১৭

ফিরিতে বেশ রাত হইয়া গেল। পড়ার হ্যাংগাম নাই, তরু উপরে চলিয়া গেল। দেখি ইমানুল আমার দুয়ারের কাছে, বারান্দাটিতে দাঁড়াইয়া আছে, আমারই অপেক্ষায় যেন। পার্টির সময় যে-সুটটা পারিয়াছিল, এখনও ছাড়ে নাই।

আমি সামনে আসিতেই একটু অপ্রতিভ ভাবেই হাসিয়া বলিল, “বড় লেট্ হ’য়ে গেল বাবু আজকে আপনাদের।”

এ-বাড়িতে ইমানুল, ক্লীনার সকলেরই একটু-আধটু ইংরেজী বলিবার ঝোঁক আছে। ওরা যে ব্যারিস্টার-সাহেব-বাড়ির চাকর, অন্য কোথারও নয় এক-আধটা বুক্‌নি দিয়া বোধ হয় সেইটে সূচিত করে, সবাই অন্তত সাত-আটটি করিয়া কথা জানে; অবশ্য রাজু বেয়ারা একটা স্কলার।

আমার দৃষ্টিটা হঠাৎ ইমানুলের শান্ত মুখের উপর যেন নিবন্ধ হইয়া গেল। আমার যেন মনে হইল এত দিন একটা কৃত্তিম উচ্চতায় আরোহণ করিয়া ইমানুলকে ভাল করিয়া বুঝি নাই, আজ নিজের স্থানটিতে ফিরিয়া অসিয়া ইহাকে বেশ বুঝা যাইতেছে, চেনা যাইতেছে। ইমানুল আমার স্তরের মানুষ, আর একটু বোধ হয় নীচে—তা এমন নীচেই বা কি? ওর ভাই আছে, ভাজ আছে, ছোট ছোট ভাইপো-ভাইঝি আছে, অভাবগ্রস্ত দরিদ্র গৃহস্থের সংসারের মধ্যে হইতে তাহারা বোধ হয় ওর দিকে চাহিয়া আছে। ইমানুল বাহিরে আসিয়াছে, পৃথিবীকে ভাল করিয়া দেখিতেছে, শিখিতেছে, উপার্জন করিতেছে; কোন এক সময়ে ফিরিবেই বাড়ি, বাড়ি ছাড়িয়া কেহ কি চিরদিন থাকিতে পারে?

বাড়ির জন্যই তো উপার্জন করা, নিজেকে বড় করিয়া তোলা মানুষের…।

সব দিক দিয়া আমার সঙ্গে ইমানুলের একটা নিষিদ্ধ সাম্য আছে। …মীরা যেন আরও দূরে চলিয়া গেল।

কেমন অদ্ভুত কাণ্ড, ভুলের মধ্যেও ইমানুলের সঙ্গে আমার একটা সাদৃশ্য রহিয়াছে। আমি চাই মীরাকে, ইমানুল চায় মিশনারী সাহেবের যুবতী ভ্রাতুষ্পুত্রীকে। ইমানুল শুনিয়াছি মাহিনা লয় না; মিস্টার রায়ের নিকট মাসে মাসে দশ টাকা করিয়া তাহার মাহিনা জমা হইতেছে। চার বৎসর হইয়াছে। হিসাব না-জানার কল্যাণে ইমানুল মনে মনে সঞ্চিত টাকাটার যে আন্দাজ করিয়া রাখিয়াছে সেটা আমাদের অঙ্কশাস্ত্র মত প্রায় চার হাজারের কাছাকাছি। অর্থাৎ ইমানুল আমার চেয়েও মজিয়াছে।

ইমানুলকে বাঁচাইতে হইবে। আমার মোহ ভাঙিয়াছে মীরা, ইমানুলের যে মোহিনী সে কি তাহার মোহ ভাঙিতে আসিবে? না, ও-কাজটা আমায়ই করিতে হইবে, আমরা পরস্পরকে না দেখিলে দেখিবে কে?—এই গৃহস্থরা, এই দরিদ্ররা…?

আমায় ঠাঁয় চাহিয়া থাকিতে দেখিয়া ইমানুল লজ্জিতভাবে মাথা নীচু করিল একটু, সঙ্গে সঙ্গেই আবার আমার মুখের পানে চাহিয়া, চক্ষুপল্লব কয়েকবার দ্রুত স্পন্দিত করিয়া বলিল, “তাহ’লে যাই এখন, দেরি হ’য়ে গেছে আপনার, এই বাট্‌ন্‌-হোলটা লেন।”

দুঃখের আঘাতে এত কাছে আসিয়া পড়িয়াছি, ইমানুল মালীর সঙ্গে একটু ঠাট্টা করিবারও প্রবৃত্তি চাপিতে পারিলাম না। বাট্‌ন্‌-হোল্‌টা নিজের নাকের কাছে ধরিয়া হাসিয়া বলিলাম, “আহা বেশ চমৎকার! থ্যাংক ইউ মিস্টার ইম্যানুয়েল বোরান।”

ইমানুল হাসিয়া আবার মাথা নত করিল। আসিয়া প্রশ্ন করিলাম, “কিন্তু ব্যাপারখানা কি বল দিকিন। চিঠি লিখতে হবে?”

ইমানুল মাথা নত করিয়াই বলিল, “কালই আসব তখন, মাস্টারবাবু, আজ রাত হয়ে গেল আপনার … মিছেই লেখা বোধ হয় বাবু, তবে টাকা অনেক জমিয়েছি, ফাদার চাইল্ড যদিই শোনে…”

কেমন এক ধরনের মূঢ় আশার হাসি হাসিল একটু।

আমি ইমানুলকে নিরস্ত করিব ঠিক করিয়াছিলাম, ওর মুগ্ধতা দেখিয়া প্রাণ সরিল না। কি হইবে মোহ ভাঙিয়া? থাক না; মোহই তো জীবন। ফাদার চাইল্ডের ভ্রাতুষ্পুত্রী তো জন্মে আসিবে না উহার কাছে, ও নির্ভয়ে করুক না পূজা।… মীরা যে আমার জীবন হইতে চলিয়া যাইতেছে, সুখী কি আমি সেজন্যে? ওর ভ্রান্তি যদি কখনও আমার মত আপনা-আপনিই ঘোচে, ঘুচিবে। ততদিন তাই থেকে জীবনের রস নিংড়াইয়া নিক না।

বলিলাম, “বলা যায় না ইমানুল, তুমি যেমন চাইছ, সেও তো তোমায় সেই রকম চাইতে পারে, তাহলে মাঝে থাকবে শুধু ফাদার চাইল্ডের মতটুকুর অপেক্ষা। তার জন্যে তো ন্যাথেনিয়ল রয়েছেই, চেষ্টা করবেই।…নাঃ, তুমি কাল নিশ্চয় এস।”

ইমানুল কৃতকৃতার্থ হইয়া কি বলিতে যাইতেছিল, এমন সময় রাজু বেয়ারা আসিয়া উপস্থিত হইল। ইমানুলের পানে চাহিয়া বলিল, “জুটেছে সেই পোস্টকার্ড নিয়ে মহাভারত লিখুতে তো? ওঃ, আজ আবার রাজবেশ।”

ইমানুল লজ্জিতভাবে সরিয়া গেল।

রাজু ঘরে ঢুকিয়া লাইটটা জ্বালিয়া বলিল, “আপনাদের রাত হ’য়ে গেল আজ, দিদিমণি ক-বার জিগ্যেস করলেন।”

আমার মুখ দিয়া আপনিই বাহির হইয়া গেল, রাগ করেছেন নাকি?

আজ বিকেলের আগে পর্যন্ত এমন কথা বলিতাম না। এই সন্ধ্যার পর থেকে হঠাৎ আবার মনিবের সম্বন্ধ হইয়া দাঁড়াইয়াছে মীরার সঙ্গে। যাহা বলিয়া ফেলিলাম আজকালকার মনোবিশ্লেষণের ভাষায় তাহাকে বলা যায়—অবচেতনার খেলা।

রাজু কোটটা ঝাড়িতে ঝাড়িতে বলিল, “নাঃ তেনার শরীরে রাগ নেই, সে রকম স্বভাবই নয়। আপনি নিশ্চিন্দি থাকুন মাস্টার মশা।”

এই আশ্বাসে আমার গা’টা যেন ঘিন ঘিন করিয়া উঠিল, কত নামিয়াছি আজ! রাজু আশ্বাস দেয়! ওকে জানাইয়া ফেলিয়াছি আমি শঙ্কিত।

রাজু হঠাৎ টেবিল ঝাড়া বন্ধ করিয়া আমার মুখের পানে চাহিয়া প্রশ্ন করিল, “একটা কথা শুনেছেন মাস্টার মশা?—হাইকোর্টে অরিজিন্যাল সাইডে এবার রেকর্ড নম্বর কেস!”

আজ পার্টিতে ব্যারিস্টার মহলে শোনা কথা। তরু, চোখ বড় করিয়া বলে “মাস্টারমশাই, কি নেশা রাজুর! তেমন তেমন বড় কথাগুলো আবার তক্ষুনি গিয়ে বাংলায় লিখে নেয়—তারপর মুখস্থ করে ফেলে।”

আজকের পার্টিতে ইংরেজী ফসল সংগ্রহ হইয়াছে বেশ মোটা রকম; অকারণে আসবাব ঝাড়িতে ঝাড়িতে ওর মুখের ভাব দেখিয়া স্পষ্ট বোঝা যায় পরিচয় দেবার জন্য রাজুর পেট ফুলিতেছে। আবার একটা ওজন-দুরস্ত বোঝা নামাইতে যাইবে, উপর হইতে বিলাস ঝিয়ের গলা শোনা গেল, “রাজু, মীরা দিদিমণি শীগ্‌গির তোমায় ডাকছেন, যেমন আছ চলে এস।”

বিলাস সিঁড়ির অর্ধেকটা নামিয়া আসিয়া খবর দিয়া আবার উঠিয়া গেল। বিলাস ঝি হোক, কিন্তু একটা রাজবাড়ির প্রতিনিধি—একটু পর্দানশীন। বনেদী ঝি, আজকালকার আয়া নয় তো!

রাজু বেচারার মুখটা ফ্যাকাশে হইয়া গেল, “ঐ যাঃ, ভুলেই গেছলাম”—তাড়াতাড়ি পকেটে হাত দিয়া একটা মুখসাঁটা খাম আমার হাতে দিয়া হন্তদন্তভাবে বাহির হইয়া যাইতেছিল, আবার উপর হইতে তাগাদা হইল—এবার খুব ত্রস্ত—“রাজু শোন, একটু শীগ্‌গির এস।”

এবার সিঁড়ির মাথা থেকে। ডাকিতেছে স্বয়ং মীরা। কণ্ঠস্বর খুব বেশি রকম উদ্বিগ্ন!

আমি শঙ্কিত কৌতূহলে বাহির হইয়া আসিলাম; কিন্তু মীরা তখন আবার নিজের ঘরে চলিয়া গিয়াছে; দেখিতে পাইলাম না।

ডাকের চিঠি নয়, মাত্র শুধু নামটা লেখা, তাও বাংলায়। চিঠি কে দেয়? … চিন্তার মধ্যে খামটা খুলিয়া ফেলিলাম।

ঠিক চিঠি জাতীয় কিছু নয়, নিতান্ত সংক্ষিপ্ত দু’টি কথা—

“মাস্টারমশাই, সরমা আমার প্রবাসী দাদার বাগদত্তা।”

মুহূর্তের মধ্যে আমার সামনে বিজলী বাতি, ঘরের আসবাবপত্র সমেত যেন একটা আকস্মিক অন্ধকারের বন্যায় ডুবিয়া গেল। সমস্ত মেরুদণ্ডের মধ্য দিয়া এক সূচীভেদের তীক্ষ্ণ জ্বালা, তাহার পর যেন নিজের অস্তিত্ব অনুভবই করিতে পারিলাম না।

কখন বসিয়া পড়িয়াছি, কতক্ষণ বসিয়া আছি জানি না। নিজেকে আবার অনুভব করিলাম রাজুর কথায়। রাজু হাঁপাইতেছে, মুখটা শুকাইয়া গিয়াছে, যেন কতদূর থেকে প্রাণপণে ছুটিয়া আসিয়াছে। বলিল, “মাস্টার-মশা, সেই চিঠিটা—এক্ষুনি যে দিয়ে গেলাম?…চাইছেন দিদিমণি…”

সঙ্গে সঙ্গে তাহার স্বর এলাইয়া পড়িল; ছিন্ন খামের দিকে চাহিয়া ধীরে ধীরে দীর্ঘ টানের সঙ্গে হতাশভাবে বলিল, “যাঃ, ছিঁড়ে ফেলেছেন?”

আস্তে আস্তে ফিরিয়া গেল, শুনিতেছি—সিঁড়ির ধাপে ওর মন্থর পদধ্বনি ধীরে ধীরে উঠিতেছে।

একটা অসহ্য রাত্রি গেল, সৃষ্টির আদিম অন্ধকারের মত দীর্ঘ। সেদিনের—সেই অপরাহ্ণের উপযোগী একটা রজনী।

আমি মনে প্রাণে এই বাড়ি ছাড়িয়াছিলাম, আবার ফিরিয়া আসিয়াছিলাম। স্থির করিয়াছিলাম থাকাই স্বার্থ। দরিদ্র যদি প্রতিজ্ঞা আঁকড়াইয়া থাকে তাহা হইলে তাহাকে আরও একটা জিনিস চিরদিনের জন্য আঁকড়াইয়া থাকিতে হয়, সে জিনিসটা দারিদ্র্য। …তাই ফিরিয়াছিলাম। অদৃষ্ট আবার চরণকে বহির্মুখী করিল। … উপায় নাই; এই চিঠি অল্প কথায় হইলেও স্পষ্ট করিয়া প্রকাশিত, এই কুৎসিত সন্দেহের পরও থাকিলে মানুষ বলিয়া পরিচয় দিবার সবই ছাড়িয়া একেবারে নিঃস্ব হইয়া থাকিতে হয়। স্বার্থের জন্য একেবারে নিঃস্ব হইয়া থাকিব কি না, সেই বিনিদ্র রজনীতে শুধু সেই কথাই ভাবিলাম।