৮
পরিবারটি ছোট—মীরার বাবা, মা, মীরা, তরু; নেপথ্যে মীরার দাদা।
সে অনুপাতে চাকর-বাকর বেশি। বেয়ারার কথা বলিয়াছি। নাম রাজীবলোচন হইতে সংক্ষিপ্ত হইয়া রাজু। অনেকটা সর্দারগোছের। বাসন মাজিতে হয় না আর ঘর ঝাঁট দিতে হয় না বলিয়া কতকটা আভিজাত্য-গর্বিত। থাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, কাঁধে একটা পরিষ্কার ঝাড়ন ফেলা; যখন অন্য চাকরদের উপর ফফরদালালি না করে, তখন সব ঘরের আসবাবগুলা ঝাড়িয়া মুছিয়া বেড়ায়। কতকটা ওর কাজের অভাবের জন্য এবং কতকটা ওর অধীনের চেয়ার, আরশির অস্বাভাবিক পরিচ্ছন্নতার জন্য অন্য চাকরেরা ওকে সম্ভ্রম করে। আরও একটা ক্ষমতা আছে লোকটার—খুব উঁচু দরের খবরের টুকরা-টাকরা সংগ্রহ করিয়া চারাইয়া দেওয়া। একদিন আমার ঘরের আসবাব-পত্রগুলা ঝাড়িতে ঝাড়িতে হঠাৎ মুখ তুলিয়া গম্ভীরভাবে বলিল, “শুনেছেন বোধ হয় মাস্টারমশা।”
আমি মুখের দিকে চাহিতে বলিল, “আমেরিকা আর এদের একটি পয়সা ধার দেবে না।”
আমি প্রথমটা একটু বিস্মিত হইলাম; তাহার পর সত্যই ও কিছু বুঝে কিনা, জানে কিনা পরীক্ষা করিবার জন্য প্রশ্ন করিলাম, “কাদের?”
জানে না, কিন্তু ঠকিল না লোকটা; একটু অবজ্ঞার হাসি হাসিয়া বলিল, “কিছুই খোঁজ রাখেন না দেখছি!”
তাহার পর পাছে আবার খোঁজ লইবার জন্য টাটকা-টাটকি উহারই দ্বারস্থ হই, সেই ভয়ে হাতের চেয়ারটাতে তাড়াতাড়ি ঝাড়ন বুলাইয়া বাহির হইয়া গেল।
কথাটা কিন্তু এখানেই শেষ হইতে দেয় নাই।—রাত্রে পড়িতে আসিয়াই তরু মুখটা বিষণ্ণ করিয়া বলিল, “আপনার এখান থেকে অন্নজল এবার উঠল মাস্টারমশাই!”
এ রকম অপ্রত্যাশিত গুরুতর সংবাদে বুকটা ছাত করিয়া উঠিল, যতটা সম্ভব শান্ত ও নির্লিপ্ত ভাব ফুটাইয়া প্রশ্ন করিলাম,—“সত্যি নাকি?—তা, হঠাৎ কি হল?”
