৫
এ এক সম্পূর্ণ অন্য মীরা।
এমন কলহাস্য আর লুটোপটি করিতে করিতে প্রবেশ করিল যেন তরুর বড় বোন নয় মীরা, পরন্তু সমবয়সী সখী। পরে বোঝা গেল মাকে দখল করিবার জন্য মোটর হইতে নামিয়াই ওদের রেস আরম্ভ হইয়াছে। তরু ছোট বলিয়া ক্ষিপ্রগতি, সেজন্যও, এবং দুয়ারের পর্দার সঙ্গে মীরার আঁচল একটু জড়াইয়া যাওয়ার জন্যও, সেই-ই গিয়া আগে মায়ের কোলে ঝাঁপাইয়া পড়িল। মীরা কাছে গিয়া ক্ষণমাত্র চিন্তা করিল, তাহার পর বলিয়া উঠিল, “ঐ যাঃ, বাবা এসে বলবেন কি? তোমার হার্ম্যানের বাড়ির অমন ফ্রকটা যে একেবারে…!”
“কি হয়েছে, অ্যাঁ!”—বলিয়া তরু সভয়ে দাঁড়াইয়া উঠিতেই মীরা তাড়াতাড়ি মায়ের কোলে তাহার স্থানটা দখল করিয়া মুক্তকণ্ঠে হাস্য করিয়া উঠিল।
তরু ঠকিয়া গিয়া একটু থতমত খাইয়া গেল, অনুযোগের স্বরে বলিল, “ওঠ দিদি, এ বেইমানি। হেরে গিয়ে …”
মীরা মায়ের কোলে মুখ গুঁজিয়া উত্তর করিল, “তোমারও এটা বেইমানি।”
“আমার বেইমানি কিসে?”
“বেইমানি নয় মা?—তোমার আদর খাওয়ার পালা আগে আমার। ও পরে জন্মেছে, আমার থেকে এঁটোকুটো যা বাঁচবে তাই নিয়ে ওকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। আমি তোমার লোভে যখন আর-জন্মে সাততাড়াতাড়ি মরে বসলাম, ও কাদের মায়ায় পড়ে ছিল? যাক্ না তাদের কাছে!… তুমি আমার পিঠে হাত বুলিয়ে আদর কর তো মা—‘মীরা আমার লক্ষ্মী মেয়ে, সোনা মেয়ে’…”
তরু ভ্যাংচাইয়া বলিল, “কেলে সোনা…”
মীরা সেইভাবে মুখ গুঁজিয়াই দুষ্টামি করিয়া হাসিতে হাসিতে বলিল, “মীরা আমার কালো সোনা; জগৎ মাঝে নাই তুলনা … বল না মা —”
এরা জায়গাটা দখল করিবার সঙ্গে সঙ্গেই কুকুরটা সরিয়া গিয়া দূরে ঘরের কোণে একটা চেয়ারের নীচে আশ্রয় লইয়াছিল। দুইটি খাবার উপর মুখ রাখিয়া চক্ষু তুলিয়া ব্যাপারটা অনুধাবন করিবার চেষ্টা করিতেছে। তরু কতকটা নিরুপায়ভাবে মীরার দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া আছে, বোধহয় সুযোগের দিকেও নজর আছে। মীরা মেঝেয় আঁচল লুটাইয়া মায়ের কোলে মাথা গুঁজিয়া কচি মেয়ের অভিনয় করিতেছে—তরুর রাগটাকে ইন্ধন জোগাইবার জন্য ঈষৎ গ্রীবা বাঁকাইয়া এক-একবার তাহার দিকে উঁকি মারিতেছে। মিসিস রায়ের একটা হাত মীরার বেণীর উপর, মুখে মৃদু হাস্যের সঙ্গে খানিকটা কৌতুকের ভাব মিশিয়া গিয়া অনির্বচনীয় একটা মাধুর্যের সৃষ্টি করিয়াছে, নিজের মাতৃত্বের রসে যেন বিলীন হইয়া গিয়াছেন। ওঁর মাথার উপর গণেশ জননীর ছবিটা—তুষারমৌলি হিমালয়, তার সানুদেশে একটি শিলাখণ্ডের উপর শিশু গণপতিকে কোলে লইয়া পার্বতী, চক্ষু দুটিতে বিশ্বের সব বাৎসল্য আসিয়া যেন পুঞ্জীভূত হইয়াছে; পাশে রক্ষী ও বাহন পশুরাজ।
আমার অবস্থিতিটাও বোঝা দরকার। —
