কাজ আরম্ভ হইল।

আমি পৌঁছিবার একটু পরেই মীরা আমায় তরুর ঘরে লইয়া গিয়া বলিল, “কাজ আপনার শক্ত মাস্টারমশাই, ছাত্রীটি বড় সোজা নয়, একটু দেখেশুনে নেবেন।”

তরুর পিঠে হাত দিয়া হাসিয়া বলিল, “তোমার পরিচয় দিয়ে দিলাম একটু, বাকিটুকু মাস্টারমশাই নিজেই টের পাবেন।”

ইহার পর আমার ঘরে একটু আসিল। বেয়ারাকে আমার জন্য আসবাব-পত্রের দু-একটা উপদেশ দিয়া কোন অসুবিধা হইলে সঙ্গে সঙ্গেই তাহাকে জানাইবার জন্য অনুরোধ করিয়া উপরে চলিয়া গেল।

আমি কিন্তু দুদিন হাজার চেষ্টা করিয়াও শক্ত সহজ কোন কাজেরই বিশেষ সন্ধান পাইলাম না। আমি সকালে বিছানা হইতে উঠিয়া তরুকে দেখিতে পাই না। স্নান করিতে করিতে শুনি তরু মোটরে করিয়া কোথা হইতে আসিল, দু-একটা কি কথা বলিতে বলিতে তাড়াতাড়ি উপরে উঠিয়া গেল। আহার করিয়া উঠিয়া ঘরে তোয়ালে লইয়া মুখ মুছিতেছি, তরু খট্‌ খট্‌ করিয়া নামিয়া মোটরে করিয়া বাহির হইয়া গেল। ব্যাপারখানা কি?

মীরার সঙ্গে দেখা হইতেছে না। চেষ্টা করিয়া দেখা করিতে বাধ-বাধ ঠেকিতেছে। বেয়ারাটাকে কি অন্য চাকর-বাকরদের জিজ্ঞাসা করিতে মন সরিতেছে না; দু-বেলা দিব্য রাজার হালে খাওয়া-দাওয়া করিতেছি, অথচ আসল যা কাজ সে-সম্বন্ধেই কোন জ্ঞান নাই, ওদের সামনে এটা প্রকাশ করা কেমন হইবে বুঝিতে পারিতেছি না। বড়লোকের চাকরদেরও ভাবগতিক একটু অন্য রকম। দেখাই যাক্‌ না, যদি এমনিই ব্যাপারটার হদিস হয় কোন।

বিকালে কি কাজ, কিংবা কোন কাজ আছে কিনা এখনও টের পাই নাই। তাহার কারণ প্রথম দিন আমার বিকালবেলার দিকে একবার পুরানো বাসায় যাইতে হইয়াছিল, ছাতাটা ফেলিয়া আসিয়াছিলাম সেটা লইয়া আসিতে। ফিরিতে রাত্র হইয়া গেল। প্রথমটা তো কাগজ পড়িবার জন্য ধরা পড়িলাম, সেটা শেষ হইলে ছাত্রছাত্রীরা ধরিয়া বসিল—আহার করিয়া যাইতে হইবে। নূতন চাকরি, কাটান দেওয়ার ঢের চেষ্টা করিলাম, সফলও হইতাম। কিন্তু বড় ছাত্রীটি এদিকে একটু চতুর হইয়াছে, বলিল, “না মাস্টারমশাই, আপনি যান, ওদের কথা শুনবেন না—তোমরা ব্যারিস্টারের বাড়ির মত ভাল খাবার দিতে পারবে ওঁকে? আদর-যত্ন করতে পারবে?”

কৃত্রিম রোষের সহিত ‘ওদের’ কথাটা বলিয়া আমার পানে চাহিয়া হাসিয়া ফেলিল।

চার বৎসরের সম্বন্ধ এদের সঙ্গে, পূর্বে তাহাতে ধৈর্যাভাবও ছিল, ক্লান্তিও ছিল, এই নুতন বিচ্ছেদে কিন্তু সব সরিয়া গিয়া শুধু স্নেহটুকু গাঢ় হইয়া উঠিয়াছে। আর ‘না’ বলিতে পারিলাম না। প্রথম রাত্রেই দেরি,—বেশ একটুকুণ্ঠার সহিত বাসায় ফিরিলাম। আহার করিব না শুনিয়া মীরা জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠাইল শরীর ভাল আছে তো? মোট কথা বিকালে ও সন্ধ্যার পর তরুকে লইয়া আমার কি ডিউটি প্রথম দিন সেটুকুও জানা গেল না।

