দশ দিন হইল আসিয়াছি; রবিতে রবিতে আট দিন গিয়াছে, কাল সোম আজ মঙ্গল। মন্দ লাগিতেছে না। আমরা, যাহারা অপেক্ষাকৃত নীচু স্তরে থাকি, বড়-মানুষ হওয়াটাকে সাধারণতঃ একটা অপরাধ বলিয়া ধরিয়া লই, সেই জন্য উহাদের সম্বন্ধে কতকগুলো মনগড়া ধারণা করিয়া বসি। ভ্রান্ত ধারণাগুলি একে একে বিদায় লইয়া এই পরিবারের সঙ্গে আমায় ক্রমেই ঘনিষ্ঠ করিয়া দিতেছে। দেখিতেছি যেমন ‘বিলাত দেশটা মাটির’, তেমনই আবার বড় মানুষেরাও মানুষ, মানুষের অতিরিক্ত কিছু নয়, তেমনই আবার মানুষের চেয়ে কমও কিছু নয়। ধারণা ছিল শুধু দুঃখের দাহনই খাদ নষ্ট করিয়া খাঁটি মানুষের সৃষ্টি করে; এখন দেখিতেছি সুখের মধ্যে, প্রাচুর্যের মধ্যেও মনুষ্যত্বের বিকাশ সম্ভব। সত্যই তো, মানুষ আওতাতেও যখন বাড়িবার শক্তি রাখে তখন আলো-বাতাসের স্বচ্ছন্দতায় কেন বাড়িবে না?

কথাটাকে আরও একটু বাড়াইয়া বলা। আলো-বাতাস কিংবা আওতা তাহার মনে; বাহিরের অনুকূল অবস্থার সঙ্গে তাহার বিশেষ কোন সম্বন্ধ নাই।

অনিলের কথা মনে পড়িয়া গেল, অনিল বলে, “ভাই,—আসলে সুখ-দুঃখ অর্থ-দারিদ্র্যের মধ্যে কোন তফাত নেই, কাজেই খাঁটি মনের ওপর কোনটারই দাগ পড়ে না। মানুষ জাতটাই মামলাবাজের জাত, ঘর-ভাঙবার জাত—অন্নপূর্ণা আর শিবকে চায় আলাদা করতে। একজনকে কারে ফেলে হাত পাতায়, একজনকে দিয়ে সেই হাতের আঁজলার ওপর সোনার হাতা ওলটায়; ভাবে এবার বুঝি ভাঙল মন দু’জনের, পাক্‌লো মামলা। দু’জনে কিন্তু সুখ-দুঃখের যুগ্মরূপে চিরদিনই সেই একই চালার মধ্যে কাটিয়ে আসছেন, কাটাবেনও।”

একটু দার্শনিক উচ্ছ্বাস আসিয়া গেল কি? আসলে কথাগুলা মনে আসিয়া পড়িল মীরার মা অপর্ণা দেবীর কথা তুলিতে গিয়া।—সুখের মধ্যে মনুষ্যত্বের বিকাশের প্রসঙ্গে।

উনি মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের এক পুরাতন রাজবাড়ির মেয়ে। জ্যাঠা-বাপ-খুড়ারা এখন কুমার-বাহাদুর, ছোট কুমার, মেজ কুমারে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন বটে, কিন্তু ঠাকুরদাদা পর্যন্ত, কুহেলী-আবৃত অতীত হইতে সবাই ‘রাজা বাহাদুর,’ ‘রাজা সাহেব, ‘ ‘রাজা’ খেতাব ধারণ করিয়া আসিয়াছেন। অথচ মনে হয় এ-বাড়ির আর সবাই এ-কথাটি জানিলেও অপর্ণা দেবী নিজে যেন জানেন না।

বাড়ির মধ্যে ওঁর স্থানটি একটু অদ্ভুত গোছের। অতুল ঐশ্বর্যের মধ্যে যেন উনি একটি বৈরাগ্য-আশ্রম রচনা করিয়া বাস করিতেছেন। অপর্ণা দেবীর জ্ঞানের গভীরতার একটু আভাস এক জায়গায় দিয়াছি পরে জানা গেল ওঁর একটা কলেজজীবনও ছিল। সেই জীবনের কৃতিত্বও এত বেশি যে ওঁর অভিভাবকেরা এঁকে বিলাত পাঠাইবার লোভও সংবরণ করিতে পারেন নাই, যদিও সেযুগে ওটা প্রায় কল্পনাতীত ব্যাপার ছিল। অভিভাবকের মধ্যে পিতৃপক্ষ শ্বশুরপক্ষ উভয়পক্ষই ছিলেন, কেননা তখন বিবাহ হইয়া গিয়াছে। এত উগ্র আলোকের নেশার যে একেবারেই কারণ ছিল না এমন নয়,—উভয়পক্ষেই কয়েকজন আই-সি-এস, ব্যারিস্টার ছিল, অর্থাৎ বিলাত জিনিসটা অনেকটা ঘরোয়া ব্যাপার হইয়া উঠয়াছিল। স্বামী বিলাতে, ইনার টেম্পলে ব্যারিস্টারি খানা খাইতেছেন। কথা হইল তিনি আরও কিছুদিন থাকিয়া যাইবেন, স্ত্রী গিয়া কেম্ব্রিজে ভর্তি হইবেন। অদ্ভুত প্রতিভাশালিনী কন্যা,—ওঁকে লইয়া অসাধারণ রকম কিছু একটা করিতে উভয়পক্ষই যেন মাতিয়া উঠিলেন।

সব ঠিকঠাক, অপর্ণা দেবী পা বাড়াইয়া আবার টানিয়া হইলেন।

তাহার পর হইতে ধীরে ধীরে একটা পরিবর্তন আসিতে লাগিল। যথাসময়ে স্বামী গুরুপ্রসাদ সাহেবী দাম্পত্য-জীবনের স্বপ্ন এবং তালিম লইয়া ব্যারিস্টার মূর্তিতে ফিরিলেন। স্ত্রীকে বিলাতে না পান, একটা সান্ত্বনা ছিল বিলাতকে স্ত্রীর নিকট হাজির করিতেছেন। দেখিলেন স্ত্রী কালী ঘাটের কালী হইতে রবিবর্মার কমলা পর্যন্ত উগ্র শান্ত হরেক রকম দেবদেবীর আশ্রয়ে। পত্রাদিতে কোনরকম আঁচ পান নাই, একেবারে অবাক হইয়া গেলেন। প্রায় বৎসর দুই ধরিয়া অনেক চেষ্টা হইল, কিন্তু তাঁহাকে সঙ্গীচ্যুত করা গেল না। এই সময়ে অপর দিকের ইতিহাস মীরার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার জন্ম—সে প্রায় পঁচিশ বৎসরের কথা। প্রায় ছয় বৎসর পরে মীরার জন্ম, আরও নয়-দশ বৎসর পরে জন্ম তরুর।

এই দশ দিনে জানা গেল মীরার দাদা নীতিশকে লইয়া এই বাড়িতে একটা ট্র্যাজেডির সুর আছে এবং এটাও বুঝিয়াছি এ-সুর অপর্ণা দেবীর জীবনকে প্রভাবিত করিয়াছে সব চেয়ে বেশি। জীবনের সঙ্গে অৰ্পণা দেবীর একটা লুস্থ ভোগের সম্বন্ধ আর নাই, উনি যেন সংসারে আছেন অথচ নাই-ও। দোতলার এক প্রান্তে নিজের ঘরটিতেই থাকেন বেশিক্ষণ, যতদূর জানিতে পারিয়াছি সাথী ওঁর অধিক সময়েই বই। কক্ষত্যাগের নিয়মিত সময় চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে দুইটি, এক সকালে, স্বামী যখন আহারে বসেন; আর এক রাত্রে, স্বামী, মীরা, তরু—সকলে যখন আহারে বসে। উনি যে সংসারে আছেন এই সময়টা একবার করিয়া মনে পড়ে সবার। আমিও মীরাদের সঙ্গেই আহার করি, গল্পে নামাইবার চেষ্টা করি অর্পনা দেবীকে। এক-এক দিন উচ্ছ্বসিত স্রোতে নামিয়া পড়েন, অনেক আলোচনা হয়, হাল্কা এবং গুরুও—যেমন প্রথম দিন হইয়াছিল। এক-এক দিন অপর্ণা দেবী থাকেন অন্যমনস্ক, স্বল্পবাক্, ঘরটাতে একটা থমথমে ভাব জমিয়া থাকে, মীরাদের কি হয় জানি না, আমার তো আহার্যগুলাও যেন গলা দিয়া নামিতে চায় না।