আমি ঘরটার একটু অন্য প্রান্ত ঘেঁষিয়া একটা নীচু সোফায় বসিয়া আছি। আমার সামনে একটা বেশ মাঝারি রকমের গোল মার্বেলের টেবিল। তাহার মাঝখানটিতে বড় একটা পিতলের পাত্রে একরাশ সদ্য-প্রস্ফুটিত সাদা লিলি; আশেপাশে কয়েক রকম মাউণ্টে বসানো কয়েকটা ফটো। মোট কথা আমি এমনই কতকটা প্রচ্ছন্ন ছিলাম, তাহার উপর দোরটা আবার ঘরের মাঝামাঝি, প্রবেশ করিয়া ঝোঁকের মাথায় সটান ওদিকে চলিয়া গেলে আমায় না-দেখিতে পাইবার কথা। ওরা নিজেদের আবদারের খেলা লইয়া দু-জনেই বরাবর আমার দিকে পিছন ফিরিয়া আছে। মিসিস রায় দু-একবার গোপনে আমার দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করিয়া ঈষৎ হাস্য করিলেন, মানে তাহার নিশ্চয়ই এই—দরকার নেই জানিয়ে তোমার উপস্থিতির কথাটা, চুপ করে দেখ না তামাশাটা।
যিনি এত গম্ভীর প্রকৃতির বলিয়া এইমাত্র পরিচয় পাইলাম, তাঁহার মধ্যে এই দুর্বলতা দেখিয়া কৌতুক বোধ করিতেছিলাম। উনিও যেন ইহাদের সঙ্গে এক হইয়া গিয়াছেন। বোধ হয় ইচ্ছা নয় যে, সন্তান লইয়া তাঁহার এই নবমাতৃত্বের খেলায় কোন বাধা উপস্থিত হয়।
মা যেমন সন্তানদের বয়স হইতে দেয় না, সন্তানেরাও তেমনই মায়েদেরও নিজেদের বয়সের সঙ্গে টানিয়া রাখে।
মিসিস রায় তরুর হাতটা ধরিয়া নিজের দিকে একটু আকর্ষণ করিয়া বলিলেন, “তুমি আমার এই সোফাটার হাতলের ওপর এসে বরং ব’স তরু, বড় বোনের সঙ্গে কি জেদাজেদি করে?… তোরা কিন্তু সাততাড়াতাড়ি চলে এলি কেন বললিনি তো মীরা?”
তরু মায়ের আহ্বানে রাজি হইল না। মুখটা গোঁজ করিয়া নাকিসুরে বলিল—“সরোঁ বলছি দিঁ দিঁ, নৈলে…”
মীরা ওদিকে কান না দিয়া বলিল, “ভাল লাগছিল না মা এক্কেবারে—মাথাব্যথার নাম করে পালিয়ে এলাম।… মাথাব্যথাটা কী চমৎকার জিনিস মা! …”
মিসিস রায় বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “চমৎকার কিরে! সত্যি করেনি তোর মাথাব্যথা?”
মীরা হাসিয়া বলিল, “এই দেখ মার বুদ্ধি! সত্যি হলে কখনও চমৎকার হয়? চমৎকার বলছিলাম—এর জোরে স্কুল থেকে পালিয়েছি, পার্টি থেকে পালাচ্ছি—ব্যথা করার জন্যে মাথাটা যদি না থাকত তাহলে কি অবস্থাটাই যে হত ভাবতে মাথা গুলিয়ে যায়।”
মিসিস রায় হাসিয়া চকিতে একবার আমার পানে চাহিলেন। তরু বলিল, “মাথাব্যথা না হাতী! কিসের জন্যে মাথাব্যথা আমি সব জানি।”
মীরা গভীর হইয়া বলিল, “আচ্ছা, জান তো চুপ করে থাক মশাই। তুমি আজকাল একটু বেশি ফাজিল হয়ে পড়েছ তরু।”
তরু বলিল, “তুমি সর না।”
মীরা মায়ের হাঁটু দুইটা আরও জড়াইয়া বলিল, “না, সরব না।”
একটু চুপচাপ গেল। মিসিস রায়ের স্মিতহাস্যটা আরও একটু ফুটিয়া উঠিয়াছে। আমার উপস্থিতিটা যে পাকেচক্রে এখনও অপরিজ্ঞাত ইহাতে মুখে কৌতুকের ভাবটাও আরও স্ফূটতর। একটু যেন সংকোচ কাটাইয়া প্রশ্ন করিলেন, “কে কে এসেছিল পার্টিতে?—মিস্টার লাহিড়ীর বাড়ির সবাই এসেছিলেন? নীরেশ এসেছিল?”
