১৪
আমি টানা পড়িলাম বটে কিন্তু আমার যেন পা-উঠিতেছিল না। বাড়িতে আমার সময়ে এই প্রথম পার্টি হইলেও তরুর সঙ্গে এর পূর্বে বার দুয়েক বাইরে পার্টিতে গিয়াছি এবং দুইবারে যা অভিজ্ঞতা হইয়াছে তাহাতে আরও দুইবার যাওয়ার যখন প্রয়োজন হইল তখন ছুতানাতা করিয়া কাটাইয়া দিয়াছি। তাহার কারণ এই পার্টিতে আমার এই অভিজাত সম্প্রদায়ের সঙ্গে বাহ্যিক এবং আভ্যন্তরিক অসামঞ্জস্যটা যতটা স্পষ্ট হইয়া উঠিত, অন্য কোন ব্যাপারেই ততটা হইত না। এধরনের পার্টিগুলা আসলে দেখিলাম স্বয়ংবর সভা, একেবারে মুখ্যতঃ না হোক নিতান্ত গৌণতঃও নয়। মীরা, শচী, মিস্টার মল্লিকের কন্যা দীপ্তি, রেবা—আরও কত সব তাহাদের নাই জানি না—ইহাদের কেন্দ্র করিয়া ভাগ্যান্বেষীরা কথাবার্তা, আধুনিকতম ফ্যাশন, মাঝে মাঝে বোধ হয় উপলক্ষ্যে-অনুপলক্ষ্যে উপহার-উপঢৌকন প্রভৃতি নানাবিধ উপায়ে অবিরাম নিজের অদৃষ্ট পরীক্ষা করিয়া যাইতেছে। মীরাকে যাহারা আগলাইয়া থাকে তাহাদের মধ্যে আছে নীরেশ লাহিড়ী, বিএ, ক্যাণ্টাব, নবীন ব্যারিস্টার; জার্মানী-প্রত্যাগত মৃগাঙ্ক সোম, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার, শোভন রায়, কি তাহা এখনও খোঁজ লইয়া উঠিতে পারি নাই; অলোক সেন, কলেজের ছাত্র! আর এই নিশীথ চৌধুরী। এই লোকটি রাজসাহী প্রান্তের কোন এক রাজার ভাগনে। বিদ্যাবুদ্ধি কতটা আছে বলা যায় না, তবে যে-সমাজে চলাফেরা করে, কিংবা মীরাকে লইয়া যাহাদের সঙ্গে রেষারেষি তাহাদের সঙ্গে মানানসই হইবার জন্য আমেরিকা হইতে কিছু টাকা দিয়া গোটাছয়েক অক্ষর আনাইয়া লইয়াছে এবং শীঘ্রই নাকি ‘হায়ার ইঞ্জিনিয়ারিং’ পড়িবার জন্য গ্লাসগো রওনা হইবে। মোটের উপর বিদ্যা, প্রতিপত্তি, অর্থ, সাজানো কথা এবং অঙ্গের সাজগোজ লইয়া ঈর্ষা-অভিনয়ের মধ্যে এখানে যে বায়ুমণ্ডল সৃষ্ট হয়, এক ধুতি-চাদর পরিহিত গৃহশিক্ষকের সেখানে স্থান নাই। আমি সেটা অনুভব করিয়াছি; বলিয়াই দুইবার কাটান দিয়াছি, পার্টিতে যাই নাই। এবার একেবারে নিজেদের বাড়িতে—উপায় ছিল না, তবু আশা ছিল বাহিরে বাহিরে ঘুরিয়াই কাটাইয়া দিব, কিন্তু পাকেচক্রে ধরা পড়িয়া গেলাম।
আজ আবার বিশেষভাবে আমি এড়াইতে চাহিতেছিলাম, তাহার কারণ সরমাঘটিত ব্যাপারটুকুর পর থেকেই মীরার হঠাৎ পরিবর্তন। মীরার চরিত্রের এই দিকটাকে আমি একটু ভয় করি। এই কয়দিন হতে মীরা কর্মচাঞ্চল্যের অনবধানতায় অল্প অল্প করিয়া আমার খুব কাছে আসিয়া পড়িয়াছিল। ওর এই খুবই কাছে আসাটাকে আমি যেমন প্রার্থনা করি, তেমনি আবার সন্দেহের চক্ষেও দেখি, —লক্ষ্য করিয়াছি মীরা জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে যখন খুব কাছে আসিয়া পড়ে তাহার পর হইতে অতি সামান্য একটা ঘটনাকে উপলক্ষ্য করিয়া—কখন বা উপলক্ষ্য না থাকিলেও ঝপ করিয়া দূরে সরিয়া যায়। এই সময় জাগে তাহার সেই নাসিকার কুঞ্চন। আমাদের দু-জনের দূরত্বটা—যাহা মীরাই মিটাইয়া আনে—আবার স্পষ্ট হইয়া উঠে।
নিশীথের পিছনে পিছনে চলিলাম। মীরা আলাপ-জিজ্ঞাসাবাদ করিতে করিতে যাইতেছে, নিশীথ কয়েক জনকে তাহার ‘হায়ার এঞ্জিনীয়ারিং’-এর জন্য গ্লাস্গো যাত্রার কথা বলিল! আমরা বাগানের শেষের দিকটায় গিয়া পড়িলাম। তিনখানি টেবিল একসঙ্গে করা, তাহার চারদিকে খান আষ্টেক চেয়ার। দেখিলাম নীরেশ, মৃগাঙ্ক প্রভৃতি মীরা-কেদ্রিকদের প্রায় সকলেই রহিয়াছে। আমরা পৌঁছিবার পূর্বেই দাঁড়াইয়া উঠিয়াছিল, অভ্যর্থনার একটা কাড়াকাড়ি পড়িল। নীরেশের বাম চোখে ফিতাবাঁধা একটা মনক্ল্ চশমা আঁটা; সেটা খুলিয়া ধীরে ধীরে লুফিতে লুফিতে মীরার পানে চাহিয়া বলিল, “আমরা এখানে খান-তিনেক টেব্ল্ একত্র ক’রে বেশ জমিয়ে বসব স্থির করলাম; কিন্তু কোন মতেই জমছে না দেখে তার কারণ খুঁজতে গিয়ে টের পেলাম এর প্রাণ-প্রতিষ্ঠাই হয়নি। যা মৃত তা জমাট বাঁধতে পারে, কিন্তু জমে না। অবশ্য আপনি ঘুরতে ঘুরতে একবার না একবার আসতেনই দয়া ক’রে, কিন্তু সেই অনিশ্চিত ‘একবারে’র জন্য ধৈর্য ধরে বসে থাকা অসম্ভব হ’য়ে উঠল বলে আপনাকে কাজের মধ্যে থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসবার জন্যে আমরা মিস্টার চৌধুরীকে পাঠালাম। এখন কি কি ক’রে যে মার্জনা চাইব বুঝতে পারছি না।”
বিলাতী কায়দায় ‘হিয়ার হিয়ার’ বলিয়া একটা সমর্থন হইল, কিছু বেশ বোঝা গেল কথাটা যেন সবার কণ্ঠে একটু বেশ আটকাইয়া বাহির হইয়াছে, বিশেষ করিয়া নিশীথের,—তাহার আপশোষ বোধ হয় এই জন্যে যে তাহাকে খুঁজিয়া-পাতিয়া আনিবার ভার দিয়া ইহারা দিব্য ততক্ষণ বসিয়া রুচিকর ভাষা গড়িয়াছে। তাহার মুখ-চোখের অবস্থা দেখিয়া সন্দেহ রহিল না যে সে ভব্য রকম একটা কিছু বলিবার জন্য ভিতর ভিতরে প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছে, কিন্তু পরের কথার প্রতিধ্বনি করা ভিন্ন অন্য শক্তি না থাকায় পারিয়া উঠিতেছে না।
দুইটা চেয়ার কম ছিল বলিয়া আমরা দাঁড়াইয়া ছিলাম, একজন ওয়েটার সংগ্রহ করিয়া আনিয়া পাতিয়া দিল।
চেয়ারে বসিতে বসিতে মীরা হাসিয়া বলিল, “এদিকে আমি কিছু বুঝতে পারছি না আপনারা ধন্যবাদের কাজ ক’রে উল্টে কেন মার্জনা চাইছেন।”
কথাটার অর্থ ধরিতে না পারিয়া সকলে জিজ্ঞাসুনেত্রে মীরার মুখের দিকে চাহিল। মীরা বলিল, “তা নয় তো কি বলুন?—ওদিকে থাকলে কিছুই যে কাজ করছি না সে হাতে হাতে ধরা পড়ে যেত; আপনাদের এই অনুগ্রহ ক’রে ডেকে নেওয়ায় বরং সবার মনে একটা ধারণা থেকে যাবে—বেচারিকে ওরা ডেকে নিলে তাই, নইলে যদি এদিকে থাকত, কাজ কাকে বলে একবার দেখিয়ে দিত।”
কথাটাতে, বিশেষ করিয়া চোখ পাকাইয়া ঈষৎ মাথা দুলাইয়া বলিবার ভঙ্গিতে, সবাই হাসিয়া উঠিল।
ওয়েটার ঘুরিতে ঘুরিতে আসিয়া চা-য়ের সরঞ্জাম লইয়া সামনে দাঁড়াইল, প্রশ্ন করিল “চা আর লাগবে কারুর?”
নিশীথ একটা কথা বলিবার সুযোগ পাইয়া যেন বর্তাইয়া গেল, বলিল, “না, চা একবার হয়ে গেছে।” তাহার পর একটা জুতসই কথা বলিতে পারিবার আনন্দে সবার মুখের উপর দৃষ্টি বুলাইয়া ঈষৎ হাস্যের সহিত বলিল, “এই দুর্লভ সময়টুকুর মধ্যে চা-কে প্রবেশ করতে দিতে মন সরে না; তাহ’লে এত যে মার্জনা চাওয়া চাওয়ির ব্যাপার, আমরা নিজেদেরই মার্জনা করতে পারব না।”
মীরা একটু বিব্রতভাবে নিশীথের দিকে চাহিয়া ফেলিয়া দৃষ্টি নত করিয়া প্রসঙ্গটা বদলাইবার জন্য কি একটা বলিতে যাইতেছিল, মৃগাঙ্ক বলিল, “আমার মত কিন্তু অন্য রকম, অবশ্য সেটা বলতে গেলে আগে মীরা দেবীর কাছ থেকে অভয় পাওয়া দরকার।”
মীরা লজ্জিতভাবে চক্ষু তুলিয়া বলিল, “আমার অভয় দেওয়ার ক্ষমতা আছে নাকি? কই, এ সম্পদের কথা তো জানতাম না!”
মৃগাঙ্ক উদ্ভব করিল, “জানেন না বলেই তো পাবার আশা করি। ধরুন, ফুলের গন্ধ আছে জানলে সে কি আর পাপড়ি খুলে সেটা ধরে বিলোতে পারত?”
সকলে আবার একটু মলিন হাসির সঙ্গে অনুমোদন করিল। ধোঁয়ার আড়ালে নিশীথের হাসিটা যে কত মলিন সেটা ঠিক বোঝা গেল না।
মীরা আবার লজ্জিতভাবে মাথা নীচু করিল, “বেশ, তাহলে আপনার কথামতই তো আমার না দেওয়ারই কথা অভয়,—ফুলকে যদি জানিয়ে দেওয়া হয় তার গন্ধ-সম্পদের কথা, কেনই বা বিলোতে যাবে?”
এ-সমস্যায় সকলেই চুপ করিয়া রহিল—উত্তর আমার ঠোঁটে আসিয়াছে; কিন্তু এ পরিবেষ্টনীতে আমার মুখ খোলা উচিত কিনা স্থির করিয়া উঠিতে পরিতেছিলাম না। শেষ পর্যন্ত কিন্তু প্রকাশের ইচ্ছাই জয়ী হইল; বলিলাম, “কৃপণ বলে বদনাম হওয়ার আশঙ্কা আছে তো?”
সকলে একটু চকিত হইয়া আমার মুখের পানে চাহিল। উত্তরটা ওদের পক্ষেরই, কিন্তু নবাগতের হঠাৎ প্রবেশটা উহারা সন্দেহের চক্ষে দেখিল। তবুও সমর্থন না করিয়া উপায় ছিল না, কাষ্ঠহাসির সহিত সবাই জড়াজড়ি করিয়া বলিল, “ঠিক, ঠিক বলেছেন উনি, বাঃ, কৃপণ হওয়ার একটা আশঙ্কা আছে তো?”
মীরা একেবারে বিজয়ের হাসি হাসিয়া উঠিল, বলিল, “চমৎকার! যে পরকে অভয় দেবে তার নিজেরই আশঙ্কা!”
সকলে আবার একচোট থ’ হইয়া গেল, কিন্তু উহারই মধ্যে খুশিও হইয়াছে, কেননা মীরা এই উত্তরটা আমায়ই দিয়াছে মুখ্যত। আমি প্রত্যুত্তর দিতে আরও খানিকটা সময় নিলাম, বুদ্ধির দৌড়ের পরীক্ষাও হইয়া থাক না একটু। নীরবতা কাটে না দেখিয়া অবশেষে বলিলাম, “কিন্তু এ আশঙ্কা যে অভয়েরই উল্টা দিক। তার কৃপণ হওয়ার আশঙ্কা আছে বলেই তো অভয়ের জন্য তার কাছে হাত পাততে যাই, যাচকের তো দাতার কাছে জোরই এইখানে। আর এই আশঙ্কা আছে বলেই তো দাতা ও মহৎ।”
সকলে আবার স্খলিত কণ্ঠে যোগ দিল, “বা ঠিকই তো…জোরই তো ঐখানে…আপনাকে কৃপণ বলা হবে—নেই এ-ভয়টা আপনার?”
মৃগাঙ্ক এই জয়-পরাজয়ের ব্যাপারটা চাপা দেওয়ার জন্যই যেন আলাদা করিয়া বলিল, “জোর বইকি, দিন অভয় এবার।”
মীরার স্তবের নেশা আসিয়া গিয়াছিল, স্তাবকের কাছে হারিয়াই তো আনন্দ; কি একটা মুগ্ধ ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে আমার পানে চকিতে চাহিল যেন বরমাল্যটা আমাকেই তুলিয়া দিল সে। মীরা সাধারণভাবে খোশামোদ ঘৃণা করে। এখানে সে সব নারী হইতেই স্বতন্ত্র, সে বিশিষ্টা। মনে পড়ে প্রথম দিন যখন আমি টুইশ্যনির জন্য তাহার সহিত দেখা করি, কি একটা কথায় আমার মুখে খোশামোদের ভাব ফুটিয়া উঠিতে দেখিয়া তাহার নাসিকা ঈষৎ কুঞ্চিত হইয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু সেই মীরাই আবার স্বয়ংবর সভায় সব নারীর সঙ্গে এক হইয়া যায়, পুষ্পবৃষ্টি হইলে সঞ্চয়ের জন্য আঁচল বাড়াইয়া ধরে। এখানে সে সাধারণ। … একটু অনুযোগের সুরে হাসিয়া বলিল, “আমার সঙ্গে এসে আপনি ঐদিকে হয়ে গেলেন? This is not fair” (এটা ন্যায়সঙ্গত হলো না)।
তাহার পর মৃগাঙ্কর পানে চাহিয়া বলিল, “আচ্ছা বলুন, আপনার মতটা কি?” লজ্জিত ভাবে ঘাড় কাত করিয়া হাসিয়া বলিল, “না হয় দেওয়াই গেল অভয়।” ব্যাপার ততক্ষণে অন্য রকম দাঁড়াইয়া গেছে;—আমার ওকালতিতে জিতিয়া স্বয়ংবরসভায় সকলের মনের অবস্থা এমন দাঁড়াইয়াছে যে অভয় যখন পাওয়া গেল তখন কি জন্য যে অভয় চাওয়া সেটা বিলকুলই ভুলিয়া বসিয়াছে। ওয়েটারও চা-য়ের সরঞ্জাম লইয়া চলিয়া যাওয়ায় মনে পড়িবার সম্ভাবনা আরও কম। মৃগাঙ্ক ব্যাকুলভাবে হাতড়াইতেছিল, আমি বলিলাম, “নিশীথবাবু দুর্লভ সময়টুকুর মধ্যে চা-য়ের প্রবেশ পছন্দ করছিলেন না, আপনি বললেন আপনার মত এই যে—”
মৃগাঙ্ক ঘাড় নাড়িয়া বলিয়া উঠিল, “ও ইয়েস, থ্যাংক ইউ, ঠিক, আমি বলছিলাম চা একবার হয়ে গেছে বটে কিন্তু লোভ বলে আমাদের একটা প্রবল রিপু আছে—যদি মীরা দেবীর ক্লেশ না হয় তো চা যদি আর একবার ওঁর হাতের রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করে তো সেটাকে অনধিকার-প্রবেশ না বলে বরং…”
সকলে উল্লাসিতভাবে সমর্থন করিয়া কথাটা আর শেষ হইতে দিল না। ওদের পক্ষে জয়যাত্রা আবার আরম্ভ হইয়াছে দেখিয়া নিশীথ পর্যন্ত নিজের পরাজয়ের কথা ভুলিয়া অকুণ্ঠভাবেই যোগদান করিল। ওয়েটারটা ততক্ষণে ওদিকে চলিয়া গিয়াছে, উৎসাহিত ভাবে চেয়ার ঠেলিয়া উঠিয়া বলিল, “আমি পাকড়াও ক’রে আনছি। চা পান না করিয়ে ওঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে নাকি?”
প্রতিধ্বনির জন্য ওর কণ্ঠ চুলকাইয়া উঠিয়াছে। এই আগেই দেওয়া নিজের অভিমতটা চা-কে প্রবেশ করিতে না দেওয়ার কথাটা—আর কি মনে থাকিতে পারে?