দ্বিতীয় দিন বিকালে মীরার সঙ্গে দেখা হইল—আমার ঘরেই। পুরানো বাসা হইতে রিডাইরেক্টেড্ হইয়া বাড়ী হইতে একটা চিঠি আসিয়াছে—না যাওয়ার জন্য সবাই চিন্তিত,—সেই চিঠির জবাব দিতেছিলাম, মীরা তরুকে সঙ্গে করিয়া আসিয়া উপস্থিত হইল, বলিল, “আপনার ছাত্রীকে আজ একটু ছেড়ে দিতে হবে মাস্টারমশাই, ডক্টর মল্লিকের ওখানে পার্টি আছে একটা, আসতে বোধ হয় রাত হয়ে যেতে পারে।”

আমি লজ্জিতভাবে বলিলাম, “তা যাক।”

লজ্জিতভাবেই এইজন্য যে, এই দু-দিনের মধ্যে ওকে আমি ধরিয়া রাখিলাম কখন যে ছাড়িয়া দিতে হইবে? ওরা চলিয়া গেলে বাড়ি না যাওয়ার কারণ জানাইয়া চিঠিটা শেষ করিলাম! তাহার পর একটু চিন্তা করিয়া ‘পুনশ্চ’ দিয়া লিখলাম “কিন্তু বোধ হয় শীঘ্রই আসিতেছি, কেন না কয়েকটা কারণে এমন সুবিধের চাকরিটা রাখিতে পারি কিনা ঠিক বুঝিতে পারিতেছি না।” চিঠিটা কাছেই একটা ডাকবাক্সে দিয়া আসিলাম।

বাস্তবিকই দু-দিনেই যে রকম ধৈর্য্যচ্যুতি হইতে বসিয়াছে, তাহাতে বেশ বুঝা যাইতেছে এ-চাকরি চলিবে না। প্রথমত, এই আভিজাত্যের আবেষ্টনীর মধ্যে নিজেকে খাপ খাওয়াইয়া লইতে পারিতেছি না; দ্বিতীয়ত, একটা রহস্য রহিয়াছে—বাড়ির মধ্যে কোথাও একজন গৃহকর্ত্রী আছেন, কিন্তু তাঁহার অস্তিত্বের কোন পাকা রকম নিদর্শন পাওয়া যাইতেছে না। মীরাই তো দেখিতেছি সর্বময়ী। ব্যাপারটার সঙ্গে হয়তো আমার চাকরীর কোন সাক্ষাৎ সম্বন্ধ নাই। কিন্তু তবুও যেন একটা অস্বস্তি বোধ হইতেছে। আর, সকলের উপর অসহ্য হইয়াছে এই জগদ্দলের মত অবসরের বোঝা। তরু ভোরে কোথায় যায়? টুইশ্যন পড়িয়া আসিতে? দুপুরে কোথায় যায়? স্কুলে? তবে অমন মোটা মাহিনা দিয়া আমায় রাখা হইল কেন? কাজের অভাবে বাড়িটার সঙ্গে কোন যোগসুত্র অনুভব করিতে পারিতেছি না। আচ্ছা বড়মানুষি চাল!—লোক রাখিল, তাহার কাজ ঠিক করিয়া দিবে না! ঠিক উল্টা একেবারে—এর আগে সব জায়গাতেই গার্জেন-উপগার্জেনের দল হুমড়ি খাইয়া থাকিত—একটা মুহূর্তও ফাঁকি দিতেছি কিনা। সেও শতগুণে ভাল ছিল কিন্তু।

