তরুর ঠাস-বোনা রুটিনের মধ্যে আমার জায়গা ঠিক হইয়া গেছে। কাজ বেশ নিয়মিতভাবে চলিতেছে। ওদিকে কলেজে নাম লিখাইয়া লইয়াছি। প্রচুর অবসর রহিয়াছে; পড়াশুনা ঠিকমত আরম্ভ করি নাই, তবু আয়োজন চলিতেছে।

প্রচুর অবসর, কেননা, পাঁচটার পূর্বে তরুর সঙ্গে আমার কোন সম্বন্ধ থাকে না। সকালে তাহার সেই লক্ষ্মীপাঠশালা, দুপুরে লরেটো, তাহার পর ঘণ্টাখানেক বৈষ্ণবসংগীত। কীর্তনের মাস্টার চলিয়া গেলে তরুর ভার আমার উপর পড়ে। প্রথমেই ওকে মোটরে করিয়া বেড়াইতে লইয়া যাইতে হয়। কোন দিন ইডেন্‌ গার্ডেন্‌স, কোনদিন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কোন দিন অন্য কোথাও। ইহার মধ্যে দুই দিন কলিকাতার বাহিরেও হইয়া আসিয়াছি—একদিন দমদমার দিকে, একদিন বটানিক্যাল গার্ডেন্‌স্। এই মোটর-অভিযানে তরুর প্রয়োজনের চেয়ে আমার নিজের শখের দিকটাই বেশি করিয়া দেখিতেছি আমি, —এ সত্যটুকু গোপন করিয়া কি হইবে? আমি একটু ভ্রমণবিলাসী, মাঝের চারিটি বৎসর আমার জীবনের এই শ্রেষ্ঠ বাসনাটিকে যেন কারারুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলাম। মুক্তি পাইয়া, মুক্তির সঙ্গে সুযোগ পাইয়া সে যেন অন্ধ আবেগে ডানা মেলিয়া দিয়াছে।

আর একটা কথা—ইহার মধ্যে একদিন মীরা সঙ্গে ছিল, বরাবরই নির্বাক, বোধহয় বার-তিনেক তরুর সঙ্গে এক-আধটা কথা কহিয়া থাকিবে, আর একবার সোফারকে একটা হুকুম; আমার সঙ্গে একটাও কথা হয় নাই। কিন্তু ও যে পাশে ছিল, সেই বা কি এক অপূর্ব অনুভূতি! তাহার পর রোজই বেড়াইতে যাইবার সময় একবার ফিরিয়া বাড়িটার দিকে চাহিতাম—একটা আশা, যদি উপর থেকে কেহ বলে, “তরুদিদি একটু থেমে যেও, বড়দিদিমণি বোধ হয় যাবেন ওদিকে।”… মোটরের পা-দানিতে পা তুলিতে দেরি হইয়া যাইত।

বেড়াইয়া আসিয়া একটু এদিক-ওদিক করিয়া তরু আসে পড়িতে। পড়িবার নির্ধারিত সময় দুই ঘণ্টা। পড়ার মাঝে মাঝে গল্পগুজব সাঁদ করাইয়া তরু যে সময়টুকু আত্মসাৎ করে সেটার হিসাব রাখিলে তরু বোধ হয় বইয়ে দেয় ঠিক ঘণ্টাখানেক সময়। কিন্তু অসাধারণ বুদ্ধিমতী মেয়ে; —ওইতেই পড়া হইয়া যায়, তা ভিন্ন লরেটোর পড়াইবার পদ্ধতিও এমন চমৎকার যে, পাঠ গ্রহণ করিবার সময়ই বোধ হয় ওর অর্ধেক পড়া হইয়া গিয়া থাকে। লক্ষ্মীপাঠশালায় পড়িবার বিশেষ হাঙ্গামা নাই,—স্তব, পূজাপদ্ধতি, সব ওখানেই সারে; খান দুই-তিন হালকা বাংলা বই আছে, দেরি হয় না।

এই একরকম নিখুঁত দিনগুলির মাঝে মাঝে ছন্দপতন হইতেছে। সেটা ঘটাইতেছে মীরা। একটু আশ্চর্য বোধ হয় বৈকি। যে মীরা আমার জীবনের ছন্দ সৃষ্টি করিতে বসিয়াছে সে-ই আবার ছন্দপতন ঘটায় কেমন করিয়া? একটা দিনের কথা বলিলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হইতে পারে। ছোট দু-একটা ঘটনার কথা বাদই দিলাম।

তরু একদিন নিজের পদ্ধতিতে প্রশ্ন করিল, “মাস্টারমশাই, শুনেছেন?”

