১৮

পরের দিন প্রভাতে রৌদ্র ছিল মলিন, সমস্ত বাড়িটা থমথম করিতেছে। হয়তো আসলে এরকম নয়, আর সব প্রভাতের মতই এটাও, শুধু আমার মনের ছায়া পড়িয়া এমনটা বোধ হইতেছে।

মীরা এদিকে রোজ সকালে বাগানে আসে। আমাদের অভিবাহনের বিনিময় হয়। আজ নামে নাই।

বেলা প্রায় নয়টা। তরু লক্ষ্মীপাঠশালা হইতে ফিরিয়া আসে নাই। মিস্টার রায় সকাল সকাল বাহির হইয়া গেলেন। আমি শ্রান্ত চরণে গিয়া মীরার ঘরের সামনে দাঁড়াইলাম। কাল তাহার চিঠি পাওয়ার পর থেকেই আহত মর্যাদার একটা তেজ অনুভব করিতেছি, সেই আমায় ঠেলিয়া আনিয়াছে, সেই আমায় মুক্তি দিবে। … কিন্তু কি অসীম ক্লান্তি! মুখ দিয়া যেন কথা বাহির হইতেছে না!

তাহার পর চেতনা হইল—এমনভাবে মীরার ঘরের সামনে দাঁড়াইয়া থাকাটা কেহ দেখিয়া ফেলিতে পারে। ঠিক শোভন নয়।

নিজে বেশ বুঝিতেছি একটা বিকৃত স্বরে প্রশ্ন করিলাম, “মীরা দেবী আছেন?”

উত্তর হইল, “কে ‥ আসুন।”

আমি পর্দা উঠাইয়া ভিতরে গিয়া দাঁড়াইলাম।

মীরার ঘরটি একেবারে বিলাতী কায়দায় সজ্জিত। দেয়ালটা হালকা সবুজ রঙে রঙীন। মেঝেয় সেই রঙের মোটা কার্পেট, তাহার উপর কৌচ, সেটী, চেয়ার, কারুমণ্ডিত ছোট ছোট টেবিল, সবগুলিই ঈষৎ গাঢ় থেকে হালকা সবুজ রঙে সুসমঞ্জসিত। একদিকে একটা দেরাজসুদ্ধ মাঝারি সাইজের টেবিল। তাহার পাশে দুইটি অদৃশ্য আলমারি ঝকঝকে বাঁধানো বইয়ে ঠাসা। দেয়ালের ছবিগুলি প্রায় সব বিদেশী—র‍্যাফেল, মাইকেল এঞ্জেলো থেকে আরম্ভ করিয়া রেনল্ডস্, টার্নার, মিলে প্রভৃতি অপেক্ষাকৃত আধুনিক যুগের চিত্রকরদের আঁকা; দেশীর মধ্যে কলিকাতার আর্ট একজিবিশনের পুরস্কার প্রাপ্ত ইউরোপীয় পদ্ধতিতে আঁকা তিন-চারখানি ছবি।

ঘরটি সাজানোর মধ্যে রুচির পরিচয় আছে, তবে একটু যেন বাহুল্য-ঘেঁষা; দু চারখানা আসবাবপত্র ও খানকতক ছবি কম থাকিলে যেন আরও ভাল হইত। … মীরার রুচি আছে, তবে সেই সঙ্গে আধিক্যপ্রিয়তার একটা ছেলেমানুষিও আছে। মেয়েছেলের মন একটু ছেলেমানুষি-ঘেঁষাই লাগে ভাল, অন্তত আমার তো ভাল লাগে।

মীরার ঘরে দেবদেবীর ছবি নাই; এই দিক দিয়া মায়ের সঙ্গে আড়াআড়িটা খুব স্পষ্ট।

অন্য কেহ ভাবিয়া মীরা স্বর শুনিয়াই “আসুন বলিয়া দিয়াছে, আমি আসিব মোটেই এটা ভাবে নাই। এই প্রথম আসাও আমার। টেবিলের উপর একটা কৌচে হেলান দিয়া পড়িতেছিল মীরা, অন্তত আমি যখন প্রবেশ করিলাম তাহার পাশেই একটা ছোট টেবিলে একটা খোলা বই ওণ্টান পড়িয়াছিল, এবং তাহার উপর মীরার হাতটা ছিল।

কিন্তু একি চেহারা মীরার! আমি আসিবার সময় বারান্দার হ্যাটস্টাণ্ডের গোল আর্শিটাতে আমার নিজের চেহারার প্রতিচ্ছায়া হঠাৎ দেখিয়া চমকিয়া উঠিয়াছিলাম; মাত্র একটি রজনীর জাগরণ আমার; মীরা যেন ক-রাত্রি ঘুমায় নাই। মুখটা শুকাইয়া যেন লম্বাটে হইয়া গিয়াছে, চোখে রাজ্যের শ্রান্তি।

আমি ভিতরে আসিতেই মীরা বিস্মিত হইয়া মুহূর্ত মাত্র আমার পানে চাহিয়া রহিল, পরক্ষণেই সোজা হইয়া বসিয়া বলিল, “ও! আপনি?”

আমি বলিলাম, “একটু দরকার পড়ে গেল, আসতে হ’ল, ইণ্ট্রড্ করলাম কি?”

আর সময় দিলাম না; বিনয়টুকু প্রকাশ করিয়াই সঙ্গে সঙ্গে বলিলাম, “কাল রাত্রে রাজু আমায় একটা চিঠি দিয়ে আসে…”

মীরা ভদ্রতার খাতিরে উঠিয়া দাঁড়াইতে যাইতেছিল, যেন ভুলিয়া গেল! আমার পানে চাহিয়া থাকিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু পারিল না, তাহার দৃষ্টি নত হইয়া গেল। আমি বলিলাম, “আর জিজ্ঞাসা করবার অত দরকার দেখি না, তবে আত্মতৃপ্তি বা স্পষ্টভাবে অতৃপ্তির জন্যে আমি একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি, মীরা দেবী—চিঠিতে যে কথাটার সংকেত আছে সে কি সত্যিই আপনি বিশ্বাস করেন?”

মীরা নিজের উপর সংযম হারাইতেছে, স্ত্রীলোক তো? তাহার উপর সেই স্ত্রীলোক যে ভালবাসিয়াছে। ভালবাসা দুর্বল করে; পুরুষকেও করে, স্ত্রীলোককেও করে, কিন্তু স্ত্রীলোককে যতটা করে পুরুষকে তার শতাংশের এক অংশও করে না বোধ হয়। এই দুর্বলতায় স্ত্রী পুরুষের চেয়ে ঢের বেশি শক্তিশালিনী। মীরা যেন ব্যাকুল হইয়া পড়িল, আমার মুখের উপর শঙ্কিত দৃষ্টি তুলিয়া প্রশ্ন করিল, “কি সংকেত—সংকেত কি? আমি তো শুধু…” শেষ করিতে পারিল না। একদিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে, আর অন্য দিকে উত্তর নিষ্প্রয়োজন বলিয়া নির্বিকার দৃষ্টিতে আমরা উভয়ে উভয়ের দিকে একটু চাহিয়া রহিলাম। তাহার পর আমি বলিলাম, “সরমা দেবী যে আপনার দাদার বাগদত্তা সেটা আমি অনেক আগে থেকেই জানি, মীরা দেবী। আর জানার পর থেকে ওঁকে যতটুকু দেখতে বা বুঝতে পেরেছি, তা দিয়ে ওঁর সম্বন্ধে আমার খুব একটা বিস্ময়ের আর শ্রদ্ধার ভাব আছে। আমি এ সম্বন্ধে বেশি কিছু বলব না, কেননা, খুব গভীর অনুভূতি আর উপলব্ধি সম্বন্ধে বলা আমার স্বভাববিরুদ্ধ। কথা জিনিসটা নিজেই হাল্‌কা বলে, মনে হয় উপলব্ধিটাকেও হাল্‌কা ক’রে ফেলবে। আমার এত কথা বলবার ইচ্ছা ছিল না; কিন্তু এসে পড়ল। আসলে এ প্রসঙ্গটা তোলবারই ইচ্ছে ছিল না আমার; আমি বলতে এসেছিলাম অন্য কথা।”

মীরা দৃষ্টি নামাইয়া লইয়াছিল, আবার তুলিয়া আমার মুখের পানে চাহিল। আমি বলিলাম, “আমি বলতে এসেছিলাম–আপনি যে আপনার সম্বন্ধে নিরাশ হয়েছেন এটা আমি বেশ অনুভব করছি—এই তরুর টিউটর বাছাই সম্বন্ধে।”

মীরা সচকিত হইয়া প্রশ্ন করিল, “সে কি!”

আমি ওর কথার উত্তর না দিয়া বলিলাম, “এটা যে হবেই, আমার বরাবরই এ-রকম একটা আশঙ্কা ছিল—যে রকম বিশেষ কিছু জিজ্ঞাসাবাদ না ক’রেই, পরিচয় না নিয়েই আপনি আমার কাজে নিয়োগ ক’রে নিলেন। আমি অনেকবার দেখেছি, আপনার চেহারায় অনুতাপের ভাব ফুটেছে, যেন আপনি ঠকেছেন, যেন অন্যরকম টিউটর রাখা উদ্দেশ্য ছিল আপনার।”

মীরা বেশ ভাল করিয়া সোজা হইয়া বসিল; বেশ বুঝিলাম সরমার ব্যাপার থেকে আমার যোগ্যতা-অযোগ্যতার প্রসঙ্গে আসিয়া পড়ায় সে যেন হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিয়াছে। বেশ সপ্রতিভ হইয়া জোরের সহিত বলিল, “না, ও কথা বলে আপনি আমার প্রতি অবিচার করছেন শৈলেনবাবু, আপনাকে রাখার জন্য মোটেই অনুতপ্ত নই আমি। আপনি যে খুব ভাল একজন শিক্ষক মা, বাবা থেকে নিয়ে বাড়ির সবাই একথা স্বীকার করি আমরা। আমার মুখে এ ব্যাপার নিয়ে…”

আজ আমি চলিয়া যাইতেছি, সুতরাং সংকোচের আর প্রয়োজন কি অত? অবশ্য স্পষ্টভাবে মীরাকে আমি পাই নাই, তাই স্পষ্টভাবে কিছু বলার কথা উঠিতেই পারে না, তবু মন তো দু-জনের দু-জনেই আভাসে জানি? আভাসেই একটু বলা যাক না, কাল থেকে দু জনের তো দুই পথ।

মীরাকে শেষ করিতে না দিয়া বলিলাম, “মীরা দেবী, আমার কাজ তরুর মাস্টারি, তাতে আমি যথাসাধ্য করিই—এ আত্মপ্রত্যয়টুকু আমার আছে। আর, একটা মানুষের সবচেয়ে বড় প্রশংসা এই যে, সে যথাসাধ্য করছে। কিন্তু মাস্টারির অতিরিক্ত আর একটা কথা আছে।”

মীরা আমার পানে চাহিয়া বলিল, “বলুন।”

আমার একটু দ্বিধা আসিল, সেটা কাটাইয়া লইয়া বলিলাম, “সে কথাটা এই যে একটা মানুষ আমাদের আশেপাশে থাকলে তার সঙ্গে আমাদের কাজের সম্বন্ধ ছাড়া আরও অনেক সম্বন্ধ এসে পড়ে…”

মীরা দৃষ্টি নত করিয়া বাম অনামিকার আংটিটা ধরিয়া ধীরে ধীরে ঘুরাইতেছিল, এইখানে হঠাৎ থামিয়া গেল, মনে হইল তাহার মুখটাও যেন রাঙা হইয়া উঠিল। আমি মুহূর্ত মাত্র একটু থামিয়া আবার বলিয়া চলিলাম, “কিছু না হোক একজন সঙ্গীও তো সে? কথাটা ঠিক সঙ্গী নয়, ইংরেজীতে যাকে বলে ‘নেবার’ (neighbour) অর্থাৎ যার সঙ্গে আত্মীয়তা না থাকলেও খুব কাছে থাকার হেতু একটা নিবিড় পরিচয় আছে। আমার মনে হয়, এই ‘নেবার’ হিসাবে আমি আপনাকে নিরাশ করেছি।”

মীরা আমার পানে তাহার সেই নিজস্ব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার চাহিল, ক্ষণমাত্র কি একটা ভাবিল, তাহার পর বলিল, “যখনই আপনার সাহায্য চেয়েছি একটুও বিরক্ত না হয়ে আপনি আমার সাহায্য করেছেন; আপনি না থাকলে এই পার্টিটা যে কি হ’ত! এর পরেও আমি মনে করব আপনাকে নিয়োগ করা আমার ভুল হয়েছে? আমায় এত ছোট মনে করলেন কেন আপনি?”

এর পরে কথাটা বলিতে কষ্ট হইল, কিন্তু উপায় ছিল না বলিয়াই বলিলাম, “আমি ঠিক ও-কথা বলতে চাইছি না। সামান্য কি একটু করেছি না-করেছি সে নিয়ে আপনি লজ্জা দেবেন না আমায়। আমি কথাটা অন্যভাবে বলছিলাম—ধরুন, আপনার এই ‘নেবার’ তো এমনও হতে পারে যে, আপনার দাদার বাগদত্তার সম্বন্ধেই একটা অনুচিত মনোভাব পোষণ করতে পারে…।”

ঘুরিয়া ফিরিয়া আবার সেই সরমার কথা। চিঠির প্রসঙ্গটা চাপা পড়ায় মীরা যেন পরিত্রাণ পাইয়াছিল, এবারে কি করিবে, কি বলিবে ভাবিয়া না পাইয়া ধীরে ধীরে সোফায় এলাইয়া পড়িল। হাত দুইটি মুষ্টিবদ্ধ করিয়া মুখের উপর জড় করিয়া একটু মৌন রহিল, তাহার পর ধীরে ধীরে তাহার মুখের রেখাগুলা কঠিন হইয়া উঠিল, নাসিকা-প্রান্তের সেই কুঞ্চন জাগিয়া উঠিল। ধীরে অথচ একটু রুঢ় কণ্ঠে বলিল, “পারে বই কি শৈলেনবাবু।”

আমার সমস্ত অন্তরাত্মা যেন বিদ্রোহ করিয়া উঠিল। কেমন করিয়া স্পষ্টভাবে কথাটা বলিতে পারিল মীরা! আমি বেশ ভাল করিয়া বুঝিতেছি, ও যাহা বলিল তাহা বিশ্বাস করে না। বিশ্বাসই করিবে তো রাজুকে দিয়া চিঠিটা ফিরাইয়া আনিতে গিয়াছিল কেন? ওর এটা বিশ্বাস নয়, পরন্তু সরমার সৌন্দর্য সম্বন্ধে একটা আতঙ্ক, যাহা অযথাই ওর মনে একটা ঈর্ষা আনিয়া দিয়াছে। এই ঈর্ষাটা এই জন্য নয় যে, আমি সরমাকে ভালবাসিয়া থাকিতে পারি, পরন্তু এই জন্য যে, মীরা আমায় ভালবাসে। … মীরা কি রকম মেয়ে আমি ভাল করিয়াই জানি, যদি ওর বিশ্বাস হইত যে, আমি সরমার অনুরাগী, ও ওর প্রবাসী ভাইয়ের এ অপমান কোনমতেই সহ্য করিত না। চিঠি ফেরত লওয়া তো দূরের কথা; চিঠি লিখিতই না, অন্যভাবে এবং অবিলম্বে এ-বাড়ির সঙ্গে আমার সংস্রব ছেদন করিত।

সে-ছেদনে যদি তাহার নিজের মর্মই রক্তাক্ত হইত তো মীরা গ্রাহ্য করিত না।

অবশ্য এখন যে উত্তরটা দিল সেটা আমার তর্কে কোণঠাসা হইয়া, মরিয়া হইয়া; তবুও আমার মনটা এমন বিষাইয়া গিয়াছে যে, আমি মার্জনা করিতে পারিলাম না। বলিলাম, “এত বড় অন্যায় অপবাদ আমি আজ পর্যন্ত জীবনে পাইনি, মীরা দেবী; আর, সবচেয়ে দুঃখের বিষয় এই যে, আপনি বোধ হয় মন থেকে বিশ্বাস না ক’রেও এ অপবাদটা আমায় দিলেন; কেন-না পার্টিতে যে ব্যাপারটুকু হয়েছিল—অর্থাৎ সরমা দেবীকে যে বারদুয়েক প্রশংসা করেছিলাম বা কমপ্লিমেণ্ট দিয়েছিলাম—যা উপলক্ষ ক’রে এতটা ব্যাপার, তার আসল হেতুটা আপনার মত বুদ্ধিমতী একজন যে বুঝতে পারেননি, এটা আমি কখনই বিশ্বাস করব না। কিন্তু যাক্, সেটা আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাসের কথা, ভুল হ’তেও পারে। তাই আমায় ধরে নিতে হবে আপনি বুঝতে পারেননি কারণটা, সুতরাং নিজেকে ক্লীয়ার করবার জন্য আমার বুঝিয়ে দেওয়াই ভাল। সরমা দেবী সম্বন্ধে কাল আমি দু-বার দুটো কথা বলেছিলাম—একবার আপনার মায়ের সাক্ষাতে। আপনার মা সরমাদেবীকে আমার কাছে পরিচিত করার প্রসঙ্গে বললেন, এমন চমৎকার মেয়ে হয় না শৈলেন,…” সরমা দেবী প্রশংসায় লজ্জিত হয়ে হেসে বললেন,—‘এমন চমৎকার কাকীমা হয় না শৈলেনবাবু, শুধু শুধু এত প্রশংসা করতে পারেন!’… আমার শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাসের কথা ছেড়ে দিন, একজন নবপরিচিতা মেয়ে সম্বন্ধে বলা হচ্ছে কথাটা, সে হিসাবেও অপর্ণা দেবীর প্রশংসাটা সমর্থন করা উচিত ছিল আমার। তাই আমি বলি, ‘যোগ্যের প্রশংসায় মস্ত বড় একটা আনন্দ আছে সরমা দেবী।’ তারপর প্রসঙ্গ ধরে আরও একটুখানি প্রশংসা করতে হয়—আমার এই হ’ল প্রথম অপরাধ।”

মীরা তেমনই কঠিন হইয়া বসিয়া আছে; চুপ করিতে আমার মুখের দিকে চাহিয়া আবার দৃষ্টি নত করিল।

আমি বলিতে লাগিলাম, “দ্বিতীয় অপরাধ,—চায়ের টেবিলে আমরা সবাই যখন বসে, তখন কথাপ্রসঙ্গে আমি জানাই যে, সরমা দেবী আসায় আমরা সবাই কৃতজ্ঞ।”

এইবার আঘাতটা একটু ব্যাপকভাবে দেওয়ার জন্য আমার মনটা যেন মাতিয়া উঠিল,—এমন একটা আঘাত দিব যাহা ব্যারিস্টারের কন্যা আর তাহার স্তাবকদের একসঙ্গে গিয়া লাগিবে। আমি তো যাইতেছি,—কিসের দ্বিধা বা সঙ্কোচ?

বলিলাম, “মীরা দেবী, আমি গরীব, পার্টিতে উপস্থিত হবার সৌভাগ্য এবং সুযোগ আমার স্বভাবতই এর আগে পর্যন্ত হয়নি। কিন্তু একটা জিনিস জানি—তা এই যে, আমাদের পার্টি জিনিসটা—শুধু পার্টি কেন, স্ত্রী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার; সারা ব্যাপারটা ইংরেজদের নকল। তা যদি হয় তো নকলটা ঠিকমতই হওয়া উচিত, আধাখ্যাঁচড়া হ’লে বড় বিসদৃশ হয়ে ওঠে। আমি মেয়েছেলের কথা বলছি না, কিন্তু আমাদের টেবিলে কাল যে-কটি পুরুষ বসেছিলেন, তাঁদের দেখে মনে হ’ল যে তাঁরা টাই বাধা, কাঁটা-চামচে ধরা, কি কাপে নিখুঁতভাবে চুমুক দেওয়ার কায়দা রপ্ত করতেই এত বেশি সময় দিয়েছেন যে ইংরেজরা যেটাকে নিতান্ত মামুলি ভদ্রতা বলে জ্ঞান করে, সেটার দিকে পর্যন্ত নজর দেওয়ার অবসর পাননি। —দু-জন মহিলা একসঙ্গে বসে রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে একজনকে—বিশেষ ক’রে সেই একজনকে যিনি হোস্টেস্ (নিমন্ত্রণকর্ত্রী)—প্রশংসায় কমপ্লিমেণ্টে বিপর্যস্ত ক’রে অপর জনের সম্বন্ধে নীরব থাকা কোন ইংরেজ কস্মিন্ কালেও ভাবতে পারে না। অথচ ঠিক এই জিনিসটা হয়েছিল কাল, নিশ্চয় আপনার চোখ এড়ায়নি। আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম ওদের প্রশংসার স্রোতটা একবার একটুখানিও সরমা দেবীর অভিমূখী করতে, আশা করেছিলাম কারুর না কারুর নজর এই ত্রুটিটুকুর দিকে পড়বেই, শেষে একেবারেই নিরাশ, নিরুপায় হয়ে আমাকেই সেটুকু সংশোধন করে নিতে হ’ল। তাও আমি কখন করলাম, না, নীরেশবাবু যখন হোস্টেসের প্রশংসার এতটা মেতে উঠেছেন যে, সরমা দেবী একটা কথা বলছিলেন, তাকে বাধা দিয়ে নিজের কথা এনে ফেললেন।”

মীরা শেষের দিকে স্থির নয়নে আমার মুখের পানে চাহিয়া কথাগুলা শুনিতেছিল—একটু বিস্মিত—আমার মত স্বল্পবাক লোক যে এতকথা বলিবে, আর এত স্পষ্টভাবে, ও যেন ভাবিতে পারে নাই, বিশ্বাস করিতে পারিতেছে না।

আমি ওর মনের কথা ধরিয়াই বলিলাম, “আমার এত কথা বা এসব কথা বলবার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু প্রয়োজন হয়ে পড়ল, কেন-না, আপনার বিশ্বাস আপনাদের বাড়ির টিউটর আপনার দাদার বাগদত্তা সম্বন্ধে একটা অনুচিত মনোভাব রাখতে পারে এবং সে কাল সরমা দেবী সম্বন্ধে যা কিছু বলেছে তার মূলে রয়েছে ঐ অনুচিত মনোভাব।”

মীরার মুখের সেই কঠিন ভাবটা নরম হইয়া আসিয়াছে। ধীরে, একটু যেন অনুতপ্ত কণ্ঠে বলিল,—“রাখতে পারে’—বলেছি শৈলেনবাবু, মাত্র একটা সম্ভাবনার কথা ‘রেখেছে’—একথা তো বলিনি। আপনি উত্তেজিত হয়েছেন। আমারও ভুল দেখুন—আপনাকে বসতেই বলা হয়নি। বসুন আপনি, দাঁড়িয়ে কেন?”

একটু হাসিয়া বলিলাম, “না, বসার বিপদ এই যে, বসলেই দাঁড়াতে একটু দেরি লাগে, আমার সময় খুব অল্প। থাক্, ধন্যবাদ। হ্যাঁ, আমি সেই কথাই বলতে এসেছি—এই সম্ভাবনার কথা—অর্থাৎ সরমা দেবীকে অন্য নজরে দেখা হয়তো আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে পড়তে পাবে একদিন। সেই সম্ভাবনার মূলই আমি নষ্ট করে দিতে চাই। আপনারা আমার প্রতি অশেষ দয়া দেখিয়েছেন। এখন আমি যাতে আপনাদের অনুগ্রহের এবং আতিথেয়তার অপমান না ক’রে বসি, সেই জন্যে বিদায় নিতে এসেছি। তরুর একটু ক্ষতি হবে, লোক ঠিক না হওয়া পর্যন্ত। কিন্তু আমি আর কোনমতেই দেরী করতে পারছি না। এক কথায় রাখতেও আপনার দয়া প্রকাশ পেয়েছিল, যাবার সময় ঠিক সেই দয়াটুকু আবার দেখাতে হবে। আমায় আজই ছেড়ে দিন…।”