আরও একদিন তাঁহাকে বাহিরে দেখিয়াছিলাম। দিনটা কখনও ভুলিব না।

আমার রুটিনের মধ্যে একটা কাজ বৈকালে তরুকে লইয়া মোটরে করিয়া বেড়াইতে যাওয়া; পূর্বে যে-সময়টা কলেজ হইতে ফিরিবার পথে তিনবার ইউনিভার্সিটি-ফেরত সেই ধাড়ি ছেলেটাকে লইয়া কসরৎ করিতে হইত।

মোটর আসিয়া গাড়ি বারান্দায় দাঁড়াইয়াছে। তরুর কি কারণে উপরে একটু বিলম্ব হইতেছে, আমি বেয়ারাটাকে তাগাদায় পাঠাইয়া বারান্দায় অপেক্ষা করিতেছি।

মোটরের ক্লীনারটা গেট খুলিতে গিয়াছিল; হঠাৎ কানে আসিল সেখানে কাহার সহিত চেঁচামেচি লাগাইয়াছে। গাড়িবারান্দার বাহির দিকটায় তারের জাল বসাইয়া এক ঝাড় মর্ণিং গ্লোরির লতা তোলা হইয়াছে; ও-দিকটা দেখা যায় না। বারান্দা হইতে নামিয়া আসিয়া দেখিলাম ক্লীনারটা একটা ভুটানী বুড়ীর সহিত বচসা করিতেছে। ভুটানীটা বোধ হয় বাহিরে অপেক্ষা করিতেছিল; গেটটা খোলা পাইয়া ভিতরে আসিবে, ক্লীনার আসিতে দিবে না। লোকটা অত্যন্ত ভীরু। ভীরু লোকদের বিশেষত্ব এই যে, তাহারা দুর্বল দেখিলে অত্যন্ত সাহসী হইয়া উঠে, বোধ হয় এই করিয়া নিজেদের চরিত্রের ব্যালান্স বা ভারসাম্য রক্ষা করিয়া চলে। বুড়ীকে দেখিয়া হাত-পা ছুঁড়িয়া খুব তম্বি করিতেছে। ভুটানীটার মুখে আর কোন কথা নাই, অত্যন্ত দীন মিনতির সঙ্গে গ্রীবা হেলাইয়া এক-একবার কপালে হাত দিয়া সেলাম করিতেছে, এক-একবার ধীরে ধীরে হাতটা বুকে চাপিয়া বলিতেছে—“বেটা—বেটা!” অত্যন্ত কাহিল, বাঁ-হাতে গেটের একটা ছড় চাপিয়া ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছে।

আমায় দেখিয়া ক্লীনার গলা উঁচাইয়া রসিকতা করিয়া বলিল, “কি আমার লবদুর্গার মত চারদিক আলো করে মাঠাকরুণ এসে দাঁড়িয়েছেন, ওঁর বেটা হতে হবে!…ভাগো জলদি; নেই তো মোটরমে থ্যাঁৎলায়ে দেগা…”

ভুটানীটা যেন আর পারিল না; হাত তাহার আল্‌গা হইয়া গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে—“বেটা—বেটা!” বলিয়া হাউহাউ করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে দুই হাতে বুক চাপিয়া সুরকির উপর বসিয়া পড়িল। ক্লীনারটা আর এক ঝোঁকে পৌরুষের সঙ্গে তাহাকে বোধ হয় টানিয়া তুলিতে যাইতেছিল, উপর তলায় অপর্ণা দেবীর ঘর হইতে উৎসুক প্রশ্ন হইল—“কি বলছে ও মদন?–কি বলছে? বেটার কি হয়েছে ওর?”

দেখি অপর্ণা দেবী জানালা খুলিয়া দুইটা গরাদ ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছেন, মুখে একটা নিদারুণ উৎকণ্ঠার ভাব, মুখটা ঈষৎ হাঁ হইয়া গিয়াছে, অমন শান্ত চক্ষু দুইটাতে রাজ্যের উদ্বেগ। কিছু বুঝিলাম না; এমন কি হইয়াছে যাহার জন্যে তিনি এত বিচলিত একেবারে!

মদন বলিল, “দেখুন না মা, ‘ব্যাটা-ব্যাটা’ করে ভুজুং দিয়ে ভেতরে আসবার মতলব; গায়ের গন্ধে ভূত পালায়, ব্যাটা হও ওনার!”

আবার টানিয়া তুলিতে যাইতেছিল, অৰ্পণা দেবী কর্কশ কণ্ঠে একরকম চীৎকার করিয়া উঠিলেন, “ছেড়ে দাও ওকে! চলে এস তুমি, তোমার ব্যাটা হতে হবে না, ভাবনা নেই তোমার! এলে চলে?”

হঠাৎ জানালার নিকট হইতে সরিয়া গেলেন এবং বেশ বোঝা গেল অত্যন্ত চঞ্চল এবং অধৈর্য গতিতে নামিয়া আসিতেছেন। বাহিরে যাহারা ছিল সবার মুখে একটা স্তম্ভিত ভাব, সবাই সবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। অপর্ণা দেবী চাকরবাকরকে একটা উঁচু কথা বলেন না, আর এ একেবারে রূঢ় হইয়া পড়া! ক্লীনার মদন মাথাটা হেঁট করিয়া ধীরে ধীরে আসিয়া মোটরটার কাছে দাঁড়াইল।

অপর্ণা দেবী কোন দিকে দৃকপাত না করিয়া একেবারে ভূটানীর সামনে গিয়া ঝুঁকিয়া দাঁড়াইলেন এবং এক হাতে তাহার বক্ষোলগ্ন একটা হাত ধরিয়া অপর হাতে তাহার মুখটা তুলিয়া উদ্বিগ্নভাবে প্রশ্ন করিলেন, “কেয়া হুয়া হ্যায় বেটাকা?”

ভুটানীটা একবার মুখের পানে চাহিল, স্ত্রীলোক দেখিয়া আরও উচ্ছ্বসিত ক্রন্দনে ভাঙিয়া পড়িল, বুকটা চাপিয়া বলিল, “বেটা—বেটা!…”

আমরা গিয়া পাশে দাঁড়াইয়াছি। জায়গাটা নূতন আর বিরলবসতি হইলেও নিতান্ত রাস্তার ধারের ঘটনা—গেটের বাহিরে জনকয়েক লোক জড় হইয়া গিয়াছে। অত্যন্ত খাপছাড়া দেখাইতেছে ব্যাপারটা,—অতিশয় নোংরা ময়লা আর ছেঁড়া, পুরু, ওদেশের লুঙ্গিপরা সেই ভুটানী, আর তাহার পাশেই এই অভিজাত মহিলা,—আশ্চর্যভাবে অধীর, কতকটা যেন পাগলের মত।…তরুর মুখটা শুকাইয়া গিয়াছে, চাকরদের সবাই ভীত, আমার মাথায় কোন ধারণাই আসিতেছে না—ব্যাপারটা কি। মীরা থাকিলেও না-হয় একটা কোন ব্যবস্থা হইত, সে প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে বাহির হইয়া গিয়াছে।

অপর্ণা দেবী আমার মূখের দিকে একটু ফ্যাল্ ফ্যাল্ করিয়া চাহিয়া রহিলেন, তাহার পর বলিলেন, “ভয়ানক মুশকিলে পড়া গেল তো শৈলেন, ও আমার কথা বুঝতে পারবে না, অথচ এটা ঠিক যে ওর ছেলে নিয়ে উৎকট রকম কিছু একটা হয়েছে—আমি বুঝতে পারছি কি না…”

একবার প্রায় উপস্থিত সকলের মুখের দিকে বিমূঢ়ভাবে চাহিয়া লইয়া আমায় প্রশ্ন করিলেন, “কি করা যায় বল দিকিন?”

বুড়ী বুক চাপিয়া অঝোরে কাঁদিতেছে, তাহার জীর্ণ গালের রেখা বহিয়া অশ্রু নামিয়াছে। বুক চাপিয়া একবার ডাইনে একবার বাঁয়ে মাথা দুলাইতেছে, আর ঐ এক বুলি—“বেটা—বেটা!”

আমাদের পাশের বাড়িটা একজন অ্যংলো-ইণ্ডিয়ানের—এ বাড়ির সঙ্গে অল্পবিস্তর ঘনিষ্ঠতা আছে। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি আসিল, “পাশে এ বাড়িতে ভুটানী আয়া-টায়া নেই কি? আজকাল সায়েবরা প্রায় নেপালী কিংবা ভুটানীই রাখে।

অপর্ণা দেবীর মুখটা দীপ্ত হইয়া উঠিল, বোধ হয় মুহূর্তমাত্র সময় যাহাতে নষ্ট না হয় সেজন্য আমায় কিছু না বলিয়া একেবারে তরুকে বলিলেন, “ঠিক, যাও তো তরু মিসিস রিচার্ডসনকে বল—Auntie will you please spare your ayah for a couple of minutes?—Mummy wants her badly, … run, there’s a dear.” (খুড়িমা, তোমার আয়াকে মিনিট দুয়েকের জন্যে ছেড়ে দিতে পারবে কি? মার বিশেষ দরকার…দৌড়োও, লক্ষ্মীটি।)

বুঝিলাম উগ্র উত্তেজনায় অপর্ণা দেবীর সংযত জীবন ভেদ করিয়া তাঁহার কলেজ-যুগের কয়েকটা মুহূর্ত আসিয়া পড়িয়াছে। মেয়ের সঙ্গে তাঁহাকে ইহার আগে এমনি কখনও ইংরেজী বলিতে শুনি নাই, পরেও শুনিয়াছি বলিয়া মনে পড়ে না; এ-বিষয়ে তাঁহার স্বদেশীয়ানা অত্যন্ত কড়া।

আন্দাজ আমার ঠিক ছিল; একটা ঐ জাতেরই আয়া আসিয়া অপর্ণা দেবীকে সেলাম করিয়া দাঁড়াইল। অপর্ণা দেবী তাহাকে ভাঙা ভাঙা হিন্দীতে বলিলেন, “একে জিজ্ঞাসা কর তো এর ছেলে সম্বন্ধে কি বলতে চায়—কি হয়েছে তার?”

চীনা ভাষার মত একটা ভাষায় উহাদের মধ্যে খানিকটা কি প্রশ্নোত্তর হইল। বৃদ্ধার কান্না আরও উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিয়াছে। আয়া ভাঙা ভাঙা হিন্দীতে বুঝাইয়া দিল—বুড়ির ছেলে আজ বৎসরাবধি নিরুদ্দেশ। গত বৎসর শীতে তাহারা কয়জন মিলিয়া কুকুর, ছাগল, চামরী-গরুর লেজ, হরিণ আর ছাগলের চামড়া প্রভৃতি লইয়া হিন্দুস্থানে ব্যবসা করিতে নামিয়াছিল। একদল গত বৎসরেই শীতের শেষে ফিরিয়া যায়। তাহার ছেলে তাহাদের মধ্যে ছিল না। গ্রামের একটি লোকের মারফত মায়ের জন্য সাতটি টাকা ও একটা ফুলকাটা জ্বলজ্বলে গোলাপী রঙের ইটালীয়ান র‍্যাপার কিনিয়া পাঠাইয়া দেয়। আর খবর দেয় যে, তাহারা মাস ছয়েকের মধ্যে ফিরিবে। পাশের গ্রামের আর একটি দম্পতি নামিয়াছিল। দুই মাস নয়, মাস-পাঁচেক পরে তাহারা ফিরিল, বৃদ্ধার সহিত দেখা করিয়া পাঁচটা টাকা আর চব্বিশ-ফলার একটা ছুরি দিয়া বলিল—ছেলে পাঠাইয়া দিয়াছে, তাহাদের হাজার বলা সত্ত্বেও কোনও মতে ফিরিল না। অন্য পথে একদল ভুটিয়া নামিয়াছিল, তাহাদের দলে ভিড়িয়া যায় খুব সত্তৰত সেই দলের একটি তরুণীর আকর্ষণে—বলে মায়ের বড় কষ্ট, হিন্দুস্থানে কিছু রোজগার করিয়া সে একেবারে ফিরিবে।

বৃদ্ধা বুকের উপর হইতে নকল প্রবালের তিন-চার ছড়া মালা সরাইয়া জামার ভিতর হইতে সযত্বে পাট-করা একটা গোলাপী রঙের ফুলকাটা র‍্যাপার আর একটা নানা ফলার ছুরি বাহির করিয়া সাশ্রুলোচনে মাথা দোলাইয়া আয়াকে কি বলিল। আয়া অপর্ণা দেবীকে বলিল– “বলছে, ও বুদ্ধের মালা ছুঁসে শপথ করছে, ব্যাটার বউকে কিছু বলবে না, একটুও কষ্ট দেবে না, এই র‍্যাপার আর ছুরি তাকেই যৌতুক দিয়ে দেবে, তাই কখনও নিজের কাছ ছাড়া করে না।”

দৃশ্যটা বড়ই করুণ, অনেকের চক্ষে জল আসিল, শুধু অপর্ণা দেবীব চক্ষু দুইটা যেন অধিকতর উত্তেজনায় আরও শুষ্ক ও দীপ্ত হইয়া উঠিল। একবার আমার দিকে একবার আয়ার দিকে চাহিয়া বিহ্বলভাবে বলিলেন, “এত লোকের মাঝখানে খোঁজা আর সে কোন্ শহরে আছে তাই বা কে জানে?”

হঠাৎ আয়ার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া বলিলেন, “আচ্ছা, এত জায়গা থাকতে কলকাতায় এল কেন খুঁজতে ও?”

কি উত্তর দেয় শুনিবার জন্যে আগ্রহে চক্ষু দুইটা যেন তাঁহার ঠিকরাইয়া বাহির হইয়া আসিতেছিল।

টের পাওয়া গেল–পাহাড় হইতে নামিয়া বৃদ্ধা খবর পাইল কলিকাতা সবচেয়ে জনবহুল জায়গা, অনেক ভুটিয়াও প্রতি বৎসব এখানে আসে, তাই সে বারটি টাকা সংগতি করিয়া পরশু এখানে আসিয়া পড়িয়াছে। তাহাদের গ্রামে তেরটি ঘরের বসতি, অনেক ছেলেবেলায় একবার ভুটানের রাজধানী পানাখা দেখিয়াছিল, মহানগরী সম্বন্ধে কোন ধারণা ছিল না, এখানে আসিয়া একেবারে অথৈ জলে পড়িয়া গিয়াছে। এখনও পর্যন্ত একটি ভুটিয়ার মুখ দেখে নাই, কেহ কথা বোঝে না, হাতে পয়সা নাই, আজ সকাল থেকে কিছু খায় নাই। সবচেয়ে নিরাশার কথা—বুদ্ধ তাহাকে দয়া করিয়া নিজের কাছে ডাক দিয়াছেন মুক্তি খুবই কাছে, কিন্তু ছেলেকে একবার শেষ দেখিবার সম্ভাবনাটা একেবারেই সুদূর হইয়া পড়িয়াছে।

অপর্ণা দেবী আরও আশ্চর্য কাণ্ড করিয়া বসিলেন,—যেমন আশ্চর্য, তেমনি অশোভন, দাঁড়াইয়া শুনিতেছিলেন, হঠাৎ বসিয়া পড়িলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধাকে বুকে জড়াইয়া ধরিয়া পিঠে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিতে লাগিলেন, “মিলেগা—বেটা মিলেগা, চলো উঠো, বুঢ়ীমাঈ, উঠো।”

এই অপ্রত্যাশিত সমবেদনায় বৃদ্ধা যেন একেবারে মুষড়াইয়া গেল। মাঝে মাঝে যে “বেটা—বেটা” করিতেছিল সেটাও বাহির হয় না মুখ দিয়া; শুধু চাপা কান্নার আওয়াজ—জীর্ণ শরীরটা যেন শতধা ভাঙিয়া পড়িবে। বুঝিতে পারিলাম—অপর্ণা দেবীরও কান্না নামিয়াছে।

কিছুক্ষণ পরে শমিত হৃদয়াবেগ লইয়া অপর্ণা দেবী ধীরে ধীরে উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বৃদ্ধার একটা হাত ধরিয়া বলিলেন, “উঠো।”

বৃদ্ধা ডান হাতে লোহার গরাদ ধরিয়া, কাঁপিতে কাঁপিতে উঠিল। অপর্ণা দেবী তাহার বাঁ হাতটা নিজের বাঁ-হাতে ধরিয়া, ডান হাতে তাহার পিঠটা জড়াইয়া, ধীরে ধীরে সুরকির রাস্তা অতিক্রম করিয়া সিঁড়ি বাহিয়া নিজের ঘরের দিকে চলিয়া গেলেন। যেন একই শোকে আচ্ছন্না দুইটি সখী—সব জিনিসেরই অমিল—জাতির, বয়সের, সজ্জার, শুচিতার,—মিল শুধু এইটুকুতে যে, দু’জনের বুকে একই ব্যথা—হৃদয়ের একই তন্ত্রীতে ঘা পড়িয়াছে।

ব্যাপারটা বুঝিতে পারিলাম সেই রাত্রে।

তরু পড়িতেছে, আমি কিছু অন্যমনস্ক, আজ বিকাল হইতে মনের সামনে একটা ছবি মাঝে মাঝে স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে। সুদূর হিমালয়ের এক জনবিরল পল্লীতে, একখানি গৃহে প্রবাসী পুত্রের পথ চাহিয়া এক বৃদ্ধা, দিন যায়, মাস যায়, বৎসর ঘুরিয়া গেল—পরিত্যক্ত ঘরের শিকল তুলিয়া দিয়া দুর্বল কম্পিত চরণে বৃদ্ধা পাহাড়ের বিসর্পিত পথ বাহিয়া নামিতেছে,–ঘরের স্মৃতির সঙ্গে পাহাড়ের স্তূপ পিছনে পড়িয়া রহিল—সামনে প্রসারিত হিন্দুস্থানের দিগন্ত-বিস্তৃত সমতল—কোথায় পুত্র? যোজন প্রসারী দৃষ্টির মধ্যে তাহার কোন সন্ধান পাওয়া যায় না। মরীচিকার মত কলিকাতার উর্মিল আকাশরেখা—সেই মরীচিকার মধ্যে বিকৃত তৃষ্ণা- “বেটা—বেটা।” তাহার পর বিকালের সেই সমস্ত দৃশ্যটা, যাহার অর্থ এখনও ঠিকমত মাথায় আসিতেছে না। “বেটা—বেটা।” আর সেই বেদনাতুর অবোধ সান্ত্বনা—“উঠো, বেটা মিলেগা—বুঢ়ী মাঈ, উঠো…”

তরু পড়ার মধ্যেই এক সময় প্রশ্ন করিল, “মাস্টারমশাই, জানেন?”

প্রতিপ্রশ্ন করিলাম, “কি?”

“মা কারুর ছেলের কথা হলে একেবারে কি রকম হয়ে যান, দাদার কথা মনে পড়ে যায়। আর একটা জিনিস মিলিয়ে দেখবেন’খন বলে দিচ্ছি আপনাকে।”

প্রশ্ন করিলাম, “কি মিলিয়ে দেখব তরু?”

“মা ঠিক এবারে অসুখে পড়ে যাবেন। কালই উঠে দেখবেন আপনি। ওঁর সামনে কারুর ছেলে নিয়ে কোন কষ্টের কথা তোলা একেবারে মানা।”

আমার মুখের উপর আয়ত চক্ষু দুইটা রাখিয়া ঘাড় দুলাইয়া বলিল, “হ্যা মাস্টারমশাই, একেবারে ডাক্তারের মানা। দাদার কাণ্ডটা…”

সামলাইয়া লইয়া আড়চোখে আমার পানে একবার চকিতে চাহিয়া তরু অধিকতর মনোযোগের সহিত আবার পড়িতে লাগিল। একটু অস্বস্তির ভাব—এখনই যেন গূঢ় কি একটা পারিবারিক রহস্য প্রকাশ করিয়া ফেলিত আর কি!

আমার মনে পড়িয়া গেল—প্রথম যেদিন অপর্ণা দেবীর সহিত পরিচয় হয়, প্রসঙ্গক্রমে উত্তেজিত ভাবে বলিয়া উঠিয়াছিলেন “তুমি জান না তাই বলছ শৈলেন, আমার নিজের ছেলে ঐ রকম আত্মবিলুপ্ত।” মীরা-তরু আসিয়া পড়ায় কথাটা আর পরিষ্কার হয় নাই সেদিন।

রহস্যটা পীড়া দিতেছিল; কিন্তু তখন আর তরুকে এ-বিষয়ে কোন প্রশ্ন করা সমীচীন মনে করিলাম না।