শেষের এই প্রশ্নটুকুতে মীরা যেন মুখটা আরও একটু গুঁজিয়া লইল।
প্রশ্নটা অনির্দিষ্টভাবে করিলেও আসলে মীরাকেই করা হইয়াছিল। কন্যার সংকোচে, শুধরাইয়া লইবার জন্য মিসিস রায় আবার তরুর দিকে চাহিয়া প্রশ্নটার পুনরুক্তি করিলেন, “আমাদের নীরেশ এসেছিল তরু? কে কে সব এসেছিল?”
পিছন ফিরিয়া থাকিলেও বুঝিলাম তরুহাতের রুমালটার একটা কোণ দাঁতে চাপিয়া রুমালটাতে মুঠার টান দিতে দিতে মসৃণ করিতেছে, এই নবতর প্রসঙ্গে সে যেমন মায়ের কোল ভুলিয়াছে—তাহাতে তাহার চোখে-মুখে যে একটা কৌতুকের হাসিও ফুটিয়া উঠিয়াছে, না দেখিতে পাইলেও এটা আমি আন্দাজ করিতেছি। মাথাটা নাড়িয়া উত্তর করিল, “না, নীরেশ-দা আসেননি মা, তবে নিশীথ-দা আগেই এসেছিলেন, আমাদের মোটর পৌঁছুতে মিসেস মল্লিকের সঙ্গে তিনিই এসে নামালেন আমাদের, আবার দিদি যখন মাথাব্যথা বলে…”
মীরা মায়ের কোলের মধ্যে মুখটা ঘুরাইয়া বলিল, “একটু অতিরিক্ত বাচাল হয়েছ তুমি তরু। তুমি এখানে কেন? তোমার মাস্টারমশায়ের কাছে যাও।”
তরু কোলের কথা ভুলিয়া গিয়াছে; অন্যমনস্কভাবে গিয়া মায়ের সোফার হাতলের উপর বসিয়া মায়ের বুকে লুটাইয়া তর্কের সুরে বলিল, “বা-রে, আর তুমি কেন এখানে?”
মীরা বলিল, “আমার ঢের কাজ আছে। আমি তোমার পড়ার সম্বন্ধে মার সঙ্গে পরামর্শ করব।”
আমি এদিকে বেজায় অস্বস্তিতে পড়িয়া গিয়াছি। যতটা আন্দাজ করা গিয়াছিল তাহার চেয়ে বেশি সময় আমার উপস্থিতিটা অজ্ঞাত রহিল। ইহার মধ্যে কথায় কথায় নীরেশ লাহিড়ীর ও নিশীথের সম্বন্ধে যে প্রসঙ্গটুকু আসিয়া পড়িল সেটুকু শোনা আমার উচিত হয় নাই, তাহার উপর আবার আমার উল্লেখ হইয়া গেল। মিসিস রায় কথাটা প্রকাশ করিতেছেন না; অথচ যে হঠাৎ কি করিয়া নিজেকে এদের সামনে ধরিব মোটেই ভাবিয়া উঠিতে পারিতেছি না। নিজেকে প্রকাশ করিলেই এতটা সময়ের অপ্রকাশের অপরাধ লইয়াই প্রকাশ করিতে হইবে; অথচ সেই অপরাধটা প্রতি মুহূর্তেই বাড়িয়া যাইতেছে!
এদিকে হঠাৎ দু-জনের যে কাহারও দ্বারা আবিষ্কৃত হইয়া পড়িবার ফাঁড়াটা মাথায় ঝুলিতেছে। মীরা যে-কোন মুহূর্তেই উঠিয়া পড়িতে পারে, কিংবা এদিকে ফিরিয়া চাহিতে পারে। তরুর নজরে তো পড়িয়া গিয়াছিলাম বলিলেই হয়; আগাইয়া গিয়া এদিকে পিছন ফিরিয়াই মায়ের বুকে লতাইয়া পড়িল, তাহা না করিয়া সোফার হাতলে বসিয়া এই দিকে মুখ করিয়াই তো বোনের সঙ্গে তর্ক চালাইবার কথা। ও-ও বোধ হয় মাকে যথাসাধ্য দখল করিল। কিন্তু এদিকে সোজাসুজি একবার মুখ করিলে আমার ধরা পড়িয়া যাওয়া অনিবার্য।
মিসিস রায় এখনও কথাটা ভাঙিতেছেন না কেন? সন্তান লইয়া এই মোহ ওঁকে কি আমার নিদারুণ অবস্থা সম্বন্ধে এতই অচেতন করিয়া তুলিয়াছে?… ঘামিয়া উঠিতেছি। মীরার কথায় তরু উত্তর করিল, “বেশ তো, আমার পড়ার কথাই তো?—কর না পরামর্শ, শুনি!”
