২০

নিজের অজ্ঞাতসারেই আমি কখন একটা কুশন চেয়ারে বসিয়া পড়িয়াছি মনে নাই। তরু চলিয়া গেলে আমরা দু-জনেই খানিকক্ষণ নীরবে রহিলাম। একবার চাহিয়া দেখিলাম মীরার মুখখানি বড় সুন্দর দেখাইতেছে, তরু সেখানে কৌতুকের ভাবটা জাগাইয়া দেওয়ার পর মনে হইতেছে যেন বর্ষার পর স্বচ্ছ আর্দ্র আকাশে রৌদ্র ঝলমল করিতেছে। দু-জনেই বোধ হয় অপেক্ষা করিতেছি কথাটা অপর দিক হইতে উঠুক। মীরাই মুখ খুলিল, প্রশ্ন করিল, “তরুকে কি বললেন ঠিক বুঝতে পারলাম না। সত্যিই কি মত বদলালেন?”

উত্তর করিলাম, “মীরা দেবী, আপনার মনে একটা স্থায়ী খেদ রেখে যাব আমি এত বড় অকৃতজ্ঞ নই। তা ভিন্ন যদি এমনই হয় যে, সত্যিই আপনি সন্দেহের ওপর চিঠিটা লিখেছেন, বা ঐ সম্ভাবনার কথাটা বললেন, তা থেকেই বরং প্রমাণ করি আমি আর যা-ই হই, অত হীনচেতা নই। যেদিক থেকে ভেবে দেখছি, ক্রমে মনে হচ্ছে আমার থাকাটাই যেন সমীচীন—মোর অনারেবল।”

মীরা একটু চুপ করিয়া রহিল, তাহার পর একটু ক্লিষ্ট স্বরে বলিল, “শুধু একটু দুঃখ রইল শৈলেনবাবু যে আপনি থেকে গেলেন বটে, কিন্তু আপনার মনে কোথায় যেন একটা কাঁটা বিঁধে রইল। ওটুকু তুলে ফেলবার উপায় নেই?”

একটু চুপ করিয়া নিজেই বলিল, “বেশ, এটুকুর জন্যেও আমি কৃতজ্ঞ রইলাম। তার কারণ আপনি গেলে আমার মনে যে আপসোসটা থাকত সেইটেই আমার সবচেয়ে বড় চিন্তা ছিল না, সবচেয়ে বড় চিন্তা এই ছিল যে বাবা আর মার কাছে আমার কোন জবাবদিহি ছিল না। আপনি সেদিক থেকে আমায় বাঁচিয়েছেন। জানেন তো যাদের কাছে অতিরিক্ত আদর পাওয়া যায় তাঁদের কাছে খুব বেশি সাবধানে থাকতে হয়। আমি যে কি বলতাম তাদের, ভেবেই সারা হচ্ছিলাম।”

আমি মীরার দিকে মুখ তুলিয়া চাহিলাম, আবার সেই চতুরা মীরা! প্রথম সুযোগেই ওর অশ্রুজলের ভিতরের কথাটা চাপা দিবে ও, যেন বাপ-মা কি বলিবেন সেই চিন্তাই ওর আসল চিন্তা। এতক্ষণ যে অশ্রু লুকাইবার জন্য ওকে অত ঘটা করিয়া জানালা বন্ধ করার অভিনয় করিতে হইল, রুদ্ধ কণ্ঠে মিনতি করিতে হইল থাকিবার জন্য—তাহার গোড়ায় শুধু ছিল বাবা-মা কি বলিবেন—আর কিছুই না।

একটা হাসি ঠেলিয়া উঠিতেছিল, কিন্তু প্রকাশ করিলাম না। মীরার কাছে যখন সব কথা বলিবার অধিকার পাইব সেই সময় একদিন এই কথাটা তুলিয়া ওর প্রবঞ্চনায় ওর চতুরতায় ওকে লজ্জা দিয়া প্রাণ খুলিয়া হাসা যাইবে। কথাটা স্মৃতির মণিকৌটায় তুলিয়া রাখিলাম। আপাতত এইটুকুই লাভ যে মীরা চতুরা বলিয়া ওকে আরও ভাল লাগিতেছে।

মীরা বলিল, “আরও একটা উপকার হ’ল শৈলেনবাবু, চিঠির মধ্যে, কিংবা কথাটার মধ্যে যে আমার তরফ থেকে অবিশ্বাসের ছিটেফোঁটাও নেই, আপনি থেকে যাওয়ার সেটা প্রমাণ করবার যথেষ্ট অবসর পাব।”

অর্থাৎ আমি যে-ভাবে কথাটা বলিলাম, মীরাও সেইভাবে একটা কথা বলিবার লোভটা সামলাইতে পারিল না,—ও-ও প্রমাণ দিবে!

আমার আবার হাসি পাইল। হাজার চতুরা হইলেও মীরা এখানে নিজের কাছেই প্রবঞ্চিত হইতেছে। নিজের মনের নিজেই নাগাল পাইতেছে না। আমায় শত নিরপরাধ বলিয়া জানিলেও যে ওর এ ঈর্ষা থাকিবেই এ-কথা ওকে কি করিয়া বুঝাই?

চেতনা হইল, অনেকক্ষণ হইয়া গেছে। আমি ওর কথার উপর আর কোন মন্তব্য করিলাম না, দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিলাম, “তাহ’লে এখন আমি আসি।”

মীরা কোন কথা বলিল না, ধীরে ধীরে দাঁড়াইয়া উঠিল। আমিও কোন মন্তব্য করিলাম না। দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিলাম, “আসি তাহ’লে।”

বাহির হইয়া আসিলাম।

দেখি রাজু বেয়ারা একতাড়া ডাকের চিঠি লইয়া ভারিক্কে চালে উঠিয়া আসিতেছে। চিঠি সব আগে মীরার কাছে যায়, সেখান থেকে আবার রাজুর মারফত যথাস্থানে বিলি হয়। এখানকার এই সাধারণ নিয়ম। রাজু সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম হইতে দেয় না, … এইখানে অন্য চাকরের তুলনায় রাজুর অসাধারণত্ব। ব্যারিস্টার হইতেছে নিয়মের রক্ষক, সেই ব্যারিস্টারের চাকর হইয়া রাজু নিয়ম ভাঙিবে!

অবশ্য নেহাত সামনে পড়িয়া গেলে আমি কখনও কখনও নিজের চিঠি বাহির করিয়া ল‍ই। বলিলাম, “দেখি, আমার কিছু আছে কি না।”

রাজু যেন একটু নিরুপায় হইয়া তাড়াটা দিল।

অনিলের একখানা চিঠি আসিয়াছে।