☼ অজেয় রায় ☼
মিস্টার বাসুর ফরমুলা
দুই
পুরো একটা বছর কেটে গেছে। মিস্টার বাসুর দেওয়া ফরমুলার প্রকৃত আবিষ্কারক কে এ-রহস্যের সমাধান আজও হয়নি। কিন্তু ফরমুলাটির ভাগ্যে কী ঘটেছিল সে খবর জোগাড় করেছিল কুণাল।
মিস্টার বাসুর পেছনে ধাওয়া করে পানিহাটি যাওয়ার মাস দুই পরে একদিন সে অসিতকে ফোন করে প্রশ্ন করে–অসিত, মনে আছে মিস্টার বাসুর ফরমুলা?
হা হা, কী হল সেটার?।
সেটা কে কিনেছে জানিস? ভারত কেমিক্যালস লিমিটেড, পাক্কা কুড়ি হাজার টাকায়। বড় ফার্ম তো, তাই টাকার জোর বেশি। সেই ফরমুলায় তৈরি ওষুধই এখন এফ ফোরটিন নামে বাজারে বেরিয়েছে। দারুণ কাটতি হয়েছে। আচ্ছা, হাজরাবাবুর কাছে কোনো খোঁজ পেলি মিস্টার বাসুর?
বঙ্কিম হাজরা মামাবাবুর কাছে আসেন বটে কিন্তু সুনন্দ বা অসিতকে একটু এড়িয়ে চলেন।
তবু একদিন তিনি এলে সুনন্দ তাকে ধরেছিল। এই যে বঙ্কিমবাবু, কেমন আছেন?
বঙ্কিমবাবু বিগলিত হেসে বললেন, এই কাটছে কোনো রকমে ঠাকুরের কৃপায়। প্রোফেসর ঘোষ বাড়ি আছেন?
হা আছেন। ওপরে যান। আচ্ছা, সেই মিস্টার বাসু আর এসেছিলেন আপনার কাছে?
না। আর আসেনি। কেন বলুন তো?
মানে ওনার ঠিকানাটা, আমার সেই বন্ধুর জন্যে…
ওহো, মনে পড়েছে। দেখা হলে নিশ্চয় চাইব।
বঙ্কিমবাবু এ বিষয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য করেন না। হয়তো আর দেখা হয়নি মিস্টার বাসুর সঙ্গে।
জানুয়ারির শেষে মামাবাবু রাজস্থান গেলেন। ভরতপুরে কেওলাদেওখানা নামে এক পক্ষিনিবাস দেখতে। বঙ্কিমবাবুও মামাবাবুর সঙ্গ নিলেন। রাজস্থান থেকে পঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লি বেড়িয়ে কুড়ি-পঁচিশ দিন পরে ফিরলেন দুজনে। বঙ্কিমবাবুর উৎসাহেই এই বাড়তি বেড়ানোটুকু। মামাবাবু ফিরতেই আবার পক্ষিবিদদের আনাগোনা শুরু হল। মামাবাররা কী কী পাখি দেখেছেন তাই নিয়ে মহা উৎসাহে আলোচনা চলল।
মামাবাবু পক্ষিবিদদের আলোচনাসভায় সুনন্দ অসিতকে ডাকতেন না। মানে যোগ দেবার জন্যে জোর করতেন না। তবে একদিন সুনন্দকে ডেকে বললেন, কাল সন্ধেবেলা থেকো বাড়িতে। বিখ্যাত এক্সপ্লোরার স্যার ডেভিড ডানকান আসছেন। ওনার ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা শোনা যাবে। উনি ভোরে হংকং থেকে কলকাতা আসবেন আর পরদিনই চলে যাবেন আফ্রিকা। অসিতকেও আসতে বোলো।
স্যার ডেভিডের নামে সুনন্দ নেচে উঠল। এই দুর্ধর্ষ পর্যটক কত দেশ যে ঘুরেছেন তার ইয়ত্তা নেই। দুর্গম পাহাড়, বন, মরু, প্রান্তর চষে বেড়ানোই ওঁর নেশা। পক্ষিবিদ হিসেবে বেশি নামডাক থাকলেও নানান দেশের জীবজন্তু ফলমূল সম্বন্ধে ওঁর জ্ঞান অসাধারণ। স্যার ডেভিড নিউজিল্যান্ডার। নাইজার নদীর অববাহিকায় অনেক অজ্ঞাত অঞ্চল আবিষ্কারের সম্মানস্বরূপ তিনি স্যার উপাধি পেয়েছেন। স্যার ডেভিড নাকি অদ্ভুত ভালো গল্প বলেন। তার গল্পের বর্ণনায় অজানা দেশের ছবি চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ফুটে ওঠে। পাঁচ বছর আগে সুইডেনের স্টকহোমে প্রকৃতি-বিজ্ঞানীদের সম্মেলনে ডানকানের সঙ্গে মামাবারক বন্ধুত্ব হয়। সেদিনই দুপুরে কুণালের টেলিফোন এল।
আজ বিকেলে অসিতের বাড়ি চলে আয়, আমিও আসব। দরকারি কথা আছে।
কী ব্যাপার? সেই বাসু নাকি?
হ্যাঁ। আয় বিকেলে, বলব সব।
বিকেল নয়। সন্ধে ছটা নাগাদ কর।
কেন?