মিসিস রায়ের একটি হাত তরুর মাথায়, একটি হাত মীরার বেণীর উপর—দুইটিই ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হইতেছে। বাৎসল্যের স্রোত যেন দুইটি ধারায় নামিয়া আসিতেছে।
মীরা বলিল, “নিজের সম্বন্ধে সব কথা শোনা চলে না।”
তরু বলিল, “খুব চলে।”
মীরা বলিল, “ধর, যদি তোমার বিয়ের কথা হত, থাকতে বসে?”
তর্কটার গলদ খুব স্পষ্ট; কিন্তু উত্তর দেবার উপায় ছিল না এবং সেখানেই মীরার জিত। তরু মুখটা আরও গুঁজিয়া অনুযোগের সুরে বলিল, “মা!”
তাহার পর কোলের মধ্যেই মাথাটা একটু ঘুরাইয়া সঙ্গে সঙ্গে বলিল, “মাস্টারমশাই বেড়াতে গেছেন; তাঁকে এখন পাব না।”
মীরা বলিল, “যাননি বেড়াতে, তোমার মাস্টারমশাই ভয়ানক কুনো!”
মিসিস রায় কন্যাদ্বয়ের মাথার উপর দিয়া আমার পানে চাহিয়া ঈষৎ হাস্য করিলেন।
তরু অনুযোগ করিল, “দেখছ মা, মাস্টারমশাইয়ের নিন্দে করছে দিদি!”
হার-জিতের দিক-পরিবর্তন হইয়াছে,—মীরা আরও রাগিয়া বলিল, “তোমার মাস্টারমশাই ভাল মানুষ, মুখচোরা, লাজুক, অমন মানুষেরা হয় বোমা করে, নয় বেকার কবি হয়—দু’জনের একজনকেও আমি দু’চক্ষে দেখতে পারি না। সুতরাং যখনই তাঁর কথা উঠবে, তখনই নিন্দে ভিন্ন সুখ্যাতি বেরুবে না আমার মুখ দিয়ে!”
তরু মুখ ঘুরাইয়া দিদির মুখের উপর দৃষ্টি নত করিয়া একটু হাসিল, ভ্রূ উঁচাইয়া বলিল, “ইস, আমি যেন জানিনে!…”
মীরা মুখটা তুলিয়া প্রশ্ন করিল, “কি জান শুনি?”
সঙ্গে সঙ্গেই বলিয়া উঠিল, “আচ্ছা থাক, মেলা বাচালগিরি করে না।”
তরু শেষের হুকুমটা কানে তুলিল না, বলিল, “তুমি এই দু’ জনকেই বেশি পছন্দ কর।”
আমার তখন যে কি অবস্থা! তরুর দৃষ্টিটা শুধু একটু তুলিতে দেরি!
মিসিস রায়ও যেন ফাঁপরে পড়িয়া গিয়াছেন,—কথাটার যে এমনভাবে মোড় ফিরিবে, আর এত অতর্কিতে—মোটেই আশঙ্কা করেন নাই। আমার মুখের দিকে আর চাহিতে পারিতেছেন না। তরুকে মানা করিতে পারিতেছেন না। তরু নিতান্ত নিরীহভাবে তর্কের ঝোঁকে কথাটা বলিতেছে, মানা করিতে গেলেই কোথায় আপত্তির প্রচ্ছন্ন কারণ আছে প্রকাশ হইয়া পড়িবে। সেটা হইবে আরও বিসদৃশ।
মীরা ধমকাইল, “চুপ কর তরু; তোমার কানে ধরে বলতে গিয়েছিলাম?”
তরুর জয়ের নেশা লাগিয়াছে। মায়ের দিকে চাহিয়া বলিল, “সত্যি বলছি মা, দিদি ওর সই রমাদিকে বলেছে—ওর ভাল লাগে কবি, নয় তো… হ্যাঁ, সত্যি বলছি,– রমাদির বোন সতী আমায় বলেছে…”
মীরা অসহিষ্ণুভাবে বলিয়া উঠিল, “তরু!”