জিজ্ঞাসা করি—“কি?”

“দিদি এইবার একদিন আসবেন বলেছেন—দেখতে যে আপনি কেমন পড়াচ্ছেন।” ঘুরাইয়া ফিরাইয়া আরও দু-একদিন বলিল কথাটা।

বলি—“বেশ ভাল কথাই তো।”

লক্ষ্য করিয়াছি কথাটা বলিয়াই তরু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার মুখের পানে চায়। “ভাল কথাই তো” বলা সত্ত্বেও আমার মুখটা যে একটু মলিন হইয়া উঠে সেটা ওর দৃষ্টি এড়ায় না। একদিন বলিয়াও ফেলিল ভিতরের কথাটা। হঠাৎ চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া গেল এবং পর্দার বাহিরে একটু মুখটা বাড়াইয়া দেখিয়া লইয়া ফিরিয়া আসিল; তাহার পর কুণ্ঠিত চাপা গলায় প্রশ্ন করিল, “একটা কথা বলছি মাস্টারমশাই, কিন্তু বলুন কারুকে বলবেন না কক্ষণো…”

ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম, “কথাটা যদি এমনই গোপনীয় তো বলে কাজ নেই তরু, বলতে হয় না অত গোপনীয় কথা।”

বাধা পাইয়া তরুর মুখের দীপ্তিটা যেন নিভিয়া গেল। অপ্রতিভ ভাবে সামলাইয়া লইয়া বলিল, “না, সে কখনও বলবও না আমি।”

পড়িতে লাগিল। কিন্তু বেশ বুঝিতেছি তরু অভিনিবিষ্ট হইতে পারিতেছে না পড়ায়, কথাটা ওর পেটে গজগজ করিতেছে। চিরন্তনী নারীরই তো একটি টুকরা তরু—পেটে কথার ভার বহন করিবে কি করিয়া বেচারী?

মনে মনে হাসিয়া ওর অবস্থাটা উপভোগ করিতেছি, তরু হঠাৎ পড়া বন্ধ করিয়া মুখটা তুলিয়া হালকা তাচ্ছিল্যের সহিত নাসিকা কুঞ্চিত করিয়া বলিয়া উঠিল, “হ্যাঁ, কি আর এমন লুকুনো কথা মাস্টারমশাই? লুকুনো হলে কখনও বলত দিদি –বলুন না?”—এবং পাছে আবার কোন বাধা উপস্থিত করি সেই ভয়ে এক নিঃশ্বাসে বলিয়া গেল, “দিদি বলে—‘পড়া দেখতে আসব বললে মাস্টার মশাইয়ের মুখটা কি রকম হয় লক্ষ্য করে বলিস তো তরু।’ আমি গিয়ে বলি। দিদি তাতে বলে—‘করুন রাগ তোর মাস্টারমশাই, আমি যাব একদিন। সাবধান থেক তরু, যদি দেখি ফাঁকি দিচ্ছ!’ দিই ফাঁকি আমি মাস্টারমশাই?”

“না, পড় দিকিন!”

পর্যবেক্ষণ! …মনে একটা গ্লানি জমিয়া উঠে। মীরার অর্থাৎ একটা মেয়ের এবং আমার চেয়ে বয়সে ছোট মেয়ের এই মুরুব্বিয়ানাটা বরাবর হজম করিয়া যাইতে হইবে? …ব্যারিস্টার রায় নাই, মন্দ লাগিতেছে না; কিন্তু এক সময় কামনা করি তিনি আসিয়া পড়ুন অবিলম্বে,—যদিও তিনি শত বিভীষিকায় ভীষণ, তবুও! নিজের মনেই ব্যঙ্গ করিয়া বলি, “এ সম্রাজ্ঞী রিজিয়ার আস্ফালন সহ্য হবে না।”

এমন সময় মীরা একদিন আসিয়াই পড়িল। অপর্ণা দেবীর ঘরে যেদিন ইচ্ছা না থাকলেও প্রচ্ছন্নভাবে উহাদের আদর-আবদারের খেলা দেখি, তাহার ঠিক চারিদিন পরে। বোধ হয় এ ঘটনাটুকুর সঙ্গে আমার সম্বন্ধও ছিল, কেননা আমার ‘মনিব’ মীরা সেদিন আমার কাছে একটু খেলো হইয়া পড়িয়াছিল, যদিও অপর্ণা দেবী মিথ্যা বলিয়া অনেকটা সামলাইয়া লইবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। সেই ক্ষতিটুকু গাম্ভীৰ্য দিয়া না পূরণ করিয়া লইলে আমি বশে থাকিব কি করিয়া?

মনে মনে ব্যঙ্গ করিয়াছিলাম, কিন্তু প্রবেশ করিলও ঠিক সম্রাজ্ঞী রিজিয়ার মতই। প্রথমে রাজু বেয়ারা পর্দার ভিতরে মুখটা বাড়াইয়া বলিল, “বড়দিদিমণি আসছেন মাস্টারমশা”; অর্থাৎ কায়দামাফিক অ্যানাউন্স করিল আর কি; তাহার পর পর্দাটা তুলিয়া ধরিল; মীরা ধীরে ধীরে প্রবেশ করিল।

মীরা সাজিয়া আসিয়াছে। একটা খুব হালকা চাঁপাফুলের রঙের শাড়ি পরিয়াছে, গায়ে ঐ রঙেরই একটা পাতলা পুরা-হাতাব্লাউস, মণিবন্ধের কাছে ঝালরের মত করিয়া কাটা, তাহার মধ্যে দিয়া মীরার পুষ্পকোরকের মত হাত দুইটি বাহির হইয়া আছে,—দু-গাছি রুলি ঝিকমিক করিতেছে। পায়ে, মাঝখানটিতে একটি করিয়া ফুলতোলা মখমলের স্যাণ্ডেল, কপালে একটি খয়েরের টিপ, মাথায় পরিষ্কার করিয়া গুছানো এলো খোঁপা, আর সেই অনবদ্য বাঁকা সিঁথি।

মীরা কালো—শ্যামাঙ্গীই বলি। পীতে হরিতে তাহাকে দেখিতে হইয়াছে ফুলে- ভরা একটি নবীন চম্পকতরুর মত।

বোধ হয় এই সাজিবার জন্যই একটু কুণ্ঠিত হইয়া একটা চেয়ারে বসিয়া রহিল মীরা—অল্প একটু নিজেকে দ্রষ্টব্য করিয়া তুলিলে যেমন হয়। অবিলম্বেই আবার সে-ভাবটুকু সামলাইয়া লইয়া বেশ সহজ গলায় সহজ গাম্ভীর্যের স্বরে বলিল, “আপনার ছাত্ৰীর পড়া দেখতে এলাম।”

উত্তর দেবার সময় গলা দিয়া যেন একটা কঠিন বস্তুকে নামাইয়া দিতে হইল। বলিলাম, “বেশ করেছেন, ভালই তো!”

মীরা বলিল, “তরু একটু বিশেষ চঞ্চল, সেই জন্যই দেখে-শুনে আপনাকে রাখলাম।”

আমার সংশয়িত মনের ভুল হইতে পারে, কিন্তু ‘রাখলাম’ কথাটিতে মীরা যেন বিশেষ একটি ঝোঁক ছিল। হয় তো আমারই ভুল, মীরা অত রূঢ় হয় নাই, কিন্তু আমি উত্তর যা দিলাম তা এই ধারণারই বশবর্তী হইয়া। একটু ইতস্ততঃ করিলাম, তাহার পর বলিলাম, “আপনার অনুগ্রহ।”

কথাটার মধ্যে মনের তিক্ততাটা বোধ হয় প্রকাশ পাইয়া থাকিবে, যদিও স্পষ্টভাবে রূঢ় হইবার আমারও ইচ্ছা ছিল না। মীরা একবার তাহার সেই তীক্ষ্ণ সন্ধানী দৃষ্টিতে আমার পানে চাহিয়া লইয়া আবার বেশ সহজ দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল, “না, না, অনুগ্রহ কিসের? আমরা উপযুক্ত লোক খুঁজছিলাম, আপনি উপযুক্ত লোক—এতে অনুগ্রহ কি আছে আর? আপনাকে রাখা এ তো নিছক স্বার্থ।”

মীরা কথাটা নরম সুরেই বলিল—একটু যেন অনুশোচনা আছে তাহাতে; আমাকে রাখা বিষয়ে যে দম্ভটুকু প্রকাশ করিয়া ফেলিয়াছে সেটুকু যেন সামলাইয়া লইতে চায়। আমিও নরম হইয়া গেলাম। সত্য কথা বলিতে কি এই নরম হইবার সুযোগটুকু পাইয়া আমি বাঁচিয়া গেলাম। মীরা কি উদ্দেশ্যে ঠিক জানি না—ইচ্ছা করিয়া আামার ক্ষুণ্ণ করিতেছে; কিন্তু ওর উপর ক্ষুণ্ণ হওয়া যে কত শক্ত আমার পক্ষে তাহা আমার অন্তরাত্মাই জানেন। আঘাতে আকর্ষণে মীরা ইহারই মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতি জাগাইতেছে। তরুর মুখে, ও আমার কাজ পরিদর্শন করিতে আসিবে শুনিলে মুখটা বোধ হয় অন্ধকার হইয়া যায়; কিন্তু উহারই মধ্যে কেমন করিয়া মনের কোথায় রঙীন বাসনা জাগিয়া থাকে। মীরা যে মূর্তিতেই আসিতে চায়, আসুক, শুধু আসুক ও। আহত পৌরুষের অভিমানে মুখ ভার করিয়া আমি এখন আশার পর চারি থাকি।

ওকে যতটা চাই না তাহার শতগুণ চাইও আবার। মীরাকে দেখিবার আগে এ অদ্ভুত ধরনের অনুভূতির কখনও সন্ধান পাই নাই নিজের মধ্যে। তাই বলিতেছিলাম নরম হইবার সুযোগ পাইয়া আমি যেন বর্তাইয়া গেলাম।

আমার উত্তরের মধ্যে যে একটা ব্যঙ্গের ইসারা ছিল সেটুকু নিঃশেষে মুছিয়া লইবার জন্য সত্যই কৃতজ্ঞতার স্বরে বলিলাম, “অনুগ্রহ যে নয় এ-কথা কি করে বলি? আমি উপযুক্ত কি না সে-কথা তো যাচাই করেন নি; এসে দাঁড়িয়েছি, আপনি নিয়োগ করেছেন। আমার যে একটা অভাব ছিল, আমার যে আশ্রয়ের একটা প্রয়োজন ছিল—আমার চেহারার মধ্যে সে-কথাটা নিশ্চয় কোথাও ধরা পড়েছিল, আপনার এড়াতে পারে নি। তাই আপনি যাচাই করা দূরে থাকুক ভাল করে পরিচয়ও নেন নি আমার; ডেকে নিলেন। অনুগ্রহ নয় তো কি বলব একে?”

এ উচ্ছ্বাসটা দেখাইয়া ভাল করি নাই। অবশ্য, সে-কথাটা অনেক পরে জানিতে পারি, তাহার কারণটাও। মীরা কি এক রকম ভাবে, স্থির দৃষ্টিতে আমার পানে চাহিয়া এই স্তুতি শুনিল, তাহার মুখটা কঠিন হইয়া আসিতে লাগিল এবং একেবারে শেষের দিকে, ধীরে ধীরে তাহার নাসিকার সেই কুঞ্চনটা জাগিয়া উঠিল। কথাটা একেবারে ঘুরাইয়া লইয়া, কতকটা অসংলগ্নভাবেই বলিল, “পড়ছে কি রকম আপনার ছাত্রী আগে তাই বলুন।”

সঙ্গে সঙ্গেই ঈষৎ হাসিয়া বলিল, “আমি আপনার স্তব শুনতে আসি নি মাস্টারমশাই। এমন কি অসাধারণ কাজ করেছি যে …”

হাসি দিয়া মর্মান্তিক কথাটা বোধ হয় নরম করিবার চেষ্টা করিয়া থাকিবে মীরা, তবুও আমার গায়ে এমুড়া-ওমুড়া একটা কশাঘাতের মত বাজিল সেটা। মনে হইল সমস্ত শরীরটা একটা অসহ্য জ্বালার সঙ্গে সঙ্গেই যেন একেবারে অসাড় হইয়া গেল, নিজের দীনতার গ্লানি যেন ক্রমাগত ফেনাইয়া ফেনাইয়া উপচাইয়া পড়িতে লাগিল। ক্ষণমাত্র মীরার চক্ষের পানে চাহিয়া চক্ষু নামাইয়া লইলাম।

তরুও যেন কি রকম হইয়া গিয়াছে, একবার নিতান্ত কুণ্ঠিত, অপ্রতিভভাবে আমার মুখের উপর করুণ দুইটি চক্ষু তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তাহলে কোন্‌খানটা পড়ব মাস্টারমশাই?” আমি উত্তর দিবার আগেই আবার মীরাকে প্রশ্ন করিল, “কোন্ পড়াটা শোনাব তোমার দিদি?”

কোন উত্তর না পাইয়া মাথা নীচু করিয়া মনোযোগের সহিত ওর ইংরাজী রীডারটার পাতা উল্টাইতে লাগিল।

ঘরটাতে বায়ু যেন হঠাৎ স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছে; অসহ্য গুমট একটা। তিনজনে মাথা নীচু করিয়া বসিয়া আছি। একটু পরে মীরাই আবার গুমট্‌টা ভাঙিল, বরং ভাঙিবার চেষ্টা করিল বলাই ঠিক। কথাটাতে চপল হাস্যের ভাব ফুটাইবার প্রয়াস করিয়া বলিল, “যেটা খুশি পড় না, আমি দুটোতেই পণ্ডিত—যেমন তোমার লক্ষ্মীপাঠশালার শিবস্ত্রোত্র বুঝি, তেমনই তোমার লরেটোর কচকচানি বুঝি; তুমি যেটা বলবে আমায় একই রকম ভাবে ঠকাতে পারবে। নয় কি মাস্টারমশাই?… কিন্তু আজ আমি এখন উঠি, আবার সরমাদিকে কথা দেওয়া আছে—আটটার সময় আসব।” বলিয়া হাতঘড়িটা উল্টাইয়া দেখিয়া উঠিয়া পড়িল।

আবার একটু নিস্তব্ধতা আসিয়া পড়িল। কোন মতেই আঘাতের স্মৃতিটা যেন কাটাইয়া উঠিতে পারিতেছি না। হঠাৎ কি করিয়া এবং কেন ব্যাপারটা এত কটু হইয়া উঠিল তাহাও ভাল করিয়া বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। একটু পরে তরু আমার ডান হাতটা হঠাৎ জড়াইয়া ধরিয়া আবদারের সুরে বলিল, “একটা কথা বলব মাস্টারমশাই?”

ক্লিষ্ট কণ্ঠস্বরকে যথাসম্ভব শান্ত করিয়া উত্তর করিলাম “বল!”

“না, আপনি রাগ করবেন; আমার ওপরও, দিদির ওপরও।”

হাসিয়া বলিলাম, “না, করব না, বল!”…এবং এই সুযোগে, তখনই যে-ব্যাপারটা হইল সেটাকে চাপা দেওয়ার জন্য আরও প্রাণখোলাভাবে হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিলাম, “তোমার দিদির ওপর রাগ কেন করতে যাব?…দেখ তো!”

তরুর মুখটাও পরিষ্কার হইয়া গেল, উৎসাহের সহিত বলিল, “ভয়ঙ্কর ভালবাসে দিদি আপনার লেখাগুলো মাস্টারমশাই। ‘মানসী’ ‘কল্লোল’ আরও অন্য অন্য মাসিক পত্র থেকে খুঁজে খুঁজে পড়ে, হ্যাঁ, দেখেছি আমি।”

কৌতুহল হইল; কিন্তু তাহার চেয়ে মুগ্ধ হইলাম বেশি। নারীর মন—উহারা পুরুষের অন্তস্তল পর্যন্ত এক দৃষ্টিতেই দেখিয়া লইতে পারে, হোক না তরুর মত ছোট। আর জোড়াতাড়া দিতেও উহাদের হাত এইটুকু থেকেই দক্ষ। তরু তাহার দিদি আর আমার মধ্যে ভাব করাইয়া লইবার জন্য সদ্যসদ্যই ব্যস্ত হইয়া উঠিতেছে, দলিল-দস্তাবেজ হাজির করিতেছে আমার প্রতি ওর দিদির প্রীতির; অর্থাৎ এই মাত্র যা হইল, ওটা কিছু নয়, মীরা আসলে আমার লেখা ভালবাসে—যাহার মানে হয় আমায় ভালবাসে।

হাসিয়া প্রশ্ন করিলাম, “সত্যি নাকি?”

তরু চক্ষু দুইটা বড় করিয়া বলিল, “হ্যা, মাস্টারমশাই! দুটো পদ্য আপনার লিখেও নিয়েছে।”

“কিন্তু পেলে কোথা থেকে?”

শান্তি স্থাপনের ঝোঁকে তরু এ-দিকটা ভাবে নাই, ভয়ে ওর হাতটা একটু আল্‌গা হইয়া গেল। তখনি আবার ভাল করিয়া আমার হাতটা জড়াইয়া পাঁজরার কাছে মাথা গুঁজিয়া ধরিল।

বলিলাম, “কি করে পেলে বল তো তোমার দিদি?”

তরু অপরাধীর মত স্খলিত কণ্ঠে বলিল, “আমি নিয়ে গেছলাম।”

তাহার পর অনুযোগের সুরে বলিল, “দিদিই কিন্তু বলেছিল মাস্টারমশাই।”

আরও একটু মৌন থাকিয়া অনুশোচনার স্বরে বলিল, “আমি কুমারী মা-মেরীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করব’খন মাস্টারমশাই, না বলে নিয়ে যাবার জন্যে আপনার খাতা। …দিদিকে কিন্তু বলবেন না।”

আবার সেই বোধহীনা বালিকা,—উহাদের কন্‌ভেণ্টের অভ্যস্ত বুলি আওড়াইতেছে।

সেই রাত্রে, যতদূর মনে পড়ে, আমার জীবনে প্রথম এক অনাস্বাদিতপূর্ব মধুর অশান্তির আস্বাদ পাইলাম।

মীরা প্রথম দিনে আমার সামনে এক দৃপ্তরূপ লইয়া দাঁড়ায়। দ্বিতীয় বার তাহাকে দেখি প্রচ্ছন্নতার অন্তরাল হইতে তাহার মায়ের কাছে সন্তানের হালকা রূপে। কোন্‌টা স্বাভাবিক মীরা জানি না, হয়তো দুইটা রূপই স্বাভাবিক—নিজের নিজের জায়গায়। কিন্তু মীরা চায় না যে, আমি জানি ওর একটা হালকা দিকও আছে। আজ যে-মীরা আসিয়াছিল সম্রাজ্ঞীর স্পর্ধিত বেশে—তাহার উদ্দেশ্যই ছিল দ্বিতীয় দিনের ছাপটা আমার মন হইতে ভালভাবে মুছিয়া দেওয়া। এক ধরনের আক্রোশ মীরার মনে,—সহজভাবে সে-ছাপটা সরাইতে না পারিয়া, সহজভাবে আক্রোশটা মিটাইতে না পারিয়া মীরা অস্বাভাবিকভাবেই একটু দাম্ভিকতা করিয়া গেছে আমার কাছে।… কিন্তু তাহার পর? মীরার সজ্জায় আড়ম্বর ছিল কেন? ঐ ছাপ মিটাইবার জন্য, না আরও কিছু?—এই প্রশ্নই সে-রাত্রে কত স্বপ্নজাল বিস্তার করিয়া ছিল। মীরা বাহিরে যাইবার জন্য সাজে নাই, আমাদের ঘর হইতে গিয়া সে যায় নাই কোথাও। যদি ধরা যায় সাজিয়াছিল বাহিরের জন্যই, কিন্তু গেল না কেন তবে? আমায় আঘাত করিতে আসিয়া সে নিজেই আহত হইয়া গেছে—নিজের অস্ত্রেই? যদি তাই হয়? স্বপ্নের জাল যেন আরও সূক্ষ্ম হইয়া, আরও জটিল হইয়া উঠে।… আর সর্বোপরি তরুর সংবাদ—মীরা আমার লেখার পক্ষপাতী,—আমার দুইটি পদ্য—আমার অন্তরের দুইটি রঙীন বাণী মীরার সঞ্চয়ের খাতায় অমরত্ব লাভ করিয়াছে…তরু সেদিন বলিয়াছিল মীরা কবিদের ভালোবাসে,—মীরা সমর্থন করিয়াছিল এই বলিয়া যে কবিদের যে দু’চোখে দেখিতে পারে না।

এই মীরাই আবার আজ আমায় আঘাত দিয়াছে—সূক্ষ্ম কিন্তু আমোঘ।

জীবনে এক নূতন আলো;—অপরূপ তৃপ্তি, তাহারই পাশে কিন্তু গাঢ় ছায়া সুতীব্র বেদনা।