১৫

আগেই বলিয়াছি আমার এ একটা দুরদৃষ্ট—অভিশাপই আছে জীবনে—মীরার যখন খুব কাছটিতে আসিয়া পড়িব, সঙ্গে সঙ্গে সরিয়া যাইতে হইবে। এবারে মীরার ততটা দোষ ছিল না, সরমার প্রশংসায় সে অবশ্য চটিয়া ছিল, কিন্তু, সে-কথা ভুলিয়া গিয়াছিল। সে স্তুতির মাদকতায় ভরপুর, তাহার চিত্তে দাক্ষিণ্যের স্রোত বহিয়া চলিয়াছে। কিন্তু অদৃষ্ট, ঘটনার চক্রান্তে ব্যাপারটা আবার অন্য রকম হইয়া দাঁড়াইল।

সুরু থেকেই একটা কথা আমার বড় বিসদৃশ ঠেকিতেছিল। মাঝে নিজেই তর্কের ঝোঁকেপড়িয়াএকটু বিশ্বত হইয়াছিলাম, আবার সেটার দিকে দৃষ্টি গেল। লক্ষ্য করিতেছি সরমাও যে আমাদের সঙ্গে আসিয়া বসিয়াছে সেদিকে কাহারও বিশেষ হুঁশ নাই। সব যেন মীরাকে ঘেরিয়া পড়িয়াছে। অবশ্য সরমাকেও সবাই সমুচিতভাবে অভ্যর্থনা করিয়া বসাইয়াছে, এক-আধটা প্রশ্নাদিও করিয়াছে মাঝে মাঝে, আর ব্যাপার যাহা হইতেছে তাহা হইতে সে যে একেবারে বাদ পড়িতেছে এমন নয়, হাসিবার সময় সেও হাসিতেছে, এক-আধটা অভিমতও দিয়া থাকিবে—শান্তভাবে যেমন হাসা, যেমন কথা বলা তাহার স্বভাব; কিন্তু একটা ত্রুটি হইয়াই গিয়াছে তাহাদের তরফ হইতে। স্তব, প্রশংসা বা ইংরেজীতে যাহাকে বলে কমপ্লিমেণ্ট, মীরার ঘাড়ে জড় করিতে সবাই এত উন্মত্ত যে এই সভাতেই যে আরও একটি মহিলা বসিয়া আছেন সেদিকে খেলায়ই নাই কাহারও। ইহারা ইংরেজদের নকল করিতে যায়, কিন্তু সমাঞ্জস্য রক্ষা করিবে এমন সাধারণ বুদ্ধিটুকু পর্যন্ত ঘটে রাখে না। বিশেষ করিয়া পাশেই একজন লেডিকে যথাস্থানে ছাড়িয়া দিয়া আর একজনকে সপ্তম স্বর্গে তুলিয়া দিবে, ওরা যে-সভ্যজগতের নকল করিতেছে তথাকার নিতান্ত অসভ্যরাও এ কথা ভাবিতে পারে না! … আমি সরমার পানে খুব সন্তর্পণে এক-আধবার চাহিয়া লইয়াছি, বুঝিয়াছি এর দাগ পড়ে নাই ওর মনে। ওর মনের কোথায় যেন একটা বেদনার উৎস আছে। যোগী যেমন নিজের মূর্ধার অমৃতরসে জিহ্বাগ্র সংলগ্ন করিয়া ধ্যানস্থ থাকে, সরমারও যেন কতকটা সেই রকম ভাব, সেও যেন সেই দুঃখের অমৃতরসে জিহ্বা দিয়া আত্মস্থ। বাহিরে ও হাসে, কথা কয়; একটা প্রসন্নতার আবরণও আছে ওর সব জিনিসের উপর; কিন্তু তাহার সঙ্গে ওর ভিতরের যোগ নাই।

হইতে পারে সবাই ওর ঔদাসীন্য জানে বলিয়াই ওকে একান্তেই থাকিতে দেয়, কিন্তু তবুও ব্যাপ্যরটা অত্যন্ত বিসদৃশ্য, প্রায় একটা দুষ্কৃতির কাছাকাছি; আমি তো হাঁপাইয়া উঠিতেছিলাম।

পাকড়াও করিয়া অনিবার নিশীথের একটা অনন্যসাধারণ ক্ষমতা আছে স্বীকার করিতে হইবে, শুধু চায়ের সরঞ্জাম ঘাড়ে ওয়েটারকে পাকড়াও করিয়া আনিল না, আরও আনিল শোভনকে আর দীপ্তিকে। শোভনের বাহুটা ধরিয়া সামনে দাঁড় করাইয়া বলিল, “দীপ্তি আর শোভনকেও ধরে আনলাম, দু-জনকে দু-জায়গা থেকে।”

প্রকাণ্ড একটা বীর সে!

মীরা চা ঢালিতে শুরু করিয়া দিল। চমৎকার দেখাইতেছিল মীরাকে। উঠিয়া সামনে ঝুঁকিয়া চা ঢালিতেছে, একগুচ্ছ চূর্ণ কুগুল কপাল হইতে স্খলিত হইয়া নতশীর্ষলতার তন্তুর মত মুখের উপর দুলদুল করিতেছে, কানের ঝুমকা দুইটা সামনে গড়াইয়া আসিয়াছে, তাহাদের মুক্তর ঝুরিগুলা গালের উপর পড়িয়া ঝিক্ ঝিক্ করিতেছে! সকলেরই কথা একটু বন্ধ, শুধু লুব্ধভাবে একের পর এক করিয়া মীরার সামনে পেয়ালা বাড়াইয়া দিতেছে; মীরা যেন ক্রমেই পরিবর্ধমান লজ্জায় রাঙিয়া উঠিতেছে; কেহ যে কথা কহিতেছে না,সেইজন্য ও নিশ্চয় অনুভব করিতেছে, ওকে সবাই দেখিতেছে বলিয়া কথা কহিতেছে না। মীরার যে-সমাজে স্থিতি-গতি সেখানে মেয়েরা নিজেদের প্রত্যেক ভঙ্গিটির সম্বন্ধেই সচেতন;—মীরা জানে তাহার ঈষন্নত দেহযষ্টি, তাহার কপালের আলগা কুন্তল-গুচ্ছ, তাহার কানের লুটান ঝুমকা চারিদিকে একটা শান্ত বিপর্যয় ঘটাইতেছে, এ-সবের উপর তাহার আরক্তিম লজ্জাটি সম্বন্ধেও সে সচেতন, তাহাতেই তাহার লজ্জা আরও বেশি। … আমি যথাসাধ্য সংযত ছিলাম, তবু নিজের দৃষ্টি বলিয়াই অযথা তাহার সাধুতার বড়াই করিতে পারি না। দৃষ্টির দোষ ছিল না, আজ খোশামোদের অর্ঘ্য দেওয়ার পর মীরার কাছে দৃষ্টি আমার প্রশ্রয়ই পাইয়াছে।

দীপ্তি একটু দূরে, ওদিকটায় কোন একজনের সঙ্গে কি কথা কহিতে গিয়াছিল, আসিয়া উপস্থিত হইল। মীরার চেয়ে দীপ্তি বছর চারেকের ছোট, একটু বেশি চটুল, মাথার দুইপাশে দুইটি বেণী, চলে শরীরটা একটু সামনে ঝুঁকাইয়া আর দুলাইয়া—সর্বসমেত বেশ একটা নিজস্ব স্টাইল আছে। কথা বলিবার ভঙ্গি খুব জোরাল,–কতটা সত্য বলিল, কতটা মিথ্যা বলিল ভ্রুক্ষেপ করে না, শ্রোতাদের উপর দাগ বসিল কিনা সেইটিই তাহার লক্ষ্য। আসিয়াই বিস্ময়ে সমস্ত শরীরটাকে যেন একটু টানিয়া তুলিয়া মুখের উপর হাত দুইটা জড় করিয়া বলিল, “ওমা! তুমি এখানে মীরাদি? অথচ তখন থেকে তোমায় এত খুঁজছি যে রীতিমত সাধনা বললেও চলে। … সরমাদিও দেখছি যে! বাঁচলাম, কে যেন বলছিল আপনার শরীর খারাপ, আসতে পারবেন না! এত ভাবনা হয়েছিল! মনে হ’ল সব ফেলে ছুটে যাই, একবার দেখে আসি।”

সরমা হাসিয়া বলিল, “না এলেই হ’ত ভাল; কিন্তু শরীরের দোহাই তো মীরার কাছে চলবে না, তাই…।”

নীরেশ আবার কি একটা লাগসই কথা ভাবিতেছিল, জোগাড় হওয়ার সরমাকে শেষ করিতে না দিয়াই বলিয়া উঠিল, “মীরা দেবীকে পেতে হ’লে তো সাধনারই দরকার মিস মল্লিক; আমাদের সাধনাটা একটু বেশি ছিল, সেই জন্যেই …।”

বোধ হয় অজ্ঞানকৃত, অথবা নিছক মূঢ়তা, তবুও নীরেশের অভদ্রতাটা আমার সহ্য হইল না—অর্থাৎ এই সরমার কথাটা শেষ করিতে না দিয়া নিজের মন্তব্য আনিয়া ফেলা। নীরেশের কথাটাও শেষ হইবার পূর্বেই সেটা যেন চাপা দিয়াই সরমাকে প্রশ্ন করিলাম, “হ্যাঁ, তাই বলে কি বলতে যাচ্ছিলেন সরমা দেবী? বোধ হয় মীরা দেবীর ভয়েই এসেছেন, কিন্তু আমাদের কৃতজ্ঞতা সেজন্যে কিছু কম হবে না।”

মীরা আমার কাপে চা ঢালিতেছিল, হঠাৎ আমার দিকে চোখ তুলিল। খানিকটা চা টেবিলের ঢাকনার উপর পড়িয়া গেল। মীরা তখনই আবার সমস্ত ব্যাপারটা সামলাইয়া লইল। চা-টা পড়িয়া যাওয়ার অজুহাতে তাহার তীক্ষ্ণ সন্দিগ্ধ দৃষ্টিটা সঙ্গে সঙ্গে শান্ত করিয়া লইয়া বলিল, “এক্সকিউজ মি, মাফ করবেন।”

কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক কথাবার্তা হইল। কথাবার্তাটা একটু বেশি উদ্যোগী হইয়া চালাইল মীরাই। যখন বুঝিল সরমা সম্পর্কীয় ব্যাপারটা তাবৎ কালের জন্য আমার মন হইতে মুছিয়া গিয়াছে, বা যাওয়া সম্ভব, নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবেই সাহিত্যের কথা তুলিল, ওদের লক্ষ্য করিয়া বলিল, “হ্যাঁ, মাঝখানে আপনারা সাহিত্য-চর্চার জন্যে একটা ছোটখাট প্রতিষ্ঠান তৈরি করবেন বলে বলেছিলেন মৃগাঙ্কবাবু, কি হ’ল তার?”

মৃগাঙ্ক বলিল, “তারও উৎস তো আপনারাই। দেখলাম দু-চার দিন কথার পর আপনার উৎসাহই নিভে এল…”

কেন যে নিভিয়া আসিয়াছিল তাহা এদের রসজ্ঞানের যেটুকু নমুনা দেখিলাম তাহা হইতেই বুঝিতে পারিয়াছি। মীরা বলিল, “না, ঠিক নেভেনি; বাবা কুমিল্লায় চলে যেতে প’ড়ে গেলাম একলা, মা’র শরীর খারাপ, নানা ঝঞ্ঝাটে আর ওদিকে মন দিতে পারিনি। আপনাদের সঙ্কল্প যদি আবার রিভাইভ্ করেন তো খুব একজন উপযুক্ত লোক পেতে পারি আমরা। আমাদের শৈলেনবাবু একজন উদীয়মান কবি এবং সাহিত্যিক,—আপনারা নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই এঁর…”

যে যেমনটি ছিল একেবারে চিত্রার্পিতের মত স্থিরদৃষ্টিতে আমার পানে চাহিয়া রহিল, কাহারও পেয়ালা ঠোঁটের কাছাকাছি আসিয়া থামিয়া গিয়াছে, কাহারও টেবিলের কাছাকাছি নামিয়া ও কেহ একটা চুমুক টানিয়াছে, না গিলিয়া গলা ফুলাইয়া চাহিয়া আছে, কেছ ঠোঁটে পেয়ালা ঠেকাইয়া বিস্মিত দৃষ্টি তুলিয়া আমায় দেখিতেছে, একটু একটু করিয়া পেয়ালার গা গড়াইয়া টেবিল ক্লথের উপর চা পড়িতেছে, আশ্চর্যের অভিনয়ে বাধা পড়িবে বলিয়া সেদিকে আর লক্ষ্য করিতে পারিতেছে না।

একটু পরে যেন সম্বিত পাইয়া কয়েকজন একসঙ্গে বলিয়া উঠিল, “ইনিই আমাদের শৈলেনবাবু?”

নগণ্যতা থেকে একেবারে খ্যাতির শিখরে উঠিয়া গেলাম। বায়রণের তবু খ্যাতিহীনতা আর খ্যাতির মাঝখানে একটা রাত্রির ব্যবধান ছিল, আমার বোধ হয় একটা মুহূর্তও নয়। উদীয়মান’ সাহিত্যিক’কে অভিনন্দিত করিবার জন্য একেবারে ঠেলাঠেলি পড়িয়া গেল যেন। অলোক বলিল, “বর্ণচোরা আম মশাই আপনি, হু কুড থিংক যে আপনিই আমাদের শৈলেনবাবু… ‘নাউ! প্লীজ…”

শেক্‌হ্যাণ্ড করিবার জন্য হাত বাড়াইয়া দিল। লজ্জিতভাবে শেক্‌হ্যাণ্ড করিয়া হাতটা টানিয়া লইব, মৃগাঙ্ক হাত বাড়াইয়া বলিল, “আসুন, বাঃ আমাদের হাতে সাহিত্য বেরোয় না বলে অস্পৃশ্য নাকি? হাঃ হা হা—”

নীরেশ একটু দূরে ছিল, টেবিলের ও-প্রান্তে; আগাইয়া আসিয়া হাতে একটা কড়া ঝাঁকুনি দিয়া হাতটা মুষ্টিবদ্ধ রাখিয়াই মীরার পানে চাহিয়া নালিশের সুরে বলিল, “কিন্তু আমি আপনাকে কোনমতেই ক্ষমা করতে পারব না মিস রায়, এ-হেন লোককে এতদিন আমাদের কাছে অপরিচিত রাখবার জন্যে।”

শেক্‌হ্যাণ্ডের সঙ্গে একটা মানানসই কথা বলাও দরকার। সেটা সংগ্ৰহ না হওয়ায় নিশীথ এতক্ষণ হাত বাড়ায় নাই, এইবার নীরেশের কাছ থেকে হাতটা প্রায় ছিনাইয়া লইয়াই খানিকটা মৃগাঙ্কের কথা, খানিকটা নীরেশের কথা একত্র করিয়া বলিল, “আসুন, হাত মিলিয়ে নেওয়া যাক, এইবার থেকে এই কাঠখোট্টা হাত দিয়েও কবিতা বেরুবে ফরফরিয়ে।…সত্যি মিস রায় আপনাকে আমরা ক্ষমা করতে পারব না, কখনও না, নেভার…”

মীরা হাসিয়া বলিল, “বাঃ, আমায়ই কি উনি বলেছেন নাকি কখনও? আমি নিজে আবিষ্কার করলাম ‘কল্লোলে’ ওঁর একটা লেখা দেখে।”

নীরেশ নিজের সীটে না বসিয়া আরও এদিকে দীপ্তির চেয়ারের পাশটাতে দাঁড়াইল। তাহার পানে চাহিয়া বলিল, “আপনি শৈলেনবাবুর লেখা পড়েননি মিস্ মল্লিক?”

বেশ বুঝিলাম দীপ্তি একটু ফাঁপরে পড়িয়াছে। ও যেন ভয়ে ভয়েই ছিল এই রকম গোছের একটা প্রশ্ন এদের মধ্যে কেউ না কেউ করিয়া বসিল বলিয়া! অপরাধীর মত কুণ্ঠিত ভাবে একটা বগ টিপিয়া বলিল, “ঠিক মনে হচ্ছে না, তবে নিশ্চয় পড়ে থাকব।”

“নিশ্চয় পড়েছেন,—শৈলেন—শৈলেন।”

মীরা সাহায্য করিল, “শৈলেন মুখার্জি।”

তর্জনী দিয়া বিলাতী কায়দায় তিনবার কপালে টোকা মারিয়া নীরেশ বলিল, “ডিয়ার মি। পদবীটা পেটে আসছিল, মুখে আসছিল না। ঠিক, শৈলেন মূখার্জি—শৈলেন মূখার্জি। ওঁর লেখা তো প্রায়ই চোখে পড়ে, এই সেদিন তো ‘প্রবাসী’তে একটা চমৎকার কবিতা পড়লাম…।

যে-সময়ের কথা, তখন ‘প্রবাসী’ আমার স্বপ্নেরও অতীত। তাহার মাস আষ্টেক পূর্বে আমার দুইটি কবিতা ‘অঞ্জলী’ নামক একটি মাসিকে উপরি-উপরি দুইবাব প্রকাশিত হয়, তৃতীয় মাসে কাগজটি উঠিয়া যায়, বোধ হয় সে গুরুপাপেই। তাহার পর ‘মানসী’ ও ‘কল্লোলে’ গুটি দু’য়েক গল্প বাহির হইয়াছে।…এই অল্প পুঁজির উপর এ রকম রাশীকৃত যশের চাপে আমি গলদঘর্ম হইয়া উঠিতেছিলাম।

মীরা বোধ হয় বিশ্বাস করিল ‘প্রবাসী’-ঘটিত কথাটা, একটু অভিমানের সুরে বলিল, “বাঃ, কই, আমায় তো বলেননি শৈলেনবাবু?”

যশের মোহ অথচ তাহার মিথ্যার গ্লানি,—আমি আমতা আমতা করিয়া চুপ করিয়া গেলাম।

নিশীথ প্রতিধ্বনি তুলিল, “কেন, আমিও তো সেদিন ইয়েতে ওঁর একটা প্রবন্ধ পড়লাম; আমাদের মধ্যে কত ডিসকাশন হয়ে গেল সেই নিয়ে। কি আর্টিক্‌লটার নাম মিস্টার মুখার্জি?

যেমন অসহ্য, স্বীকার করিয়া লইলে তেমনি বিপজ্জনক। আমি বিনীতকণ্ঠে নিবেদন করিলাম, “কই আর্টিক্‌ল তো আমি লিখিনি কোথাও!”

নিশীথ চায়ের পেয়ালাটা নামাইয়া চেয়ারে সোজা হইয়া বসিল, টেবিলে একটা ঘুষি মারিয়া বলিল, “লিখেছেন; আমি নিজে পড়েছি, এখানে ‘না’ বললে শুনব? আত্মগোপন করা তো স্বভাব আপনাদের সাহিত্যিকদের।”

এমন বিপদেও মানুষে পড়ে! আমি নিরুপায় লজ্জার সহিত কথাটা মানিয়া লইয়া বিনয়োচিত মৃদুহাস্য করিতে লাগিলাম।

উদ্ধার করিল শোভন। লোকটা ক্রমাগত চুরুট টানিতে টানিতে সামনের ব্যাপার পর্যবেক্ষণ করিতে থাকে, কথা কয় কম। তবে যেটুকু বলে তাহাতে স্পষ্টতার ছাপ থাকে। আমার সহিত করমর্দনের সৌভাগ্য হইতে ঐ একটি লোক নিজেকে বঞ্চিত রাখিয়াছে এখন পর্যন্ত। এদের অভিমতে শোভন একটু দেমাকী।

চুরুট টানার ফাঁকে ফাঁকে বলিল, “মিস্টার মুখার্জিকে পাওয়া তো আমাদের খুবই সৌভাগ্য, তোমার আর্টিকেলের কথাও তো উনি শেষ পর্যন্ত মেনে নিলেন, নিশীথ, কি করা হবে তোমাদের ওঁকে নিয়ে সেটার একটা ঠিক করে ফেল।”

“করা—মানে…” নিশীথ মীরার পানে চাহিল, অর্থাৎ কী সে মূল প্রস্তাব যাহার প্রতিধ্বনি সে করিবে?

মীরা টেবিলের উপর আঙুলগুলি সঞ্চালিত করিতে করিতে বলিল, “আমি বলছিলাম শৈলেনবাবুকে কেন্দ্র করে আমাদের একটা সাহিত্যবাসর গড়ে তুললে কেমন হয়?…তুমি কি বল সরমাদি?”

সরমা বলিল, “খুবই ভাল হয় তো; খাঁটি একজন সাহিত্যিককে পাওয়া…”

সরমার কথাব দাম অন্য রকম; আমি প্রকৃতই লজ্জিতভাবে তাহার মুখের দিকে চাহিলাম।

নীরেশ বলিল, “তাহ’লে ওঁকে কেন্দ্র করার মানে…”

মৃগাঙ্ক সমর্থনের জন্য মীরার মুখের পানে চাহিয়া বলিল, “কেন্দ্র করা মানে মীরা দেবী মীন করছেন সভাপতি আর কি।”

মীরা বলিল, “ওই তো ওঁর প্রকৃষ্ট আসন। আজ এখান থেকেই আমাদের সভা প্রতিষ্ঠিত ক’রে দেওয়া যাক না কেন—শৈলেনবাবুর সভাপতিত্বে। আমি প্রস্তাব করছি…”

‘হিয়ার হিয়ার!’ বলিয়া সকলে সমর্থন করিতে গিয়া হঠাৎ মীরার পানে চাহিয়া থামিয়া গেল। মীরা উদ্বিগ্নভাবে সোজা হইয়া বলিল, “কিন্তু কি ক’রে হবে? ভাগ্যিস মনে পড়ে গেল!… আপনার তরু কোথায় মাস্টারমশাই? আমরা দিব্যি নিশ্চিন্তভাবে বসে আছি। তার বিকেলে বেড়াতে যাওয়া যে নিতান্ত দরকার। ডাক্তার বোস বিশেষ ক’রে বলে রেখেছেন। আপনাকে তো সে-কথা বলেওছি মাস্টারমশাই, দেখছি আজকের গোলমালে আপনিও ভুলে বসে আছেন। মাস্টারমশাইকে আমরা সবাই পার্টিতে খুবই মিস্ করব কিন্তু ওঁর যা আসল কাজ…

মীরা যেন নিরুপায়ভাবে একবার সবার পানে চাহিল। এক মুহূর্তে সবার মূর্তি বদলাইয়া গেল। আবার চারিদিক হইতে প্রতিধ্বনি উঠল—“ও ইয়েস্, মিস্ করব বইকি, কিন্তু ডিউটি ইজ্ ডিউটি…” আচ্ছা, মাস্টারমশায়ের সঙ্গে আবার আলাপ হবে এ-বিষয়ে…সাহিত্য-চর্চার সময় তো আর চলে যাচ্ছে না, কিন্তু কর্তব্য তো দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না…শি ইজ, এ স্টার্ন মিসট্রেস” (কর্তব্য বড় কড়া মনিব)।

কে একজন ওয়ার্ডস্ ওয়ার্থের একটা কবিতা থেকে উদ্ধার করিয়া বলিল, “স্টার্ন ডটার অব, দি ভয়েস্ অব গড (Stern daughter of the voice of God)।”

শিখর হইতে পতন যে কি তা সেই দিন বুঝি। চেয়ার ছাড়িয়া উঠিবার সময় যেন স্বপ্নে তাড়া খাওয়ার মত পা মুড়িয়া যাইতেছিল। সৌভাগ্যক্রমে আর কাহারও মুখের পানে দৃষ্টি যায় নাই, গিয়াছিল শুধু একবার সরমার মুখের দিকে, সত্য এবং শিষ্টতা আহত হইল কিনা দেখিবার কৌতূহলে।

সে আরক্তিম মুখে দৃষ্টি নত করিয়া বসিয়া ছিল।