুষবে বলে। বাগ মানেনি। বুনো হয়ে গেছে।
ধপ! এবার ব্যাগটা পড়ল মাটিতে। বাঁদরটা কী জানি চিবুচ্ছে। বঙ্কিমবাবু জানালেন– নিশ্চয় পিপারমেন্ট। ছিল এক বাক্স।
বঙ্কিমবাবু পাগলের মতো ঘুরে ঘুরে তাঁর ফেলে দেওয়া জিনিস উদ্ধার করতে লাগলেন। সুনন্দ, অসিত, মামাবাবু, ডানকান সাহেব–আর গ্রামসুন্ধু লোক তাকে সাহায্য করতে লেগে গেল। যাহোক আধঘণ্টার মধ্যে হারানো জিনিস প্রায় সবই উদ্ধার হল। অবশেষে ফের রওনা দিল তারা।
বৈকুণ্ঠপুরের ঝিল সত্যি অপূর্ব।
অন্তত আধ মাইল লম্বা, হাত পঞ্চাশ চওড়া জলাশয়। চারিধারে উঁচু পারে তালগাছের সারি এবং শর ঝোঁপ। তীরের কাছে অগভীর জলে কিছু নলখাগড়া ও আগাছা জন্মেছে। ঝিলের তিন পাশে চাষের ক্ষেত। একপাশে উঁচু-নিচু লালচে রুক্ষ খোয়াই। খোয়াইয়ের পথে মাইল দেড় গেলে কোপাই নদী। ঝিলের পশ্চিম দিকে প্রায় দুশো গজ দূরে বৈকুণ্ঠপুর।
শীতের দুপুরে গাঢ় নীল জলে ছোট ছোট ঢেউ উঠছে। আর জলের বুকে মনের আনন্দে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে অসংখ্য হাঁস। শুধু হাঁস নয়, আরও অনেক রকম পাখি–কেউ ভাসছে জলে, কেউ চরছে পারের কাছে ডাঙায়। কেউ ডানা মেলে উড়ছে আকাশে। এতগুলো মানুষের আগমনে তারা বিন্দুমাত্র বিচলিত হল না। বোঝা গেল এরা মানুষকে ভয় করে না।
ডানকান তো দৃশ্য দেখে মুগ্ধ।
মামাবাবু, ডানকান এবং বঙ্কিম হাজরা চোখে দূরবিন লাগালেন পাখি দেখতে।
সুনন্দ অসিত, শ্ৰীমন্ত ও আরও কয়েকজন বৈকুণ্ঠপুরবাসীর সহায়তায় তিনটে তাঁবু খাঁটিয়ে ফেলল ঝিলের কাছে। গ্রামের লোক তাদের রাতে থাকার জায়গা দিতে চেয়েছিল কিন্তু মামাবাবু ও ডানকান এমন খাসা জায়গাটি ছেড়ে বদ্ধ ঘরে ঘুমোতে রাজি হলেন না। ডানকান হেসে বললেন, বুঝলে ব্রাদার, সত্যি বলতে কি ক্যাম্পে শুতে আমি নিজের বেডরুমের চেয়েও আরাম পাই। অভ্যেস!
