১৯
শেষের দিকে আমার কথা অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক ধরনের চাপা ভয়ে, বিস্ময়ে, আবেগে মীরার মুখের চেহারা প্রতিমুহূর্তেই কি এক যেন অদ্ভুত রকম হইয়া উঠিতেছিল। অন্তরে অন্তরে সে অতিরিক্ত চঞ্চল হইয়া উঠিতেছে, আমায় শেষ করিতে না দিয়াই সে প্রশ্ন করিল, “আপনি যাবেন?—সে কি?—যাবেন কেন?—যাবার কথা কি হয়েছে এমন…”
এই সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত প্রস্তাবে মীরা সংযম হারাইয়া ফেলিয়াছে। আমার সংযম হারাইবার কোন বালাই নাই, আমি আজ দ্রষ্টা মাত্র, দেখিতেছি। বুঝিতেছি মীরা একটা অসহ্য অবস্থায় পড়িয়াছে—সে বুঝিতেছে নিজেকে সংযত করা দরকার, সাধারণ অনুরোধের চেয়ে একটা কথাও বেশি বলা তাহার শোভা পায় না, মুখচোখে তাহার একটা অবহেলা বা নির্লিপ্ততার ভাব থাকা দরকার—একজন মাস্টার ঘাইতে চাহিতেছে, একবার মুখে বলা থাকিবার কথা—একটা মামুলী, মৌখিক ভদ্রতা, তাহার পরও যাইতে চাহে, যাক। আবার শত শত মাস্টারের দরখাস্ত পড়িবে।
কিন্তু এই নিতান্ত দরকারী ভাবটা—কথায় এবং চেহারায় মীরা কোনমতে আনিতে পারিতেছে না। তাহার কারণ ওর চেয়েও একটা ঢের বড় প্রয়োজন আছে, মীরার সমস্ত সত্তার সঙ্গে যাহার সম্বন্ধ, অর্থাৎ আমার এখানে থাকাটা।… মীরা যে এতদূর আগাইয়া গিয়াছে আমার এই বিদায় ভিক্ষার পূর্বে সে জানিত না, আবিষ্কার করিয়া যেন অসহায়ভাবে শঙ্কিত হইয়া পড়িয়াছে। অবশ্য আমিও এতটা জানিতাম না। কিন্তু আমি অবিচ্ছেদের জন্য শঙ্কিত নই, মুক্তি আমার ডাক দিয়াছে, আমি সাড়া দিয়াছি।
ভালবাসা দুর্বল আমার?—তাহাতে খাদ আছে?—তা সে কথা তো গোড়াতেই স্বীকার করিয়াছি যে পুরুষের ভালবাসা মেয়েদের ভালবাসার শতাংশের একাংশও নয়।
আমি শান্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠেই বলিলাম, “আমায় যেতেই হবে মীরা দেবী।”
মীরা স্থির নেত্রে আমার মুখের পানে চাহিল, প্রতিজ্ঞার মধ্যে কোথাও একটু দুর্বলতা আছে কিনা আমার মুখের রেখায় তাহার অনুসন্ধান করিল। তাহার পর বলিয়া উঠিল, “না, যাওয়া আপনার হ’তেই পারে না শৈলেনবাবু।”
প্রশ্ন করিলাম “কেন?”
মীরা একটু চিন্তা করিল, তাহার পর কৌচে হেলিয়া পড়িল! আঁচলের একটা কোণ ধীরে ধীরে পাকাইতে পাকাইতে বলিল, “কেন? কেন?… আপনি যাবেনই বা কেন তাও তো বুঝছি না।”
বলিলাম, “বললাম তো সব কথা।”
“কি কথা?…ও, হ্যাঁ, কিন্তু সে সম্বন্ধে তো বললাম আপনাকে।”
“কি বললেন!”
মীরা বড় অন্যমনস্ক হইয়া পড়িতেছে।
একটু চুপ করিয়া রহিল, কপালের চুল চারিটি আঙুল দিয়া উপরে তুলিয়া দিতে লাগিল, তাহার পরে খোঁজ করিতে করিতে কথাটা হঠাৎ যেন মনে পড়িয়া গিয়াছে এইভাবে বলিল, “বাঃ, বললাম না যে ওটা খালি সম্ভাবনার কথা বলছিলাম? আপনি এত শীগগির ভোলেন! “শেষের কথাটুকু বলিল একটু হাসিবার চেষ্টা করিয়া।
আমি বলিলাম, “তার উত্তরও তো আমি দিয়েছি,–অর্থাৎ সম্ভাবনা রয়েছে বলেই—একটা অমার্জনীয় অপরাধ ক’রে ফেলা সম্ভব বলেই আমার যাওয়ার দরকার এ-জায়গা থেকে। … মীরা দেবী বিশ্বাস করুন সরমা দেবী সম্বন্ধে একটু কথা বলতেও, ওঁকে নিয়ে এ-ধরনের আলোচনা করতেও আমি অত্যন্ত ব্যথিত হচ্ছি…… আমার ছেড়ে দিন।”
মীরা নিরাশ ভাবে এলাইয়া পডিল; তাহার পর ধীরে ধীরে কণ্ঠস্বরে নির্লিপ্ত ভাব বজায় রাখিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, “যাবেনই? তা বেশ।”
পরক্ষণেই তাহার যেন মস্ত বড় একটা অবলম্বনের কথা মনে পড়িয়া গেল, আবার হাসিবার প্রয়াস করিয়া বলিল, “বেশ, আমার আপত্তি নেই শৈলেনবাবু, আপনি যেতে চাইছেন, কেনই বা থাকবে আপত্তি? তরু কিন্তু আপনাকে কখনই ছাড়বে না। পারেন তো যান আপনি, আমার কোনই আপত্তি নেই। এক্কেবারেই না।”
বুঝিলাম তরু যে আমার রুখিবেই তাহার প্রেরণাটা কোথা থেকে পাইবে সে। আমি হাসিয়া বলিলাম, “বেশ, সেই কথাই থাক্।”
মীরা আবার একটু দ্বিধায় পড়িল, উহারই মধ্যে স্বচ্ছন্দ ভাবটা ধরিয়া রাখিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, “আপনি রাজি করে নেবেন তরুকে?”
হাসিয়া বলিলাম, “সেটুকু ভরসা আছে বৈ কি!”
“কি করে?”
“আপনার মত বুদ্ধিমতীর কাছ থেকে অনুমতি আদায় করতে যে কসরতটা হল সেটা কি বৃথা যাবে মীরা দেবী? শক্তি বৃদ্ধি হ’ল তো? তাই দিয়ে একটা ছোট মেয়েকে আর ভোলাতে পারব না?”–একটু হাসিলাম।
মীরা বলিল, “আপনি ভুল করছেন শৈলেনবাবু, তার শক্তি ভালবাসায়, স্নেহে, সেখানে আপনার হারতেই হবে।”
হাসিয়া বলিলাম, “ওই ভালবাসাই তো জোর আমার মীরা দেবী। ওর দোহাই দিয়েই তো জিতব আমি।”
“কি রকম?”
“বলব—তোমায় মাস্টারমশাইকে এত ভালবাস তরু, তবু তাকে আটকে রাখতে চাইছ?—বাঁধার ভয়ে সে নিজে কাতর হচ্ছে জেনেও?”
নিজেকে হাজার সংযত করিবার চেষ্টা করিয়াও আমি কথাটা বলিয়া ফেলিলাম। তরুর নাম করিয়া মীরাকে আমার মর্মের কথাটা যাইবার পূর্বে একবার শুনাইয়া দিবার লোভটা কোনমতেই সম্বরণ করা গেল না, বলার মিষ্টতাটুকু থেকে রসনাকে বঞ্চিত করিতে পারিলাম না।…সত্যিই তো; ওরই বাঁধনের তো ভয়—এত গ্লানি মাথায় করিয়াও যে বাঁধন কাটা দুষ্কর হইয়া পড়ে।…কিন্তু আজও অনুতাপ হয়, নিজের সাধ মিটাইতে গিয়া সেই প্রথম আমি মীরার চক্ষে জল টানিয়া আনি।
অনুতাপের পাশে পাশে এও ভাবি—ঐটুকুই আমার সম্বল—এ অশ্রুবিন্দুর স্মৃতিটুকু, না হইলে কি লইয়া বাঁচিতাম?
মীরার চক্ষু ছলছল করিয়া উঠিল। টলটলে দুই বিন্দু জল, ঘরের চারদিকে সবুজের আভা পড়িয়া দুইটি মরকতের মত দেখাইতেছে। মনটা আমার বেদনার মথিত হইয়া উঠিল—কেন বলিতে গেলাম কথাটা? দরকার কি বাঁধন ছিঁড়িবার? এই বাঁধনেই বাঁধা থাকি না চিরদিন…
“মীরা দেবী…” বলিয়া কি একটা কথা বলিতে যাইতেছিলাম, এখন ঠিক গুছাইয়া মনে পড়িতেছে না। মীরা চোখের জলে একটু বিব্রত হইয়া পড়িয়াছে, তাড়াতাড়ি এ-পর্বটা শেষ করিবার জন্যই যেন বলিল, “আপনি যাবেনই। সত্যিই তো, যেতে চাইলে তরুর সাধ্য কি বাঁধে…”
কথাটা আটকাইয়া গেল।
মীরার কৌচের পিছনে খোলা জানালা দিয়া এক ঝলক হাওয়া প্রবেশ করিয়া টেবিলের উপর থেকে গোটা দুই-তিন পাতলা কাগজের টুকরা উড়াইয়া দিল। মীরা বাঁচিল। তাড়াতাড়ি উঠিয়া জানালাটা বন্ধ করিবার জন্য আমার দিকে পিছন ফিরিয়া গরাদ ধরিয়া দাঁড়াইল। অশ্রুর লজ্জা গোপন করিতেছে মীরা। জানালা বন্ধ কবিবার কোনই প্রয়োজন নাই, ঘরের গুমট ভাঙিতে ঐ রকম কয়েক ঝলক হাওয়াই দরকার বরং। ধীরে ধীরে হাত বাড়াইয়া জানালার পাল্লা দুইটা টানিতে টানিতে বলিল, “আমি শুধু এই জন্যে বলছিলাম যে আমার মনে একটা চির জন্মের মত খেদ থেকে যাবে।”
কিসের খেদ? যাইবার সময়, চোখাচোখি না হইয়া থাকিবার এই সুযোগে মীরা কি মন উজাড় করিয়া আমাকে তাহার অন্তরতম কথাটি বলিবে? এমন হয়। যখন সব সম্বন্ধ ফুরাইয়া আসে তখন পরম সম্বন্ধের কথাটা বলা যায়। একটু উৎকর্ণ হইয়া রহিলাম, তাহার পর প্রশ্ন করিলাম, “খেদ কিসের?”
জানালা বন্ধ করিতে অত বিলম্ব হয় না, আসল কথা, মীরা নিজেকে, নিজের অবুঝ অশ্রুকে বিশ্বাস করিতে পারিতেছে না, এখন ধারায় নামিয়াছে কিনা তাহাই বা কে জানে? একটা পাল্লা আবার একটু বাহিরে ঠেলিয়া দিয়া মুখ না ফিরাইয়া বলিল, “আপনি রূঢ় ব্যবহার পেলেন আমার কাছ থেকে, তাই… কাল তারপর চিঠি‥”
আবার থামিয়া গেল, আর যেন ও নিজেকে সামলাইতে পারিতেছে না।
আমিও এবার বোধ হয় সংযম হারাইতাম; কিন্তু ঠিক এই সময়টিতে তরুর মোটর আসিয়া থামিল এবং তরু কিছুমাত্র অবকাশ না দিয়া, দু-একটা সিঁড়ি বাদ দিতে দিতেই হুড়হুড় করিয়া উপরে উঠিয়া আসিতে লাগিল।
লুকোচুরি সামলাইতে গিয়া, আমরা উভয়ে উভয়ের কাছে আরও স্পষ্ট করিয়া ধরা পড়িয়া গেলাম, মীরা জানালা বন্ধ করিতে উঠিয়াছিল, চেষ্টাও করিতেছিল, কিন্তু তরুর পায়ের শব্দে তাড়াতাড়ি পাল্লা দুইটা বাইরের দিকে ঠেলিয়া দিয়া কৌচে আসিয়া বসিল। ভাবিবার চিন্তিবার পূর্বেই তাহাকে আরও একটা কাজ করিতে হইল, অঞ্চল তুলিয়া চক্ষু দুইটি মুছিয়া লইতে হইল—নিতান্ত আমার সামনা-সামনিই। আমিও বিষণ্ণতা চাপা দিয়া মুখে হাসির ভাব টানিয়া আনিলাম।
তরু পর্দাটা এক সাপটে সরাইয়া ঘরে আসিয়া পড়িল। আমাকে দেখিয়া একটু থমকাইয়া দাঁড়াইল, কখনও দেখে নাই আমায় এ-ঘরে; মীরার মুখের পানে চাহিয়া একটু বিস্মিত হইল, চোখে জল না থাকিলেও পাপড়ি তাহার ভিজা তখনও। আমরা দু-জনই একসঙ্গে প্রশ্ন করিলাম, “কি তরু?”
মীরা আরও একটু বাড়াইয়া বলিল, “বড় ফুর্তী তোমার দেখছি!”
তরু বর্তমান ভুলিয়া তাহার স্ফুর্তীর কারণের ব্যাপারে গিয়া পড়িল, বলিল, “আমাদের মেজ গুরুমার বিয়ে তাই ..”
আমরা দু-জনেই হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিলাম; মীরা বলিল, “তাই এত ফুর্তী? আমরা ভাবলাম তোমার নিজের বিয়ে বুঝি!”
“যাঃ”—বলিয়া তরু ছুটিয়া গিয়া দিদির কোলে মুখ লুকাইল।
মীরা বলিল, “তুমি কি দেবে গুরুমাকে?—এক ঝুড়ি ফুল দিয়ে এস, ইমানুলকে বলে দেব আমি।”
তরু মুখটা তুলিয়া আবদারের সুরে বলিল, “আর একটা পদ্য দিতে হবে, হুঁ…”
মীরা আবার হাসিয়া বলিল, “ও প্রীতি-উপহার! তা তো চাই-ই, না হ’লে বিয়ে পাকাই হবে না তোমার গুরুমার। কিন্তু সে তো মুশকিল, তোমার মাষ্টারমশাইকে এবার আমাদের ছেড়ে দিতে হবে; কে লিখে দেবে তোমায়?”
তরু বিস্ময়ের সহিত ঘাড় বাঁকাইয়া আমার পানে চাহিল, বিদ্রুপের মধ্যে এই গভীর কথাটা বিশ্বাস করিবে কি না বুঝিতে পারিতেছে না। একবার দিদির সিক্ত চোখের পানে চাহিল। মীরা বিব্রত হইয়া মুখ ঘুরাইতে যাইতেছিল, আমি হাসিয়া বলিলাম, “যাতে ছেড়ে না দেন সেই জন্যেই আমি ওঁর দরবার করতে এসেছি তরু; তুমিও বল না আমার হয়ে, তাহ’লে খুব ভাল ক’রে তোমার মেজ শুরুমার বিয়ের প্রীতি-উপহার লিখে দোব’খন—প্রীতি-উপহার তো নয়, শ্রদ্ধাঞ্জলি।”
কঠিন এক রহস্যের মধ্যে পড়িয়া তরু আবার তাহার দিদির মুখের পানে চাহিল।
মীরা ভ্রূ-কুঞ্চিত করিয়া নত নয়নে আমার কথাগুলা শুনিতেছিল, একবার চকিতে আমার পানে চাহিয়া লইল, তাহার পর তরুর পিঠে দুই-তিনবার হাত বুলাইয়া নিয়া বলিল, “আচ্ছা, হবে না ছাড়া। পদ্যর বন্দোবস্ত হ’ল তো? এবার আগে জামা-জুতো ছাড়গে তরু, যাও।”