রহস্যটা সেই দিনই কতকটা পরিষ্কার হইল।

চিঠিটা ফেলিয়া কথাগুলো মনে তোলপাড় করিতে করিতে বাগানে গিয়া একটা লোহার বেঞ্চিতে বসিলাম। বাহির হইতে বাগানটা যে অতি-কৃত্রিমতায় বিসদৃশ বোধ হইতেছিল, এখন ততটা মনে হইতেছে না। বরং মনে হইতেছে এই ভাল। ঘাড়-রগ ঘেঁষিয়া চুলছাটা লোকের গায়ে যেমন আলখাল্লা মানায় না—কাটাছাটা বাহুল্যবর্জিত পাঞ্জাবিই শোভা পায়, এ-বাড়ির পক্ষে এ-বাগান ও কতকটা সেই রকম। আমার বেঞ্চের পাশটাতেই একটা গোলাপের বেড। হাতের কাছের গাছটিতে গুটি পাঁচ-ছয় ফুল ফুটিয়াছে। বাড়ির মধ্যকার হাওয়াটা যেন চিন্তার চিন্তায় ভারাক্রান্ত হইয়া উঠিযাছে, লাগিল বেশ। গন্ধ-লুব্ধ হইয়া একটি ফুল আলগাভাবে তুলিয়া ধরিয়াছি—পাপড়িগুলি ঝুরঝুর করিয়া ঘাসের উপর ঝরিয়া পড়িল। আমি শঙ্কিত হইয়া উঠিলাম। একবার চাহিয়া নিঃশদে স্থানটি ত্যাগ করিব ভাবিতেছি, এমন সময় বারান্দা হইতে বেয়ারা “মেমসাহেব আপনাকে একবার ডাকছেন মাস্টার-মশা।”

আমি দাঁড়াইয়া উঠিয়া তাহার মুখের পানে চাহিয়া রহিলাম, চোখ দুইটা অবাধ্য-ভাবেই একবার ছিন্ন পাপড়িগুলার উপর গিয়া পড়িল। মেমসাহেব দেখিয়াছে—দুইটা কটু কথা বলিবে, যদি শত মোলায়েম করিয়াও বলে তো বুঝাইয়া দিবে—ফুলগাছশুদ্ধ টানিয়া নাকে চাপিয়া গন্ধ লওয়াটা যে-রুচির পরিচয়, এ বাড়িতে সে-রুচির স্থান নাই।

অথচ ধর্ম জানেন আমার কোন দোষ নাই। ফুলটি ছিল ফুটিবার শেষ অবস্থায়, একটু পরে আপনিই ঝরিত, রূপে লুব্ধ করিয়া আমায় নিমিত্তের ভাগী করিল মাত্র।

বেয়ারার মুখের পানে অপরাধীর মত চাহিলাম,—এমনই অভিভূত হইয়া গিযাছি যে, আর একটু হইলে তাহারই শরণাপন্ন হইয়া বোধ হয় বলিয়া ফেলিতাম, “এ যাত্রাটা আমায় বাঁচাও কোন রকমে।”

বেয়ারা বলিল, “ওপর ঘরেই রয়েছেন তিনি, আসুন আমার সঙ্গে।”

নিরুপায় হইয়া অগ্রসর হইলাম।

মনে মনে কিন্তু স্থির করিয়া ফেলিলাম—আজই এ-কাজে ইস্তফা দিয়া বাড়ি চলিয়া যাইব। মীরাকে দেখিয়া উঠিয়া দাঁড়ানও আর ভাল লাগে না, একটা গোলাপ আপনি পড়িয়াছে ঝরিয়া, তাহার জন্য কালো মেমসাহেবের লাঞ্ছনাও সহ্য হইবে না ইহার অতিরিক্ত যে-সব বিড়ম্বনা সে তো আছেই। চাকরটা পর্যন্ত চলিয়াছে—যেন একটা কয়েদীকে বিচারাসনের সামনে হাজির করিতেছে।

বেয়ারা গিয়া পর্দার সামনে মুখটা বাড়াইয়া বলিল, “মাস্টারমশা এসেছেন মা।”

ভিতর হইতে আদেশ হইল, “আসতে বল্।”

বেয়ারা দুয়ারের পাশে দাঁড়াইয়া পর্দাটা তুলিয়া ধরিল। আমি ভিতরে প্রবেশ করিয়া নতনেত্রে দাঁড়াইয়া রহিলাম।

আদেশ হইল, “ব’স ঐ সোফাটায়।”

আমি ঘাড়টা সেই রকম গোঁজ করিয়াই আড়চোখে পিছনের সোফাটা দেখিয়া লইয়া কয়েক পা গিয়া বসিয়া পড়িলাম। সেকেণ্ড কয়েক চুপচাপ; মনে মনে মহলা দিতেছি,—প্রথমে বুঝাইব প্রকৃতই ফুলটি আমি জানিয়া নষ্ট করি নাই। কালো-মেমসাহেবী মেজাজ নিশ্চয় বুঝিতে চাহিবে না। না চায় বলিব—চাকরি দিয়া ফুলের জন্য ক্ষতিপূরণ করিলাম। এ অশান্তির এইখানেই ইতি করিয়া দিব।

প্রশ্ন হইল, “তোমায় বাগান থেকে ডেকে নিয়ে এল?”