বৈকুণ্ঠপুরের ঝিলে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় রয়েছে পিনটেল বা সূচ্যগ্রপুচ্ছ হাঁস। জলের মধ্যিখানটা তাদের দখলে। এরা যাযাবর। উত্তর এশিয়া ও ইউরোপ থেকে শীতকালে এদেশে আসে। বেশ বড় হাঁস।
ঝিলে আর এক জাতের হাঁস ছিল—নাক্টা। আকারে পিনটেলের চেয়েও বড়। নাকটা যাযাবর নয়। এখানে স্থায়ীভাবে বাস করে।
হাঁস ছাড়াও জলে সাঁতার কাটছিল কিছু পানকৌড়ি। তীরে গাছের ডালে বা মাটিতে বসেছিল কয়েকটি ধ্যানমগ্ন বক। থেকে থেকে জলে ছোঁ মারছিল মাছরাঙা। দূরে খোলা মাঠের আকাশে প্রকাণ্ড ডানা মেলে উড়ছিল শামুকখোল।
দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে আসা হয়েছিল স্টেশনে। এক রাউন্ড কফি খেয়ে সবাই চলল নদী দেখতে।
অগভীর ক্ষীণকায়া স্রোতস্বিনী। টলমলে জলে হাঁটু অবধি ডোবে না। তবে বর্ষায় নাকি এই নদীতেই বান ডাকেকূল ছাপিয়ে যায় জল। নদীতটে ঝোঁপ-ঝাড়, হালকা জঙ্গল। ভারি নির্জন। এই জায়গা নানা জাতের পাখির আদর্শ বিহারভূমি।
মামাবাবু উত্তেজিতভাবে ডানকানকে খোঁচা মারলেন ওই দেখুন একজোড়া ব্রাহ্মণী হাঁস।
অ্যাঁ, হাঁসেরও বামুন কায়েত আছে? আশ্চর্য হয়ে বললেন বঙ্কিমবাবু।
“না না, সে ব্রাহ্মণী নয়, হাঁসের নাম। চলতি বাংলায় যাদের বলি চকাচকী। বললেন মামাবাব। এরাও যাযাবর হাঁস। তুর্কিস্থান সিকিম তিব্বত ইত্যাদি দেশ থেকে আসে। সর্বদা জোড়ায় জোড়ায় ঘোরে।
মামাবাবু গ্রামের লোকের সাহায্যে ঝিল ও নদীর তীরে কয়েকটা পাখি ধরার ফাঁদ পাতলেন। পাখি ধরে তাদের পায়ে রিং পরানো হবে। রিং বের করে দেখালেন তিনি। ছোট ছোট অ্যালুমিনিয়ামের বলয়। তাতে পাঞ্চ করে খুদে খুদে অক্ষরে ছেপে দেওয়া হয়–রিং পরানোর তারিখ, কে পরাচ্ছে, কোথায়, পাখির ওজন কত ইত্যাদি তথ্য। বিশেষ করে যাযাবর পাখিদের জানতে এই রিং পরানোর প্রয়োজন খুব বেশি।
শীতের শেষে যাযাবর পাখির দল আবার নিজের দেশে ফিরে যাবে। হয়তো দূর দেশে এখানের রিং পরানো কোনো পাখিকে জীবিত বা মৃত অবস্থায় পাওয়া যাবে। পক্ষিবিশারদরা তখন ওর পায়ের রিং দেখে জানতে পারবেন পাখিটা কত দূরে গিয়েছিল, কবে, ইত্যাদি খবর।
দিনান্তের অস্পষ্ট আলো যখন যাই-যাই করছে, আকাশের পশ্চিমপ্রান্ত অস্তগামী সর্যকিরণের আভায় রাঙা হয়ে উঠেছে, তখন দেখা গেল এক আশ্চর্য দৃশ্য। পিনটেলরা ঝাঁকে ঝাকে উড়তে আরম্ভ করল জল ছেড়ে। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে প্রথমে ঝিলের ওপরে কয়েক পাক ঘুরে তারা উঠে গেল বহু উঁচুতে। তারপর তীরবেগে অদৃশ্য হল দৃষ্টির সীমানা ছাড়িয়ে। তাদের ডানায় শনশন আওয়াজ হচ্ছিল যেন ঝড়ের বাতাস। নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে তারা এখন চরতে চলল–দূরে খাল-বিল-শস্যক্ষেতে। কারণ রাতের আঁধারে শিকারীর দৌরাত্ম্য নেই। আবার ওরা বৈকুণ্ঠপুরের ঝিলে ফিরবে খুব ভোরে। সূর্যের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে। এই ওদের দৈনিক রুটিন।
সকালে আবিষ্কার হল ঝিলের পাশে ফাঁদে পাঁচটি পাখি বন্দী হয়েছে। তাদের মধ্যে তিনটি যাযাবর পিন্টেল। সাবধানে বের করা হল পাখিগুলোকে। যাযাবর পাখিগুলোর পায়ে রিং পরিয়ে দিলেন মামাবাবু। সুনন্দ অসিত বঙ্কিমবাবু ছাড়াও গ্রামের অনেক লোক গভীর আগ্রহে দেখল তার কাজ। ডানকান তখন নিজের মনে ফোটো তুলতে ব্যস্ত।
ঘণ্টাখানেক পরে এক ব্যাপার দেখে সুনন্দরা হেসে অস্থির।–গ্রামের একটি লোক দুটো পায়রা এনে দিল বঙ্কিমবাবুকে। স্রেফ গোলা পায়রা। যারা গেরস্ত-বাড়ির ঘুলঘুলিতে বাস করে, কাছাকাছি মাঠে-ময়দানে চরে বেড়ায়। বঙ্কিমবাবু লোকটির হাতে একখানা নোট গুঁজে দিলেন। তারপর চুপিচুপি পায়রা দুটো থলিতে ভরলেন।
অসিত হেঁকে বলল, “কী হাজরা মশাই, রোস্ট খাবেন নাকি?
বঙ্কিমবাবু জিভ কাটলেন। আরে ছি ছি। বৈকুণ্ঠপুরে পক্ষিবধ! গ্রামের লোক মনে করবে কী? এই পায়রা দুটোকে আমি রিং পরাব। মানে প্র্যাকটিস করব।
মামাবাবু হেসে বললেন, আপনার রিং পরানোর ইচ্ছে আছে বলেননি কেন? দুটো হাঁস তো এমনি ছেড়ে দিলাম। সেগুলোকে পরাতে পারতেন।
লাজুক হেসে বঙ্কিমবাবু বললেন, ঠিক আছে। আগে একটু প্র্যাকটিস করে নিই; নিজের হাতে পরিয়ে দেখাব আপনাকে। পায়রা দুটো নিয়ে বঙ্কিমবাবু খোয়াইয়ের ঢালে নেমে অদৃশ্য হলেন।
প্রথম পায়রাটির পায়ে পরানো অ্যালুমিনিয়াম বলয় পরীক্ষা করে মামাবাবু বঙ্কিমবাবুকে সার্টিফিকেট দিলেন–গুড! কেবল আর একটু টাইট হবে। হ্যাঁ, পয়সা দিয়ে পায়রা কেনার দরকার নেই। আপনি বরং নদীর তীরে চলে যান। শ্ৰীমন্ত বলেছে, একজোড়া বালি-তিতির পড়েছে ফাঁদে। ওরা অবশ্য যাযাবর নয়, তবু ওদের ওপর হাত পাকাতে পারেন। রিং পরিয়ে ছেড়ে দেবেন। বঙ্কিমবাবু বেজায় খুশি হয়ে চলে গেলেন।
সুনন্দ দুপুরের খাওয়ার আয়োজন শুরু করল। সে রান্নায় ভারি পটু। অসিতকে বলল, ভানকান বাঙালি রান্না খাবে। খিচুড়ি, ডিম ভাজা, আলুর দম বানাচ্ছি।
সুনন্দকে ব্যস্ত দেখে অসিত বলল, একটু ঘুরে আসি।
মামাবাবু তখন ঝিলের ধারে চোখে দুরবিন লাগিয়ে বসে আছেন। ডানকান গ্রামে গেছেন একটা প্রাচীন মন্দির দেখতে।
অসিত যখন ফিরে এল, সুনন্দর রন্ধনপর্ব সমাপ্ত।
সুনন্দকে ফিসফিস করে বলল অসিত–হ্যাঁরে ভক্ত বঙ্কিমের মাথার গোলমাল নেই
সুনন্দ অবাক।–কই, মনে তো হয় না। কেন?
অসিত একটু চুপ করে থেকে বলল–আমার মনে হয় আছে।
হঠাৎ?
একটা উদ্ভট ব্যাপার দেখলাম, তাই।
নদী পেরিয়ে ওপারে গেলাম। খানিক ঘুরে বায়নোকুলার দিয়ে দেখলাম চারধার। তারপর গাছের ছায়ায় শুয়ে পড়লাম চিৎপটাং হয়ে। একটু বাদে পাশ ফিরেছি, চোখে পড়ল নদীর উল্টো তীরে ঝোঁপের আড়ালে বসে বঙ্কিমবাবু। তিনি–
হ্যাল্লো দেয়ার! ডানকানের গমগমে গলা শুনে দুজনে চমকে উঠল। ডানকান সাহেব পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন হাসি মুখে। এক কাপ কফি খাওয়াবে?
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই-সুনন্দ তৎপর হয়ে ওঠে। ডানকান জুৎ করে বসলেন সামনের মোটা গাছের শিকড়ের ওপর। বোঝা গেল শুধু কফির তেষ্টা নয়, তার কিঞ্চিৎ আড্ডা দেওয়ার বাসনা জেগেছে।
জানো, খাবার-দাবার নিয়ে আমার কোনো বাছবিচার নেই। শুধু এই কফির ওপর একটু যা দুর্বলতা। এই যে ইচ্ছে করলেই কফি খেতে পাচ্ছি, এ যে কত বড় সৌভাগ্য সে তোমরা বুঝবে না। আমিও বুঝিনি আগে। প্রথম টের পেলাম উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার জঙ্গলে পথ। হারিয়ে ঘুরতে ঘুরতে। তখন কেবল গরম কফিতে চুমুক দেওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। নৌকাডুবি হয়ে আমার কফির প্যাকেট গেল ভেসে। তারপর পাক্কা চল্লিশ দিন কফি খেতে পাইনি।
ওখানে গিয়েছিলেন কেন? প্রশ্নটা দুজনের।
নাইজার নদীর গতিপথ আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে। বড্ড ভুগিয়েছিল সেবার।
কী-কীরকম?
স্যার ডেভিড কফিতে চুমুক দিতে দিতে তার অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনি আরম্ভ করলেন। রুদ্ধশ্বাসে শোনে দুই বন্ধু। বঙ্কিমবাবুর অদ্ভুত আচরণের কথা আপাতত মুছে গেল তাদের। মন থেকে। কথাটা অবশ্য সুন্দর মনে পড়েছিল–তবে অনেক–অনেক পরে।
সেই রাতে কলকাতার বাসায় ফিরে, শুতে যাওয়ার আগে সুনন্দর মনে পড়ল–তাই তো, হরিধনের খবর পাওয়া গেছে কি? আর বঙ্কিমবাবু সম্বন্ধে কী একটা রহস্যময় ঘটনা বলতে যাচ্ছিল অসিত? কিন্তু রাত সাড়ে এগারোটার সময় কাউকে বিরক্ত করা উচিত নয়। পরদিন সুনন্দ কুণাল ও অসিতকে টেলিফোন করল।
কুণাল জানাল–হ্যাঁ, ফিরেছে হরিধন। খুব বেঁচে গেছে। আমি এখুনি আসছি তোর কাছে।
অসিত বলল–সত্যি, বঙ্কিমবাবুর ব্যাপারটা ভুলেই গেসলাম। অদ্ভুত লোক।আম কিছু মাথামুণ্ডু বুঝলাম না। ফোনে বলা যাবে না সব গুছিয়ে। আমি যাচ্ছি। তবে একটু লাল হবে। কাজ আছে বাড়িতে।