তরু মায়ের ঘাড়ে মুখ গুজিয়া বলিল, “বাঃ, এতে ধমকের কি আছে মা? উনি বলছেন, মাস্টারমশাইকে দু’চক্ষে দেখতে পারেন না। আমি দেখাব না যে… আচ্ছা, এবার বল তো দিদি– সেদিন….”
উৎসাহের ঝোঁকে দিদির দিকে মুখ তুলিয়া ফিরিতে গিয়া তরু স্তম্ভিত বিশ্বয়ে ও কৌতূহলে একেবারে নিশ্চল হইয়া গেল, বলিয়া উঠিল, “ওমা! মাস্টারমশাই যে!”
আর দৃষ্টি না পড়িয়া উপায় ছিল না, কেননা, আমি প্রবল অস্বস্তিতে অন্যমনস্কভাবে দাঁড়াইয়া উঠিয়াছি।
মীরা ধড়মড়িয়া উঠিয়া পড়িয়া বস্ত্র সংযত করিয়া লইয়া খানিকটা মুখ নীচু করিয়াই রহিল, তাহার পর ধীরে ধীরে চক্ষু তুলিয়া সম্পূর্ণ পরিবর্তিত আকৃতিতে স্পষ্ট দৃষ্টিতে আমার পানে চাহিল। আমাকে চাকরিতে নিয়োগ করিয়াছিল যে মীরা, শান্ত, দৃপ্ত, আরও একটা কি যেন। সকলেই আমরা প্রস্তরবৎ স্থাণু হইয়া গিয়াছি।
নিয়োগের সময় মাহিনার কথায় আমি যখন বলি– “আপনাদের যা সুবিধে হয় অনুগ্রহ করে দেওয়া”—সে সময় মীরার নাসিকার ডান দিকে যে কুঞ্চনটা ফুটিয়া উঠিয়াছিল সেটা আবার ধীরে ধীরে ফুটিয়া উঠিতেছে।
মিসিস রায়ের মুখেও একটা ভয়ের ছায়া ঘনাইয়া উঠিতেছিল, এখনই একটা অঘটন ঘটাইয়া বসিবে মীরা, আমার এই চৌর্যবৃত্তির জন্য—এই অলক্ষ্যে সব কথা শুনিবার জন্য। তীব্র উৎকণ্ঠার মধ্যেই হঠাৎ আবার মুখটা তাঁহার প্রসন্ন হাস্যে দীপ্ত হইয়া উঠিল, বলিলেন, “তা ব’স শৈলেন, এতক্ষণ ছিলে কোথায়? তোমার ছাত্রীরই পড়ার কথা হচ্ছিল।”
আমি যত দিন এখানে ছিলাম তাহার মধ্যে মাত্র দুই দিন এই মহীয়সী নারীকে মিথ্যা বলিতে শুনিয়াছিলাম, তাহার মধ্যে এই এক। আমায় বাঁচানো দরকার ছিল, উনি সেই জন্য নিজের জিহ্বা কলুষিত করিলেন।
মীরা একবার মায়ের পানে চাহিল—যাচাইয়ের দৃষ্টিতে, তাহার পর তাহার নাসিকার সেই কুঞ্চন ধীরে ধীরে মিলাইয়া গেল। মীরা মাকে বিশ্বাস করিয়াছে, তাঁহার মিথ্যায় প্রবঞ্চিত হইয়াছে। বিশ্বাস করিয়াছে যে, আমি এই ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিযাছি, এখনও আসন গ্রহণ করি নাই। সুতরাং এক-আধটা শেষের কথা যদি কানেও গিয়া থাকে তো তাহার প্রাসঙ্গিক মানেটা নিশ্চয় ধরা পড়ে নাই আমার কাছে। কতকটা ভাবহীন দৃষ্টিতে আমার পানে চাহিয়া শান্তকণ্ঠে বলিল, “বসুন, দাঁড়িয়ে রইলেন যে?”
ওর মায়ের অনুরোধে নয়, অনুরোধের সুরে ঢালা ওর হুকুমে ধীরে ধীরে আবার উপবেশন করিলাম।
কিন্তু কোথায় কি একটা রহিয়া গেল যেন, কথাবার্তা আর জমিল না। আমার মনে হইল মায়ের কথা যদি বিশ্বাস করিয়া ও থাকে, না বলিয়া নিঃসাড়ে প্রবেশ করিবার গ্রাম্যতাটা মীরা অন্তর দিয়া ক্ষমা করিতে পারিতেছে না।
একটু পরে একটা ছুতা করিয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল।