১৬

আমার ডায়েরির সেই দিনের পাতায় মাত্র দুইটি কথা লেখা আছে,–“সাবাস মীরা!” কেন লিখিয়াছিলাম মনে আছে—

মীরা নিপুণ শিল্পী, যাহা ফুটাইতে চাহিতেছে তাহা কিসে ফুটিবে, অর্থাৎ যাহাকে শিল্পীর সেন্স, অব্ এফেক্ট বলে মীরার সেটা পূর্ণ আয়ত্তে। পার্টিতে সরমার আসিবার পর হইতে, বিশেষ করিয়া আমি তাহাকে প্রশংসা করিবার পর হইতেই মীরা মনে মনে সংকল্প করিয়াছিল আমায় নামাইবে, মনে করাইয়া দিবে ওরা প্রশ্রয় দেয় তাই, নহিলে আমি কত নগণ্য। নামাইলই সে, যাহাতে আমার বা দর্শকদের মধ্যে কোন সন্দেহ না থাকে সেই জন্য প্রথমে ঊর্ধ্বে তুলিয়া দিয়া তাহার পর নামাইল; শূন্যে একটা স্পষ্ট সুদীর্ঘ রেখা অঙ্কিত করিয়া অতলে বিলীন হইয়া গেলাম আমি।

কিন্তু কেন নামাইল মীরা? আমার অপরাধটা কি ছিল? আগাগোড়া একটু অনুধাবন করিয়া দেখা যাক্‌।—

ব্যাপারটার সূত্রপাত হয় সরমাকে লইয়া, যথাস্থানে তাহার উল্লেখ করিয়াছি;—সরমাকে সেদিন পরিচিত করাইবার সময় অপর্ণা দেবী বলিলেন, “এমন চমৎকার মেয়ে দেখা যায় না শৈলেন।” সরমা হাসিয়া বলিল, “এমন চমৎকার কাকীমা দেখা যায় না শৈলেনবাবু, মিছিমিছি এত প্রশংসা করতে পারেন।”

আমি বলিলাম, “যোগ্যের প্রশংসায় একটা মস্ত বড় আনন্দ আছে কিনা সরমা দেবী…”

কথা লঘুভাবেই বাড়িয়া যায় এবং সরমাকে আমি আরও খানিকটা বাড়াইয়া দিই। এই খানে মীরার নিষ্প্রভ হাসির কথা উল্লেখ করিয়াছি। পছন্দ হয় নাই মীরার। পৃথিবীতে এত লোক থাকিতে আমি সরমাকে অর্থাৎ সরমার মত সুন্দরীকে প্রশংসার এত যোগ্য ঠাহর করিতে গেলাম কেন? মীরার যে এটা ভাল লাগে নাই তাহাই নয়, এই ভাল না-লাগার ব্যাপারটা যে আমি ধরিয়া ফেলিয়াছি সেটা মীরা টের পাইয়াছিল। ব্যাপারটা এইখানে সামলাইয়া যাইত, কিন্তু তাহা না হইয়া আরও বাড়িয়াই গেল; মীরার কটু লাগিতেছে জানিয়াও আমায় আবার এই দ্বিতীয়বার বলিতে হইল যে, সরমা আমাদের মধ্যে আসিয়াছে বলিয়া আমরা সবাই কৃতজ্ঞ। মীরার ঈর্ষাকে কোথায় ঠাণ্ডা করিব, না উদ্রিক্ত করিয়া তুলিলাম। কিন্তু উপায় ছিল না; ওইটুকু না বলিলে ঘোরতর অন্যায় হইত।

মীরা চা ঢালিতেছিল, ঠিক এই সময়টিতে তাহার হাত হইতে ছলকিয়া খানিকটা চা টেবিল-ক্লথের উপর পড়িয়া যায়। ইহার পরই মীরার প্রতিশোধ আরম্ভ হয়; অনাড়ম্বর, কিন্তু অব্যর্থ।

একটু পরেই, কতকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবেই যেন মীরা সাহিত্য-চর্চার কথা তুলিল; আমার পরিচয় দিল। আমি স্বীকার করিতেছি মীরার হঠাৎ এই দিক্‌-পরিবর্তনে আমার সতর্ক হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু পারি নাই। নিজেকে দোষ দিব না—অবশ্য মীরার উপগ্রহদের প্রশংসার কথা ধরি না, মীরার নিজের মুখের দুইটা প্রশংসার কথায় যে কি সুধা আছে তারা দুইটা মসির আঁচড়ে আপনাদের কি করিয়া বুঝাইব?—আমি তাই সতর্ক থাকিতে পারি নাই; আমি আমার মোহের সাজা পাইয়াছি।

আমি বুঝিতে পারি নাই যে, প্রশংসার আড়ালে মীরা আমার জন্য নিদারুণ অপমানকে আগাইয়া আনিতেছে। সভাপতি করিবার প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গেই সে আমায় জানাইয়া দিল,—সভাপতি হইব কি, আমার এদের সভায়, এদের পার্টিতে বসিবার অধিকারই নাই। কাণ্ডটা যে উদ্দেশ্যে করা, তদনুরূপ ভাষায় প্রয়োগ করিলে দাঁড়াইত—‘যে কাজের জন্য মাইনে দিয়ে রাখা তাই করুন গিয়ে। বাড়িতে পার্টি হচ্ছে তো আপনার কি সম্পর্ক তার সঙ্গে? আর সভাপতি যখন হবেন, হবেন; আপাতত সে-সব বড় কথা ছেড়ে তরুকে বেড়িয়ে নিয়ে আসুন।”

পূর্বে বোধ হয় বলিয়াছি, মীরার এ-আক্রোশ একটা মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত, সেই মিথ্যার একদিকে আমার যেমন দারুণ লজ্জা, অপরদিকে তেমনই সুনিবিড় তৃপ্তি। লজ্জা এই জন্যে যে, মীরা ভাবিল আমি সরমার প্রতি অনুরাগী হইয়া পড়িয়াছি, তাই এত লোক থাকিতে সরমার যোগ্যতার দিকে আমার এত দৃষ্টি, তার উপস্থিতির জন্য এত কৃতজ্ঞতার ছড়াছড়ি। এত লজ্জা জীবনে বোধ হয় আমার কমই ঘটিয়াছে। আমি সরমার বিষয় যাহা শুনিয়াছি, এ-বাড়িতে তাহার যে প্রতিষ্ঠা, তাহার জন্য তাহার প্রতি আমার একটা অপরিসীম শ্রদ্ধা আছে। আমার বিশ্বাস যে, যে সরমার তিল তিল করিয়া আত্মোৎসর্গের কথা জানিবে, সে ওকে না ভালবাসিয়া পারিবে না; যে জানিবে, তাহার পরও যদি বাসনা দিয়া সরমার বায়ুমণ্ডল কলুষিত করিতে চায়, বিশেষ করিয়া এই বাড়িতেই থাকিয়া, তো তাহার মনুষ্যত্বে সন্দেহ হইবারই কথা।

এই একই মিথ্যার অন্য দিকে আছে চরম তৃপ্তি।—মীরা যদি ধরিয়াই লইয়া থাকে আমি সরমার পক্ষপাতী তো তাহাতে তাহার কি?—ঈর্ষা? যদি তাহাই হয় তো কোথায় সে ঈর্ষার উৎস?—আমার আর মীরার মাঝে নূতন করিয়া সরমা—এর মধ্যেই নয় কি?

কিন্তু এ-সব কথা যাক।

তখনকার সব চেয়ে বড় কথা যা মনের সামনেই ছিল তা এই যে মীরাদের বাড়িতে আমার এই শেষ দিন। মীরা আমায় কয়েকবারই খুব নিকটে টানিয়া আবার দূরে ঠেলিয়াছে, কিন্তু আজ চরম। তীব্র অপমানে শরীরটা কি ভারী করিয়া দেয়? পার্টির মধ্য হইতে বাহির হইলাম যেন সমস্ত মাটি তিল তিল করিয়া মাড়াইয়া চলিয়াছি, পা উঠিতেছে না যেন—আমার অদ্ভুত চলার দিকে সবাই যেন চাহিয়া আছে—প্রত্যেকটি চক্ষুতে যেন ব্যঙ্গের কটাক্ষ—আমি এদের স্তরের একজন মেয়েকে ভালবাসিতে গিয়াছি… স্পর্ধা!

তরুকে লইয়া তাড়াতাড়ি মোটরে বাহির হইয়া গেলাম।

মাঠের পর গঙ্গার ধার, তাহার পর ষ্ট্রাণ্ড রোড অতিক্রম করিয়া ব্যারাকপুর রোড—আশ মিটিতেছে না, ইচ্ছা করিতেছে দূরে—আরও দূরে যাই, যেখানে আজকের অপরাহ্ণের স্মৃতি আর পৌঁছিতে পারিবে না। ড্রাইভারকে আদেশ দিয়া স্তব্ধভাবে বসিয়া আছি, তরু প্রশ্ন করিয়াছে, এক-আধটা উত্তরও দিয়া থাকিব, কিন্তু কি প্রশ্ন আর কি উত্তর তা একেবারে মনে নেই। শুধু একটা কথা মনের মধ্যে ক্রমেই দৃঢ় হইয়া উঠিতেছে—কালই, তার বেশি আর এক মুহূর্ত এখানে নয়। কাজ তো গৃহশিক্ষক, বাড়িতে এত বড় একটা উৎসবের মধ্যেও যাহার তিলমাত্র স্থান নাই বলিয়া মীরাই জানাইয়া দিল,—তাহার জন্য আবার নোটিশ দেওয়া কি?

ফাঁকা রাস্তা, মোটরের হুড নামাইয়া দিয়াছি; হু হু করিয়া বাতাস আসিয়া মুখে চোখে সর্বাঙ্গে লাগিতেছে। তবুও ড্রাইভারকে মাঝে মাঝে বলিতেছি, “আরও একটু জোর দেওয়া যায় না জগদীশ?”

ফিরিবার সময় মাথাটা অনেকটা ঠাণ্ডা হইয়াছে। বেশ একটু রাত হইয়াছে, কিন্তু তখনও কলিকাতার বাহিরে। রাত্রির প্রশান্তির মধ্যে চিন্তার ধারা বদলায়। প্রতিজ্ঞা এরই মধ্যে একটু শিথিল হইয়াছে। অল্পে অল্পে নিঃসাড়ে একটা প্রশ্ন আসিয়া মাথায় জাকিয়া বসিয়াছে—মীরার দোষ কোথায়?

 —আমি গৃহস্থসন্তান; ঠিক তাহাও নয়, দরিদ্রসন্তান। পড়িব এই উচ্চাশা লইয়া টুইশ্যন করিতেছি, তাহাতে ভগবান আমার আশার অতিরিক্ত সুযোগ দিয়াছেন। ফলও পাইতেছি; সর্বপ্রকার সুবিধা এবং নিশ্চিন্ততার মধ্যে পড়াশুনা করিতে পাওয়ায় আমি এখন এম-এ ক্লাসের একজন বিশিষ্ট ছাত্র। আমি এর বেশি আর কি আশা করিতে পারি? কিন্তু অচিন্ত্যনীয় সফলতাকেও অতিক্রম করিয়া আমার বাসনা মাথা চাড়া দিয়া উঠিল,—আমি চাই মীরাকে—আমার মনিবের সুন্দরী, সুশিক্ষিতা, অসাধারণ তীক্ষ্ণধী কন্যা মীরাকে, যে-কোন এক রাজকুমারেরও পরম কাম্য ধন!

না, মীরার দোষ নাই। মীরা আমার উপকার করিয়াছে। আমি দিশাহারা হইয়াছিলাম, মীরা বন্ধুর মতই আমায় আমার নিজের জায়গাটিতে ফিরাইয়া আনিয়াছে। বোধ হয় ব্যাপারটা বেশ সুমিষ্টভাবে করে নাই; ভালই করিয়াছে, রুচিকর করিতে গেলে আমার চৈতন্য হইত না।

না, নিজের স্বার্থের জন্য থাকিতে হইবে, থাকিতে হইবে নিজের গণ্ডী সম্বন্ধে সচেতন হইয়া।

মনে রাখিতে হইবে—আমার গণ্ডীর মধ্যে আছে মাত্র তরু, আর সবাই, সব কিছুই গণ্ডীর বাহিরে।

বাসায় যখন ফিরিলাম তখন আমার প্রতিজ্ঞা একেবারে শিথিল হইয়া গিয়াছে। অথবা এমনও বলা চলে, প্রতিজ্ঞাটার আকার পরিবর্তিত হইয়াছে এবং সেটা আরও দৃঢ় হইয়াছে। অর্থাৎ থাকিতে হইবে।

সরমার প্রতি কৃতজ্ঞতার কথা ভুলিয়া গিয়াছি; মনটা মীরার প্রতি কৃতজ্ঞতার ভরিয়া আসিতেছে।