তরু মুখটাকে বিকৃত কবিয়া বলিল, “বা–রে! পড়ে কি হবে আপনার কাছে? আমেরিকা যে অতবড় একটা মাড়োয়ারী মহাজন তার নাম পর্যন্ত জানেন না আপনি! গোয়েঙ্কা, মুরারকা, আমেরিকা –শোনেন নি এদের নাম?—বাবার মক্কেলই তো কতজন আছে।”
আমার মুখের পরিবর্তিত ভাব লক্ষ্য করিয়া সে-ও আর হাসি থামাইতে পারিল না। মুক্তকণ্ঠে হাসিতে হাসিতে বলিল, “রাজু বেয়ারা ঐ রকম মাস্টারমশাই, কিছু জানে না, বোঝে না, অথচ গালভরা খবর সব যোগাড় করে তাক লাগিয়ে দেবে।”
লোকটার চরিত্রে এই নূতন আলোকসম্পাতে আমার প্রথম দিনের একটা কথা মনে পড়িয়া গেল—রাজু আমায় বলিয়াছিল ব্যারিস্টার সাহেব একটা সিডিশান কেসে কুমিল্লায় গিয়াছেন। আমি একটু বিস্মিতও হইয়াছিলাম। তরুকে বলিলাম। তরু হাসিয়া জানাইল—রাজু বেয়ারার কাছে সিডিশানের যা অর্থ পার্টিশানেরও সেই অর্থ, অর্থাৎ কোন অর্থই নাই; ও শুধু ব্যারিস্টারদের সঙ্গে খাপ খায় এই রকম একরাশ শব্দ সুযোগমত সংগ্রহ করিয়া গভীর অধ্যবসায়ের সহিত কণ্ঠস্থ করিয়া রাখিয়াছে। যা-তা বলিয়া লোকদের ভুল খবর দেওয়ার জন্য প্রায়ই ধমক খায় মিস্টার রায়ের কাছে, চাকরি থেকে বরখাস্ত করিয়া দিবেন বলিয়া ভয় দেখান। বরখাস্ত যে করা হয় না, সেইটেই রাজু নিজের মর্যাদার পরিপোষক করিয়া চাকর-দাসীদের মধ্যে আস্ফালন করে, বলে, “দিন না ছাড়িয়ে, বারো টাকায় ইংরিজী-জানা বেয়ারা ফলছে গাছে!”
তরু বলিল, “বাবা হাল ছেড়ে দিয়েছেন মাস্টারমশাই। রাজু বেয়ারা বলেন না বলেন রেজো বেয়াড়া।”
নামের এই কদর্য অপভ্রংশে তরু আবার খুব এক চোট হাসিল।
রাজু বেয়ারার পরেই নাম করিতে হয় বিলাসের; বরং লাগে নাম করিলেই বেশি শোভন হইত, কেননা, এ-বাড়িতে রাজুর যদি এমন কেহ প্রতিদ্বন্দ্বী থাকে যাহাকে সে ভয় করে তো সে বিলাস। প্রতিদ্বন্দ্বী বলিলেও বরং বিলাসকে ছোট করা হয়। রাজু বেয়ারা আর সব চাকর-বাকরদের নিজের চেয়ে ছোট মনে করিয়াই তৃপ্ত, বিলাসের পূর্ণ বিশ্বাস রাজু একটা তৃণখণ্ড মাত্র, প্রয়োজন হইলে তাহাকে ফুৎকারে উড়াইয়া দেওয়া যায় অথবা বাক্যের স্রোতে নিরুদ্দেশ করিয়া ভাসাইয়া দেওয়া চলে। তবে বিলাস এটুকু করাকে পণ্ডশ্রম বা শক্তির অপব্যয় বলিয়া মনে করে, তাই নীরব অবহেলার দ্বারাই তাহার প্রতিদ্বন্দ্বীকে চাপিয়া রাখিয়াছে। তরুর মুখে শুনিয়াছি রাজু বেয়ারা যখন চাকর-বাকরদের মধ্যে কোন বড় কথা ফাঁদিয়া জমাইবার চেষ্টা করে, একবার খোঁজ করিয়া লয় বিলাস কাছে-পিঠে কোথাও আছে কিনা। যদি কোন প্রকারে আসিয়াই পড়ে গল্পের মাঝখানে, উপরের কোন ফরমাস লইয়া, তো রাজু থামিয়া যায়; আবার বিলাস শ্রুতির বাহিরে চলিয়া গেলে নাক সিঁটকাইয়া বলে, “ছুতো করে শুনতে এসেছিল! আমার বয়েই গেছে এসব কথা ওকে শোনাতে; শখ হয়েছে তোদের বলছি, কোন বাদশাজাদীর বয়না নিয়ে তো কথকতা শোনাচ্ছে না রাজু…”
বিলাসের এই শক্তির মূলে একটি আত্মচেতনা বর্তমান, সে অপর্ণা দেবীর বাপের-বাড়ির ঝি, রাজবাড়ির পরিচারিকা। অপর্ণা দেবী নিজে মাটির মানুষ, বিলাসের বিশ্বাস রাজবাড়ির মর্যাদা যাহাতে তাঁহার এখানে কোন রকমে ক্ষুণ্ণ না হয় সেই জন্যই বিশেষ করিয়া তাহাকে অপর্ণা দেবীর সঙ্গে এখানে পাঠানো হইয়াছে; যদি সত্যই হয় বিশ্বাসটা, তো লোক বাছাইয়ে রাজবাড়ি যে ভুল করে নাই এ-কথা বেশ স্বাচ্ছন্দেই বলা চলে। আজ প্রায় পঁচিশ-ছাব্বিশ বৎসর পূর্বে বিলাস রাজবাড়ি হইতে যে বায়ুমণ্ডল সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিল, এখনও সেটা বজায় রাখিয়াছে। এই জন্য সে এই আধুনিক রুচিসম্মত বাড়িতে কতকটা বেমানান,—তাহার চওড়া কস্তাপেড়ে শাড়ি, গা-ভরা সোনা-রূপার মোটা মোটা গহনা, গালে অষ্টপ্রহর পান-দোক্তা, নাকে নথ আর চালের গুরুত্ব এই হালকা ফ্যাশানের বাড়িতে অনেকটা বিসদৃশ। মনে পড়ে প্রথম বিলাস যখন আমায় অপর্ণা দেবীর আদেশে ডাকিতে আসে, আমি তাহাকে নবপ্রথা অনুযায়ী কপালে জোড়কর ঠেকাইয়া নমস্কার করি, ভগবানকে ধন্যবাদ দিই যে, ভাগ্যে পুরাতন প্রথাটা বিলুপ্ত হইয়া আসিতেছে, নয় তো নিশ্চয় পায়ের ধুলা লইয়া বসিতাম বিলাসের। যত দিন ছিলাম মনে বরাবরই একটা ধুকপুকুনি লাগিয়া থাকিত—বিলাস কথাটা ফাঁস করিয়া দেয় নাই তো? কখনও কখনও এরূপও মনে হইয়াছে, নমস্কারটা বাড়ির মাস্টারের কাছে ওর ন্যায্য প্রাপ্য বলিয়াই দেয় নাই ফাঁস করিয়া।
বিলাসের সঙ্গে ওর কর্ত্রীর এক দিক দিয়া একটা মস্ত বড় মিল আছে, ওকে দেখা যায় বড় কম,—আরও কম যেন; অপর্ণা দেবীর ঘরেও ওকে খুবই কম দেখিয়াছি। তবুও মাঝে মাঝে ওর প্রসঙ্গ এক মাধবার আসিয়া পড়িবে।
আর একটা কথা মনে পড়িয়া গেল। এই গম্ভীরা পরিচারিকাকে দু-এক বার মিস্টার রায়ের সঙ্গে স্থিতবদনে চট্টল চপলতার সহিত পরিহাস করিতে দেখিয়াছি,—তাহাদের বাড়ির জামাই হিসাবে। আধুনিক রুচির মাপকাঠিতে এই যে গুরু অপরাধ এটিও রাজবাড়িরই পুরানো চাল,—বিলাস বজায় রাখিয়া আসিয়াছে। দেখিয়াছি মিস্টার রায় বেশ উপভোগ করিয়া প্রসন্ন-বদনেই উত্তর-প্রত্যুত্তর দিয়াছেন। ব্যাপারটা গোপনীয় নয়, অপর্ণা দেবীর সামনেই হইয়াছে। যতদুর মনে পড়িতেছে, একবার অন্ততঃ তাঁহাকেও বিলাসের পক্ষ অবলম্বন করিতে দেখিয়াছি। সমস্ত ব্যাপারটির মধ্যে একটি অনির্বচনীয় মাধুর্য ছিল—চমৎকার একটি নির্মল সরসতা।
মনে হইত এই সামান্যা পরিচারিকা হঠাৎ অপর্ণা দেবীর ভগ্নীতে রূপান্তরিতা হইয়া মিস্টার রায়ের শ্যালিকার আসন গ্রহণ করিয়া বসিয়াছে।
রাজু বিলাসের পরে, শুধু একজন ছাড়া, আর সবাই এক রকম সাধারণ বলিলেই চলে—সোফার, যেমন হয় আর সোফার, পাচক-ঠাকুর—যে কোন পাচক-ঠাকুরেরই মত। মিস্টার রায়ের জন্য, বিশেষ করিয়া পার্টি প্রভৃতি উপলক্ষ্যের জন্য একজন বাবুর্চি আছে—সেও অন্য সব বাবুর্চির মত অল্পভাষী এবং তাহার রন্ধনের আভিজাত্য এবং উৎকর্ষের জন্য পৃথিবীটাকে কিছু নীচু নজরে দেখে। মাজা ঘষা ধোওয়া-মোছার জন্য একটি সস্ত্রীক পশ্চিমা চাকর আছে; অত্যন্ত খাটে এবং যখন কাজ থাকে না আউট- হাউসে নিজেদের বাসায় বসিয়া পরস্পর কলহ করে। বাকি থাকে মালী; তাহার একটু ইতিহাস আছে। আমার এ-কাহিনী ভালবাসারই কাহিনী; মালীর জীবনে ভালবাসার বা নারী-মোহের যে রূপ দেখিয়াছি তাহার একটু পরিচয় দিলে বোধহয় অন্যায় হইবে না। ইমানুল মালীকে আমি প্রথম দেখি বাগানেই। বিকাল বেলা, অলসভাবে ঘুরিয়া ঘুরিয়া নানা বর্ণের ফুলের বেডগুলি দেখিয়া বেড়াইতেছিলাম, ইমানুল বাগানের ওধার থেকে চারিটি ভায়োলেট ফুলের সঙ্গে ফার্ণের শীর্ষ লাগাইয়া একটা বাটন হোল তৈয়ারি করিয়া আমার হাতে দিল, ঝুঁকিয়া কপালে হাত দিয়া বলিল, “সেলাম মাস্টারবাবু।”
ৰলিলাম, “সেলাম, তুমি এই বাগানের মালী?”
ইমানুল হাতের ডালকাটা কাঁচিটাতে একটা শব্দ করিয়া হাসিয়া বলিল, “আজ্ঞে হেঁ বাবু।”
আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। এর পরে কি বলা যায়? বলিলাম, “বাগানটা রেখেছ চমৎকার, তোমার নাম কি?”
“ইমানুল।”
একটু বিস্মিত হইয়া চাহিলাম, মুসলমান—ইহাদের খুব একটা মালী হইতে দেখা যায় না। বলিলাম, “তা বেশ।… ইমানুল হক?”
আরও বিস্মিত হইতে হইল। ইমানুল হাসিয়া বিনীত গর্বের সহিত বলিল, “আজ্ঞে না বাবু, আমরা কেরেস্তান—রাজার যা ধর্ম্ম আর আপনার গিয়ে লাট সাহেবের যা ধৰ্ম্ম তাই আর কি।”
ক্রীশ্চান বলিতে আমাদের মনে সাধারণতঃ যে ধারণা জাগে এ তাহা হইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন। মসীতুল্য গায়ের রঙ, মুখের হাড়গুলা কিছু উঁচু, গলায় একটা কাঠের মালা, ডান হাতে রূপার একটা অনন্ত, মাথার তৈলমসৃণ চুলে একটা কাঠের চিরণী গোঁজা। বলিলাম, “ও, তাহলে তোমার নাম ইম্যানুয়েল বাঃ, বেশ; আমি মনে করিলাম—ইমানুল হক বুঝি।”
ইমানুল হাসিয়া বলিল, “আজ্ঞে না, মুসলমান নয়, রাজার যা ধৰ্ম্ম সেই।”
প্রশ্ন করিলাম, “বাড়ি কোথায়?”
“বাড়ি রাঁচি বাবু—আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“ও। কি জাত?”
‘ওরাঁও জাত আমরা।” ইমানুল বিকশিতদন্ত হইয়া আমার পানে চাহিয়া রহিল। মনে পড়িল ওদিককার আদিম অধিবাসীদের মধ্যে ক্রীশ্চানের ছুট বড় বেশি বটে। ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’ প্রভৃতি কাগজে ইহাদের সম্বন্ধে প্রবন্ধ পড়িয়াছি অনেক। সেই সব জাতেরই একজনকে সামনে পাইয়া কৌতূহল জাগিল। জিজ্ঞাসা করিলাম, “তা ইমানুল, ক্রীশ্চান কে হয়েছিল? তোমার বাপ, না ঠাকুর্দা?”
