২
আমারও রক্ষাকবচের আয়োজন হইতেছিল।
বিএ পাশ করিয়া বেশ একটু ক্লান্তি আসিয়াছে। বাড়ির বাড়া ভাত খাইয়া কলেজে হাজিরা দিয়া পাশ করা নয় তো, হোস্টেলের আড্ডা জমাইয়াও নয়। উদয়াস্ত মাস্টারি, প্রাইভেট টুইশ্যন। চারিটি বৎসর একদণ্ডের জন্যেও সরস্বতী দেবীর এলাকার বাহিরে পা দিতে পারি নাই। বীণাপাণি সরস্বতীর নয়, শুদ্ধ বাগ্দেবীর—বাক্যের অধীশ্বরীর। অর্থাৎ জীবনের সমস্ত সরসতা বিসর্জন দিয়া এই চারিটি বৎসর শুধুই বকিয়াছি। সকালের দুই টুইশ্যনে পাঁচটি ছেলে—ছোট ছেলে। বিকালে, কলেজ-ফেরত বাসায় আসিবার পথে একটি ধাড়ি—তিন-তিনবার ম্যাট্রিকুলেশন-বুড়ি ছুঁইয়া আসিয়াছে। তাহার পর সন্ধ্যা যাইতে না যাইতে বাসায় টুইশ্যন—তিনটি ছেলেমেয়ে ও একজন বৃদ্ধ, আমার মনিবের খুড়া। বৃদ্ধের টুইশ্যনটা একটু বাড়াইয়া বলিতেছি, আসলে টুইশ্যন নয়, তাঁহাকে খবরের কাগজ পড়িয়া শোনাইতে হইত, ছেলেমেয়েদের পড়ার পাট শেষ হইলে। তিনি আবার বেতর কালা ছিলেন, প্রায়-কথাটাই তাঁহাকে দুইবার করিয়া শুনাইতে হইত। বৃদ্ধ এদিকে কিন্তু লোক ভাল ছিলেন এবং ভাল লোক ছিলেন বলিয়াই আমার নিকট হইতে ফালতু কাজটুকু করাইয়া লইতেন; তাঁহার বিশ্বাস এই ছিল যে এটা আমায় মস্তবড় অনুগ্রহ করিতেছেন,—টুইশ্যনের অধিক এই কাজটুকু লইয়া আমায় যেন নিছক গৃহশিক্ষকেরও অধিক একটু জায়গা দিলেন। এক এক সময় বেশী প্রীত হইয়া বলিতেন, “না, তোমার পড়ার বেশ কায়দা আছে শৈলেন।”
নিতান্ত ভদ্রতার মিথ্যা এটুকু, কেন না, সমস্ত দিনের কসরতের পর গলা আমার তখন সমস্ত কায়দার বাহিরে। আমিও একটা ভদ্রতার মিথ্যায় জবাব দিতাম—তাঁহার কানের নিদারুণ অত্যাচারের কথা চাপা দিয়া বলিতাম, “আপনাকে শুনিয়েও বেশ একটা সুখ আছে; বহু ভাগ্যে এমন একজন শ্রোতা পাওয়া যায়।”
যখন আহারে বসিতাম অনর্গল বকিবার ফলে পেট আর বুক দুইটাই এমন ফাঁকা হইয়া থাকিত যে, কোণ্টা পেট আর কোণ্টা বুক যেন সাড় থাকিত না।
আমার পাস করিবার জীবনটা অতিবাহিত করিয়া আসিয়াছি বাক্যের মরুভূমির ভিতর দিয়া—মহাশ্বেতা বাঙ্ময়ী সরস্বতীর এলাকা। যখন বিএ পাশ করিলাম তখন আমি শুষ্ক, পরিশ্রান্ত। শুধু এইটুকুই নয়, অনুভব করিলাম জীবনের একটা মস্ত বড় ক্ষতি হইয়া চলিয়াছে। টুইশ্যন সংগ্রহ করিতে এবং সংগ্রহ করিবার পর বজায় রাখিতে ঝুটা-সাঁচ্চা উভয়বিধ কৃতজ্ঞতার জন্য গাজেনদের খোশামোদ করিতে করিতে মেরুদণ্ড যাইতেছে বাঁকিয়া। বাক্যের অর্ঘ্য রচনায় পাই আনন্দ। হারানো দম বোধ হয় ফিরিয়া পাইতে পারি, কিন্তু এ সর্বনাশ হইতে কখনও উদ্ধার পাইব কি না জানি না। মোট কথা আমার পাস করিবার যে আনন্দ সেটা ঠিক সাফল্যের আনন্দ নয়, একটা মুক্তির স্বস্তি, মনে হইল কি একটা অসহ্য অবস্থা হইতে যেন অব্যাহতি পাইলাম।
জীবনের এই সুর পরিবর্তনের মাহেন্দ্র লগ্নের ওদিকে সানাইয়ের আমেজ উঠিল। আমি তখন পরীক্ষা দেওয়ার পর পূর্ব-উপকূলে ভ্রমণে বাহির হইয়াছি। প্ল্যান হইয়াছে পরীক্ষার ফল বাহির হইবার মুখে কলিকাতায় ফিরিব তাহার পর দেশে—আমাদের প্রবাসভূমিতে। ভ্রাম্যমাণের নিরুদ্দেশ হাল্কা দিনগুলি বাঁশির সুরে স্বপ্নালু হইয়া উঠিত। খবর পাইতাম বিবাহের আয়োজন হইতেছে। রূপ-রস-শব্দ-গন্ধের জীবন আমায় ডাকিতেছে। কি মধুর! ক্লান্ত চোখে কত অপূর্ব রঙের আভাস যেন ফুটিয়া উঠিতেছে; কত স্বপ্ন;—যেন একটা রূপকথার জগৎ এই জীবনকেই ঘিরিয়া কিভাবে প্রচ্ছন্ন ছিল, তাহার সন্মুখ হইতে পর্দা গুটাইয়া যাইতেছে। বাঁচিয়াছি, শুষ্ক পাঠের উপর আর স্পৃহা নাই। বাঁচিয়া আবার ঐ মরণের দিকে পা বাড়াইব না।
ঠিক এই সময় একটা ব্যাপার হইল যাহাতে কলেজ, পড়া, পাসকরা—যে সবকে মরণ ভাবিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইয়াছিলাম তাহারা আবার নূতন সুরে ডাক দিল। আহ্বানটা আসিল ও নিতান্ত অপ্রত্যাশিত একটা দিক হইতে।
ভ্রমণ হইতে ফিরিয়া আসিয়া খবর পাইলাম পাস করিয়াছি। পাততাড়ি গুটাইতেছিলাম, অৰ্থাৎ বাড়ি যাইব, বাঁধাছাঁদা হইতেছিল, স্টেট্সম্যান পত্রিকার একটা পাতা ছিড়িয়া আমার প্রিয় একটি সিনেমা-আর্টিস্টের ছবি মুড়িয়া বাক্সে তুলিয়া রাখিব, হঠাৎ সেই ছিন্ন পত্রিকার বিজ্ঞাপনের গোটা দুই অসংলগ্ন লাইন চক্ষে পড়িল—
‘আবেদনকারী স্বয়ং আসিয়া সাক্ষাৎ করুন। শুরু প্রসাদ রায়, ব্যারিস্টার, ৩৫/৩/১, লিণ্ডসে ক্রেসেণ্ট, বালিগঞ্জ।’
আবেদন করিয়াই জীবনের এতটা কাটিয়াছে, কাজেই একটা কৌতূহল হইল, এ আবার কিসের আবেদন? বিজ্ঞাপনের বাকিটুকু মোড়কের ভাঁজের মধ্যে লুপ্ত হইয়াছে, আবার ভাঁজ খুলিয়া পড়িলাম।
‘একটি নয়-দশ বৎসরের বালিকার জন্য একজন গ্র্যাজুয়েট গৃহশিক্ষক প্রয়োজন। গৃহশিক্ষকতা সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা আছে এমন লোকই বাঞ্ছনীয়। আবেদনকারী স্বয়ং আসিয়া’…ইত্যাদি —
কয়েকবার পড়িলাম এবং প্রতিবারেই মনটা যেন বেশি করিয়া ঝুঁকিয়া পড়িতে লাগিল। আমায় আকৃষ্ট করিতেছিল স্বয়ং বিজ্ঞাপন-দাতা অর্থাৎ ছাত্রীর পিতা। আরও সঠিকভাবে বলিতে হয়—ঠিক ছাত্রীর পিতা নয়, তাঁহার নামটা। আমার জিভে যেন জড়াইয়া যাইতেছে,—গুরুপ্রসাদ—গুরুপ্রসাদ রায়…যতই নাড়াচাড়া করিতেছি ততই লোকটিকে প্র্যাকটিসে, প্রাচুর্যে, আরামে বেশ হৃষ্টপুষ্ট বলিয়া মনে হইতেছে। এই মনে হওয়ার মধ্যে একটা হিসাবও ছিল বোধ হয়। নামটা অতি আধুনিক সুধীনও নয়, অথবা রীতীশও নয়। গুরুপ্রসাদ নামের গুরুভার কাঁধে লইয়া ব্যারিস্টারি পড়িতে যাইত সে অন্তত চল্লিশ বৎসর আগের কথা। তাহার মানে এখন তাঁহার অন্তত ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ বৎসরের প্র্যাকটিস, বয়স ষাটের ওদিকে একটা বেশ কায়েমী প্র্যাকটিসের উপর গদিয়ান হইয়া বসিয়া আছেন। আশা করা যায় দিবেন-থোবেন ভাল। একটা আরামের পরিবেশের ছবি চক্ষের সামনে ভাসিয়া উঠে।…নিশ্চয় কালা নয়, নিশ্চয় বসিয়া বসিয়া পরের মুখে খবরের কাগজ শুনিবার ফুরসত নাই তাঁহার। লোভ হয়, একবার দেখাই যাক না।
এম-এ পড়িবার এমন সুযোগ ছাড়া উচিত নয়, এ বিষয়বুদ্ধিটা যে একেবারেই ছিল না একথা বলিতে পারি না, তবে আসল কথা ছিল শখ। চার বৎসর ধরিয়া যে নাগাড়ে নয়টি দশটি ছাত্রছাত্রীর হাতে আয়ুক্ষয় করিয়া আসিতেছে তাহার একবার একটি মাত্র ছাত্রীকে পড়াইবার শথ হয়ই। চুরি-ডাকাতির জন্য পাঁচ বৎসর কারাদণ্ড ভোগ করিয়া আসিবার পর আমাদের গাঁয়ের ভূতো বাগ্দী একবার বলিয়াছিল, “এবার আরাম করে তোমাদের স্বদেশী জেল খাটবার বড় আহিংকে হয় দাদাঠাকুর; একবার দেখলে হত।” …এ ব্যাপারটাও অনেকটা সেই রকম—সশ্রম কারাভোগের পর একটু নিশ্চিত কারা উপভোগ মাত্র।
কিন্তু বাধাও আছে। ব্যারিস্টার জীবগুলিকে আমি যেন অন্তনির্দিষ্ট হইয়া এড়াইয়া চলি। মনে হয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, খড়্গ-নাসা এবং বক্র-তর্জনী দিয়া উহারা সর্বদাই যেন অস্ত্রের কথাগুলি পর্যন্ত টানিয়া বাহির করিয়া লইবার জন্য মুখাইয়া আছে। অবশ্য সব ব্যারিস্টারই যে খড়্গ-নাসা এমন নয়, সংসারে খাঁদা ব্যারিস্টারও বিস্তর আছে; তবে আমার মনে কেমন করিয়া একটা টাইপ-চেহারা গাঁথিয়া গিয়াছে।
ধরুন, আমি চাকরির উমেদার হইয়া গেলাম। যেন গিয়া বারান্দার সিঁড়ির নিচের ধাপে দাঁড়াইয়াছি। সামনে প্যাণ্টের পকেটে ডান হাত দিয়া বা হাতের মুঠায় পাইপের আগাটা ধরিয়া ব্যারিস্টার গুরুপ্রসাদ রায়; আমার মুখের উপর ফেলা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, খড়্গ নাসা ইত্যাদি। প্রশ্ন হইল, “কি চান?”
আমার গলা শুকাইয়া গিয়াছে, ঢোঁক গিলিয়া উত্তর করিলাম, “আজ্ঞে স্টেট্সম্যানে দেখলাম।”
“ই-য়েস্, কি দেখলেন বলুন, আউট্ উইথ্ ইট্।”
“আজ্ঞে দেখলাম যে আপনার মেয়ের জন্যে”…
“আর ইউ শিশুর—আমার মেয়ে?”
“আজ্ঞে আপনার নাতনীর জন্যে…”
“স্টেটস্ম্যানে কি আমার নাতনী বলে মেন্শ্যন্ করা আছে?—তাড়াতাড়ি, আমার সময় অল্প।”
ততক্ষণে আমাব দফা অর্ধেক নিকেশ হইয়া গিয়াছে। প্রাণপণ শক্তিতে নিজেকে সামলাইয়া লইয়া, একদমে সবটা বলিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিয়া কহিলাম, “আজ্ঞে, দেখলাম নয়-দশ বৎসরের একটি মেয়ের জন্যে একজন টিউটর…”
“এক্সপিরিয়েন্সড্, গ্র্যাজুয়েট টিউটর।”
“আজ্ঞে হ্যাঁ, একজন এক্সপিরিয়েন্সড্ গ্র্যাজুয়েট টিউটর দরকার আপনার, তাই…”
“আপনার এক্সপিরিয়েন্স?”
“আজ্ঞে আমি চার বৎসর ধরে দিনে আট-দশটি ছেলেমেয়ে পড়িয়ে এসেছি।”
ব্যারিস্টার অধরোষ্ঠ কুটিল বিদ্রূপে কুঞ্চিত হইয়া উঠিল।—আঁতের কথা বাহির হইয়া পড়িয়াছে—শখ। …উত্তর হইল, “তার মানে জঙ্গলে খেটেছেন বলে বাগানেও কাজ করতে পারবেন। …না, আমার একটু অন্য ধরনের অভিজ্ঞ লোক চাই; আপনি আসুন, নমস্কার।”
কাল্পনিক গুরুপ্রসাদের সঙ্গে এই রকম একটা কাল্পনিক কথাবার্তা হইয়া গেল। বিজ্ঞাপনটার দিকে চাহিয়া একদিকে লোভ আর অপর দিকে আশঙ্কা—এই দোটানায় ‘পড়িয়া যাইব কি যাইব না’ যেন ঠিক করিয়া উঠিতে পারিতেছিলাম না।
শেষ পর্যন্ত কিন্তু যাওয়াই স্থির করিয়া ফেলিলাম, তাহার কারণ শুধু একটা মনগড়া আশঙ্কায় এমন একটা সুবিধা ছাড়িবার চিন্তায় নিজের মনের কাছেই যেন নিজেকে অপরাধী বলিয়া বোধ হইতেছিল। ব্যারিস্টারের ভয়ে শখের দিক্টা যেমন কমিয়া আসিতেছিল, ব্যারিস্টারের বাড়ি বলিয়াই ইহার বৈষয়িক দিকটা তেমনি স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছিল। মনে হইতেছিল, চাই কি এই সুযোগে জীবনের গতিটাই ফিরিয়া যাইতে পারে। দুশ্চিন্তারহিত প্রচুর অবসরের মধ্যে বেশ ভালভাবেই এম-এ-টা হইতে পারে, আই-এ পাশ করা পর্যন্ত জীবনের যা একটা প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। একটা কৃতি মানুষের সাহচর্যে ও সাহায্যে জীবনে ভালভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়া যাইতে পারি। শেষ পর্যন্ত যদি কপাল তেমনভাবেই খোলে তো কত কী না হইতে পারে?—কল্পনা একেবারে অর্ধেক রাজ্য ও রাজকন্যাদানের কোঠায় গিয়া ঠেকিল; সংস্কৃত, বাংলা, ইংরেজী—নানারকম তত্ত্ববাক্যের হুড়াহুড়িতে মনটা গরম হইয়া উঠিল; সেক্সপীয়রের অমর বাণী—‘দেয়ার ইজ এ টাইড্ ইন্ দ্য এফেয়ার্স অব মেন’… বাঁধা-ছাঁদা ছাড়িয়া খানিকটা চিন্তা করিলাম—ভগবান এদিকে নামে যেমন লোকটিকে গুরুপ্রসাদ করিয়াছেন, ওদিকে পেশায় যেমনি ব্যারিস্টার না করিয়া যদি ডাক্তার কিংবা জজ-মুন্সেফ গোছের কিছু একটা করিয়া দিতে পারিতেন তো সোনায় সোহাগা হইত। কিন্তু তাহা যখন হয় নাই…
চিন্তার মাঝেই একবার গা-ঝাড়া দিয়া উঠিয়া পড়িলাম; না, জুজুর ভয়ে বসিয়া থাকিলে চলিবে না; ব্যারিস্টার তো ব্যারিস্টার সই। জীবনের যত মঙ্গল সব থাকে বিপদের অন্তরালে, বীরের মত পা ফেলিয়া গিয়া সেই বিপদের সামনে দাঁড়াইতে হইবে। দেরি করা নয়, ‘শুভস্য শীঘ্রম’।