আহারের সময় ব্যতীত এই দশ দিনে মাত্র তিনবার অপর্ণা দেবীকে তাঁহার কক্ষের বাহিরে দেখিয়াছি; দুই দিন অপরাহ্ণে, বাগানের মধ্যে। বলিতে তুলিয়া গিয়াছি বাগানটায় এই কয়দিনে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন আসিয়াছে। কাচির শাসন অবশ্য পূর্বরূপই, তবে নূতন বসন্তের সাড়া পাইয়া যেখানে যা ফুল ছিল এই শেষের দিকে সাত-আট দিনে যেন হুড়াহুড়ি করিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে। নানা রঙের কাপড়-চোপড় পরা একপাল শিশু যেন কোথায় আবদ্ধ ছিল, হঠাৎ মুক্তি পাইয়াছে। নূতন বসন্তের আতপ্ত অপরাহ্ণে রঙে-গন্ধে বোঝাই এই বাগানটা আমায় অমোঘ আকর্ষণে টানে। দুই দিন অপর্ণা দেবীও নামিয়া আসিয়াছিলেন। একদিন আলোচনা হইল ফুল সম্বন্ধে, কিছু উচ্ছ্বসিত আলোচনা। প্রত্যেকটি ফুলের নাম জানেন, অনেকগুলার ইতিহাস জানেন। ইহার আগে জানিতামই না যে, ফুলের আবার একটা ইতিহাস আছে এবং সেটা রাজারাজড়ার ইতিহাসের মত শিখিবার জিনিস। গল্প করিতে করিতে বেড়াইতে ছিলাম—পরিচয় দিয়া যাইতেছেন, হঠাৎ একটা বিচিত্র বর্ণের মরশুমী ফুলের বেডের সামনে দাঁড়াইয়া পড়িয়া ঘুরিয়া বলিলেন—“শৈলেন, এত ভাল লাগে আমার শীতের মাঝখান থেকে বসন্তের গোড়া পর্যন্ত এই সময়টা, সমস্ত বছর যেন প্রতীক্ষা করে থাকি। জান তো এ ফুলগুলো ওদের দেশের মাঝ-বসন্তের ফুল, আমাদের দেশে ফুটতে আরম্ভ করে বেশ একটু শীত পড়লে। ওরা এই সব দিয়ে আমাদের শীতের চেহারা বদলে দিয়েছে। ঐ ফুলগুলো চিরস্থায়ী হল এদেশে, আরও ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের পরাজয়ের গ্লানির মধ্যে এইগুলো থাকবে সান্ত্বনা হয়ে…”

শুধু কথাগুলা নয়, বলিবার সময় ওঁর চেহারাও হইয়া উঠিয়াছিল অপরূপ। কতক যেন আবেশভরে বলিয়া যাইতেছেন–আয়ত চক্ষু দুইটি স্থির দৃষ্টিতে উপরে নীচে এক-এক জায়গায় বা আমার মুখের উপর এক-একবার নিবদ্ধ হইয়া যাইতেছে, যেন স্বপ্নলোকে বিচরণ করিতেছেন। একটু যে বেশি ভাবালু হইয়া পড়িয়াছেন, আমি যে খুব বেশি পরিচিত নই এখনও; সে-সব দিকে লক্ষ্য নাই। উনি যেন চেষ্টা করিয়া কিছু বলিতেছেন না ওঁর অন্তর্লোকে যে-সব ভাবনা উঠিতেছে সেগুলাই যেন আপনা হইতে বাক্যে উৎসাবিত হইয়া উঠিতেছে মাত্র! সেদিন ওঁর ইংরেজী বলিবার মধ্যেও এই জিনিসটি লক্ষ্য করিয়াছিলাম; যা অন্তরে জাগে তা প্রকাশ করিবার মধ্যে সংকোচ বা কৃপণতা থাকে না।

এমন অনাবিল কবি-প্রকৃতি আমার নজরে আর পড়ে নাই।

কয়েক দিন পরে আর একবার এঁকে বাগানে দেখি, দুপুর গড়াইয়া গিয়াছে। আমি একটা ঘনপল্লবিত কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় একটি বেঞ্চে বসিয়া বই পড়িতেছিলাম, হঠাৎ ওঁর শাড়ির চওড়া পাড়ের উপর নজর পড়িয়া যাওয়ায় উঠিয়া দাঁড়াইলাম। অপর্ণা দেবী সস্মিত বদনে আমার মুখের পানে চাহিয়া বলিলেন, “ব’স তুমি।”

তাহার পর আগাইয়া গেলেন। বুঝিলাম আজ আরও পুষ্পাবিষ্ট!‥ প্রায় ঘণ্টাখানেক ছোট বাগানটিতে নীরবে ঘুরিয়া ফিরিয়া আবার ধীরে ধীরে উপরে উঠিয়া গেলেন।

এই দুই দিন।