ইমাম্বুল বলিল, “না বাবু, আমি ধরম আপনি বদলিয়েছি।”
সামনেই একজন ধর্মান্তরগ্রাহীকে পাইয়া কৌতূহলটা আরও তীব্র হইয়া উঠিল—কি বুঝিল ইমানুল যে, নিজের ধর্ম ত্যাগ করিয়া বসিল? তাহার নিজের ধর্মের তুলনায় ক্রীশ্চান ধর্মের মহত্ত্ব? পাদ্রীর প্ররোচনা? রাজার সঙ্গে, রাজ প্রতিনিধির সঙ্গে ধর্মসাম্যের লোভ? না কি?
প্রশ্ন করিলাম, “কি ভেবে ছাড়লে ধর্ম তুমি ইমানুল?”
ইমানুল সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিতে পারিল না, একটু মুখ নীচু করিয়া লজ্জিত হাসির সহিত বলিল, “যীশু আমাদের ত্রাণ করার জন্যে জান দিয়েছিলেন বাবু, তাই—”
বেশ বোঝা গেল কিন্তু ইমানুলের এটা প্রাণের কথা নয়, কোথায় যেন একটা কি আছে। আরও কৌতূহল হইল, বলিলাম, “তাহলে তো আমাকে, মিস্টার রায়কে, রাজু বেয়ারাকে, জগদীশ সোফারকে—সবাইকেই ধর্ম পালটাতে হয় ইমানুল। বল বাজে কথা বলছি আমি?”
অবশ্য বাজে কথাই বলিলাম, কিন্তু যাহা অভীপ্সিত ছিল সেটুকু হইল। তর্কের গলদ কোথায় ধরিতে না পারিয়া অথবা পারিলেও সেটা গুছাইয়া ধরিতে না পারা—ইমানুল একটু থতমত খাইয়া চুপ করিয়া গেল। তাহার পর মাথাটা আবার নীচু করিয়া বগলের কাছটা চুলকাইতে লাগিল।
আমি সুযোগ বুঝিয়া বলিলাম, “ঠিক বলি নি আমি? মানে তোমায় দেখেই সন্দেহ হয়েছিল কি না যে এমন একজন চৌকস লোক…”
ইমানুল একবার আমার পানে চাহিল, তখনই আবার মাথাটা নামাইয়া লইয়া বলিল, “ঠিক খেয়াল করেছেন আপনি বাবু। আপনাকে না বলে কাকেই বা বলি?—এখন কথা হচ্ছে আপনাকে একটা চিঠি লিখে দিতে হবে বাবু আমায়।”
গভীর রহস্যের আভাস পাইয়া আমি উৎসাহের সহিত বলিলাম, “তা লিখে দেব না? বাঃ, এক-শ বার লিখে দেব। ব্যাপারটা খুলে বল দিকিন আগে।”
ইমানুল কুণ্ঠিতভাবে ঘাড়টা চুলকাইতে আরম্ভ করিল, “আজ্ঞে—মানে …”
বলিলাম, “হ্যাঁ বল, আরে আমায় বলবে তাতে আবার…”
“পাদ্রী সাহেবকে লিখতে হবে বাবু,–রেভারেও স্যামুয়েল চাইল্ড সাহেবকে।”
“এ তো খুব সহজ কথা, কি লিখব বল?”
ইমানুল আবার খানিকক্ষণ নিরুত্তর রহিল, তাহার পর আরও কুণ্ঠিতভাবে বলিল, “পাদ্রী সাহেবকে লিখতে হবে—টাকা কিছু জমেছে, কিছু জোগাড়ও হবে, এবার তুমি নাথুর মারফত যা কথা দিয়েছিলে তার একটা…”
এমন সময় বারান্দা হইতে রাজু বেয়ারা হাক দিল—“ইমানুল, তোকে বড়দিদিমণি ডাকছেন, শীগ্গীর আয়। হারামজাদা আপনাকে বুঝি বাট্ন-হোল ঘুষ দিয়ে চিঠি লেখাবার জন্য ধরেছে মাস্টার-মশা?…এলি?—জলদি আয়।”
প্রথম দিন এই পর্যন্তই টের পাই। ইমানুলের কথা আবার যথাস্থানে তোলা যাইবে।