মুখ না তুলিয়াই উত্তর করিলাম, “আজ্ঞে হ্যাঁ।”

“আচ্ছা উজবুক তো রাজুটা, আমায় এসে বললেই পারত তুমি বাগানে রয়েছ। আমার এমন কিছু তাড়াতাড়ি ছিল না।”

শান্ত, একটু অনুতপ্ত কণ্ঠস্বর। বিস্মিত হইয়া মুখ তুলিয়া আরও বিস্মিত হইয়া গেলাম। প্রথমেই সামনে দেওয়ালের উপর একটি গণেশ-জননীর মূর্তির উপর নজর পড়িল। তাঁহাকে দেখিয়া মনে হইল যেন, পটের মুর্তিটাই নীচে নামিয়া আসিয়াছে।

বয়স বোধ হয় পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ হইবে। চওড়া টকটকে রাঙা পাড়ের একটা গরদের শাড়ি পরা, সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর, মাথার কাপড়ের পাড়ের সঙ্গে রঙে রঙে একেবারে মিলিয়া গিয়াছে, হাতে সোনার চুড়ির সঙ্গে দু-গাছি শাঁখা।

মুখটা ঈষৎ ক্লান্ত, মনে হয় যেন অসুস্থ রহিয়াছেন। ঘরের এক পাশে কৌচের উপর দৃষ্টি পড়িতে ঠেলিয়া জড়-করা একটা র‍্যাগ দেখিয়া মনে হইল কোচেই শুইয়াছিলেন এতক্ষণ, ওদিকে আমায় ডাকিতে পাঠাইয়া কুশন চেয়ারটায় আসিয়া বসিয়াছেন।

ঘরটা বেশ প্রশস্ত। নীচে আসবাবের বাহুল্য নাই, উপরে ছবির কিছু বাহুল্য আছে এবং বাড়ির হিসাবে দেখিতে গেলে বিশেষত্বও আছে। চোখে পড়ে জগদ্ধাত্রী, কালীঘাটের একটি রাঙায় কালোয় জ্বলজ্বলে কালীর পট, রবিবর্মার আঁকা একখানি শতদলের উপর কমলা-মূর্তি।

অর্থাৎ আমি, অথবা যে-কোন বাঙালী গৃহস্থ পরিবারের ছেলে যাহাতে অভ্যন্ত, ঘরের মানুষটি হইতে আরম্ভ করিয়া মায় পট-ছবি সমেত ঠিক সেই রকম একটি পারিপার্শ্বিক। পরিবর্তনটাও এত অপ্রত্যাশিত এবং আকস্মিক যে, মনে হয় হঠাৎ ইহার মধ্যে যাদুবলে কিছু একটা যেন হইয়া গিয়াছে—আমার এই বাগান হইতে উঠিয়া আসিবার অবসরটুকুতে। দু-তিন দিনের যে আড়ষ্ট ভাবটা মনে জমা হইয়া উঠয়াছিল, অনুভব করিলাম সেটাও হঠাৎ অপসৃত হইয়া গিয়াছে। লিখিতে দেরি হইল, কিন্তু আমার এই ভাবান্তরটা ঘটিতে মোটেই দেরি হয় নাই। মুখ তুলিয়া প্রথমটা বিব্রত হইয়া গেলাম, তাহার পর অল্প হাসিয়া বেশ সহজভাবেই বলিলাম, “ডেকে এনে কি আর অন্যায় করেছেন!”

“এখন মরশুমী ফুলে বেশ চমৎকার হয়েছে বাগানটি, তাই বলছিলাম।” হাসিয়া বলিলেন, “আমায় ডাকতে গেলে আমি তো চটতাম।”

একটু বিরতি দিয়া প্রশ্ন করিলেন, “তুমিই তাহলে নতুন টিউটর এসেছ?”