বিকেলে স্যার ডেভিডের লেকচার আছে আমাদের বাড়িতে। বিখ্যাত এক্সপ্লোরার। অসিতও আসবে শুনতে, তারপর যাব।
অল রাইট।
সুনন্দ উগ্রীব হয়ে উঠল। কী ব্যাপার? মিস্টার বাসুর কি খোঁজ পেয়েছে কুণাল? ফরমুলার প্রকৃত আবিষ্কারককে জানার সূত্র কি পেল কিছু? ডেভিডের লেকচার না থাকলে সে এখুনি ছুটে যেত কুণালের কাছে।
স্যার ডেভিড হাজির হলেন বিকেল চারটেয়। লম্বা পাতলা গড়নের মানুষটি। বয়স প্রায় ষাট ছুঁয়েছে, কিন্তু ইস্পাতের মতো দৃঢ়। যুবকের মতো চটপটে। হালকা লালচে দাড়ি, কপালে গালে অজস্ৰ ভাঁজ-বহু কষ্টকর দিন যাপনের সাক্ষ্য। ভীষণ আমুদে। হেঁড়ে গলায় যখন তখন হো-হো হাসিতে ফেটে পড়েন। লোকটির একটি বদভ্যাস–উচ্ছ্বাসের মাত্রা প্রবল হলে ফুর্তির চোটে কাছের লোকের পিঠ চাপড়ে দেন সজোরে। একবার সেই কড়া পড়া কঠিন হাতের চাপড় খেয়ে সুনন্দর কঁধ ঝনঝন করে উঠল। সে সভয়ে সরে বসল।
স্যার ডেভিড কথা বলছিলেন ইংরেজিতে।
গত দু-বছর তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বোর্নিও, জাভা, সুমাত্রা প্রভৃতি অঞ্চলে অরণ্যময় দ্বীপগুলিতে ঘুরেছেন। সেইসব অভিযানের গল্প শুরু করলেন–
ঘরে বঙ্কিমবাবুর মতো কয়েকজন পক্ষিবিদ উপস্থিত ছিলেন। তারা জানতে চাইলেন– ওইসব দেশে নতুন কোনো পাখি দেখেছেন কিনা স্যার ডেভিড।
হুঁ দেখেছি বৈকি। তাদের বর্ণনা নোট করা আছে। তারপর ডেভিড হাসতে হাসতে বললেন, গত বছর বোর্নিওর এক দুর্গম অঞ্চলে মাইগ্রেটারি বার্ড পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে যা বিপদে পড়েছিলাম!
কীরকম শুনি? সবাই উৎসুক আবেদন জানাল।
স্যার ডেভিড পাইপে লম্বা টান দিয়ে বলতে শুরু করলেন।
–খবরটা আমায় দেয় চিয়াং। সিঙ্গাপুরে চিয়াংয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলাম একজন পক্ষিবিদ। বিশেষত যাযাবর পাখি নিয়েই তার স্টাডি। চিয়াং বলল, উত্তর বোর্নিওর সারওয়াক অঞ্চলে কাপুয়াস শৈলশ্রেণির কোলে বনের মধ্যে এক গ্রামে যাচ্ছে সে। ছোট্ট প্রসঙ্গ গ্রাম। কেলাবিট উপজাতির বাস। কাছাকাছি লোকালয় নেই। গ্রামে আধুনিক সভ্যতার কোনো স্পর্শই লাগেনি। আদিম প্রথায় চাষবাস আর শিকার করে জীবনধারণ করে। কেউ লেখাপড়া জানে না, গুনতে পারে না, মাস বা বছরের হিসেবও জানে না। আবার জায়গাটা বিষুবরেখার খুব কাছাকাছি বলে সারা বছর আবহাওয়া গরম থাকে এবং বৃষ্টিপাত হয়। ফলে বিভিন্ন ঋতুর পার্থক্য বোঝা যায় না।
কেলাবিটদের প্রধান খাদ্য চাল। বন কেটে, ঝোঁপ-ঝাড় আগুনে পুড়িয়ে তারা ধানচাষের জমি তৈরি করে। কিন্তু ধান যখন তখন পোঁতা চলবে না। বছরের শেষের দিকে, অন্তত ডিসেম্বরের আগে পুঁততেই হবে। এই চাষের সময় ঠিক করতে তাদের প্রধান ভরসা কিছু যাযাবর পাখি। ওরাই তাদের ক্যালেন্ডার।
সেনসুলিট অর্থাৎ হলদে খঞ্জনের আবির্ভাব দিয়ে কেলাবিটদের বছর শুরু হয়। এই পাখিরা উত্তর চীন এবং সাইবেরিয়া থেকে বোর্নিও ইন্দোনেশিয়ায় শীত কাটাতে আসে। গ্রামে কেলাবিটরা তখন চাষের জন্য জোগাড় আরম্ভ করে।
এরপর আসে ব্রাউন ইক। মধ্য এশিয়া থেকে। গ্রামের লোক তখন ধান পোঁতা শুরু করে।
তারপর এক জাতের ছোট বাজপাখি জাপানি স্প্যারো হকদের পালা। এবং আরও কিছুদিন পরে ডিসেম্বর জানুয়ারি নাগাদ ছাইরঙা থ্রাশদের আগমন হয়। ব্যস, গ্রামের লোক ইতিমধ্যে ধান পোঁতা শেষ করে ফেলে।
ক্রমে ধানগাছ বড় হয়। ফসল কেটে নেওয়া হলে কেলাবিটরা ফের সেনসুলিটদের অপেক্ষায় থাকে।
আমি চিয়াংয়ের কাছে জানতে চাইলাম, ডিসেম্বরের মধ্যে ধান পুঁততে ওরা ব্যস্ত হয়। কেন? বৃষ্টিপাতের যখন তেমন হেরফের নেই। একটু দেরি হলেই বা ক্ষতি কী?
চিয়াং বলল, তারও কারণ এক জাতের যাযাবর পাখি–লম্বা লেজ মুনিয়া। ঠিক মার্চ মাসের গোড়ায় ঝুঁকে ঝাঁকে মুনিয়া এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষেতে। তার আগে ধান ঘরে তুলতে না পারলে একটি দানাও আর রক্ষা পাবে না।
চিয়াং বলল, আমি গত বছর গিয়েছিলাম ওই গ্রামে। খঞ্জনাদের আবির্ভাব দেখার পর চলে আসি। এবার অন্য পাখিগুলো দেখতে যাচ্ছি।
আমি তক্ষুনি চিয়াংয়ের সঙ্গে জুটে গেলাম।
দক্ষিণ চীন সমুদ্রতীরে কুচিং শহর থেকে রওনা হয়ে কিছুটা মোটরে চড়ে তারপর বাজার নদী বেয়ে শ-খানেক মাইল গেলাম সাম্পানে। এরপর নৌকো ছেড়ে পায়ে হেঁটে। তিনদিন হাঁটলাম গভীর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। ঠাসা ট্রপিকাল অরণ্য। বিরাট বিরাট আকাশ-ছোঁয়া গাছ আর বাঁশঝাড়। দিনের বেলাও মাথার ওপর ঘন পাতার আচ্ছাদন ভেদ করে সামান্য আলো তোকে। প্যাঁচপ্যাঁচে কাদা ও জলাভূমি। বিষাক্ত সরীসৃপ, পোকামাকড়, বনো শুয়োরের উৎপাত। আর এক ভয়, কখন হঠাৎ ওরাং ওটাংয়ের মুখোমুখি হব। উত্তর বোর্নিওর ঘন বনে এই বিশাল বানরদের বাস। এমনি লাজুক প্রকৃতির। কিন্তু বিরক্ত হলে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। ক্রমে সেই গ্রামে পৌঁছলাম। বড় অধিত্যকায় মাত্র চল্লিশটি পরিবারের বাস। তিন-চারটে লম্বা লম্বা খড়ে ছাওয়া বাঁশের ঘরে তারা সবাই মিলে থাকে।
গ্রামের ধারে তাঁবু ফেললাম। চিয়াংয়ের সঙ্গে গ্রামের লোকের আগেই পরিচয় হয়েছিল। ফলে গ্রাম থেকে চাল, ডিম, তরকারি ইত্যাদি খাবার কিনতে অসুবিধা হল না। তবে একটা ভয় ছিল সাপ। সাংঘাতিক বিষাক্ত একজাতীয় ভাইপারের উপদ্রব। প্রতি বছর দু-একজন গ্রামের লোক মারা পড়ে সাপের কামড়ে।
দিন দশ দিব্যি কাটল।
ব্রাউন-শ্রাইকরা আসতে আরম্ভ করেছে। প্রথমে অল্প অল্প। তারপরে দলে দলে। চড়ুইয়ের চেয়ে সামান্য বড় পাখি। পেট সাদা, ডানার রং খয়েরি। ঝোপেঝাড়ে, জলের ধারে ধারে তারা পোকামাকড় খেয়ে বেড়াচ্ছে। গ্রামের লোকও ধান পুঁততে শুরু করেছে। হঠাৎ এক কাণ্ড!
ভোরে তাঁবুর বাইরে বসে কফি খাচ্ছি। চার-পাঁচজন কেলাবিট পুরুষ আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। গ্রামের মোড়লও রয়েছে তাদের মধ্যে। লোকগুলোর হাব-ভাব মোটেই সুবিধের ঠেকল না। কয়েকজনের হাতে ছুরি ও বর্শা।
মোড়ল কড়া সুরে কী জানি বলল চিয়াংকে। চিয়াং কেলাবিট ভাষা জানত। দুজনে কথা শুরু হল। দুজনেই বেশ গরম হয়ে উঠল। অন্য লোকগুলোও কটমট করে চাইতে লাগল। আমি হতভম্ব। এ যাবত গ্রামবাসীদের তো বেশ ঠাণ্ডা বলে মনে হয়েছিল, কী আবার ঘটল?
চিয়াং একবার আমার দিকে ফিরে বলল,–এক ফ্যাসাদ বেধেছে। আমরা আসার পর গ্রামে এক রোগ দেখা দিয়েছে। দুজন লোক মরেছে। এরা আমাদের দায়ী করছে এই দুর্ঘটনার জন্য।
আমাদের কেন! আমি অবাক।
চিয়াং বলল, এদের দারুণ কুসংস্কার। ওদের ধারণা বিদেশিদের আগমনের ফলে গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী চটে গেছেন, অভিশাপ দিয়েছেন, বিশেষত লাল দাড়িওয়ালা বিদেশির আগমন দেবীর কোপের কারণ। অর্থাৎ তুমি। আমি এত বোঝাচ্ছি, কান দিচ্ছেই না। বলছে, এখুনি আমাদের চলে যেতে হবে গ্রাম ছেড়ে।
চিয়াং বেজায় গোঁয়ার। এত কষ্ট করে এসে তাড়াতাড়ি ফিরতে কিছুতেই রাজি নয়। মোড়লের সঙ্গে অনেক তর্ক করল। বলল, চলো দেখি কোথায় তোমাদের রুগী। আমি ওষুধ দিয়ে সারিয়ে দেব।
গ্রামে গিয়ে একজন রুগী দেখলাম। লক্ষণ দেখে বিশেষ কিছু বুঝলাম না। মনে হল ঘোরালো ধরনের ফু। এ-জ্বর নাকি এখানে কখনো হয়নি আগে। আমাদের সঙ্গে কিছু জ্বর-জ্বালার ওষুধ ছিল। তাই একটা ঠুকে দিলাম আন্দাজে, কিন্তু ফল হল মারাত্মক।
দু-দিন পরে দুপুরে ক্যাম্পে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছি। হঠাৎ কুড়ি-পঁচিশ জন কেলাবিট এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমাদের ঘাড়ে। এবং তৎক্ষণাৎ আমাদের হাত-পা বেঁধে ফেলল।
শুনলাম আমাদের দাওয়াই খাটেনি। সেই রুগীটি পটল তুলেছে। সুতরাং গ্রামের লোক খাপ্পা। তারা আপাতত আমাদের বিচার করবে, ওই দেবীর সামনে শাস্তি দেবে। নইলে নাকি গোটা গ্রাম উজাড় হয়ে যাবে দেবীর রোষে। আমাদের সঙ্গে বন্দুক ছিল। কিন্তু সেগুলো নাগালের বাইরে। অসহায় অবস্থায় মরতে হবে নাকি?
সেই দূর অরণ্যভূমিতে সভ্য জগতের আইন-কানন খাটে না। বিচারের নামে এরা আমাদের ওপর যে কী অত্যাচার চালাবে কে জানে! হয়তো হত্যাই করবে।
চিয়াং মোডলকে বোকাল, আমরা এখনি চলে যাচ্ছি। মোড়ল একটু নরম হল।ও ছোকরাগুলো রাজি হয় না। চিয়াংকে রেহাই দিলেও আমাকে তারা ছাড়বে না। শেষে চিত্রা এক প্যাঁচে ফেলল। মোড়লকে কাছে ডেকে ফিসফিস করে ঘষের লোভ দেখাল। আমের লোক আমাদের মালপত্র বাজেয়াপ্ত করলে মোড়লের বিশেষ লাভ নেই। কারণ তা ভাগাভাগি হয়ে যাবে। কিন্তু ঘুষ সবটাই পাবে স্রেফ মোড়ল একা। ওতেই কাজ হল।
মোড়ল অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে অন্যদের রাজি করল আমাদের ছেড়ে দিতে। মোড়লের পায়ে সর্বস্ব সমর্পণ করে প্রায় এক বস্ত্রে গ্রাম ছেড়ে পালালাম।
তারপর তিন-চার দিন কাটল অসহ্য কষ্টে। খাদ্য বলতে জংলি কলা বা আরস। তার ঝলসানো মাছ। খোলা আকাশের নিচে শয়ন। কেবল বৃষ্টিতে ভিজেছি।
হতভাগারা রাইফেল কেড়ে নিয়েছিল। দুটো ছোট ছুরি ছাড়া আত্মরক্ষার আর অন্য ব্যবস্থা ছিল না। ভাগ্যিস নদীতে দেশি মাঝিরা কথামতো তামাদের অপেক্ষায় ছিল, তাই রক্ষে। উঃ, খুব শিক্ষা হয়েছে সেনার বার্ড-ওয়াচিং করতে গিয়ে!
স্যার ডেভিড এক চোট অট্টহাসির সঙ্গে গল্প শেষ করলেন। শ্রোতারাও চমৎকৃত।
স্যার ডেভিড বললেন, সেই গ্রামে রহস্যময় জ্বরের কারণ কিন্তু আবিষ্কার করেছিলাম পরে। ব্যাপারটা অদ্ভুত।
কী? কী? সবাই জানতে চাইল।
কুচিংয়ে চেনা এক ডাক্তারের কাছে দিলাম ওই জ্বরের বর্ণনা। ডাক্তার অনেক ভেবে, বই-টই উলটিয়ে জানালেন, আশ্চর্য! এই রোগ তো মধ্য এশিয়ায় হয়। এদেশে শোনা যায়নি। কী করে ছড়াল ওই গ্রামে?
ঝট করে মনে পড়ে গেল একটা কথা। চিয়াং ফিরে আসার সময় একজোড়া খয়েরি শ্ৰাইক এনেছিল। গ্রামের কাছে ফাঁদ পেতে ধরেছিল পাখি দুটো। ইচ্ছে ছিল চিহ্ন দেওয়া। রিং পরিয়ে এই যাযাবর পাখিদের ছেড়ে দেবে। হঠাৎ পালাতে হল। তবু সে ছাড়েনি পাখি। বয়ে বয়ে এনেছিল পাখি দুটো।
ছুটে গেলাম চিয়াংয়ের হোটেলে। তার খুব জ্বর হয়েছে। তাই পাখিকে তখনও রিং পরানো হয়নি। খাঁচায় রয়েছে। পাখি দুটো নিয়ে গেলাম এক প্যাথলজিস্টের কাছে। লিটন পরীক্ষা করে বললেন, একটা পাখির ডানার পালকে ওই জ্বরের জীবাণু রয়েছে। অর্থাৎ মধ্য এশিয়া থেকে ওই পাখিগুলির কোনো কোনোটা বহন করে এনেছিল রোগের জীবাণ। চিয়াংয়ের জ্বরও সেই মধ্য-এশিয়ার মারাত্মক ব্যাধি। জ্বরের প্রকৃতি বুঝতে পেরে ঠিকমতো চিকিৎসা হতে সে সে-যাত্রা বেঁচে গেল।
গল্প শুনতে শুনতে হুঁশ ছিল না। হঠাৎ ঘড়ির দিকে নজর পড়তে সুনন্দ চমকে উঠল–সাড়ে ছটা। কুণাল এসে অপেক্ষা করবে অসিতের বাড়ি। অসিতেরও খেয়াল নেই, তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়ে।
কুণাল অসিতের বাড়িতে অপেক্ষা করছিল।
কুণাল জানাল, শোন, মিস্টার বাসু টেলিফোন করেছিলেন আজ সকালে। তিনি নাকি গমের নেতানো রোগের একটা ওষুধ বের করেছেন। একটা সলিউশন। ফরমুলাটা বিক্রি করতে চান। পেটেন্ট-রাইট শুদ্ধ। আগের বারেই মতোই। তোরা বোধহয় জানিস না, গম গাছে একটা অদ্ভুত রোগ দেখা দিয়েছে আগের বছর থেকে। ব্যাকটিরিয়া অর্থাৎ জীবাণুঘটিত রোগ! এই রোগ পশ্চিম বাংলা এবং উত্তর ভারতের নানা জায়গায় খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে তাজা গম গাছ শিষ সমেত শুকিয়ে যায়। চাষীরা এর নাম দিয়েছে নেতানো রোগ। জানাশোনা কোনো জীবাণুনাশক ওষুধেও এ রোগ আটকানো যাচ্ছে না। আমি বলেছি ফরমুলা কিনতে চেষ্টা করব। কাল সকাল দশটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট। হোটেল কুতুবে সতেরো নম্বর ঘর। এখন বল কী কর্তব্য?
সুনন্দ বলল, “কী আবার! বাসুকে ফের ফলো করতে হবে! ফরমুলা তুই কিনবি কিনা, সে তোের মাথাব্যথা। কিন্তু ওর আস্তানা জানতেই হবে। জানতে হবে ওর প্রকৃত পরিচয়। এমন সুযোগ ছাড়া যায় না।
কে ফলো করবে? আমরা? অসিত জিজ্ঞেস করল।
না। আগের ব্যাচের কেউ নয়। মিস্টার বাসু আগেরবার আমাদের খেয়াল করেছিলেন কিনা জানি না। তবু সাবধানের মার নেই। ফের সেই এক লোক পিছু ধরেছে দেখলে সতর্ক হয়ে যাবে। তাই এবার ওকে অনুসরণ করবে নতুন লোক–বাচ্চু।
মানে তোদের পাড়ায় শেষ লাল বাড়িটায় থাকে? কলেজ স্ট্রিটে বইয়ের দোকান আছে?
হ্যাঁ। ও আগে প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরের কাজ করত। এসব কাজে খুব পোক্ত। পেশা পালটেছে কিন্তু ডিটেকটিভগিরির শখটা যায়নি। এককথায় রাজি হয়ে যাবে। বাসু প্রথমে হোটেল থেকে গিয়ে কোথায় ওঠে সেটা বের করুক। তারপর আমরা আছি।
পরদিন সকাল দশটা নাগাদ বাচ্চু সুনন্দর কাছে হাজির হয়ে রিপোর্ট দিল।
হোটেল থেকে বেরিয়ে মিস্টার বাসু ট্যাক্সি চেপে যান হাওড়া স্টেশন। সেখান থেকে লোকাল ট্রেন ধরে সপ্তগ্রাম। মেন লাইনে ব্যান্ডেলের পরেই ছোট এক স্টেশন। সপ্তগ্রামের কিছু দূর দিয়ে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড গেছে। স্টেশন থেকে রিকশা নিয়ে বাস যান জি টি রোডের ধারে এক বাড়িতে। নিরালা জায়গায় মস্ত বাগানঘেরা ছোট দোতলা কোঠা বাড়ি। নাম–সুরভি নার্সারি। সারাদিন বাসুর আর দেখা পাওয়া যায়নি। বাড়িতে কে কে থাকে, স্থানীয় লোকজনের কাছে খোঁজ-খবর নিয়েছিল বাচ্চু। থাকেন তপন দত্ত বলে এক ভদ্রলোক। ইয়ংম্যান। তিন বছর হল বাড়িটায় নার্সারি করেছেন। নানারকম ফল, ফুল ও বীজ তৈরি করে কলকাতার বাজারে বিক্রি করেন। অতি অমিশুক। বাইরে বেরোন কদাচিৎ।
একাই থাকেন তপনবাবু। আর থাকে দুজন মালি এবং একটি বুড়ি-ঝি। সবাই বাইরের আমদানি। কেউ স্থানীয় লোক নয়। মিস্টার বার সঙ্গে ওখানকার কারো আলাপ হয়নি। তবে মুখ চেনে। আসা-যাওয়া করতে দেখেছে।
বাচ্চু বেশ রাত অবধি পাহারা দিয়েছিল বাড়িটা। অবশেষে শীতে কাবু হয়ে একটা জঘন্য নোংরা দোকানের বেঞ্চিতে শুয়ে কোনোরকমে রাত কাটায়। একজন ৬০কে লোককে ঘোরাফেরা করতে দেখে স্থানীয় লোকদের একটু সন্দেহের উদ্রেক হচ্ছিল বৈকি! তবে বাচ্চু বলেছে সে ইটের ব্যবসা করতে চায়, তাই জমি খুঁজছে। পরদিন সকালে সে খোঁজ করে শোনে যে বাসু খুব ভোরের ট্রেনে কলকাতার দিকে চলে গেছেন।
তপন দত্তকে দূর থেকে দেখছে বাচ্ছ। ময়লা রং। খুব রোগা ছোটখাটো চেহারা। নার্সারির এক বুড়ো মালির সঙ্গে ভাব জমিয়েছিল বাচ্ছ। মালিটি জিনিস কিনতে এসেছিল। বাইরের দোকানে। মালি নিজের দেশ এবং স্ত্রী-পুত্রের সম্বন্ধে গাদাগুচ্ছের গল্প শোনালেও মিস্টার বাসু বা তপন দত্ত সম্পর্কে রহস্যজনকভাবে নীরব থেকেছে। ও-বিষয়ে কোনো আলোচনাই যেন করতে চায় না।
হ্যাঁ, একটা কথা মালি বেফাঁস বলে ফেলেছে, বাড়িতে ল্যাবরেটরি জাতীয় কিছু একটা আছে। ল্যাম্প জ্বেলে কীসব ওষুধ-টসুধ বানায় তপনবাবু।
কনগ্রাচুলেশনস, বাচ্চু! সুনন্দ অসিত চেঁচিয়ে উঠল। জব্বর খবর এনেছ ভাই। ওই তপন দত্তই নির্ঘাত আসল বৈজ্ঞানিক। পেট পুরে খাইয়ে দেওয়া হল বাচ্চুকে।
ঠিক হল আসছে কাল সুনন্দ ও অসিত সপ্তগ্রাম যাত্রা করবে তপন দত্তর উদ্দেশে। কুণালের ইচ্ছে ছিল সঙ্গে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে আটকে গেল ব্যবসা-সংক্রান্ত কাজে।
সুরভি নার্সারি।
সুনন্দ অসিত রিকশা থেকে নেমেই চট করে ঢুকল না ভিতরে। চারপাশে ঘুরে দেখতে লাগল। প্রধান দোতলা বাড়িটা ছাড়া বাগানের পিছনের অংশে আর একটা ইটের দেওয়াল ও টালির ছাদওলা বাড়ি নজরে পড়ল। এছাড়া রয়েছে আরো দুটো ছোট মাটির বাড়ি। একজন বুড়ো মতন লোক সামনে ফুলের বাগানে বসে কাজ করছে। দুজনে গেট খুলে গুটি গুটি ভেতরে ঢুকল।
তাদের দেখে মালিটি উঠে দাঁড়াল।
তপনবাবু আছেন? জিজ্ঞেস করল অসিত।
আপনারা কোত্থেকে আসছেন?
কলকাতা থেকে। দরকার আছে। ফুলের বীজ কিনতে চাই।
ও দাঁড়ান। দিচ্ছি ডেকে। লোকটি বাড়ির দিকে চলে গেল।
লোকটি তাদের না ডাকলেও সুনন্দরা পায়ে পায়ে এগিয়ে একেবারে বাড়ির সামনে হাজির হল। সদর দরজা বন্ধ। মালি ঘুরে খিড়কি দিয়ে ঢুকেছে।
দরজা খোলার আওয়াজ। এবং তারপর যে যুবকটি তাদের মুখোমুখি দাঁড়াল, তাকে দেখে দুজনে থ। আগন্তুকও অবাক।
প্রায় পনেরো-ষোলো বছর বাদে দেখা হলেও তপনকে চিনতে ভুল হল না তাদের। স্কুলে এই তপন দত্ত ছিল সুনন্দ-অসিতের সহপাঠী। যথেষ্ট বন্ধুত্ব ছিল তাদের।
খুব বুদ্ধিমান ছেলে ছিল তপন। ইংরেজি আর অঙ্কে খুব পাকা। কিন্তু বড় অভাবী। সব বই কিনে পড়তে পারত না। স্কুল থেকে বেরোবার পর ছাড়াছাড়ি হয় তাদের। আর দেখা হয়নি!
“আরে তপন তুই? সুনন্দই প্রথমে সামলে উঠল।
অ্যাঁ, তোরা? তপন থতমত খেয়ে গেল।
তুই এই নার্সারি করেছিস?
হ্যাঁ ভাই। চাকরির বাজার তো জানিস। কিছু জোটাতে পারলাম না সুবিধে মতো। তাই–
কদ্দুর পড়েছিলি? শুনেছিলাম তুই আশুতোষে ভর্তি হয়েছিলি, আই. এস-সি. নিয়ে।
হ্যাঁ। তবে পড়া এগোল না বেশি। এই বি. এস-সি, অবধি টেনেটুনে। তাও ফি জোগাড় করতে পারলাম না, তাই পরীক্ষা দেওয়া হল না। হঠাৎ বাবা মারা গেলেন। এটা সেটা কয়েকটা চাকরি করলাম, টিকল না কোনোটাও। তারপর নার্সারি করেছি। তা মন্দ নয়, চলে যাচ্ছে একরকম। তপন জ্ঞান হাসল।
তুই এ বিদ্যে শিখলি কোত্থেকে?
শিখেছি। বলতে পারিস নিজের চেষ্টায়। আয় ভেতরে।
নিচের ঘরে বসল সবাই।
ঘরে কয়েকটি সস্তা কাঠের চেয়ার টেবিল বেঞ্চি। একগাদা কাঠের প্যাকিং বাক্স এককোনায় গা করা। দেওয়াল-তাকে সুরভি নার্সারির লেবেল মারা কিছু প্যাকেট। টেবিলে কাগজপত্র ফাইল সাজানো। মনে হল এটা অফিসঘর।
তোরা আমার ঠিকানা পেলি কী করে? তপন জানতে চাইল।
পাইনি তো, আবিষ্কার করলাম এই মাত্র। বলল সুনন্দ– এসেছিলাম এইদিকে। নার্সারি দেখে ঘুরে দেখতে ইচ্ছে হল। তাই বীজ কেনার নাম করে ঢুকলাম। তা আমরা কী জানি তোর নার্সারি! খাসা জায়গাটা কিন্তু।
চা-বিস্কুট খাওয়াল তপন।
সুনন্দরা লক্ষ করছিল, তপন কথা বলতে বলতে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। পুরনো বন্ধুদের দেখে খুশি হয়েছে বোকা যায়, তবে নিজের সম্বন্ধে কিছু বলতে তার যেন উৎসাহ নেই। হয়তো নিজের দারিদ্র্য ও ভাগ্যহীনতা প্রকাশ করতে লজ্জা পাচ্ছে।
একফাঁকে অসিত বলল, “তপন তুই নাকি একটা ল্যাবরেটরি করেছিস?
কে বলল? তপন ভুরু কোঁচকালো।
মালি। সাফ মিথ্যে চালিয়ে দিল অসিত।
একটু হেসে তপন বলল, “হ্যাঁ আছে। বীজগুলো শোধন করে নিই। সংক্রামক রোগের হাত থেকে বাঁচাতে। সে অতি সামান্য আয়োজন। পুরোদস্তুর ল্যাবরেটরির মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য নয়। আয় দেখবি।
অসিতদের পাশের ঘরে নিয়ে গেল তপন। দুটো টেবিলের ওপর একটা স্পিরিট ল্যাম্প ও একটা বার্নার। কিছু কাঁচের বাটি প্লেট টেস্ট টিউব। পাশে আলমারিতে কিছু শিশি–তাতে রাসায়নিক চূর্ণ ও তরল পদার্থ। দেখে বোঝা গেল তপনের কথা ঠিকই।
অনেকক্ষণ ধরে বলি-বলি করে যে প্রশ্নটা করতে চাইছিল দুজনে, সুনন্দ এবার সেই প্রসঙ্গ তুলল–
হ্যাঁরে, তোর কাছে মিস্টার বাসু নামে কেউ আসেন। গোঁফ আছে। সাহেবি পোশাক পরেন।
তপন কেমন চমকে উঠল।-কেন?
মানে একটু দরকার ছিল।
তপন জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে রইল। উত্তর দিল না।
সুনন্দ বলল, আসল ব্যাপারটা খুলে বলি। ওই ভদ্রলোক এক মেডিক্যাল ফার্মকে একটা ওষুধের ফরমুলা বিক্রি করেছেন আগের বছর। ধানগাছের শত্রু রাক্ষুসে পোকা দমন করার কীটনাশক। আশ্চর্য ফল দিয়েছে ওষুধটায়। আমাদের এক পরিচিত লোকের কেমিক্যালস ফ্যাক্টরি আছে। তিনি মিস্টার বাসুর সঙ্গে দেখা করতে খুব আগ্রহী। কারণ নানা শস্য রোগের কিছু ভালো প্রতিরোধক যদি বাসু আবিষ্কার করে থাকেন, মিস্টার পাকরাশি তা কিনতে চান। আসলে সেবার মিস্টার বাসু পাকড়াশিকেই প্রথমে অফারটা দিয়েছিলেন। কিন্তু অচেনা লোককে বিশ্বাস না হওয়ায় পাকড়াশি পিছিয়ে যান। তখন বাসু অন্য কোম্পানিকে ফরমুলাটা বিক্রি করে দেন। এখনও পাকড়াশি সেকথা ভেবে হা-হুঁতাশ। করেন। ইদানীং গমে নাকি একরকম নতুন রোগ ধরেছে। নেতানো রোগ। মিস্টার বাসু যদি এই রোগের কোনো প্রতিরোধক বের করতে পারেন–তাই মিস্টার পাকড়াশি তার খোঁজ করছেন।
কিন্তু মুশকিল হল মিস্টার বাসুর ঠিকানা কেউ জানে না। কীভাবে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়? পাকড়াশি আমাকেও বলেছিলেন মিস্টার বাসুর কথা–যদি তার ঠিকানা জোগাড় করে দিতে পারি। অ্যাক্সিডেন্টলি গত পরশু হঠাৎ মিস্টার বাসুর দেখা পেয়ে গেলাম। বাসুকে আমি দেখেছি হোটেল কুতুবে। সেবার পাকড়াশি আমায় সঙ্গে করে নিয়ে বাসুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। অবশ্য তাদের কথাবার্তার সময় আমি উপস্থিত ছিলাম না।
যা হোক, গত পরশু এই পথ দিয়ে ব্যান্ডেলে যাচ্ছিলাম মোটরে। হঠাৎ দেখি মিস্টার বাসু সাইকেল রিকশা থেকে নেমে এই নার্সারিতে ঢুকলেন। তখন সময় ছিল না হাতে, অন্যের গাড়ি তাই। জায়গাটা চিনে রেখেছিলাম। তারপর আজ চলে এলাম।
তপন গম্ভীরভাবে শুনছিল। বাঁকা হেসে বলল-বুঝেছি, এই জন্যেই তোদের আগমন। কিন্তু ভাই আমিও মিস্টার বাসুর ঠিকানা জানি না।
বাসু এখানে আসেন?
আসেন মাঝে মাঝে। আসলে এই নার্সারির জমি আর বাড়ির মালিক হচ্ছেন মিস্টার বাসু। উনি কখনো কখনো এখানে আসেন। ভাড়া নিয়ে চলে যান। দু-একদিন বাসও করেন–ওই টালির ঘরটায়।
মনি অর্ডার বা চিঠি পাঠাসনি কখনো?
না, সে ব্যবস্থা নেই।
মিস্টার বাসু বোধহয় বায়োকেমিস্ট্রির লোক।
হুঁ, সায়েন্সের লোক।
আবিষ্কারটা ওর নিজের হলে বলতে হয়, আশ্চর্য প্রতিভা। অথচ অবাক ব্যাপার–সায়েন্টিস্ট মহলে কেউ ওঁর নাম জানে না। তোর সঙ্গে এ বিষয়ে আলো করেননি কখনো?
না।
তপনের মুখ ক্ৰমে থমথমে হয়ে উঠছিল। হয়তো বাসু প্রসঙ্গ তার মনঃপূত হচ্ছিল না। অসিত তাই কথা ঘোরাল–বাদ দে তোর মিস্টার বাসু। চল তোর বাগান দেখি।
বাগানে ঘুরল তিনজনে।
পরিচ্ছন্ন নার্সারি। গাছপালার মধ্য দিয়ে সরু সরু কাকর বিছানো পথ। তপন বন্ধদের চিনিয়ে দিল নানা ফুলফলের গাছ। তবু আড্ডার সুর যেন আর তেমন জমল না। কেমন ভাসা-ভাসা দায়সারা ভদ্রতা দেখাচ্ছিল তপন। বোধহয় মিস্টার বাসুর প্রসঙ্গই তার মেজাজ বিগড়ে দিয়েছিল। সত্যি বলতে কি, এতদিন পরে তপনের খোঁজ পেয়ে সুনন্দ অসিত খুব। খুশি হলেও মিস্টার বাসুর হদিশ ফের হারিয়ে যেতে তারা বেশ দমে গিয়েছিল।
একবার তপন জিজ্ঞাসা করল–আচ্ছা ধানের রাক্ষুসে পোকা আর গমের নেতানো রোগ সম্বন্ধে কী বলছিলি যেন? আমার অবশ্য লাইন আলাদা–এ ব্যাপারে বিশেষ ধারণা নেই।
কুণালের মুখে এ বিষয়ে যা যা শুনেছিল তাই বলল অসিত। তপন দুপুরে খেয়ে যেতে বলেছিল। কিন্তু সুনন্দরা রাজি হল না। সেখানে ঘণ্টা দুই কাটিয়ে ফিরল কলকাতা।
পথে অসিত বলল, “দেখ সুনন্দ, আমার কিন্তু মনে হচ্ছে তপন অনেক কথা চেপে গেল।
হুঁ, কিন্তু তাতে ওর স্বার্থ?
সেটাই তো ধরতে পারছি না। আচ্ছা তপন স্বয়ং সেই রহস্যময় বৈজ্ঞানিক নয়তো?
ধ্যেৎ! তপনের বিদ্যেতে এমন আবিষ্কার সম্ভব নয়।
কুণাল শুনে রেগে বলল–অদ্ভুত ব্যাপার! লোকটা বারবার যেন পিছলে যাচ্ছে। কেন বাস কাউকে তার ঠিকানা জানান না! এত লুকোচুরি কীসের?
সুনন্দ হেসে বলল, হয়তো তোদের মতো ফরমুলা-চোরদের হাত এড়াতে। বৈজ্ঞানিকের সাধনা গাপ মেরে দেবার মতো সৎ লোকের তো অভাব নেই দেশে। তাই তো এত সাবধানতা।
কিন্তু বৈজ্ঞানিকটি যে বাসু, এইখানেই আমার ঘোর সন্দেহ। কারণ ফরমুলা সংক্রান্ত কাগজ পরীক্ষা করে এবারও আমি একটা ফ্যাকড়া তুলেছিলাম। ওষুধটা সিসটেমিক অর্থাৎ প্রয়োগ করলে সলিউশনের রাসায়নিক বস্তু উদ্ভিদের শরীরে প্রবেশ করে। এবং তাকে আক্রমণকারী জীবাণুর পক্ষে বিষাক্ত করে তোলে। বললাম–সলিউশন ক্ষেতে স্প্রে করার পর তার প্রভাব দূর হতে কতদিন লাগবে সেটা তো লেখা নেই পরিষ্কারভাবে। পাকা গম কাটার অন্তত কতদিন আগে এ ওষুধ ব্যবহার করা উচিত? নইলে যে ফসল বিষাক্ত হয়ে থাকলে মানুষের ক্ষতি করবে।
বাস বললেন–সেসব ডিটেলস পরে দেব। সমস্ত নোট করা আছে। এখন ঠিক মনে পড়ছে না।
যে তোক হাতে-কলমে এই ওষুধ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছে তার পক্ষে এই তুচ্ছ প্রশ্নের জবাব দেবার জন্য নোট কনসাল্ট করতে চাওয়া হাস্যকর। পরিষ্কার মনে থাকার কথা। তাই বাসু সম্বন্ধে আমার সন্দেহটা আরও বেড়েছে।
দিন চারেক পরে এক দুপুরে উদভ্রান্ত কুণাল অসিতের বাসায় এসে হাজির হল।
কী ব্যাপার?
কুণাল বলল, হরিধনকে পাওয়া যাচ্ছে না।
কে হরিধন?
মিত্র কেমিক্যালস-এর একজন সেলসম্যান। ঘুরে ঘুরে ওষুধ বিক্রি করে। খুব চালাক-চতুর ছেলে। ওকে গতকাল হোটেল কুতুবের সামনে পাহারায় বসিয়েছিলাম।
কেন?
দুদিন আগে কুতুবের ম্যানেজারের কাছে গিয়েছিলাম মিস্টার বাসুর খোঁজে। বললাম–ওঁর সঙ্গে আমার বিশেষ দরকার। প্রথমে স্রেফ এড়িয়ে গেল ম্যানেজার। শেষে অনেক পেড়াপীড়িতে মুখ খুলল। বাসুর সঙ্গে আমার দুবার অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়েছে, তা তো সে দেখেছে। বলল, মিস্টার বাসু নাকি শিগগিরি আসতে পারেন হোটেলে। কয়েকখানা চিঠি এসেছে ওঁর নামে, সেগুলো নিয়ে যাবেন। বাসু ফোনে তাই জানিয়েছেন। ম্যানেজারকে অনুরোধ জানালাম–মিস্টার বাসুকে বলবেন, আমি ওঁর সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাই। কোথায় কখন দেখা হবে যেন চিঠিতে জানান।
ফিরে গিয়ে হরিধনকে বললাম যদি বাসুর ঠিকানা বের করে দিতে পারো তোমার প্রোমোশন হবে। হরিধন তক্ষুনি রাজি হয়ে গেল। গত রাতে হরিধন বাসায় ফেরেনি। আজ সারা সকাল থানা-হাসপাতাল চষে বেড়িয়েছি। হরিধনের পাত্তা নেই। ওর বাড়ির লোক কান্নাকাটি করছে। হয়তো আমার জন্যেই বিপদে পড়ল ছেলেটা?
কাল বাসু এসেছিলেন কুতুবে?
হ্যাঁ, বিকেল পাঁচটায় আসেন, খানিক পরে চলে যান।
কুণালের সঙ্গে বেরলো দুজন। অনেক খোঁজাখুঁজি করল বিকেল অবধি। হরিধনের খোঁজ পাওয়া গেল না। সন্ধেবেলা মামাবাবুর বাসায় ফিরতে বাধ্য হল সুনন্দ অসিত। কারণ স্যার ডেভিড ডানকান আসবেন আজ। সেই উপলক্ষে আরও কয়েকজন অতিথি আসবেন বাড়িতে। তাদের যত্নের ভার সুনন্দদের ওপর।
আবার আগামীকাল এক প্রোগ্রাম ঠিক হয়ে আছে। মামাবাবু ডানকানকে নিয়ে কলকাতার বাইরে যাবেন বেড়াতে। সুনন্দ অসিত যাবে সঙ্গে।
সুনন্দদের ইচ্ছে ছিল না কুণালকে ফেলে রেখে যায়। কুণালই জোর করল–তোরা আর থেকে কী করবি। মাঝ থেকে প্রোফেসর ঘোষের অসুবিধে হবে। তোরা যা–
ভাগ্যিস গিয়েছিল তারা। নইলে এক অতি জটিল রহস্যের জাল হয়তো কোনোদিনই ভেদ করা সম্ভব হত না।
রাতে সুনন্দ একবার ফোন করল কুণালকে–হরিধনের খোঁজ পেলি?
উত্তর এল–না।