উত্তর করিলাম, “আজ্ঞে হ্যাঁ।”

“শুনলাম। দু-দিন থেকে ভাবছি ডাকব, শরীরটা ঠিক ছিল না; হয়ে ওঠেনি।”

আবার একটু হাসির সঙ্গে বলিলেন, “মীরা বলছিল, ‘মুখচোরা ভালমানুষ লোকটি, উনি তরুকে পড়াবেন কি মা, তরুই উল্টে ওঁর মাস্টারি করবে।’ জিজ্ঞেস করলাম—‘তবে রাখতে গেলি কেন ওঁকে’?”

আমি কৌতূহলে মুখ তুলিয়া চাহিতে হাসিয়া বলিলেন, “সে তোমার আর শুনে কাজ নেই বাপু।”

তাহার পর বোধ হয় আপত্তিজনক কিছু একটা মনে করিয়া লইতে পারি ভাবিয়া বলিলেন, “উত্তর আর কি, দুষ্টুমি!—‘তরুর হাতে নাকাল হবেন, দিব্যি দেখব বসে—গোবেচারি কেউ নাকাল হচ্ছে দেখতে বেশ লাগে।’…ওর কথা সব সময় ধরা হয় না বাড়িতে; ওঁকেই মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে বসে। থাক, তোমার ছাত্রী পড়ছে কেমন?”

হাসিয়া বলিলাম, “আমি তাকে ভাল করে দেখিইনি এখনও।”

“তাই নাকি?—তা ওর দোষ দেওয়া যায় না।”

মিসিস রায় একটু চুপ করিয়া গেলেন। মুখে যে একটা লঘু প্রসন্নতার ভাব ছিল সেটা ধীরে ধীরে লুপ্ত হইয়া মুখটা চিস্তায় একটু গভীর হইয়া উঠিল। ধীরে ধীরে বলিলেন, “কখন যে পাবে দেখতে তা আমি ভেবে উঠতে পারি না। বাপেতে আর মেয়েতে মিলে সংকল্প করেছে এদিকে এশিয়া আর ওদিকে ইউরোপ—এ দুয়ের মধ্যে যা কিছু ভাল আছে বেছে বেছে তরুর মধ্যে বোঝাই করতে হবে। আমার মত অন্য রকম, তাই ওসব কথার মধ্যে আর থাকি না, বলি তোমাদের যা ইচ্ছে কর গে বাপু।”

আমি জিজ্ঞাসু নেত্রে চাহিয়া প্রশ্ন করিলাম, “আপত্তি না থাকে তো আপনার মতটা জানতে পারি কি?”

মিসিস রায় যেন আরও গম্ভীর হইয়া গেলেন, বলিলেন, “আমার মত ওদের একজন শ্রেষ্ঠ কবির যা মত তাই। ওদের সঙ্গে আর কিছুতেই মেলে না, শুধু এইখানটাতে মেলে, ওয়েস্ট ইজ ওয়েস্ট এণ্ড ইস্ট ইজ ইস্ট, দ্য টোয়েন শ্যাল নেভার মীট্”—(West is West and East is East, the twin shall never meet)।

আমি অতিমাত্রায় আশ্চর্য হইয়া মুখের পানে চাহিলাম। ইংরেজীর এমন বিশুদ্ধ উচ্চারণ আমি বাঙালী মেয়ের মুখে ইহার পূর্বে কখনও শুনি নাই, অন্তত কাছাকাছি যদি কিছু শুনিয়াও থাকি তো তাহা অতি-মেমসাহেবিয়ানায় দুষ্ট। মিসিস রায় কথাটা বলিলেন অতি সহজভাবে, তাহাতে যেমন একদিকে কৃত্রিমতাও ছিল না, অন্যদিকে তেমনই নিখুঁত বলিতে পারিবার জন্য আমার এই যে বিস্ময়, এজন্য স্ত্রী লোক বলিয়া বিন্দুমাত্র সঙ্কোচও ছিল না। খুব বেশি জানিবার মধ্যে যেমন একটা অনায়াস অবহেলা থাকে—ভাবটা অনেকটা সেই রকম। আমিই বরং একটু অপ্রতিভ হইয়া মুখে বিস্ময়ের ভাবটা মিলাইয়া লইলাম।

তিনি স্থিরদৃষ্টিতে সামনে একটু চাহিয়া রহিলেন, তাহার পর একটু স্মিত হাস্যের সহিত বলিলেন, “এরা আমার কথা মানতে চায় না, মীরা ঝগড়া করে, মীরার বাপও ঝগড়া করেন। আমাদের এই রাজায় রাজায় ঝগড়া, মাঝখান থেকে তরু-উলুখড়ের প্রাণ যায়। ওকে বিলেতে পাঠানো হবে—লরেটোতে জুনিয়ার কেম্ব্রিজের জন্যে হাতেখড়ি চলছে; অথচ সকালবেলায় উঠে নেয়ে-টেয়ে বেচারির লক্ষ্মী পাঠশালায় গিয়ে শিবপুজোর জন্যে চন্দন ঘষতে হয়। স্কুলে ওদের মিউজিক ক্লাস সেরে এসে বাড়িতে বিকেলে কীর্তন। আমি বলি–আপাতত একটা জিনিসে পাকা হোক, তারপর অন্যটা ধরলেই চলবে—আগে কীৰ্তনটা আয়ত্ত করে নিক না হয়। বলেন—না, তাহলে ঝোঁকটা একদিকে চলে যাবে, বেশ সরলভাবে নতুন জিনিসকে তুলে নিতে পারবে না‥…”

আমি বেশ নিঃসঙ্কোচে প্রশ্ন করিলাম, “কথাটা কি সত্যি নয়?”

মিসিস রায় কৌতুকচ্ছলে হাস্য করিয়া উঠিলেন, বলিলেন, “নাঃ, আমার কপাল মন্দ; মীরাব মুখে তোমার বর্ণনা শুনে মনে হল বোধ হয় এত দিনে স্বপক্ষে একটি মানুষ পেলাম, তুমিও দেখছি ঐ দলেই!”

তাহার পর আবার গম্ভীর হইয়া কহিলেন, “না, আমি সে কথা বলছি না, বলছি—মিলতে গেলে ঐক্যের দিকগুলোয় ঝোঁক দিতে হবে, কিন্তু তা তো করা হয় না, বিরোধের দিকগুলোয় দেওয়া হয় জোর। এটা কি রকম তার জন্যে বেশি দূর না গিয়ে তরুর ব্যাপারটাই ধরা যাক না—ওকে এমন সুযোগ দেওয়া হবে যাতে ও একেবারে অতি-আধুনিক ইংরেজ যুবতী হয়ে উঠতে পারে। ও যখন লরেটোতে যায় তখন ওকে দেখলেই বুঝতে পারবে এ-বিষয়ে আমাদের কোনদিক দিয়ে ত্রুটি নেই। এদিকে যাতে আবার বেশি দূর না এগোয়, অর্থাৎ দিদিমা-ঠাকুরমাদের কথা ভুলে কোন কেম্ব্রিজ ব্লুর গলায় মালা না দিয়ে বসে, সেজন্য তাকে দিয়ে শিবের মাথায় ও গঙ্গাজল ঢালানো হচ্ছে। এ-মনস্তত্ত্ব তোমরা যদি বোঝ তো বোঝ, আমি একেবারেই বুঝি না; কেন না ঠাকুরমা-দিদিমাদের আদর্শ আর বিশ্বাস যদি মানতে হয় তো সেই আদর্শে গড়া শিবঠাকুর ওকে ঠেকাবার জন্যে হিমালয় ছেড়ে কেম্ব্রিজের দিকে এক পা-ও বাড়াবেন না। তার কারণ গেলেই তাঁর নিজের জাত যাবে, আর ভক্তের খাতিরে যদি সেটাও না গ্রাহ্য করেন তো এইজন্যে যে কেম্ব্রিজে টাটকা বিল্বপত্র একেবারেই পাওয়া যাবে না।

“এই এক ধরনের মিলন। আর এক ধরনের আছে নিজেদের সব ছেড়ে ওদের সব নেওয়া, মনে-প্রাণে সাহেব হয়ে গিয়ে উদয়াস্ত গায়ে সাবান ঘষতে থাকা। কিন্তু একে তো আর মিলন বলা যায় না, এ আত্ম-সমর্পণ; বরং আত্ম-সমর্পণের মধ্যেও আত্মার কিছু বিভিন্নতা বজায় থাকে বোধ হয়; এ একেবারে আত্মবিলম্ব—ওরাই রইল, বরং পুষ্ট হল, তুমি গেলে নিশ্চিহ্ন হয়ে মুছে। এটা সেই মনোভাব যার জন্যে মুখ থেকে বেরোয়—ইংরেজী শিখতে হলে ইংরেজী পড়তে হবে, ইংরেজীতে কথা কইতে হবে, ইংরেজীতে ভাবতে হবে, এমন কি স্বপ্নও দেখতে হবে ইংরেজীতেই (To learn English, read English, speak in English, think in English, and even dream in English) –কে বলেছিলেন কথাটা? রমেশ দত্ত, না মাইকেল?—কিন্তু কেন তা করব? মায়ের দুধের সঙ্গে যে ভাষা আমার জিভে মিলিয়ে রয়েছে তাকে তাড়াতে যাব কোন, দুঃখে? –এই আত্মবিলোপের জাত আমরা, ভাষার দিক দিয়েও আত্মবিলোপ, সভ্যতার দিক দিয়েও আত্মবিলোপ।”

মিসিস রায় সোজা হইয়া বসিয়া ছিলেন, ক্লান্তভাবে সোফার পিঠে হেলান দিয়া একটু চুপ করিলেন; চোখ দুইটি অন্যমনস্কভাবে সামনের দেওয়ালে কমলার ছবির উপর নিবদ্ধ।

আমার চোখ দুইটি নিজে হইতেই কৌচের উপর গিয়া পড়িল।

মিসিস রায় অসুস্থ, তাহার উপর হঠাৎ মনের এই আবেগ। বলিলাম, “আপনি এখন একটু আরাম করলে ভাল হত। আপনার কথার প্রতিবাদ করা যায় না, অন্তত ভেবে চেষ্টা করতে হয়—এখন আমি আসি, আবার যখন আদেশ করবেন, আসব।”

উঠিতে যাইব কিন্তু কোন উত্তর না পাইয়া উঠিতে পারিলাম না। হাতের মধ্যে মুখের দুইটি পার্শ্ব ঈষৎ চাপিয়া, স্থির দৃষ্টিতে চাহিয়া আছেন মিসিস রায়–বুঝিলাম আত্মস্থ; আমার এতগুলো কথার একটাও কানে যায় নাই। একটু পরে কমলার মূর্তি থেকে ধীরে ধীরে প্রশান্ত চক্ষু দুইটি নামাইয়া আমার উপর ন্যস্ত করিয়া বলিলেন, “হতেই হবে।”

বুঝিলাম এখনও ঘোরটা কাটে নাই। তখনই যেন সচকিত হইয়া উঠিলেন, “বলছিলাম হতেই হবে, অর্থাৎ এই আত্মবিলোপের প্রতিক্রিয়া একদিন আসবেই। তাই কৈলাস আর কেম্ব্রিজের এই জগাখিচুড়ি।”

আমি যেন কিছু একটা বলিবার জন্য বলিলাম, “কিন্তু এই একেবারে আত্মবিলোপের ভাবটা যেন যাচ্ছে ক্রমে ক্রমে।”

মিসিল রায় বলিলেন, “মোটেই নয়। পুরোদমেই চলেছে এখনও। যেটাকে তুমি যাওয়া বলছ, সেটা হল ঐ দুটোতে মিলে তালগোল পাকিয়ে যাওয়া।”

আমি বলিতে যাইতেছিলাম, “আজকাল জাহাজ থেকেই সুট ছেড়ে ধুতি-চাদর পরে আমাদের দেশের ছেলেরা নামছে এমন উদাহরণ বিরল নয়।”

মিসিস রায় শেষ করিতে না দিয়া একটু অসহিষ্ণুভাবেই বলিয়া উঠিলেন, “তুমি জান না তাই বলছ; আমি খুব জানি—আমার নিজের ছেলে এই রকম আত্মবিলুপ্ত, আর এই আমার ছোট মেয়েকে এরা…”

এমন সময় একটা ছোট্ট জাপানী কুকুর ত্রস্তভাবে ঘরে ঢুকিয়া মিসিস রায়ের পায়ের কাছে লুটিয়া গড়াইয়া একশা হইয়া পড়িল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মীরা আর তরু এক রকম হুড়োমুড়ি করিতে করিতেই আসিয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল।